Leave a message
> কনে দেখা আলোয় পর্ব ৩
-->

কনে দেখা আলোয় পর্ব ৩



সেদিন সারাটা দিন যে কিনঞ্জলের কিভাবে কেটেছে তা একমাত্র কিনঞ্জলই জানে।যতবার ও সাক্ষরের সামনা সামনি হয়েছে ঠিক ততবারই শরীর থেকে আঁচল পরে যাওয়ার ব্যাপারটা মাথায় চারা দিয়ে উঠেছে।বিকেলের মধ্যেই ওদের বউভাতের সমস্ত আনুষ্ঠিকতা শেষ হয়ে গিয়েছে।আর সন্ধ্যার আগেই কিনঞ্জলের বাড়ি থেকে আসা মানুষদের সাথে সাক্ষর আর কিনঞ্জল ও বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিয়ে দিয়েছে।আজকে রাতটা কিনঞ্জল আর সাক্ষর নিয়মানুযায়ী ও বাড়িতেই কাটাবে।

বাসায় পৌঁছেই কিনঞ্জল কাউকে কিছু না বলেই লুকিয়ে ওর মায়ের রুমে সরাসরি ঢুকে গেলো।এদিকে সাক্ষর ফ্রেশ না হয়েই ড্রয়িং বসে কিনঞ্জলের ভাই আর বাবার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে।যেহেতু সাক্ষরের এ বাড়িতে বিয়ের আগে থেকেই যাতায়াত ছিলো তাই সে বেশ ফ্রিলি সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে গল্প করছে। কিনঞ্জল ওয়াড্রবের ভেতরে কাপড়ের ভাজের থেকে নিজের ফোনটা বের করে সুইচ অন করতেই দেখলো স্ক্রিনে প্রায় তিনশ মিসড কল আর সত্তরটা মেসেজ শো করছে।নুহাশের সাথে কিনঞ্জলের প্রায় সব রকম যোগাযোগ একমাস যাবত বন্ধ ছিলো।তবে এই এত মিসড কল আর মেসেজ গত তিনদিনের দেওয়া।কিনঞ্জল ফোনটা নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।দরজা চাপিয়ে দিয়ে বিছানায় বসে নুহাশকে কল ব্যাক করার সাথেই কল রিসিভ করে ওপাশ থেকে নুহাশের উদ্বিগ্ন গলা ভেসে আসলো মোবাইলেই এই প্রান্তে,

"হ্যালো রেণু,কেমন আছিস তুই?আর এসব কি শুনছি আমি?গতকাল নাকি তোর বিয়ে হয়ে গেছে।তাও আবার তোর সাক্ষর ভাইয়ের সাথে।গত পরশু কথাটা জানার পর থেকেই তোকে কত্ত ফোন কত মেসেজ করেছি।তুই ঠিক আছিস তো রেণু?"

নুহাশের প্রথম কথাগুলোতে প্রবল উদ্বিগ্নতা থাকলেও শেষ কথাটায় একরাশ হতাশা আর আকুতি মেশানো ছিলো।নুহাশের কথাগুলো শুনে কিনঞ্জল হু হু করে কেঁদে দিলো।কানে ফোন চেপে ধরেই কান্না মাখা গলায় বলল,

"আমি ভালো নেই নুহাশ।তোমার রেণু ভালো নেই।বাসা থেকে আমাকে জোর করে সাক্ষর ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।এমনকি সাক্ষর ভাইকে ওরা তোমার ব্যাপারেও কিচ্ছু জানায়নি।সাক্ষর ভাইয়ের ব্যাবহার দেখেও তো তেমনটাই মনে হলো তিনি কিছুই জানে না।আর ফোনতো বাসা থেকে সেদিন ই নিয়ে নিয়েছিলো।তাই তো এতদিন তোমার সঙ্গে কোন কন্টাক করতে পারিনি।আমাকে তুমি এই জাহান্নাম থেকে নিয়ে যাও নুহাশ।আমি আর থাকতে পারছি না।"

"কান্না বন্ধ কর রেণু।তোর কান্না আমার সহ্য হয় না।তুই বললেই তো আমি আর তোকে নিয়ে আসতে পারবো না।তোর বিয়ে হয়ে গেছে।তুই এখন অন্য কারো ঘরের বউ।"

নুহাশের কথা শুনেই কিনঞ্জল কান্নার সাথে সাথে চাপা ক্রোধ নিয়েই বলল,
"কেনো?কেনো নিয়ে যেতে পারবে না?নাকি তুমি ভাবছো আমি এখন আর ভার্জিন নই।আর একটা নন-ভার্জিন মেয়েকে মেনে নিতে পারবে না বলেই বিয়ের দোহাই দিচ্ছো নাতো?

" পাগলামি করিস না রেণু।তোর শরীরটাই যদি আমার কাছে মূখ্য হতো তবে আমাদের এত বছরের রিলেশনে তোকে বিছানায় নেওয়াটা আমার কাছে খুব কঠিন কিছু ছিলো না।সেটা তুই নিজেও খুব ভালো করে জানিস।বুঝার চেষ্টা কর রেণু,তোর বিয়ে হয়ে গেছে।তোর সাথে সাথে এখন ওই দুই পরিবারের সম্মানটাও জড়িয়ে আছে।আজকে যদি তুই যদি নিজে সাক্ষরকে ছেড়ে আমার হাত ধরে চলে আসিস লোকে ছি ছি করবে।তোর বাবা-মা এলাকায় মুখ দেখাতে পারবে না।তাদের কথাটা তো অন্তত ভাব।"

"ওরা তো আমার কথা ভাবেনি,তাহলে আমি কেনো ওদেরটা ভাববো?ওরা তো জানত আমি তোমাকে ভালোবাসি।তারপরও তো জোর করে আমার বিয়ে দিয়ে দিলো।বিয়ে করবনা বলে আমি সুইসাইড করারও চেষ্টা করেছিলাম।কিন্তু ভাগ্য খারাপ ছিলো তাই এ যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম।তবে এবার কিন্তু ভাগ্য আমার সাথে আর খেলতে পারবে না।তুমি যদি আমাকে এই অন্ধকার থেকে না নিয়ে যাও কিন্তু নিজেকে শেষ করে দিবো নুহাশ।"
কিনঞ্জলের কথায় নুহাশ ধমকে উঠে বলল,
"এক থাপ্পড় দিয়ে তোর মরার শখ আমি ঘুচিয়ে দিবো রেণু।এখন তুই আমাকে কি করতে বলছিস?তোর সাথে পরকীয়া করতে বলছিস?তোর আর আমার সম্পর্কটা এখন আর ভালোবাসা অবধি আটকে নেই রেণু।এখন সমাজ তোর আর আমার সম্পর্কটাকে কুৎসিত নজরে দেখবে,পরকীয়া উপাধি জুড়ে দেবে।আর আমার তোর প্রতি ভালোবাসাটা এতটা সস্তা না যে আমি সমাজের নোংরা কালিমা মাখাতে দিবো।সত্যি কথা কি জানিস রেণু,তুই আমাকে কখনো ভালোই বাসিসনি।আমিই তোকে এতগুলো বছর নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে গেলাম।যদি তুই আমাকে ভালোবাসতি তবে কখনোই সুইসাইড করতে যেতি না তার আগে অন্তত একবার আমার কথাটা ভাবতি।আর না আমাকে সুইসাইডের ভয় দেখিয়ে তোকে নিয়ে আসতে বলতি।"
" নুহাশ!আমি তোমাকে ভালোবাসি না,এত বড় কথাটা তুমি আমায় বলতে পারলে?
"হ্যাঁ পারলাম।কেননা তুই সত্যিই আমাকে কখনো ভালোবাসিস নি রেণু।যে মেয়ে নিজের বাবা-মাকে ভালোবাসতে পারলো না সে আমাকে কিভাবে ভালোবাসবে?তুই বল,তোর বাবা তোকে আমার হাতে কিসের ভরসায় তুলে দিতো?আমি সদ্য গ্রাজুয়েশন করা একটা বেকার ছেলে।বাবার তেমন টাকা-পয়সাও নেই।টিউশনি করিয়ে নিজের খরচ চালাই সেখানে তোর দ্বায়িত্ব আমি কিভাবে নিতাম বল?তুই হয়ত বলবি ভালোবাসা থাকলে গাছ তলায়ও সংসার করা যায়।কিন্তু অভাব দরজায় কড়া নাড়লে ভালোবাসা জানলা দিয়ে দৌড়ে পালায়।তোর ভালোর জন্য এইসব ভেবেই তোর বাবা জোর করে তোকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়েছে।যে বাবা এতটা বছর তোকে আগলে রেখে নিজের সব শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে তোকে বড় করল আর আজকে সেই তুই নিজের বাবাকেই আমার জন্য ছেড়ে আসতে চাইছিস।কি অকৃতজ্ঞরে তুই রেণু!হ্যাঁ হয়ত কয়েকটা বছর অপেক্ষা করলে আমি ভালো একটা পজিশনে যেয়ে আংকেল এর থেকে তোর হাতটা চাইতে পারতাম।সেই সময়টাই শুধু আমাকে দেওয়া হয়নি।আংকেল শুধু এই একটা জায়গাতেই আমার সাথে বড্ড অন্যায় করে ফেলেছে।"

"তুমি আমার বাবার উপর রাগ করে এসব বলছো তাই না নুহাশ?আমি সত্যিই পারব শত অভাবের মাঝেও তোমার সাথে সংসার করতে।"
"না রেণু!আমি কারোর উপর রাগ করছি না।আমার রাগটা কেবল আমার ভাগ্যের উপর।তুই যদি আমার ভাগ্যে নাই থাকবি তবে কেনো তোকে আমার জীবনে এনেছিলো?আর খুব তো বলছিস সংসার করতে পারবি।পারবি টিনসেড এর দোচালা ঘরে থাকতে,এসির হাওয়া খেয়ে বড় হওয়া তুই ফ্যানের বাসাতে দিন কাটাতে,কল চেপে পানি উঠাতে,অভাবের সময় এক বেলা না খেয়ে থাকতে,বছরে কেবল দুই ঈদে দুটো জামা কিনে সন্তুষ্ট থাকতে যে তুই কিনা প্রত্যেক মাসে শপিং করিস,সপ্তাহের চার থেকে পাঁচদিন পারবি শুধু ডালভাত খেতে?পারবি না রেণু।অভাব বড্ড ভয়ানক জিনিস।প্রয়োজনে অভাব মানুষের স্বভাবটাকেও নষ্ট করে দেয়।এই আমরা দুজন এখন একে অপরকে কত ভালোবাসি।কিন্তু তুই যদি আমার ঘরের বউ হয়ে আসিস মাস শেষে হাতে টাকা না থাকায় বাজার করতে না পেরে খালি হাতে যখন বাড়ি ফিরব তখন সেই তুই আমাকে হাজারটা কথা শোনাবি আর আমিও হয়ত রেগে গিয়ে তোকে দু-চারটে চড় বসিয়ে দিবো।এই এত কিছু সহ্য করে তুই কখনোই আমার সংসার করতে পারতি না রেণু।ভুলটা আমারই ছিলো! বামণ হয়ে চাঁদে হাত দিতে চেয়েছিলাম।তোর মতো কিশোরী মনের একটা মেয়ের ডাকে সাড়া দেওয়াটাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো।বড্ড ভুল করে ফেলেছিলামরে রেণু তোর ডাকে সাড়া দিয়ে।"

"এরকম বলছো কেনো নুহাশ?"
"এরকম বলছি কারন আমি তোকে ভালোবাসি রেণু।আমি সবসময় তোকে সুখী দেখতে চাই।হোক সেটা আমার সাথে বা অন্য কারো।তুই নিজেই বল,যখন তুই আমাকে প্রপোজ করেছিলি তোর বয়স কত ছিলো?খুব বড়জোড় ১৫-১৬ বছর।একজন টিন এইজারের ওইসময় খুব বড়জোড় ভালোলাগাটা তৈরি হতে পারে ভালোবাসা নয়।তোর কাছে তখন ভালোবাসার ডেফিনেশন ছিলো সুন্দরমতো দেখতে একটা ছেলে,একসাথে ঘুরাঘুরি করা,বাদাম খাওয়া,পাশাপাশি বসে মুভি দেখা ব্যাস এতটুকুই।কিন্তু ভালোবাসার পরিধি কি আদোও এইটুকুই।আমি তোর কিশোরী মনের ভালোলাগা ছিলাম রেণু,ভালোবাসা নয়।ভালোতো আমি তোকে বাসতাম।সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া আমি তোকে নিজের সবটা দিয়েই ভালোবেসেছিলাম আর এখনো বাসি।তাইতো তোর কিশোরী মনের আবেগটাকে নিজের অজান্তেই প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছিলাম।আর তুই এখনো নিজের টিনএজ এর আবেগকে ভালোবাসা ভেবে বসে আছিস।নিজের সংসার,মা-বাবা,ভাইকে ছেড়ে আমার সঙ্গে চলে আসতে চাইছিস।এটা কি তুই ঠিক করছিস রেণু?"

"এখন তুমি কি বলতে চাইছো নুহাশ?"
এবার বেশ কড়া গলাতেই কথাটা জিজ্ঞেস করল কিনঞ্জল।নুহাশ বেশ ঠান্ডা স্বরেই উত্তর দিলো,
"এই বিয়েটাকে তুই একটা সু্যোগ দে রেণু।বিয়ের মত পবিত্র একটা সম্পর্ককে এভাবে হেলাফেলা করিস না।সাক্ষর এখন তোর স্বামী।তোর প্রতি ওর পূর্ণ অধিকার আছে।ও যদি তোর সামনে নিজের অধিকার নিয়ে আসে ওকে কখনো ফিরিয়ে দিবি না তুই।আমি বিশ্বাস করি,একিদিন নিশ্চই তুই আজকের দিনের বোকামির কথা ভেবে হাসবি।ভাববি কি বোকাটাই না তুই ছিলি।রিয়ালিটিটাকে মেনে নে রেণু।আমি শুধুই তোর কিশোরী মনের ভালোলাগা ছিলাম,ভালোবাসা নামক পাখিটার হদিস তুই এখনো পাস নি।হয়ত একদিন সাক্ষরই তোর জীবনে সেই কাংখিত প্রেমিক পুরুষ হয়ে ধরা দিবে।"

"কিসের বিয়ে,স্বামীর অধিকার আর কিসের প্রেমিক পুরুষ?আমি এই বিয়ে মানি না।সাক্ষর ভাইয়ের সাথে আমি কখনোই সুখী হতে পারব না নুহাশ।"
"তুই না মানলেও সামাজিক আর ধর্মীয় রীতিমতো তোদের বিয়ে হয়ে গেছে রেণু।ভালো থাকিস।আর লক্ষীবউ এর মতন মন দিয়ে সংসার করিস।"
কথাটা বলেই নুহাশ কলটা কেটে দিলো।ফোনের দু'পাশেই দুজন কান্নায় ভেঙে পড়ল।কিনঞ্জল ফোনটা ফ্লোরে এক আছাড়ে ভেঙে ফেলল।মুখে হাত দিয়ে নিজের কান্নাটাকে আটকাতে চাইলেও বারবার ব্যার্থ হচ্ছিলো কিনঞ্জল।গায়ের বেনারসি শাড়িটা দেখতেই গত দুটোদিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে কিনঞ্জলের।রাগে ক্ষোভে শাড়িটা একটানে খোলে ফেলে দিয়ে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল কিনঞ্জল।আর ওপাশে নুহাশ ফোনটা বুকে চেপে ধরেই বলল,
"মন দিয়ে সংসার করিসরে রেণু।তোকে সুখী দেখার বড্ড লোভ আমার।তবে যদি কোনদিন দেখি তুই সাক্ষরের সাথে ভালো নেই সেদিন ঠিকই আমার প্রাণপাখিটাকে নিজের খাঁচায় বন্দি করে নেবো।তবে আমি জানি রেণু,তুই নিজের বয়ঃসন্ধির আবেগের জন্য নিজের পুরো জীবনটা নষ্ট করবি না।কষ্ট হলেও তুই সাক্ষরকে একটা সময় ঠিকই মেনে নিবি।আর আমি হয়ত আবেগ বা ভুল নামেই তোর জীবনের এক কোনে স্মৃতি হিসেবে পরে থাকবো।"
কথাগুলো আপনমনেই বলে চোখ বুজলো নুহাশ।চোখজোড়া বন্ধ করতেই দু'ফোটা নোনাজল নুহাশের গাল বেয়ে নিজেকে ধূলোয় মিশিয়ে দিলো।




(চলবে)




লিখা~ নাজমুন নাহার তৃপ্তি






 

Delivered by FeedBurner

a