Bangla Love Story |
রাতটা পোহালেই ঈদ। ইফতার করে পত্রিকা নিয়ে বসেছি।হেনা চা দিয়ে গেলো। হঠাৎ খেয়াল করলাম ওর হাতটা খালি। মেহেদির আঁকিবুকি নেই। নখে পেঁয়াজ মসলার কশ লেগে কালচে পড়া। মুখটাও মলিন। মনটা কেমন করে উঠলো। মনে হলো আমি মেয়েটার সাথে বড্ড অবিচার করছি।
আমাদের বিয়ের বয়স সাত বছর।মাস্টার্সের পর বিয়ে করেছি।ও তখন ফাইনাল ইয়ারে পড়ে।সুতরাং এমন কোনো বয়স হয়নি মেয়েটার,যে ঈদে তার কোনো উচ্ছ্বাস থাকবে না।কোনো শখ আহলাদ থাকবে না।
বিয়ের আগেই আমাদের দুজনের ভালো পরিচয় ছিলো।খুব হাসিখুশি আর চনমনে একটা মেয়ে ছিলো হেনা।বিভিন্ন দিবসে সাজগোছ করতো।সাজগোজের প্রতি সবসময়ই একটা ঝোক ছিলো।শাড়ি পরতো সুযোগ পেলেই।মাঝেমধ্যে কাজল দিতো চোখে।
টিএসসিতে চা খেতে খেতে আমি একদিন বলেছিলাম, কাজল পরলে তোমাকে কিশোরী পরীদের মতো লাগে।এরপর দেখতাম প্রায়ই কাজল পরতো।আমি তাকে অনেক নামেই ডাকতাম,তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি ডাকতাম কাজলচোখা বলে।তার আঙুলগুলো ছিলো অদ্ভুত সুন্দর।একবারে লাউ লতিকার ডগার মতো।মেহেদী দিলে কী যে চমৎকার লাগতো!
সেই রূপবতী চঞ্চলা মেয়েটা অভাবের জাঁতাকলে পিষ্ট একটা সংসারের গ্যাড়াকলে পড়ে কেমন চুপসে গেছে!ঈদে মেহেদী দেয়া যে তার একটা সময়ের প্রধান কাজ ছিলো,তা বেমালুম ভুলে গেছে।মেহেদীর বদলে নখে মসলার কালচে দাগ লেগে আছে।
এইসব নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথাইও নেই।তার চিন্তাভাবনার পুরো জায়গাটা জুড়ে আছে,কিভাবে কলেজ মাস্টার স্বামীর সামান্য বেতন দিয়ে পুরো মাস সংসার চালানো যায়।সংসার খরচের টাকা থেকে খুব কায়দা করে দুই পাঁচশো টাকা বাঁচিয়ে জমিয়ে জমিয়ে অসুখ-বিসুখ বা জরুরি মুহূর্তগুলো পার করা যায়।
হেনার পরিবার ছিলো আমাদের চেয়ে বেশ স্বচ্ছল।ও ছিলো বাবা-মা'র একমাত্র মেয়ে।ওর ভাই আছে একজন বড়ো।সুতরাং খুব আদরেই বড়ো হয়েছে।আদুরে মেয়েটাকে বিয়ের আগে আমি বারবার সতর্ক করেছিলাম,বুঝিয়েছিলাম,কিন্তু আমার কথা সে শোনেনি।
আমি বলেছিলাম,কবিরা প্রেম করার জন্য ভালো।জামাই হিসেবে এদের চেয়ে ফালতু ম্যাটেরিয়াল আর হয় না।কিন্তু মেয়েটা কানে তোলেনি।কারণ,সে মনেপ্রাণে আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো।বিশ্বাস করে ফেলেছিলো।সেই ভালোবাসার চড়া মূল্য তাকে আমার সংসারে এসে দিতে হচ্ছে।
তারচেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার এই নিয়ে তারমধ্যে কখনো শোক তাপ দেখি না।আমি অবাক হই।কিন্তু মেয়েটার জন্য কিছু করতে পারি না।
মেয়েটা আমার জন্য তার ক্যারিয়ার নষ্ট করলো।ফিন্যান্সের ছাত্রী ছিলো।খুব ভালো কিছু করতে পারতো।আমার বাবা-মা'র আপত্তিতে সেই সম্ভাবনার শুরুতেই ভেস্তে গেলো।
আমাকে বিয়ে না করলে হয়তো আমার চেয়ে হাজার গুণ ভালো কোনো ছেলের সাথে বিয়ে হতো,তা হলো না।সেই জামাই হয়তো অনেক বড়ো চাকরি করতো।ঢাকায় ফ্লাট থাকতো।গাড়ি থাকতো।ঝলমলে একটা সংসার হতো।
সব সেক্রিফাইস শুধু মেয়েরাই কেন করে?সংসার তো শুধু তাদের একার না,ছেলেদেরও।একটা মেয়ে তার ঘর ছেড়ে,বাবা-মা ছেড়ে,চিরচেনা সংসার ছেড়ে একটা ছেলের হাত ধরে চলে আসে,কিন্তু ছেলেটা কী কী ছাড়ে এই সংসারের জন্য?এতো কিছুর পরও মেয়েটা কি তার প্রপ্য অধিকারটুকু পায় এই সমাজ থেকে?স্বামীর থেকে?স্বামীর বাবা-মা,ভাই-বোন থেকে?
এইসব চিন্তা যখন করছি তখন শুনছি হেনা রান্নাঘরে শিলপাটায় মশলা বাটছে।ঘড়োর ঘড়োর শব্দ হচ্ছে।কাল ঈদ।অনেক রান্নাবান্না।এইজন্য আগে থেকে গুছিয়ে রাখা।
আমি এগিয়ে গেলাম।রান্নাঘরের চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে দেখছি ওর কাজ।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।কী যে সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে!
ইচ্ছে করছে কাঁধে হাত রেখে পেছন থেকে কপালের ঘাম মুছে দেই।কিন্তু অজানা এক দূরত্ব মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে।এই দূরত্বটা একসময় ছিলো না।ধীরে ধীরে জন্মেছে।হেনা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,কিছু লাগবে?গরমে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?আমি বললাম,না কিছু লাগবে না।
ইফতারের আগে বৃষ্টি হয়েছে,রাস্তাঘাট এখনো ভেজা।স্নিগ্ধ একটা পরিবেশ।হাটতে ভালো লাগছে।রোকেয়া হলের সামনে,ক্যাম্পাসে,ফুলার রোডে এইরকম ভেজা পথে কতো হেটেছি দুইজন হাত ধরে একটা সময়!
আমার বাড়ি বাগেরহাটের ফকিরহাট থানার সোনাখালী গ্রামে।বাড়ি থেকে বাজারে যাওয়ার জন্য মোড় পর্যন্ত হেটে যেতে হয়।ওখান থেকে ভ্যান আর ইজিবাইক পাওয়া যায়।আমার বন্ধু মামুনকে ফোন দিলাম,সে এখন বাজারেই আছে।
প্রথমে ওর কাছে যাবো।বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ফোন করে কিছু টাকা ধার চেয়েছি।ও বলেছে যা লাগবে নিয়ে যা কিংবা পাঠিয়ে দিচ্ছি।আমি বলেছি,থাক আমি এসে নিয়ে যাবো।
আমার কলেজের সামনেই একটা ফুলের দোকান।নাম পদ্মকুঞ্জ।দোকানটা এলাকার এক ছোটো ভাই'র।দোকানের নামটা আমারই দেওয়া।একটা বেলি ফুলের মালা নিলাম।বেলি ফুল হেনার খুব পছন্দ।বাজারে গিয়ে একটা নীল শাড়ি আর চব্বিশটা কাচের চুড়ি কিনলাম।ফেরার পথে একটা মেহেদী নিয়ে বাড়ি আসলাম।
বাড়ি ফিরতে প্রায় দশটা বেজে গেলো।রাত দশটা গ্রামে প্রায় নিশুতি রাত।ঘরে ঢুকে এইগুলা হেনার অগোচরে খাটের নিচে লুকিয়ে রাখলাম।ও সম্ভবত মার ঘরে ছিলো।এসে বললো,খেতে এসো,খাবার দিচ্ছি।ও জানে রোজ রাতে আমি মামুনের অফিসে আড্ডা দেই।এইজন্য এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না।
