> নন্দা
-->

নন্দা

আর দুশোটা টাকা বেশি দেবেন বাবু?"
নন্দার কথায় বেশ রেগে গেলো গিন্নি।-"হ্যাঁ রে নন্দা আগের মাসেই তো‌ তোর মাইনে দুশো টাকা বাড়িয়ে দিলাম আবার দুশো টাকা বেশি!তোর তো দেখছি কিছুতেই দাবি মেটে না আর।"
গিন্নিকে বললাম-"আহা গিন্নি এতো রাগ করলে চলে?"
নন্দাকে আরো দুশো টাকা দিয়ে দিলাম।ওর মুখে দেখলাম তখন কি খুশির হাসি।টাকাটা নিয়ে ও ব্যস্ত হয়ে পড়লো ঘরের কাজে।

নন্দা মেয়েটা বেশ চুপচাপ তেমন কথা বলে না,একমনে নিজের কাজ করে বেরিয়ে পড়ে অন্য বাড়ির কাজে।সব সময় সে কাজ করে চলে,যেনো ওর ক্লান্তি নেই।নন্দা এ বাড়িতে কাজে এসেছে মাস ছয়েক হলো।আগে একজন কাজ করতো সে কাছ ছাড়ার সময় নন্দাকে কাজটা দিয়ে গেছিল।নন্দা তাড়াতাড়ি করে কাজ করলেও নন্দার কাজ বেশ পরিষ্কার আর গুছানো তাই গিন্নিও আর আপত্তি করেনি।

সেদিন বসার ঘরে ঢুকতেই অবাক হলাম দেখে আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে নন্দা আমার ইংরেজি খবরের কাগজটা মন দিয়ে পড়ছে।জিজ্ঞেস করলাম-"কিরে নন্দা তুই ইংরেজি কাগজ পড়তে পারিস?"
নন্দা শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।বললাম-"কতো দূর লেখাপড়া শিখেছিস তুই?"
নন্দা বললো-"মাধ্যমিক পাশ করে এলেভেনে ভর্তি হয়েছিলাম দাদাবাবু।কিন্তু 
বস্তির মেয়ে তো আমি তাই বাপ মা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিল তাই আর পড়া হয়নি।"
আমি সেদিন অবাক হলাম মেয়েটার দুর্দশার কথা ভেবে।লেখাপড়া শেখার সুযোগ পেলে হয়তো ও প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো অনেক।

সেদিন রান্না ঘরে শুনলাম গিন্নি আর নন্দার কথোপকথন।নন্দা বলছে-"দুটো দিন ছুটি দেবেন গিন্নি মা?"
গিন্নি বললো-"না না এখন ছুটি দেওয়া যাবে না আমার শরীর ভালো নেই।আসতেই হবে তোকে।"
নন্দা সেদিন মুখ ফুটে বলতে পারলো না যে ছেলেটার পরীক্ষা শুরু হবে কদিন পর তাই ছুটিটা চাইছিল সে‌।গিন্নি রান্না ঘর থেকে বেরোতেই বললাম-"তোমার শরীর তো ঠিকই আছে তাহলে ছুটিটা দিলে না কেনো?"
গিন্নি ওমনি ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো-"তুমি তো চলে যাবে তোমার স্কুলে আর সব কাজ তো আমাকেই করতে হবে ও না এলে।তাই কোনো ছুটি দেওয়া যাবে না।"
আস্তে আস্তে বললাম-"ছুটি চাওয়ার কারণটাতো জানতে চাইতে পারতে।"
কিন্তু গিন্নি আমার কথায় কোনো গুরুত্ব না দিয়েই চলে গেলো।

নন্দার এ কদিন রাতে ঘুম নেই।রাত থাকতে উঠে রান্না চাপায় ছেলের জন্য। পরীক্ষার দিন নাহলে যে ছেলেটাকে খালি পেটে যেতে হবে।সকালে ছেলে বসে থাকে মুখ গুঁজে বইয়ে,নন্দা ছেলেকে খাইয়ে দেয় নিজের হাতে।তারপর ছেলেকে ভালো করে পরীক্ষা দেওয়ার কথা বুঝিয়ে দিয়ে ছোটে বাস রাস্তায়।কাজের বাড়িতে যেতে দেরি হলে আবার ঝামেলা।এ কদিন একটু তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করে নন্দা।পরীক্ষা দিয়ে ফিরলে ছেলেটার মুখে তরকারি ভাত তুলে দেওয়ার আশায়।কখনো কেউ কেউ তাড়াতাড়ি ফেরার অনুমতি দেয়,কেউ দেয় না।এইভাবে দেখতে দেখতে এক সময় নন্দার ছেলের পরীক্ষা শেষ হল।

