Leave a message
> কনে দেখা আলোয় পর্ব ১৯
-->

কনে দেখা আলোয় পর্ব ১৯


ঘড়ির কাটা তিনের ঘর ছুঁইছুঁই।আর এদিকে সাক্ষর কিনঞ্জলের কোলে উপুড় হয়ে মুখ গুজে শুয়ে আছে।বেচারির পায়ের সাথে সাথে কোমরটাও একদম অবশ হওয়ার পথে।সেই রাত দশটা থেকে একইভাবে সাক্ষরের মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে।মাঝখান কেবল একবার সাক্ষর বমি করার জন্য কোল থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়েছিলো।তখন কিনঞ্জল নিজেই সাক্ষরের পেছন পেছন গিয়ে সাক্ষরের হাতটা নিজের কাধে রেখে বেসিনের সামনে দাড়িয়ে থাকতে হেল্প করেছে,বুকে হাত বুলিয়ে দিয়েছে।বমি শেষে সাক্ষরকে নিজের হাতে পানি নিয়ে কুলি করিয়ে দিয়েছে।তারপর সাক্ষরকে রুমে বিছানায় নিয়ে গিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে শুয়িয়ে রেখে এসে নিজেই বেসিন পরিষ্কার করে বালতিতে করে পানি রুমে নিয়ে গিয়ে সাক্ষরের হাত-পা,ঘাড়,গলা মুছে দিয়েছে।কাজ সেরে বিছানায় বসতেই সাক্ষর আবার এসে কিনঞ্জলের কোলে মুখ গুজে শুয়েছে আর কিনঞ্জলের হাতটা নিজের মাথায় রেখে ইশারায় চুলে হাত বুলাতে বলেই চোখ দুটো বন্ধ করেছে।চুলে হাত বুলাতে বুলাতেই সাক্ষর যা একটু ঘুমিয়েছে।এখন কিনঞ্জল আর না পারছে বসে থাকতে আর না সাক্ষরের মাথাটা বালিশে রাখতে।বেচারা জ্বরের কারণে একটুও ঘুমাতে পারেনি।তাই এইমূহুর্তে সাক্ষরের ঘুম ভাঙ্গাতে একদম ইচ্ছে করছে না কিনঞ্জলের।সকাল থেকে কেবল ঠান্ডা-কাশি থাকলেও বিকেলের দিকে হালকা জ্বর হয়েছিলো সাক্ষরের।তাই সন্ধ্যার দিকে একবার ডাক্তার এসে সাক্ষরকে দেখে গিয়েছে।তবে রাতে যে ব্যাপারটা এমন বিগড়ে যাবে কিনঞ্জল ভাবতেও পারেনি।এসব ভাবতে ভাবতেই সামান্য ধাক্কা অনুভব করে সাক্ষরের দিকে তাকিয়ে দেখে ঘুমে জড়ানো লাল চোখ দুটো নিয়ে সাক্ষর ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
সাক্ষর কিছুটা সময় কিনঞ্জলের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থেকেই কিনঞ্জলের কোল থেকে মাথাটা সরিয়ে বালিশে রাখলো।আর মৃদুস্বরে কিনঞ্জলকে ধমক দিয়েই বলল,
"রাত-বিরেতে আমার মাথা কোলে জাপটে ধরে
বসে আছিস কেনো?ঘুম নেই চোখে?জলদি শুয়ে পর।এভাবে একটানা বসে থাকলে পরে কোমরের ব্যাথায় নড়তে পারবি না।"
সাক্ষর কোল থেকে মাথাটা সরাতেই পা-টা যেনো আরও অবশ হয়ে এলো কিনঞ্জলের।তবে মুখে কিছু না বলেই বালিশটা ঠিকঠাক করে রেখে শরীরটা এলিয়ে দিতে দিতেই বলল,
"আপনার কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিলো না।এমনিতেই জ্বর,মাথাব্যাথায় সারারাত দুচোখ এক করতে পারেননি।তারপর আবার বমিও করেছেন।তাই ভাবলাম ঘুমাচ্ছেন যেহেতু একটু ঘুমিয়ে নিন।মাথাটা বালিশে রাখতে গেলে যদি ঘুম ভেঙে যায়?"
এই বলে বিছানায় শরীরটা রাখতেই কোমরের ব্যাথায় খানিকটা নিঃশব্দেই কুঁকিয়ে উঠল কিনঞ্জল।আওয়াজ না করলেও কিনঞ্জলের চোখ-মুখ কুঁচকানো দেখেই ব্যাপারটা সাক্ষর বুঝতে পেরে গেলো।তবে কিনঞ্জলকে কিছু না বলেই বেডসাইড ড্র‍য়ার হাতড়ে মুভ ক্রিমটা বের করে এনেই উঠে বসল।আর কোন ভনিতা ছাড়াই কিনঞ্জলকে আদেশের সুরে বলল,
"কোমর থেকে কাপড়টা সরা কিনঞ্জল।"
কিনঞ্জল সাক্ষরের এমন কথায় প্রথমে একটু অবাক হলেও পরমুহূর্তে কোন ভনিতা ছাড়াই বুকে ভর দিয়ে শুয়ে সাক্ষরের কথামতো পরনের কামিজটা খানিকটা উপড়ে উঠালো।খানিকটা অস্বস্তি হলেও কিনঞ্জল নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে লাগল।এদিকে কিনঞ্জল কামিজ সরাতেই সাক্ষর চার আঙুলে ক্রিম নিয়ে কিনঞ্জলের কোমরে মালিশ করে দিতে লাগল।আর বিড়বিড়িয়ে বলতে শুরু করল,
"তুই কি কোন কাজ ঠিক মতোন করতে পারিস না কিনঞ্জল?অর্ধেক রাত আমার একটু যত্নয়াত্তী কি করেছিস এখন মাঝরাতে উঠে আমি রোগী মানুষ তোর খেদমত করছি।এই এতটা সময় কোন দুঃখে বসেছিলিস।আমার সাথেসাথে তো নিজেও একটু ঘুমিয়ে নিতে পারতিস।একটু পর আমার আবার বমি পেলে তখন আমাকে কে ধরে বমি করাবে শুনি?কুলি কে করিয়ে দিবে?হাত মুখ ধুয়িয়ে দিবে কে?আর তোকে কি আমি সাধ করে ভ্যাবলি ডাকি?কাপড় সরাতে বললাম আর তুইও নাচতে নাচতে কাপড়টা সরিয়ে ফেললি।কেনো সরাতে বললাম সামান্য এই প্রশ্নটাও করলি না?এত ভ্যাবলি কেনো তুই কিনঞ্জল?যে কেউ এসে তোকে কাপড় তুলতে বললেই তুই তার কথা শুনে কাপড় সরিয়ে ফেলবি?"
"আপনি তো যে কেউ নন সাক্ষর ভাই।আপনার কি মনে হয় যে কেউ এসে আমাকে কাপড় সরাতে বললেই আমিও নাচতে নাচতে নিজের শরীরের কাপড় সরিয়ে ফেলবো?যতটা ভ্যাবলি আপনি আমাকে মনে করেন ততটা ভ্যাবলি কিন্তু আমি নই সাক্ষর ভাই।আপনার এক কথাতেই কাপড় সরিয়েছি,এমনকি কোন প্রশ্ন করিনি কারণ আপনি নিজেই সেই বিশ্বাসটা অর্জন করেছেন।আমি আপনাকে বিশ্বাস করি সাক্ষর ভাই।আমার অনিচ্ছায় যে আপনি আমাকে কখনোই জোড় করবেন না সে বিশ্বাস আমার আছে।দিনের পর দিন এক বিছানায় ঘুমিয়েও আমার অসম্মান হয় বা আমি আনইজি ফিল করব এমন কোন কাজ করেন নি আপনি।তাহলে আপনার এক কথায় কাপড় সরালেই আমি ভ্যাবলি হয়ে গেলাম?আমারতো এখন আপনাকে ভ্যাবলাকান্ত মনে হচ্ছে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন করার জন্য।"
কিনঞ্জলের এমন উত্তরে সাক্ষর পুরো থ হয়ে গেছে।কি বলছে টা কি ভ্যাবলিটা?এতটা গুছিয়ে কথা বলা কবে শিখলো ও?আর কি বললো সাক্ষর যে কেউ নয়?
তাহলে সাক্ষর ওর কে?জিজ্ঞেস করবে করবে করেও কিনঞ্জল যদি অপ্রস্তুত হয়ে পরে এই ভেবে আর কথাটা জিজ্ঞেস করল না সাক্ষর।তবে কন্ঠে কাঠিন্যতা বজায় রেখেই বলল,
"সেসব না হয় বুঝলাম।কিন্তু তুই এতটা সময় ধরে বসেছিলি কেনো?আমাকে শুয়িয়ে দিয়ে নিজেও তো একটু বিশ্রাম নিতে পারতি।সকাল থেকে লাট্টুর মতো ঘুরছিস আর কাজ করছিস।কালকে তুই অসুস্থ হয়ে পরলে তখন তোকে কে দেখবে?"
এইসব বলতে বলতেই ক্রিমটা ভালোমতোন কিনঞ্জলের কোমরে মালিশ করে দিয়ে কাপড়টা ঠিকঠাক করে কম্বলটা কিনঞ্জলের গায়ে জড়িয়ে দিলো।আর ক্রিমটা ড্রয়ারে রেখে নিজেও কম্বলের ভেতর ঢুকে পড়ল।"
কিনঞ্জল সাক্ষরের কোন প্রশ্নেরই উত্তর না দিয়ে চোখ বুজে পরে রইল।আর সাক্ষর সিলিং এর দিকে ধ্যান ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিনঞ্জলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
"তুই দিনকে দিন বেশ ম্যাচিউর হয়ে উঠছিস কিনঞ্জল।আজকাল তোকে দেখে মাঝেমধ্যে আমি নিজেই ভিমড়ি খেয়ে যাই।যদিও বাচ্চামোটা এখনো পুরোপুরি যায়নি।এখনো তুই আবেগে ভেসে বেড়াস।যাই হোক,ম্যাচিউর হওয়ার চেষ্টা করছিস কর,তবে নিজের সত্ত্বাটাকে আবার হারিয়ে ফেলিস না যেনো?"
কিনঞ্জল চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
"হুম।"
এই বলেই নিজের গায়ে কম্বলটা ভালোমতোন জড়িয়ে নিয়ে উল্টোপাশে ঘুরে শুয়ে পরল কিনঞ্জল।এই দেখে সাক্ষর রেগে গিয়ে ধমকে বলে উঠল,
"ওদিকে ঘুরে ঘুমাচ্ছিস কেনো?বিছানায় কি তুই একাই শুয়ে আছিস নাকি?আমাকে চোখে পরে না?আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে ঘুমা।বিয়ে করেছি কি এই শীতের রাতে ঠান্ডা বিছানায় একা ঘুমানোর জন্য।নেহাৎ আমি তোর বুকে মাথা রাখলে তুই চ্যাপ্টা হয়ে যাবি তাই এ যাত্রায় বেঁচে গেলি।"
কিনঞ্জল সাক্ষরের কথায় তেমন কিছু না বলে সাক্ষরের গা ঘেষে শুয়ে ঠাস করে মাথাটা সাক্ষরের বুকে রাখল।সাক্ষর ব্যাথায় 'ও মাগো' বলে কুঁকিয়ে উঠে কিনঞ্জলের মাথায় ঠাসস করে একটা গাট্টা মেরে বলল,
"মারার প্লানিং করেছিস নাকি?"
প্রতিত্তোরে কিনঞ্জল কিছুই না বলে কেবল মিটমিটিয়ে হেসে উঠলো।


(চলবে)...


লিখা:~ নাজমুন নাহার তৃপ্তি

 

Delivered by FeedBurner

a