-পিরিয়ডের সঠিক বাংলা কি হতে পারে জানো?
আমি মা হতে তৈরী হচ্ছি। আমি সেসব সন্তানের মা হতে তৈরী হচ্ছি, কষ্ট সহ্য করছি, যারা একদিন এই সময় টা কে পৃথিবীর নোংরাতম দিন হিসেবে আখ্যায়িত করবে।
আমার এই কথায় থমকে গেল পলাশ। আমাকে ছুড়ে মারার জন্য যে ফুলদানীটা সে তুলে ধরেছে। সেটা কিছুটা নিচে নেমে যাচ্ছে ওর হাত গলে। ও ফুলদানীটা আবার ঠিক জায়গায় রাখলো। শান্ত হয় নি সে, তবে থেমেছে।
বিয়ের পর প্রথম মাসে যখন আমার পিরিয়ড হয়, আমাকে বলা হয়েছিল ছাদে গিয়ে চাদর শুকাতে দিয়ে আসতে।
আমার শরীর রান্নাঘরে কাজ করে তখন এক বিন্দুও নড়ছে না। আমাকে বার বার বলা হচ্ছিলো,
-বিছানার চাদর ধোয়া হয়েছে গিয়ে ছাদে দিয়ে আসো।
সেখানে ঘরের সবাই ছিলো। যাচ্ছি না দেখে কিছুটা নাক উচিয়ে আমাকে বেয়াদব ব্যাখ্যা যখন দেওয়া হচ্ছিলো, আমি তখন জোরে বলে উঠি,
-আমার পিরিয়ড হয়েছে। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। শরীর ভালো লাগছে না।
এই সামন্য কথা টা রক্ষনশীল পরিবারের টুনকো শালীনতায় নাকি অবমাননার শামিল।
আমি কিছু বুঝতে পারার আগে হুংকার ছাড়ে শাশুড়ী,
-অসভ্য, বেয়াদপ মেয়ে, শ্বশুর ভাসুরের সামনে মুখে লাগাম নেই?
আমি শুধু বলেছিলাম, এই যুগে এসেও আপনারা এমন নিচু ধারনা রাখেন কীভাবে?
এইটা আমার দ্বিতীয় অপরাধ। এই কথার জের ধরে আমাকে ধমকাতে আসে আমার স্বামী, আমি যখন প্রতি কথার উত্তর দিয়েই যাচ্ছি তখন সে তার কালো চারকোনা টুপি,কালো কোর্ট আর লাল ফিতেই বাধা সার্টিফিকেট তুলে হাস্যজ্জ্বল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমার্বতের ছবির পাশে রাখা ফুলদানি উচিয়ে ধরে আমার দিকে ছুড়বে বলে।
আমি খাটে বসে তার চোখে চোখ রেখে এই কথা বলায় সে থেমে যায়। তার ভেতরের সামান্য বোধ, এখনো বোধহয় আটকে রেখেছে তাকে।
সে ইস্তহস্ত আচরণ করে,কোন শব্দ খুঁজে না পেয়ে সে বেড়িয়ে গেল। সে বেড়িয়ে যেতেই আমার সারাশরীরে তীব্র জ্বলুনি অনুভব করি। সাথে পায়ে তীব্র কাপুনি।
হাই স্কুলে উঠে প্রথম যখন পিরিয়ড শুরু হয়, তবে থেকে একেবারেই অসহ্য আর অপছন্দের একটা ব্যাপার এই পিরিয়ড। সারশরীর জুড়ে তীব্র অসাড় অনুভূতি। মরণ কামড়ের মতো পেট ব্যাথা। আর সারাক্ষনে ধারালো ছুড়ির আচড়ের মতো অনুভূতি কোমড়, তলপেট আর রান জুড়ে।
স্যতস্যতে নেকড়ের মতো ভিজে থাকা মন৷ মূহুর্তেই উদাস হয় মূহুর্তে খিটখিটে।
তার উপর বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে নীরবে সহ্য করা অব্যথিত, অকথিত চোখের পানি।
যেন এই এক মহা পাপের শাস্তি ভোগ করা, যার প্রকাশ তুমি কাউকে করতে পারবে না। বলতে পারবে না। উচ্চারণ করতে পারবে না তোমার ব্যাথিত অনুভব।
তখন থেকেই আমার শুধু মনে হতো কেন এই অত্যাচার সহ্য করা অযথা প্রতিমাসে?
একটা সময় জানলাম, বুঝলাম কেন মেয়েদেরেই এইটা সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েছে সৃষ্টিকর্তা। আমার তখন থেকে মনে হতো মেয়েদের ক্ষমতা বেশি তাই তাদের এই অকথ্য অত্যাচার তাদের ভাগ্যে দেওয়ায় উচিত ভেবেছেন সৃষ্টিকর্তা। মেয়েদের মা বানাতে যে ধর্য্য দরকার তা আনার জন্য বোধহয় প্রতিমাসে পিরিয়ডের যন্ত্রনা ধারণ করার দিয়ে ধর্য্যের পরীক্ষা নিয়ে পাকাপোক্ত করেন।
যত বড় হচ্ছিলাম তত অবাক হচ্ছিলাম চারপাশের মানুষের এইটাকে লুকিয়ে রাখার নিম্ম নীতিবাক্যে আর প্রবণতা দেখে। যেন উচ্চারণ করা মহাপাপ। এই সময়ে খাওয়া পাপ, চলা পাপ, বলা পাপ। এমন কি অর্ন্তবাস খানা কড়া রোদে শুকিয়ে জীবাণু মুক্ত করাও পাপের শামিল।
যত দেখছিলাম তত প্রশ্ন তুলছিলাম কোন ব্যাখ্যা ছাড়া উত্তর পেতাম,
-এমন টাই চলে, এমন টাই চলে আসছে হাজার বছর ধরে।
কিন্তু কেন? তার কোন উত্তর আমি কোন কালেই পাই নি। অন্যদের মতো আমিও লুকাতে শুরু করি, ভয় পেতে শুরু করি। এক প্রকার আতংক নিয়ে অপেক্ষা করি। আমার মতো হাজার মেয়ের মতো। তবে যখন ব্যাথায় বিছানার চাদর ধরে কুকড়ে পা গুটিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতাম তখন মা মাথায় হাত বুলিয়ে পানির গ্লাস টা এগিয়ে দিতো।
সদ্য স্কুলে পা দেওয়া ছোট ভাই টাও পাশে বসে কান্না করতো। কিংবা কোমড়ে ধরে বসে থাকতো গরম পানির ব্যাগ । তখন যেন সাহস পেতাম। বার বার শুকিয়ে উঠা ফাঁটা ঠোঁট ছড়িয়ে হাসার চেষ্টা করতাম। ভয় কাটিয়ে উঠে বসতাম।
তবে মেয়েরা কষ্ট সহ্য করতে ভয় পায় না। ভয় পায় তখন তাদের সাথে করা আচরণ গুলোর জন্য।
গ্রামে হাল্কা রোদ পড়া কোন এক আড়াল বেছে নেওয়া হয় পিরিয়ডের সময় ব্যবহার করা কাপড় শুকাতে। কারণ সবাই জানার শর্তে সেসব কাপড়ের দিকে তাকিয়ে এমন ব্যঙ্গ স্বরে জানতে চাইবে, এইটা কিসের কাপড়?
তখন কিশোরী হোক কিংবা দুই সন্তানের জননী, সবারেই ইচ্ছে করে,
- হে মাটি তুই ভাগ হয়ে যা মা, আমি এখনিই ঢুকে পড়ি।
কোন কারণ নেই লজ্জা পাওয়ার, তবে আমাদের এমন ভাবেই প্রস্তুত করা হয়, যাতে আমরা কষ্টও সহ্য করি, লজ্জাও পায়। যেন এইটা আমাদের জম্মগত অপরাধ।
শহরের অলিতে-গলিতে ফার্মেসী, নানা রং এর প্যাডের প্যাকেট সাজানো থাকে পুরো ফার্মেসী একটা বিশাল তাক জুড়ে। কিন্তু তাও প্রতিবার ফার্মেসী থেকে প্যাড কেনার জন্য আমরা মেয়েরা অপেক্ষা করি, দোকানটা জনশূন্য হোক। প্রতিবার প্যাড দিতে বলার সময় আমরা আটকে যাই, কিংবা মনে মনে কয়েক বার প্রক্টিস করে নিই যে আমরা ভীষণ ব্যস্ত। ব্যস্ত স্বরে কারো দিকে না তাকিয়ে বলি,
-একটা জয়া দেন কিংবা একটা সেনোরা দেন।
যেন দ্রুত দেওয়া হয় আমাকে আর আমি দ্রুত পালিয়ে বাঁচি।
কোন কারণ নেই, তাও আমরা লজ্জা পাই। আমাদের যেন এই লজ্জা পাওয়াতেই তারা সন্তুষ্ট। যারা বার বার শুনেও জানতে চায়, কি চায় তোমার?
জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথা ব্যাথা,ডায়রিয়া সব কিছুর জন্য ছুটির আবেদন লেখা শেখালেও, কোন দিন কোন পরীক্ষা বা ক্লাস রুমে কিংবা হোর্মওয়ার্কে, পিরিয়ডের জন্য ছুটির আবেদন লেখা আমাদের শেখানো হয় নি। নেই কোন পাঠ্য বইয়ের সিলেবাসে৷ কোন কর্মজীবি মহিলা, সিক লিভের মধ্যে এইটা অন্তর্ভুক্ত নেই। নেই নিত্য সাধারণ জীবনের কাজ কর্মে।
ঘরের কাজে কোন মাফ নেই। উল্টো বেড়েই যায়। যেন এইটা কোন খারাপ লাগাতেই পড়ে না। পড়ে না কোন ছুটির চাওয়ার অজুহাতে। কিন্তু এইটার চেয়ে বেশি কষ্ট মেয়েদের শরীর বোধহয় আর কিছুতেই পায় না। কিন্তু কারো এইটা নিয়ে কথা বলার রুচি নেই।
কিন্তু রাস্তা ঘাটে দাঁড়িয়ে ঠাট্টা সুরে, বাজে শব্দ ছুড়ে দেওয়ার জন্য বোধহয় কোন রুচিবোধের দরকার পড়ে না। ওটা একটা অধিকার বোধেই বেড়ে উঠে এক শ্রেনীর মানুষের মধ্যে।।
পরের দিন কাজ শেষে রুমে শুয়ে ছিলাম, পলাশ এসে বলে,
-তোমাকে মা ডাকছে শুনতে পাচ্ছো না?
আমি কোমড় তুলতে পারছি না বিছানা ছেড়ে। শোয়া অবস্তায় বলি,
-কেন?
সে ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলে, আমি কি জানি?
কোন মতে উঠে রুম থেকে বের হতেই মা চেঁচিয়ে বলে,
- শুয়ে আছো কেন? ঘর মুছে দাও।
আমি অবাক না হয়ে পারি না,
- কেন? পরশু দিন তো মুছা হলো। তাছাড়া খুব একটা ময়লা তো হয় নি।
উনি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,
-এইসব দিনে ঘর পরিস্কার রাখতে হয়, ঘর মুছতে হয়। এই ঘরের এইটাই নিয়ম। সবাই মুছে।
আমি আমার জায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, সেও সায় দিচ্ছে।
আমি বলি,
-আজ থেকে নিয়ম পাল্টান। নিয়মের নামে এইসব অত্যাচার বন্ধ করুন। শরীর ভালো থাকলে তখন দিনে তিনবার ও মুছা যায় ঘর। কিন্তু যখন শরীর টা যেখানে এক কদম চলতে পারছে না। ব্যাথায় কুকড়ে কুকড়ে যাচ্ছে তখন এইসব নিয়ম বলে মানা কুসংস্কার গুলো অত্যাচার ছাড়া কিছুই না। আমি পারব না এইসব। আপনারাও করিয়েন না। পারলে এইসময় আরো সাহায্য করুন ,যাতে কম কাজ করে রেস্ট নেওয়া যায়। ভালো খাওয়া দাওয়া করা যায়।
আমার কথা গুলো ওদের কাছে অতি রঞ্জিত ন্যাকামী ছাড়া কিছুই মনে না হলেও, ধীরে ধীরে নিয়ম পাল্টে গেল। আমি হাল ছাড়ি নি। হেরে গিয়ে মেনে নিই নি এইসব নিয়ম বলে মানা অত্যাচার গুলো। এক দিনে নয়, সময় নিয়ে। দশ বছর লেগেছে আমার এইসব নিয়ম থেকে সবাইকে বের করতে।
ছেলেদের মাঝে পিরিয়ড নিয়ে নোংরা অভিব্যক্তি কিভাবে তৈরী হয় জানেন? না জানা থেকে, তাদের অজ্ঞতা থেকে। ছেলেরা মেয়েদের পিরিয়ড সর্ম্পকে কোন আলোচনা বা কোন ব্যক্তির কাছ থেকে জানতে পারে না। তারা পিরিয়ড সম্পর্কে জানে বন্ধুদের অশ্লীল আড্ডার টপিকে। যদি ঘর থেকে পিরিয়ড সম্পর্কে সঠিক ধারনা বা এইসময়ের কষ্ট টা এরা জানতো, এইসব দিনকে, কোন নোংরা দিনের আখ্যা দেওয়ার বোধ, বোধহয় কোন দিনেই উৎপন্ন হতো না।
তখন ঘরে মা, বোন, বউ, বৌদির এইসব দিনে, কাজের ফরমায়েশ না দিয়ে, যদি একটা কাজ এগিয়ে দেওয়া, কিংবা বিছানায় কাতর শরীরে তাকে গরম পানির ব্যাগ এগিয়ে দেওয়া যায়, সেটাই বোধহয় সত্যিকারের পুরুষত্ব।
মেয়েকে পিরিয়ডের দিনে কষ্ট পেতে দেখে, অন্যদিকে ফিরে, দেখেও না দেখার ভান না করে, মাথায় হাত বুলিয়ে পানির গ্লাস দেওয়া, লজ্জা পেতে না শিখিয়ে এইটা স্বাভাবিক একটা কথা, শিখিয়ে নির্দ্ধিধায় কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলার অভয় দেওয়াটায়, কিংবা বউ কে পিরিয়ডের দিনে ঘর মুছার হুকুম না দিয়ে, দুই বেলা ফল আর গরম দুধ খাওয়ার হুকুম দেওয়ায় বোধহয় আসল মাতৃত্ব।
পিরিয়ড মেয়েদের জীবন প্রতিমাসের একটা আতংকের দিন, অসহ্য তীব্র যন্ত্রনা সহ্যের দিন। এইটা কোন নোংরা দিন নয়, কিংবা লজ্জিত হওয়ার দিন নয়। এই দিন গুলোর কাছে ঋণী পুরো বিশ্বের মানব সমাজ, এইসব কষ্টের দিন কে আবর্তন করে ঘুরছে, কিন্তু এই পুরো মানব সভ্যতা।
এইটায় নতুন করে জানতে শিখুন, মানতে শিখুন। শুধু পুরুষেরা নয় । ডিগ্রির ভরে নিজেকে শিক্ষিত ভাবা অনেক নারীও এখনো পিরিয়ড নিয়ে আলোচনা কে সমাজের বির্তকিত বিষয় বলে মনে করে।
তারা প্লিজ নিজের মেয়ে সন্তান কে অভয় দিন আর ছেলে সন্তান দের সঠিক ধারণা। সমাজ তো এক দিনে বদলায় না। বদলায় ঘর থেকে। এই এই বদলানোর ভূমিকা পালনে মা ছাড়া সেরা যোদ্ধা আর কেউ বোধহয় হতে পারে না।
Writer:- দোলনা বড়ুয়া তৃষা