> চন্দ্ররাতের মায়া পর্ব ১, ৪
-->

চন্দ্ররাতের মায়া পর্ব ১, ৪

- আমার পেটের বেবিটা মনে হয় আর বেঁচে নেই তীব্র।

মাঝরাতে শরীর ঝাকিয়ে ডেকে তুলে আমার স্ত্রী নন্দিতা কথাটি বললো।আমার ঘুমঘুম চোখে ওর দিকে তাকিয়ে অনেকটা রেগে গিয়েই বললাম

- এসব কি কথা বলছো নন্দিতা?

- আমি সত্যিই বলছি।বেবিটা নড়াচড়া করছে না গতকাল থেকে।

এবার আমি একটু অবাক হলাম।বিছানায় বসে চশমাটা চোখে দিলাম।নন্দিতা কাঁদো কাঁদো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি পর পেটে কিছুক্ষণ হাত দিয়ে দিয়ে রাখলাম।মুহুর্তেই আমার শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।সারা শরীর দিয়ে ঘাম ঝরতে থাকলো।নন্দিতা ঠিকই বলছে।পেটের বেবি টা সত্যি'ই নড়াচড়া করছে না।নন্দিতা কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো

- ওরা আবার আমার বেবিটাকে মেরে ফেলেছে তীব্র,ওরা আবার আমার সন্তানকে মেরে ফেলেছে

বলেই আমায় জরিয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।আমি কাঠ হয়ে বসে রইলাম।আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না।নন্দিতার কান্নার শব্দে সারা বাড়ির লোকজন জেগে গেলো।বাবা,মা,বড় ভাই,ভাবী সবাই আমার রুমে আসলো।ভাবী এসে নন্দিতাকে ধরে বললো

ভাবী- কি হয়েছে নন্দিতা? কাঁদছিস কেনো?এই অবস্থায় কাঁদা তো ঠিক না,এতে বেবির সমস্যা হবে তো বোন

মা- কি হয়েছে বৌ মা? এতোরাতে কাঁদছো কেনো? বলো আমাদের? তীব্র কিছু বলেছে? 

বাবা- তীব্র কি হয়েছে রে? বৌমাকে কিছু বলেছিস নাকি?

সবার প্রশ্ন যেনো আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। এখন আমি কিছুই ভাবতে পারছি না।ভয়ে আমার শরীর হিম হয়ে আসছে।নিজের সন্তানকে এভাবে প্রত্যকবার হারানো একটা বাবার কাছে যে কতোটা কষ্টদায়ক সেটা একজন বাবাই জানেন।নন্দিতা ভাবীকে উদ্দেশ্য করে কান্না করতে করতে বললো-

- ভাবী,আমাদের বেবি আর বেঁচে নেই,

কথাটা শুনে মা,বাবা,ভাইয়া,ভাবী সবাই চমকে উঠলো।মা কান্নামিশ্রিত  কন্ঠে  বললেন-

- কি বললে বৌ মা? আমার দাদুভাই আর নেই মানে, কি অলক্ষুণে কথা বললে তুমি? 

ভাবী- নন্দিতা শান্ত হয়ে বোস তো। কিভাবে বুঝলি বেবিটা বেঁচে নেই? 

নন্দিতা- ও নড়াচড়া করছে না ভাবী।কাল সকাল থেকে ও নড়াচড়া করা বন্ধ করে দিয়েছে।আমি ভেবেছিলাম পরে ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু এখন"

নন্দিতার কথা শুনে ভাবী নন্দিতার পেটে কিছুক্ষণ হাত রাখলেন।রেখেই চোখ সংকুচিত করে ভাইয়ার দিকে তাকালেন।এর অর্থ নন্দিতা যা বলছে সেটা সত্যি।
ভাইয়া বলে উঠলেন-

- ওসব চিন্তা ভাবনা বাদ দাও,ওই রকম কিছুই হয় নি। তোমরা মিছেই চিন্তা করছো।আমি এমবুলেন্স কে ফোন করছি।মেডিকেলে পরিক্ষা করলেই বুঝা যাবে আসল সত্যি কি। কিরে তীব্র তুই কিছু বল? 

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম

- হ্যা,?হ্যা হসপিটালে নিয়ে গিয়ে পরিক্ষা করলেই সব বুঝা যাবে।

ভাইয়া এম্বুলেন্স কে ফোন করলো।আমি নন্দিতার মাথায় হাত বুলাচ্ছি আর ওকে শান্তনা দিচ্ছি।ভেতরে ভেতরে আমার আবারো সেই অজানা ভয় কাজ করা শুরু করে দিয়েছে।মা দরজার কাছে গিয়ে কান্না করছে আর বলছে

- সব এই অপয়া মেয়েটার দোষ।ও আমার ছেলেটার জীবনে একটা খুশির সংবাদ এনে দিতে পারলো না।অলক্ষুণে মেয়ে।বিয়ের সময় বার বার বলেঋিলাম এই মেয়েকে বিয়ে করিস না,একে দেখে আমার সুবিধার ঠেকছে না।এখন হলো তো? সর্বনাশের কিছু বাকি রইলো? এক বার নয় দুই বার নয়,,তিন তিন বার।এই নিয়ে তিনবার হলো বাচ্চা নষ্ট হওয়ার।এই সব এই কুলাঙ্গার মেয়ের দোষ।

মাকে উদ্দেশ্য করে বাবা বললেন-

- তুমি চুপ করবে? এখন এসব কথা না বললেই কি নয়?একে দেখছোই এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে কিসের কি তুমি শান্তনা দিবে তা না করে উল্টো পাল্টা বকে যাচ্ছো।

- তুমি চুপ থাকো।ওই অপয়া মেয়ের দিকে হয়ে কথা বলবে না একদম।ওই মেয়েকে আমি আর বাড়িতে রাখবে না।আমার ওমন সুন্দর একটা ছেলের জীবন এই মেয়ের পাল্লায় পড়ে নষ্ট হতে দিবো না। আমি তীব্র কে আবার বিয়ে করাবো।

- ইউ ব্লাডি ও-ম্যান, 

কথাটি বলেই বাবা মায়ের দিকে তেড়ে গেলো।ভাইয়া তখন বাবাকে থামিয়ে দিয়ে মা কে বললো  "মা তুমি প্লিজ এখন চুপ করো।এসব কথা এখন বলার মানে হয় না"। বাইরে সাইরেন বাজার শব্দ হচ্ছে।নন্দিতাকে এম্বুলেন্সে তুলে আমি ভাইয়া আর ভাবী গেলাম সাথে। বেডে আধশোয়া হয়ে আছপ নন্দিতা।তার পাশেই বসে আছি আমি।ও অনবরত কেদেই চলেছে।আমি ওর হাত শক্ত করে ধরে বসে আছি।নন্দিতা আমার দিকে করুন দৃষ্টি নিয়ে বললো

- তীব্র, আমি তোমায় কখনো বাবর সুখ দিতে পারবো না।তুমি আবার বিয়ে করে নাও প্লিজ।আমার জন্য তোমার কষ্ট আমি মেনে নিতে পারছি না।

- প্লিজ নন্দিতা চুপ করো তুমি। ডাক্তাররা এখনি চলে আসবে।রিপোর্ট আসলে দেখা যাবে আমরা যেমন ভাবছি তেমন কিছুই হয় নি।তুমি মনে সাহস রাখো।

- কিছুই ঠিক হবে না তীব্র। আমি জানি

- কি জানো তুমি? 

- আমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম গত পরশুদিন 

- কি স্বপ্ন? আগে তো বলোনি

- আগে বলিনি কারন তোমার মন খারাপ হবে এজন্য বলিনি

- এখন বলো,কি দেখে ছিলে স্বপ্নে তুমি?

- আমি দেখলাম একটা বাচ্চা মেয়ে আমার চার দিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে।  মেয়েটার পরনে শাদা ধবধবে একটা ফ্রগ ছিলো।চোখ দুটি নীল।কি সুন্দর চুল। একটা প্রজাপতির পেছন পেছন ছুটে বেড়াচ্ছে।

- আর কি? 

- আর মেয়েটা হঠাৎ হঠাৎ আমার দিকে তাকাচ্ছে আর মা,মা বলে ডাকছে।আর আমি প্রত্যেকবার তার মা ডাকে চমকে উঠছি,।তখনই

নন্দিতা থেমে গেলো।হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বললো কিছুনা,বাদ দাও।আমি জোর করে বলতে বললাম-

-তখনই? তখনই কি নন্দিতা? 

- তখন কোথা থেকে যেনো তুমি এলে।মেয়লটা তোমায় দেখে বলতে লাগলো মা, আমায় বাঁচাও মা,মা ওই লোকটা আমায় নিয়ে যেতে এসেছে মা।প্রত্যেকবার এই লোকটাই আমায় মেরে ফেলে মা।আমার তুমি বাঁচাও। 

- আমায় দেখে মেয়েটা এরকম বললো?

- হুম

- তারপর? 

- তুমি এসে মেয়েটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছো।আমি শত চেষ্টার পরেও আটকাতে পারছি না।তোমার পা ধরে ওকে ভিক্ষা চাইলাম, তুমি আমায় লাথি মেরে ওই মেয়েটাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছো।আমি মাটিতে পড়ে কাঁদতে লাগলাম।তুমি তখন মেয়েটাকে নিয়ে যাচ্ছো বর বলছো," আমি থাকতে তোর কোনো সন্তান হতে দিবো না আমি।এবারেও মেরে ফেললাম।বলেই একটা বিকট হাসি দিলে"

নন্দিতা এবার বলা শেষ করে আমায় জরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কেনো নন্দিতা এরকম স্বপ্ন দেখলো।আর কেনোই বা আমায় সেখানে এরুপ পাষানের মতো কাজ করতে দেখলো।আমিই কি না প্রত্যেকবার নিজের সন্তানকে মেরে ফেলি?।ভাবনার অবসান ঘটিয়ে ডাক্তার আসলো।তারা নন্দিতাকে নিয়ে গেলো এক্স রে করাতে।নিয়ে যাওয়ার সময় নন্দিতা আমায় দেখে আনেক কাদলো।আমি শুধু তাকে অভয় দিলাম, "সব ঠিক হয়ে যাবে" কথাটা বলে।আমি আর ভাইয়া বাহিরে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

মনে মনে ভাবলাম পুরনো সেসব কথা। আমাদের বিবাহের সাত বছর অতিবাহিত হয়েছে।এই নিয়ে তিনবার নন্দিতা সন্তানসম্ভবা হলো।কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রত্যেকবারই কোনো না কোনো ভাবে আমাদের সন্তানটা নষ্ট হয়ে যায়।প্রথমবার সে একটা মৃত শিশু জন্ম দিলো।এরপর জন্মের পর কাছে গিয়ে দোলনায় দেখলাম কোনো সন্তান নেই। আর এখন!! 
এর ব্যাখ্যা আমাদের কাছে আজো নেই।

ডাক্তাররা রিপোর্ট দেখতে গিয়ে মনে হলো চরম আতঙ্কে পড়ে গেলেন।তারাও হাতের পিঠ দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে নন্দিতার দিকে ভীতু নজরে তাকালো।

এরপর আমায় সাইডে এনে বললেন- 

- মিঃতীব্র,আপনার স্ত্রীর পেটে কোনো সন্তান নেই।কখনো ছিলোও না।


- মিঃতীব্র,আপনার স্ত্রীর পেটে কোনো সন্তান নেই।কখনো ছিলোও না।

তীব্র অনেকটা চমকে উঠলো। এটা কিভাবে সম্ভব? নন্দিতা তো সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা।ওরা সবাই এতোদিন এটাই জানতো যে নন্দিতার গর্ভে তীব্রর সন্তান বেড়ে উঠছে।ডাক্তারের কথায় তীব্র ক্ষিপ্র কন্ঠে বলে ওঠে-

- আপনারা এসব কি বলছেন ডাক্তার সাহেব? আমার স্ত্রী গর্ববতী।আর আপনারা কি না বলছেন তার পেটে কোনো সন্তান নেই। 

- দেখুন মিঃতীব্র আমরা ডাক্তাররা কখনো শুধু কথায় বিশ্বাসী না।আমরা সবসময় রিপোর্টে বিশ্বাসী হই।

- রিপোর্টে কি লেখা? 

- আপনি নিজেই দেখুন।তাহলে নিজেই বুঝতে পারবেন। 

কথাটা বলে ডাক্তার সাহেব তার হাতের রিপোর্টটা তীব্রকে দেয়।তীব্র হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো রিপোর্টের পানে।এই জীবনে এতোটা বিষ্ময় হয়তো সে হয়নি।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগলো।চোখের চশমাটা হাতে নিয়ে পাঞ্জাবির পকেটের কাছে হাল্কা  স্লাইড করে পরিষ্কার করে আবারো চোখে দিয়ে রিপোর্টের দিকে তাকালো। নাহ্,রিপোর্ট সে প্রথমে যেটা দেখেছিলো সেটাই আছে।রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা,প্রেগন্যান্সি কোয়ালিটি নেগেটিভ। তীব্র কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মনে মনে ভাবছে,তাহলে এতোদিন ধরে নন্দিতার গর্ভে কি বেড়ে উঠছে? ওর গর্ভে কি আমার সন্তান বেড়ে উঠছে না? সেখানকার একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে সে।হঠাৎ ফোনে রিং বেজে উঠলো।ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো-

- তীব্র? 

- হ্যা বাবা বলো

- বউমার কি অবস্থা? আমাদের তো জানালেও না,আমরা কতোটা চিন্তায় আছি

- বাবা একটা বিরাট সর্বনাশা কান্ড ঘটে গেছে 

- কি হয়েছে?তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন তিব্র? বউমা ঠিক আছে তো? কি হলো চুপ করে আছো কেন? 

- বাবা,এতোদিন আমরা যা ভেবেছিলাম তা সম্পুর্ন মিথ্যে ছিলো

- কিহ্? কোনটা মিথ্যে ছিলো?

- নন্দিতার গর্ভে কোনো সন্তান নেই বাবা।ডাক্তাররা আলট্রাসনোগ্রাফি করে দেখেছে ওর পেটে কোনো বাচ্চা নেই।

কথাটা শোনা মাত্র শেখর চৌধুরী থম মেরে কানে ফোন ঊরে দারিয়ে রইলো।তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুচ্ছে না।তার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে মিসেস রামেয়া চৌধুরী বললেন

- তীব্র কি হয়েছে রে?কি বললি তোর বাবাকে?উনি এভাবে ভয় পেয়ে গেলেন কেন? 

- সেটা বাবার কাছেই শুনে নিও মা।এখন রাখি

টুট টুট শব্দে ফোনটা কেটে দিয়ে মাথায় হাত রেখে বসে রইলো তীব্র।রিপোর্টটা হাতে নিয়ে বসে থাকা ঠিক হবে না।ভাইয়া,ভাবিকে জানা দরকার ঘটনাটা।এক পা দু পা করে সে তার স্ত্রীকে যে রুমে রাখা হয়েছে সেখানে গেলো।গিয়ে দেখলো নন্দিতা একাই শুয়ে আছে।তার ভাবীকে দেখা যাচ্ছে না।তীব্র নন্দিতার কাছে গেলো।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো

- নন্দিতা তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে? 

- না,হচ্ছে না (মলিন কন্ঠে বললো)

- ভাবী কোথায় নন্দিতা?

- জানিনা তো,আমি তখন থেকে এখানে একা-একা শুয়ে আছি

- কি বলছো।ভাবী ছিলো না রুমে?কোথায় গেলো ভাবী?ওয়াসরুমে নেই তো?

- ওখানে নেই।থাকতে তো এতোক্ষন থাকার কথা না

- নন্দিতা তোমাকে একটা সংবাদ দেওয়ার আছে।আমি নিজেও বিষয়টা মানতে পারছি না এখনো।আদৌ এরকম ঘটনা কখনো ঘটেছে কিনা জানিনা আমি।

- কি হয়েছে তীব্র,আমার সন্দেহ কি ঠিক? 

বলেই নন্দিতার চোখের কোনে জল চলে এলো।এই অবস্থায় যদি ওকে বলি যে তোমার গর্ভে কোনো সন্তান আদৌ ছিলো না,তাহলে সে এই ব্যাথা সইতে পারবে না।বরং ওকে পড়ে জানাই বিষয়টা।অনেক মিথ্যে অজিহাত দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে অন্য কথায় ফাঁদে ফেলিয়ে তীব্র এই ভয়ংকর সত্যটা নন্দিতাকে জানালো না।

তখনি কোথা থেকে যেনো ভাবী তোরজোর করে ছুটে এসে আমায় বললো-

- তীব্র ডাক্তার সাহেব তোমায় ডাকছে।

- তুমি কোথায় ছিলে ভাবী?নন্দিতাকে এভাবে একা রেখে?

- ডাক্তার এই ঔষধ গুলি আনতে বলেছিলো।তুমি তো কোথায় যেনো ছিলে,তোমার ভাইয়াও নেই।তাই বাধ্য হয়ে আমিই নিয়ে আসলাম।

- ও আচ্ছা। তুমি এখানে ওর সাথে থাকো।আমি শুনে আসি ডাক্তার কি বলে।

রুম থেকে বেড় হয়ে ডাক্তারের কেবিনে গেলাম।দরজায় কড়া নাড়লাম -

- ডাক্তার সাহেব আসতে পারি?

- হুম আসুন

তীব্র ভেতরে ঢুকে চেয়ারটায় বসলো।রুমে ফিনাইলের তীব্র গন্ধ নাকে আসছে।ডাক্তারের দিকে চোখ পড়তেই তীব্র লক্ষ করলো ডাক্তার আলোয় কি যেনো একটা ফেলে গভীর মনোযোগ দিয়ে ইকুয়েশন করছে।তীব্র হাল্কা কাশি দিয়ে নিজের উপস্থিতি বোঝাতে চাউলেও ডাক্তারের সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ ই নেই।তিনি বারবার টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ মুছছেন। তাকে অনেক চিন্তিত,এবং হতাশ লাগছে।তবে কি ডাক্তার নন্দিতার বিষয়ে কোনো জটিল বিষয়ে কথা বলবে?সেটাই এতো মনোযোগ দিয়ে ইকুয়েশন করছে?। তার চিন্তার অবসান ঘটিয়ে ডাক্তার বললেন-

- মিঃতীব্র,আপনি তো মিস নন্দিতার হাসবেন্ড তাই না?

- জ্বি

- আমরা তার পেটে একটা অস্বাভাবিক কিছুর উপস্থিতি লক্ষ্য করছি। 

তীব্র একটু ভয় পেয়ে গেলো।বিষন্ন কন্ঠে বললো

- কিরকম অস্বাভাবিক ডাক্তার সাহেব ? 

- গর্ভে শিশু থাকলে যেরকম একটি মাংসপিণ্ড বুঝা যায়,সেরকম একটি বস্তু আপনার স্ত্রীর পেটে রয়েছে।

তীব্র চেয়ার থেকে দারিয়ে চরম উত্তেজনায় ফেটে পড়ে ডাক্তারের দিকে অনেকটা ঝুকে বললো

- তাহলে কি ডাক্তার সাহেব নন্দিতার গর্ভে আমার সন্তান আছে?

- আমাদেরও তো সেরকমই মনে হচ্ছে। আমাদের জীবনে এটাই প্রথম ঘটনা।

তীব্র ডাক্তারের সাথে কথা বলছে এমন সময় হঠাৎ ভাবী এসে তীব্রকে বললো,

- তীব্র,মা বিষ খেয়েছে।


- মা বিষ খেয়েছে মানে?কি বলছো তুমি ভাবী? 

- হ্যা, সত্যিই মা বিষ খেয়েছে। বাবা এখনি ফোন করে বললো।

- মা এখন কোথায়?

- বাবা বললো এখানে নিয়ে আসছে।

- ভাবী আমি আর পারছি না।এইদিকে এই চিন্তা আবার ওদিকে মা এরকম একটা কাজ করে বসলো।আমি পাগল হয়ে যাবো ভাবী,আমি পাগল হয়ে যাবো

- তুমি চিন্তা করোনা।সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি দেখি ওরা এখন কোথায়।তুমি ডাক্তারের সাথে কথা বলো

- চলো আমিও যাবো।

ডাক্তারের রুম থেকে বেড় হতেই ডাক্তার বললো,"মিঃতীব্র, আপনার স্ত্রীকে অপারেশন করাতে হবে খুব শীঘ্রই। সেটার বিষয়ে বলে যান"। তীব্র মাথা ঘুরিয়ে শুধু বললো " যদি অপারেশন করা লাগে তাহলে করুন।আমার স্ত্রীর যেনো কোনো ক্ষতি না হয়।আর হ্যা,আমি আসার পর তবেই করবেন"।

বলেই রুম থেকে বেড় হয়ে গেলো।বেড় হতেই তীব্রর বাবা শেখর চৌধুরীর সাথে মুখোমুখি দেখা।তীব্র মূহুর্তেই বললো

- বাবা, মা কোথায়? 

- এতো অস্থির হওয়ার কিছু নেই তীব্র। তোমার মা'কে ওটিতে নিয়ে গেছে।তেমন বিষক্রিয়া ছড়াতে পারেনি।ওই মহিলা কি খেয়েছে শুনতে চাও?

- কি খেয়েছে?

- গত পরশুদিন আমি যে আরশোলা মারার বিষ এনেছিলাম সেটা খেয়েছে।একটু মুখে ঢেলে দিতেই আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই।তারপর এখানে নিয়ে আসলাম।গাধা মহিলা

ভাবি- কিন্তু মা বিষ কেন খেতে গেলো? 

বাবা-কেন আবার।আমার বিপক্ষে চলতে হবে না? আমি ভাবলাম পরিবারে অশুভ ছায়া নেমে এসছে।একটা পূর্ণ্যর কাজ করা দরকার।অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম প্রাইমারি স্কুলের পাশে যে পুকুরটা আছে,ওটা ভরাট করে ওখানে একটা বৃদ্ধাশ্রম তুলে দিবো।

ভাবি- এজন্যই বিষ খেলো?

বাবা- হ্যা।গাধা মহিলা বলে কিনা কোনো বৃদ্ধাশ্রম হবে না।এভাবে দু,এক কথা হতে হতে সে বিষ খেয়ে নিলো।এসব বাদ দাও।বৌ'মার কি খবর তীব্র?

- বাবা ডাক্তার বলেছে ওর অপারেশন করাতে হবে যত তারাতাড়ি সম্ভব। সেই বিষয়েই কথা বলছিলাম তখন ভাবী এসে বললো মা বিষ খেয়েছে। 

- এখন যাও ডাক্তারের সাথে কথা বলো তুমি।আমি এদিকে আছি।

তীব্র কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়ে পুনরায় ডাক্তারের ঘরে গেলো।দরজায় কড়া নাড়তেই ডাক্তার সাহেব একটা বইয়ে চোখ রেখেই বললো " ইয়েস কাম "

- ডাক্তার সাহেব,অপারেশনটা কি এখনি করাবেন? 

- হুম,যত সময় যাবে ব্যাপারটা তত জটিল হবে।বাই দ্যা ওয়ে।আপনার স্ত্রীর রিপোর্টটা এসে গেছে।ওনার পেটে  টিউমার হয়েছে।তাও একটা না,দু দুইটা।রীতিমতো সেগুলা অনেক বৃহদাকার ধারন করেছে।এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।

তীব্র ডাক্তারের কথা শুনে তীব্র চমকে উঠলো। নন্দিতার পেটের টিউমারকে এতোদিন নিজের সন্তান ভেবে রেখেছিলো সে।অজান্তেই চোখের কোন বেয়ে অশ্রু গাল বেয়ে মাটিতে পড়লো।হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে করুন স্বরে বললো-

- নন্দিতার পেটে দু,দুটো টিউমার? 

- হুম

- হায় রে ভাগ্যর পরিহাস।আমরা ভেবে বসলাম

- আমার একটা কথা বিশ্বাস হচ্ছে না মিঃতীব্র।এতে বড় ভুল আপনারা করলেন কিভাবে? সন্তান গর্ভে ধারনের ব্যাপারটা আর টিউমার ধারনের ব্যাপারটা তো একই না।এই পার্থক্যটুকু কি মিস নন্দিতা বুঝতে পারেনি?

- আমি জানিনা ডাক্তার সাহেব। 

- সেসব বাদ দিন।হিউম্যান নিউরন অনেক পাওয়ারফুল একটা জিনিস বুঝলেন। আপনি যদি দৃঢ় ভাবে ভেবে বসে থাকেন যে আপনার ডান হাত অবশ হয়ে আছে।তাহলে দেখবেন আপনি সত্যিই হাত নাড়াতে পারছেন না।আমার মতে মিস নন্দিতার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।মানষিক ভাবে তিনি দূর্বলচিত্তের।চা খাবেন? 

- না, চা খাবো না।আপনারা তাহলে অপারেশনের ব্যাবস্থ করুন।

- হুম

- ডাক্তার, আমার স্ত্রীর কি কোনো সমস্যা হবে? আই মিন সে সুস্থ হবে তো?

- হ্যা,আমরা আশাবাদী। বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে। 

- আমি তাহলে আসি।

-হ্যা আসুন।আর কাউন্টারে পঞ্চাশ  হাজার টাকা জমা করুন।আমরা ব্যাবস্থা করছি

- জ্বি আচ্ছা 

বলেই রুম থেকে বেড় হয়ে আসলো তীব্র।নন্দিতার কাছে যেতেই দেখলো সেখানে বাবা,ভাইয়া,ভাবী সবাই। ওদের দেখে নিজের মনে কিছুটা সস্তির আভাস ফুটে উঠলো।মৃদু স্বরে সবার উদ্দেশ্য বললো-

- বাবা,ভাইয়া,ভাবী তোমরা একটু বাইরে যাবে প্লিজ?আমার কিছু কথা ছিলো

ভাবী- হ্যা বলো বলো।আমরা বাইরেই আছি।

সবাই বাইরে গেলে তীব্র নন্দিতার কাছে বসলো।পর কপালে হাত বুলিয়ে দিলো।কপালে একটা ভালোবাসার ছোঁয়া একে দিয়ে কাছাকাছি বসলো।নন্দিতা তীব্রর গালে আলতো ভাবে হাত রেখে করুন স্বরে বললো

- তুমি খেয়েছো? সকাল থেকে কিছুই খাওনি তাই না? এভাবে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বা।

- আমি সুস্থই আছি নন্দিতা।শুধু তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো প্লিজ 

বলেই নন্দিতাকে জরিয়ে ধরে কান্না করছে তীব্র। তার ধৈর্য্যর বাধ ভেঙ্গে গেছে।নন্দিতা ওর চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো

- এই পাগল,কি হয়েছে? কাঁদছো কেনো? 

