রাতে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়েছিলাম। সকাল বেলা আবারও ঝগড়া হয়, একপর্যায়ে সে আমাকে একটা থাপ্পড় মেরে বসে। আমি চুপচাপ অফিসে চলে যাই৷ চার বছরের সংসার জীবনে এরকম কষ্ট আমার কখনো হয়নি। মা-বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছি, স্বামী হিসেবে তিনি যথেষ্ট ভালো ছিলেন।
অফিসে এসে আমি কোনভাবেই কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। তাজুলের মুখে রাতে অমন বিশ্রী কথাবার্তা শুনে আমি বাকরূদ্ধ। তাছাড়া সে আমার গায়ে হাত তুলবে এটা তো আমার কল্পনাতেই ছিল না।
দুপুর পর্যন্ত শুধু ভাবনাতেই কেটে গেল। অফিসের ক্যান্টিনে খেয়ে নিলাম। বেশ কিছু অভিজ্ঞতা এই প্রথমবার হচ্ছে।
স্বামীর হাতে প্রথম চড় ছাওয়া।
রাগ করে খাওয়া বন্ধ করা।
সকালে উঠে রান্না না করা।
অফিসে খাবার না নিয়ে আসা।
দুপুর ২:৪০ PM
রিসিপশন ডেস্ক থেকে টেলিফোনে কল দিয়ে বললো " আপা আপনার সঙ্গে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছে। "
রিসিপশনের বলা সেই ভদ্রলোক তাজুল ছাড়া আর কেউ নয়। তাজুল আমার অফিসে কোনদিন আসেনি। তার এই অফিসে আসাটাও আজ প্রথম। প্রথমবারের ঘটনা ঘটার রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। তাজুল আমার রুমের মধ্যে এলো। তাকে দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না।
ঘেমে জবজবে শরীর, চেহারার মধ্যে মারাত্মক চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। ঝগড়ার কারণে অনুতপ্ত হয়ে এরকম করার কথা নয়। তারমানে অন্য কিছু ঘটনা আছে, কিন্তু সেটা কি? কি এমন হতে পারে যার কারণে এতটা চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছে।
" বললাম, কি হয়েছে? এভাবে ঘামছো কেন? আর তুমি এ সময় তোমার অফিসে না গিয়ে এখানে কি করো? "
" একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে মিতু। "
" কি হয়েছে? "
রাতের আর সকালের সবকিছু ভুলে আমি তাজুলের দিকে স্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে রইলাম।
" আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। বিশ্বাস করো আমার কোনো দোষ নেই। আমি কিছু করিনি! "
" ভালো করে বলো কি হয়েছে? তুমি কি রাতের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে এসেছ? যদি তাই হয় তাহলে এসব নিয়ে আমরা বাসায় গিয়ে কথা বলতে পারবো। "
" না! রাতের বিষয় কিছু না। "
" তাহলে কি হয়েছে ভালো করে বলো? "
" আমি লাঞ্চ করতে বাসায় গেছিলাম। "
আমাদের বাসা থেকে মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে হেঁটে হেঁটে তাজুলের অফিসে যাওয়া যায়। আমরা সেক্টরের বাইরে তবে ওর অফিস সেক্টরের মধ্যে। বাসা থেকে বের হয়ে রেললাইন পার হলেই ওর অফিস।
যখন আমি চাকরি করতাম না তখন নিজের অফিসের কাছেই বাসা নিয়েছিল তাজুল। বছর খানিক আগে আমি যখন চাকরি নিলাম তখন দেখা গেল আমার অফিস দুরে। কিন্তু সুবিধা হচ্ছে অফিসের গাড়ি আছে। তাই আমার যাতায়াতের অসুবিধা হবে না মোটেই। সুতরাং বাসা আর পরিবর্তন করা হয়নি। প্রতিদিন আমি বাসা থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে আসি কিন্তু তাজুল লাঞ্চ টাইমে বাসায় গিয়ে খায়।
বললাম " আমি তো সকালে রান্না করিনি তাহলে বাসায় গেলে কেন জানতে পারি? "
" তোমার মোবাইল আজকে বাসায় রেখে আসছো তাই না? "
" হ্যাঁ। কিন্তু কি হয়েছে সেটা বলো না কেন? "
" বারোটার দিকে আফরিন আমার কাছে কল করেছিল। "
আমি চমকে গেলাম। আফরিন মাত্র দুদিন আগে আমাদের বাসায় এসেছিল। আফরিন আমার ছোটবোন। আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট আর ওর এখনো বিয়ে হয়নি। মাঝে মাঝেই সে চলে আসে আমাদের কাছে। কিন্তু তাই বলে সপ্তাহের মধ্যে দুবার চলে আসবে ভাবিনি। কারণ কি?
বললাম " আফরিন কল দিয়ে কি বলেছে? "
" আমাকে বললো যে, দুলাভাই আপা তো কল রিসিভ করে না। আমি তো আপনাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷ "
আমরা থাকি উত্তরা! আমার মা-বাবা সবাই মিলে থাকে ধানমন্ডি। যেহেতু আফরিন এভাবে হুট করে কখনো আসে না। তাই সন্দেহ হচ্ছে তাজুল হয়তো কল দিয়ে ওকে আসতে বলেছে। নিশ্চই আমার রাগের কথা বলে ওকে নিয়ে এসেছি ওকালতি করতে।
বললাম " আফরিনকে আমাদের ঝগড়ার কথা বলতে গেলে কেন? "
" আমি তো বলিনি কিছু। সে আমাকে হঠাৎ কল দিয়ে বললো যে সে বাসার সামনে। আমি তাকে আমার অফিসের সামনে যেতে বলি। তারপর আফরিন অফিসের সামনে গেল। আমি ওকে বাসার চাবি দিলাম। আফরিন বাসায় চলে গেল। যাবার সময় শুধু বললাম,
" তোমার আপার সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে তাই সকালে রান্না হয়নি। "
আফরিন বললো " ঠিক আছে দুলাভাই, আমি তাহলে বাসায় গিয়ে রান্না করে রাখবো। আপনি খেতে চলে আসবেন দুপুরে। "
তখন আমি বললাম, " সমস্যা নেই তুমি রান্না করে খেয়ে নিও। আমি বরং আজ হোটেলে খাবো। "
ও বললো " তা কি করে হয় দুলাভাই। আপনার অফিস থেকে তো কাছেই। আপনি বাসায় চলে যাবেন। "
একটু থেমে তাজুল আবার বললো, দেড়টার দিকে আমি অফিস থেকে বের হলাম। কারণ এর আগে তিনবার কল করেছে। রেললাইন পার হয়ে আমি আফরিনের নাম্বারে কল দিলাম। আফরিন কল রিসিভ করলো না। রেললাইনের পাশের বাজার থেকে দুই কেজি দই কিনে বাসায় গেলাম। তুমি পরশু বলেছিলে দই কিনতে।
আফরিন তখন একটা মেসেজ দিয়ে বললো " কল দিতে হবে না, আপনি চলে আসেন। "
বাসায় গিয়ে দেখি ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। আমি আস্তে আস্তে ভিতরে প্রবেশ করি। আফরিনের নাম ধরে ডাকতে থাকি কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। দিনের মধ্যেও কেন জানি ভয় করতে লাগলো। এমন তো হবার কথা নয়। তারপর আমাদের রুমের মধ্যে গিয়ে দেখি.....
তাজুল থেমে গেল, ওর চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে আরও। আমি ধৈর্য ধরতে না পেরে বললাম,
" আমাদের রুমের মধ্যে কি হয়েছে? "
" আমি বলতে পারবো না তুমি আমার সঙ্গে চলো এখনই। বাসায় গিয়ে দেখবে। "
" ন্যাকামি করো না তো, বলো কি হয়েছে। "
" আমাদের বিছানার উপর আফরিনের লাশ পড়ে আছে। ওর ওড়না দিয়েই ওকে ফাঁস দেওয়া হয়েছে। চোখ গুলো এখনো খোলা। "
তাজুল কাঁপছে, আমার শরীরও তখন কাঁপা শুরু করেছে। আমি অস্পষ্ট গলায় বললাম " আফরিন এর কি হয়েছে বললা? "
তাজুল আমার হাতটা টেবিলের উপরে ধরেই বললো " মিতু বিশ্বাস করো আমি কিছু জানি না। আমি শুধু ওকে চাবি দিয়ে দিছিলাম। কিন্তু আমি বাসায় যাবার আগেই কেউ হয়তো আমাদের বাসায় গিয়ে ওকে খু!ন করেছে। "
আমার দম বন্ধ লাগছিল, তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠে গেলাম। কাউকে কিছু না বলে অফিস থেকে বের হলাম। তাজুল আমার পিছনে পিছনে আসছে আর বলছে " আমি এখনো কাউকে কিছু বলিনি। বিশ্বাস করো খুব ভয় লাগছে। আমি রুমের মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে সরাসরি তোমার কাছে এসেছি। "
একটা সিএনজি নিয়ে আমরা দুজনেই একসঙ্গে বাসায় এলাম। দারোয়ান আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললো " ভাবি আপনাকে এমন লাগছে কেন? আর এমন সময় আপনি বাসায়। কোথাও কিছু হয়েছে নাকি? "
ফ্ল্যাটের মধ্যে এসে আমাদের রুমের মধ্যে দেখি সত্যি সত্যি আমার বোনটা চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেছে। না না কেউ একজন ওকে ঘুম পারিয়ে দিয়েছে। তাজুল নিচ থেকে আসার সময় দারোয়ানকে বলেছিল বাড়িওয়ালাকে আমাদের বাসায় পাঠাতে।
একটু পরেই সদর দরজায় বাড়িওয়ালার কণ্ঠের আওয়াজ শোনা গেল। তাজুল তাকে বেডরুমে নিয়ে এলো। আমি তখন ফ্লোরে বসে আছি। কোনকিছু বলার মতো ভাষা আমার মুখ থেকে হারিয়ে গেছে।
বাড়িওয়ালা তখন তাজুলের কাছে কি কি হয়েছে সব শুনতে শুনতে পুলিশের কাছে কল করে। ধানমন্ডিতে মা-বাবার কাছে খবর দেওয়া হলো। আপন ছোটবোনের এমন লাশ দেখে একসময় আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমার চারিদিকে অনেক মানুষ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সামনেই তাজুল দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু ওর হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো।
ওসি সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন " আপনি কি এখন ঠিক আছেন? "
আমি কিছু না বলে তাকিয়ে রইলাম। ওসি সাহেব আবার বললেন " আমরা ঘটনার প্রাথমিক কিছু কথাবার্তা শুনলাম। বাসার দারোয়ানের বর্ননা আর ফ্ল্যাটের পরিস্থিতি দেখে আপাতত আপনার স্বামীকে আমরা সন্দেহ করছি। আপনার বোনের লাশ পোস্টমর্টেম করতে পাঠানো হয়েছে।
আপনার স্বামীর সঙ্গে কখন দেখা হয়েছে আর সে আপনার কাছে কি কি বলছে সেগুলো একটু বলবেন? আর আপনার সন্দেহের তালিকায় আর কেউ আছে নাকি? থাকলে বলেন।
আমি তাজুলের দিকে তাকিয়ে আছি। অসহায় দৃষ্টিতে তাজুল আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি একটু একটু করে সব বললাম পুলিশের কাছে। তারপর পুলিশ তাজুলকে থানায় নিয়ে গেল। বাবা পুলিশের কাছে মামলা করে এলো৷
↓
↓
খালি কফির কাপটা হাতে নিয়ে সাজু ভাই বসে আছে। কফি খেতে খেতে মিতুর কাছ থেকে এতক্ষণ ধরে সবকিছু শুনছিলেন তিনি। গতকাল খুনের ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে সাজু গিয়েছে থানায়। তারপর গিয়েছে তাজুলের অফিসে। সেখান থেকে মিতুর অফিসে গিয়ে তারপর এসেছে বাসায়।
সাজু ভাই বললেন " সবকিছুই তো বললেন মিসেস মিতু। বাট চার বছরের মধ্যে প্রথম ঝগড়া কেন হয়েছে সেটা তো বললেন না। "
মিতু বললো " সেরকম বড় কোনো বিষয় না। "
" আরেকটা প্রশ্ন, আপনি বলেছেন আপনি অফিস ক্যান্টন থেকে দুপুরে লাঞ্চ করেছেন। কিন্তু আমি খবর নিয়ে এলাম যে আপনি লাঞ্চের সময় অফিস থেকে বের হয়েছিলেন। এবং প্রায় দেড় ঘন্টা পরে অফিসে প্রবেশ করেছেন। "
মিতু চুপ করে রইল। সাজু বললো " কোথায় ছিলেন সত্যিটা ভালো করে ভাবুন, আমি বরং ততক্ষণে রান্না ঘরে গিয়ে ঘুরে আসি। আপনার বোন গতকাল কি কি রান্না করেছে সেটা তো দেখা দরকার তাই না? রান্না করতে পেরেছে নাকি তার আগেই খু!ন হয়েছে সেটা বরং দেখে আসি। "
মিতু খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সাজু তার সেই চিরচেনা গম্ভীরতার মধ্যে ঠোঁটের আগায় হাসি দিয়ে
রান্না ঘরে গেল। পুলিশ গতকালই সবকিছু দেখে গেছে একবার। সাজু চারিদিকে তাকিয়ে অবশেষে ফ্রিজটা খুলে ভিতরে উঁকি দিল। অবাক হয়ে পাঁচ মিনিটের মতো তাকিয়ে থেকে আবার মিতুর কাছে এসে বললো,
" আপনার স্বামীকে না নিয়ে পুলিশ আপনাকে ধরে নিয়ে গেলেই বেশি ভালো হতো। "
বিশ্বাস_অবিশ্বাস! [ সাজু ভাই সিরিজ ]
পর্ব:- ০২
মিতু বললো " আমাকে পুলিশ কেন ধরবে? আমি তো কিছু করিনি, সবকিছুই আমার অগোচরে হয়ে গেছে। "
সাজু ভাই বললেন " এবার বলেন লাঞ্চ টাইমে আপনি কোথায় ছিলেন? অফিস থেকে আপনি ১২:৩৫ মিনিটে বের হয়েছেন আর অফিসে প্রবেশ করেছেন ০২:০৪ মিনিটে! এটা আপনাদের অফিসের গেইটের সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত তথ্য। "
মিতু মাথা নিচু করে বসে রইল। সাজু ঘরের মধ্যে চারিদিকে তাকাচ্ছে। মিতুর মা-বাবা, এক মামা, আরো চার পাঁচজনের উপস্থিতি এখানে। সকালে চুপচাপ তবে মিতুর কাছ থেকে উত্তর শোনার অপেক্ষা করছে।
সাজু বললো " আপনি উত্তর দিলে তারপর আমি কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্ন শুরু করবো। "
" আমার অফিস কলিগের সাথে বাইরে ছিলাম। "
" তার নাম কি ফয়সাল? "
" জ্বি, আপনি কীভাবে জানেন? "
" জানবো না কেন? সকাল বেলা যেহেতু আমি আপনার অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছি। সুতরাং এতটুকু কথা জানা খুব বেশি আশ্চর্য নয়। "
" না কিছু না। আসলে আমি সারাক্ষণ কাজের মধ্যে অমনোযোগী থাকার কারণে ফয়সাল সাহেব আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করে। মন খারাপ কেন এটা জানার জন্য তিনি ব্যাকুল ছিলেন। আমি বলেছি যে বাসায় সামান্য রাগারাগি হয়েছে। "
" তারপর? "
" আমাদের অফিসে বারোটা থেকে লাঞ্চের সময় শুরু হয়। ফয়সাল সাহেব সবসময়ই ক্যান্টিনে লাঞ্চ করতেন। আমি খাবার নেইনি শুনে তিনি তার সঙ্গে খাবার খেতে অনুরোধ করে। তারপর আমরা দুজন মিলে ক্যান্টিনে না গিয়ে বাহিরে যাই। অফিস থেকে বের হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে লাঞ্চ করি। "
" সেই রেস্টুরেন্ট অফিস থেকে কতদূর? মানে আসা-যাওয়া কতক্ষণ সময় লাগে? "
" তা ধরুন, পনের পনের ত্রিশ মিনিট। "
" সবকিছু সত্যি বলেন কারণ আমি সবকিছু কিন্তু যাচাই করবো। "
" সত্যিই বললাম। সেখানে গিয়ে দুজনে খাবার খেলাম, তারপর কফি খেলাম। এরপর কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে অফিসে গেলাম। আসলে আপনি ভুল বুঝবেন না, আমি সকাল থেকে মানসিক যে চিন্তার মধ্যে ছিলাম সেটা দুর করার জন্য আমি এটা করেছিলাম। "
" আপনি বাসায় আসেননি তাই তো? "
" কখনোই নয়, আপনি আমাদের বাসার যিনি দারোয়ান তাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। নিচে গেইটে সিসি ক্যামেরা আছে সেটাও চেক করতে পারেন। আমি সকালে অফিসে যাবার পরে আর একা একা বাসায় আসিনি। তাজুল আমাকে নিয়ে আসার পর একসঙ্গে এসেছি। "
সাজু আর কিছু বললো না। ঝগড়ার বিষয় নিয়ে সে সরাসরি তাজুলের সঙ্গে কথা বলতে চায়। সাজু মিতুর মা-বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মিতুর বাবা সাজুর চোখে চোখ রেখে বললো,
" আমার এতো সুন্দর মেয়েটাকে কেন এভাবে মেরে ফেললো বাবা? "
" আঙ্কেল আমি একটু আপনাদের দুজনের সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চাই। আপনারা কি দুজন মিলে পাশের রুমে আসবেন? "
" ঠিক আছে বাবা। "
এই রুমটায় শুধু একটা খাট আছে। আফরিন বা যেকোনো আত্মীয় স্বজনরা বেড়াতে এলে সম্ভবত এই রুমে থাকতেন। সাজু ভাই বললেন,
" আঙ্কেল আপনার মেয়ের উপর থেকে আমার সন্দেহ দুর হচ্ছে না। মিতু ও আফরিন এই দুই বোনের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ছিল? "
" খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, ওদের তো কখনো তেমন ঝগড়া হতো না। বরং বাসায় আমি যখন পড়াশোনার কিছু বলতাম তখন আফরিন বলতো যে আপুর কাছে চলে যাবো। তোমরা একটুও শান্তিতে থাকতে দাও না। "
মিতুর মা তখন ফুপিয়ে কেঁদে বললো " এবার ওকে চিরদিনের মতো শান্তিতে থাকতে দিল। "
সাজু বললো " আপনার তো শুধু দুটো মেয়ে। এদের নামে কোনো আলাদা একাউন্ট আছে? "
" হ্যাঁ আছে, গ্রামের বাড়িতে বাজারের মধ্যে অনেক বড় একটা জমি ছিল আমাদের। জমিটা বিক্রি করতে হয়েছিল। জমি বিক্রির পুরো টাকা আমি আমার দুই মেয়ের একাউন্টে সমানভাবে ভাগ করে দেই। "
" পরিমাণ কতো? "
" ত্রিশ লাখ টাকা, মিতুর পনের লাখ এবং ছোট মেয়ে আফরিনের পনের লাখ। তবে মিতুর টাকা নেই, কোনো এক এনজিও না কিসে যেন সবগুলো টাকা সে জমা করেছিল বেশি লোভের আশায়। আমি অবশ্য জানতাম না। সেই এনজিও দেশ থেকে চলে গেছে, মিতুর সম্পুর্ণ টাকাটাই শেষ হয়ে গেছে। "
" তাদের দুজনের একাউন্টে নমিনি কে কে ছিল? মানে যদি কেউ মারা যায় তাহলে তার সেই টাকা কে তুলবে? "
" মিতুর নমিনি আফরিন আর আফরিনের নমিনি মিতু ছিল। যেহেতু এরা দুই বোন তাই কেউ যদি মারা যায় তাহলে তার টাকা যেন অপর বোন পায় সেজন্যই এই ব্যবস্থা করেছিলাম। "
" আপনার কি মনে হয় যে সেই টাকার জন্য মিতু আফরিনকে হত্যা করেছে? আর নিজের কাঁধে দোষ যেন না পড়ে সেজন্য স্বামীর উপর দোষ দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। "
" এসব তুমি কি বলছো বাবা? "
" আঙ্কেল, ওসি সাহেব আমাকে বলেছিলেন যে আপনার বড় মেয়ের জামাই সম্ভবত ছোট মেয়ের সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কে ছিল। হয়তো এসব নিয়েই কিছু একটা হয়েছে তাই তাজুল সাহেব আফরিন কে খু!ন করেছে। "
" এটা হতে পারে না। আফরিন এরকম মেয়ে নয়। তাছাড়া ওর পছন্দের একটা ছেলে আছে। আমি অবশ্য সেই ছেলের পরিচয় জানি না। "
" তাহলে কি এরকম কিছু হতে পারে যে আফরিন চাবি নিয়ে বাসায় তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে এসেছে। তার সঙ্গে আপা দুলাভাইয়ের বাসায় একান্তই নিরিবিলিতে কিছুক্ষণ গল্প করেছে। "
মিতুর মা বললো " আমার মেয়েটা গতকাল মারা গেল, এখনো তার দাফন হলো না। আর আপনি এসব কি বলেন? "
সাজু চুপ করে গেল। বললো " আমি সত্যিই দুঃখিত আন্টি। আসলে সম্ভবনা করতে গিয়ে অনেক কিছু বলতে হয় আমাদের। "
দুই মিনিটের মতো কিছু একটা ভাবতে লাগলো সাজু ভাই। তারপর মিতুর মা-বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
" আমি আপাতত চলে যাচ্ছি। দেখি বাসার নিচে দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলি। তাছাড়া আরেকবার একটু থানায় যেতে হবে তাজুল সাহেবের সাথে কথা বলতে। "
মিতুর বাবা বললো " বড়জামাই ই আমার মেয়েকে খু!ন করেছে। হয়তো সে জোর করে আমার মেয়ের সঙ্গে খারাপ কিছু করতে চেয়েছে। "
" তারপর আফরিন রাজি হয়নি। বরং তাজুলকে উল্টো হু!মকি দিয়ে বলেছে সে তার আপুকে সব বলে দেবে। তাই নিজের ইজ্জতের জন্য তাজুল খুন করেছে, তাই তো? "
" জ্বি এটাই হবে। আপনারা ওকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করুন দেখবেন সব স্বীকার করবে। "
" ঠিক আছে, দেখি পুলিশ কি করে। "
সাজু বের হয়ে গেল। ড্রইং রুমে বাড়িওয়ালা বসে আছে চুপচাপ। বেচারা পড়েছে বিপদে। এলাকায় হয়তো আফরিনের হ!ত্যাকা!ণ্ডের ঘটনা প্রচার হচ্ছে।
সাজুকে দেখে বাড়িওয়ালা বললো " তেমন কিছু বের করতে পারলেন বাবাজী? "
" নাহ আঙ্কেল, তবে আমরা চেষ্টা করছি। "
" পুলিশ এবং আপনারা একটু তাড়াতাড়ি করেন দয়া করে। মানসম্মান যা যাবার তা তো গেছেই। এখন যত তাড়াতাড়ি আসল অপরাধী ধরা না পরে ততদিন আমি শান্তিতে থাকতে পারবো না। "
" আমি একটু আপনার দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলতে চাই। "
" চলুন এক্ষুনি নিয়ে যাচ্ছি। "
তিনতলা থেকে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বাড়ির মালিক বললো " রাস্তার অলিতে-গলিতে চায়ের দোকানে সবাই আমার নাম ধরে ধরে বলে " সিদ্দিক সরকারের বাড়িতে একটা মেয়ে খু!ন হয়েছে। "
" আজ সকালে এখানকার একটা পত্রিকার মধ্যে নিউজটা এসেছে দেখলাম। সেখানেও লেখা ছিল ' খুন হওয়া মৃত আফরিনের বোন দুলাভাই অত্র এলাকার সিদ্দিক সরকারের বাড়িতে ভাড়ায় থাকতো। "
" এবার বলেন তো কতটা টেনশনে আছি। এই বাসা এখন মানুষ ভাড়া নিতেই ভয় পাবে। বলবে বাড়ির কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। অথচ আপনি দেখেন সেক্টরের মধ্যে যেরকম সুযোগ সুবিধা সেরকম সবকিছু আছে আমার বাড়িতে। "
ভদ্রলোকের কষ্ট পাওয়া স্বাভাবিক। এতকিছু যখন ঘটে গেছে তখন আর কি করার। কিন্তু তিনি চান দ্রুত এই মামলা শেষ হোক। তার বাকি যেসব ভাড়াটিয়া আছে তারা নিশ্চিত হোক। নাহলে যদি এরকম সকাল বিকাল পুলিশ আসে তাহলে তো সবাই বিভ্রান্ত হয়ে যাবে।
দারোয়ানের বয়স ত্রিশের মধ্যেই। পরিশ্রম আর দারিদ্র্যের জীবনে চেহারায় বয়সের তুলনায় বেশি মনে হচ্ছে। সিদ্দিক সরকার তাকে ডাক দিতেই সে দৌড়ে এলো।
সরকার বললো " তিনি যা যা জিজ্ঞেস করবেন সবকিছুর ঠিক ঠিক উত্তর দিবি। কোনকিছু গোপন করার চেষ্টা করবি না রফিক। "
" ঠিক আছে স্যার। "
নিচতলা পুরোটাই ফাঁকা। গাড়ি পার্কিং করার জন্য এভাবে ফাঁকা রাখা হয়েছে। সিসি ক্যামেরা সেট করা হয়েছে গেইটের ভিতরে। লিফটের জন্য যায়গা রাখা আছে কিন্তু বাস্তবায়নাধীন। হয়তো ভবিষ্যতে লিফট লাগানো হবে।
সাজু বললো " আপনি একদমই বিচলিত হবেন না রফিক ভাই। আমি শুধু নরমাল কিছু প্রশ্ন করে চলে যাবো। ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। "
" আপনাকে দেখে ভয় লাগে না স্যার। গতকাল পুলিশ দেখে বহুত ভয় পাইছি। তারা যখন বারবার জিজ্ঞেস করছে তখনও ভয় পাইছি। কিন্তু আপনি একটু আলাদা। "
" তাজুল সাহেবের স্ত্রীর ছোটবোন গতকাল এই বাসার সামনে কখন আসেন? "
" বারোটার দিকে স্যার। প্রথমে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি বললাম যে ভিতরে আসেন। সে বলে তার কাছে চাবি নাই, আর তার আপা কল রিসিভ করে না। "
" তারপর? "
" তারপর এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাজুল স্যারের কাছে কল দিল। কথা শেষ করে আমাকে বলেন আমি দুলাভাইর কাছ থেকে চাবি নিয়ে আসি। "
" আপনি তো তাকে আগে থেকে চিনতেন? "
" হ্যাঁ চিনি তো, এই বাসায় আগে অনেকবার তো আসছিল। আহারে, আজ থেকে আর আসবে না। মানুষের জীবন কিছুই না, মরলেই শেষ। "
" তারপর কি হলো? "
" আধা ঘণ্টা পরে চাবি নিয়ে ফিরেছে। মোবাইলে কথা বলতে বলতে উপরে চলে গেছে। "
" কিরকম কথাবার্তা সেটা কি মনে আছে? "
" স্যার আমার মনে নাই। তবে কিছুটা কথা হয়তো সিসি ক্যামেরায় রেকর্ড আছে। আমাদের এই ক্যামেরায় ভিডিও অডিও দুটোই রেকর্ড হয়। "
" ঠিক আছে সেটা চেক করবো। তাজুল সাহেব অফিস থেকে কখন এসেছে? আর সে আসার আগ পর্যন্ত অপরিচিত কেউ কি এসেছে? "
" অপরিচিত কেউ আসে নাই স্যার। যারাই আসা যাওয়া করেছে সবাই এই বিল্ডিংয়ের মানুষ। "
সাজু আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। সিদ্দিক সরকারের সঙ্গে সিসি টিভি ফুটেজ চেক করতে চলে গেলেন। সবকিছু দেখে নতুন কিছুই পাওয়া গেল না। শুধু আফরিনের কথা ছাড়া।
আফরিন মোবাইলে কথা বলতে বলতে যখন ক্যামেরার কাছাকাছি অবস্থান করছিল তখন মোবাইলে কার কাছে যে বলছিলেন,
" তুমি তো জানো আমি এক কথার মানুষ। আমি বাসা থেকে আপার বাসায় চলে এসেছি। বিকেলে তোমার সঙ্গে জসীমউদ্দিন মোড়ে বিএফসি তে দেখা হবে। "
এমন সময় সাজুর মোবাইলে কল আসে। কল দিয়েছে সাজুর সেই পরিচিত বড়ভাই হাসান।
'' বলেন ভাই। "
" সাজু আমি তো তোমাকে কথামতো পোস্টমর্টেম করা সেই ডাক্তারের কাছে কল দিছিলাম। কিন্তু তার একটা কথা শুনে আমি বেশ চিন্তা করছি। "
" কি কথা? "
" আফরিন তো অবিবাহিতা তাই না? "
" জ্বি, তার এখনো বিয়ে হয়নি। "
" গতকাল আফরিন মারা যাবার আগে সে সহবাস করেছে। "
" মানে ধ!র্ষ!ন? "
" ধ!র্ষ!ন নাকি স্বেচ্ছায় যৌ!ন মিলন সেটা তো জানি না। তবে আমার মনে হচ্ছে আফরিনের সম্মতিতে ঘটনাটা ঘটেছে। কারণ তোমার কাছে গতকাল রাতে আফরিনের লা!শের এবং রুমের যেসব ছবি দেখেছি। সেগুলো দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না যে তাকে জোর করা হয়েছে। "
" যদি এমন হয় যে তাকে অজ্ঞান করা হয়েছে? "
" একটা কথা বলি সাজু? "
" বলেন ভাই। "
" তুমি মেয়েটার দুলাভাইকে ভালো করে জিজ্ঞেস করো। সে নিশ্চয়ই কিছু লুকচ্ছে। এছাড়া কিন্তু আর কোনো রাস্তা পাচ্ছি না। সন্দেহের তীর সবটা ওই লোকটার উপর। তোমার মতে, আফরিনের বোন মিতু অপরাধী হতে পারে। কিন্তু আমি এখানে মিতুকে সন্দেহ করার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না। "
" ঠিক আছে ভাই, তাহলে আমি থানায় গিয়ে তাজুল সাহেবের সাথে ভালো করে কথা বলি। "
" আচ্ছা যাও, আর কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। যদি কাজ শেষ নাহয় তাহলে এক ফাঁকে এসে খেয়ে যাও। তোমার ভাবি তো শুধু বারবার বকা দিচ্ছে আমাকে। "
" ঠিক আছে ভাই। আর ওই ডাক্তারের কাছ থেকে এরকম একটা খবর বের করে দেবার জন্য মেলা মেলা ধন্যবাদ আপনাকে। "
↓
↓
হাসান সাহেবের সাথে কথা বলার সময় সাজুর নাম্বারে দুবার আরেকটা নাম্বার দিয়ে কল এসেছে। সাজু হাসানের সঙ্গে কথা শেষ করে সেই নাম্বারে কলব্যাক করলো। অপরপ্রান্ত থেকে একটা ছেলে বললো,
" সাজু ভাই বলছেন? "
" হ্যাঁ বলছি, কে আপনি? "
" আফরিন খুনের মামলা নিয়ে এতো জল ঘোলা করার জন্য কেন এসেছেন? পুলিশ তার দুলাভাই কে গ্রেপ্তারের করেছে। সকল তদন্ত পুলিশের উপর ছেড়ে দিন না। শুধু শুধু নিজের বিপদ যমের কাছ থেকে ডেকে আনবেন না। "
" আপনার পরিচয়? "
" পুলিশ যাকে ধরে নিয়ে গেছে তাকে নিয়েই তাদের খেলা খেলতে দিন। আপনাকে সামান্য সাবধান করে দিলাম। "
সাজু বললো, " আপনার কণ্ঠটা পরিচিত মনে হচ্ছে। আচ্ছা আপনি কি মিতুর কলিগ ফয়সাল সাহেব? যার সঙ্গে সকাল বেলা মিতুর অফিসে গিয়ে কথা হয়েছিল। "
চলবে...
লেখা:- মোঃ সাইফুল ইসলাম (সাইফ)