Leave a message
> স্বপ্ন ধোঁয়াশা অন্তিম পর্ব
-->

স্বপ্ন ধোঁয়াশা অন্তিম পর্ব


আমার খালাতো বোন শশীকে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির খালেদা জিয়া হলের সবাই ভূত ভাবে।। কারণ ঐ হলের বেশ কিছু মেয়ে নাকি রাতে স্বপ্নে দেখছে, শশী তাদের বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে চাইছে।। এরপর থেকে আস্তে আস্তে শশীকে সবাই অন্য চোখে দেখতে শুরু করলো।। অনার্স প্রথম বর্ষে পড়া আমার সুন্দরী খালাতো বোনটা এসব শুনে নিজেই খুব কষ্ট পেলো।। আমি সব শুনে ভাবলাম, শশীকে আপাতত ঢাকা এনে কোন মেয়েদের ব্যাচেলর বাসায় রাখি।। কিন্তু কোন এক অজানা টানে শশী আমার সাথে থাকতে চায়, আমি অবিবাহিত একজন মানুষ, ঢাকায় থাকি, আমার সাথে খালাতো বোনের তো একই বাসায় থাকা মানায় না।। আমি শশীর জন্যে বাসা খুঁজতে গিয়ে, কাহিনী অন্য দিকে মোড় নিলো, আমি বাসা একটা পেলাম বটে কিন্তু সেই বাসায় আমার প্রাক্তন উপমা থাকে।। মেয়েটা চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটির ছিলো, এখন অনার্স মাস্টার্স শেষ করে মোহাম্মদপুর আদাবর আছে।। আমি ভাবলাম এক কাজ করি, শশীকে উল্টা আমার প্রেমিকা সাজিয়ে উপমার রুমমেট বানিয়ে দেই।। তাতে উপমা যতবার শশীর সাথে আমাকে কথা বলতে দেখবে, রঙঢং করতে দেখবে, ততবার অদ্ভুত এক জ্বালায় জ্বলবে।। উপমা মোটেই জানে না, কি অপেক্ষা করছে ওর জন্যে, কারণ আমার এসব প্ল্যানের ব্যাপারে তার কোন ধারণাই নেই।। এমন প্ল্যানের পর কোন একরাতে ঘুমাচ্ছি, আচমকা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলো।। স্বপ্নে নাকি বাস্তবে কে জানে, দেখলাম শশী আমাকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে চাইছে।। আরও ভড়কে গেলাম, যখন দেখলাম শশী তখন আমার রুমে।। পরে যেটা আবিষ্কার করলাম সেটা আরও ভয়াবহ, আসলে শশী তখন বাস্তবেই আমার রুমে ছিলো।। তার কাছে আমার বাসার চাবি ছিলো, যেটা সে আগেই আমার কাছ থেকে চুরি করেছে, সেই চাবি দিয়ে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করেছে।। আমি শশীকে বুঝিয়ে উপমা, মানে আমার প্রাক্তনের বাসায় পাঠিয়ে দিলাম।। কিন্তু বাজে ব্যাপার হলো, শশী ওই বাসায় যাবার পর আমার প্রাক্তন নিজেও নাকি দুইবার এই স্বপ্ন দেখছে যে, শশী ওকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে চাইছে।। সব কিছু আমার কাছে জট পেকে গেলো, এক বন্ধু মঈনের সাহায্য নিলাম, এইসব ঘটনা আদ্যপান্ত খুলে বললাম মঈনকে।। সে অদ্ভুত এক সমাধান দিলো, যা থেকে দাঁড়ালো শশী নাকি স্বয়ং উপস্থিত থেকে এই কাজ করে কারণ সে আমার সাথে থাকতে চায়, তাই যেখানেই যায় এই ঝামেলা বাঁধায়।। আমি সরল মনে মঈনের ব্যাখ্যা মেনে নিলাম।। কিন্তু ভয়ানক ব্যাপারটা ঘটলো, যখন মঈন ঢাকা ভার্সিটির একটা হলে থেকেও, এই স্বপ্ন দেখলো যে শশী ওকে বালিশ চাপা দিচ্ছে।। মানে দাঁড়ালো, মঈনের সব ব্যাখ্যা ভুল।।

এই ছিলো প্রথম দুই পর্বের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, আপনি যদি আগের দুই পর্ব না পড়ে থাকেন, আরও বিশদ জানার জন্যে পড়ে নিতে পারেন।। আমি নিচে দুই পর্বের লিংক যুক্ত করে দিবো।।

ফোন কেঁপে উঠছে, কয়টা বাজে।। কি এক ফোনের যন্ত্রনায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো।। আমি চোখ কচলে দেখি মঈনের ফোন।। কি ব্যাপার হারামী কি এখন শশীর নাম্বার চাইবে নাকি, কি বিপদ!! কোন দুঃখে আমি শেয়ালের সামনে মুরগী নিয়ে গেছিলাম, খোদা জানে, তাও এত সুন্দরী একটা মুরগী, ধুর!! প্রথম কল এড়িয়ে গেলাম, সাথে সাথে আবার কল দিলো, এবার ধরলাম-

-কি রে ব্যাটা এত রাতে!! কি মনে করে কল দিলি?

ও পাশের হাঁসফাস কন্ঠ- দোস্ত, তোর বোইন তো আমার স্বপ্নে রে, আমারে বালিশ চাপা দিছে, ভাইরে আমার মনে হয় এখনো আমার দম চালু হয় নাই।। কি দেখলাম এইডা!!

আমি সোজা কেঁপে উঠলাম, এক নিমিষে মঈনের দেয়া সব ব্যাখ্যা মিথ্যে হয়ে গেলো!!

ঘুম জড়ানো কণ্ঠটা আমার মুহূর্তেই গায়েব হয়ে গেলো, আমি থতমত খেয়ে বললাম- দোস্ত, তুই হলে না।। কি বলিস, বুঝলাম না।।

মঈন সেই আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে যাচ্ছে- বন্ধুরে আমি তো হলেই, আমি তো সিঙ্গেল বেডে থাকি, ঘুমানের পরে দেখলাম শশী আমারে বালিশ চাপা দিতাছে, লাফ দিয়ে উঠে বসছি বুকের উপর থেকে মনে হলো একটা বালিশ পরে গেলো।। ভাইরে, এই মেয়ে তো মানুষ না, জ্বীন পরী বা কিছু একটা।। আমি বিকালে তোরে যা বলছি এখন তো মনে হচ্ছে সব কথা ভুল ছিলো।।

আমার মাথা কাজ করছে না, মগজ বরফের মত জমাট বেঁধে আছে।। যতটা শান্তি নিয়ে ঘুম দিয়েছিলাম, চট্‌ করে ততটা অশান্তি নিয়ে ঘুম ছুটে গেছে।। আমি মঈনকে কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না, আমার এই থেমে থাকার ফাঁকে মঈন আবার বললো- দোস্ত, এই মেয়ে কি জাদু জানে নাকি, আমি কি বারবার এসব দেখমু নাকি, ভাইরে তুই হুজুরের কাছে যা।। কোন এক হুজুররে সব খুলে বল, আমি ভাই মাফ চাই।। হ্যালো, তুই লাইনে আছিস??

-হুম আছি রে, দোস্ত!! আমি কি করি বল তো।।

যা মন চায় কর ভাই, আমার আর রাতে ঘুম হবে না রে।। আমি শেষ, পুরাই শেষ।।

মঈনকে সান্ত্বনা কিভাবে দিবো, বুঝতে পারছিলাম না।। কোনমতে বললাম- দোস্ত, আল্লাহ্‌, আল্লাহ্‌ কর, কিছু হবে না।। আমারও আর রাতে ঘুম হবে না, দেখি সকালে খালাম্মা খালুকে এবার সব জানাতে হবে।।

জানা ভাই জানা, পারলে এই মেয়েকে হুজুরের কাছে নিয়ে যা।। নিশ্চিত এর সাথে জ্বীন আছে, মন্দ কোন জ্বীন।।

মঈনের সাথে আরও কিছু কথা বলে ফোন রেখে দিলাম।। বিছানা থেকে উঠে বসেছি, মাথার নিউরণগুলো ছিঁড়ে যেতে চাইছে, এত চাপ নিতে পারছি না।। কি করবো, কি করা উচিত।। মোবাইলে দেখলাম রাত ১ টা ৩৭ বাজে।। আমার ঘন ঘন ঘড়ি দেখার অভ্যাস, খুব যে রাত হয়েছে তা না, শশীকে একটা কল দেয়া যেতে পারে।। যেতে পারে কি, দেয়া উচিত।।

আমি আর কিছু না ভেবেই শশীকে কল দিলাম।। আরে, এত রাতে শশীর কল ওয়েটিং, একটু অন্যরকম লাগলো ব্যাপারটা।। ফোন রেখে এখন অন্য চিন্তায় বিভোর, শশীর ফোন ওয়েটিং দেখে কেনো যেনো আমার খারাপ লাগছে, হিংসা হচ্ছে।। অথচ, এমন হবার কথা ছিলো না, আমি মহা দোটানায় পড়ে গেছি, শশীর প্রতি মায়া, নাকি খালাতো ভাইয়ের দায়বদ্ধতা নাকি ভালোবাসা, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।।

শশী কল ব্যাক করলো।।

-কি রে এত রাতে কার সাথে কথা বলিস?? আমার কণ্ঠে অস্বাভাবিকতা আমি নিজেই খেয়াল করলাম।।

শশী স্বাভাবিক গলায় বললো- আরে এক বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলাম, তুমি এত রাতে কল দিলা কি মনে করে??

আমি ভাবছি, শশীকে কি মঈনের ব্যাপারটা বলবো।। আবার ভাবলাম না থাক, মেয়েটা এত রাতে এটা শুনলে ভয় পেয়ে যেতে পারে।। আমি বললাম- আচ্ছা, বান্ধবীর সাথে এত রাতে কিসের কথা?? উপমা কি করে??

-তোমার উপমা ঘুমায়, ফালতু মেয়ে তোমার এই উপমা।। সে আমাকে বুঝায় তোমাদের রিলেশন থাকার সময় নাকি তোমরা অনেক কিছু করছো, নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে, করলে করছিস, আমাকে বলিস কেন।।

শশীর কণ্ঠ আস্তে আস্তে ঝাঁঝালো হয়ে গেলো।।

আমি একটু বিব্রত হলাম, শশী আর উপমার মধ্যে ঠান্ডা এক নোংরা যুদ্ধ চলছে।। বাস্তবতা হলো, উপমার সাথে আমার জড়িয়ে ধরা আর গালে চুমু দেয়া ছাড়া কিছুই হয় নি কোনদিন।। অথচ সে শশীকে কিসব ইঙ্গিত দিচ্ছে, কে জানে।। আসলে কেন দিচ্ছে, তা বোঝার জন্যে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না, মানুষ স্বভাবতই হিংসুক, আর মেয়েরা এসব ক্ষেত্রে মহা হিংসুক।।

আমি ম্রিয়মাণ গলায় বললাম- আচ্ছা থাক, ওর সাথে এত কথা বলার দরকার নেই।।

শশী বলে যাচ্ছে- শুনো আমি এই মেয়ের সাথে বেশিদিন থাকতে পারবো না, তুমি যাস্ট একটা বাসা দেখো, যেখানে আমরা দু’জন থাকতে পারবো।। আর হ্যাঁ, আমি তো ভালো রান্না পারি, তোমার চিন্তা করতে হবে না।।

শশীকে নিয়ে এক বাসায় থাকার প্রশ্নই আসে না, এই মেয়ে হয়তো পুরোদস্ত এক ভূত।। আমি কিনা শেষে ভূত নিয়ে সংসার করবো।। কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না, কি যে হয়েছে, সব জায়গা থেকেই নতুন নতুন ঝামেলার উদ্ভব।। মনে হলো, এক জানলা দিয়ে ভূত বের করে দিতেই অন্য জানালা দিয়ে আরেক ভূত এসে হাজির।। শশীকে আর বেশি ঘাঁটলাম না, ফোন রেখে দিলাম।। একটা ব্যাপার বুঝলাম না, এত রাতে সে কি সত্যিই বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলো, একবার যখন বলেছেই যে বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলো, আমি তো এখন আর জেরা করতে পারি না।। রাতে আর ঘুম হবে না মনে হচ্ছে, আবার শশীকে কল দিবো, এখুনি দিবো।। কোন বান্ধবীর সাথে কথা বলছিলো, এটা জানা দরকার, বান্ধবীর কাছেও নতুন কোন তথ্য থাকতে পারে।।

সব ভেবে আবার শশীকে কল দিলাম, এইবার বড়সর ধাক্কা খেলাম বলতে হবে, আবার নাম্বার ওয়েটিং।। বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে, মনে হচ্ছে কেউ একজন বুকের মধ্যে ভাইব্রেটর লাগিয়ে বসে মজা নিচ্ছে।। জীবনে এমন হয়েছিলো, সারারাত যখন উপমার ফোন ওয়েটিং পেয়েছিলাম।। সে বলেছিলো, তার এক কাজিন ইউএসএ থেকে ফোন দিয়েছিলো, খুব জরুরী কথা বলার ছিলো তাদের।। আসলে সেদিন সে তার আগের বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলো।। ফোন নিয়ে মিথ্যে কথা বলাটা যেনো ডাল ভাত।। আমার ভাবনার সাথে বুক কাঁপুনিতে ছেদ পড়লো, আবারও শশীর কলে।। আমি ধরেই রাগান্বিত কণ্ঠে বললাম-

কি রে ভাই, এত রাতে কার সাথে এত কথা বলিস।।

শশী ফোনের অপর প্রান্তে হেসে উঠলো, মধ্য রাতে সুন্দরী কোন মেয়ের হাসি, মায়াবী হাসি- কি ব্যাপার, হিংসে হয় নাকি মিস্টার!!

এমন সুরে শশী কখনো আমার সাথে কথা বলবে তা ভাবি নাই, আমি খেয়াল করে দেখলাম আগে মেয়েটা কথায় কথায় ভাইয়া বলতো, এখন ভাইয়া উহ্য রেখে বাক্য সাজায়।।

-কিসের হিংসা হবে, তোর সমস্যা কি, এত রাতে কোন বান্ধবীর সাথে কথা বলিস শুনি??

শশীর কণ্ঠে রহস্য- আরে আছে আছে, শুনো তখন তো ওর সাথে কথা শেষ হয় নাই, তুমি কল দিলা।। তাই আবার কল দিছি।। কিন্তু তুমি আবার কি মনে করে কল দিলা, ঘুম আসে না বুঝি, চলে আসি তোমার কাছে।।

-থাপ্পড় দিবো একটা, চলে আসি মানে।। বল যার সাথে মন চায় যতক্ষণ খুশি কথা বল, আমার কি।।

নাহ্‌ তোমার কিছু না, তুমি তো জগতের সবচেয়ে অবুঝ পুরুষ, তোমার কি হবে।।

- শুন, এই জাতীয় কথা আগেও বলেছিস, হাজার হলেও আমি তোর ভাই, এটা মাথায় রাখিস।।

ধুর, কিসের ভাই।। তুমি আমার ভাই না, ব্যাস।। রাখি, মেজাজটাই খারাপ করে দিলা।।

সত্যি সত্যি এই কথার পরেই শশী ফোন কেটে দিলো।। আমি আসলে বুঝি, সব বুঝি, ও আমাকে আর ভাই ভাবতে পারছে না, স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে।। কিন্তু এত রাতে, কি এত কথা, হোক সে বান্ধবী!!

……………

উপমার সাথে বসে আছি, কেনো যেনো উপমা মিট করতে রাজী হচ্ছিলো না।। যদিও সে আগে একবার আগ্রহ দেখিয়েছিলো।। পরে বেঁকে বসে, আমি একপ্রকার অনুরোধ করেই তাকে আসতে বললাম, শ্যামলীর ওদিকে যে একটা পার্ক আছে আমার জানা ছিলো না, সেই পার্কের ওখানেই দু’জন বসে আছি ।। আজ প্রায় দেড় বছর পর আমরা মুখোমুখি।। গতরাতে আমার এক ফোঁটাও ঘুম হয় নি, সকালে চলে গেলাম অফিস।। অফিসে বসেই উপমাকে দেখা করানোর জন্যে রাজী করালাম, তবে এসব হচ্ছে শশীর অগোচরে।।

উপমা আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছে, এখন ওকে দেখে মনেই হচ্ছে না মেয়েটার অনার্স মাস্টার্স শেষ।। বাচ্চা বাচ্চা একটা চেহারা, তবে লক্ষণীয় ব্যাপারটা হলো, ওকে আমি হিজাব ছাড়া আগে বাস্তবে কোনদিন দেখি নি, আজ দেখলাম জিন্স টপস্‌ আর ছোট্ট একটা বেখেয়ালী ওড়না জড়ানো।। ঠোঁটে গোলাপী শেডের লিপস্টিক, কেনো যেনো মেয়েটাকে সুন্দর লাগছে।। আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে।। মনে মনে বুলি আওড়ালাম, প্রাক্তনগুলো আসলেই সুন্দর হয়ে যায়।। উপমা এখনো সরাসরি কোন কথা বলে নি, মেয়েটা আমাকে দেখার ক্ষেত্রেও কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে না।। এই সুযোগে আমিই ওকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছিলাম।।

নিরবতা ভেঙ্গে আমি বললাম- উপ কেমন আছো?? শুকিয়ে গেছো আগের চেয়ে।।

উপমা আমার দিকে না তাকিয়ে, কৌণিক ভাবে মুখ আড়াল করে বললো- হুম, তুমি আজকাল শার্ট পরো, অথচ আগে তো টি শার্ট ছাড়তেই চাইতে না।। গালের ওখানে কাটা দাগ কিসের, কবে হলো এমন??

আমার একটা ভুল ভাঙলো, উপমা আমাকে কোন ফাঁকে পর্যবেক্ষণ করে নিয়েছে কে জানে!! সব মেয়েদের কিছু স্পেশাল জাদু-মন্তর থাকে, ছেলেদেরকে সেই জাদুর রহস্য ভেদ করার সাধ্যি বিধাতা দেয় নি।। আমি স্বাভাবিক গলায় জবাব দিলাম- আরে সেভ করতে গিয়ে কেটে গেছিলো, তাও তো কয়েক মাস আগে।। এখন অফিস-টফিস করি তো, শার্ট পড়তেই হয় আর কি।।

-হুম, শার্টেও তোমাকে মানায়।। শশীকে বিয়ে করবে কবে, সে তো তোমার জন্যে উতলা, সারাদিন তোমার নাম জপ করে।।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম- আর বিয়ে, তুমি বিয়ে করছো না কেন?? নবীনের সাথে সম্পর্ক কি আছে??

-নবীন, নবীনের সাথে আমার সম্পর্ক কোনদিন জোড়া লাগে নি রায়হান।। আমি বিয়ে করবো না, এই নিয়েই তো বাসায় রাগ করে ঢাকায় থাকা।।

কি বলো, নবীন আর তোমার ব্যাপারে সব জানি বুঝলা, এখন এসব মিথ্যে বলে লাভ কি।। যাই হোক, এবার বাবা-মায়ের ইচ্ছায় বিয়েটা করে ফেলো।।

-আমি মিথ্যে বলি না রায়হান।। মিথ্যে কে বলে সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি, যাক্‌ এভাবে ডেকে মিট করার কারণ কি??

কোন বিশেষ কারণ নেই, আচ্ছা তুমি কি শশীকে নিয়ে আবার ঐ স্বপ্নটা দেখছো??

-না দেখি নাই, আমার ধারণা শশীর কোন অদ্ভুত ক্ষমতা আছে।। সে যার উপর রাগ করে, তাকে স্বপ্নে ভয় দেখাতে পারে।। যেহেতু আমি তোমার এক্স, আমার ধারণা মেয়েটা আমাকে মোটেই সহ্য করতে পারে না।। তুমি কি একটু আমার বাবার বন্ধু শফিক আংকেলের সাথে দেখা করবে, আমি বলেছিলাম তোমাকে উনার কথা মনে আছে কি??

আমি চিন্তার সাগরে ডুব দিয়ে, শফিক নামটা কুড়িয়ে পেলাম।।

হ, মনে আছে তো।। উনি না তোমার আম্মুর কি যেনো সাইকোলোজিক্যাল সমস্যা দূর করছে।। আচ্ছা ভালো কথা বলছো তো, আসলেই উনার সাথে দেখা করা দরকার।।

-শুধু আম্মু না, আমি নিজেও উনার আন্ডারে আছি প্রায় এক বছর ধরে।। তুমি চলে যাবার পর আমার কিছু মানসিক সমস্যা হয়, তবে এখন যথেষ্ট ভালো আছি।। সুইসাইড এটেম নিয়েছিলাম দুইবার, সফল হই নি।।

আমি চমকে উঠলাম, উপমা এসব কি বলছে।। আমি উপমাকে যেহেতু ভালোবাসতাম, এসব শুনলে তো সোজা দ্বিধায় পড়ে যাবো।। তাৎক্ষণিক আবার, শশীর সব পাগলামীর কথা মনে হতে থাকলো।। জড়ানো গলায় বললাম- কি বলো, সুইসাইড মানে।। তোমার বান্ধবী আমাকে কি সব বলছিলো, তোমার সাথে নবীনকে সে কয়েকবার অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখছে, এসব কি মিথ্যে!!

উপমা চট্‌ করে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকালো।। সেই আমার চেনা চোখটা, এখন এই চোখে রাজ্যের জিজ্ঞাসা- বান্ধবী মানে, কোন বান্ধবী?? এসব তো আগে বলো নি, তুমি তো আমাকে অযথাই ব্লেম দিয়ে সরে গেলা।। আবার প্রচন্ড গালিগালাজ করতা, এত নিকৃষ্ট ব্যবহার পাবো তোমার কাছে কল্পনাই করি নি।।

আমি বিষ্ময় কণ্ঠে বললাম- স্বর্ণা এসব বলেছিলো, শুধু স্বর্ণা না তোমার এক ছেলে বন্ধু কি যেনো নাম সম্ভবত রানা সেও বলেছিলো একই টাইপ কথা।।

উপমা কপাল কুঁচকে বললো- বাহ্‌ রায়হান, আপনাকে আমি বুদ্ধিমান মনে করতাম, আর আপনি কিনা, মানুষের কথা যাচাই না করেই সিদ্ধান্ত নিলেন তখন।।

-মানে কি, ওরা তো তোমার সব থেকে ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলো তাই না।।

হুম ছিলো, কোন একসময় ছিলো।। যাক্‌ যা হবার হয়েই গেছে, বাদ দেন এসব।। বলেন এখানে ডাকলেন কেনো??

আমি উপমার চোখে আদ্রতা দেখতে পাচ্ছি, উপমা খুব একটা কাঁদুনে ছিলো না।। কিন্তু হুট করে ওর চোখের কোণায় পানির চিকচিকানি।। আমার মন বলছে, সম্পর্কটা আবার জোড়া লাগাই, কিন্তু মন এসব বললেই তো হবে না, সব তো গুলিয়ে ফেলেছি।। নিজের মায়াকে সামলে নিয়ে, উপমাকে বললাম- আচ্ছা শফিক আংকেলের ঠিকানা দাও, উনার সাথে দেখা করতে চাই।। তুমি কি আমাকে উনার কাছে নিয়ে যাবা??

উপমা খানিক ভেবে বলছে- উনি তো উনার বাসায় বসেন, আজ আমার যাবার কথা আছে, চলেন আপনিও চলেন।। চাইলে এখুনি যেতে পারেন, আমি কল করে বলে দিচ্ছি।।

আমি খুশি হয়ে গেলাম, এখন শফিক সাহেবের কাছে যাওয়া মানে, উপমার সাথে রিক্সা বা একই বাহনে উঠার সুযোগ।।

……………

শফিক সাহেবের বাসার নিচেই চেম্বার।। উনি দেখতে বেশ বয়স্ক, যদিও আমি উপমার বাবাকে বাস্তবে কোনদিন দেখি নি, কিন্তু এই লোক যদি উপমার বাবার বন্ধু হয়, তবে উপমার বাবার বয়স নেহাৎ কম না।। উনি চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকেন, আজব এক চাহনী, যখন আপনার দিকে তাকাবে মনে হবে আপনাকে সে স্কান করছে, চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হবেন।। উনার সামনে বসে আমি বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছি।। উনি চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, পাশেই উপমা বসা।।

উপমা শুরুতে সংক্ষেপ করে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো, ওর বন্ধু বলে।। কিন্তু নাম শোনার পর, শফিক সাহেব বললেন- আচ্ছা, রায়হান, রায়হান।। তুমি কি সেই রায়হান, আমি যাকে ভাবছি।।

এ কেমন কথা!! আমি কোন রায়হান, আর এই লোক না জানি কাকে ভাবছে!!

উপমা জবাব দিলো- জ্বী আংকেল, কিন্তু এবার ওর দরকারেই এখানে আসা, ওর নিজের দরকার, আমার কিছু না।।

আমি ঘুরে উপমার দিকে তাকালাম, মেয়েটার বাম গালে ছোট্ট একটা ব্রণ হয়েছে, কারণ ছাড়াই টুস করে ব্রণটা গালিয়ে দিতে মন চাচ্ছে।। আগেও এমন হতো, ওর মুখে ব্রণ দেখলে গালিয়ে দিতে চাইতাম, উপমা বাঁধা দিতো, কে শুনতো এইসব উপ-ফুপর বাঁধা।। আমি আনমনে বুঝে নিলাম, উপমার এই ডাক্তার নিশ্চয় আমাকে নামে চিনে, হাজার হোক আমার ব্যাপারেই তো উপমার মানসিক রোগের আবির্ভাব!!

শফিক সাহেব সেই অদ্ভুত চাহনী দিয়ে বললেন- বলো তো বাবা, কি ঘটনা!! সময় নিয়ে গুছিয়ে বলো, মনে করো অফুরন্ত সময় আমাদের হাতে, তুমি আমাকে গল্প শোনাচ্ছ।।

আমি বুঝলাম, এই কাজ করতে হলে মনযোগী শ্রোতা হতে হয়, শফিক সাহেব নিঃসন্দেহে একজন মনযোগী শ্রোতা।।

আমি লম্বা করে দম নিয়ে শুরু করলাম, প্রায় আধা ঘন্টা ধরে সব বলে গেলাম।। কথার ফাঁকে খেয়াল করছিলাম, উপমা তো অনেক কিছুই জানতো না, সে প্রচণ্ড কৌতুহল নিয়ে আমার কথা শুনে যাচ্ছিলো।। আমি শশীর হল থেকে শুরু করে, উপমার ওখানে পাঠানো, উপমার স্বপ্ন দেখা, শেষে গিয়ে বন্ধু মঈনের ব্যাখ্যা এমনকি মঈন যে স্বপ্ন দেখলো তাও বাদ দিলাম না।। এত কথার ফাঁকে এটাও বলেছি, শুধুমাত্র উপমাকে জ্বালানোর জন্যে শশীকে আমার প্রেমিকা সাজিয়ে ঐ বাসায় পাঠিয়েছি।। কথার মাঝে একবার পানি খেয়ে নিচ্ছিলাম, তবে পানিটা উপমাই আমাকে অফার করে।। ওর ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে বলে, রায়হান একটু পানি খেয়ে নাও।।

শফিক সাহেব আমার দিকে ঝুঁকে এসে কথাগুলো শুনছিলেন, লোকটার চোখে মনে হয় পলক পড়ে না।। এখন চোখ পিটপিট করছে উনার।। উনি ডানে বামে তাকিয়ে আবার আমার দিকে ফিরে তাকালেন।। তারপর মুচকি হাসি দিয়ে বললেন- খুব মজার কাহিনী, আমি শুনে বেশ মজা পেয়েছি।। মানুষ স্বপ্ন কেনো দেখে জানো??

আমি আর উপমা উনার দিকে তাকিয়ে আছি।। এই তাকানো মানেই, আপনি বলতে থাকেন, আমরা শুনি।।

শফিক সাহেব পিছিয়ে গিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন, তারপর বলতে শুরু করলেন- ঘুমের মধ্যে প্রায়ই আমরা স্বপ্ন দেখি।। মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, মানুষের অবচেতন মনের ভাবনা-চিন্তা, ভয় কিংবা অপূর্ণ ইচ্ছার প্রতিফলন হচ্ছে স্বপ্ন।। যদিও স্বপ্ন দেখার পর অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, এমনটা তো আমি চিন্তাও করি না।। তাহলে স্বপ্নে দেখলাম কেন?? কিন্তু মনোবিদরা বলে, অবচেতন ভাবে যা কিছু ভাবা হয় তাই মানুষ স্বপ্নে দেখে।। যেটা হয়তো সে বুঝতেও পারে না।।

শশীর ঘটনার সাথে উনার এইসব কথার কি সম্পর্ক কে জানে, উনি তো মনে হচ্ছে স্বপ্ন নিয়ে বিশাল লেকচার দিবেন।। সত্যি সত্যি আমার ধারণাকে সঠিক প্রমাণ করে শফিক সাহেব বলে যাচ্ছেন- জন্মের তিন চার মাস পর থেকেই শিশুরা স্বপ্ন দেখা শুরু করে।। দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা ঘুম সময়ের প্রায় ৪০ শতাংশ এবং কৈশোরে ঘুম সময়ের ২০ থেকে ২২ শতাংশ স্বপ্ন দেখে।। চল্লিশের পর থেকে ঘুম সময়ের ১২ থেকে ১৫ শতাংশ স্বপ্ন দেখা হয়।। মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে স্বপ্ন দেখা তত কমতে থাকে। সুতরাং রায়হান, প্রাকৃতিক প্রবণতা হচ্ছে মানুষকে সর্বস্বপ্নহীন ভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় দেয়া।।

আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম এতক্ষণ, কিন্তু নতুন নতুন তথ্য পেয়ে শুনতে বেশ লাগছে, যদিও উনি কেমন যেনো কথার সাথে ফিলোসফি ঝাড়ছেন মনে হচ্ছে।। শফিক সাহেবের কথা চলমান- একজন ক্লান্ত মানুষ প্রথম দুই ঘন্টা ঘুমানোর সময় স্বপ্ন দেখে না।। তখন শরীর পূর্ণ বিশ্রাম নেয়।। স্বপ্ন দর্শন কালকে rapid eye movement period বলা হয়।। নিদ্রাকালে যে সময় মানুষ স্বপ্ন দেখে না সে সময়টাকে non rapid eye movement period বলা হয়।। ঘুমের মধ্যে প্রায় প্রত্যেক ৯০ মিনিটে, প্রায় ১০ মিনিট সময় ধরে REM নিদ্রা দেখা যায়। ঘুমের মধ্যে ৪-৫ বার REM নিদ্রা।। অর্থাৎ প্রতিদিন মানুষ অন্তত ৪-৫ টি স্বপ্ন দেখে।। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এর কিছুই তার তেমন মনে থাকে না, এবং আস্তে আস্তে সে স্বপ্নের সব ভুলে যেতে থাকে।।

আমি শরীর টানটান করে উনার কথা শুনে যাচ্ছি!! একবার উপমার দিকে তাকালাম, উপমা মনে হয় বিরক্ত, তার এত জ্ঞানের প্যাঁচাল ভালো লাগছে না নিশ্চয়।।

শফিক সাহেব এবার সোজা হয়ে বসলেন, তারপর আবার বলে গেলেন- একটা জিনিস বলি তোমাকে, শুধু মানুষ স্বপ্ন দেখে তা নয় বরং সকল স্তন্যপায়ী প্রাণিই স্বপ্ন দেখে মানে তাদের ক্ষেত্রেও র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট হয়ে থাকে।। REM পর্যায়টির স্থায়ীত্বকাল সাধারণত মোট ঘুমের ১ চতুর্থাংশ হয়ে থাকে যদি একে অনুপাতের হারে ফেলি অর্থাৎ কেউ যদি টানা ৮ ঘন্টা ঘুমের মধ্যে কাটায় তাহলে তার REM ফেইজ হবে প্রায় ২ ঘন্টা।। একজন গড় আয়ুর ব্যক্তি তার জীবনের প্রায় ৬ বছর সময় কাটিয়ে দেন স্বপ্ন দেখে।। এই পর্যায়টি হচ্ছে ঘুম থেকে জেগে উঠার সবচেয়ে নিকটস্থ সময়ে হয়ে থাকে এজন্য অনেক সময় খেয়াল করে দেখবা স্বপ্ন দেখার সাথে সাথেই তোমার ঘুম ভেংগে গিয়েছে।। এছাড়া গভীর ঘুমে থাকা অবস্থায় ( NON-REM) আমরা হয়ত স্বপ্ন দেখি তবে সেটা স্মৃতিতে থাকেনা সাধারণত।। একটি স্বপ্নের স্থায়ীত্বকাল ১৫-২৫ মিনিট আবার কয়েক সেকেন্ডও হতে পারে তবে দীর্ঘক্ষণ ধরে স্বপ্ন দেখলে সেটা স্মৃতিতে ভালমত জমা থাকে।। স্বপ্নের ভিতরে যা ঘটে থাকে তার সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হয় কিন্তু তোমার যখন ঘুম ভেংগে যাবে এবং স্বপ্ন নিয়ে যদি একটু চিন্তা করো তাহলেই দেখবে কতটুকু গড়বড় ছিল স্বপ্নে।। এর কারণ হচ্ছে স্বপ্ন দেখার সময় আমাদের ব্রেইনের একটি সেকশন প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স যার সাহায্যে আমরা লজিক্যাল চিন্তাভাবনা করে থাকি সেটি কাজ করেনা। এজন্য স্বপ্ন যতটাই বাস্তবিক মনে হোক না কেন স্বপ্ন দেখার সময় তোমার একটিবারের জন্যেও মনে হবে না তুমি স্বপ্ন দেখছো বরং মনে হবে সেখানেই উপস্থিত আছো আর এর ফলে স্বপ্নের ভেতরকার এনভাইরনমেন্টের সাথে ইন্টারেক্ট করাটা আরো সুবিধাজনক হয়।।

আমি শফিক সাহেবের কথা শুনে যতটা মুগ্ধ উপমা ততটাই মনে হচ্ছে বিরক্ত।। এত কথার ভিড়ে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, ঠিক কোন কাজে এখানে আসা।।

শফিক সাহেব এবার নড়েচড়ে বসলেন- শুনো রায়হান, তোমার কোন এক বন্ধুর কথা বললা মঈন, ওর ব্যাখ্যা ঠিক হতে পারে।। ইনফ্যাক্ট আমার কাছে সেটাই ঠিক মনে হচ্ছে।।

উপমার দিকে তাকিয়ে শফিক সাহেব বললেন- তোমার কি ধারণা উপমা, তোমাকে কি সত্যি শশী বালিশ চাপা দেয় নি।। আর ঘুমের মধ্যে চাপা দিলে ঘুম ভাঙ্গার পর সেটা স্বপ্ন মনে হবার কারণ আছে, এর ব্যাখা হলো, এমন কিছু বাস্তবে হতে পারে তুমি তা কল্পনাও করো নি, তাই ঘুম ভাঙ্গার পর মনে হয় এটা স্বপ্ন।। আর শশী মেয়েটাকে যদিও আমি দেখি নি, মনে হচ্ছে মেয়েটার অনেক জেদ, বা শক্তি আছে।। কারণ রায়হান বললো, এক মেয়ের ভারি কোলবালিশ নাকি তার বুকের উপর রাখা ছিলো।। এখন আমাকে প্রশ্ন করবা মঈন কেনো এমন স্বপ্ন দেখলো।। হ্যাঁ, মঈন কেনো এমন স্বপ্ন দেখলো, তার ব্যাখ্যা দিতেই উপরের এতসব কথা।। মঈন তার মত করে শশীর স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিলেও তার অবচেতন মন শশীর স্বপ্নের ব্যাপারটাই ভাবছিলো বার বার, তাই নিজেই সে এই স্বপ্ন দেখে ফেলেছে।। আর বুকের উপর বালিশ সে নিজেও টেনে নিতে পারে, তুমি কি জানো স্বপ্ন দেখে মানুষ প্যারালাইজড হয়ে যায় অনেক সময়।। শুধু মঈনের ব্যাপারটার জন্য এতসব বাক্য ব্যয়।।

আমি শফিক সাহেবের কথায় সন্তুষ্ট কিনা কে জানে।। কিন্তু উপমার চোখে আমি পূর্ণ সন্তুষ্টি দেখতে পেলাম।। আমিও যেভাবেই হোক একটা ব্যাখ্যা পেয়ে মেনে নিলাম, আর যাই হোক মঈনকে আবার জিজ্ঞেস করা যাবে।।

শফিক সাহেব এখন আমাদের নাস্তা করাবেন।। বার বার মানা করা সত্ত্বেও উনি করাবেন।। তবে একটা কথা উনি আমাকে বলে দিলেন- রায়হান যদি শশীকে বাঁচাতে চাও, তুমি এই মেয়েকে বিয়ে করে নাও, সে এখন সিরিয়াস ইরোটোমোনিয়া ডিজঅর্ডার রোগী, তোমাকে পেলে এটা ঠিক হবার সম্ভবনা প্রবল।। আরেকদিন এসো আমি ইরোটোমোনিয়া নিয়ে বিস্তারিত বলবো।।

এবার উপমার দিকে তাকিয়ে উনি শক্ত মুখে বললেন- উপ মা মণি, যেখান থেকে সরে এসেছো, তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে নিতে পারো।। তাতে একটা মেয়ে বেঁচে যাবে, আর আমার ধারণা তুমিও যথেষ্ট শক্ত হয়ে গেছো।।

উপমা ফ্যালফ্যাল করে শূন্যে কোথাও তাকিয়ে আছে।। আর আমি কি যে ভাববো, তাই ভেবে পাচ্ছিলাম না।।

……………

আমাকে নদীর মাঝে রেখে দুই পাড়েই আশ্রয় দিয়ে বিধাতা অদ্ভুত এক দোটানায় ফেলে দিয়েছেন।। মনের পাল্লা উপমার দিকে ঝুঁকে আছে, কিন্তু বিবেক আর মায়া পড়ে গেছে শশীর দিকে।। এভাবেও হয়তো মানুষ বাঁচে, কিন্তু ভালো থাকে না।। উপমা আমাকে বলেছে, সে অন্তর দিয়ে চায় আমি যেনো শশীকে বিয়ে করি।। কিন্তু তার চোখে ছিলো ভিন্ন দৃশ্যপট।। কে জানে অন্তরের কথা কি কারও চোখে বিপরীত হয়ে ফুটে উঠে, আমি জানি না, জানার ইচ্ছে হচ্ছে না।। জীবনের বাঁকে বাঁকে গল্পগুলো গল্পকারকের সৃষ্টিকেও মাঝেসাজে হার মানায়, গল্পকার সেখান থেকে গল্প টুকে নেয়, মনের মাধুরি মিশিয়ে লিখে ফেলে, এদিকে হয়তো জীবনের সেই গল্পে ঘটতে থাকে আরও নতুন কিছু নাটকীয় ঘটনা।।

সব কিছু স্বাভাবিক, শফিক সাহেবের সাথে দেখা করে এসেছি, আজ দিন দুয়েক হবে।। এই দুই দিন নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করেই যাচ্ছি, কেউ কি আমার হয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে, পারবে বলে তো মনে হচ্ছে না।।

মঈন আমার সাথে দেখা করতে অফিসের নিচে দাঁড়িয়ে আছে, কি যেনো বলার ব্যাকুলতা তার মাঝে।। জিজ্ঞেস করলাম, আবার স্বপ্ন দেখেছে কিনা?? উত্তর দিলো, না দেখে নি, তবে এটা নিয়েই কথা বলবে।। আমার দ্বিধান্বিত মন এখন কারও কথা শুনতে চায় না, কারো ব্যাখ্যায় মন নেই, তবুও বন্ধুর ডাকে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই।।

মঈনের সাথে অফিসের সামনে একটা ছোট্ট ক্যাফেতে বসলাম।। মঈন হুট করে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরলো, আমি অপ্রস্তুত হয়ে মঈনের দিকে চাইলাম।। মঈন বলে উঠলো- তুই শশীকে বিয়ে কর, নয়তো মেয়েটা পাগল হয়ে যাবে।। আমার অনুরোধ, দোস্ত।।

আমি মঈনের এমন অপ্রাসঙ্গিক কথা হজম করতে না পেরে বললাম- মানে কি, তুই আবার এসব বলছিস কেনো?? কি হইছে??

-দোস্ত, সেদিন শশীকে দেখার পর আমার খুব ভালো লেগে যায়, মেয়েটা ভালো লাগার মতই, পরে তোর আইডি ঘেঁটে আমি শশীর আইডি খুঁজে বের করি।। সরি দোস্ত, তুই ভুল বুঝিস না।।

আমি তাকিয়ে আছি, আমার কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে না।। তবুও অস্ফুট কণ্ঠে বললাম- তারপর!!

-পরে আর কি, শশীর সাথে চ্যাট করলাম।। অনেকক্ষণ চ্যাট করে যা বুঝলাম, মেয়েটা নাকি অনেক ছোট বেলা থেকেই তোকে খুব পছন্দ করে, সেটা নাকি এখন বেড়ে পাগলামির পর্যায়।। শেষে তার স্বপ্নের কথা বলতেই, মেয়েটা গরগর করে সব বলে দিলো।।

আমি একটু আগ্রহী হলাম- কি বলে দিলো??

-এই যে সব ও ইচ্ছা করে করেছে, ওইদিন যেসব বললাম, কাহিনী এটাই আসলে।। এখন তুই বলবি আমি আমি তাহলে কিভাবে স্বপ্নে দেখলাম।। আসলে, শশীর অনুরোধে আমি সেদিন মিথ্যা বলছিলাম।। শশীর সাথে আমার ফোনে কথা হচ্ছিলো, তুই তো সেদিন ওকে দুইবার কল দিস, সেসব বললো।। দোস্ত, আমি ভিতরে ভিতরে অনেক ভেবে দেখলাম, হাজার হোক তুই আমার বন্ধু, অনেক ভালো বন্ধু তোর সাথে এমন করা ঠিক হয় নি।। তবে দোস্ত, পারলে মাফ করে দে।। শশীর মধ্যে কোন ভৌতিক ব্যাপার নেই, যেটা আছে তোকে ভালোবেসে সে ভূত সেজে বসে আছে।। ভাই সম্ভব হলে ওকে স্বীকৃতি দে রে।। এমন পাগলী কাউকে পাবি না।। ওকে তুই কাছে টেনে নে, প্লিজ, এই টুকুর জন্যে সে আমাকে দিয়েও মিথ্যে বলাইছে।।

আমি মনে মনে ভাবছি, আমি তো পাগলি কাউকে চাই নি, একটা আগাগোড়া সত্যিকারের ভালোবাসার মানবী চেয়েছিলাম।। শশী পাগলামীর কোন লেভেলে চলে গেছে, আমাকে পাবার জন্যে সে এমন কোন কাজ নাই করছে না।। তবে কি শশীতেই আবদ্ধ হয়ে যাবো, কিন্তু কোন এক ভুলের রাতে মেয়েটা যদি আমাকেই বালিশ চাপা দিয়ে দেয়।। হুট করে মন থেকে, সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে, সব বাদ শশীই থাকুক জীবনে।।

ঠিক এমন সময় উপমার কল পেলাম, মঈনকে থামিয়ে দিয়ে ফোন রিসিভ করলাম-

রায়হান তোমার শশীকে বিয়ে করার দরকার নেই, তুমি যাকে খুশি তাকে বিয়ে করো, কিন্তু শশীকে করার দরকার নাই, প্লিজ!!

-মানে কি, কেনো কি হইছে আবার, শশী কই??

শশী আছে, আসলে একটু আগে শফিক আংকেল কল করে বললো, গতরাতে নাকি স্বপ্নে দেখেছে, কোন এক মেয়ে তাকে বালিশ চাপা দিচ্ছে, মেয়েটা তো মনে হয় শশীই হবে।। প্লিজ এই মেয়ে স্বাভাবিক না রায়হান প্লিজ, তুমি ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দাও, তুমি বেঁচে থাকো প্লিজ।।

দ্বিধা!! দ্বিধা!! দ্বিধা!!

আমার মনে হচ্ছে, এই জগতে আমি ছাড়া আর কেউ দ্বিধায় নেই, শশীর কোন দ্বিধা নেই, সে আমাকে চায়, উপমার কোন দ্বিধা নেই সেও আমাকে চায়, মঈনের কোন দ্বিধা নেই, ও আমাকে শশীর সাথে দেখতে চায়, শফিক সাহেবের চাওয়াটাও এটাই।।

তবে একটা কথা বলে দেই, উপমা মিথ্যে বলছে, শফিক সাহেব কোন স্বপ্ন দেখে নি।। উপমা মিথ্যে বলে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে, যাতে আমি শশীর কাছ থেকে পালিয়ে যাই।। কিন্তু……………...।।

……………

সমাপ্ত!!

Writer:- রাজভী রায়হান শোভন ( Razvi Rayhun Shovon )
 

Delivered by FeedBurner

a