Leave a message
> উষ্ণতা শেষ পর্ব
-->

উষ্ণতা শেষ পর্ব


আরিফ ফ্রেশ হয়ে বের হতেই মুখোমুখি হল ওর শাশুড়ী মানে লিয়ার আম্মু আফরোজার সাথে। জামাইকে এত সকালে দেখে আফরোজ মনে মনে শংকিত হলেও মুখে হাসি টেনে বলল,
___ " কি হল বাবা এত সকাল সকাল উঠে গেলে তুমি....লিয়া এখনও ওঠে নি?"
___ " না আম্মা ওঠে নি এখনও, আম্মা আমি অফিসে যাচ্ছি একটু কয়েকদিন পরে লিয়াকে আমার সাথে নিয়ে যাবো।"
এটুকু বলেই আরিফ নাস্তার টেবিলের দিকে এগোলো। আফরোজার মনে হল এটা আরিফ ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে লিয়া আর আরিফ কাছাকাছি থাকলে হয়ত দুজন দুজনকে বুঝতে আরো সুবিধা হবে ওদের। তাই আফরোজা মনে মনে বেশ খুশিই হলো। আরিফ নাস্তা খেয়ে অফিসে চলে গেলে আফরোজা মেয়ের রুমে যেয়ে হাজির হল কিন্তু লিয়া তখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আফরোজা ঠেলে লিয়াকে ঘুম থেকে উঠিয়েই বেশ রাগ করে বলল,
___ " আচ্ছা লিয়া তোর কোন কান্ডজ্ঞান বলতে কিছু আছে?"
___ " কেন মা আমি কি করেছি।"
আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙ্গতে প্রশ্ন করল লিয়া। আফরোজা আরো রেগে গিয়ে বলল,
___ " মা বাপ মরা ছেলে দুনিয়ায় কেউ নেই ওর তুই ছাড়া। আর বিয়ের পরের দিনই ছেলেটা মুখ ভার করে চলল অফিস করতে? "
___ " মা আমি কি উনাকে বলেছিলাম অফিসে যেতে? আর আমাকে ডাকলেই পারত অফিস যাওয়ার আগে।"
লিয়া বরফ শীতল গলায় উওর দিলো। আফরোজা আর বেশি না ঘাটিয়ে লিয়াকে নাস্তা করতে ডেকে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। সারাদিন চলে গেলেও আরিফের কোন ফোনকল না পেয়ে লিয়া বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। মানুষটা গেল কই? শেষমেশ থাকতে না পেরে সন্ধ্যার পরে কল দিয়েই বসল ও আরিফের নাম্বারে। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পরে আরিফ ফোন ধরেই বলল,
___ " স্বপ্নে দেখছি না তো? এ যে দেখি আমার বউ আমারে কল দিয়েছে।"
___ " এত দেরি কেন বাসায় আসতে?....
এটুকু বলেই বুঝলো ভুল করে ফেলেছে ও তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বলল,
___ " না মানে বাসায় আসা হবে কখন? মা জিজ্ঞেস করছিল তাই আর কি?"
___ " শুধুই কি আম্মা??? তুমি বুঝি চাওনা যে আমি বাসায় আসি।"
আরিফ রসিকতার সুরে বলল। লিয়া বেশ হচকচিয়ে গেল কি উওর দেবে তাই ভেবে৷ আরিফ মুচকি হেসে মনে মনে বলল, " বউ ভালতো তুমি আমাকেই বাসবে তাও আবার পাগলের মত।" লিয়া কথা গুছিয়ে নিয়ে বলল,
___ " তাড়াতাড়ি যেন বাসায় আসা হয়৷ সবাই অপেক্ষা করতেছে। "
এই বলেই খট করে ফোন রেখে দিল। আরিফ বাসায় আসতে আসতে প্রায় রাত সাড়ে এগারোটা বাজলো। আশফান সাহেব অপেক্ষা করছিলেন আরিফের জন্য। আরিফ বাসায় ঢুকতেই দেখলো ডাইনিং টেবিলে তার শশুর শাশুড়ী দুজনেই বসে আছে। আরিফ উনাদের দেখে আর রুমে না যেয়ে সোজা এসে বসল ডাইনিং টেবিলে। ওকে দেখেই লিয়ার বাবা বলতে শুরু করল,
___ " বাবা আমাদের তো একটু সমস্যা হয়ে গেছে। জরুরি কাজে তোমার আম্মা আর আমাকে কালকে ভোরেই গ্রামের বাড়িতে যেতে হবে। লিয়াতো কখনও বাসায় একা থাকেনি যদি তুমি এ কয়েক দিনের ছুটি নিতে খুব ভাল হতো.।"
___ " সমস্যা নেই বাবা আপনারা চিন্তা করবেন না আমি ছুটি নিয়ে নেব।"
আরিফ আশফান সাহেবকে আশ্বাস্ত করে রুমে চলল। রুমে ঢুকেই দেখে লিয়া রকিং চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে৷ মনে মনে আরিফের প্রচুর অনুশোচনা হলো মেয়েটা এতক্ষন ধরে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়েই পড়লো? খেয়েছে কি খায় নি কে জানে। কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারতেছে না। মানসম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে তখন।।আরিফ আড়কোলে করে লিয়াকে তুলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দিয়ে নিজে ফ্রেশ হয়ে নিল। আজকে আর আরিফ মাঝে বালিশের দেওয়াল তুলে দিল না। লিয়াকে ও কথা দিয়েছে লিয়ার অনুমতি ছাড়া কিছুই হবে না কিন্তু বালিশের দেওয়াল তুলে দেওয়ার কোন কথাই তো হয় নি। আরিফ আর একটু এগিয়ে গেল লিয়ার দিকে। কম্বলের নিচে উষ্ণতার পরশে আরিফের চোখ ভেঙ্গে নেমে এলো শান্তির ঘুম। পরের দিন লিয়ার চোখ বন্ধ করেই মনে হতে লাগল ও যেন গাড়িতে শুয়ে আছে৷ একবার মাথা উঁচু হচ্ছে একবার নিচে নামছে। কিন্তু ঘুমের মধ্যে লিয়া বুঝতেই পারছে না আসলে হচ্ছেটা কি? পিটপিট করে চোখ মেলে দেখো ফর্সা কিছু একটার উপরে ও ঘুমিয়ে আছে। তাড়াতাড়ি হাতের উপরে ভর দিয়ে লিয়া উঠে যা দেখলো তাতে ওর চক্ষু চড়ক গাছ। ও আরিফের বুকের উপরে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে ছিল। লজ্জায় ততক্ষনে লিয়ার গালে রক্ত জমতে আরম্ভ করেছ। আরিফকে কখনও খালি গায়ে দেখেনি লিয়া। আজই প্রথম ওকে এই অবস্থায় দেখছে। ফর্সা প্রশস্ত বুকে কালো হালকা পশম৷ বুকের ঠিক বাঁ পাশে কালো একটা তিল। লিয়ার হঠাৎ মনে হল ও এতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে কেন আরিফ কে। আগে তো কখনও কাউকে এমন করে দেখে নি। লিয়ার খুব লোভ হল আরিফের ওই কালো তিলটাকে আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখার। আরিফতো ঘুমিয়েই আছে এখন ছুঁলে তো ও টেরই পাবে না। লিয়া আস্তে আস্তে আরিফের তিলটাকে আঙুলের আগা দিয়ে৷ ছুঁয়ে দিল। হঠাৎ তখনই আরিফ লিয়ার হাতটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,
___ " নিজের বরকে কেউ এমন ভয়ানক ভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সেটা আগে জানতাম না তো।"
আরিফের হঠাৎ এই আচরণে লিয়া হতভম্ব হয়ে যায়। নিজেকে একটু সামলিয়ে হাত টেনে নিতে নিতে বলে,
___ " ময়লা ছিল তাই সরিয়ে দিয়েছিলাম এই আর কি.... "।
আরিফ লিয়াকে এক টানে নিজের বুকের উপরে নিয়ে এলো তারপর লিয়ার চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে বলল,
___ " এত ভয় পাও কেন হারাতে? একবার হারিয়েই দেখো না ফিরে আসতে মনই চাইবে না।"
___ " নিজের উপর এত কনফিডেন্স ভাল না।"
লিয়াও আরিফের চোখে চোখ রেখে বলল। রান্নাঘরে নাস্তা রেডি করতে গেল লিয়া। আজ থেকে রান্নাবাড়া লিয়াকেই সামলাতে হবে৷ কোমরে ওড়না বেঁধে ডিম পাউরুটি টোষ্ট করতে লাগল ও। আরিফ ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে এসে লিয়ার এ পেছনে এসে দাঁড়ালো। চুল গুলো খোঁপা করে ঘাড়ের কাছে ঝুলিয়ে রেখেছে। কপালের দুই পাশে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কোমরে ওড়না পেঁচানো এ যে পাক্কা গিন্নী। আরিফ ধীর পায়ে এসে লিয়ার হাত খোঁপা করা চুল গুলো খুলে দিল একটানে। চুল হাত দিয়ে চেপে ধরে লিয়া রাগের দৃষ্টিতে আরিফের দিকে তাকাতেই ও লিয়াকে কোলে তুলে নিল। লিয়ার কেন জানি না এই দুইদিনে আরিফের কিরা পাগলামি গুলোকে ভাল লাগা শুরু হয়েছে।এই মানুষটা খুব ভালবাসতে ইচ্ছা হচ্ছে লিয়ার।
দুপুরে চারপাশে অন্ধকার করে নামলো ঝুম ঝুমে বৃষ্টি। ছাদে কাপড় আনতে ছুটলো লিয়া। বেশ কিছুখন যাওয়ার পরেও যখন লিয়া আসল না তখন আরিফ চলল ছাদে কাহিনী কি সেটা দেখতে। ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে আরিফ দেখলো লিয়া চোখ বন্ধ করে ভিজেই চলেছে। আরিফ লিয়ার সামনে যেয়ে দাঁড়াতে ও চোখ খুলে আরিফের দিকে তাকায়। কিন্তু লিয়ার সেই চাউনী দেখে আরিফের মনের ভিতরে শক্ত করে একটা ঝাকা দেয়। লিয়ার চোখের সাদা অংশ রক্ত বর্ণ ধারন করেছে। কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই দুই হাত দিয়ে সজোরে ধাক্কা দেয় আরিফকে। পাঁচ তলার ছাদে কোন রেলিং না থাকায় আরিফ আর নিজেকে রক্ষা করতে পারে না সোজা যেয়ে ওর দেহটা নিচের গ্রাউন্ডে পড়ে থেতলে যায়। সেই বৃষ্টিভেজা দুপুরে লিয়া চোখ মুছতে মুছতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
___ " বুবু তুই যেভাবে গিয়েছিলি তোর সাথে প্রতারণা করা সেই প্রতারককেও আমি তোর মত করেই শাস্তি দিয়েছি।"
আজ থেকে চার বছর আগে এই ভাবেই লিয়ার বড় বোন হিয়া ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে সুইসাইড করেছিল আরিফের বাচ্চা পেটে নিয়ে৷ আর আজকে লিয়া তার চরম প্রতিশোধ নিল। লিয়ার খুব করে মনে পড়তে লাগল হিয়ার সেই শেষ জড়িয়ে ধরার উষ্ণতার কথা। মায়ামাখা সেই হাসিখুশি মুখটা থেঁতলে গিয়েছিল ছাদ থেকে পড়ে। লিয়ার মনে হতে লাগল হিয়া উপর থেকে হয়ত ওকে দেখে হাসছে। তাই তো ঝুম বৃষ্টিতে এক চিলতে রোদের দেখা মিলল।


Writer:- মারিয়া আফরিন নুপুর
 

Delivered by FeedBurner

a