- তোমাকে অনেক ভালোবাসি গো,তোমার কিছু হলে আমি সহ্য করতে পারবো না।মরে যাবো আমি।

তীব্রর এরুপ আচরনে নন্দিতার চোখে জল চলে এলো।সে মৃদু স্বরে তীব্রর কানে কানে বললো

- একবার যখন হাত ধরেছি,তখন মরনের আগ পর্যন্ত ছাড়বো না।তুমি শুধু এভাবেই আমায় ভালোবেসো।

এখন বাজে দুপুর বারোটা।নন্দিতাকে অপারেশন করানোর জন্য ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।তীব্র এক মূহুর্ত স্থির নেই।এখানে,ওখানে পায়চারি করছে আর বিড়বিড় করে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছে।শেখর চৌধুরী বসে আছে চিন্তিত গম্ভীর মুখ নিয়ে।তিনি গালে হাত রেখেই তীব্রকে বললো

- তোমার ভাই,ভাবী কোথায় তীব্র? দেখতে পাচ্ছি না যে

- বাবা ওরা বাসায় গেছে।মাঝরাত থেকে ভাবীর ঘুম হয়নি। মাথা ধরেছে।তাই ভাইয়াকে বলে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। 

- ও আচ্ছা। তুমি খেয়েছো?

- হুম

- মিথ্যে বলো কেন,যাও কিছু খেয়ে এসো নিচ থেকে।আমি আছি এখানে,কিছু প্রয়োজন হলে তোমায় ডেকে নিবো

-আমি থাকি না বাবা। খাওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই।নন্দিতার ভালোয় ভালোয় অপারেশনটা হলেই হয়

ছেলের এই ভালোবাসায় শেখর চৌধুরী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন।মনে মনে ভাবলেন,ছেলেটা দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে।

__________

ডাক্তার সিহাব অপারেশন থিয়েটারে অপারেশন শুরু করে দিয়েছে।তার একটা আলাদা ফোন থাকে সাথে সবসময়। খুবই প্রয়োজন না হলে সেই ফোনে ফোন দেয় না কেউ।এই নাম্বারটাও সবার কাছে নেই।তার খুব কাছের পরিচিত এবং হসপিটালের কিছু স্টাফের কাছে নাম্বারটা দেওয়া আছে।বারবার করে বারন করা আছে,সেই নাম্বারে ফোন দেওয়ার কারনটা হবে মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ।কেননা সেই নাম্বারে ফোন দিলে ডাঃ সিহাবকে ধরতেই হবে। সেই মিনি ফোনটা পকেটে বাজতে থাকলো।

ডাঃসিহাব সাইডে এসে রিসিভ করতেই একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসলো-

- কেমন আছেন ডাঃসিহাব? 

- কুশল বিনিময় না করে কাজের কথা বলুন

- আপনি এখন আমার হাতের পুতুল ডাঃ সিহাব। 

- রসিকতা করছেন?ফোন রাখুন।আমি এখন থিয়েটারে আছি।রসিকতার জন্য পরে দেখে নিবো আপনাকে।রাবিশ ওম্যান 

বলে ফোনটা কেটে দিয়ে পকেটে রাখতেই টুং করে একটা মেসেজের আওয়াজ আসলো।ওপেন করতেই দেখলো একটা ভিডিও। ভিডিওটা ওপেন করতেই ডাঃ সিহাব চমকে উঠলেন।সারা শরীর ঘামতে শুরু করে।যে নাম্বারে ফোন এসেছিলো সেই নাম্বারে ডাঃসিহাব ফোন করলো।ওপাশ থেকে ধরতেই অট্টহাসির আওয়াজ ভেসে এলো

- কি মিঃসিহাব।ভয় পেয়ে গেলেন? 

- কি চান আপনি?

- তেমন কিছুই না।এখন যে অপারেশনটা করছেন সেখানে হাল্কা একটা কাজ করতে হবে

- কি কাজ 

- আর কোনোদিন ও যেন নন্দিতা মা হতে না পারে,সেই ব্যাবস্থা করবেন আপনি

- কিহ? কি বলছেন এসব?একজন ডাক্তার হয়ে এসব আমি কখনোই করবো না।

- না করলে আমি কি করতে পারি,দেখাবো সেটা?

- নাহ্ প্লিজ,আমার মেয়েকে কিছু করবেন না।আমি করবো,যা বলবেন তাই করবে আমার মেয়েকে ছেড়ে দিন প্লিজ।


- আপনারা যা বলবেন আমি তাই করবো,আমার মেয়ের কোনো ক্ষতি করবেন না প্লিজ

- গুড।এমন ব্যাবস্থা করবেন যেনো নন্দিতা আর কখনোই মা হতে না পারে।আর যদি এর বেতিক্রম করেছেন তো নিজের মেয়ের মুখের বাবা ডাক শুনতে পারবেন না। গট ইট।

- আমি করবো।যা বলবেন তাই করবো।আপনারা আগে আমার মেয়েকে ছেড়ে দিন

- হা হা হা,যা বলেছি সেটা করবি,তা না করে তোর মুখে এতো কথা ফুটছে কেন? 

তখনই ডাঃসিহাব ফোনের অপর পাশ থেকে চিৎকারের আওয়াজ পায়।এটা যে তার আদুরে মেয়ের গলা সেটা বুঝায় অভিপ্রায় রইলো না।ডাঃসিহাব আকুতি-মিনতি করতে লাগলো-

- প্লিজ এরকম করবেন না।আমি আর কিছু বলবো না।

- গুড।কাজ শেষে তোর মেয়ে ঠিকি বাড়িতে পৌঁছে যাবে।

টুট টুট শব্দ করে ফোনটা কেটে গেলো।ডাঃসিহাবের সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। এটা কিভাবে করবে সে? এর মতো বড় পাপ যে আর হয় না।কিন্তু নিজের মেয়েকে বাঁচাতে এটা তাকে করতেই হবে।একরাশ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে অপারেশনটা শেষ করলো।নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানালো।আজ তার জন্য একটা মেয়ে মা ডাক শুনতে পারলো না,একটা ছেলে বাবা হতে পারলো না,বাবা ডাক শুনতে পারলো না।বাবা,মা ডাক শুনার মতো এতো সুন্দর অনুভূতি সে নিজের হাতে কেটে ফেললো।এই পাপ কিভাবে খেয়া করবে? এর শাস্তি যে তাকে পেতেই হবে।শুধু অপেক্ষা। 

অপারেশন শেষে নন্দিতার মায়াবী মুখখানা দেখে ডাঃসিহাব নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারলো না।অজ্ঞানরত নন্দিতার পা ছুঁয়ে বললো

- আমি অন্যায় করেছি আপনার সাথে।মাতৃসত্তাকে আমি শেষ করে দিয়েছি।একটা মেয়ের জীবনে সব থেকে বড় পাওয়া হলো সন্তানের মুখে মা ডাক শুনা।আমি সেই পথ আজ নিজ হাতে বন্ধ করে দিয়েছি।আমার কোনো ক্ষমা নেই।আমার কোনো ক্ষমা নেই।

কয়েক ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে নন্দিতার পায়ের ওপর পড়লো।ডাঃসিহাব স্বাভাবিক হয়ে  অ্যাফ্রোন দিয়ে বেড় হতেই দেখলো তীব্র দরজার সামনে দারিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে দারিয়ে আছে।তাকে দেখতে পেয়েই তীব্র বললো

- ডাঃ আমার স্ত্রী কেমন আছে?ও ঠিক আছে তো?

- আপনি চিন্তা করবেন না মিঃতীব্র। উনি একদম ঠিক আছে।এখন ঘুমাচ্ছে।ওনাকে এখন ডিস্টার্ব না করলেই ভালো হয়।

- ডাঃ আমি কি দেখতে পারি? আমি কোনো কথা বলবো না শুধু দেখবো

- হুম। 

নন্দিতাকে দেখার অনুমতি পেয়ে যেনো তীব্রর ভেতর খুশির বাঁধ ভেঙ্গেছে। সে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে ওটির ভেতরে গেলো।দূর থেকেই নন্দিতাকে দেখে চোখের জল বিসর্জন দিয়ে বাহিরে বেড় হয়ে আসে।বেড় হয়ে দেখে সামনের ওয়েটিং চেয়ার গুলিতে ভাবী বসে আছে। তীব্রকে দেখে সে বললো

- তীব্র, মা এখন সুস্থ।ডাক্তার রিলিজ করে দিয়েছে।দ্রুত ডাক্তারের কাছে আনায় তেমন বিষক্রিয়া ছড়াতে পারেনি। বাবা,মা নিচে আছে।তুমি ওনাদের নিয়ে বাড়িতে যাও,বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।সারারাত ঘুমাও নি।তোমার ঘুম দরকার 

- আমি যাবো না ভাবী।নন্দিতা জেগে উঠলে আমায় না পেলে মন খারাপ করবে।

- ডাক্তার বলেছে ১২ ঘন্টার আগে ওর ঘুম ভাঙ্গবে না।এতক্ষণ করবা কি? বরং তুমি যাও,আমি আছি এখানে।আসার সময় রহিমের মা কে বলে স্যুপ নিয়ে আসিও।নন্দিতাকে এখন বাইরের খাবার খাওয়ানো যাবে না।

- ভাবী, তোমাকে কি বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাবো

- এইই,আমি কি বাইরের কেউ নাকি হ্যা? এখন যাও তো।তেমাকে দেখে আমার হিংসা হয়,নন্দিতাকে কত্ত ভালোবাসো।আর আমারটাকে দেখো, সারাদিন ওয়েব সিরিজ,নাটকের শুটিং করতেই যায়।

- আচ্ছা ভাবী আমি আসি থাহলে।তুমি খেয়াল রেখো।

তীব্র নিচে আসতেই দেখলো তার বাবা শেখর চৌধুরী,মা রামেয়া চৌধুরী দারিয়ে আছে।তীব্র দৌড়ে গিয়ে তার মাকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।আর অভিমানী সুরে বলে " তুমি এমনটা কেন করলে মা,আমার কথা মনে পড়লো না? তোমাদের কিছু হলে আমি যে সহ্য করতে পারিনা"। ছেলের এরুপ মায়াবী ভালোবাসার সুর শুনে রামেয়া চৌধুরীর চোখে জল চলে এলো।

