Bangla Sad Story |
ছোটবেলা থেকেই আমি আমার মেঝো চাচাকে তেমন একটা ভালো নজরে দেখতাম না। এর কারণটাও ছিলো খুবই সাধারণ। আমার চাচা তরুণ বয়সে এক মেয়েকে নিয়ে ভেগে গিয়েছিলেন। কিন্তু বেশ কিছুমাস পর আবার সেই মেয়েকেই স্বদিচ্ছায় ডিভোর্স দিয়ে পুনরায় আরেকটি বিয়ে করেছিলেন। লোকমুখে জানতে পারি তিনি যেই মেয়ের সাথে দ্বিতীয় বিয়েতে আবদ্ধ হয়েছিলেন তাঁর সাথে প্রথম মেয়েটিকে ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগেই অবৈধ সম্পর্ক ছিলো। এছাড়াও তাঁর অন্যান্য নারীদের প্রতিও বেশ আসক্তি ছিলো। আর এতসব বিবেচনা করেই তিনি ছিলেন আমার চোখে বিঁধে যাওয়া কাঁটার অনুরূপ।
বাবা মা খুব ভালো করেই জানেন আমি মেঝো চাচাকে তেমন একটা পছন্দ করিনা এমনকি তাঁরাও মনে মনে বিভিন্ন অপকর্মের কারণে তাকে অপছন্দ করতো। তবে ঐ যে ভদ্রতা রক্ষা নামে একটি কথা আছে। মূলত মেঝো চাচার চরিত্র খারাপ হওয়া সত্ত্বেও আমার বাবা মা ছোট ভাই কিংবা দেবরের চোখে দেখার কারণে কখনো তাঁর সামনে এমন কোনো কথা বলতেন না যাতে তিনি কষ্ট পান। আর আমার চাচাটাও ভদ্রতার আড়ালে থাকা এক দুঃশ্চরিত্রবান লোক হওয়া সত্ত্বেও সে আমাদের সামনে ভদ্রতার মুখোশ পরেই চলাফেরা করতো। ফলস্বরূপ তাঁর এই উপরে উপরে ভদ্রতা দেখানোর কারণে আমরাও তাকে উপরে উপরেই ভালো সম্বোধন করতাম।
আমি ঢাকার একটি স্বনামধন্য কোম্পানিতে চাকরী করার দরুন ঢাকাতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে আমার স্ত্রী মিমিকে নিয়ে বাস করি। মিমি আর আমি ব্যতীত আমাদের পরিবারের সবাই গ্রামেই থাকে। ফলে গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে কিংবা ঢাকাতে কোনো বড় ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন হলে সকলেই আমাদের বাসাতে কিছুদিন থেকেই প্রয়োজনীয় কাজ সেড়ে আবার বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু দিনকে দিন আমার নিকট এভাবে সকলের বাসায় আসা যাওয়াটা বেশ বিরক্তিকর লাগতে শুরু করে। কারণ আমার আর মিমির পরিবারের লোকজন বাদেও এমনসব আত্মীয় স্বজন গ্রাম থেকে আমার বাসায় আসে যাদেরকে আমরা কোনো বিপদে পরলেও পাশে পাইনি। কিন্তু এতসব বিরক্তি আমি আমার মহামান্য স্ত্রীর কারণে কখনোই তাঁদের সামনে প্রকাশ করার সাহস পাইনি। আমার স্ত্রী মিমির মতো এতোটা অমায়িক আর পরোপকারী মেয়ে বর্তমান সময়ে আমি খুব কমই দেখেছি। মাঝেমধ্যেই মিমি এসব ঘটনার কারণে আমার বিরক্তিমাখা মুখমন্ডল প্রদর্শন করে বলে,
-শোনো, আমরা যেহেতু শহরে একটা অবলম্বন হিসেবে আছি তাই কেউ যদি বিপদে পরে কিংবা কোনো প্রয়োজনে আমাদের এখানে আসে তবে নিঃস্বার্থভাবে তাঁদেরকে আশ্রয় দেয়া উচিৎ। নয়তো আল্লাহ আমাদের প্রতি অখুশি হবেন।
মিমির এসব কথা শুনে আমি প্রতিউত্তরে কিছু বলার মতো সুযোগ পাইনা। কারণ যেখানে ঘরের রমণী এতোটা নিশ্চিন্ত মনে আশ্রয়দাত্রীর ভূমিকা পালন করছে সেখানে ঘরের কর্তার কিছু বলার থাকেনা কেননা সব কষ্টতো মিমিরই হয়।
সেদিন হঠাৎই আমার বাবা ফোন দিয়ে বলেন যে,
-শোন, তোর বাসায় তোর মেঝো চাচা কিছুদিনের জন্য যাবে ডাক্তার দেখাতে। তুই আবার কিছু বলিস না।
আমি মনের মধ্যে বিরক্তি চেপে বললাম,
-তাঁর সাথে চাচী আসবে নাহ?
-নাহ! বাড়িতে অনেক কাজ পরে আছে তাই যেতে পারবেনা।
বাবার কথায় এবার আমি কিছুটা উত্তেজিত স্বরেই বললাম,
-তুমি জানোইতো যে আমি অফিসে গেলে মিমি একাই বাসায় থাকে তবুও তুমি কিভাবে চাচাকে আমার বাসায় একা আসার অনুমতি চাইছো?
বাবা কিছুটা ধমক দিয়েই বললেন,
-বেয়াদবের মতো কথা বলিস কেন? উনি তোর চাচা সেটা কি তুই ভুলে গেছিস নাকি? উনি কি করবে তোর বউয়ের সাথে?
বাবার এমন প্রশ্ন শুনে আমি নিজেই কিছুটা লজ্জায় পরে গেলাম। তবুও বাবার মুখের উপর আর কিছু না বলে ফোনটি রেখে দিতেই পাশ থেকে মিমি বলে উঠলো,
-কে আসবে?
-ধুর! ভাল্লাগেনা আর। এখন নাকি শালার মেঝো চাচা আমাদের এখানে আসবে। ওর চরিত্র সেই ছোটবেলা থেকেই খারাপ তাই চিন্তা করছি আমি যদি অফিসে থাকি তখনতো তুমি বাড়িতে একাই থাকো...
মিমি আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই কঠিন গলায় বললো,
-তোমার কি সারাদিন এসব আজেবাজে চিন্তাই মাথায় ঘোরাঘুরি করে? উনি আমাদর চাচা লাগে বুঝছো? আর কত মানুষইতো আমাদের এখানে নিজেদের প্রয়োজনে আশ্রয় নিতে আসে। আর এখন যদি নিজের চাচাকে তুমি ফিরিয়ে দাও তাহলে কতটা কথাকথি হবে জানো তুমি?
মিমির কথায় স্বভাবতই আমি চুপ হয়ে গেলাম কারণ একটি কথাও মিমি যুক্তিহীনভাবে বলেনি।
এর ঠিক তিনদিন পরই আমার মেঝো চাচা আমাদের বাসায় আসে। গ্রাম থেকে হাসি হাসি মুখে অনেক ফলমূল, চালডাল কিংবা হাঁস মুরগী নিয়ে আমাদের বাসায় উপস্থিত হলেও আমার সেদিকে একদমই খেয়াল নেই বরং সে যখন মিমির সাথে এসবের বিনিময় করছিলো তখন আমি খুব নিখুঁতভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। তাঁর প্রতিটা হাসিতেই আমি যেন অন্য কিছুর আভাস পাচ্ছিলাম।
আমার স্ত্রী মিমি বেশ ঘটা করেই চাচার জন্য রান্নাবান্না করেছিলো। কারণ একেতো তিনি গ্রাম থেকে অনেক কিছু নিয়ে এসেছিলেন অন্যদিকে তিনি সম্পর্কে আমার আপন চাচা।
অফিসে আসার পর থেকেই আমি মিমিকে কিছুক্ষণ পরপরই কল দিচ্ছি। এমনটা করার কারণ মিমি বেশ বুঝতে পেরেও তেমন কিছু বললোনা। শেষবার যখন কল দিয়েছি তখন মিমি কিছুটা রাগান্বিত স্বরেই বললো,
-আচ্ছা পাঁচমিনিট পরপর এভাবে কল দেওয়ার মানে কি বলোতো? আমার কি আর কোনো কাজ নেই যে আমি সারাদিন তোমার কল রিসিভ করার জন্য বসে থাকবো? এতোই যখন বউকে হারানোর ভয় তাহলে একমাসের ছুটি নিলেইতো পারো। এভাবে বিরক্ত করার কোনো মানে হয়না। রাখি।
এই বলেই মিমি ওপাশ থেকে ধুপ করে কলটি কেঁটে দিলো। মিমির কথায় আমি বেশ কষ্ট পেলাম বটে পরক্ষণেই চিন্তা করলাম আজ আর একটাও কল দিবোনা।
এসব চিন্তা করার পরমুহূর্তেই এমডি স্যারের রুমে আমার ডাক পরলো। সচরাচর কোনো প্রয়োজনীয় কাজ ব্যতীত এমডি স্যার আমাকে ডেকে পাঠান না। তাই কিছুটা কৌতুহল নিয়ে এমডি স্যারের রুমে প্রবেশ করতেই তিনি বললেন,
-বসুন, আপনাকে দুইদিনের জন্য বরিশাল শাখায় যেতে হবে। সেখানের কর্পোরেট শাখা পরিদর্শন করে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আপনি আপতত এখন বাসায় যান, বিকালের গাড়িতেই রওয়ানা দিবেন।
-স্যার, দুইদিন পরে গেলে হয়নাহ?
-না! কোনো উসীলা আমি শুনতে চাইনা। আর এটা অফিসের কোনো ফাইলের কাজ নয় যে আজকে করেননি কিন্তু দুইদিন পর ঠিকই করে ফেলবেন। যান তাড়াতাড়ি।
-জ্বী স্যার!
এমডি স্যারের রুম থেকে বের হয়েই মনে মনে তাকে অজস্র গালি দিতে লাগলাম। এই সময়টিতেই কেন আমাকে বরিশাল পাঠানো লাগবে শা*র?
দুপুরে ঘরে ফিরতেই দেখি আমার চাচাকে মিমি বেশ আয়েশ করে খাওয়াচ্ছে এবং তিনি মিমির রান্নার প্রশংসায়ও পঞ্চমুখ করে ফেলেছেন। মিমিও তাঁর এমন প্রশংসা শুনে বেশি বেশি করে মাছ মাংস তাঁর প্লেটে ঢেলে দিচ্ছেন। বিষয়টা আমার নিকট বেশ বিরক্তিকর লাগলেও কিছু বললামনা। পরক্ষণেই মিমি আমাকে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-একি এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলে যে? আজ কি হাফ টাইম অফিস হয়েছে নাকি?
-না, আসলে আজ বিকালেই আমাকে বরিশাল যেতে হবে অফিসের কাজে। তাই অফিস থেকে আগেবাগেই আমাকে ছুটি দিয়েছে সবকিছু গুছিয়ে রাখার জন্য।
-ওহ। আচ্ছা আমি গুছিয়ে দিচ্ছি সব।
এই বলেই মিমি সেখান থেকে আমাদের বেডরুমে চলে গেলো সবকিছু গুছানোর জন্য। আর এদিকে চাচার দিকে তাকাতেই আমি কেমন যেন একটি রহস্যমাখা হাসির আভা খুঁজে পেলাম। হয়তো তাকে অতি সন্দেহ করার দরুনই এসব দৃশ্য আমার অক্ষিগোলকের দৃষ্টি রেখায় বিচরণ করে।
বিকালে মিমির কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় বললাম,
-সাবধানে থেকো। আর কোনো বিপদের আশংকা করলে আমাকে সাথে সাথে ফোন দিবে।
-আচ্ছা তুমি কি বলোতো? এখনো আমাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছো চাচার জন্য? আরে তোমরা সবাই তাকে শুধু শুধুই খারাপ বলো মূলত সে অতটা খারাপ না। কতটা অমায়িক ভাবে নিজের মেয়ের মতো আমার সাথে ব্যবহার করলো আর তুমি কিনা এখনো এসব আজেবাজে চিন্তা নিয়ে বসে আছো। যাও এখন দেরী হয়ে যাচ্ছে।
মিমির কথার প্রতিউত্তরে আমি কিছু বললাম না ঠিকই তবে আমার মনের বাক্যবিন্যাস ছিলো অন্যরকম। অতