Leave a message
> ভীনদেশী তারা - Sad Story - Boipoka365
-->

ভীনদেশী তারা - Sad Story - Boipoka365


এই ছেলেটার মূল সমস্যা হলো তিন বেলাতেই রুটি খায়। রুটি বানাতে গেলে কিযে বিরক্তি লাগে আমার। কপালে ঘাম জমে,নাকের ডগায় ঘাম জমে অথচ সেদিকে তার কোনো চিন্তাই নেই।
আবার রুটি খাওয়ার সময় কেমন গরুর মত চপ চপ শব্দ করে খায়! আমি শব্দ শুনে রাগে জ্বলে যাই। তবুও সে আমার দিকে না তাকিয়ে খেয়েই যায়!
মাঝে মাঝে এই ছেলেটাকে আমি গরু বলি, কারণও আছে। গরুর যেমন দুটো চৌকস শিং থাকে, ওর আছে অন্তহীন দুটো চোখ। ওর অন্তহীন চোখ যখন আমার চোখে পরে, আমার বুকের ভেতর কেমন গর্তের সৃষ্টি হয়! সেই গর্তে আমি একটা ভালোবাসার "বটবৃক্ষ" পুতে দেই। আমার মনে হয় সেই "বট" একদিন প্রকান্ড বড় হবে।
.
আমি, তমা! পড়াশোনা, ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার রানিং।
এইযে সামনে বসে গরুর মত চপ চপ করে রুটি খাচ্ছে, তার পড়াশোনা, মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ার। নাম, রাকিব। আমি মনে মনে তাকে রাখাল বলে ডাকি। এখানেও আমার কষ্ট! এই রাখাল, বাঁশি বাজাতে জানে না।
.
গত তিন বছরে রাকিব ভাই আমার সাথে অপ্রয়োজনে একটা কথাও বলেনি। মাঝে মাঝে রাগে আমার চোখে পানি এসে যায়! তার গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে করে।
কোন প্রশ্ন করলে "হু" "হা" এইটুকুতেই শেষ!
আমার খুব রাগ হয়! আমার সাথে একটু মন খুলে কথা বল্লে তার কি এমন হয়! ভেজা বেড়াল একটা।
.
কিছুদিন পর এক কাক ডাকা ভোরে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই ভোর টা স্পেশাল!
চোখ দুটো কচলাতে কচলাতে ভাবছি, রাকিব ভাই যদি ভোরের কাক হতো। তার জন্য এক প্লেট পান্তা নিয়ে দিতাম। পান্তা গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বলতাম, নে খা এগুলো আমার ভালোবাসার পান্তা। তবুও এমন করে ডাকিস না। আমার কষ্ট হয়! একলা ঘরে থাকতে পারি না!
সে চুপচাপ গাছ থেকে নেমে, টুকটুক করে সবগুলো পান্তা খাবে। আমি কেমন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবো!
.
বাহিরে কারো গরগর কুলি করার শব্দে আমার ঘোর কাটলো। ধুরর, কি ভাবছি এসব!
.
নিজের ঘর গুছিয়ে বাহিরে গেলাম। রাকিব ভাই চোখে পানি দিচ্ছে। তাকে দেখেতে কেমন লাজুক প্রাণীর মত দেখাচ্ছে!
-- পাশের ঘর থেকে খালা ডাক দিয়ে বল্ল, রাকিবের ঘরটা গুছিয়ে আমায় একটু গরম পানি করে দে মা। শরীর টা তেমন ভালো না।
-- আমি বল্লাম, জ্বি খালা... দিচ্ছি।
আমি রাকিব ভাইয়ার ঘরে ঢুকলাম। ওনার ঘরটতে আজ সবকিছু এতো পরিপাটী কি করে হলো! আমি হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। আমার চোখ পড়লো ওনার টেবিলে একটা লাল গোলাপের উপর পাশে একটা ছোট্ট চিরকুট! আমি হ্যাঁ না করতে করতে চিরকুটটা হাতে নিলাম।
.
চিরকুট....
রাকিব, আমাদের ভালোবাসার আজ চারবছর হলো। এই নিয়ে আমার সুখের শেষ নেই। আমার কষ্ট এক যায়গায়, তুমি জানি কেমন অগোছালো হয়ে থাকো। এসব আমার ভাল্লাগে না।
আর হ্যাঁ তোমাদের বাড়িতে একটা মেয়ে থাকে, কি যেন নাম? ওহহ মনে হইছে, নামটা তমা। খবরদার এই তমা মেয়েটার কাছে একদম ঘেঁষবে না। মনে থাকে যেন।
ইতি, তোমার হাসি!
.
আমার চোখ দিয়ে গরগর করে পানি পরতে লাগলো। আমার মনে হলো আমার শরীর জমে যাচ্ছে। শরীর জমে গেলেও হাত পা কাপছে। চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে। সে পানি গাল ছাড়িয়ে বুক অব্দি চলে গেছে।
চিরকুটটা টেবিলে রেখে উরনা দিয়ে মুখ চেপে বেরিয়ে আসি।
চুলোয় গরম পানি বসিয়ে ভাবতে থাকলাম, আসলে এ বাড়িতে আমার অস্তিত্ব টা কি!
.
.
রাকিব ভাই, খালার একমাত্র ছেলে।
আমার যখন ক্লাস এইটের পরীক্ষা শেষ হয়। একটা রোড এক্সিডেন্টে আমার মা মারা যান। বাবা তখন দেশের বাহিরে। মায়ের মৃত্যুতে আমি কেমন নির্বোধ, নির্বাক, নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
আমার খালা আমায় জড়িয়ে বলেছিলো, এইযে আমি তোর আরেকটা মা! আমি এখনো আছিতো।
আমি তার সমস্ত বুকে আমার মাথা গুঁজে দেই। আমার নাকে কেমন "মা" "মা" গন্ধ আসে! সেই গন্ধের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে আমার হেঁচকি উঠা কান্না।
.
-- খালা আবার ডাক দিলো, মা গরম পানি হয়েছে রে?
-- নিজেকে সাভাবিক রেখে গরম পানি নিয়ে খালার পাশে বসলাম।
-- খালা আমায় দেখে বল্ল, শুন মা... এ বাড়িতে অনেক কষ্ট করেছিস। আর কত?
তোর বাবা নাকি তোর জন্য একটা ছেলে ঠিক করেছে। ছেলে জার্মানি থাকে। কিছুদিনের ভেতর তাঁরা তোকে দেখতে আসবে।
-- আমার মনে হচ্ছে আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমার বুক বন্ধ হয়ে গেছে। বুকের ভেতর বাতাস যাচ্ছেনা। আমি শুধু বুঝতে পারছি আমার যন্ত্রণা হচ্ছে অসহ্য যন্ত্রণা!
এ বাড়িতে আরেক যন্ত্রণার নাম হচ্ছে, রাকিবের বাবা। মানে, আমার খালু।
রাকিবের বাবা আজকাল আমার দিকে জানি কেমন করে তাকায়! উনার এমন তাকানো আমার ঘেন্না লাগে। বিষাদময় ঘেন্না!
.
শুনলাম, আমায় নাকি তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। বিয়ের জন্য সব খরচ নাকি তাঁরাই বহন করবে।
তাড়াহুড়ো করেই আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। ছেলে পক্ষের নাকি ব্যাপক তাড়া, বিয়ে করেই আবার জার্মানি ব্যাক করবে। সামনের মাসের সাত তারিখ বিয়ে, হাতে এখনো নয়দিন সময়।
আমার চারপাশের সবকিছু কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে।
এই কদিনে খালার অসুখ ক্রমাগত বেড়েই চল্ল। আমার বিয়ে ঠিক হবার পরদিনই গ্রামের ডাক্তার বাবু বল্লেন, অবস্থা ক্রমশ বিপদজনক হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব খালাকে ইন্ডিয়া নিয়ে যেতে হবে। এই নিয়ে রাকিবের বাবার কোন আগ্রহ দেখালো না। উনার মাঝে খালাকে নিয়ে কেমন ভাবলেশহীন ভাবভঙ্গি।
.
৭ দিনের ভেতরে রাকিব ভাই একাই খালাকে নিয়ে ইন্ডিয়া যাবার সব ব্যাবস্থা করে ফেললেন। আগামীকাল সকালে ট্রেনে করে তাঁরা ইন্ডিয়া যাবেন।
রাতের বেলা আমি সবকিছু গুছিয়ে দিতে লাগলাম।
-- খালা আমার দিকে নিথর চোখে তাকিয়ে বল্ল, প্রকৃতির কি নিয়ম। আমার বাড়ি বিয়ে অথচ আমিই নাই! তুই কোন চিন্তা করিস না মা, তোর খালু একাই বিয়ের সব ব্যবস্থা করতে পারবে।
-- আমি কিছু বল্লাম না, নিরব দাড়িয়ে ব্যাগ গুছানো শেষ করলাম।
.
-কাক ডাকা ভোরে রাকিব ভাই এসে আমার দরজায় করা নাড়লো।
-আমি ঘুম ঘুম চোখে স্তব্ধ হয়ে ভাবলাম, আমার ভোরের কাক বোধহয় আমার কাছে ভালোবাসার পান্তা চাইতে এসেছে। আমি দরজা খুলে দিলাম।
-- রাকিব ভাই অসহায়ের মত আমার হাত ধরে বল্লেন, তমা... তোর কাছে কিছু টাকা হবে?
-- তার হাতের স্পর্শে আমার চোখে পানি এলো। চোখের পানি নিয়ে, বইয়ের ভেতর থেকে ১০টাকার কিছু নোট, ডায়েরির ভেতর থেকে ১০০টাকার কিছু নোট, বালিশের কবার থেকে ৫০০টাকার তিনটা নোট তার হাতে দিলাম।
-- রাকিব ভাই কষ্ট চাপা হাসি দিয়ে বল্ল, তুই অনেক সুখি হবি রে।
-- আমি মূর্তির মতো দাড়িয়ে মনে মনে বল্লাম, তোমার মাথাটা একবার বুকে রাখলে বুঝতে পারতে কি সুখ বইছে ভেতরে!
-- রাকিব ভাইয়ার চোখ পরাজিত সৈনিকের মত কেমন ছলছল করছে, মাঝে মাঝে ঠোঁট কামড়াচ্ছে।
-- আমার কেমন অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হলো। আমি দরজায় কপাট দিলাম। রাকিব ভাই বাহির থেকে কিছু বলতে গিয়েও বল্লো না!


মাসখানেক পর,
শেষ বিকেলে আমার শাশুড়ী ডেকে বল্ল, বউমা... তোমার খালার বাড়ি থেকে চিঠি আসছে।
আমি দৌঁড়ে গিয়ে চিঠিটা আনলাম। চিঠিটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে ভাবলাম, সন্ধার পর আয়োজন করে চিঠিটা পড়বো। আয়োজন শুরু হলো, আমি একটা নতুন শাড়ী পরলাম। ভালো করে সাজলাম। সিলিং ফ্যান টা অফ করে দিলাম। এখন ঘর টা নিরব। আমি চিঠিটা নিয়ে ঘরের মেজেতে বসলাম। দেয়াল হেলান দিলে আয়োজন টা পরিপক্ব হবে। আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে চিঠি খুল্লাম।
.
চিঠি...
জানিস তমা, ইন্ডিয়া থেকে এসে তোর শশুড় বাড়ি গিয়েছিলাম! গিয়ে জানতে পারলাম, তোরা জার্মানি চলে গেছিস।
.
মা এখন পুরোপুরি সুস্থরে। মা তার স্বামীর সাথে কিযে হাসিখুশি থাকে এখন। গভীর রাতে তাদের গুনগুন গল্পের আওয়াজ আসে আমার কানে। আমার কেমন রাগ মিশ্রিত সুখ হয়। জন্মদাতা পিতাকে আমি এখন বাবা বলে ডাকতে পারিনা রে।
.
সেদিন আমার টেবিলে যে গোলাপ দেখেছিলি সেটা তোর জন্যই এনেছিলাম। রাতের বেলা বাজার থেকে ফেরার সময়, তোর পড়ার টেবিলের জানালার সামনে বাবাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কেমন হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। তার একটা হাত লুঙ্গির ভেতর! তার চোখ দেখে মনে হয়েছিলো, চোখ দিয়েই যেন তকে গিলে খাচ্ছে।
আমি গলা খাকড়ি দিয়ে, না দেখার ভান করেই ঘরে প্রবেশ করি। বাবা ভয়ে সেখান থেকে সরে যায়।
সেই রাত আমার একটু ও ঘুম হয়নি রে। টেবিলের চিঠিটাও আমিই লিখেছিলাম। রাতভর ঘরটা পরিপাটি করতে আমার খুব কষ্ট হয়েছিলোরে।
মিথ্য হলেও তকে অন্তত বুঝাতে পেরেছি আমার একটা সুখি সম্পর্ক আছে।
বিশ্বাস কর, তোর বুক ভাংচুরের শব্দ আমার কানে আসতো। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে খুব কাঁদতাম।
অথচ তোরা কেমন পাষাণ! আমার দুঃখ গুলা তোদের চোখেই পরেনি!
তোর বিয়ের ঠিক আগে আগে মায়ের বড় অসুখ হলো। মায়ের অসুখের চিন্তায় সব ভুলে গিয়েছিলাম। তোর শূন্যতার কিযে কষ্ট সেটা ভাবতেই পারিনি।
.
জানিস, কাল রাতে ঘুমের ঔষুধ খুজতে গিয়ে তোর বিয়ের দিনের লেখা চিঠিটা পেয়েছি। আমার নরপিশাচ বাবা নাকি তোকে শেষ রেহাই দেইনি। তুই নাকি ভেতরে ভেতরে মরেই গিয়েছিস। তোর লেখা চিঠিটা আমি আর পড়তেই পারিনি।
.
আমার নরপিশাচ বাবাকে আমি খুন করতে চেয়েছিলাম। মায়ের অমন হাসিমাখা মুখ দেখে আমার সাহস হয়নি রে।
সেদিন মা এসে আমায় বল্ল, আমি নাকি দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছি। আমায় নাকি তাঁরা বিয়ে দেবে!
আচ্ছা, আমার মত অগোছালোকে কে বিয়ে করবে তুই ছাড়া?
তাছাড়া, আমিও না ভেতরে ভেতরে মরে গেছিরে!
জানিস তমা, আমার মনে হয় মৃত্যুর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! এখন শুধু বর সেজে পালকিতে চড়াটা বাকি!
.
তমা শুনবি? বাহিরে কাক ডাকছে! আমার চোখ দুটো কেমন ঝিম ধরে আসলো রে। আজ আর কলম চলছেই না। বর সাজার আগে সময় পেলে আরেকদিন নাহয় লিখব।
ইতি, তোর গরু, তোরই রাখাল!
.
তমা চিঠিটা গুটিয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে মেজেতে বসে রইলো। তার স্বামী বাহির থেকে আসলো সেদিকে তার কোন খেয়ালই নেই।
টেলিফোনটাও বেজেই চলছে সেটাও তমা টের পায়নি।
-- তমার স্বামী টেলিফোন কানে নিয়ে ভীতু সুরে বল্ল, কিহ্... রাকিব ভাই মারা গেছেন? কখন? কিভাবে?
.
কথাটা শুনে মেয়েটা বসা থেকে মুহূর্তেই দাঁড়িয়ে গেলো।
-- তমা উঠে গিয়ে স্বামীর হাত ধরে বল্ল, চলো না যাই। রাকিব ভাইকে একটা নজর দেখে আসি।
-- তমার স্বামী একরাশ বিরক্তি নিয়ে বল্ল, আমরা গেলে উনি জীবিত হয়ে যাবেন নাকি?
.
তমা তার স্বামীর কথায় কেমন শিউরে উঠলো। স্বামীর চোখের দিকে ফেলফেল করে চেয়ে রইলো তমা! তমার কাছে মনে হচ্ছে, তার শিরা-উপশিরা গুলি এখন আর কাপছে না! তার শুধু দুইটা লাইন মনে আসছে।
.
স্বামীর মৃত্যুর চাইতে প্রেমিকের মৃত্যু বেশি ভয়ানক!
স্বামীর লাশে অধিকার থাকে, প্রেমিকের লাশে তা-ও থাকেনা!


লেখাঃ Md Nayeem
 

Delivered by FeedBurner

a