নন্দার অনেক স্বপ্ন তার ছেলেটাকে নিয়ে অনেক লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হবে সে।বাপ মা তো সেই বিয়ে দিলো লেখাপড়া বন্ধ করে,তারপর দু'বছর পর ছেলেটা হলো।বর ভোলা দূরের শহরে কাজ করতে গিয়ে তো আর ফিরলো না।সবাই বলে আবার নাকি বিয়ে করেছে সে।নন্দা পড়ে রয়েছে তার একমাত্র ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরে।নিজে শত কষ্ট করলেও ছেলের সব প্রয়োজন মেটায় নন্দা।যদিও উঁচু ক্লাসে ওঠার পর থেকে ছেলের টিউশনি পড়ার টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়েছে নন্দাকে।কিন্তু তাও নন্দা থামেনি নিজে খেটে ছেলের লেখাপড়ার টাকার জোগান দিয়েছে।

আজ সকালে খবরের কাগজটা পেতেই আমি তো আনন্দে আত্মহারা।আমার স্কুলের ছাত্র আনন্দ এবার উচ্চমাধ্যমিকের কৃতী প্রথম দশজন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একজন।বারবার বলছি সত্যি ছেলেটা জিনিয়াস।ওই ছেলে আমাদের স্কুলের নাম উজ্বল করলো।আমি খুব খুশি আনন্দ'র শিক্ষক হিসাবে।রিটায়ার হওয়ার এক বছর আগে আমার এটা অনেক বড় প্রাপ্তি।এর আগে আমাদের স্কুলের কোনো ছাত্রছাত্রীই এতো ভালো রেজাল্ট করতে পারেনি। তাড়াতাড়ি করে রেডি হলাম দামী শার্ট, প্যান্ট,বুড পরে।আজ নিশ্চয়ই সাংবাদিকরাও স্কুলে আসতে পারেন,যতোই হোক আমি কৃতী ছাত্রের শিক্ষক বলে কথা।গিন্নি সমানে বলে চলেছে-"কি আক্কেল নন্দাটার!না বলে কয়ে হুট করে কামাই!আর ওকে কাজে রাখলে চলবে না তো বলে দিলাম।"
আমার এখন এসব শোনার মোটেই ইচ্ছা নেই। বেরিয়ে পড়লাম স্কুলের উদ্দেশ্য।

স্কুলে পৌঁছে আনন্দকে অনেক আশির্বাদ করলাম।রেজাল্ট দেওয়া হচ্ছে সব মাষ্টারমশাইরা সেখানে উপস্থিত।একজন শিক্ষক প্রশ্ন বললেন-"আনন্দ তুমি তো এতো ভালো রেজাল্ট করেছ,তোমার জুনিয়র ভাই বোনদেরকেও একটু বলো তোমার কঠোর অধ্যাবসায়ের কথা।"
আনন্দ বলতে শুরু করলো-"আমি তো শুধু লেখাপড়া করে গেছি মন দিয়ে,সফলতা পেয়েছি তাই আপনারা আমার সাফল্য দেখছেন কিন্তু এর পিছনে আছে একটা মানুষের কঠোর পরিশ্রম।যার জন্য আজ আমি সফল আজ আমি তাকে দেখাবো আপনাদেরকে।"
আমাদের স্কুলের সেরা ছেলেটা হঠাৎ ছুটে গেল স্কুলের গেটের কাছে।দেখলাম হাত ধরে টেনে আনছে একজন মহিলাকে। কিন্তু এই মুখটা তো আমার খুব চেনা,এ যে আমার বাড়ির কাজের মেয়ে নন্দা।আজ আমি আর মুখ তুলে তাকাতে পারছি না নন্দার দিকে।ওর মুখে জয়ের হাসি আমি এ স্কুলের কৃতী ছাত্রের শিক্ষক আর ও‌ যে সেই ছাত্রের মা।আমি সরে গেলাম ওখান থেকে।নন্দা'র আজ কাজে না যাওয়া আমার স্ত্রী'র অশান্তির কারণ,সে তো জানেই না আজ নন্দার ছেলের রেজাল্ট।

আমার স্কুলের যে ছাত্রের জন্য আমি এতো খুশি,পরীক্ষার দিনগুলোতে তার মা ছুটি পর্যন্ত পায়নি ছেলেটাকে ঠিক করে খাবার দেওয়ার জন্য।একদিন ওই ছেলেটার একটা নতুন বই কেনার জন্য দুশো টাকা বেশি দিতে গিয়ে কথা শুনিয়েছে আমার স্ত্রী।আসলে আমরা হয়তো ভাবতেই পারিনা যে একটা কাজের মেয়ের সন্তান এতো মেধাবী হতে পারে।বাস্তবেও কিন্তু এমন হয়।আমরা শুধু নিজেদের সমস্যা গুলো দেখি কিন্তু ওদেরও প্রয়োজন আছে ছুটির কিম্বা টাকার,অনেক সময় আমরা সেসব ভুলে যাই।

বাড়ি ফিরতেই স্ত্রী শুরু করলো-"নন্দা কাল এলে টাকাটা মিটিয়ে দিও আর ওকে আসতে হবে না।"
নিজের সন্তানের জীবনের একটা এমন গুরুত্বপূর্ণ দিনে মা কাজে আসেনি বলে তার কাজটা চলে যাচ্ছে।পুরো ঘটনাটা না জানলে হয়তো আমি এটাই করতাম‌‌।কিন্তু স্ত্রীকে পাশে বসিয়ে বললাম-"তোমার ছেলে যদি পরীক্ষায় সেরা দশজনের একজন হতো তুমি কি ছেলের পাশে থাকতে না?"
গিন্নি অবাক হয়ে বললো-"তার মানে?"
সবটা বলতেই গিন্নির চোখেমুখে ফুটে উঠলো অনুশোচনার ছাপ।

পরের দিন সকালে গিন্নি আমাকে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে তুলে বাজারে পাঠালো।বাজার আনতেই নিজেই রান্না চাপিয়েছে দেখলাম।নন্দা বোধহয় আঁচ করে এসেছিল বকা শুনবে চুপ করে এসে ঘরের কাজে হাত দিতেই,গিন্নি বললো-" সোফায় বস আমি আসছি।"
নন্দার চোখেমুখে দুশ্চিন্তা।আমি দেখলাম আমার রাগী গিন্নি হাতে এক গাদা টিফিন বক্স এনে ধরিয়ে দিলো নন্দার হাতে।বললো-"বলিসনি কেনো সবকিছু বল? এগুলো ছেলেটাকে খাওয়াস।বলিস আমি পাঠিয়েছি।আর একদিন আনিস আমার বাড়ি।ছেলেমেয়ে বড় হয়ে ভুলতে বসেছে আমাদের কথা,তাই মেজাজ ঠিক থাকে না রে।যা বোন দুদিন ছুটি তোর সব কাজ আমি সামলে নেবো।"
আমি বললাম নন্দা-"এই নে এটা আমার প্রিয় ছাত্র আনন্দ'র জন্য উপহার তার মাষ্টারমশাইয়ের তরফ থেকে।"
বলে দুটো নতুন জামার প্যাকেট ধরিয়ে দিলাম ওর হাতে।নন্দা অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে।আমি বললাম-"হ্যাঁ রে নন্দা আমিই তোর ছেলের স্কুলের সেই শিক্ষক,যে কিনা তোর ছেলের সাফল্য দেখেছে তার পিছনে থাকা তোর পরিশ্রমের খোঁজ রাখেনি।"
আজ নন্দার মুখে সেই হাসিটাই দেখলাম যেটা আগেরবার দুশো টাকা বেশি দিয়ে দেখেছিলাম।









Writer:- শ্রাবন্তী মিস্ত্রী








সমাপ্ত
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner