Leave a message
> কনে দেখা আলোয় পর্ব ২০
-->

কনে দেখা আলোয় পর্ব ২০


বরাবরের মতো আজকে সকালেও কিনঞ্জলের আগেই সাক্ষরের ঘুমটা ভেঙে গেলো।সাক্ষরের বুকে মুখ গুজে সাক্ষরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে কিনঞ্জল।কিনঞ্জল রাতে চুল বেধে ঘুমাতে পারেনা।নয়ত প্রতিটা চুলের গোড়ায় টানটান ব্যাথার কারণে সারা সকাল নাজেহাল অবস্থা হয়ে যায় কিনঞ্জলের।তাই বাকি দিনগুলোর মতো গতকাল রাতেও খোলা চুলেই ঘুমিয়েছিলো কিনঞ্জল।যার কারণে এখন মুখের উপরে বেবি চুলগুলো পড়ে রয়েছে।মুখটা একদম তেলতেলে আর ঠোটদুটোও একদম শুষ্ক হয়ে আছে।সেইসাথে নাকের ডান পাশেই একটা নতুন পিম্পল হয়েছে।একদম লালটুকে হয়ে আছে পিম্পলটা।যদিও শীতকালে সচরাচর সবাই ড্রাই স্কিনের প্রবলেমে ভুগে কিন্তু কিনঞ্জলের এমনই অয়েলি স্কিন যে শীতকালেও ওর কোন মশ্চারাইজার এর প্রয়োজন পড়ে না।অলয়েজ স্কিন তেলতেলে হয়ে থাকে।এরমধ্যে আবার গতকাল কিনঞ্জল বেশ রাত জেগেছে আর প্রচুর টেনশনও করেছে তাই হয়ত নতুন এই পিম্পল মহাশয়ার আগমন।এই ভেবেই মুচকি হেসে সাবধানে কপালের চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে কিনঞ্জলের কপালে নিজের উষ্ণ ঠোঁটদুটো ছুয়িয়ে বিড়বিড়িয়ে নিজের জীবনসঙ্গীকে সুপ্রভাত জানালো সাক্ষর।ভালোবাসা,জীবনসঙ্গী এই শব্দদুটির মর্মার্থ জানার পর থেকেই এমন একটি সকালকে হাজারবার নিজের কল্পনার ক্যানভাসে আঁকিবুঁকি করেছে সাক্ষর।আর ফাইনালি আজকে সেই স্বপ্নীল সকালটা ওর কাছে ধরা দিলো।ঘুমের শরীরে আজ সকালে যখন প্রথমবারের মতো কিনঞ্জলের অস্তিত্ব নিজের বুকের উপর আবিষ্কার করল,সাক্ষর তখন চোখ বুজে শুধু একটা কথাই ভেবেছে,"জীবন আসলেই অনেক সুন্দর।"তবে জীবনটাকে রঙিন,সুন্দর করার দায়িত্বটাও নিজ নিজ।আজও যদি সাক্ষর বিয়ের প্রথমদিকের মতো কিনঞ্জলকে নিজের স্ত্রী রুপে মেনে না নিতো,জীবনসঙ্গীকে নিয়ে নিজের স্বপ্নগুলো ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে এই ভেবে বসে থাকতো তবে হয়ত এই স্বর্গীয় মুহূর্তটুকু ওর জীবনে কখনোই ধরা দিতো না।জীবনকে নিজ গতিতে চলতে দিয়েছে,ভালো-মন্দ দুই মিলেই জীবনটাকে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো বলেই আজ কিনঞ্জল ওর বুকে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে আর সাক্ষর নিজেকে পৃথিবীর সুখী ক'জন মানুষের সারিতে দাড় করাতে পেরেছে।জীবন আসলেই অনেক সুন্দর।
এলার্মের শব্দে সাক্ষরের ধ্যান ভাঙলো।কিনঞ্জলের মুখের দিকে তাকিয়ে আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতেই সময় যে কখন চলে গেছে টেরই পায়নি।এলার্ম বন্ধ করে কিনঞ্জলের মাথাটা নিজের বুক থেকে নামিয়ে সাবধানে বালিশে রেখে কম্বলের ভেতর দিয়েই নিজের শরীরের উপর থেকে একে একে কিনঞ্জলের হাত,পা বিছানায় নামিয়ে দিয়ে কিনঞ্জলের প্লাজোটা হাটু থেকে নিচে নামিয়ে সুন্দর করে পা ঢেকে দিলো।এই মেয়ের ঘুমালে কোন হুশজ্ঞান থাকে না।প্লাজো পর্যন্ত হাটুর উপরে উঠে শর্টপ্যান্টের মতো হয়ে যায় আর মহারাণীর সেদিকে কোন তালগোলই থাকে না।এদিকে বেচারা সাক্ষর যে নিজেকে কিভাবে এই ডাকাতরাণীর কাছে যাওয়া থেকে নিজেকে কন্ট্রোল করে তা একমাত্র সাক্ষরই জানে।ইনি তো "আমি আপনাকে বিশ্বাস করি সাক্ষর ভাই" বলেই খালাস।আর এদিকে এই বিশ্বাস অর্জনের জন্যতো সাক্ষরের এই সাড়ে তিনমাসে হাজারটা উইক মোমেন্টে নিজেকে কন্ট্রোল করার জন্য নোবেল,অষ্কার সব পেয়ে যাওয়ার কথা।এমনকি গিনিজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বইয়েও নিজের নাম লিখিয়ে নেওয়ার কথা।এইসব ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাক্ষর বিড়বিড়িয়ে বলল,
"তুই কবে বড় হবি কিনঞ্জল?আমার ধৈর্যের ধনুক যে টানটান হয়ে ছিঁড়ে যাবার পথে।কবে নিজের ঘর-সংসার সামলাবি?আমাকে সামলাবি?তোর এই সর্বনাশা ঘুমের স্টাইল দেখে তো মনে হয় না আর খুব বেশিদিন আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারব?"
এই বলেই সাবধানে বিছানা থেকে নেমে গেলো সাক্ষর যাতে কিনঞ্জলের ঘুমটা না ভাঙে।
এমনিতেই বেচারি কালকে প্রায় সারারাত জেগেছিলো এই ঘন্টা চারেক হলো ঘুমিয়েছে।এখন যদি ঘুম ভেঙে যায় আর ঘুমাতে পারবে না পরে সারাদিন মাথাব্যাথায় ছটফট করে মরবে।
ফ্রেশ হয়ে আজকে একাই নিচে চলে গেলো সাক্ষর।প্রতিদিন তো সাহেব-বিবি দুজনে একদম রেডি হয়ে জোড় বেধে নিচে নামে।তারপর নাস্তা সেরে কিনঞ্জলকে কলেজে ড্রপ করে তারপর নিজে অফিসে যায় সাক্ষর।আজকেও রেডি হয়েই নিচে নেমেছে সাক্ষর।যদিও আজকে সাক্ষরের অফিসে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আর বাসার কেউ যেতেও দিবে না তবুও সাক্ষরকে আজকে মিনিট পনেরোর জন্য হলেও অফিসে যেতে হবে।কিছু ইম্পর্টেন্ট ফাইল ম্যানেজারের হাতে নিজেকেই বুঝিয়ে দিতে হবে।যদিও শরীরে এখন আর তেমন জ্বর নেই সাক্ষরের তবু্ও শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছে ওর।নিচে গিয়ে দেখে সবাই ডায়নিং টেবিলে বসে আছে।সাক্ষরের বাবা,সাফিন,দাদি,ফুপি,তাহা-তাহি প্লেট সামনে নিয়ে বসে আছে।আর মা কিচেন থেকে নাস্তা আনার জন্য সবকিছু ট্রে-তে তুলছে।সাক্ষর এসে সবাইকে গুড মর্ণিং জানিয়ে চেয়ার টেনে বসতেই সবাই ওর শরীরের খবর জানতে চাইলো।সাক্ষর ভণিতা ছাড়াই বলল,জ্বর নেই,তবে শরীরটা বেশ দুর্বল।আর ঠান্ডাটাও গতকাল আদা খাওয়ার পর কমে গেছে।আর আজকে একটু অফিসে যে যাবে সে কথাটাও সবাইকে বুঝিয়ে বলল।সব শুনে কেউ আর আপত্তি করলনা।তবে দাদি শর্ত জুড়ে দিয়েছে আজকে যেনো গাড়িতে করেই অফিসে যায় সাক্ষর।আর সাথে সাফিন বা অন্য কাউকে যেনো নিয়ে যায়।কিনঞ্জলের কথা জিজ্ঞেস করতেই সংক্ষেপে গতকাল রাতে সাক্ষরের অবস্থা খারাপ হওয়া আর কিনঞ্জলের রাত জেগে ওর দেখভাল করার কথাটা জানালো সবাইকে সাথে এটাও বলল এখন যাতে ওর ঘুম কেউ না ভাঙায়।কিনঞ্জলের নাস্তাটা ও নিজেই নাস্তা সেরে উপরে নিয়ে যাবে।সব শুনে কেউ আর তেমন কিছু না বলে নিজ নিজ খাওয়ায় মন দিলো।
একফাঁকে সাক্ষরের দাদি গ্রামের বাড়িতে মানে নিজের মরহুম স্বামীর ভিটেতে যাওয়ার ইচ্ছেটাও সবার সামনে তুলে ধরল।শাহাবুদ্দিন চৌধুরী নিজে এক ছেলের বাপ হয়ে গেলেও এখনো মায়ের প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে মানেন।আর মায়ের ইচ্ছেগুলোকে সবকিছুর আগে প্রাধান্য দেন।কারণ বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ওদের তিন ভাই-বোনকে তিনি একা হাতেই মানুষ করেছে।কখনো ওদের কোন অভাব-অনটন বুঝতে দেয়নি।তাই মায়ের ইচ্ছেতেই ঠিক করল বছর শেষে একবার গ্রামের বাড়িতে স্বপরিবারে যাবেন শাহাবুদ্দিন।
নাস্তা সেরে ট্রেতে করে পরোটা,আলুভাজি,ডিম পোজ আর একগ্লাস পানি নিয়ে রুমে ঢুকলো সাক্ষর।কিনঞ্জল এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।আটটা বাজতে চললো তবুও উঠার কোন নাম গন্ধ নেই।শেষমেশ সাক্ষর নিজেই পাশে বসে আস্তে আস্তে নাম ধরে ডেকে কিনঞ্জলের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছিলো।কেননা জোরে আওয়াজ করে কারো ঘুম ভাঙালে স্নায়ু ও মস্তিষ্ক প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।সাক্ষরের ডাকে কিছুক্ষণের মধ্যেই কিনঞ্জল চোখ মেলে তাকালো।চোখ কচলে উঠে বসতেই সাক্ষর গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়ালো।কিনঞ্জল সাক্ষরের দিকে তাকাতেই দেখলো ব্লু জিন্স আর স্কাই ব্লু রঙের একটা শার্ট পরে হেয়ার ব্রাশ করছে সাক্ষর।ঘড়ি পরতে পরতে কিনঞ্জলের দিকে তাকিয়ে বলল,
"আমি অফিসে যাচ্ছি।নাস্তা টি-টেবিলে রাখা আছে।ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে।"
সাক্ষরের কথায় যেনো কিনঞ্জল ভীষণ বিরক্ত হলো।বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,
"আপনি এই অসুস্থ শরীর নিয়ে আবার অফিসে যাচ্ছেন কোন আক্কেলে?আর যাবেন তো সেই বাইকে করে।এমনিই আপনার ঠান্ডা লেগেছে,আর বাইরেও যে ঠান্ডা পড়েছে আরও অসুস্থ হয়ে পরবেন তো।যেতে হবে না আজকে অফিসে।কয়দিন অফিসে না গেলে ব্যবসা লাটে উঠবে না।"
সাক্ষর গায়ে পারফিউম স্প্রে করে জ্যাকেটটা হাতে নিয়ে কিনঞ্জলের পাশে এসে বসে হালকা হেসে বলল,
"বাবাহ!আমার বউয়ের দেখি আজকাল আমার জন্য চিন্তাও হয়।ভাবিস না গাড়ি করেই যাচ্ছি আর সাফিন চাচ্চুও যাবে আমার সঙ্গে।আধাঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসবো।জরুরি কিছু ফাইল আমার আন্ডারে রয়েছে ওগুলো ম্যানেজারকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেই বেশ লম্বা একটা ছুটি কাটাবো।"
"সেসব না হয় বুঝলাম।কিন্তু আপনি বাসায় গাড়ি থাকতে সবসময় বাইক নিয়ে বেরোন কেনো?আমাকে যখন কলেজে নিয়ে যান আমিতো ভয়ে থাকি আবার কখন বাইক থেকে পড়ে গিয়ে হাত-পা কেটে ফেলি।"
কিনঞ্জলের প্রশ্নে সাক্ষর হালকা হেসে খপ করে কিনঞ্জলের গলায় ঝুলানো ওড়নাটা টেনে কিনঞ্জলের মুখটা নিজের মুখ বরাবর এনে চোখ টিপ মেরে বলল,
"বাইকে পরপুরুষের সঙ্গে উঠেছিস ভেবে মাঝখানে একহাত জায়গা রেখে বসলেতো পরে যাবিই।আর না পড়লে আমি নিজেই ধাক্কা মেরে ফেলে দিবো।নিজের পুরুষের বাইকে উঠেছিস ভেবে জাপ্টে ধরে বসবি।ভাববি ছেড়ে দিলেই উড়ে যাবে এমন একটা ভাব নিয়ে আজকে রাতে যেমন জাপ্টে ধরে ঘুমিয়েছিস সেভাবে জাপ্টে ধরে থাকবি তাহলেই তো আর পড়ার ভয় থাকে না।"
এই বলেই কিনঞ্জলের ওড়নাটা ছেড়ে দিলো সাক্ষর।আর আবারো বলতে লাগলো,
"আমাদের দুইটা বাচ্চা হওয়ার আগ পর্যন্ত তোকে এই গরীবের বাইকেই যাতায়াত করতে হবে।একটা বাচ্চা যখন হবে তখন বাবুকে বাইকে আমার সামনে বসাবো আর তুই আমাকে জাপ্টে ধরে পেছনে বসবি।তারপর যখন দুটো বাচ্চা হবে তখন না হয় গাড়ি কেনার কথা ভাববো।
বাপের পয়সায় ফুটানি করার স্বভাব আমার নেই।যে বাইকটাতে আমি যাতায়াত করি এটা আমার স্যালারির টাকা জমিয়ে কেনা আর গাড়িও ইনশাআল্লাহ নিজের টাকাতেই কিনবো।বাসায় যে দুটো গাড়ি দেখছিস একটা বাবার টাকায় কেনা আরেকটা সাফিন চাচ্চুর টাকায়।তাই আমি খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ওগুলো ইউজ করি না।"
বাচ্চাকাচ্চার প্রসঙ্গ আসায় কিনঞ্জল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।যদিও ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক কিনঞ্জল জানে।তবুও টপিক চেইঞ্জ করার জন্য বললো,
"আপনি কি আধঘন্টা লেইট করতে পারবেন?"
সাক্ষর কিনঞ্জলের টপিক চেইঞ্জ করার ব্যাপারটা ধরতে পেরে মুচকি হেসে বলল,
"হ্যাঁ,পারব।কিন্তু কেনো?"
"আমারও একটু বাইরে যাওয়ার ছিলো।কিছু কেনাকাটা করতে হবে।সাফিন চাচ্চুকে না করে দিন।আমিই যাবো আপনার সঙ্গে।প্রথমে আপনি অফিসে গিয়ে নিজের কাজটা কমপ্লিট করে নিবেন আমি না হয় গাড়িতে ওয়েট করব।তারপর দুজনে মিলে শপিং মলে যাবো।"
"ওকে,As your wish my queen."
এই বলেই সাক্ষর ফেসবুকে লগইন করল।আর কিনঞ্জল ফ্রেশ হতে চলে গেলো।



(চলবে)...

লিখা:~ নাজমুন নাহার তৃপ্তি

 

Delivered by FeedBurner

a