> জলছবি
-->

জলছবি


আম্মার পুরানো ছবির এ্যালবাম দেখতে দেখতে হঠাৎ এক অতিশয় হ্যান্ডসাম ভদ্রলোক চোখে পড়ল আমার। আমি আম্মাকে জিজ্ঞেস করি," হায়! হায়!! আম্মা এই লোক কে?"
আম্মা বলেন, " ডিপার্টমেন্ট এর সিনিয়র ভাই ছিলেন।"শারাফাতুল্লাহ রিজভী"। খুবই সুন্দর আবৃত্তি করতেন। উনার কোন অনুষ্ঠান হলেই আমাদের অডিটোরিয়ামে উপচে পড়া ভিড় হত সবসময়।খুব সম্ভবত সুইডেন প্রবাসী এখন।"
আমি বললাম,"লোক তো ভয়ংকর সুন্দর আম্মা আমি ত ক্রাশ খেয়ে গেলাম! "
আমার কথা শুনে আম্মা হেসেই বাঁচে না। বলেন,"তোর যত পাগলের মত কথা! " আম্মাকে হাসতে দেখলে ভালো লাগে আমার। আম্মার একটা ঢাউস টিনের ট্রাঙ্ক আছে।সেই ট্রাঙ্কে আম্মার স্কুল কলেজের ড্রেস, বন্ধুদের দেয়া পুরোনো পোষ্টকার্ড, কোন এক কালের পত্রমিতালীর দুয়েকটা চিঠি,ডাইরী খবরের কাগজের কাটিং,পুরোনো ছবিটবির বেশ কিছু এ্যালবাম এই সমস্ত সম্পত্তি জব্দ থাকে। মাঝেমধ্যে সেই ট্রাঙ্ক খুলে আম্মা এক দুই ঘন্টার স্মৃতিচারণ করেন। সেই সময়টাতে তার মুখে ৭ সেমি. লম্বা একটা হাসি চিপকে থাকে সবসময়। স্মৃতিচারণ পর্বের সময় আম্মার পাশে বসে তাকে নানান প্রশ্নে ত্যাক্ত,বিরক্ত করাটা আমি আমার মহান দায়িত্ব বলেন মনে করতাম। আমার আম্মা এখনো অনেক সুন্দরী। কিন্তু আম্মার পুরোনো ছবিটবি দেখে রিতীমত অবাক হয়ে যাই আমি। মনে হয় পিঠে দুটো ডানা জুড়ে দিলেই যেন এক্ষুনি পরী হয়ে আকাশে উড়ে যাবেন।
.
মানুষ হিসেবে আম্মা রহস্যময়ী। তার মেজাজ মর্জির কোনই ঠিক ঠিকানা নেই। এই তিণি রোদ,এই তিণি বৃষ্টি। এই তিণি খুশি,এই তিণি বেজার। দশ মিনিট আগেই হয়ত তিণি আপনার সাথে বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে খিলখিল করে হেসেছেন। দশ মিনিট বাদেই দেখা যাবে কি এক অজানা গোপন দুঃখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিণি চোখ মুছছেন। যদি জিজ্ঞেস করি, "আম্মা আপনার কি হইছে? " তিণি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলবেন," কি আবার হবে কিছুই হয় নাই!" এই হলো আমার আম্মা তার মনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়াটা সত্যিই দুষ্কর। হয়ত তার চারিত্রিক এইসব রহস্যময়তার জন্যই আব্বা তাকে এত্ত ভালোবাসেন। আব্বার কথা এবার একটু বলা দরকার। তার মতন রোমান্টিক মানুষ গোটা বঙ্গদেশে আর ২য় কেউ আছে বলে আমার জানা নেই। আমার চাচা, ফুপুরা সব তাকে, "প্রেমিক পুরুষ", " মজনু মিয়া" এইসব বলে খেপায়। কিন্তু আব্বা এইসবে থোরাই কেয়ার করেন। আব্বা আম্মাকে এমন ভাবে যত্ন করেতেন সবসময় যেন আম্মা একটি ছোট্ট পাখির ছানা। আম্মার ছোট থেকে ছোট প্রয়োজন ও আব্বার গুরুত্ত্বের তালিকায় সবার প্রথমে আসত। আম্মার দীঘল কালো লম্বা চুলে আব্বা যত্ন করে তেল লাগিয়ে,আঁচড়ে বিনুনি করে দিতেন। প্রায়ই দেখতাম অফিস থেকে ফেরার পথে আব্বা রজনীগন্ধার মালা নিয়ে আসতেন। নিজ হাতে আম্মার খোপায় তা পড়িয়ে দিতেন। বিয়ে,জন্মদিনের মত কোন অনুষ্ঠানে যাওয়ার হলে, আব্বা নিজে তৈরী হওয়া বাদ দিয়ে, মহা আগ্রহে আম্মার শাড়ি, ব্লাউজ তার সঙ্গে ম্যাচিং চুড়ি, ঝুমকো এইসব বের করে দিতেন। আম্মা তৈরী হয়ে এসে তার সামনে দাড়াবে তিণি পরিতৃপ্তির সঙ্গে তা দেখবেন। এরপরেই তিণি নিজে তৈরী হতে যাবেন৷ অসুখ বিসুখ আম্মার তেমন হত না। শুধু একবার ডেঙ্গু হয়েছিল। আমার তখন গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। ভাইয়াও সেমিষ্টার ব্রেকে বাসায় এসেছে। পিনু খালাও ( আম্মার ছোট বোন) কিছুদিন এর জন্য বাসায় চলে আসল।আর আমিনার মা তো ছিলই। এতগুলি মানুষ থাকার পরও আব্বা দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়ে নিলেন অফিস থেকে। সারাদিন আম্মার মাথার কাছে বসে থাকেন। মাঝেমধ্যে আম্মা ব্যাথায় কাতরে উঠলে আব্বা অস্থির হয়ে ওঠেন। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে তার। আম্মার যাতে জাউ ভাত আর পেঁপের তরকারী টাইপ খাবার খেয়ে অরুচি না ধরে যায়। সেজন্য নিজে গিয়ে মতি লাইব্রেরি থেকে একটা বই কিনে আনলেন, "১০১ রকমারি রোগীর পথ্য"। সেই বই দেখে প্রতিদিন নিত্যনতুন রান্না করেন আম্মার জন্য। আমিনা মা যতবারই গিয়ে বলে,
" খালু দ্যান আমি রাইন্দা দেই। " ততবারই তাকে ধমক দিয়ে বের করে দেন৷ আমি গেলে বলেন,"না না, তুই ছোটমানুষ তুই কি রান্না করবি! ঝালের পরিমাণ টা বুঝতে পারবি না। তোর মা ঝাল বেশি খেতে পারে না আবার খুব কমও খেতে পারে না৷ পরিমাণটা বুঝে দিতে হয়।" আমি হাল ছেড়ে বের হয়ে আসি। এই যে, আব্বার এত ভালোবাসার বাড়াবাড়ি সবসময় যে আম্মা সেটা সহ্য করেন তা কিন্তু না। মাঝেমধ্যে বাজখাঁই গলায় একটা ধমক দিয়ে বলেন,
"নিভৃতের আব্বা আপনি তো খুব ঝামেলা করছেন। চুপ করে বসেন তো। এইসব আমার একদম ভালো লাগে না!"
আব্বা তখন মুখ অন্ধকার করে ঘরের এক কোণায় বসে থাকেন। এমন হাসি পায় আমার তখন। অবশ্য টেনেটুনে কেবল এক ঘন্টা বসে থাকার পরেই আব্বা যেই লাউ সেই Pumpkin হয়ে যান।
আব্বার একবার সিলেটে এক অফিসের ট্যুর পরায় আব্বা সেখানে চলে যান। প্রায়ই এক দুমাস অন্তর অন্তর আব্বা এমন অফিসের ট্যুরে যান। তখন আমাদের ভীষণ বোরিং সময় কাটে। আব্বা থাকলে সারাক্ষণ কিছু না কিছু করতে থাকেন। দুই ঘন্টার প্রেম,এক ঘন্টার মান -অভিমান । বাসায় বিরতিহীন চলচ্চিত্র চলতে থাকে সবসময়। বাসায় আমি,আম্মা আর আমিনার মা তিন তিনটে মানুষ থাকা সত্ত্বেও, শুধুমাত্র আব্বার অনুপস্থিতিতে বাসাটা হঠাৎ করে ভূতের বাড়ির মত থমথমে মনে হতে থাকে। আর এইবার আমিনার মা ও ছুটি নিয়ে ক'দিনের জন্য দেশের বাড়ি গেছে। বাসায় খালি আমি আর আম্মা। আমি ও পড়াশোনায় ব্যাস্ত। ক'মাস বাদেই এইচএসসি ।টেষ্ট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবুও ফাঁকেফাঁকে আম্মাকে টুকটাক সময় দেয়ার চেষ্টা করি। কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় আসার চেষ্টা করি। এরমধ্যে একদিন,সকালে হন্তদন্ত করে কলেজে গিয়ে দেখি সেদিন ক্লাস হবে না কোন। মেজাজটা এমন খারাপ হলো, কি আর বলব! অবশ্য দোষটা আমারই। গতকাল রাতেই কলেজের ফেসবুক গ্রুপে খবরটা জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। মোবাইলে এসএমএস ও দেয়া হয়েছে।আমিই চেক করিনি। আমি ভাবলাম, ভালোই হয়েছে আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে আম্মাকে একটু চমকে দিবো। রাস্তায় " অর বড়ই" দেখলাম। আম্মার জন্য নিয়ে ফেললাম আড়াইশ গ্রাম। নুন দিয়ে অর বড়ই খেতে বড় ভালোবাসে আম্মা। বাসায় এসে দেখি মেইন দরজাটা খোলা। আম্মা নিশ্চয়ই আবার দরজা লাগাতে ভুলে গেছে। আম্মা রাতে ঘুমানোর আগে ছাড়া অন্যান্য সময় কেবল লকের বোতাম চেপে দরজা বন্ধ করেন,ছিটকিনি লাগান না। কদিন ধরে লক টা নষ্ট হওয়াতে বোতাম চেপে লাগানোর পর কিছুক্ষণ লেগে থাকে তারপর আপনা আপনি আবার দরজা খুলে যায়। সেজন্য ছিটিকিনি টা লাগাতে হয়। কিন্তু নতুন এই সমস্যা র সাথে আম্মার পুরোনো অভ্যাসটা এখনো মানিয়ে উঠতে পারেনি। এখন যদি আমি না হয়ে কোন চোর ডাকাত চলে আসত ঘরে? আমি ভাবলাম আজকে এই বিষয়ে আম্মাকে শক্ত একটা বকুনি দিতে হবে। বাসায় ঢুকে দেখি জুতার সেলফের কাছে মোজা গুজে রাখা এক জোড়া জুতা। আব্বার জুতাই মনে হলো। আব্বা কি চলে এসেছে? আমি মহা আনন্দে জুতা খুলে এক দৌড়ে আব্বা আম্মার ঘরের কাছে চলে গেলাম।গিয়ে যা দেখলাম মনে হলো এক মূহুর্তের মধ্যে আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল। বিছানায়া একটা লোক আধশোয়া হয়ে আম্মার পাশে বসে আছে। এবং লোকটা আব্বা নয়। এরপর আরও জঘন্য কিছু ঘটল। আরও৷ নিজের চোখকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে মনে চিৎকার করে বলছিলাম যা দেখছি সব মিথ্যা। এসব সত্যি হতে পারে না। মনের অজান্তে আমার হাত থেকে অর বড়ই এর ঠোঙ্গা টা পড়ে যায়। মেঝের এদিক ওদিক গড়াগড়ি খেতে থাকে বড়ইগুলো।আম্মা ততক্ষণে আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ওড়না আর গায়ের কাপড় চোপড় ঠিক করে আমার কাছে দাঁড়ায়। নার্ভাস হয়ে প্রচন্ড মেকী একটা হাসি দিয়ে বললেন, "ও,তুই চলে এসেছিস! এত তাড়াতাড়ি আসলি যে আজ। ক্লাস হয়নি বুঝি। খিদে লেগেছে? সকালের খিচুড়ি টা গরম করে দিব?" লোকটাও ততক্ষণে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি লোকটাকে চিনতে পারলাম। মায়ের পুরোনো এ্যালবামের সেই ফর্সা করে, লম্বা মতন, সোনালী চশমার ফ্রেম ওয়ালা লোকটি।সামনের চুলে কিছু পাক ধরা আর পরিবর্তিত চশমার ফ্রেম ছাড়া পুরোনো সেই ছবির সঙ্গে তার তেমন কোন অমিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার ইচ্ছে হলো, ঝাপিয়ে পড়ে গলা টিপে লোকটাকে খুন করে ফেলি। কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। রাগে কাঁপতে থাকে আমার সমস্ত শরীর। আম্মা টেবিল থেকে একটা কার্টুন আঁকা পেন্সিল ব্যাগ আর একটা চকলেট এর বাক্স আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, "দেখ তোর রিজভী আংকেল কত কিছু এনেছে তোর জন্য। " আমি সমস্ত শক্তিতে ঘরের এককোণে ছুড়ে ফেলি সেগুলো।চোখে ঘৃণা আর রাগের ভয়ংকর দাবানল দিয়ে আমি আম্মার দিকে তাকিয়ে থাকি। আম্মা অপরাধীর মতন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে আমার সামনে। আর লোকটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর মত দেখতে থাকে সবকিছু।
.
আব্বা ফিরল এর ৪ দিন পর। বিকালে নাস্তা করার পরে আব্বা চুপিচুপি আমার ঘরে এসে ছিটিকিনি লাগিয়ে বলে, "নিঝুম এই দেখ কি এনেছি।" দেখি আব্বা নিজের পেছন থেকে একটা প্যাকেট সামনে এনে দেখায় আমাকে। আমি ভ্রুক কুঁচকে জিজ্ঞেস করি, "কি আব্বা?" আব্বা এক গাল হেসে বলেন, "খুলেই দেখ না!" আমি প্যাকেট খুলে দেখি খুবই সুন্দর শাপলা রঙের একটা সিল্কের শাড়ি। আব্বা বলেন, "কি,সুন্দর না?" আমি ঘাড় নেড়ে বলি, "খুবই সুন্দর আব্বা!"
"তোর আম্মার জন্য আনলাম। আগামী সপ্তাহে আমাদের বিবাহবার্ষিকী না! বেচারি কে গতবার তেমন ভালো কিছু দেই নি৷ তাই এবার এইটা নিলাম।রঙটা তোর আম্মাকে খুব মানাবে তাই না! " আমি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকি তার দিকে। আহারে! আমার ভালোমানুষ আব্বা! আমার চিৎকার করে সমস্ত কিছু বলতে ইচ্ছে হয় তাকে। কিন্তু কিছুই বলতে পারি না। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে আমার। আব্বা বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন,"কাঁদো কেনো মা? কি হয়েছে?" আমি চোখ মুছে বলি, "কিছু না আব্বা,কয়দিন ধরে চোখটা খুব চুলকায় আর খালি পানি পড়ে।" আব্বা মুখ অন্ধকার করে বলেন, " এতো ভারী চিন্তার কথা! দাঁড়া কালকে সকালেই তোকে চক্ষু হাসপাতালে দেখানোর ব্যাবস্থা করছি।"
.
আব্বা চলে যাওয়ার পর আমি দীর্ঘক্ষণ বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদি। কেন আব্বা? কেন আপনি এত ভালো হতে গেলেন? এই পৃথিবীটা আপনার মতো ভালোমানুষ এর জন্য খুব কুচ্ছিত কদাকার। খুউউব!




লেখা:- Rehnuma Quadir
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner