Leave a message
> নামাজে ফেরা
-->

নামাজে ফেরা


নামাজ বাসার সবাই পড়ে,আমিও পড়তে বাধ্য। তাই আমারও পড়া হয় নামাজ। কিন্তু ফরজ ছাড়া সুন্নাত আর নফল পড়ি না কখনো,পড়বই বা কিভাবে ফরজ ই সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি নিয়মিত সেখানে সুন্নাত আর নফল পড়ার তো প্রশ্নই উঠে না!
যখন নামাজ পড়তে যাই এই ঐ কতসব কথা,গান, গালগল্প, মুভি কত কিছু মনে পড়ে যায়। হুটহাট সূরা পড়া বাদ দিয়ে অনেক সময় নিজের অজান্তেই গান বেরিয়ে আসে,তাই বিরক্ত হয়ে গেছি নিজেই।
এমনিতেই নামাজ পড়ি না তারমধ্য যদি এমন হয় তাহলে পাপ বাড়বে বৈ কমবে না।
তাই বাদ দেই নামাজ আবার শুরু করি।
শুধু তাই না, যত দ্রুত সম্ভব নামাজ শেষ করি, আমাকে কে কখন মেসেজ দিল,কি নটিফিকেশন আসল, কে কি রিয়েক্ট করল তা তো জানতে হবে নাকি!
তাই দেহ জায়নামাজে থাকলেও মনটা মোবাইলে ই আঁটকে থাকে। এর মধ্য দরূদ অর্ধেক পড়লাম নাকি পুরোটা এই নিয়ে নামাজের মাঝে দ্বিধা বেঁধে যায়, তখন ভুলেই যাই যে আমি নামাজে আছি।
কখনো দেখা যায় সূরা ফাতেহার পর অন্য সূরা না পড়েই রুকুতে চলে যাই, আবার কখনো সিজদায় গিয়ে দুবার সুবহানা রাব্বি'য়াল আ'লা পড়লাম নাকি তিনবার সে হিসেব ঠিক থাকে না।
কখনো দরূদের মাঝে দোয়া মাসূরা জোড়া দিয়ে দেই মনের ভুলে!
এইভাবেই চলে আমার নামাজ।
তাতে কি? সবাই তো বলে নামাজে নাকি কেউই পূর্ণ মনযোগ দিতে পারে না। তাই আমিও চালাই কোনোমতে নামাজ।
কারণ আমার তো তাড়া আছে ভাই, ফেসবুকে ঢুকতে হবে, টিভি দেখতে হবে, কত গল্প আছে সেগুলো করতে হবে।
তাই যত তাড়াতাড়ি নামাজ পড়ব তত তাড়াতাড়ি আমি এসব করতে পারব।
সেজন্য মোনাজাত ধরার আমার কখনো সময় হয় নি!
কিন্তু সবাই বলে নামাজে নাকি কেঁদে কেঁদে মোনাজাত করলে সব দোয়া কবুল হয়। তাতে আমার কি? কবুল হওয়ার হলে এমনিতেই হবে!
আব্বু সব সময় রাগ করে জন্য নামাজ টা পড়ি, রাগ করে বলে দেয়, "যেদিন আমি নামাজ পড়ব না সেদিন যেন আমাকে খেতে ও না দেয়"। আর এই বুড়ো বয়সেও মার খেতে হয় মায়ের কাছে ঠিক সময়ে নামাজ না পড়ার জন্য! আমার ফোনও কেড়ে নেয়। তাই বাধ্য হয়ে পড়তেই হয়।
আমি এদের বুঝাতে পারি না, আরে নামাজ হলো মনের বিষয়, যেদিন মন চাইবে আজকে নামাজ পড়তেই হবে, মনে আজেবাজে কিছু আসবে না নামাজ পড়ার সময়, সেদিনই নামাজ পড়ে লাভ। এই এত অমনোযোগের মাঝে কেউ নামাজ পড়ে?
.
.
আমি অজু করে আসলাম, মনে নেই মাথা মাসেহ্ করেছি নাকি, এ আর নতুন কি? রোজই এমন হয়। আজও যেমন তেমন করে অজু করে নামাজে যাচ্ছি, ফজর শেষ হতে আর চার কি পাঁচ মিনিট, তাই দ্রুত যেতে হবে। প্রত্যেক দিনের মত আজও আধা ঘন্টা ধরে ডাকতে ডাকতে এখন উঠেছি।
যেই না আকাশের দিকে তাকিয়ে কালেমা শাহাদাত পড়ব, ওমনি দেখি কালো আকাশ হুট করে আগুনের মত হয়ে গেল, আকাশে কিসব যেন বিস্ফোরিত হচ্ছে, মাটি কাঁপছে, আগুন ছিটকে পড়ছে আমার গায়ে।
উফ কি জ্বালা, কি বেদনা!
আমি চিৎকার করছি, ভয়াবহ্ চিৎকার করছি, বাঁচাতে বলছি, কিন্তু মা-বাবা, ভাই বোন কেউই আসছে না ছুটে আমাকে বাঁচাতে!
আমার সামনে ঘর বাড়ি গুলো সব ভেঙে মাটিতে তলিয়ে যাচ্ছে, কি বিকট শব্দ হচ্ছে, আমার খুব ভয় করছে, খুউব!
একটা কুয়োর মত গর্তে আমি পড়ে গেলাম, নিচে পড়েই চলেছি, কে যেন আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেছে, এটা করেছি কেন, সেটা করেছি কেন?
আজব! আমি পড়ে যাচ্ছি কিন্তু আমাকে তুলছে না!
তার উত্তর দিতে না পারায় সে আমাকে বলল কিভাবে সে আমার মাথায় আঘাত করবে সেটা যেন তাকে বলে দেই!
আমি অবাকের সাথে এবার ভয়ও পাচ্ছি, মাথায় মারলে তো আমি মরেই যাব!
কিছু না বলাতে সে দুহাত দিয়ে ঠাস করে মাথায় আঘাত করল যেমন মশা মেরে থেঁতলে দেই আমরা ঠিক সেভাবেই আমারও মাথা থেঁতলে গেল! ইশ কি যন্ত্রনা হচ্ছে আমার, আমি সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করলাম। যখন চোখ খুললাম তখন আমি এক জায়নামাজের ওপর। আমার সামনে অতি নূরের সহিত কেউ একজন আছে, যে নূরের দিকে আমি তাকাতে পর্যন্ত পারছি না, চোখ ব্যাথায় যেন ফেঁটে বের হয়ে আসছে!
আমি বাম পাশে তাকালাম, তাকিয়েই শিউড়ে উঠলাম!
একি! নিচে সম্পূর্ণ আগুন! আগুনের সমুদ্র যেন টগবগ করছে! কি ভয়াবহ্ লাল হয়ে আছে! ভয়ে আমি কুঁকড়ে গেলাম, আবার থরথর করে কাঁপছি, খুব ভয় হচ্ছে আমার।
কে যেন একজন এসে বলে গেল, " তোমার সামনে তোমার রব, মহান অাল্লাহ্ তা'য়ালা আছেন, তুমি তোমার শেষ সালাত আদায় করে নাও, তুমি যদি পূর্ণ মনোযোগের সাথে নামাজ শেষ করতে না পার তবে তোমাকে এই আগুনে নিক্ষেপ করা হবে, আর যদি পড়তে পার তাহলে এই আজাব থেকে তোমাকে মুক্তি দেয়া হবে! যতক্ষণ তুমি নামাজ পড়বে, ততক্ষণ তোমার কোনো ক্ষতি হবে না, তুমি নিচে পড়বে না! এই শেষ সুযোগ, তুমি তোমার রবকে খুশি কর,যদি করতে পার তাহলে বেঁচে যাবে,অন্যথায় ভয়াবহ্ পরিণতি তোমার!"
আমি মুহূর্তেই যেন নিঃশেষ হয়ে গেলাম, এ আমি কি শুনছি!
আমি জায়নামাজে দাঁড়িয়ে আগুনের টগবগানো সমুদ্রের ওপর ভেসে আছি, সামনে আমার রব, আমার আল্লাহ্! কিন্তু এই মুহুর্তে আমি মনযোগ তো দূরের কথা, দাঁড়াতেও পারছি না, মনে হচ্ছে এই পা ফসকে পড়ে গেলাম ঐ ভয়াবহ্ আগুনে।
আমাকে শেষ সাইরেন দেয়া হলো নামাজের জন্য, আমি ভয়ার্ত কন্ঠে বারবার বলছি আমাকে ক্ষমা করুন, আমার ভয় করছে, আমাকে এখান থেকে নামান!
কিন্তু কেউ আমার কথা শুনল না!
আমি নামাজ শুরু করলাম, এ কি! আমার বারবার সূরা গুলিয়ে যাচ্ছে, আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি এই সূরা এখন পড়ব কিন্তু বারবার ভুল করছি!
নাউজুবিল্লাহ্, আমি গান গাচ্ছি সূরার বদলে,আমি রুকু দিতে গিয়ে গল্প বের হচ্ছে মুখ দিয়ে!
আমি চিৎকার করে কাঁদছি আমাকে ক্ষমা করুন, কিন্তু আমার কথার কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না!
আমি চাচ্ছি ধীরেসুস্থে নামাজ টা আদায় করতে, কিন্তু পারছি না, ঠোঁট যেন নিজে নিজেই দ্রুত সূরা উচ্চারণ করছে!
ভীষণ, ভীষণই ভয় হচ্ছে আমার!
আজ কোনো কথা মনে পড়ছে না আমার এই নামাজের সময়, অামি শুধু আল্লাহ্ কে ভয় পাচ্ছি,ভয় পাচ্ছি ঐ আগুনকে!
তবুও আশ্চর্য জনক ভাবে আমি ভুলভাল পড়ছি, খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে নামাজ,আমি চেষ্টা করছি নিজেকে আটকানোর কিন্তু ব্যার্থ হচ্ছি বারংবার!
আমার নামাজ শেষ, সেই সাথে শেষ আমার সময়। আমি আমার আল্লাহ্ কে বারবার ডাকছি, কিন্তু আল্লাহ্ আমার সাথে কোনো কথা না বলেই চলে গেলেন। কেউ আমার দিকে ফিরে তাকাল না, আমাকে বলা হল, আমিই নাকি আল্লাহ্ র সাথে আমার সম্পর্ক শেষ করেছি,তাই আল্লাহ্ নারাজ আমার ওপর!
আমার চোখ দিয়ে অবিরামভাবে পানি পড়ছে কিন্তু আমার নিস্তার নেই,আজ আমাকে ঐ আগুনে নিক্ষেপ করবেই!
আমাকে এও বলা হল, আমি যে কান্না এখন করছি, সে কান্না যদি আমি আগে জায়নামাজে বসে আল্লাহ্ র ওয়াস্তে কাঁদতাম, তাহলে আজকের এই চোখের পানি এই আগুনের সমুদ্রে পড়ে আগুন নিভাতো!
আমার সময় শেষ, আমাকে জায়নামাজ থেকে নিক্ষেপ করা হল ঐ ভয়াল আগুনে, এত উঁচু থেকেও আমার শরীর ঝলসে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছি আমি!
.
.
ধড়ফড় করে লাফ দিয়ে উঠলাম আমি, পুরো শরীর আমার ভিজে গেছে, সারা মুখ ঘেমে গেছে,গলা শুকিয়ে গেছে,সারাগাল চোখের পানিতে ভেসে গেছে!
কই আগুন?
এইতো আমি বিছানায়!অাজান হচ্ছে ফজরের..
তারমানে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম এতক্ষণ! স্বপ্নও এত ভয়াবহ হয়?
আমি চোখের পাতা ফেলতেও ভয় পাচ্ছি, এটা যদি এখনই সত্যি হয়ে যায়!
শ্বাস-প্রশ্বাস দীর্ঘ হয়েছে, এই বুঝি আমার কলিজা দেহ থেকে আলাদা হয়ে যাবে!
এ কি ভয়াবহ স্বপ্ন দেখালেন আমার রব আমাকে?
.
আমি বু্ঝতে পারলাম আমার সব ভুল,আমি উপলদ্ধি করতে পারছি সব কিছু। আমার রব আমাকে শেষ সুযোগটা দিলেন আমাকে তাঁর পথে ফেরার, নামাজে ফেরার!
এতদিনের সব কুকর্মের হিসাব আমি কষলাম, নিজের অজান্তেই নামাজে এত অমনোযোগী হয়েছি, আমি জানতাম নামাজের সময় মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সামনে থাকেন, তাও আমি এত দিন তাঁকে অগ্রাহ্য করে ভুলভাল নামাজ পড়েছি, জগতের সৃষ্টিকর্তার সামনে দাঁড়িয়ে আমি তাকে এতদিন ব্যস্ততা দেখিয়ে এসেছি,নাউজুবিল্লাহ্!
কিসের এত তাড়া ছিল আমার? এ ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াতে আমি এতটাই মগ্ন ছিলাম যে, পাঁচ পাঁচবার মাহান আল্লাহ্ র সাক্ষাতের সময়ও আমি দুনিয়াবি ব্যস্ততায় ডুবে গেছিলাম, আসতাগফিরুল্লাহ্!
আমি নিজ হাতেই এতদিন আমার আর আমার রবের সম্পর্ক নষ্ট করে গেছি!
আমি আমার রব কে পরিপূর্ণ সময় দিতে পারিনি, যে নামাজ বেহেস্তের চাবি, সেই নামাজ নিয়ে এত হ্যালা ফ্যালা করেছি!
আমার আল্লাহ্ আমাকে সাক্ষাতের জন্য ডাকতেন আর আমি কি না কখনো ঘুমিয়ে, কখনো মোবাইলে আর কখনও বা টিভিতে ছিলাম!
আমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু,আমার রবের কাছে মোনাজাতে বসে কিছুই বলি নি, আমার কষ্ট ভাগ করে নেই নি, তাঁর নিকট কোনো হাদিয়া ও চাই নি!
যে নামাজ ফরজ, যার কোনো মাফ নেই, সেই নামাজকে নিজের মনগড়া যুক্তি দিয়ে বলেছি মন থেকে যেদিন আসবে সেদিনই পড়ব, আসতাগফিরুল্লাহ্!
আমি আমার পিতামাতার ভয়ে,তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নামাজ পড়তাম, কিন্তু যে এই জাহান, পরকাল এবং ঐ ভয়ংকর জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন, সেই আল্লাহ্'র কথা আমি ভুলে গেছিলাম, তাঁকে ভয় করাও ভুলে গেছিলাম! আল্লাহ্'র হক এতদিন আমি নষ্ট করেছি, তাঁর ইবাদাত আমি হ্যালায় করেছি! আসতাগফিরুল্লাহ্!
আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি, আর এ ও বুঝতে পারলাম আমার রব আমাকে কত ভালোবাসেন! তাইতো আমার হেদায়াত এর জন্য আমাকে সব কিছুর জানান দিলেন, আবার মনে করিয়ে দিলেন সব! আমি এতদিন যা চেয়েছি, আমার হেদায়াত, সেই হেদায়াত আজ আমি পেয়েছি!
নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমি খাঁশ দিলে আল্লাহ্ তা'য়ালার কাছে ক্ষমা চাইলাম, কৃতজ্ঞতায় আমার বুক ভরে গেল, অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল আমার কপোলে!
.
আমি এখন আর দ্রুত নামাজ পড়ি না, এখন আর বেশি ভুল হয়না আমার। যখন জায়নামাজে দাঁড়াই, মনে করি নিচে যেন আগুনের সমুদ্র। আর সামনে আমার রব আল্লাহ্ সব সময়ই থাকেন, যিনি নিজে আমার নামাজ দেখেন, আমি কত গল্প করি তাঁর সাথে!
আগে আমি শত চেষ্টা করেও যেখানে কাঁদতে পারতাম না, সেখানে এখন নিজের অজান্তেই চোখের জল গড়িয়ে পড়ে, আলহামদুলিল্লাহ্!
অামি ফিরে এসেছি আমার রবের কাছে, ফিরে এসেছি নামাজে!
.
.
লেখা: রূপসীনা খুকু
 

Delivered by FeedBurner

a