আয়োজন সামান্য।পোড়া পোড়া করে ভাজা আলুভাজি,গুড়ো চিংড়ি দিয়ে কাঁঠালের এঁচোড় আর ডাল।তবে প্রতিটা পদই খেতে খুব ভালো হয়েছে।হেনা বিয়ের আগে তেমন রান্না পারতো না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে মাঝেমধ্যে এটাসেটা রান্না করে নিয়ে আসতো,কখনো ডাকসু,কখনো টিএসসি ক্যাফেটেরিয়া আবার কখনোবা আইইয়ার ক্যাফেটেরিয়ায় বসে খেতাম।বেশি ভালো লাগতো না।বিয়ের পর আমার মা ওকে অনেককিছু রান্না শিখিয়েছে।এখন সে রান্নাবান্নায় মাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
করোনার জন্য বেতন ঠিকমতো পাচ্ছি না।এর প্রভাব পড়েছে সবকিছুতে।ঈদে শুধু বাবাকে পাঞ্জাবি আর মাকে শাড়ি কিনে দিয়েছি।শ্বশুর দুই হাজার টাকা দিয়েছিলেন কিছু কেনার জন্য,সেই টাকা বাজার খরচে চলে গেছে।অভাব বড়ো খারাপ জিনিস।একবার পেয়ে বসছে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে।চিরচেনা পৃথিবীটা বড়ো অচেনা লাগে।
রান্নাঘর গুছিয়ে হেনা ঘরে আসলো এগারোটার কিছু আগে।আমি টেবিলে খাতা কলম রেখে খাটে এসে বসলাম।হেনা আগের চেয়ে আরো রূপবতী হয়েছে।মেয়েরা একটু মোটা হলে তাদের রূপ খুলতে থাকে।ও পাশে বসতে বসতে বললো, এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?আজ আবার কোনো মতলব আছে নাকি?থাকলেও কাজ হবে না।খুব ক্লান্ত।
আমি বললাম,পা তুলে আরাম করে বসো।কিছুক্ষণ গল্প করি।হেনা বললো,ভোরে উঠতে হবে।অনেক কাজ।এখন ঘুমালে হয় না?আমি বললাম না,হয় না।একান্ত কিছু সময় আমরা কেউ কাউকে দিচ্ছি না,এটা ঠিক না।সংসারের এই অভাব একদিন থাকবে না,কিন্তু দূরত্বটা বড়ো হবে।আমি এই দূরত্বটাকে আর বাড়তে দিতে চাই না।হেনা পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বুঝতে চেষ্টা করছে।
আমি তার সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললাম হাত দাও।সে দিলো।টেবিলের উপর থেকে কাগজটা ছিড়ে তার হাতে দিলাম।মাত্র তাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছি-
"আকাশ সমান অবহেলা দিলাম
ভালোবাসার অপরাধে।
বুকের ভেতর অপ্রকৃতস্থ সেই ভালোবাসা
গুমড়ে গুমড়ে কাঁদে।"
হেনা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।তার চোখে কিছুটা অভিমান।এমন কিশোরী অভিমান বহুদিন পর দেখলাম।বহুদিন। বহুদিন।
তাকে বললাম চট করে দুই হাত ধুয়ে এসো।সময় দেড় মিনিট।এরচেয়ে দেরি করলে ভুঁড়ি গালায়ে দিবো।এই কথায় মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে।মনে হচ্ছে তামার একটা বড়ো প্লেটে অনেক উপর থেকে কেউ একজন পাঁচ টাকার অনেকগুলো কয়েন ফেলছে।কয়েনগুলো পড়ে ঝনঝন করে বাজছে।খুব তাড়াতাড়ি সেই শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে না।ঝনঝন করে বেজেই চলেছে।
সে হেসেই যাচ্ছে।আমি বললাম তাড়াতাড়ি যাও।সে বললো কেন?আমি বললাম,আগে যাও তো।ধুয়ে এসো।হাত ধুয়ে এলে তার হাতে মেহেদির টিউপটা দিলাম।আনন্দে মেয়েটার চোখ চকচক করছে।কী যে ভালো লাগছে দেখতে!সে আমার দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,মেহেদী এনেছো এখন লাগিয়ে দাও।আমি বললাম আমি তো পারি না,সে নাছোড়বান্দা,বলে যা পারো তাই দাও।তাকে কাছে টানলাম,বাঁধা দিলো না।অনেকটা গোড়া কাটা গাছের মতো আমার বুকে খসে পড়লো।
এই মেহেদীর ব্যাপারটা বেশ ভালো।পঁচিশ মিনিট পর ধুয়ে ফেলা যায়।ভালো রঙ হয়েছে।ডিজাইন খুব ভালো না হলেও একবারে খারাপ হয়নি।আজ চুক্তি হয়েছে দুজন সারারাত গল্প করে কাটিয়ে দিবো।কেউ ঘুমাবো না রাতে।হেনা খাটে বসে আছে।আমি শাড়ি,চুড়ি আর বেলি ফুলের মালাটা এনে তার হাতে দিয়ে বললাম,কাল পরো।গাড়ো করে কাজল দিও চোখে কাজলচোখা।
জৈষ্ঠ মাস।কুত্তামরা গরম।বৃষ্টির দেখা নেই।জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে।গাছের আম প্রায় সব পেকে গেছে।উঠোনে পাটি পেতে মশার কয়েল জ্বালিয়ে শুয়ে আছি।ঢ্যাঁপ ঢুঁপ করে আম পড়ছে।
হেনার মাথা আমার বুকে।বিয়ের পর তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো আমার বুকে,বাহুতে ঘুমানোর।অনেকদিন ছিলো সেই অভ্যাস।বহুদিন পর আজ আবার সে তার স্পেশাল বালিশে মাথা রেখেছে।
মেয়েটা আস্তেধীরে তার এই অতি প্রিয় কাজটা ছেড়ে দিয়েছে,অথচ আমি খেয়ালই করিনি।বড়ো ছোটলোকি হয়েছে।অভাব জিনিসটা একবার কাউকে ছুঁলে তার আর ছোটোলোকি বড়োলোকি জ্ঞান থাকে না।তবে এই ব্যাপারটা আর বাড়তে দেয়া যায় না।মেয়েটাকে আর দূরে সরে যেতে দিবো না।ভাগ্যোন্নয়নের চেষ্টা করতে হবে।
রাত একটার কিছু বেশি বাজে।পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ।নিঝুম।জোছনা আছে আকাশে।দুইজনে চাঁদের আলো গিলছি।হেনাকে বললাম,কবিতা লেখা কাগজটা এনে আবৃত্তি করো।অনেকদিন শুনিনা তোমার আবৃত্তি।সে বললো,আনতে হবে না।মুখস্থ করে ফেলেছি।
আমার বুকে শুয়ে সে আবৃত্তি করছে-
"আকাশ সমান অবহেলা দিলাম
ভালোবাসার অপরাধে।
বুকের ভেতর অপ্রকৃতস্থ সেই ভালোবাসা
গুমড়ে গুমড়ে কাঁদে।"
মেয়েটার গলা ধরে এসেছে শেষ দুই লাইন পড়তে গিয়ে।কিছুতেই আর স্বাভাবিকভাবে এগোতে পারছে না।আমি ঠিক পেলাম বুকে কয়েক ফোটা পানি পড়েছে।ওর চোখের পানি।কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর শরীর।
আমি হেনার মাথায় হাত রাখলাম।আমার নিজেরো ভীষণ কান্না পাচ্ছে অনেকদিন পর।
মনে মনে বললাম,
"চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে
নিও না নিও না সরায়ে।
জীবন মরন সুখ দুঃখ দিয়ে
বক্ষে ধরিবো জড়ায়ে। "
ফিরতি ট্রেন
( সমাপ্ত )
Writer: S Tarik Bappy