বাড়িতে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে তীব্র নাশতার জন্য নিচে আসলো।সকাল থেকে কিছুই পেটে যায়নি তীব্রর।সে নিচে এসে ডাইনিং টেবিল থেকে একটা আপেলে কামড় দিয়ে খাবার আনতে বললো।শেখর চৌধুরী খবরের কাগজ হাতে নিয়ে তীব্রর সাথেই টেয়ায়টায় বসলেন।খবরের কাগজ টেবিলে ঠাস করে রেখে তীব্রকে বলতে লাগলো

- দেশটার কি হচ্ছে দিন দিন? ছেলে-মেয়েরা নিজেদের বাবা-মাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে? তাহলে এই শিক্ষা দিয়ে করবেটা কি? যদি বৃদ্ধ বাবা মায়ের যায়গা না দিতে পারে,তেমন ছেলের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।পাষাণ হয়ে গেছে সবাই

- বাবা,তুমি এসব নিয়ে খেবে কিছু করতে পারবে?শুধু শুধু মাথা গরম করছো।

- করবো,আমাকে কিছু একটা করতেই হবে

- কি করবে শুনি?

- শোন তীব্র,আমাদের পুকুরটা ভরাট করে সেখানে বৃদ্ধাশ্রম করে দিতে কেমন হয়? কত অসহায় বাপ-মায়ের যায়গা হবে সেখানে ভাবো একবার?

- বাবা, তোমায় নিয়ে আমার গর্ব হয়।তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা।মানুষের জন্য এতোকিছু করেও তোমার শান্তি নেই।এই বয়সেও তুমি অন্যর কথা ভাবছো।

- ভাবতে হয় রে বাপ।সৃষ্টিকর্তা দিয়েছে, সেগুলো ভালো কাজে না লাগালে তাকে যে অপমান করা হবে

- আচ্ছা বাবা মা কোথায়,? এসব শুনে আবার বিষ খেয়ে বসলে কি করবে? হাহাহহা

- গাধা মহিলাকে জানাবো না।কথাটা আমাদের মধ্যে থাকবে,ওকে? ( ডান হাতটা তীব্রর দিকে এগিয়ে দিয়ে)

- ওকে।

- আরেকটা কাজ করো ঝটপট।ওই গাধা মহিলা আসার আগেই। তোমার বড় ভাইয়ার রুম থেকে লকারে রাখা দলিলটা নিয়ে আসো,দেখি ওখানে কতটুকু যায়গা আছে।

- ঘরে তো কেউ নেই।ভাবী হসপিটালে।ভাইয়া নতুন নাটকের শুটিং করতে ব্যাস্ত।না বলে যাওয়াটা কেমন দেখায় না বাবা? 

- ধুর,বড় ভাইয়ের ঘরে যাবে,সেখাবে এতো ভাবার কি আছে, যাও নিয়ে এসো।

তীব্র তার ভাইয়ার ঘরের দিকে গেলো।দরজা লক করা নেই।দরজাটা সামান্য আটকে রাখা।দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে লকারটা খুললো।এই লকারের একটা পিন আছে।যেটা শুধু শেখড় চৌধুরী, তীব্র আর তার ভাইয়া জানে।আর কেউ জানেনা। লকারটা খুলতেই সেখানে অনেক কাগজের মধ্যে সেই পুকুরের দলিলটা খুজতে বেশ সময় লেগে গেলো।অবশেষে খোঁজা খুজি শেষে দলিলটা পাওয়া গেলো।দলিলটা হাতে নিয়েই দলিলের ভাজ থেকে একটা পেনড্রাইভ ফ্লোরে পড়ে গেলো।

আরেহ? লকারের মধ্যে এই পেনড্রাইভটা কেন? এটাতো ভাইয়ার কম্পিউটারের সাথে থাকে সবসময়। এখানে তার করা শুটিং এর ভিডিওগুলি রেখে দেয়।এটা এখানে থাকার কথা নয় তো।

তীব্রর মনে একটু খটকা লাগলো।পেনড্রাইভে কি আছে সেটা দেখার প্রবল ইচ্ছে জাগলো।আবার অন্যর জিনিস দেখা কেমন এটা ভেবেও পিছুপা হচ্ছে। কিন্তু না মনকে মানাতে এর ভেতরে এমন কি আছে সেটা দেখতেই হবে।নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে,নইলে লকারে রাখার তো কারন নেই।

দলিলগুলি বিছানায় রেখে তীব্র ওর ভাইয়ার কম্পিউটার ওপেন করলো।কম্পিউটারে কোনো পাসওয়ার্ড দেওয়া নেই।পাসওয়ার্ড না দেওয়ার কারন হলো ভাইয়া পাসওয়ার্ড মনে রাখতে পারেনা।যাইহোক,পিসিতে পেনড্রাইভটা ঢুকিয়ে ভেতরে থাকা ফাইলে যেতেই তীব্র একটা ভিডিও পায়।পেনড্রাইভে শুধু একটা ভিডিও দেখে তীব্রর খটকাটা বেড়ে যায়।ভিডিওটা ওপেন করতেই যা দেখতে পেলো সেটা দেখার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।চোখ বড় বড় করে মনিটরের দিকে চেয়ে রইলো। ভাইয়ার পেনড্রাইভে এই ভিডিও কিভাবে?? 





চলবে...





Writer:- জয়ন্ত কুমার জয়





NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner