দেখতে দেখতে আট মাস কেটে গেল আমার স্বামী ফয়সাল না ফেরার দেশে চলে গেছে,আমাকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে আর আমাদের মেয়েকে এতিম করে।
ভাইয়ের মেয়ে রিমিকে স্কুল থেকে নিয়ে বাসার গেইটের কাছে পৌঁছে দিয়ে ছুটলাম বাজারে। স্কুলে যাওয়ার সময় হেঁটে যেতে হয়, আসার সময় রিকশায় আসি। এখন বাজারে যাচ্ছি হেঁটেই।আমাকে টাকা দেয়া হয় খুব হিসেব করে।ভাবি বলে,' রাস্তা তো খুব বেশি না। অপ্রয়োজনে টাকা খরচ করা একদম উচিত না।যাওয়ার সময় খুব একটা কষ্ট না হলেও বাজার করে ফেরার পথে খুব কষ্ট হয় আমার। সবচেয়ে অপমান জনক ব্যপার যেটা তা হলো,সব হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেয়ার পরেও আমার দিকে ভাবির সন্দেহের চোখে তাকানো। কিছু না বলে শুধু কঠিন চোখে তাকাই তখন।তখন সে বলে ,'না মানে তোমাকে দোকানিরা ঠকালো কিনা তাই ভালোভাবে হিসাব করি।আমি মনে মনে হাসি তখন,কথা বাড়াই না।'
খুব দ্রুত কেনাকাটা করে, বাসার রাস্তায় হাঁটা ধরলাম।এত ওজন নিয়ে হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে।আজ রোদের তেজ খুব বেশি যেন,ঘেমে কাপড় গায়ের সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। ফয়সাল সাথে গেলে কখনো আমাকে একটা প্যাকেট ও বহন করতে দিত না। আমার একটু ও যেন কষ্ট না হয় সবসময় সেই চেষ্টা করতো।আহ্ ফয়সাল। বুকের ভিতরে কেমন করে উঠলো। তুমি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?তুমি তো আমাকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে, নিজে খুব সুখে আছ।এই আট মাসে তোমার কুমকুমের কি অবস্থা হলো দেখ,সামনে আরো কত পথ বাকি!তোমাকে মনে করে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যায় , এখন যদি রাস্তা না দেখতে পেরে উল্টে পড়ে যাই - সব দোষ কিন্তু তোমার।
বাসায় পৌঁছার পর ভাবি এসে বলল-
---এত দেরি করলে ?রান্না কখন হবে বলতো।আম্মার ঔষধ খাওয়ার সময় পার হয়ে যাবে তো।
---ভাবি, ফারিন কিছু খেয়েছে?
---ওকে তো রুটি সেই কখন দিয়েছি।
ভাবি আমার খুব বুদ্ধিমতি।সংসারের দায়-দায়িত্ব আস্তে আস্তে একটা একটা করে আমার ঘাড়ে চাপিয়েছে আর সব অজুহাত আমার আম্মা, আমার ভাই, আমার ভাতিজির প্রয়োজন। আসলেই তো আমারই তো সব,সবাই আমার কিন্তু আমি যে কার এই হিসাব এখন আর মেলাতে পারি না।
এই রুম আগে স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার হতো। এখন আমার আর আমার মেয়ের রাজ্য গড়ে তুলেছি এই ছোট্ট রুমটাতে। আমাদের জন্য এর চেয়ে বেশি জায়গার দরকার নেই,এটা ভাবির কথা।আরেকটা রুম যে খালি পরে থাকে, মেহমান আসলে সেখানে তো থাকতে দিতে হয়।ভাবির বাবার বাড়ির মেহমানদের তো আর এই ঘুপচিতে ঘুমাতে দেয়া যায় না।তার বাবার বাড়ির আত্নীয়রাই আসে কয়েকদিন পর পর। ভুল ক্রমে আমাদের দিকের আত্নীয়-স্বজন এসে পড়লে কত বিরক্তি আর অভাব অনটন দেখা দেয়।
রুমে ঢুকে দেখি ফারিন রুটি সামনে নিয়ে বসে আছে।ওর ঠোঁট কেটে গেছে।আমাকে দেখেই ওর চোখ টলটল করে উঠলো।
জরিয়ে ধরলাম আমার আত্নাকে।
---মা তুমি খাওনি কেন?
---আমি চিনি দিয়ে খাবো না।নাটিলা দিয়ে খাবো।
---নাটিলা তো নেই মা।চিনি দিয়ে খেয়ে ফেল।
---রিমি আপু তো নাটিলা দিয়ে খাচ্ছে।
আমার পাঁচ বছরের অবুঝ বাচ্চাকে কিভাবে বুঝাবো?
কত কত খাবার জিনিস লুকিয়ে লুকিয়ে রিমিকে খাওয়ায় ভাবি, আমার মেয়েকে কখনো বা দেয় রিমির নষ্ট করা জিনিস।যেটা রিমি খায় না, ফেলে দিবে সেটা। খুব অবলীলায় বলবে-
---এত দামি জিনিস ফেলে দেয়ার দরকার কি?
আমার মেয়ের জন্য কত কত খাবার জিনিস আনতো ফয়সাল। তখন খেতে চাইতো না, এখন আমার মেয়ে খেতে পায় না।
আমি ফারিনকে খুব ভালো করে বুঝালাম, 'অন্যের কোন কিছু দেখে চাইতে হয় না। কিছু দিন পর আমি ওকে কিনে দিব।'আমার গয়নাগুলোর কথা মনে পড়ল। আমার মেয়েটা খুব লক্ষ্মী।সব বোঝে আমার জান।
এক গাল হেসে আমার মেয়ে বলল-
---ঠিক আছে মা আমি খাচ্ছি, আমাদের টাকা হলে নাটিলা কিনে দিও।
আমার মেয়ে ছোট ছোট হাতে রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। আমার মেয়েটা এই কয় মাসে অনেক বড় হয়ে গেছে।আট মাস আগেও মেয়ে আমার নিজের হাতে খেতে পারতো না।স্কুলে টিফিনের সময় দৌড়ে যেতাম খাইয়ে দিতে। এখন কত কি শিখে গেছে!আমি কি কম কিছু শিখেছি?বিয়ের আগে আব্বা বেঁচে ছিলেন,আম্মা সুস্থ ছিলেন। তেমন একটা কাজ করতে হয়নি। আমার নিজের কাজগুলো আম্মা করে দিতে দিতে বলতেন-
'কবে যে শিখবি, নিজের রুমটা পর্যন্ত গুছিয়ে রাখিস না।'
বিয়ের পরে ছুটা বুয়া সব কাজগুলো করে দিয়ে যেতো। আমি শুধু রান্নাটা করতাম।বুয়ার হাতের রান্না ফয়সাল খেতে পারতো না।যদিও মুখে বলতো না,তাই আমিই রান্না করতাম।যতক্ষণ বাসায় থাকতো আমার কাজে সাহায্য করতো ফয়সাল।
আর এখন ঘর মোছা আর কাপড় ধোয়া ছাড়া সব কিছু আমাকেই করতে হয়।পানি ধরতে ধরতে, বাসন মাজতে মাজতে নখে সমস্যা দেখা দিয়েছে।
আমার উপর বাজারের দায়িত্ব পড়েছে এইভাবে-
'কুমকুম তোমার ভাই দেখ কি কিনে এনেছে,সব ফেলে দিতে হবে। তার এত সময় কোথায় দেখে শুনে কিনে আনবে! আমার ও আবার গরম সহ্য হয় না।এখন থেকে তুমি বাজারটা করো।
আব্বা মারা যাওয়ার পরে বারান্দায় আম্মার জন্য একটা রুমের মত করে দিয়েছে, শুধু ছোট একটা খাট বসানো,এর বেশি জায়গা নেই।আম্মার হাই ব্লাড প্রেশার, শ্বাসকষ্ট আছে। বেশির ভাগ সময় আম্মা এই এখানেই কাটান।আসলে কাটাতে হয়,একবার স্ট্রোক হওয়ার পর হাঁটা চলায় কষ্ট হয়,কোন মতে নিজে নিজে বাথরুম পর্যন্ত যেতে পারেন , শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে।একটা ভালো ডাক্তার দেখিয়ে নিয়মিত ঔষধ খেলে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব হতো।
আম্মা ইদানিং আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না। নিজের মেয়ের কষ্টের জন্য কি নিজেকে দায়ী ভাবেন আম্মা?আমিও কিছু বলি না, কিছু জিজ্ঞেস করি না, বেশিক্ষণ আম্মার কাছে থাকি ও না,আম্মাকে দেখলে কষ্ট লাগে।মনে মনে বলি আম্মা তুমি নিজেকে দায়ী করে কষ্ট পেও না।এখন ভাবি যদি বলে তোমাকেও এখানে থাকতে দিবে না,তাহলে আমরা কোথায় যাবো? আমার ভাই তো কোন প্রতিবাদ করবে না।
সমস্ত কাজ করে যেই না একটু শুয়েছি,ভাবি এসে বলল-
---কুমকুম তোমার ভাতিজি নুডুলস খেতে চাইছে,একটু করে দাও।আজ দুপুরে একটুও ভাত খায়নি।
আমি বুঝি না আট বছরের একটা ছোট বাচ্চাকে কত জোর করে খাওয়ানো যায়।এক ঘন্টা আগে খেয়ে আবার কিভাবে খাবে বাচ্চাটা?না খেলেই বাচ্চার গায়ে হাত তুলবে।রিমিকে খুব ভালোবাসি আমি,রিমিও আমার জন্য পাগল।এই নিয়েও ভাবি কথা বলে।ওর উপর এমন ব্যবহার করলে খুব খারাপ লাগে।অনেকটা দূরে সরে তাই যেন, রিমির কান্না কানে না আসে।
এক রাজ্যের আলসেমি নিয়ে উঠে গেলাম রান্না ঘরে।
সামনের বছর ফারিনকে ভালো কোন স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। এই জন্য, ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য ওকে প্রস্তুত করছি। কোচিং এ দিতে চেয়েছিলাম,'ভাবি বলল,'শুধু শুধু টাকা খরচ হবে।সব হলো কপালের ব্যপার,ভালো স্কুলে টিকলে এমনিতেই টিকবে।না টিকলেও সরকারি কোন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিও।
রিমিকে স্কুলে দিয়ে বাসায় ফেরার পথে পেছন থেকে আমার নাম শুনে পেছনে তাকালাম।একটু সময় লাগলো। আমার ভার্সিটির ক্লাসমেট লুসি। শুনেছিলাম লুসি অস্ট্রেলিয়া থাকে। তৃতীয় বর্ষে থাকতেই বিয়ে করে চলে গেল।এত দিন পরে আমাকে দেখে জরিয়ে ধরলো।
---আমি দেশে এসে সবার খবর নিয়েছি।তোর কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো।
---থাকবি কিছু দিন।
আমি কথা ঘুরানোর চেষ্টা করলাম। কারো সান্ত্বনা শুনতে ভালো লাগে না।
---আছি তিন মাস।চল কোথাও একটু বসে কথা বলি।
---নারে, বাসায় গিয়ে নাস্তা বানাতে হবে।
---এত সকালে কোথা থেকে আসলি?
---ভাইয়ার মেয়ে রিমিকে স্কুলে দিয়ে এলাম।
লুসি আমার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইল।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-
---তুই কি আমার চেনা সেই কুমকুম?
একটা কথাও বলবি না, চল ঐ জায়গায় একটু বসি।
স্বাস্থ্য সচেতন লোকেরা ব্যায়াম করছে একটা মাঠে।এর পাশেই ঢালাই করা কয়েকটা ব্রেন্ঞ্চ।অনেকে ক্লান্ত হয়ে এখানে বসে,ঘাম মুছে,পানি খায়। খুব সুন্দর সকাল।কত দিন থেকেই তো আমি এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছি এত কিছু তো আমার চোখে পরেনি।হয়তো দেখতে চাইনি বলেই চোখে ধরা দেয়নি।
ফয়সালের ব্যবসা থেকে, ওদের পৈতৃক সম্পত্তির কোন অংশ থেকে এক টাকাও পাইনি বলে লুসি খুব অবাক হলো।
আমি নিজেও কি কম অবাক হয়েছি। একসাথে ফয়সাল আর তার বড় ভাই ব্যবসা করতো।ও মরে যাওয়ার পরে আমার ভাসুর বলল,ওর নাকি এক টাকাও মুলধন নেই।ওর পরিশ্রম আর ভাসুরের টাকা এভাবেই নাকি এত দিন ব্যবসা চালিয়েছে।যা লাভ হতো সমান দুই ভাগ হতো। আর সম্পত্তি সেটা তো তারা দিবে না, আমার কোন ছেলে নেই দেখে,মেয়ে হলে সম্পত্তি চাচারা পায়। শুধু প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস দিয়ে এক প্রকার জোর করেই বের করে দিল বাড়ি থেকে।
ফয়সাল খুব খরচ করতো। কোথাও কোন টাকা জমাতো কিনা জানিনা,বলে যেতে পারেনি।
লুসি সব কিছু শুনে বলল-
---এখন তাহলে কি করবি?
---কি আর করবো?
---তাহলে তোর সারা জীবন এভাবেই অন্যের ঘাড়ে বসে খাওয়ার ইচ্ছা?
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম দেখে ও বলল-
---তোর সার্টিফিকেট গুলো কি করবি? এগুলো শুধু জমিয়ে রাখার জন্য কষ্ট করে অর্জন করেছিলি?
---একটা চাকরির অফার পেয়েছিলাম,সারে তিন লাখ টাকা দিলে চাকরি কনফার্ম। দিলাম, আমার মত আরো কয়েকজনের টাকা নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল ঐ প্রতারক।এখনো পুলিশ খুঁজে পায়নি তাকে।আর আমার জমানো টাকা যা ছিল সব এইভাবে চলে গেল।
---শিক্ষিত মানুষ হয়ে তোরা কিভাবে প্রতারকের খপ্পরে পড়িস?
---এর পরে বেশ কিছুদিন চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছি।যাও বা পাই , সেগুলোর বেতন এত কম, মেয়েকে নিয়ে চলতে পারবো না।
---ময়মনসিংহের বাইরে চাকরি হলে তোর কোন সমস্যা আছে?
---ভালো বেতন ভালো পরিবেশ হলে সমস্যা নেই।
--- আমি সাত বছর থেকে একটা মানবাধিকার সংস্থায় চাকরি করছি। এবার দেশে এসেছি অফিসের কাজেই।তোর জন্য অবশ্যই কিছু করবো। তুই নিজে সাবলম্বী হয়ে মেয়েটাকে মানুষ কর।
তোর ফেবু আছে দেখলাম,এক্টিভ থাকিস না।আমি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম।
---ও সবে এখন আর ঢোকা হয় না,সময় পাই না।
---সব কিছুরই দরকার আছে। নিজেকে নিজেই সাহায্য না করলে কেউ কিছু করতে পারে না। নিজের মনোবল হারিয়ে ফেলিশ না।নিজে ভালো থাকলে আশপাশের সবাইকে ভালো রাখতে পারবি।
লুসির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসার পথ ধরলাম।
আমি এত দিন পরে যেন আমার পাশে দাঁড়ানোর মত কাউকে পেলাম। আশ্চর্য বিষয় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা কেউ খোঁজ নেয় না।লুসি এত ঘনিষ্ঠ না হয়েও আমার ব্যথায় ব্যথিত।
বাসায় যেতেই ভাবি বলতে লাগলো-
---এত দেরি করে এলে যে,গায়ে বাতাস লাগিয়ে এলে? তোমার ভাই যে বের হবে সেই খেয়াল আছে।এখন কি খেয়ে বের হবে?
আমি কোন উত্তর না দিয়ে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ভাবি আমার কাঁধে ধরে টান দিল-
---কি ব্যপার উত্তর না দিয়ে দেমাগ দেখিয়ে চলে যাওয়া?
---ভাবি বাড়াবাড়ি করো না, নাস্তা বানাতে দাও।
---বাড়াবাড়ি আমি করছি? নিজের স্বামীকে খেয়ে এখন আমার সংসার খেতে এসেছ?
এই কথা শোনার পর আমি আর কন্ট্রোল রাখতে পারলাম না।
---আমি আজ থেকে কোন কাজ করবো না। তোমার সংসার তুমি সামলাও। আমার বাবার পৈতৃক বাড়ি,এখানে থাকার অধিকার আমার আছে। তোমার কথায় না, আমার ভাই যদি বলে আমাদের খাবার দিতে পারবে না, তখন খাব না।
ভাইয়া এসে বলতে লাগল-
---কি শুরু করলে বলতো?
ভাবি ঝাঝিয়ে উঠলো-
---আমি শুরু করেছি? তোমার বোনের কথা বলতেই ছেত করে উঠ ।
---আমার বোনকে নিয়ে বাজে কথা বললে সহ্য করবো?
---কি বাজে কথা,বলেছি, তোমার বোনের মতিগতি ভালো লাগছেনা। সেদিন একটা বিয়ের প্রস্তাব এলো,তুমি না করলে।আরে ঐ লোকের ছেলে-মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, ঝামেলা নেই।
---এত বয়ষ্ক লোকের সাথে বিয়ে দিব না।
---আহারে-তোমার বোন কি কুমারী,বিধবা,একটা মেয়ে আছে। তার জন্য কি অবিবাহিত সুদর্শন যুবক আনবে?
ভাইয়ার জন্য আমার মনে এত দিন যে অভিমান, অভিযোগ জমা ছিল এ সব কথা শুনে সেটা মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল।
আমি ভাইয়ার হাতটা ধরে বললাম-
---আমার জন্য অশান্তি করো না ভাইয়া।একটা ব্যবস্থা করে এখান থেকে চলে যাবো আমি।
---কোথায় যাবি তুই? আমি তো মরে যাইনি এখনো।বলেই ভাইয়া আর দাঁড়ালো না, বেরিয়ে গেল বাইরে।
ভাবির ব্যবহার দিন দিন আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে।আমি বাইরে থেকে এসে দেখি পারিনি ঘুমিয়ে গেছে ওর চোখের কোনে পানি জমে আছে, ঠোঁটটা ফুলে আছে।রুটির প্লেট পাশেই পরে আছে। আমার বুকটা মোচর দিয়ে উঠলো।এই সময় কেন ঘুমালো?আদর করে কোলে নিতেই জেগে গেল। ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো। আমি বুকের সাথে চেপে ধরলাম মেয়েকে।কি হয়েছে জানতে চাইলে বলল-
---খাবার চাইলাম মামির কাছে,মামি বকা দিল,আর প্লেটটা শব্দ করে টেবিলে রেখে আমাকে ধাক্কা দিয়ে খেতে বলল। তখন প্লেটে লেগে আমার ঠোঁট কেটে গেল।মা বাবাকে নিয়ে আমরা যখন এখানে আসতাম তখন তো এমন করতো না ,এখন কেন এমন করে?
আমি বুকে চেপে ধরে কাঁদতে লাগলাম। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগলাম।
ভাবিকে জিজ্ঞেস করলেই সে সব কিছু অস্বীকার করবে।তাই কিছু জিজ্ঞেস না করে বললাম-
---কাল থেকে তোমার মেয়েকে আনা-নেয়া,বাজার করা সব কিছু তুমি করবে।আমি আর কিছু করতে পারবো না।
সে কি বলছে না শুনেই চলে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম।
মানুষের অবস্থার উপরেই যদি মানুষের ব্যবহার নির্ভর করে তাহলে তার মনুষত্ব কোথায়।এক সময় সে নিজেও তো এমন অবস্থায় পড়তে পারে এই চিন্তাটা কেন করে না?
'ফয়সাল সেদিন কেন তুমি সাবধানে মোটরসাইকেল চালাও নি,তাহলে তো তুমি আজ আমাদের সাথে থাকতে।সেই এক্সিডেন্টের দিন ঠিক কি হয়েছিল ভালোভাবে জানি না। শুনেছি তোমার মোটরসাইকেলের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় একটা ট্রাকের।আর সব কিছু শেষ। আমি এই সব ভাবতে চাই না তবুও কেন যে মনে পড়ে?'
আমার পোস্টিং হয়েছে রাঙ্গামাটি। অফিসের কোয়ার্টারে থাকি,আম্মাকেও নিয়ে এসেছি।আম্মা এখন অনেক সুস্থ। হাঁটা চলায় কোন সমস্যা হয় না। ভালো আছেন।
আমার ভাগ্য ভালো লুসির মত বন্ধু পেয়েছি।ওর ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারবো না।
নিজের উপার্জনে চলে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারছি। এখানে এত ভালো লাগে! কোয়ার্টার থেকে দুরের সব কিছু সবুজ দেখা যায়। খুব সুন্দর লাগে-আফসোস তোমাকে সাথে নিয়ে কখনো এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবো না। তবে আমি জানি তুমি যেখানে আছ সেখানকার সৌন্দর্যের কোন তুলনাই চলে না এই পৃথিবীতে। আকাশের তাঁরাদের দিকে তাকিয়ে বললাম-'তুমি কি দেখতে পাচ্ছ ফয়সাল,দোয়া করো আমাদের মেয়েটাকে যেন মানুষের মত মানুষ করতে পারি। তোমার জন্যেই পড়া শেষ করতে পেরেছিলাম, আমার একদম ইচ্ছা ছিল না।বিয়ের পরে পড়া কমপ্লিট করাটা কঠিন ছিল। এখন চিন্তা করি, পড়াশোনা শেষ না করলে কি এই চাকরিটা লুসি দিতে পারতো?
ফারিন দৌড়ে এলো, মা মা দেখ কেমন হয়েছে? আমার মেয়ে ছবি এঁকেছে-নিজের ছবিকে পরিচয় করিয়ে দিল-
অনেক ফুলের গাছ,গাছে প্রজাপতি,আমি প্রজাপতি ধরতে চাইছি।এটা নানু আর এটা তুমি দাঁড়িয়ে হাসছ।ঐ যে আকাশে বাবা আমাদের দেখছে।
ফারিনের কথা শুনে আমার চোখ ভিজে উঠতে লাগলো।
(সমাপ্ত)
Writer:- ফাহমিদা লাইজু