ইতিহাস হল এমন এক স্মৃতি যা পড়লে পিছনের কথাগুলো স্মরণ হয় এবং আশ্চর্যজনক কথাগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ঠিক আজকে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা করছি যার জীবনী অনেকের কাছে অজানা। তিনি হলেন ' সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্স'।
.
রুকনুদ্দিন বাইবার্স শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। মিসরের সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবীর কথা আমরা অল্পবিস্তর জানি। কিন্তু আমাদের কাছে গোপন হয়ে আছে সুলতান রুকুনদ্দিন বাইবার্সের বীরত্বপূর্ণ জীবন ও কথা। অনেকেরই অজানা।
.
রুকনুদ্দিন বাইবার্স ১৯ জুলাই ১২২৩ সালে কিপচাক উপত্যকার (বর্তমান কাজাখস্তান) কুমান গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। কিপচাক উপত্যকায় যাযাবর সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করত। তারা ছিল কর্মঠ, নিষ্ঠাবান ও তেজস্বী। তাই দেহরক্ষী হিসেবে কিপচাক উপত্যকা থেকে দাস কিনে আনতেন সে সময়কার রাজা বাদশারা। যাদের কিনে প্রশিক্ষণ দিতেন তাদের মামলুকরা। সবকিছুতে পারদর্শী ছিলেন মামলুক যোদ্ধারা। তাদের তলোয়ার চালানো ছিল অন্য সবার থেকে আলাদা।
.
হঠাৎ এক দিন কিপচাক উপত্যকায় অতর্কিত হামলা করে চেঙ্গিস খানের গড়া মোঙ্গল বাহিনী । এই বাহিনী মুসলিমদের ওপর হামলা করত, জুলুম-নির্যাতন করত। পুরুষদের হত্যা আর মেয়ে ও শিশুদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দিত। সে সময় বাইবার্সের বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। মোঙ্গলরা ছোট্ট বাইবার্সকে দামেস্কে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয় মাত্র ৮০০ দিরহামে। তাকে মামলুক হিসেবে কেনেন ‘আলাউদ্দিন আইতাকিন বান্দুকদার’।
.
ছোট্ট বাইবার্স এখন আর ছোট নেই। তিনি বড় হলেন, দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করলেন, তিনি অত্যন্ত সাহসী ছিলেন, দুই ঘোড়ার পিঠে দাঁড়িয়ে তীর ছোড়ায় পারদর্শীও ছিলেন, তিনি যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে ক্রুসেডার ও মোঙ্গলদের কাছে ত্রাস হয়ে ওঠেন।
.
মোঙ্গলরা সব যুদ্ধে জয়ী হলেও, সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্সের কাছে পরাজিত হতো। মোঙ্গলরা প্রথম পরাজয় বরণ করে ঐতিহাসিক 'আইন জালুত ' যুদ্ধ দিয়ে। আইন জালুত ছিল পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেওয়া এক লড়াই। এই লড়াই ছিল মোঙ্গলদের কাছ থেকে মুসলিমদের প্রথম বিজয় এবং ইতিহাসের বাঁকবিন্দু।
.
অন্যদিকে ক্রুসেডাররা যখন পুরো আরবকে আস্তে আস্তে দখল করতে চক্রান্ত করছে, তখন উত্থান হয় বাইবার্সের। ১২৬০ সালের পর চারদিকে মোঙ্গল-ক্রুসেডারদের কাছে বাইবার্স হয়ে যায় অপ্রতিরোধ্য।
.
হালাকু খান ছিলেন মোঙ্গল শাসক। তিনি তোলুইয়ের ছেলে এবং মোঙ্গল বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা চেঙ্গিস খানের নাতি।
.
হালাকু খান ১২৫৮ সালে বাগদাদে মুসলমানদের ওপর হামলা চালায়। এবং ১০ লাখ মানুষকে হত্যা করে বাগদাদ শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। বাগদাদ ছিল ইসলামি সভ্যতা, খিলাফত, জ্ঞানচর্চা ও সংস্কৃতির প্রতীক। কিন্তু মোঙ্গলরা মুসলমানদের জ্ঞান আহরণের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি বাইতুল হিকমাহ ধ্বংস করে দেয়। মোঙ্গল বাহিনী মানুষের ওপর এত বেশি নৃশংসতা চালিয়েছিল, ফোরাত নদীর পানি লাল হয়েছিল এবং ওই নদীর ওপর তৈরি হয়েছিল বই পোড়ানো ছাইয়ের স্তূপ। তবে বাইবার্সের যুদ্ধ এবং কৌশলে বাগদাদ পুনঃউদ্ধার হয়। এর মধ্য দিয়ে সুলতান বাইবার্স পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে যান আব্বাসী খিলাফতের।
১ জুলাই ১২৭৭ সালে এই মহান বীরের জীবনাবসন হয়। মোট তিনি বেঁচে ছিলেন ৫৪ বছর। তিনি দেখিয়েছেন মুসলিমরা মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার জাতি। মিসরের সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবীর পর মামলুক সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্সকে দ্বিতীয় স্থান দেওয়া হয়।
Writer:- মুহাম্মদ জুহাইর