> তুমিময় অনুভূতি
-->

তুমিময় অনুভূতি

সাঁতপাচ না ভেবেই হুট করে রিকশায় উঠে গেলাম আমি। পাশের টং দোকানে চা খাচ্ছে আমার একমাত্র ক্রাশ ।ক্রাশের সামনে আসলেই আমার হার্টবিট উসাইন বোল্টের ন্যায় দৌড়াতে থাকে।কেমন অসার অসার লাগে।লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার সময় মনে হয়,এই মনে হয় ধরা পড়ে গেলাম।উফফ!!কি জ্বালা!!শান্তিতে একটু দেখতেও পারিনা ক্রাশটাকে।

তো আমি আসলে এখন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলাম।বাসার কাছাকাছি আসতেই দেখি সয়ং ক্রাশ মহাশয় পাড়ার টং দোকানে চা খাচ্ছেন।এমনেই আমি দেখতে সুন্দর না।তার উপর কলেজ থেকে ফিরছি।
ক্লান্তিতে চেহারার বিধস্ত অবস্থা।আয়না নেই সাথে,নয়তো নিশ্চিত বলে দিতে পারতাম আমাকে ঠি ক ভূতের মতো লাগছে।এখন এই বিধস্ত অবস্থায় তো আর ক্রাশের সামনে থাকা যায়না।তাই নিজেকে আড়াল করতেই সামনে থাকা রিকশায় উঠে গিয়েছি।
পাশ থেকে কেউ ডাকছে বুঝতে পারছি কিন্তু আমি এখন ক্রাশকে দেখতে ব্যস্ত আশে পাশে কে ডাকছে সেসব নিয়ে মাথাব্যাথা নেই।রিকশা একটু এগিয়ে যেতেই ক্রাশকে আর দেখা গেলো না।

-এইযে,কে আপনি? আশ্চর্য তো!!হুট করে রিকশায় উঠে গেলেন।এত ডাকছি শুনতে পাচ্ছেন না,বধির নাকি?

কারো রাগী কন্ঠে ধমক শুনে এবার পাশ ফিরে তাকালাম।একজন সুদর্শন যুবক আমার পাশে বসে আছে।আরে!!এ কে!!

-আপনি আমার পাশে কি করছেন?বেশ জোরেই বলে উঠলাম।

উচ্চস্বরে কথা বলায় রাস্তার বেশ কিছু মানুষ সোজা আমাদের রিকশার দিকে তাকালো।এমনকি রিকশা আলাও একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে পরখ করে নিলো।এবার আমি একটু মিইয়ে গেলাম।

-আরে আস্তে,আপনিতো আমাকে গণধোলাই খাওয়াবেন দেখছি।রিকশায় উঠলেন আপনি আর বলছেন আমি আপনার পাশে কি করছি?অদ্ভুত পাগল তো।

এবার ব্যাপারটা বুঝলো মিহু।তাড়াহুড়ো করে তখন এই লোকের রিকশায় উঠে বসেছে সে।তবুও দমে গেলে তো হবেনা।তার উপর লোকটা ওকে পাগল বলেছে।
কনফিডেনস নিয়ে বললো,

-এই,পাগল কাকে বলেন?রিকশায় উঠেছিতো কি হয়েছে হ্যাঁ?আমিতো ওতো মোটা না যে সব জায়গা নিয়ে বসেছি।আপনিতো আর জায়গায় অভাবে রিকশা থেকে পড়ে যাচ্ছেন না,তাইনা?তো এত সমস্যা কিসের?

-সমস্যা কিসের মানে?আপনি এরকম যার তার রিকশায় উঠে পরবেন নাকি?একটা ছেলের সাথে বাড়ি ফিরছেন আপনার বাসার লোক কিছু বলবে না?

একটু চিন্তায় পরে গেলো মিহু।লোকটা অবশ্য ঠি কই বলেছে। একহাত দিয়ে মাথা চুলকে বললো,

-আচ্ছা,যান ঠিকাছে।আমার বাসা সামনেই,আমি তার একটু আগেই নেমে যাব।আর ভাঁড়াটাও দিয়ে দিব।এবার খুশি?কিপটা কোথাকার।

মেয়েটার কথায় অবাক না হয়ে পারলোনা অভি।ও কিপটা?লাইক সিরিয়াসলি?তবুও কিছু বললোনা।এই মেয়ের সাথে যতো কথা বলবে ততোই কথা বাড়বে।চুপ থাকাই ভালো।সামনে নেমে গেলেই ঝামেলা শেষ।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে কৌতুহল নিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেললো অভি।

-আপনি এত কি দেখছিলেন ওই ছেলেটাকে?

হকচকিয়ে যায় মিহু।আমতা আমতা করে বলে,

-কোন ছেলে?আমিতো কাউকেই দেখছিলাম না।

অভি নি:শব্দে হেসে দেয়।সন্ধিহান গলায় বলে,

-ক্রাশ নাকি?

-ধ্যাত্ বেশি বুঝেন কেন?ওই ছেলে আমার ক্রাশ হবে কেন?উলটা আমিই ওর ক্রাশ।দেখলে ডিসটার্ব করবে তাইতো আপনার রিকশায় উঠে গেলাম বুঝলেন।হুহ্।

নিজের টেলেনট দেখে নিজেই মুগ্ধ মিহু।কি সুন্দর করে বানিয়ে কথা বলতে পারে।বাহ্।

-হুম,বুঝলাম তো।

মেয়েটার বাচ্চামো কথায় না হেসে পারেনা অভি।সে খুবই রাগী।অন্য কেউ হলে এতক্ষণে সে কি করতো তা সে নিজেও জানেনা।
একবার আড়চোখে সচেতনভাবে মেয়েটার দিকে তাকায়।
রিকশার একদম পাশ ঘেঁষে বসে আছে সে।একটু হলেই পরে যাবে।চোখের দৃষ্টি বাইরের দিকে।ঘন পাপড়ির আড়ালে গভীর কালো চোখদুটো যেন ঢেকে গেছে।

হাল্কা বাতাসে মাথায় থাকা ওড়না পড়ে যায় মিহুর।দৃষ্টি সরিয়ে নেয় অভি।একটা মেয়ের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকা মোটেও কোন শোভনীয় কাজ নয় সেটা সে জানে।

মিহু দ্রুত ওড়না টেনে নেয়।আজকে সকালে তাড়াহুড়োয় হিজাবটাও পরতে পারেনি সে।

-আঙ্কেল থামান।আমি এখানেই নামব।রিকশা থামলে মিহু দ্রুত নামতে যেয়ে হোঁচট খায়।

অভি মৃদু ধমকের সরে বলে,

-আরে আসতে,এত ছটফট করেন কেন?

মিহু একপলক তার দিকে দৃষ্টি দেয়।চোখাচোখি হয়ে যায় তাদের।অভি চাইলেও দৃষ্টি সরাতে পারে না।
মিহু চোখ নামিয়ে নেয়।অসস্তি হয় তার।আমতা আমতা করেও কিছু না বলে ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে নিলেই অভি বলে,

-হয়েছে।আপনার ভাড়াঁ দিতে হবেনা ভাড়াঁ দেয়াই আছে।আপনি বাসায় যান।

-কিন্তু.

অভি ইশারায় যেতে বলে।মিহু কথা বাড়ায় না।

বাসার গেট দিয়ে ঢুকতেই পিছে ফিরে দেখে ছেলেটা রিকশা থেকে ওর বাসার সামনেই নামছে।এমনকি গেট দিয়েও ঢুকে গিয়েছে।
দ্রুতপায়ে এগোতে এগোতে বলে,
-সমস্যা কি আপনার?এখন কি বাসায় এসে কমপ্লেন করবেন নাকি?

মিহুর কথায় ভ্রু কুচকে তাকায় অভি।শান্ত গলায় বলে,
-আমি এখানেই এসেছি।

বিরক্তি নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে মিহু।ভাবে হয়তো কোনো ভাড়াটিয়ার বাসায় এসেছে।
একসাথেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে তারা।তৃতীয় তলায় এসে অভি বেল বাজালেই বিস্মিত কন্ঠে মিহু বলে,

-আপনার ভুল হচ্ছে।এটা আমার বাসা।আপনি হয়তো অন্য কোনো..এটুকু বলতেই গেট খুলে দিলো সাদিফ।
সাদিফ মিহুর বড় ভাই।মিহুর থেকে প্রায় ছয় বছরের বড়।

-অভি,আয়।

অভি ভেতরে ঢুকতেই মিশুকে দেখে সাদিফ।অভির পিছে এতক্ষন দেখাই যাচ্ছিলো না মেয়েটাকে।

-তুই দাড়িয়ে আসিছ কেন?ভেতরে ঢুক।

ধীরপায়ে ভেতরে ঢুকে মিহু।মনে মনে তার হাজার চিন্তা।লোকটা কি তার ভাইকে কিছু বলে দিবে নাকি।ধুর..সব ছেড়ে এর রিকশায়ই উঠতে হলো।আর উনারই ভাইয়ার বন্ধু হতে হলো।
উফফ..পৃথিবাটা গোল।আসলেই পৃথিবীটা গোল।


নিজের ঘরে যেয়ে দরজা আটকে দেয় মিহু।বিছানায় ব্যাগটা রেখে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে।
ফ্রেশ হয়ে বের হতেই রান্নাঘর থেকে মায়ের ডাক শুনে রুমের বাহিরে পা বাড়ায় সে।
ভাইয়ের রুম কাটিয়ে যাওয়ার সময় হাসাহাসির শব্দ শুনে মনে মনে সস্তি পায় সে।অভি কিছু বলেনি এই ভেবেই চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে।
রান্না ঘরে ঢুকতেই দেখে মা বিরিয়ানি রান্না করছে।ভ্রু কুচকে ফেলে মিহু।সন্ধিহান কন্ঠে বলে,

-এসব রান্না করছো কেনো?কেউ আসবে?

পিছন ফিরে তাকায় নাজিফা বেগম।মিহুর উদ্দেশ্য বলে,

-হ্যাঁ,তোর বড় মামা আসবে।

বড় মামার কথা শুনে মনটাই ভালো হয়ে গেলো মিহুর।এই মানুষটা মিহুর খুব বেশি প্রিয়।
মায়ের ডাকে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো মিহু।নাজিফা বেগম মেয়ের হাতে একটা ট্রে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

-এটা যেয়ে সাদিফের রুমে দিয়ে আয়।ওর বন্ধু আসছে।

মিহু ইতস্তত করে বলে,

-আমেনা খালা যেয়ে দিয়ে আসেন।আমি পারবোনা।

-দেখছিস না আমেনা কাজ করছে।ও পারবেনা।তুই যা।

বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ট্রে টা হাতে নেয় মিহু।
সাদিফের রুমে যেয়ে দরজায় দাড়িয়ে করে বলে,

-ভাইয়া দরজা খুলো।

সাদিফ যেয়ে দরজা খুলে দেয়।মিহুর হাতে খাবার দেখে সাইড দিয়ে বলে,

-টেবিলে রেখে দে।

মিহু ধীরপায়ে ভেতরে ঢুকে সাবধানে ট্রে টা রেখে দেয়।আড়চোখে একবার অভির দিকে তাকায়।অভিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে পরক্ষনেই চোখ নামিয়ে নেয়।

বিছানায় হেলান দিয়ে একহাতে ফোন নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিহুকে পর্যবেক্ষন করছিল অভি।যদিও মুখের ভাব নির্বিকার।মিহু চলে যেতেই স্বাভাবিকভাবে বলে,

-কোন ক্লাসে পরে তোর বোন?

সাদিফ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে,

-ইন্টারে।সেকেন্ড ইয়ার।

অভি বাঁকা হাসে।বিরবির করে বলে,
-ওহহো।বাচ্চা মেয়ে।

-কিছু বললি?

-নাহ্,ভালো।

ড্রইংরুমে বসে খোশমেজাজে আড্ডা দিচ্ছে সবাই।মিহু বসে আছে তার বড় মামার পাশে।মিহুর পাশে তার মামাতো বোন ফারিয়া।তাদের মুখোমুখি সোফায় বসেছে সাদিফ আর অভি।আর একটা সোফায় বসে আছে মিহুর বাবা ইমতিয়াজ আহমেদ।
অভি হাসিমুখে আফতাব হোসেন এর সাথে কথা বলছে।আফতাব হোসেন রীতিমতা মুগ্ধ তার কথা-বার্তায়।

অনেকক্ষন যাবত ফারিয়া মিহুর মাথা খেয়ে যাচ্ছে।অভির ব্যাপারে হাজারটা প্রশ্ন করে তার প্রশংসায় মিহুর মাথা ব্যাথা বানিয়ে ফেলছে সে।

-আমি কিছু জানিনাতো ফারিয়া।উনি ভাইয়ার ফ্রেন্ড শুধু এটাই জানি আর কিছু জানিনা।

-জানিসনা তো কি হয়েছে?জানবি।ছেলেটা যে কি সুন্দর দেখতে।কথা বলার স্টাইলটা কি সুন্দর।মিহুরে আমিতো ক্রাশ খেয়ে গেলাম।

মিহু বিরক্তি নিয়ে বলে,

-তোর কয়জনকে ভালো লাগে?যাকে দেখিস তার উপরই ক্রাশ খাস।

-ধ্যাত্ তুই বুঝবিনা।

মিহু কিছু বলেনা।এই মেয়েকে বুঝিয়ে লাভ নেই।
_______________

সন্ধ্যাবেলা মিহু রুমে বসে ফোন চালাচ্ছে।ফারিয়াও তার সাথেই আছে।হঠাৎই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো নাফিসা বেগম।ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,

-মিহু,সাদিফ ডাকে তোকে।ওর রুমে যা।...আর ফারিয়া নিচে চল মা নাস্তা খেয়ে নে।

মিহু উঠে যায়।সাদিফ কেন ডাকছে ভেবে পায়না সে।

গুটিগুটি পায়ে ভাইয়ের কাছে যেতেই সাদিফ গম্ভীরভাবে বলে,

-তোকে নাকি কোন ছেলে ডিসটার্ব করে রাস্তায়?কে?আমাকে আগে বলিস নাই কেনো?

চুপ হয়ে যায় মিহু।অভির দিকে তাকিয়ে দেখে তার মুখে দুষ্টামি ভরা হাসি।দুই আঙ্গুল দিয়ে থুতনি চেপে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
তার ভাইকে চিনে সে।খুব রাগী।আমতা আমতা করে বলে,

-না মানে হ্যাঁ.....

সাদিফ ভ্রু কুচকে তাকায়।

-আমাকে আগে বলবি না?

-আ..আসলে...

তার কথা টেনে নিয়েই অভি বলে,

-তোর কাছে বলতে লজ্জা পায় হয়তো..

মিহু দাঁতে দাঁত চেপে তার দিকে তাকায়।অভি যে তাকে রাগানোর জন্য এমন করছে সেটা সে ভালো করেই বুঝতে পারছে।

-আচ্ছা,ঠিকাছে।যা তুই।আর কালকে আমার সাথে যাবি কলেজ।

মিহু মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে যায়।মেজাজটা প্রচন্ড পরিমাণে গরম হয়ে আছে।এই ব্যাটা এতো অসভ্য কেন?
তার কি দরকার ছিল ভাইয়াকে বলার?
শেষে কিনা তার ভাইয়ের হাতেই তার ক্রাশ মার খাবে?উফ!!জাসট অসহ্যকর!!!


বাইরে বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছে সাদিফ।কানে ফোন নিয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে।পরণে ব্লু জিনস আর ব্ল্যাক শার্ট।চোখে কালো সানগ্লাস।হাত দিয়ে বারবার সামনের চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিচ্ছে।
মিহুকে বের হতে দেখে চোখের ইশারায় বসতে বলে।
মিহু মাথা নাড়িয়ে বাইকে উঠে বসে।মনে মনে বারবার দোয়া করছে তার ক্রাশ অর্থ্যাৎ অনিক যেন আজকে না থাকে যাওয়ার পথে।কোনোভাবেই যেন না থাকে!!থাকলে যে তাকে কি একটা পরিস্থিতিতে পরতে হবে তার জানা নেই।দুই দিক দিয়েই ফেঁসে যাবে সে।

বড় রাস্তার মোড়ে যেয়ে বাইক থামায় সাদিফ।মাথাটা হাল্কা ঘুড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

-ওই না?

সাদিফের ডাকে হুঁশ ফেরে মিহুর।অন্যমনস্ক হয়ে অতিরিক্ত চিনতায় ডুবে ছিলো সে।মাথা তুলে দেখে অনিক দাড়িয়ে আছে রাস্তার ওপাশে।সাদিফ কেমনে চিনলো বুঝে উঠে না সে।

-হ্যাঁ,তুমি কেমনে চিনলে?

-অভি বললো কালকে।আর আমি চিনিতো ওকে।বলতে বলতেই বাইক থেকে নেমে দাড়ায় সাদিফ।
হাত ধরে বোনকে নামিয়ে দেয়।হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখের ঘাম মুছে মিহু।কোনোভাবে আজকে সামাল দিতে পারলেই হয়।আর কোনোদিনও অনিকের দিকে ফিরেও তাকাবে না সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে সে।

গুটিগুটি পায়ে ভাইয়ের পিছে দাঁড়ায় মিহু।সাদিফ শান্ত গলায় বলে,

-অনিক তুমি ওকে ডিসটার্ব করো?এই বয়সেই এসব শিখছো?তোমার বয়স পার করে এসেছি আমি।এই বয়সে ধমকে কাজ হয়না।হিতে বিপরীত হয়।তাই আমি ভালো করেই বলছি তোমাকে এসব ছাড়ো।আমি যেন আর কখনো না শুনি তুমি এসব করছো।গট ইট্?

মিহু অনিকের রিয়েকশন দেখার জন্য অপেক্ষা করেছিলো।তবে সে যা ভেবেছিলো তেমন কিছুই হলোনা।
বরং হলো তার উল্টো।অনিক মাথা নিচু করে বললো,

-সরি ভাইয়া আর কখনো হবেনা।

মিহু হতবাক,চমকিত।হলোটা কি?ভ্রু কুচকে নিজেকে চিমটি কাটলো সে।নাহ্,ব্যাথা তো পাচ্ছে।তারমানে সত্যি!!
অনিকের দিকে তাকায় সে।অনিক স্বাভাবিকভাবে দাড়িয়ে আছে।তাকে দেখে মনে হচ্ছে যা হচ্ছে তাই যেন হবার ছিলো।
__________
মিহু চলে যেতেই একটা বাইক এসে থামে সেখানে।
হেলমেট খুলে চুলগুলোতে হাত চালাতে চালাতে অভি বলে,

-গুড জব,অনিক।যেমনটা বলেছিলাম ঠি ক তেমনটাই করেছো।

-জি ভাইয়া।আপনি বলেছেন আমি না করবো নাকি?বলেই হাসলো অনিক।

-অভি হেলমেটটা পরতে পরতে বললো,হুম গুড।কোন সমস্যা হলে আমাকে বলবা।আজকে আসি।আল্লাহ হাফেজ।

-আল্লাহ হাফেজ ভাইয়া।

বাইক স্টার্ট দিলো অভি।মুখে তার দুষ্টু হাসি।মিহুর চিন্তিত চেহারাটা দেখে যে তার কি পরিমাণ হাসি পাচ্ছিল।
অনিককে সে আগেই বলে রেখেছিল যেন সাদিফ আসলে সে দোষটা নিজের বলেই স্সিকার করে।
মিহুকে অপমান করার কোনো ইচ্ছা ছিলোনা তার।সে শুধু এটাই বোঝাতে চেয়েছিলো যে মিথ্যা বললে কতটা ঝামেলায় পরতে হয়।আর মিহুর চেহারা দেখে সে এতটুকু আশ্বস্ত হয়েছে মিহু অন্তত মিথ্যা বলবে না আর কখনো।
__________
কলেজের সামনে বাইক থামায় সাদিফ।হাত বাড়িয়ে মিহুকে বলে,

-সাবধানে নাম।পরিস না।
বাইক থেকে নামতে নিলে সবসময়ই হোঁচট খায় মিহু।দু তিনবার পরে ব্যাথাও পেয়েছে সে।এজন্যই সাদিফের এক্সট্রা সতর্কতা।
মিহু নামতেই পাশে এসে দাড়ায় ইপসা।মিহুর একমাত্র বান্ধবী সে।মিহুর হাত টেনে ধরে সে।

-এত দেরি হলে কেন তোর?জানিসনা আজকে ইমপোর্টেনট ক্লাস আছে।আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল সে তবে সাদিফকে দেখে থেমে যায়।সাদিফ তখন হাতের ঘড়ি ঠি ক করতে ব্যস্ত।একনজর ইপসাকে দেখে সে।তারপর মিহুর দিকে তাকিয়ে বলে,

-একা আসতে পারবিনা?নাকি আমি নিতে আসবো?

-না না।আমি একাই পারবো।

"আচ্ছা"বলে দ্রুত বাইক ছুটিয়ে চলে যায় সে।
মিহু দীর্ঘ:শ্বাস ফেলে।আজকের ঘটনায় সে খুবই দিধা গ্রস্থ।এখনো তার মাথায় কিছুই ঢুকছেনা।
ইপসা বাহু ঝাঁকিয়ে বলে,

-এই কি হলো তোর?চল।

-হুম যাচ্ছি।চল।

ক্লাস রুমে বসে আছে তারা।এখন ব্রেক টাইম।ইপসা গালে হাত রেখে মনোযোগী হয়ে মিহুর কথা শুনছে।
মিহু একহাত দিয়ে তুড়ি বাজিয়ে বললো,

-তুই কি আদো আমার সব কথা বুঝতে পারছিস ইপসা?এমন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছিস কেনো?

-পারছি রে দোস্ত পারছি।শুধু সব না একটু বেশিই বুঝতে পারছি আমি....


কলেজ থেকে বাসায় ফিরে সোফায় ধপ করে বসে পরে মিহু।ক্লান্তিতে ঘুম আসছে তার।
এতক্ষন ইপসার ননস্টপ বকবকানি শুনে কানগুলো পর্যন্ত ব্যাথা হয়ে গেছে ।হিজাবটা খুলে সোফায়ই গা এলিয়ে দেয়।কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমিয়েও যায়।

ঘুম ভাঙে সাদিফের ডাকে।চোখগুলা ছোট ছোট করে বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলে,

-কি সমস্যা তোমার?দেখছো না ঘুমাচ্ছি?ডাকো কেন?

-এই ভরদুপুরে তুই ঘুমাচ্ছিস?তাও বসার ঘরের সোফায়?বাড়িতে কি জায়গা কম হয়ে গেছে?যা নিজের রুমে যা।
মিহু একহাতে চোখ কচলায়।হাই তুলে বলে,
-ধ্যাত্।তুমি কি এখন সোফায় বসে বসে সার্কাস করবে হ্যাঁ?একটু ঘুমালে কি হয়?

"থাকনা ওকে ঘুমাতে দে"

পেছন থেকে কারো পুরুশালী কন্ঠে চমকে উঠে মিহু।ঘুম উড়ে যায় নিমিষেই।জলদি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে নিলেই প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে উঠে।ঘাড়ে হাত দিয়ে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরে তার।অনেকক্ষন এককাত হয়ে শুয়ে ছিল তাই হঠাৎ করে ঘাড় ঘুরানোতে ঘাড়ের পেশিতে টান পরেছে তার।

সাদিফ দ্রুত ধরে মিহুকে।চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে অস্থির কন্ঠে বলে,

-কি হলো?

মিহুর চিৎকারে নাজিফা বেগম রান্নাঘর থেকে ছুটে এসেছে।
সেও চিন্তিত গলায় বললো,

-কি হলো?ঘাড়ে ব্যাথা করছে?

মিহু অস্পষ্ট সরে বলে,

-হু।

অভি এগিয়ে যায়।কিছুটা অপ্রস্তুতভাবে বলে,

-হঠাৎ নড়ে যাওয়ায় পেশিতে টান পরেছে।

সাদিফ তাকায়।বলে,

-তাহলে এখন?ঠি ক হবে কিভাবে? ডাক্তার ডাকবো?

-ম্যাসাজ করে দিলেই ব্যাথা কমে যাবে।তারপর কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,আমি করবো?

সাদিফ দ্রুত উঠে দাড়ায়।অভিকে নিজের জায়গায় বসতে বলে।

-কর তাড়াতাড়ি কর।

অভি মিহুর পাশ ঘেঁষে বসে।নরম গলায় মিহুকে বলে,

-হাতটা সরাও।

মিহু ঘাড়ে রাখা হাত সরিয়ে নেয়।চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে আছে সে।অনেক জায়গায় দেখেছে কোথাও মচকে গেলে একটানে ঘুরিয়ে দেয় আর মচকানো জায়গা ঠি ক হয়ে যায়।এখন যদি এই লোকও ম্যাসেজের নাম করে ধুম করে তার ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়?ভেবেই শিঁউরে উঠে সে।
তার ভাবনাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমান করে অভি এমন কিছুই করেনা।সে আলতো করে ঘাড়ে হাত দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে ম্যাসেজ করতে থাকে।
মিহুর অসস্তি হয়।অভি তার অনেকটা কাছে বসে আছে।অভির ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায় ভিতরে ভিতরে বারবার কম্পিত হচ্ছে সে।

কিছু পোড়ার গন্ধ নাকে আসতেই দ্রুত রান্নাঘরে ছুট লাগায় নাজিফা বেগম।তরকারি না নামিয়ে গ্যাস জালিয়েই চলে এসেছিল সে।নিশ্চিত সব পুড়ে শেষ!!!

বেশ কিছুক্ষন ম্যাসেজ করার পরও মিহুর কোনো পরিবর্তন দেখতে পেলোনা সাদিফ।সে এখনো চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে।না পেরে অধৈর্য গলায় অভিকে বলে,

-অভি?ব্যাথা তো কমেনি মনে হয়।ওকে হসপিটালে নিয়ে যাই?

-আরে না রে।..মিহু ঘাড়টা ঘুরাওতো।

মিহু মৃদু কন্ঠে বলে,

-নাহ্,ব্যাথা করবে।

-করবেনা তুমি ঘুরিয়েতো দেখো।

মিহু চোখ খুলে।আড়চোখে একবার অভিকে দেখে।ধীরে ধীরে ঘাড়টা ঘুরায়।নাহ্,কোনো ব্যাথা নেই।সে অবাক হয়।উৎফুল্ল কন্ঠে বলে,

-ভাইয়া সত্যিই ব্যাথা নেই।আবার আগের মতো হয়ে গেছে।

সাদিফের ঠোঁটের কোঁণে হাসি ফুটে উঠে।হাসিমুখে অভির দিকে তাকায় সে।
অভি বলে,

-ব্যাথার মলম থাকলে নিয়ে আয়।লাগিয়ে দিলে ভালো হবে।

-আনছি।বলে দ্রুতপায়ে নিজের ঘরে যায় সাদিফ।

অভি নি:শব্দে হেসে দেয়।সাদিফের মতো রাগী মানুষও বোনের সামান্য ব্যাথায় কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে।
মিহুর পাশ থেকে কিছুটা দূরে সরে বসে অভি।পকেট থেকে ফোনটা বের করে আড়চোখে মিহুর দিকে তাকায়।
কোমড় পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে পিঠে।ওড়নাটা যে মেঝেতে পরে আছে,
মেয়েটা হয়তো খেয়াল করেনি।অস্থিরতায় ভরা দৃষ্টি সরিয়ে ফোনের দিকে তাকায় অভি।
মিহু কি করবে বুঝতে পারেনা।হঠাৎ মেঝেতে চোখ পরতেই আবারও চমকে উঠে।তার ওরনা মেঝেতে পরে আছে!!তারমানে অভির সামনে সে এতোক্ষণ ওড়না ছাড়া ছিলো?আল্লাহ্!অভি না জানি কি মনে করেছে।একটানে ওরনাটা উঠিয়ে টনের্ডোর গতিতে নিজের রুমে যেয়ে দরজা আটকে দেয় মিহু।
অভি হাসলো।মেয়েটা আসলেই বাচ্চা।

সাদিফ মলম নিয়ে আসে।মিহুকে না দেখে বলে,

-কই গেলো?

-ওই রুমে।অভি হাত দিয়ে ইশারা করে।তারপর বলে,পরে লাগিয়ে দিস মলম।সমস্যা হবেনা।
______________

-ভাইয়া, আমার ফোনের চার্জার কোথায়?তুমি নিয়েছো?বলতে বলতেই সাদিফের রুমে ঢুকে মিহু।
স্টাডি টেবিলে এতগুলা কাগজপত্র নিয়ে অভিকে বসে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যায়।এরা যে এত পড়াশোনা করে কি মজা পায় এটাই ভেবে পায়না মিহু।
একবার ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখে সাদিফ নেই।
অভি দ্রুত বলে,

-সাদিফ ওয়াশরুমে।

-ওহ্ আচ্ছা।বলে নিজেই যেয়ে ড্রয়ারে খুঁজতে থাকে।পেয়েও যায়।চার্জার নিয়ে বের হতে গেলে অভি বলে,

-কোথায় গিয়েছিলে?

মিহু বুঝতে পারেনা অভির কথা।

-জি মানে?

-মানে তখন যে এত জোরে দৌড় দিলে,মনে তো হচ্ছিলো তোমার রুমে কোন রেল স্টেশন আছে আর তোমার ট্রেন ছুটে যাচ্ছে।তাই বলছি,ট্রেনে করে কোথায় গিয়েছিলে?

মিহুর রাগ হয়।মুখ ভেংচিয়ে রাগী কন্ঠে বলে,
-আপনার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম।আপনিও যাবেন?
বলেই হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে।

অভি একা একাই হাসে।এক আঙ্গুল দিয়ে কপালের সাইডে ঘঁষতে ঘঁষতে বিরবির করে বলে,

-আমিতো আমার শ্বশুরবাড়িতেই আছি।.....


মুষুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।সাথে তুমুলবেগে বাতাস।গ্রীষ্মকালের এই কালবৈশাখীর সময় কোনো আগাম বার্তা ছাড়া এমন হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি  অস্বাভাবিক কিছু নয়।

একটা দোকানের সামনে টি নের সামান্য ছাউনির নিচে জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে মিহু।ভেজা শরীরে ঠান্ডা শীতল বাতাসের স্পর্শ সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পরতেই থরথর করে কাঁপছে সে।ক্রমশ বৃষ্টির ঝাপটা এসে আরো নিপুণভাবে ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে।পরণে হাল্কা গোলাপি রংয়ের থ্রিপিস।জামার হাল্কা রং ভেদ করে সবকিছুই প্রায় দৃশ্যমান।
মিহু ওড়নাটা মাথা থেকে নামিয়ে ভালোমতো গায়ে জড়িয়ে নিল।ভেজা চুলগুলো কোনরকম হাত দিয়ে গুছিয়ে নেয়।আঁশে পাশে আরো অনেকগুলো লোক দাড়িয়ে আছে।একরাশ অসস্তি নিয়ে এককোণায় নিজেকে আরো একটু গুটিয়ে নিয়ে দাড়িয়ে রইলো সে।

কিছুক্ষণ আগে কলেজ থেকে হেঁটেই বাড়ি ফিরছিলো মিহু।আজকাল হাঁটতে বেশ ভালোলাগে।
আকাশে মেঘ করছে দেখে দ্রুত পা চালায়।তবে তার আগেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে যায়।দৌড়ে এখানে আসতে
আসতেই অনেকটা ভিজে যায়।বৃষ্টির সময় রিকশা পাওয়া যায় না।যাও দু একটা আছে সেগুলো রাস্তার ওপারে ।আর এই ভেজা অবস্থায় রাস্তার ওপারে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয় মিহুর পক্ষে।

-মিহু না?

পরিচিত কারো কন্ঠে মুখ তুলে তাকায় মিহু।সামনে থাকা ব্যক্তিটি তার জন্য সবচেয়ে বিরক্তিকর হওয়া সত্তেও তাকে দেখে এখন বিরক্ত লাগছেনা।
প্রশ্নের উওরে মৃদু মাথা নাড়ায় সে।

সামনে বাইক থামিয়ে দাড়িয়ে আছে অভি।সেও ভিজে চুপচুপে।গায়ের শার্ট লেপটে আছে শরীরের সাথে।হেলমেটটা খুলে চুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে দ্রুত মিহুর পাশে এসে দাড়ালো সে।

-এখানে দাড়িয়ে আছো কেন?

-কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলাম।বৃষ্টি নামে মাঝপথেই.....মিহুর কন্ঠ ঈষৎ কেঁপে কেঁপে উঠে।

অভি মিহুর দিকে আপাদমস্তক একবার চোখ বুলায়।মেয়েটা ভিজে একাকার।শরীরের প্রতিটি ভাঁজ স্পষ্ট।
দৃষ্টি সরিয়ে আশেপাশের লোকগুলোর বিশ্রী চাহনি দেখে মুহুর্তেই মুখ গম্ভীর হয়ে যায়।কিছু না ভেবেই 
একহাতে কাছে টেনে অন্যপাশে নিয়ে জড়িয়ে ধরে নিজের বলিষ্ঠ দেহ দিয়ে লোকগুলোর চাহনি থেকে মিহুকে আড়াল করে দাড়ায়।

মিহু সচকিত হয়ে বলে,

-ভাইয়া কি করছেন?

অভি সামনে দিকে তাকিয়েই কাঠকাঠ কন্ঠে বলে,

-চুপচাপ এভাবেই থাকো।বৃষ্টি কমলে বাসায় পৌছে দিব।

মিহু কাঁচুমাচু করে।কিছু বলতে চেয়েও অভির দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলেনা।
মনে মনে শান্তি পায় সে।লোকগুলোকে মোটেও সহ্য হচ্ছিল না তার।
অভির সপর্শে আর যাই হোক কোন খারাপ ছোয়াঁ নেই।
অভির শরীর ভিজে বরফ ঠান্ডা হলেও তার সংস্পর্শে এসে কাঁপাকাঁপি কমে গেছে মিহুর।উষ্ম উষ্ম আভাস পাচ্ছে সে।

বৃষ্টি হাল্কা কমেছে।মিহুকে এই অবস্থায় নিয়ে বাইকে যাওয়া যাবে না।তাই রিকশা ঠিক করার জন্য বের হতে নিলেই মিহু ইতস্তত কন্ঠে বলে,

-আপনি যেয়ে রিকশা নিয়ে আসেন।আমি এখানেই দাড়াই।

অভি মিহুকে আরো একটু শক্ত করে ধরে সহজ গলায় বলে,

-কেউ কিছু দেখতে পাবেনা।আমি আছিতো.....চলো।

মিহুকে রিকশায় উঠিয়ে রিকশার পলিথিনটা দিয়ে সুন্দর করে ঢেকে দিল অভি।তারপর নিজেও উঠে বসল।
রিকশা চলছে দ্রুত গতিতে।ঠান্ডা বাতাস সাঁই সাঁই করে ছড়িয়ে পরছে তাদের নাকেমুখে।
মিহু আবারও কাঁপছে।দাঁতে দাঁত লেগে মৃদু আওয়াজ হচ্ছে।
অভি শার্টের হাতা ফোল্ড করে চেপে চেপে পানি ঝাড়ছিল।মিহুকে এভাবে কাঁপতে দেখে একহাত পিঠের পিছন দিয়ে মিহুর হাতের বাহুতে রাখে।মধ্যেকার দুরত্ব কমিয়ে আনে।মিহুর গা গরম।জর আসবে বোধহয়।

মিহু গুটিশুটি হয়ে লেগে থাকে অভির সাথে।শীত সহ্য হয়না তার।

-খুব ঠান্ডা লাগছে?

মিহু অস্পষ্ট সরে বলে,

-হু।

রিকশার ঝাকুনিতে নড়েচড়ে উঠে মিহু।তাল সামলাতে অভির হাত খাঁমছে ধরে।

নখের আঁচরে ব্যাথা লাগে অভির তবুও কিছু বলেনা।মিহুর দিকে আর একবারও তাকায়না সে।মুখ ঘুড়িয়ে কঠিন দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থাকে।মনের মধ্য বিচরণ করা নিষিদ্ধ অনুভূতিগুলো ঝেড়ে ফেলার তীব্র চেষ্টায় অব্যাহত সে।
_____________

ওয়াশরুমে ঢুকে গিজার অন করে দেয় অভি।শার্টটা খুলে ঝুলিয়ে রাখে।মেয়েলি ঘ্রান আসছে তার শার্টটা থেকে।এমনকি তার শরীর থেকেও।
অভি হাসে।আনমনেই বলে,

-"এমন নেশাময় পারফিউম তুমি কোথায় পাও মিহুপাখি?"এই ঘ্রানে আসক্ত হয়ে যাবোতো আমি।

হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে লাল হয়ে নখের দাগ বসে গেছে।মুখে পানির ঝাপটা দেয় সে।চোখ বন্ধ করতেই মিহুর স্নিগ্ধ  মুখটা,কাঁপাকাঁপা ঠোঁটগুলো,ভেজা পাপরিতে ঢাকা কালো কালো চোখদুটো ভেসে উঠে।

চোখ খুলে জোরে জোরে দুটো শ্বাস নেয় অভি।এ কেমন ঝামেলায় পড়লো সে!!!!

শাওয়ার নিয়ে মাত্রই বেরিয়েছে মিহু।বের হতেই দেখে বিছানায় নাজিফা বেগম বসে আছে।হাতে তার খাবারের প্লেট।
মিহু হাল্কা হেসে পাশে বসল।মেয়ের হাতে খাবারটা দিয়ে তোয়ালেটা নিয়ে নিলো নাজিফা।মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,

-ছেলেটা খুব ভালো তাইনা?

-হুম।

-তোদের মধ্য কিছু আছে?

মিহু চমকায়।মায়ের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছে সে।মায়ের সাথে বেশ ফ্রেন্ডলি সে।তাই সহজ গলায় বললো,

-কি থাকবে মা?কিছুই নেই।

নাজিফা বেগম আর কিছু বলেনা।মেয়ের প্রতি যথেষ্ট বিশ্বাস আছে তার।
উনি চলে যেতেই দরজা লাগিয়ে দেয় মিহু।পাশে থাকা জরের ওষুধটা খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
চোখটা বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে।মনে মনে চিন্তা করে,

-এই প্রথম কারো এতটা কাছে ছিলো সে!!!


মুখের সামনে বই খুলে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে মিহু।মাথায় যদিও কিছু ঢুকছেনা তবুও পড়তে হবে
দুইমাস পর প্রি-টেস্ট পরীক্ষা।পড়াশোনায় ভীষন চাপ।
গায়ে মোটা কাঁথা জড়ানো তার।এখনো হাল্কা শীত শীত করছে।ওষুধ খেয়ে নিয়েছিলো বলে হয়তো জরটা আর আসেনি।একবার চোখ তুলে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকায়,সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে।সারাটা বিকাল ঘুমিয়েই কাটিয়েছে।আধো আধো ঘুমের ঘোরে কিশোরী মনে অভিকে নিয়ে নানান ভাবনা আসছিলো।
এই বয়সটা স্পর্শকাতর।একটু কিছু হলেই আবেগে ভেসে যায় মেয়েদের মন।একফোঁটা আবেগি রং ই যথেষ্ট 
তাদের ছোট দুনিয়াটাকে রঙবেরঙে করার জন্য।

দ্রুতবেগে মিহুর রুমে ভিতরে ঢুকে সজোরে দরজা লাগিয়ে দেয় সাদিফ।
মিহু চোখ তুলে তাকায়।
সাদিফের মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।চোখ মুখ ফোলা।গভীর ঘুম থেকে ঢেকে তোলা হয়েছে তাকে।
হুড়মুড় করে মিহুর বিছানায় এসে সটান হয়ে শুয়ে পরলো সে।দুই সেকেন্ড পর টান দিয়ে মিহুর কোলে রাখা বালিশটা নিয়ে মাথার নিচে দিতে দিতে বললো,

-কোনো শব্দ করবিনা।নি:শব্দে পড়বি।আমি ঘুমাবো।

মিহু ভ্রু কুচকায়।তেড়ে উঠে বলে,

-তুমি এখানে ঘুমাবে কেনো?তোমার ঘরে যাও।

সাদিফ পাশ ফিরে মিহুর গায়ের কাঁথা টেনে নিয়ে বললো,

-আমার রুমে মা আর আমেনা খালা।পরিষ্কার টরিষ্কার করছে।

মিহু দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়ে।ভাইকে কিছু বলে লাভ নেই।সে এখন ঘুমাবে মানে ঘুমাবে।

-ধ্যাত্।এত মোটা করে কাঁথা নেয় কেউ?গন্ডারের চামড়া নাকি তোর!!গরম লাগে না নাকি?

মিহু কাঁথাটা ধরে বললো,

-কাঁথাটা ছাড়ো।আমি ভাঁজ খুলে গায়ে দিয়ে দিচ্ছি।

কাঁথাটা সাদিফের গায়ে দিয়ে লাইট অফ করে আলতো করে দরজা ভিড়িয়ে বের হয়ে যায় মিহু।
রান্নাঘরে যাওয়ার পথে ভাইয়ের রুমে একবার উঁকি দেয়।মা বিছানা ঝাড়াঝাড়ি করছে আর আমেনা খালা বড় একটা লাঠির মতো ঝাড়ু দিয়ে দেয়ালের কোণের ঝুল ঝাড়ছে।ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে মিহু।
তার মা অতিরিক্ত সুচিবাই টাইপের মানুষ।

____________
মিহুর ফোন অনবরত বেজেই চলেছে।সাদিফ কানে বালিশ চেপে রাখা সত্তেও শব্দটা তার কানে এসেই চলেছে।এই মিহুটা ফোন রেখে কই গেলো কে জানে!!!
অধৈর্য হয়ে না দেখেই ফোনটা রিসিভ করে সাদিফ।হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে মিষ্টি কন্ঠে ঝাঁঝালো ভাবে ভেসে আসে,

-ওই কই মরছিলি তুই?কতক্ষণ যাবত ফোন করছি।...আচ্ছা শোন আমি একটু তোর বাসায় আসতেছি হ্যাঁ?আমার বায়োলজি প্র্যাকটিকাল খাতাটা তোর কাছে না?কালকে জমা দিতে হবেতো।আমারটা কমপ্লিট হয়নি।ওইটা একটু বের করে রাখ আমি এসে নিয়ে....

সাদিফ অবাক হয়।ফোনটা কান থেকে সরিয়ে স্ক্রীনের নামটা দেখে,নাম্বারটা "ইপসা চুন্নি" দিয়ে সেভ করা।সাদিফ ঠোট বাকিয়ে হাসে।ভাবে,একটা মানুষ এক নি:শ্বাসে এত কথা কিভাবে বলতে পারে।হাহ্।
সে ঘুম জড়ানো ভরাট গলায় বলে,

-আমি ওর ভাই।...তুমি আসো,আমি মিহুকে বলে দিচ্ছি।

সাদিফ ইপসার জবাবের অপেক্ষা করে।কোন উওর না পেয়ে আবার বলে,

-ইপসা?

ইপসা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে।বুকের ভেতর মনে হয় হাতুরি পিটাচ্ছে কেউ।তবুও গলার সর নামিয়ে কোনমতে বলে,

-জি ঠিকাছে ভাইয়া।

সাদিফ ফোন কেটে দেয়।ইপসার মন খারাপ হয়।সাদিফ এমন মুখের উপর ফোনটা কেটে দিতে পারলো?
একটু কথা বললে কি হয়?সে কি এতই খারাপ?আবার পরক্ষনেই ভাবে,কন্ঠ শুনে বোঝা গেল উনি ঘুমিয়ে ছিলেন।ওর ফোন করাতে বিরক্তবোধ করেনিতো?

সাদিফ গলা চড়িয়ে মিহুকে ডাক দেয়।মিহু সবেমাত্র চুলা থেকে কফিটা নামিয়েছে।মগে না ঢেলেই রুমে যায় মিহু।দরজার সামনে দাড়িয়েই বলে,

-কি হয়েছে?

সাদিফ মৃদু ধমকে বলে,

-ফোন নিয়ে যেতে পারিসনা?তোর বান্ধবী ফোন করছিলো।ওর বায়োলজি প্র্যাকটিকাল খাতা বের করে রাখতে বললো।ও নিতে আসতেছে।

মিহু সামনে যেয়ে ফোনটা নেয়।সাদিফ আবারও বালিশে মুখ গুঁজে দেয়।
ফ্ল্যাশলাইট জালিয়ে খাতাটা বের করে মিহু।লাইট জালায়না বিধায় সাদিফের ঘুমে ডিসটার্ব হয়।
___________

ল্যাপটপের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অভি।আমেরিকার পড়াশোনা নিয়ে একটা আর্টিকাল পরছে।মাস্টার্ট ফাইনাল ইয়ারটা শেষ হলেই আমেরিকায় পি এইচ ডি করতে যাবে সে।এরকমটাই প্ল্যান তার।
ধনী পরিবারের ছেলে ও।চাইলেই বাবার অফিসের কাজে হাত দিতে পারে সে।কিন্তু না শুধু সেটা করতে তার মন সায় দেয় না।নিজেই কিছু করার ইচ্ছা তার।
আগে নিজে প্রতিষ্ঠিত হবে তবেই বাবার কাজে হাত দিবে।তার আগে না।

দরজায় নক করার শব্দে ধ্যান ভাঙে তার।ল্যাপটপের থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলে,

-"আসো"

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো নিশাত।পরণে টাইট জিনস আর পাতলা ফিনফিনে একটা টপস্।সোনালি কালার করা চুলগুলো উঁচু করে বাঁধা।
অভি একবার তাকায়।তারপর চোখ নামিয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বিরক্তিকর কন্ঠে বলে,

-তোর এখানে কি কাজ নিশাত?

নিশাত উওর দেয়না।দৌড়ে এসে অভিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে।অভি চমকায় না।নিশাত এমনই গায়ে পড়া সভাবের।
সে ধমকে উঠে বলে,

-নিশাত ছাড়।তোকে কতবার বলেছি হুটহাট এমন করবিনা।ছাড় বলছি।

নিশাত ছাড়েনা।অভি নিজেই জোরপূর্বক ছাড়িয়ে নেয়।নিশাত গা ঘেঁষে বসে পরে।ওর গা থেকে তীব্র পারফিউমের গন্ধ আসছে।গন্ধটা সহ্য হচ্ছেনা অভির।মাথা ধরে যাচ্ছে।কই মিহুর গা থেকে তো কতো মিষ্টি ঘ্রান আসে।
একহাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে অভি।
বলে,

-তুই যাচ্ছিস না কেনো?দেখতে পাস না কাজ করছি?

নিশাত অভির হাত ধরে।হাতের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বলে,

-তুমি এমন করো কেনো ভাইয়া?দেখো আমি কতো সুন্দর করে সেজে এসেছি তোমার জন্য।দেখো।

অভি তাকায়না।গম্ভীর কন্ঠে বলে,

-তুই আমার জন্য সাজবি কেনো?পাগলামো না করে যা প্লিজ।আমাকে রাগতে বাধ্য করিসনা।

নিশাত হতাশ হয়।সরে বসে অভির থেকে।অভিকে রাগাতে চায়না ও।খটখট করে হীল জুতার শব্দ তুলে বের হয়ে যায় রুম থেকে।

অভি দরজার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়ে।নিশাতের পাগলামির কারণ সে জানে,বুঝে।মেয়েটা তাকে ভালোবাসে।কিন্তু তার কিছুই করার নেই।সে যে তাকে ভালোবাসেনা।মনে বিরুদ্ধে কার জোর খাটে?নিশাতের শরীরের প্রতি বিনদু মাত্র আকৃষ্ট হয়না সে।জোর করে তো ভালোবাসা যায় না।সে ভেবেছিলো সে কখনোই কাউকে ভালবাসতে পারবে না।কখনো কারো জন্য এমন অনুভূতি তৈরিই হবেনা।
কিন্তু না,সে ভালোবেসেছে,প্রবলভাবে ভালোবেসেছে।প্রকৃতি তাকে ভালোবাসার জালে ফাঁসাতে সক্ষম হয়েছে।
সে ভালোবেসেছে তার প্রাণপ্রিয় মিহুপাখি কে....


সাদিফ এর বিছানায় পা গুটিয়ে বসে আছে ইপসা আর মিহু।সামনে দুটো বাটিতে পেঁয়াজু আর বিস্কিট রাখা।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে তাই ইপসা খাতা টা নিয়েই চলে যেতে চেয়েছিলো।কিন্ত নাজিফা বেগমের জোড়াজোড়িতে 
কিছুক্ষনের জন্য থেকে গিয়েছে।
মিহুর রুমে সাদিফ শুয়ে আছে এজন্যই সাদিফের রুমে এসে বসেছে তারা।

ইপসা খানিকক্ষণ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বললো,

-উনি খুব শৌখিন।খুব গোছানো।

মিহু একটা পেঁয়াজু মুখে নিয়ে চিবাতে চিবাতে বললো,

-ভাইয়ার কথা বলছিস?

ইপসার হুঁশ ফিরে।সে অসস্তিভরা কন্ঠে বলে,

-না মানে হ্যাঁ,রুমটা...রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো।

মিহু অদ্ভুতভাবে হাসে।ইপসা সচেতন চোখে তাকায়।মিহুর কি হলো?সে তো কখনো এতো সিরিয়াস থাকে না।
সে সন্ধিহান কন্ঠে বললো,

-তোর আবার কি হলো?

মিহু কিছু বলবে তার আগেই দরজা খোলার শব্দে দুজনেই সেদিকে ফিরে তারায়।নাজিফা বেগম হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন।দ্রুত গলায় বললেন,

-মিহু,যা সাদিফকে ডেকে বল ইপসাকে বসায় পৌছে দিতে।দেরি হয়ে যাচ্ছে মেয়েটার।

ইপসা হচকচিয়ে যায়।সাদিফের সাথে বাসায় ফিরবে সে!!তাড়াহুড়ো করে বলে,

-না আন্টি।আমি একাই যেতে পারবো।সমস্যা হবেনা।

নাজিফা বেগম আপোত্তি করে বলেলেন,

-না না।এই সন্ধ্যা বেলা একা একা যাওয়া যাবেনা।বিপদ-আপদ বলে কয়ে আসে না।

ইপসা চুপ করে যায়।এই কথার পিঠে কিছু বলার মতো যৌক্তিক যুক্তি পেলো না সে।অগত্যা রাজি হওয়া ছাড়া কোন উপায়ান্তর পেলোনা ও।
_____________

ধীরপায়ে সাদিফের পিছে উঠে বসল ইপসা।সাদিফের পরণে ট্রাওজার আর হাফ হাতা গেনজি।
নিজের হেলমেটটা পরে ইপসার দিকে আরেকটা হেলমেট এগিয়ে দিলো।

-পরো।বাতাস অনেক...ঠান্ডা লেগে যাবে।আর ট্রাফিকেও থামিয়ে দিবে হেলমেট না পরলে।জানোইতো?

-জি।বলে হেলমেটটা নিয়ে পরে নিলো ইপসা।

সাদিফ বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বললো,

-আমাকে ধরে বসো ইপসা।

ইপসা কিছু বললোনা।সাদিফ যতবারই তাকে নাম ধরে ডাকে ততবারই একটা অদ্ভুত ভালোলাগে তার।সে একটা হাত আলতো করে সাদিফের কাঁধে রাখলো।সাদিফ একনজর তাকিয়ে বাইক চালানোয় ধ্যান দিলো।
পথিমধ্য আর একটা কথাও বলেনি কেউ।
ইপসার বাসার সামনে বাইক থামালো সাদিফ।হেলমেটটা খুলে উসকো খুসকো চুলগুলোতে হাত চালাতে চালাতে বললো,

-পৌছে গেছি।নামো সাবধানে।

ইপসা নামছেনা দেখে ঘাড় ঘুড়ায় সাদিফ।দেখে দুহাত উঠিয়ে পিছনে নিয়ে মাথা নিচু করে হেলমেটের লক খোলার চেষ্টা করছে ইপসা।

-চুলে আঁটকে গেছে?

-হু।

সাদিফ মৃদু হেসে বলে,

-হাত সরাও।আমি খুলে দিচ্ছি।

ইপসা হাত সরায় না।দ্রুত চুলগুলো ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে,

-আমি পারবো।

-পারবেনা।বলে ইপসার হাতের উপরই হাত রাখে সাদিফ।এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নেয় ইপসা।
সাদিফ খুব যত্ন করে লকটা থেকে আটকে যাওয়া চুলগুলো ছাড়িয়ে নেয়।হেলমেটটা খুলে দিয়ে বলে,

-হয়ে গেছে।যাও।

ইপসা নেমে যায়।মিষ্টি হেসে হাত নাড়িয়ে বিদায় দিয়ে বলে,

-ধন্যবাদ ভাইয়া।আল্লাহ হাফেজ।

সাদিফ হেসে বলে,

-আল্লাহ হাফেজ।যাও বাসায় ঢুকো।

ইপসা না ঢোকা পর্যন্ত ওখানেই দাড়িয়ে থাকে সাদিফ।ইপসা চলে যেতেই একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বাইক স্টার্ট দেয়।

________________
কখন থেকে মিহুর ফোনে কল দিয়েই যাচ্ছে অভি।রিসিভ করার নামই নাই মিহুর।সাদিফকে কল করছে সেও ধরছে না।মেয়েটার আবার জর এলো নাতো।কম তো ভিজেনি!!আবার ভেজা শরীরে কতক্ষণ দাড়িয়েও ছিলো..টেনশনে মাথা ধরে যাচ্ছে তার!!আরেক বার কল করতেই রিসিভ হলো।ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো কন্ঠে শোনা গেলো,

-এই কে তুই?বারবার কল দিচ্ছিস কেনো?মেয়েদের নাম্বার পেলেই ডিসটার্ব করতে মন চায় না?অসভ্য কোথা..

অভি ফোনটা কান থেকে একটু সরিয়ে নেয়।দুই সেকেন্ড পরে আবারো কানে লাগিয়ে বলে,

-আমি অভি..

মিহু দাঁত দিয়ে জিভ কাটে।মৃদু কন্ঠে বলে,

-আ..আপনি?

অভি ব্যঙ্গ করে বলে,

-এখন আপনি?একটু আগেতো তুই তুকারি করছিলা।আর কি যেনো..মেয়েদের ডিসটার্ব করি,অসভ্য?

-আমিতো জানতাম না আপনি ফোন করেছেন..

-আচ্ছা ফাইন।এবারের মতো মাফ করে দিলাম।এখন বলো এতক্ষন কই ছিলো ফোন রিসিভ করনি কেনো?

-আননোন নাম্বার রিসিভ করিনা।আপনি এতবার ফোন দিচ্ছেন তাই ধরলাম..

-গুড।সাদিফ কই?ওকেও তো ফোন দিচ্ছি।
এতক্ষনে বুঝে মিহু।অভি আসলে সাদিফের সাথে কথা বলার জন্য তাকে কল দিয়েছে।তাই তো বলে,অভি তাকে ফোন দিবে কেন?

-আপনি ভাইয়ার সাথে কথা বলবেন তাইনা?আসলে ভাইয়া বাসায় নেই।বাইরে গেছে।

-আমি কখন বললাম ওর সাথে কথা বলবো?

-না মানে...

অভি কন্ঠে কোমলতা নিয়ে বলে,

-তুমি ঠি ক আছো?জর টর আসেনি তো?

মিহুর অদ্ভুত লাগে।অভি কন্ঠ কেমন অন্যরকম শোনায়।সে আমতা আমতা করে বলে,

-জি ঠি ক আছি।

-আচ্ছা রাখছি।আল্লাহ হাফেজ।

-শোনেন?

অভি ফোন কাটতে যেয়েও কাটেনা।জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলে,

-কিছু বলবা?

-আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?

-সেটা কি খুব কঠিন কিছু?

মিহু জবাব দেয়না।ভাবে,আসলেইতো..কি বোকার মতো একটা প্রশ্ন করলো সে।অভি হেসে ফোন কেটে দেয়।
এখন শান্তি লাগছে তার।খুব শান্তি....


সময় প্রবহমান।কারো জন্য থেমে থাকেনা।ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে নির্দিষ্ট গতিতে চলতে থাকে আমাদের জীবন।দেখতে দেখতে কেটে গেছে আড়াই মাস।
আজকেই শেষ হয়েছে মিহুর প্রি-টেস্ট পরীক্ষা।ব্যস্ত সময় কেঁটেছে তার।পড়াশোনায় সে মাঝামাঝি ধরণের স্টুডেনট।
বস্তুত ভালো করতে হলে পড়তেই হবে এই কথায় বিশ্বাসী সে।
পরীক্ষা দিয়ে কলেজ থেকে ফিরেই গোসলে ঢুকেছে।একঘন্টার যাবত শান্তিময় গোসল দিয়ে চুলে তোয়ালে পেচিয়ে বেরিয়ে এলো সে।পরীক্ষা বেশ ভালো হয়েছে আজকে,মনটা ফুরফুরে।আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল মুছছে আর গুনাগুন করে গাইছে-
"ও বেবি কাম কাম কাম কাম কাম কাম টু মি..
ও বেবি কাম কাম কাম কাম কাম কাম টু মি..ওওওওও
আমি তোমার হিরো হলে তুমি সুপারহিট...
ও বেবি...

আরো গাওয়ার আগেই সাদিফের ধমকে চমকে পিছে ফিরলো সে।

-"ওই কি বলোস তুই এইগুলা?"

মিহু ফিচলে হেসে বললো,

-"এটাতো গান ভাইয়া।"

সাদিফ চোখমুখ কুচকে তাকায়।মৃদু ঝাড়ি দিয়ে বলে,

-"এটা কেমন গোঁছের গান?...বাদ দে,তুই যেমন তোর গানও সেরকমই।

মিহু তেড়ে উঠে বলে,

-"আমি কেমন হ্যাঁ?তোমাকে কেউ বলসে আমার গান শুনতে?"

সাদিফ এসে কান টেনে ধরে মিহুর।মিহু চিল্লিয়ে বলে,

-"মাআআআ,দেখে যাও তোমার ছেলে আমাকে মারে"

সাদিফ দিগুন চিল্লিয়ে বলে,

-"হ্যাঁ আসো,দেখো তোমার মেয়ে "বেবি বেবি"গান গায়।আবার কাম টু মি কাম টুমি করে।আরো কি সব যে বলে!!

নাজিফা বেগম রান্নাঘর থেকেই চিল্লিয়ে বলে,

-"তোরা থামবি?সাদিফ তুই না বড়?মারিস কেনো?ছাড়বি নাকি আমি আসবো?

সাদিফ একটা মোচর দিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলে,

-"না থাক আসা লাগবেনা।ছেড়ে দিসি।"

মিহু একহাতে কান ঘঁষতে থাকে।ব্যাথা হয়ে গেছে।বিরবির করে বলে,
-"ফালতু,অসহ্যকর।"

-"কি বললি?"

মিহু ঝামটা দিয়ে বলে,
-"কিছুনা।...তুমি কি কাজে এসেছো?"

-"ওহ্,হ্যাঁ।আমি বলতে আসছিলাম যে,রাতে রেডি থাকিস তুই।আমার সাথে একটা দাওয়াতে যাবি।"

-"কিসের দাওয়াত?আমি যাবোনা।"

সাদিফ মিহুর মাথায় চাঁটি মেরে বলে,

-"তুই যাবি,তোর বাপ যাবে।...না থাক বাপ যাওয়ার দরকার নাই।তুই গেলেই হবে।এন্ড ইটস্ ফাইনাল।বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

মিহু মুখ ভেংচিয়ে চুল মুছতে থাকে।।এই কয়েকমাস পড়তে পড়তে ক্লান্ত সে।এখন একটা শান্তির ঘুম দিবে।

সন্ধ্যা ৭ টা...

মিহু রেডি হচ্ছে।একটু আগেই গভীর ঘুম থেকে টেনেটুনে তাকে তুলেছে সাদিফ।চোখে এখনো ঘুম ঘুম ভাব।

একটা কালো রংয়ের লং গাউন পরে নিলো ও।জামার ওড়নাটা লাল রংয়ের।তাই মিলিয়ে একটা লাল হিজাব 
পড়লো।হালকা একটু পাউডার দিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে নিল।ফোনটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হলো সে।

সাদিফ সোফায় বসে ওর জন্য অপেক্ষা করছে।মিহু কাছে যেয়ে বললো,

-আমি রেডি।চলো।

সাদিফ একনজর তাকিয়ে উঠতে উঠতে বললো,

-বাহ্।তোর তো খুব কম সময় লাগে তৈরি হতে।মেয়ে দের তো সাজ গোজ করতেই ঘন্টা পার হয়ে যায়।

মিহুর মুখে চওড়া হাসি ফুটে ওঠে।সাদিফ তার প্রশংসা বরাবরই খুব কম করে।হাসি হাসি মুখ নিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল সে।তার আগেই সাদিফ বলে,

-তোকে তো ভালোই দেখাচ্ছে।কি রে পেত্নী?মেক-আপ করেই ঘুমিয়েছিলো নাকি?

দপ করে নিভে যায় মিহু।কিছু না বলে রাগী ফেস নিয়ে হন হন করে বেরিয়ে যায় সে।
সাদিফ হাসে।বোনটা তার বাচ্চাই রয়ে গেলো!!!

_____________
-আম্মু,আজকে কিন্তু ও আসবে।

রুবিনা আহমেদ ছেলের কথায় ফিরে তাকায়।মৃদু হেসে বলে,

-আর কয়বার বলবি?

অভি ঠোঁটের কোঁণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলে,

-ও কিন্তু বাচ্চা মেয়ে মা।উল্টা পাল্টা কিছু বললে তুমি কিছু মনে করোনা।

-মনে করবোনা মানে?আমার ছেলেকে পাগল করে ফেলেছে।ওকে তো আমি আচ্ছা মতোন বকে দেবো।

-আচ্ছা বকে দিও।

অভি চলে যেতেই রুবিনা আহমেদ স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে।মেয়েটাকে দেখার খুব শখ তার।অভির মতো বদমেজাজি রাগী ছেলেও যে কাওকে এতটা ভালোবাসে ভাবতেই অবাক লাগে রুবিনার।
_____________

-কোথায় যাচ্ছি আমরা?মানে কার বাসায়?কিসের দাওয়াতে?

সাদিফ শান্ত কন্ঠে বলে,

-অভির বাসায়।ওর মায়ের জন্মদিন আজকে।সেখানেই যাচ্ছি।

মিহু থমকে যায়।অভির সাথে তার দেখা হয়না প্রায় দুইমাস।কতবার অভির ফোনে কল করতে যেয়েও করেনি সে।ভাবত কল করে কি বলবে?"আপনাকে মনে পরছিলো"।একটু কেমন শোনায় না?তাই আর করা হতো না।
আজকে এতোদিন পরে দেখা হবে।কেমন অদ্ভুত লাগছে মিহুর।আচ্ছা,এমন কেনো লাগছে?


মিহুর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অভি।মিহুর দৃষ্টি নিচের দিকে।উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়াছে সে।অভির রাগ হয়।ঠোঁটটার উপর এমন অত্যাচার চালাচ্ছে কেন মেয়েটা?পাশেই দাড়িয়ে আছে সাদিফ।
সাদিফ হাল্কা গলা ঝেড়ে অভির দিকে তাকিয়ে বলে,
-ভেতরে ঢুকতে দিবি না?
অভির হুঁশ ফিরে।দ্রুত সামনে থেকে সরে দাড়িয়ে বলে,
-হ্যাঁ,হ্যাঁ,আয়।
সাদিফ মুচকি হেসে ভিতরে ঢুকে।মিহুও ঢুকে তার সাথে।
অভিদের বাসাটা বেশ বড়ো।উপরতলার একদম কোণার ঘরটা অভির।
মিহু সাদিফের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে।আশেপাশে মেহমান।সবাই অচেনা।মিহু সহজে মিশতে পারেনা মানুষের সাথে।তার সময় লাগে।

রুবিনা আহমেদ কয়েকজন এর সাথে কথা বলছিলেন।সাদিফ তার দিকে এগিয়ে যায়।হাসিমুখে সালাম দিতেই উনি তাকায়।মিহুও সালাম দেয়।উনি সালামের উওর দিয়ে বলেন,

-কেমন আছো বাবা?
- আলহামদুলিল্লাহ আন্টি।আপনি কেমন আছেন?
-ভালো আছি।মিহুর গালে হাত রেখে বলেন,মিহু তাই না?

মিহু অবাক হয়।ভদ্রমহিলা ওর নাম জানল কি করে?মৃদু সরে উওর দেয়,"জি"।

-ভারি মিষ্টি দেখতে তুমি।অভির পছন্দ আছে...

মিহু চমকায়।কথার মানে বুঝতে না পেরে বলে,

-জি আন্টি?

রুবিনা বেগম দাঁত দিয়ে জিভ কাটেন।অভি তাকে এসব বলতে মানা করেছিল।তবুও সে বলে ফেলেছে।তাই কথা কাটানোর জন্য বলেন,

-মিহু তো আগে কখনো আসোনি।সাদিফ তো চিনোই সব।ওকে বাগানটা ঘুরিয়ে দেখাও।ওর ভালো লাগবে।অভিও যা সাথে।এখানে সব বড় মানুষদের আড্ডাখানা।বুড়ো মানুষের জন্মদিনতো!!তোমরা বাচ্চারা বোর হবা।বলেই হাসেন উনি।

মিহু মুগ্ধ হয়।ভদ্রমহিলা এতো সুন্দর করে কথা বলে।দেখতেও বেশ সুন্দরী।চেহারায় বয়সকের ছাপ আছে তাও সুন্দরী।মিহু মনে মনে বলে,"এজন্যই মনে হয় উনিও এতো সুন্দর"।কিসব ভাবছে সে!!হুহ্!!

__________
বাগানে এসে দেখে ঘুটঘুটে অন্ধকার।অভির ভ্রু কুচকে আসে।সব লাইট তো জ্বালানো ছিলো।বন্ধ করলো কে!!
মিহু সাদিফের গা ঘেঁষে দাড়ায়।সাদিফ একহাতে জড়িয়ে ধরে তাকে।অন্ধকার ভয় পায় মিহু।

অভি"একটু দাড়া,আমি দেখছি"বলে ভেতরে যায়।কিছুক্ষনের মধ্যেই সব লাইট জ্বলে উঠে।মিহু পিটপিট করে তাকায়।চোখে আলো সয়ে যেতেই অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকায়।এতো বড় ফুলের বাগান!!
মিহু এগিয়ে যায়।সাদিফ পকেট থেকে ফোন বের করে।হাঁটতে হাঁটতে ফোন চালায় সে।
অভি মিহুর পাশে পাশে হাঁটে।একটা গাছ দেখে দাড়িয়ে পরে মিহু।হলুদ রংয়ের বেশ সুন্দর ফুল ফুঁটে আছে সেটায়।মিহু হাত দিয়ে ধরে কৌতুহলী কন্ঠে বলে,

-এটার নাম কি?

অভি সাদিফের দিকে তাকায়।তাদের থেকে কিছুটা দুরে দুরে হাঁটছে সে।চোখের দৃষ্টি ফোনের মধ্য আবদ্ধ।
অভি মিহুর দিকে কিছুটা ঝুকে বলে,

-এটার নাম আলমান্ডা।বাংলায় বলে অলকানন্দা।

মিহুর  উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বর,

-বাহ্,বাংলা নামটাতো অনেক সুন্দর।অলকানন্দা!!

অভি তীর্যক গলায় বলে,

-তুমি নিবে?ছিঁড়ে দিব?

মিহু অভির দিকে তাকায়।অভিকে এত কাছে দেখে হৃদস্পন্দন দৌড়াতে থাকে তার।আমতা আমতা করে বলে,

-নাহ্,ফুল গাছেই সুন্দর লাগে।ছিঁড়ে নিলে সৌন্দর্যের ব্যাঘাত ঘটে।

অভি মিহুর এমন ফেস দেখে সরে দাড়ায়।তার মুখে তার প্রশস্ত হাসি।হাত দিয়ে চুলগুলো পেছনে ঠেলে দেয় সে।মিহু অদ্ভুতভাবে তাকায়।অভির এই হাত দিয়ে চুল সরানো টাও একদম পারফেক্ট ভাবে করে।
সাদিফ ততক্ষনে মিহুর পাশে এসে দাড়িয়েছে।পকেটে ফোনটা ঢুকাবো ঢুকাতে সে বললো,

-হলো তোর ফুল-ফল দেখা?
মিহু ভ্রু কুঁচকে বলে,
-এখানে ফল নেই ভাইয়া।শুধু ফুল।
সাদিফ ফিচেল হাসে।
-তুই আছিস না?আসত একটা কঁদবেল।
মিহু তেড়ে উঠে।গলা উঁচিয়ে বলে,
-ভাইয়া!!!

-ওর সাথে না লাগলে হয় না তোর?চল ভেতরে চল।কেক কাটবে এখন।
_____________
অভি আগে ঢুকে।পিছে পিছে ঢুকে সাদিফ মিহু।একটা জায়গায় দাঁড়াতেই মিহুকে ধাক্কা দিয়ে সামনে যায় একটা মেয়ে।সাদিফ ধরে ফেলে বিধায় সামলে নেয় মিহু।নয়তো নির্ঘাত এতগুলা মানুষের সামনে পরে গিয়ে মান-সমমান যেতো তার।
সামনে যেয়ে অভিকে জড়িয়ে ধরে নিশাত।অভি চকিতে তাকায়।এতগুলা মানুষের সামনে নির্লজ্জের মতো নিশাত জড়িয়ে ধরেছে তাকে।অভির প্রচন্ড অসস্তি হয়।সাথে তুমুল রাগ।মিহুর দিকে তাকায় সে।মেয়েটা মাথা নিচু করে রেখেছে।আচ্ছা ও ভুল বুঝলো না তো?

মায়ের এত স্পেশাল একটা দিন সিন ক্রিয়েট করে নষ্ট করতে চায়না সে।তাই চাপা সরে ধমকে বলে,

-নিশাত,ছাড় আমাকে।নির্লজ্জের মতো এগুলা কেমন ব্যবহার?
নিশাতের কোনো হেলদোল নেই।সে বলে,

-তুমি কই ছিলে?কতক্ষন যাবত তোমাকে খুঁজছি আমি।
অভি জোরে একটা শ্বাস নিয়ে রাগ দমনের চেষ্টা করে।নিশাতের বাহু ধরে ছাড়িয়ে নেয় নিজের থেকে।ভাগ্য ভালো আশেপাশের মানুষ খেয়াল করেনি।

-নিজের ভালো চাইলে ফারদার এমন করবিনা নিশাত।গট ইট?

নিশাত ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।রাগে অপমানে চোখে পানি চলে আসে তার।কেন তাকে অভি পছন্দ করেনা?কেন?
________________
সেদিনের পর আবারও মিহুর সাথে অভির দেখা হয়না প্রায় অনেকদিন।কথায় আছে না "দুরত্বে প্রেম বাড়ে"।
সেটাই হচ্ছে মিহুর সাথে।ভালোলাগাটা তুমুল বেগে ভালবাসায় রুপ নিচ্ছে।তবে বলার সাহস নেই মিহুর।
তার মধ্য জড়তা কাজ করে।সাদিফ,তার বাবা,মা কেমন ভাবে নিবে বিষয়টা?জানা নেই তার।তার উপর ওইদিনের মেয়েটার ওইরকম একটা কাজ।হয়তোবা মেয়েটা অভির কিছু হয়!খুব ঘনিষ্ট কেউ!!

একদিন সকালে নাস্তা করছিলো সে।সাদিফ তার পাশেই বসে খাচ্ছে।মাস্টার্স এর কনভোকেশন ছিলো তার একসপ্তাহ আগে।পড়াশোনা শেষ।পি এইচ ডি করার জন্য আমেরিকার ইউনিভার্সিটিতে এপলাই করেছে সে আর অভি।মাসখানেক লাগবে হয়তো কনফার্মেশন মেইল পেতে।
হঠাৎ করেই মিহুর প্রচন্ড মাথাব্যাথা শুরু হয়।দুহাতে মাথা চেপে ধরে ও।সাদিফ হকচকিয়ে মিহুর মাথায় হাত রেখে বলে,

-কি হলো মিহু?
মিহু কোনমতে বললো,
-মাথাব্যাথা করছে ভাইয়া।খুব মাথাব্যাথা।আমি..বলতে বলতেই সাদিফের গায়ে ঢলে পরে সে।অজানা আতঙ্কে বুক ভারি হয়ে যায় সাদিফের...


মিহুর রিপোর্ট হাতে নিয়ে বসে আছে সাদিফ।চোখ লাল হয়ে আছে তার।মুখে উদ্ভ্রানতের আভাস।
কেবিনের বাইরে তার মা অঝোর ধারায় কাঁদছে।বড়মামী সামলাচ্ছে তাকে।সাদিফ তাদের কি বলে সান্তনা দিবে জানা নেই।তার নিজেরই কেমন হিসেবছাড়া লাগছে ।কয়দিন যাবত এত মাথা ব্যাথা হতো মিহুর।ওরা ভাবত নরমাল মাইগ্রেনের ব্যাথা হয়তো।কিন্তু তাদের ধারনা সম্পূর্ণ ভুল ছিলো।মিহুর ব্রেইন টি উমার ধরা পরেছে।

ডাক্তারের কথাগুলো মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে বেরিয়ে এলো সাদিফ।মাকে দেখে একটা দীর্ঘ-শ্বাস ছাড়ে সে।বলা বাহুল্য মিহুর বাবা বিদেশ থাকে।তাই সবটাই সাদিফের দায়িত।সে বড়-মামার দিকে তাকিয়ে যথাসম্ভব কঠিন গলায় বলে,

-মামা,ডাক্তার বলেছেন সপ্তাহ খানেকের মধ্য অপারেশনটা করিয়ে ফেললেই ভালো হবে।তবে বাংলাদেশে নয়,ইন্ডিয়ায়।মিহুর তো পাসপোর্ট নেই।তুমি কোনোভাবে সেটা ম্যানেজ করতে পারবেনা?

-অবশ্যই।সেটা কোনো ব্যাপার না।

-ওকে।ইন্ডিয়ায় কোথায় কি করতে হবে সেগুলো আমি দেখে নেব।সেটা নিয়ে টেনশন করার কোনো কারণ নেই।এখন একটু বাইরে যাচ্ছি।মিহুর কিছু ওষুধ আনতে হবে।

সাদিফ বেরিয়ে যায়।মিহু এখনো অচেতন।মূলত ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে তাকে।
বোধকরি স্ট্রেস নিলে তার মাথায় চাপ পরবে।তাই ঘুমিয়ে থাকাই শ্রেয়।

রিকশা থেকে দ্রুত নেমে হসপিটালে ঢুকে ইপসা।অনেকবার মিহুকে কল দেয়ার পরও যখন সে ধরেননি তখন সে বাধ্য হয়েই তার মাকে কল করে। ফোন রিসিভ করে মিহুর মামি।তার থেকেই মিহুর এই অবস্থা জানতে পেরেছে ও।একমুহূর্তও দেরি না করে হসপিটালের নাম জেনেই ছুটে এসেছে সে।রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও মিহু যে তার কাছে কি সেটা শুধু সে আর সৃষ্টিকর্তা জানে।জীবনের একপর্যায়ে যখন সে সুইসাইডের মতো জঘন্য কাজ করতে গিয়েছিল।তখনো ফ্যামিলির মানুষ নয় বরং মিহুই তাকে সামলেছিলো।তাকে বুঝিয়েছিলো।এজন্যই হয়তো আজও বেঁচে আছে সে।

রিসিপসনিসট এর থেকে কেবিন নম্বর জেনে সিঁড়ি দিয়ে উঠার পথে সাদিফকে চোখে পরে তার।তাকে বোধহয় খেয়াল করেনি ,পাশ কাটিয়ে দ্রুত নিচে নেমে যায় সাদিফ।ইপসা ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে উপরে উঠে যায়।সে সাদিফের প্রতি দূর্বল।সেটা সে জানে এবং মানেও।তবে দূর্বলতা টাকে প্রশয় দেয়না ও।দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে।
"একপাক্ষিক ভালোবাসায় প্রশান্তি থাকে না,থাকে শুধু না পাওয়ার প্রবল যন্ত্রনা ও হাহাকার।"
_____________
বিছানায় হেলান দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিলো অভি।হাতে ধোঁয়া উঠা কফির মগ।একটা চুমুক দিয়ে কিছু একটা ভেবে সাদিফকে কল দেয় সে।প্রথমবারে রিসিভ হয়না।ভ্রু কুচকে আবারো কল করে।এবার রিসিভ হয়।ওপাশ থেকে সাদিফের ভাঙা কন্ঠে ব্যস্ত গলা শোনা যায়,

-হ্যাঁ,অভি বল।

-তুই কি ব্যস্ত?তোর গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?

সাদিফ একটা ফাঁকা ঢোক গিলে নিজেকে সামলে বলে,

-মিহু হসপিটালে।ওর....

-ওয়াট!!কেনো?কি হয়েছে ওর?Is she okay?ও ঠি ক আছে তো?

-নাহ্ ও ঠি ক নেই অভি।আমার এতটুকু বোনটার ব্রেইন টি উমার হয়েছে।(কন্ঠ ভার হয়ে আসে সাদিফের)

অভি স্তব্দ হয়ে যায়।কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে তার।ধাক্কাটা নিতে পারেনা সে।কথা বের হয়না মুখ দিয়ে।

-আচ্ছা রাখছি হ্যাঁ?অভি?

ফোন কেটে যায়।সাদিফ কান থেকে নামাতেই আবার রিং হয়।রিসিভ করে সাদিফ।অভি শুধু বলে,
-কোন জায়গায় আছে ও?

সাদিফ হসপিটালের নাম বলে।অভি"ওকে"বলে কেটে দেয়।
_____________
নাজিফা বেগম মিহুর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।ইপসা একপাশে বসে হাত ধরে রেখেছে।মিহু বারবার তাদের দিকে তাকাচ্ছে।মাথায় ব্যাথাটা এখন নেই।তবে বুঝতে পারছে তার হয়তো কোন বড় অসুখ হয়েছে।সে স্লান কন্ঠে বলে,

-আচ্ছা আমার কি হয়েছে?আমাকে বলবা তো?

নাজিফার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরে।

-ইপসা তুই তো বল?

ইপসা মৃদু হাসার চেষ্টা করে বলে,
-কিছু হয়নি তোর।একদম পারফেক্ট আছিস তুই।

মিহুর বিশ্বাস হয় না।চোখ বন্ধ করে সে।কিছুক্ষন পর চোখ খুলে বলে,
-ভাইয়া কোথায়?

ইপসা কিছু বলার আগেই সাদিফ ঢুকে কেবিনে।হাতে তার ওষুধের প্যাকেট।
-ভাইয়া এখানে মিহু।মিহু তাকায়।হাসি ফুটে তার মুখে।ইপসা দাড়িয়ে যায়।সাদিফকে বসার জায়গা দেয়।
সাদিফ মিহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নাজিফা বেগমকে বলে,

-মা,তুমি যেয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নাও।তোমার বিপি লো হয়ে যাবে।

নাজিফা যেতে চায়না।সাদিফ জোর করে ইপসার সাথে পাঠিয়ে দেয় তাকে।এখন মা ও অসুস্থ হয়ে পরলে কয়জনকে সামলাবে সে?
তারা বেরিয়ে যেতেই সাদিফ মিহুর দিকে তাকায়।হাল্কা হাসার চেষ্টা করে বলে,
-মাথা ব্যাথা করছে নাতো?

মিহু মাথা নাড়িয়ে বলে,
-উহু।করছেনা।...আমার কি হয়েছে?কেউ কিছু বলেছেনা কেন?

সাদিফ একটা লম্বা দম ফেলে।নার্স কিছু খাবার নিয়ে ঢুকে।সাদিফ সেগুলো নিয়ে বলে,"আপনি যান,আমি খাইয়ে দিব।"

নার্স চলে যেতেই মিহুকে উঠিয়ে হেলান দিয়ে বসাতে বসাতে বলে,"আমি বলছি"।
মিহুর মুখে খাবার তুলে দিয়ে বলে,
-দেখ মিহু,আমি যা বলবো তুই কিন্তু একদম ভয় পাবিনা।
মিহু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।সাদিফ আরেক গাল খাবার তুলে দিয়ে বলে,
-তোর মাথায় একটা ছোট্ট টি উমার হয়েছে।ভয়ের কিছু নেই।একটা ছোট্ট অপারেশন করতে হবে জাস্ট।বাংলাদেশেও করানো যাবে।বাট তোর সেইফটির জন্য আমরা ইন্ডিয়ায় করাবো।ওখানের চিকিৎসা খুব উন্নত।
কোনো রিস্ক থাকবেনা।বুঝলি?

মিহু নির্বিকার।তার কেমন রিয়্যাক্ট করা উচিত বুঝতে পারছেনা।সে কি কাঁদবে?কিন্ত কান্না আসছেনা।
সে স্বাভাবিক গলায় বললো,

-আমি কি মারা যাবো ভাইয়া?

সাদিফের বুকটা ধক করে উঠে।সে শক্ত কন্ঠে বলে

-এসব কি বলিস?ব্রেইন টিউমারে কেউ মারা যায় নাকি?কত মানুষের হয় এমন।

মিহু হাসে।সে জানে,"অধিকাংশই বাঁচেনা"।এতোটা ছোট সে নয় যে কিছু বুঝেনা।তবে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলেনা।চুপচাপ খেতে থাকে।তারপর ওষুধ খেয়ে শুয়ে পরে।ঘুমের ওষুধের ডোজ বেশি হওয়ায় কিছুক্ষনের মধ্যই ঘুমিয়ে পরে।

মিহুর ঘুমন্ত মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকায় সাদিফ।খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার।চোখের পানি আটকে রেখে শক্ত হওয়ার চেষ্টা করে।নি:শব্দে তার পাশে এসে দাড়ায় ইপসা।সাদিফ বুঝতে পারে।মাথাটা কিছুটা ঝুকিয়ে ফেলে সে।কাঁদতে চাচ্ছেনা সে।ইপসা পাশে বসে একহাত সাদিফের কাঁধে রাখে।সাদিফ আর আটকাতে পারেনা।ইপসাকে জাপটে ধরে ফুপিয়ে উঠে।
ইপসা থমকে যায়।কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করে।খানিকক্ষণ পর কাঁধে চোখের পানির অস্তিত্ব পেতেই বুঝে সাদিফ কাঁদছে।সে ধীর কন্ঠে বলে,

-শান্ত হন ভাইয়া।মিহু ঠিক হয়ে যাবে।

সাদিফ তাকে ছাড়েনা।ইপসাও আর কিছু বলেনা।সাদিফকে বাঁধা দিতে ইচ্ছা করেনা তার।কেমন আপন আপন অনুভব হয় তার।
কিছু সময় পরে সাদিফ নিজেই ছেড়ে দেয় তাকে।উঠে দাড়িয়ে অপ্রস্তুতভাবে বলে,

-আ'ম সরি।আ'ম রিয়েলি সরি।আই কান্ট কন্ট্রোল মাইসেলফ।রিয়েলি সরি।

ইপসা চাপা সরে বলে,

-ইটস্ ওকে।

সাদিফ দ্রুত বেরিয়ে যায়।এরকম লজ্জায় সে কখনো পরেনি।
__________
হনহনিয়ে কেবিনের সামনে যায় অভি।সাদিফকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,

-মিহু ভেতরে?
-হ্যাঁ।ঘুমাচ্ছে।
কাঁচের দরজা দিয়ে তাকায় অভি।মিহু ঘুমিয়ে আছে।তার হাত ধরে পাশেই মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে ইপসা।
-ভেতরে যা সমস্যা নেই।
অভি ভেতরে ঢুকে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বের হয়ে আসে।মনে তার এক টাই প্রশ্ন,"আমার মিহুপাখির সাথেই কোনো এমন হলো?"

অভি বেরিয়ে আসতেই সাদিফ বলে,
-তুই এতো চিন্তা করছিস কেনো?বোনটা তো আমার।বন্ধুর বোনের জন্য এতোটা চিন্তা?
অভি স্লান হেসে শান্ত সরে বলে,

-ইউ নো, আই লাভ হার...


ব্যস্তময় শহর।প্রকৃতিতে যেন নেমে এসেছে বিষাদময় পূর্বাভাস।বাতাস গুলোও কেমন তেতো ঠেকছে।
এয়ারপোর্টে সবাই ব্যস্ত নিজ নিজ কাজে।পিনপতন নিরবতা নয় তবে কোলাহলের মাত্রা খুবই কম।

টিকিটের যাবতীয় কাজগুলো শেষ করে ফিরে এলো সাদিফ।নাজিফা বেগম এখনো মিহুকে জাপটে ধরে ফোপাচ্ছেন।উপস্থিত সবার চোখই পানিতে পরিপূর্ণ।ইপসা,ফারিয়া,তার বড়মামি সবাই ই বারবার চোখ মোছার বৃথা চেষ্টা করছে।মিহুর কোনো ভাবান্তর নেই।সে কেমন যেন অনুভূতিহীন।উল্টো পাশ থেকে সাদিফকে ফিরে আসতে দেখে সে মুচকি হেসে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

-কাঁদছো কেনো মা?তোমার কি মনে হচ্ছে আমি মারা যাব?
নাজিফার কলিজা কেঁপে উঠলো।এত আদরের মেয়ে তার!যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়?প্রতিউওরে কিছু বলার আগেই সাদিফ এসে কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,
-তোকে না বলেছি উল্টা পাল্টা প্যাঁচাল পারবি না?চুপ করে থাক।মা তুমি কান্না বন্ধ করো।আমাদের ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে।যেতে হবে।

মামার কাছে যেয়ে লাগেজগুলা পরখ করে নেয়।সবার দৃষ্টির অগোচরে ক্ষীণ সরে ইপসাকে বলে,

-মায়ের খেয়াল রেখো।
ইপসা মাথা কাত করে।যতদিন ওরা ফিরছেনা ততদিন মিহুর মায়ের সাথেই থাকবে সে।

সাদিফ নিজের লাগেজটা একহাতে ধরে আরেকহাতে মিহুর হাতটা শক্ত করে ধরে সে।মিহু আরেকবার চারপাশটায় চোখ বুলায়।ঘন পল্লবে ঢাকা চোখগুলো দিয়ে বারদুয়েক পলক ফেলে অতি আকাঙক্ষিত ব্যক্তিটাকে খুঁজে।
কিন্তু নাহ্,যতদূর তার দৃষ্টি যায় ততটুকুতে নাই সে।আবারও চোখ বন্ধ করে সে।ভাবে খুললেই হয়তো দেখবে অভি তার সাথে দেখা করতে এসেছে।হয়তোবা শেষ দেখা।তবুও দেখা তো হোক।
হাতে টান পরতেই সম্ভিৎ ফিরে তার।সাদিফ তাকে হাঁটার জন্য ইশারা করছে।দীর্ঘ:শ্বাস ফেলে পা বাড়ালো সে।
চোখের মনি এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছে বারংবার।চোখের কোঁণে জমা হচ্ছে অভিমানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সিক্ত কণা।
তাহলে কি অভি তাকে শুধুই বন্ধুর বোন মনে করে?আর কিছুইনা?তার অসুস্থতার কথা শুনে একটিবারের জন্যও কি তার সাথে দেখা করা যেতো না?নাকি উনি আমার অসুস্থতার কথা জানেই না?পরক্ষনেই ভাবে,নাহ,ভাইয়া অবশ্যই তাকে বলেছে।হয়তো উনিই প্রয়োজনবোধ করেনি অথবা তার ইচ্ছাই হয়নি দেখা করার।
এই একসপ্তাহে নিজের মনকে শক্ত করেছে মিহু।পৃথিবীতে শুধু বেঁচে থাকাটাই যে কতটা সুখের সেটা ক্ষনে ক্ষনে বিস্তরভাবে উপলদ্ধি করতে শিখেছে।যদিও বেশিরভাগ সময়ই ঘুমিয়ে থাকত সে।মূলত ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো তাকে।যেন মাথায় চাপ না পরে।
বড়মামা,সাদিফ আর সে যাচ্ছে ইন্ডিয়ায়।তার বাবা দেশে আসতে চেয়েছিলো তবে ভিসা পায়নি তাই আসা সম্ভব হয়নি।মিহু মুখ ঘুরিয়ে পিছে তাকায়।তার অতি প্রিয় মানুষগুলোর ছলছল নয়নের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে।জানে না আবার আসতে পারবে নাকি দেশে,দেখতে পারবে নাকি প্রিয় মানুষগুলোকে।

প্লেনে উঠার আগমুহূর্ত পর্যন্ত সে ভেবেছিলো অভি সাথে হয়তো দেখাটা হবে।কিন্তু নাহ্!!আসলেই দেখাটা হলোনা!!সিটে মাথা এলিয়ে দিলো মিহু।চোখ বন্ধ করে মনে করলো সেদিন অভির মায়ের জন্মদিনের দিন তাদের শেষ দেখার হওয়ার সময়টা।চোখের কোঁণ ঘেঁষে দু ফোটা অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পরলো।
সাদিফ তাকে কাঁদতে দেখে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,

-মাথা ব্যাথা করছে তোর?ওষুধ নিয়েছিলি না?

মিহু সন্তর্পণে পানিটা মুছে মৃদু হেসে বললো,

-ব্যাথা করছেনা ভাইয়া।তুমি চিন্তা করোনা।

সাদিফের চোখেমুখে বিস্ময়।এই এক সপ্তাহে মিহুকে একবারও কাঁদতে দেখেনি সে।কোথাও হালকা কেটে গেলেও বাড়িঘর মাথায় তুলে বসতো মিহু।আজ পর্যন্ত মাকে ছেড়ে একা কোথাও বেড়াতে পর্যন্ত যায়নি।অথচ আজকে...এই নির্ভীক মিহুকে নতুন করে দেখছে সে।নিজের ছোট্ট বোনটাকে নতুন করে চিনছে।

___________
ঘন্টাখানেক পরে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হবে মিহুকে।সাদিফের কাঁধে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে।বাবার সাথে কথা হয়েছে কিছুক্ষন আগে।বাবার কন্ঠ টা কেমন যেন ভেজা ভেজা শোনাচ্ছিল..বাবাকে কখনোই কাঁদতে দেখেনি মিহু।
চোখ না খুলেই একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,

-আমার খুব ভয় করছে ভাইয়া।
সাদিফ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-ভয় পাবি কেনো?কত রেয়ার কেস আছে জানিস,মানুষ বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছা প্রকাশ করে বলে বেঁচে যায়।
মনের জোরটাই আসল।এই ভয় তোর বেঁচে থাকার ইচ্ছা টাকে গ্রাস করে ফেলবে বোন।মনে সাহস রাখ।আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।

মিহু উওরে কিছু বলার আগেই কেবিনে কারও ঢোকার শব্দে মুখ তুলে তাকায়।সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে যায় সে।মুখটা কিনচিত ফাঁক হয়ে যায়।একটু আওয়াজ করেই বলে উঠে,

-আপনিইইই?

অভি কাছে এগিয়ে যায়।সাদিফ উঠে ,"আমি একটু ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসি"বলে বেরিয়ে যায়।
অভি যেয়ে মিহুর পাশ ঘেঁষে বসে।একহাত দিয়ে বাহু জড়িয়ে ধরে বলে,

-আমার মিহুপাখি ভয় পাচ্ছে কেন?
অভির মুখে "আমার মিহুপাখি"ডাক শুনে লজ্জারাঙা হয়ে যায় মিহু।সেগুলোকে পাশে রেখে দৃঢ় অভিমানি কন্ঠে বলে,

-আপনি আমাকে দেখতে আসেননি কেনো?আমাকে কি আপনার মনে পরে না?নাকি আমি আপনার কেউ নই?
এই সময়ও মিহুর ছেলেমানুষি কথা শুনে অবাক হয় সে।আবার খুশিও হয় এই ভেবে যে মিহুর নার্ভাসনেসটা একটু হলেও কমেছে।

অভি কিছুটা ফিসফিসিয়ে বলে,
-আমি রোজ তোমাকে দেখতে আসতাম।তুমি ঘুমিয়ে থাকতে বিধায় আমাদের দেখা হতোনা।আর শোনো,তুমি আমার মনেই থাকো তাই আর মনে করার দরকার পরে না।আর কি যেন বললে,তুমি আমার কেউ না?তুমিই তো আমার সব।আলাদা করে বলতে হবে মিহুপাখি?

মিহু মাথা নাড়ায় অর্থ্যাৎ "আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।সে বুঝতে পারছে"।

অভি মিহুর হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে।একহাতের উল্টোপিঠে আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে বলে,
-তোমাকে আমার জন্য হলেও বাঁচতে হবে মিহুপাখি।তোমায় ছাড়া আমি সত্যিই অপূর্ন।এই অপূর্ন আমার সঙ্গে পূর্নতা প্রাপ্তির পথটুকু চলার জন্যে হলেও আমার তোমাকে প্রয়োজন।একটু বেশিই প্রয়োজন মিহুপাখি।

মিহু মাথা নিচু করে রেখেছে।ভাবছে কেনো এই মুহূর্ত গুলো তার জীবনে আর একটু আগে এলোনা?এই অনুভূতিগুলো উপভোগ করার সময়টুকুও কি পাবে না সে?
হঠাৎই বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙক্ষা জেগে উঠলো মিহুর হৃদয়ে।হ্যাঁ,তাকে বাঁচতেই হবে।

খানিক পরেই নার্স এলো।মিহুর পোশাক বদলে অপারেশনের পোশাক পরিয়ে দেয়ার জন্য।
অগত্যা অভি বেরিয়ে যায়।বেরোনোর সময় একবার মিহুর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।
মুখে হাসি দিলেও মনে মনে দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়ে মিহু।আদৌ কি বাঁচবে সে?

ঘন্টা দুয়েক যাবত অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হয়েছে মিহুকে।সাদিফ একদৃষ্টিতে থিয়েটারের বাইরে জলতে থাকা লাল রংয়ের বাল্ব টার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।ভাবছে,এই বাল্ব টার রং লাল কেনো?লাল রং তো বিপদের আভাস দেয়।

মিহুর বড়মামা সামনেই বসে আছে।আড়চোখে অভিকে দেখছে সে।নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে পাথরের ন্যায় বসে আছে অভি।

এই একটা সপ্তাহ ছেলেটা কি না করেছে মিহুর জন্য?একদিন আগেই ইন্ডিয়ায় চলে এসেছিলো সে।এখানের হসপিটাল,ওদের থাকার জায়গাসহ সবকিছু ম্যানেজ করেছে।মিহুর প্রতি তার ভালোবাসাটা ঠি ক কতখানি গভীর সেটা উনিসহ বাসার সবাই ইতিমধ্যেই বুঝে গেছে।ছেলেটা মুখে কিছু না বলেও কতকিছু প্রমান করে দিয়েছে।

হঠাৎই একজন ডাক্তার হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।সাদিফ কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই বলে,

-পেশেন্টের মস্তিষ্কে খুব রক্তক্ষরণ হচ্ছে।ইটস্ নট আ গুড সাইন।তবুও আমরা আমাদের সর্বোচচ চেষ্টা করবো।ডোন্ট ওয়ারি।

বলেই ডাক্তারটা চলে যায়।সাদিফ স্তব্দ হয়ে যায়।অভি তখনো ঠায় বসে আছে।দুহাতে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে।
মস্তিষ্ক বলছে,খারাপ কিছু হবে।আবার মন বলছে,আল্লাহ এতটা নিষ্ঠুর হবেননা ওর প্রতি।
__________
ছয় বছর পর....

হসপিটালের সামনে থামানো একটা গাড়িতে বসে আছে মিহু।গাড়ির জানালাটা দিয়ে চেয়ে আছে বাইরের দিকে।তাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে অভি ভেতরে গেছে রিপোর্ট আনতে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরে এলো অভি।ড্রাইভিং সিটে বসে রিপোর্টটের প্যাকেটটা পেছনের সিটে রাখলো।মিহুর সিটবেল্ট বেঁধে দিয়ে জানালার কাঁচ তুলে দিয়ে বললো,
-গ্লাস আটকে দিয়ে গিয়েছিলাম আমি। শীতের মধ্যেও তোমার হাওয়া না লাগালে চলেনা না?
মিহু ভেংচি কেটে অভির দিকে তাকিয়ে বললো,
-না চলে না।জানালা খোলাই থাকবে।আটকালেন কেন?খুলেন বলছি।
অভি চোখ গরম করে তাকায়।মিহু মুখ ফুলিয়ে চোখ নামিয়ে পেটে হাত রেখে বিরবির করে বলে,
-আমি কতবার বললাম,আমার আসতে ইচ্ছা করছে না হসপিটালে।না তাও আনতেই হবে।চেকআপ করাতেই হবে।এত জেদি তোর বাবা।বুঝলি,তোর বাবা আমাকে কত অত্যাচার করে?

অভি এক ভ্রু উচিয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।
মিহু চারমাসের অন্ত:সত্তা।গোলগাল হয়ে গেছে মেয়েটা।ফোলা গালগুলো আরো ফুলিয়ে রেখেছে।
অভি তার একগালে আঙ্গুল দিয়ে টোঁকা দিয়ে পকেট থেকে একটা বড় চকলেটের প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিয়ে বলে,

-চেকআপ করানো জরুরি ছিলো বলেই করিয়েছি।এখন গাল না ফুলিয়ে এটা খাও।

মিহু ভ্রু কুচকে টান দিয়ে চকলেটটা নেয়।প্যাকেটটা খুলে এমন একটা ভাব করে যেন সে খুব বিরক্ত।
অভি হেসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।মিহু তার অমূল্য সম্পদ।হারাতে হারাতেও ফিরে পেয়েছে তাকে।

সেদিনের অপারেশনে মিহু বেঁচে গিয়েছিলো।আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছে তাকে।এতগুলা মানুষের দোয়া ফিরে দেয়নি আল্লাহ।অবস্থা ক্রিটিকাল হওয়া সত্তেও ধীরে ধীরে রিকোভার হয়েছিলো।৭২ ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরেছিলো তার।

-এই গাড়ি থামান।আমি চা খাবো।পাশের চায়ের দোকানের দিকে ইশারা করে মিহু।
অভি গাড়ি না থামিয়ে বলে,
-এখন এইসব চলবেনা।রাত হয়েছে অনেক।আরেকদিন নিয়ে আসবোনে।
মিহু একহাত দিয়ে অভিকে হাত ঝাঁকিয়ে বলে,
-থামান না প্লিজ।
গাড়ি থামিয়ে দেয় অভি।দীর্ঘ:শ্বাস ফেলে বলে,
-আচ্ছা বসো।আমি নিয়ে আসি।
মিহু কিছুটা সাহস নিয়ে বলে,
-বাইরে যেয়ে খাই?
অভি সোজা মানা করে দেয়।
-একদম না।আমি এনে দিচ্ছি।এরপর গাড়ির দরজা লক করতে করতে বলে,"তোমার ভরসা নাই।গাড়ি লক করে দিয়ে যাই।"

নিচু হয়ে মাথা ঢুকিয়ে মিহুর দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয় অভি।মিহু মুখ বাঁকা করে সেটা নেয়।
অভি নিজের কাপটা নিয়ে বসতেই মিহু বলে,
-সিটবেল্টটা খুলে দেন না।আরাম পাচ্ছিনা বসতে।
অভি সিটবেল্টটা খুলে দিতেই তার ফোন বেজে উঠে।হাতে নিয়ে দেখে সাদিফের ফোন।রিসিভ করতেই সাদিফের ব্যস্ত স্বর শোনা যায়,
-হ্যালো অভি, ইপসার খুব বমি হচ্ছে।কিছু খেতে পারছেনা।ওর ডাক্তারটাও ফোন ধরছে না।মিহুর ডাক্তার টার নাম্বার টা দে তো।ওনাকে ফোন করি।

-এই সময় এমন হয়েই থাকে।তুই এতো চিন্তা করিস না।আমি নাম্বার মেসেজ করে দিচ্ছি তুই ফোন করে দেখ।

ফোন কেটে নাম্বারটা মেসেজ করে দেয় অভি।সাদিফ-ইপসার বিয়েটা ওদের বিয়ের সাথেই হয়।দুইবছর আগে তাদের পি এইচ ডি শেষ করে দেশে ফেরার পরই বিয়েটা করে নেয় ওরা।বলা বাহুল্য,ইপসাও এখন তিনমাসের অন্ত:সত্তা।

চায়ে চুমুক দিয়ে মিহুর গায়ের শালটা ঠি ক করে জড়িয়ে দেয় অভি।গাড়ির লাইট নিভানো।চাঁদের আলোতে স্নিগ্ধ দেখা যাচ্ছে সবকিছু।অভি মাথা ঝুকিয়ে মিহুরপেটে একটা চুমু খায়।মিহুর লজ্জায় লালবর্ণ ধারণ করা গালদুটো চোখ এড়ায়না তার।সে মিহুর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে নেশাতুর কন্ঠে বলে,

"আমার সবটা জুড়েই শুধু তুমি আছো মিহুপাখি।আর এখন তোমার মাঝেও আমার অস্তিত্ব ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে।আমার সকল অনুভূতিতে শুধু তুমি এবং তুমিই।আমার ভালোলাগা,খারাপলাগা সবকিছুতেই শুধু তুমিই বিরাজ করো।আমার সকল অনুভূতির একটাই নাম-"তুমিময় অনুভূতি"।"





______সমাপ্ত______





Writer:- মালিহা খান

NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner