> উজান মাস্টার
-->

উজান মাস্টার


" রসগোল্লা ? সবাই তোমাকে রসগোল্লা বলে?"
"জ্বি স্যার।"
"গাব গাছের কষ দিয়া ইস্কুলের দেয়ালে তোমার নাম লিখে রাখে?"
"জ্বি স্যার।"
"শুধুমাত্র এইজন্যে পড়ালেখা বাদ দিয়া ঘরের কোনায় বসে আছ তুমি?"
"আমার খুব লজ্জা লাগে!"
"লজ্জা তো তোমার পাওয়া উচিত নয় পারুল। তুমি কি অপরাধী?"
"সবাই আমাকে নিয়া হাসাহাসি করে স্যার। কমনরুমের মেয়েগুলাও এখন আমারে টিজ করে। একে অন্যের গায়ে চিমটি কেটে রঙমাখা কণ্ঠে বলে, ঐ দেখ, রসগোল্লা আসছে।"
শেষের দিকের কথাগুলি বলার সময় পারুলের গলাটা ধরে আসে। উজান স্যারের মাথার ভেতর ধরাস করে একটা নক্ষত্র পতনের আওয়াজ হয়।
কমনরুম... মেয়েরা..হাহ, ইতিহাসের পরম্পরা এই কথা-ই লিখা রয়েছে, এই জগতে একটা মেয়ে মানুষের সবচাইতে বড় শত্রু হল অন্য একটা মেয়ে মানুষ।
মুর্খ, মহামুর্খ!
পারুলের মতো এইরকম তেজ দীপ্ত একটা মেয়ের পেছনে কয়েকটা ফেউ লেগেছে। ইস্কুলের দেয়ালে বিভিন্নসব নোংরা কথা লিখে রাখছে। ওর এই দুঃসময়ে সবার আগে যারা সান্ত্বনার হাত বাড়িয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে আসতে পারত, আসা উচিত ছিল, ওরাই হল এখন মেয়েটার সবচাইতে বড় প্রতিবন্ধকতা।
"পারুল!"
"জ্বি স্যার।"
"আগামীকাল সকাল ন'টার মধ্যে ইস্কুলে আসবা। পিটি-প্যারেডের গ্রাউন্ডে সবার সঙ্গে দাঁড়াব। এইটা আমার আদেশ!"
পারুল মাথা নুইয়ে সায় দেয়। পরদিন সকালে সে সত্যি-সত্যিই স্কুলে যায়।
দীর্ঘ এক সপ্তাহের বিরতির পর আবার স্কুলে এসেছে। উজান মাস্টারের কথামতো সে পিটি-প্যারেডের লাইনে দাঁড়ায়।
*
সেইদিন, কদমতলীর ইস্কুলে একটা বিচিত্র ঘটনার জন্ম হল। প্যারেড গ্রাউন্ডের স্বাভাবিক নিয়ম ভেঙে, শারিরীক-শিক্ষা বিভাগের টিচার আনন্দ দেবকে সাইডে সরিয়ে ইস্কুলের হেড-মাস্টার হামিদুল্লাহ সাহেব নিজে এসে সকলের সামনে বুক চেটিয়ে দাঁড়ালেন।
কদমতলী মাঠে, তার সমুখে দাঁড়ানো শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীর দিকে তাকিয়ে রণস্বরে হুংকার দিলেন,"প্যা-রে-এ-এ-ড, আরামে দাঁড়াও!"
সমবেত ছাত্রছাত্রীদের সকলেই দুইপা ফাঁক করে আরামে দাঁড়ায়। তিনি আবারও হুংকার দেন," প্যা-রে-এ-এ-ড, সোজা হও!"
সকলেই দুইপায়ের শূন্যস্থান সংকোচিত করে বুক চেটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
হামিদুল্লাহ সাহেব, যাকে সকলেই উজান মাস্টার নামে চিনে, এবং যিনি শুধুমাত্র এই শিক্ষকতার মহান পেশাকে ভালোবেসে সুদীর্ঘ কাল ধরে নিজের পরিবার পরিজন বয়কট করে এই ভাঁটির তল্লাটে পড়ে আছেন, তিনি জীবনের সবচাইতে সুন্দর একটা বাণী দিলেন সেদিন!
তিনি বললেন,"প্রিয়তম ছেলেরা আমার, বিগত কয়েকমাস ধরেই তোমাদের নামে একটা কদর্য অভিযোগ উঠছে...
তোমাদের মধ্যেই কিছু কিছু ছেলে ইস্কুলের পেছনে বাগানবাড়িতে বসে তাস খেলছ! নেশাদ্রব্য পান করছ। ইস্কুল ড্রেস গায়ে চাপিয়ে কাঠ বাজারের পেছনে অশ্লীল সিনেমা দেখছ...
এই কাজগুলা কেন করছ তোমরা? কারা কারা করছ, সাহস থাকলে হাত উঁচিয়ে দেখাও আমাকে!"
কথা শেষ করে তিনি তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের লাইনগুলিতে চোখ বুলাতে লাগলেন। বলাবাহুল্য, অপকর্মের স্বীকারুক্তি দিয়ে হাত কেউই তুলে নি৷ কিন্তু বিচ্ছিরি একটা গুঞ্জন ও কেওয়াজের জন্ম হল। প্রতিটা ছেলেই তার আশপাশের অন্য ছেলেদের দিকে তাকাচ্ছে। একে অন্যের গায়ে আঙুলের খোঁচা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলছে,"হাত তুলছ না কেন? হাত উঠা বাঞ্চোত!" চাপা গুঞ্জনের সঙ্গে খিকখিকিয়ে কয়েকজন হাসছেও বটে!
হামিদুল্লাহ সাহেব বিমর্ষ বোধ করেন। তিনি ভেবেছিলেন, ভিড়ের মধ্যে দুই-চারটা কালপ্রিট রয়েছে, এইগুলাকে একটু শাসিয়ে দিবেন। কিন্তু ক্লাস- এইট - নাইন- টেন.. এই তিনটা সারির দিকে তাকিয়ে তিনি সত্যি সত্যিই অসহায় বোধ করে। অল্পকটা ছেলে দেখা যাচ্ছে, তার কথার গুরুত্ব উপলব্ধি করে দয়াদ্র চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। বাদবাকি সবকটাই নৈরাজ্য করে বেড়াচ্ছে।
তিনি আগের চাইতেও জোরাল কণ্ঠে হুংকার দিলেন,"স্ট্যান্ড টু এটেনশন প্লিজ!"
হুংকারে কাজ হল। সকলেই উনার দিকে ফিরে তাকায়। তিনি খুব শান্ত কণ্ঠে বলেন,
"সুদীর্ঘ একুশ বছরের শিক্ষকতার জীবনে তোমাদের মতো হাজারে হাজার ছাত্রছাত্রী এসেছে। তোমাদের কি মনে হয়, সবাইকে মানুষ করার ক্ষমতা আমাদের আছে?"
সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই চুপচাপ। 'হা' বলে না, নাও করে না।
পেছন থেকে হিক-হিক, খিকখিক হাসির আওয়াজ ভেসে আসে। অতি সাহসী কয়েকজন চাপা কণ্ঠে বলে, নাহ জনাব, পারেন নাই!
হামিদুল্লাহ সাহেব ম্লান কণ্ঠে বলেন,"সেই চেষ্টাও আমরা করি না। আমরা হলাম পাথুরে সিঁড়ির মতো। বুক পেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যদি কেউ সত্যিই বড় হতে চাও। যদি চূড়ায় উঠতে চাও, আমরা শুধু একটা পথ হিসাবে এইটুকু অবদান রাখতে পারি.."
ভিড়ের ভেতর থেকে কে যেন একজন স্পষ্ট স্বরেই জানতে চায়,"সিঁড়ি কি কাঠের? নাকি ইটের?"
ওর কথা শুনে অনেকেই হে-হে করে হেসে উঠে।
হামিদুল্লাহ সাহেব পাত্তা দেন না। তিনি পূর্বের কথার রেশ ধরেই বলেন,
"এই যে আজ তোমাদের সবাইকে একত্রে সমবেত করে আমি বাণী দিচ্ছি, খুব ভালো করেই জানি- তোমাদের মধ্যে অধিকাংশ ছেলেমেয়ে এইগুলাকে পাত্তায়ই দিচ্ছ না।
দিবে না।
কিন্তু আমি খুব ভালো করেই জানি, এইখানে শত শত তোমাদের অন্তত এক ডজন ছেলেমেয়ে আছে, যারা হৃদয়ের সবকটা দরজা খুলে দিয়ে অত্যন্ত সমীহের সঙ্গে আমার কথাগুলি শুনছ। এর ভেতরকার ইঙ্গিতগুলা ধারণ করার চেষ্টা করছ!"
এইবার সকলেই মাথা ঝাঁকায়। যেন খুব বুঝতে পারছে! হামিদুল্লাহ সাহেব বললেন,
"বিগত একুশ বছর ধরে ঠিক এভাবেই, বছরে কোন না কোন একটা দিন আমাকে সকলের সামনে দাঁড়াতে হয়। কথা বলতে হয়। কেন বলি জানো?"
"কেন স্যার?"
"দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রতিটা ভিড়ের ভেতর আশ্চর্য ক্ষমতা সম্পন্ন কিছু ছেলেমেয়ে থাকে।
সবাই যখন আমার কথা শুনে হাসিঠাট্টা করে, এরা তখন মন ও মগজের সবকটা দরজা জানালা খুলে দিয়ে আমার কথা শুনে। বুক ভরে দম নেয় এবং এই দমের জোরেই একদিন আকাশে নক্ষত্র হয়ে আলো দেবার প্রয়াস চালায়!"
দূর থেকে কে জানি একজন বলে "আলু!", "আলু-আলু!" ... কারা যেন হাসে, হি-হি, খিক-খিক!
হামিদুল্লাহ সাহেব ক্লান্ত বোধ করেন।
মন্দ মানুষ আগেও ছিল। কিন্তু এতটা মন্দ ছিল না। সিন্নীর লোভে মিলাদে গেলেও দোয়ার সময় সত্যি সত্যিই সবাই হাত উঁচিয়ে দোয়ায় সামিল হত। নরম গলায় আমীন বলত।
ইদানীং দেখা যায়, প্রতিটা মিলাদের অনুষ্ঠানে একদল নব্য-বণিক এবং নব্য-রাজনৈতিক পান্ডা আসে। এরা মিলাদের মজমা থেকে একটু দূরে গোল করে চেয়ার ফেলে আয়েশ করে গল্প জুড়ে। দোয়ার সময় বিড়ি ফুকায়। দোয়ার শেষে সিন্নীর তালাটা ওদের কাছেই স্পেশাল ভাবে যায়। ইস্কুলের চারদেয়ালের ভেতরেও এখন ওদের শুক্রাণুজাত শাবকেরা ঢুকে যাচ্ছে। পুরনো আদব এবং পুরনো মূল্যবোধের সঙ্গে তিনিও এখন পুরাতন হয়ে যাচ্ছেন।
উজান মাস্টার অবশ্যি কখনো হতাশ হন নি। এখনো নয়। এই যে এত এত মুখ, তিনিই ঠিক জানেন, এরমধ্যে দুই-চারটা দেবশিশু অবশ্যই আছে, যারা সমস্ত চৈতন্য মগ্ন করে তাঁর কথাগুলি আত্মস্থ করবে। সেইমতন জীবন গঠনের চেষ্টা করবে...
আঙুলে গুণে গুণে তিনি বেশ কটা উপদেশ দিলেন।
ইস্কুলেরা ছাত্ররা বাগানবাড়িতে যাবা না। নেশাদ্রব্য, হোক সে সিগারেট, ভুলেও হাত লাগাবা না।
কাঠ-বাজারের গলি-ঘুপচিতে বসে নোংরা সিনেমা দেখবা না। স্কুলের ভেতর এতবড় লাইব্রেরি আছে, থরে থরে বই আছে, বই পড়। নিজেকে জানো। বিপুলা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময় সমূহ জানার চেষ্টা কর।
মেয়েদের সম্মান করতে শিখবা।
গাব-গাছের কষ দিয়ে ইস্কুলের দেয়ালে কেন তোমরা মেয়েদের নাম লিখবা? কেন নোংরা কথা লিখবা?
বরং বাইরে থেকে এসে কেউ যদি লিখে যায়, তোমরা ভলান্টিয়ার হয়ে সেইগুলা মুছে দিবা। এইটুকু শিক্ষা যদি তোমাদের না দিতে পারি, তাইলে...
শেষের দিকে তার গলাটা ভারি হয়ে আসে। চোখ দুইটা খুব ভিজে ভিজে দেখায়...
*
সেইসব বহুত আগের কথা। উজান স্যার এখন পরপারে। দয়াময় স্রষ্টা তাঁর মঙ্গল করুন।
তিনি খুব বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন।
তিনি ঠিক জানতেন, ভিড়ের ভেতরেও কিছু দেবশিশু আছে। এই ছেলেমেয়েগুলাকে ঠিকঠাক পথের দিশা দেবার জন্যই তার জন্ম হয়েছে!
আদতে হয়েছেও তাই৷ সেইদিনের পর থেকেই দেখা গেল, পারুল নামের মেয়েটি হাসিমুখে স্কুলে আসছে।
কমনরুম থেকে দলবেঁধে কয়েকটা মেয়ে বের হচ্ছে, স্কুলের দেয়ালে কোথাও কোন মেয়ের নাম লিখা থাকলে ওরা হল্লা করে সেইসব নাম উঠিয়ে দিচ্ছে।
রক্তরঙা ইটের সুরকি দিয়ে "রসগোল্লা" টাইপ শব্দগুলি মুছে দিয়ে অবিকল শুকিয়ে যাওয়া রক্তের মতো আঁকিবুঁকি মেখে দিচ্ছে।
কিছু ছেলেমেয়ে লাইব্রেরিতে আসছে। আলী ইমামের "সাগরজলের নানা প্রাণী" পড়ছে। আবদুল মমিন চৌধুরীর "ডাইনেস্টিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল" নেড়েছেড়ে দেখছে!
খুব বড় সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছিলাম বলেই হয় এইসব মানুষের শুদ্ধতম প্রণোদনা বুকে ধারণ করার সুযোগ হয়েছিল। এতগুলি বছর পর, এমনকি এখনো, যখন একেকটা গল্প লেখি, অবিকল স্যারের মতো করেই ভাবি...
এই যে দিনরাত হল্লা করে গল্প লিখছি, থরে থরে বই লিখছি, শত সহস্র অভ্যস্ত পাঠকের ভিড়ে একটা বা দুইটা মুখ ঠিকই এর অন্তর্নিহিত অর্থটা ধারণ করতে পারবে।
এইসব উজাগর দিনরাতের ফসল আমার কিছুতেই বৃথা যাবে না।
উজান স্যারের গল্পটা যেখানে এসে থেমে যায়, ঠিক সেখান থেকেই আমাদের গল্পটা শুরু হয়। নিজেকে নিরন্তর প্রহার করে, রীতিমতো চাবুক পিটিয়ে পুরনো পিতাদের প্রজ্ঞাময় বাণীগুলি আগামী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
একদিন হয়ত আমরাও থেমে যাব। নতুন দিনের কান্ডারিগণ আসবে। ঠিক যেখান থেকে আমরা শেষ করব, সেখানে থেকেই ওদের যাত্রা শুরু হবে!
নিরাকার নিরঞ্জনের প্রজ্ঞা থেকে জাত যে প্রাণ, অনাবিল প্রজ্ঞা এবং প্রার্থনাতেই রয়েছে তার চূড়ান্ত মুক্তি ও আনন্দ।
সেইজন্যই বারেবারে বলতে হয়, বলে কখনো ক্লান্ত হই না,
"আপনাকে ভালোবাসি প্রিয় উজান স্যার। মৌরসী অন্ধকারের আগ্রাসন থেকে আপনি আমাদের মুক্তি দিয়েছিলেন। দয়াময় স্রষ্টা আপনাকে এর উত্তম প্রতিদান দান করুন।
মৃত্যুময় মানুষজন্ম আপনাকে নিরন্তর যন্ত্রণা দিয়েছে।
হিরণ্ময় অমরত্বের দেশে আপনি অবিরাম জ্যোৎস্না ধারায় প্লাবিত হোন...
নিরন্তর ভালোবাসা...
ভালোবাসা, ভালোবাসা..."

Writer:- মুহম্মদ নিজাম An indebted author of the novel of ঝড় জনৈক চিন্তাবিদ
NEXT ARTICLE Quote #10
PREVIOUS ARTICLE ঝরাপাতা
NEXT ARTICLE Quote #10
PREVIOUS ARTICLE ঝরাপাতা
 

Delivered by FeedBurner

a