ফেসবুকের একটা ভাইরাল পোস্ট দেখছিলাম। "আমি হাত দিয়ে যা ছুঁই তা দুঃখ হয়ে যায়"। হাত দিয়ে কোনো কিছু স্পর্শ করলে সর্বোচ্চ একটু ময়লা হবে। বিদ্যুতের তার অথবা ক্ষতিকর কেমিকেল হলে ভিন্ন কথা। কিন্তু দুঃখ কেনো হবে! এসব হাবিজাবি ভাবছিলাম। এমন সময়ে একটা কল আসলো। মাসুদের কল। রিসিভ করতেই বললো, "মামা এলাকায় তো সেই একটা জিনিস আসছে"। কোন জিনিস এর কথা বলছে আমি ভালো করেই বুঝছি। তার সাথে ভার্সিটিতে দেখা হয়ে গেছে। আমার সাথেই ভর্তি হইছে। বললাম, "ভাষা ঠিক কর বেদ্দপ, জিনিস আবার কি?" মাসুদ বললো, "আরে বাদ দে, শুনলাম তোর ডিপার্টমেন্টেই নাকি ভর্তি হইছে?" আমি "হ্যাঁ" বলে কল কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ করে দিলাম। নাহলে খুব জ্বালাবে। মাসুদ বলে কথা। তার ভালো হওয়ার চান্স নাই।
মেয়েটা সুন্দর। নাম ঝুমুর। একেবারে নায়িকাদের মত গর্জিয়াছ সুন্দর না। স্নিগ্ধ সুন্দর। দেখলে মনে হয় কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছি। আমি এমনিতেই প্রকৃতি প্রেমি। মানুষের মাঝেই যদি সেই প্রকৃতির ছোঁয়া খুজে পাই তাহলে তো আর কথা'ই নাই। কথাবার্তা ও খুব আস্তে আস্তে বলে। চালচলনে যেনো কোনো তাড়াহুড়ো নেই। ক্লাস শেষে বই এমন ভাবে ব্যাগে ঢুকায় ব্যাগ নিজেও বুঝতে পারেনা তার ভেতরে কিছু একটা ঢুকতেছে।
ক্লাসে মোটামুটি সবার সাথেই আমার ভালো বন্ধুত্ব আছে। একমাত্র ঝুমুর ছাড়া। অন্য কেউ সামনে দিয়ে গেলে হয়তো আমি জিজ্ঞেস করি কোথায় যাচ্ছে অথবা সে জিজ্ঞেস করে। ঝুমুর সামনে দিয়ে গেলে একপাশে সরে দাড়াই।
একদিন ক্লাসে ম্যাডাম আসতে দেরি হচ্ছিলো। মেয়েরা একে অপরের সাথে কথা বলে হাসাহাসি করে মজা করতেছিলো। মজা করতে করতে সামিয়া থাপ্পড় দিলো নাদিয়ার পিঠে নাদিয়া দিলো ঝুমুরের পিঠে। ঝুমুর বেচারি চুপচাপ বসে আছে। তাদের খুনসুটি দেখতে ভালোই লাগছিলো আবার ঝুমুরের জন্য খারাপ লাগলো। ভাবলাম কিছু একটা করা দরকার। ম্যাডাম আসতেই ম্যাডামের কাছে বিচার দিলাম। বললাম, "ম্যাম আপনি আসার আগে এখানে রেসলিং খেলা হচ্ছিলো", সামিয়াকে আর নাদিয়াকে দেখিয়ে বললাম, "রোমান রেইন্স আর জন সিনার বউ মিলে তানভীরের বউকে মে'রেছে"। ম্যাডাম বললো, "রোমান রেইন্স আর জন সিনাকে তো চিনলাম, তানভীর কে?" তানভীর আমিই। পুরো ক্লাস তানভীরের বউ বলতে কাকে বুঝিয়েছি বুঝে গেছে। ম্যাডাম ও বুঝছে তবুও না বুঝার ভান করতেছে। বললাম, "ম্যাম এটা নতুন প্লেয়ার। অনেক ভালো খেলে"। যাদের নামে বিচার দিলাম তাদেরকে শা'স্তি না দিয়ে ম্যাডাম আমার এটেন্ডেন্স কে'টে দিলো। ভাবলাম কি আর করা, আমিও মন থেকে কারো উপকার করতে গেলে তা দুঃখ হয়ে যায়।
আমাদের খেলার মাঠ ঝুমুরদের বাসার পাশেই। এইজন্য আজকাল খেলতে যেতে অনেক অস্বস্তি লাগে। মনে হয় ওই বাসা থেকে কেউ একজন তাকিয়ে আছে। ফুটবলে ঠিকঠাক কিক দিতে পারিনা। পাঁ কাঁপে। অস্বস্তি দূর করার জন্য একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। খেলা'ই বাদ দিয়ে দিলাম। খেলার টাইমে মাসুদ সহ কয়েকজন মিলে ঝুমুরদের বাসার নিচে আড্ডা দিতাম। একদিন ঝুমুরের মা বাসা থেকে বের হয়ে এসে এমন ভাবে সামনে দাঁড়ালো আমাদের পালানোর কোনো পথ ছিলো না। মনে হচ্ছে শুধু হাত না, পাঁ নিয়ে যেখানে দাড়াই সেটাও দুঃখ হয়ে যায়। বাকি সবাই পিছনের দিকে দৌড় দিলো। আমি সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ঝুমুরের মা যখন এক পা এক পা করে সামনে আসছিলো আর আমার বুক থেকে হৃদপিন্ড যেনো বেরিয়ে আসতে চাইছিলো। সামনে এসে বললো, "ওরা দৌড় দিছে কেনো?" উনার প্রশ্ন শুনে আমার ভয় কিছুটা কমেছে। মা'রতে আসেনি এতটুকু শিওর হলাম। বললাম, "মসজিদে শিন্নি দিতেছে শুনে দৌড় দিছে।" ঝুমুরের মা সন্দেহের স্বরে জিজ্ঞেস করলো, "তো তুমি যাওনি কেনো?" বললাম, "আমার এসবে লোভ নাই আন্টি"। উনার চেহারা দেখে মনে হলো আমার উত্তর খুব বেশি একটা পছন্দ করে নাই। বললো, "যাইহোক শোনো, তুমি তো ঝুমুরের ক্লাসে পড়ো তাই না?" হঠাৎ ঝুমুরের কথা বলায় আবার ভয় পেতে শুরু করলাম। আস্তে করে "জ্বি আন্টি" বললাম। আমার হাতে একশো টাকা আর একটা নাম্বার দিয়ে বললেন, "বাসায় ছেলে মানুষ নাই। রিচার্জের দোকান ও অনেক দূরে। এই নাম্বারে একশো টাকা দিও।" তারপর নিজে নিজে বকবক করতেছিলো। ফোনে টাকা প্রচুর কাটে। রিচার্জ করলেই থাকে না। হঠাৎ ধমক দিয়ে বললো, "যাও, তাড়াতাড়ি দিবা টাকা"। আচ্ছা আন্টি বলে কোনোরকম জান নিয়ে কে'টে পড়লাম।
মাসুদের ফ্লেক্সিলোডের দোকানে গেলাম। মাসুদকে বললাম, "শাশুড়ি আম্মা ফোনের টাকা দ্রুত শেষ হয়ে যায় দেখে চিন্তায় আছে। কিছু একটা ব্যবস্থা কর।" মাসুদ বললো, "মিনিট কিনে দে তাহলেই হয়।" ভালো আইডিয়া। নিরানব্বই টাকার মিনিট প্যাকেজ রিচার্জ করে দিলাম। বাকি এক টাকা মাসুদের পকেটে। শাশুড়ি প্রথমবার টাকা দিয়েছে সেই টাকাও অন্য কারো পকেটে মেনে নিতে পারছি না। তার দোকানে এক টাকায় পাওয়া যাবে এমন কোনো জিনিসও নাই যে টাকার বিনিময়ে সেটা নিয়ে চলে যাবো। একমাত্র মাসুদ ছাড়া। তাকে বিক্রি করতে নিলে কেউ ফ্রিতেও নিবে না এক টাকা তো বহুদূর।
সেদিন ক্লাসে ঝুমুরকে বউ বলার পর থেকে খেয়াল করছিলাম ঝুমুর আরো বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে। ভুলে কখনো চোখে চোখ পড়ে গেলে চোখ নামিয়ে নেয়। নিচের দিকে তাকিয়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে। আমার কেনো জানি মনে হয় লজ্জা পায়।
একদিন সকাল বেলা একটা টিশার্ট পরেই বাজারে যাচ্ছিলাম। শীতকাল, রোদ উঠে গেছে তাই আর জ্যাকেট গায়ে দিইনি। ঝুমুরকে দেখলাম বিপরীত দিক থেকে আসতেছে। দেখে মনে হচ্ছে কাঁপতেছে। জ্যাকেট নাই আমার গায়ে কাঁপে অন্য কেউ। একেই মনে হয় মনের সাথে মন, দেহের সাথে দেহের কানেকশন বলে। সামনে আসতেই পথ আটকে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম,
- শীত লাগে?
উত্তর দিলো,
- না
- তাহলে এভাবে কাপতেছো কেনো?
সে একটু চুপ করে থেকে বললো,
- আমার লজ্জা লাগে।
লজ্জায় মানুষ কাঁপে এই প্রথম দেখলাম। ঝুমুরের নরম স্বর হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে গেলো। বললো,
- আপনি প্লিজ পালিয়ে যান।
লজ্জা লাগতেছে তার। পালালে সে পালাবে। আমি কেনো পালাবো! বললাম,
- কেনো?
- ওইদিন যে আপনি আম্মুর ফোনে নিরানব্বই টাকা দিছেন বাকি এক টাকার জন্য আম্মু আপনার উপর ক্ষেপে আছে। এইদিকেই আসতেছে।
পেছনে তাকিয়ে দেখলাম একটু দূরে শাশুড়ি আম্মা পাঁ থেকে জুতা খোলার চেষ্টা করতেছে। একে তো এক টাকা কম দিয়েছি তার উপর মাঝ রাস্তায় তার মেয়ের পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছি। উনার হাতে পড়লে আজকে আর রক্ষা থাকবে না। দিলাম দৌড়। যত জোরে পারা যায় দৌড়াচ্ছি। যেনো আমার পেছনে বাঘ আছে আর আমি হরিণ।
এর কিছুদিন পরেই কোরবানির ঈদ ছিলো। বাসার গেইটের সামনে চাচাতো ভাইকে নিয়ে ক্রিকেট খেলছিলাম। বল শুধু মাত্র সামনে মারা ছাড়া বাকি যেদিকেই যাবে আউট। মনে হচ্ছিলো বল ব্যাটে লাগানোর চেয়ে না লাগানোটাই বেশি নিরাপদ। এমন সময় ঝুমুর সহ ঝুমুরের মা'কে আসতে দেখে ভুলে লেগ সাইডে মে'রে দিয়েছি। চাচাতো ভাই আউট হওয়ার সেলিব্রেশন করতেছে কিন্তু আমি আউট মেনে নিচ্ছি না। প্রস্তুত ছিলাম না ডট বল ছিলো আবার বল করতে বলছিলাম। আউট হয়েও না মেনে নেওয়া দেখে ঝুমুর হাসছে।কেমন জানি একটু অপ'মানিত বোধ করলাম। বৃষ্টি আসলে যেমন খেলা ক্যান্সেল হয়ে যায় তেমনি মেহমান আসায় খেলা ক্যান্সেল করে দিয়ে চলে আসলাম। আন্টিকে সালাম দিলাম।
শাশুড়ি আম্মা আমার আম্মুকে খুজতে ভেতরে চলে গেলো। ঝুমুর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমার হাতে গোস্তের পোটলা দিলো। বললাম,
- আমরা তো কোরবান দিয়েছি।
- এটা গিফট।
বাহ ইউনিক গিফট। সবাই চকলেট দেয় ঘড়ি দেয় সে দিচ্ছে গোস্ত। খারাপ না। কিছুক্ষণ পরেই আম্মুদের হাসাহাসি শুনে কান খাড়া করলাম। ঝুমুরের আম্মু বলছিলো, "জুতা বেশিদিন টিকেনা বুঝছেন ভাবি। মেয়েকে প্রায়ই বকাবকি করি তার পাঁয়ে লোহাও টিকে না, কিন্তু আমার নিজের পাঁয়ে যে ইস্পাত ও টিকে না"। এটা বলেই তারা আবার হাসছিলো। ঝুমুরের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম কালো জুতা পড়েছে। জুতার উপরে একটা ফুল আছে। সাদা পায়ে কালো জুতা দেখতে সুন্দর লাগছিলো। ঝুমুরের মা আবার বলতে লাগলো, "ওইদিন রাস্তায় জুতা ছিঁড়ে গেছিলো। তানভীরকে দেখলাম বাজারের দিকে যাচ্ছে। ঝুমুরও ওইদিক থেকে আসছিলো। পাঁ থেকে জুতা খুলতে খুলতেই ছেলে উধাও হয়ে গেলো। ঝুমুরকে জিজ্ঞেস করার পর বললো আমার জুতা খুলতে দেখে নাকি ভয়ে পালিয়েছে"। কথা শেষ করেই তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মাথা নিচু করে মুচকি হাসছে। আমার সাথে ধোকা হয়ে গেছে। ঝুমুর সেদিন লজ্জা থেকে বাঁচার জন্য ইচ্ছে করে সেখান থেকে আমাকে ভাগিয়ে দিয়েছিলো। এই মেয়ে এত চালাক হবে বুঝতে পারিনি। একদিনে এত অপমান সহ্য করা যাচ্ছে না।
সহ্য করে নিলাম একটা অদ্ভুত জিনিস দেখে। রাগ করে উঠে চলে যাবো এমন সময় ঝুমুর হাত ধরে টেনে বসালো। বললো পোটলা টা খুলে দেখতে। খুলে দেখলাম গরুর কলিজা নিয়ে এসেছে। কলিজা কে'টে খাওয়াতে চায় ভালো কথা, হোক সেটা গরুর কলিজা। কিন্তু কলিজা দেখে খু্শি হয়ে অপমান সহ্য করিনি। সহ্য করেছিলাম অন্য কিছু দেখে। কলিজার পিস গুলোর মধ্যে একটা পিস হার্ট শেপে কা'টা ছিলো। তার মাঝখানে আমার নাম লেখা ছিলো। এটা করতে তার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে দেখে বোঝা'ই যাচ্ছে। যে কেউ এত সুন্দর করে ডিজাইন করে কা'টতে পারবে না। তার উপর সবার থেকে লুকিয়ে আমার কাছে পর্যন্ত নিয়ে আসা কম ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো না। জিজ্ঞেস করলাম,
- অনলাইনে অর্ডার করছিলা নাকি?
রাগ দেখিয়ে বললো,
- পছন্দ না হলে ফেরত দেন।
তাড়াতাড়ি করে এমন ভাবে পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম যেনো খুব মূল্যবান জিনিস। কিন্তু চিন্তা হচ্ছিলো এটা তো দু একদিনের মধ্যেই পঁচে যাবে। ফ্রিজে রাখলে আম্মু দেখে ফেলবে। খেয়ে ফেললে সকালে আবার বের হয়ে যাবে। সম্ভবত এর আগে কেউ কখনো গরুর কলিজার একটা ছোট টুকরা নিয়ে এত টেনশন করেনি। হাতের উপর ছোট কলিজার টুকরা একইসাথে আমার সুখ এবং দুঃখের কারণ। আমি হাত দিয়ে যা ছুঁই আসলেই তা দুঃখ হয়ে যায়। এক কলিজার টুকরা পরিমাণ দুঃখ।
( সমাপ্ত )
লেখা: তানভীর আহমেদ হানিফ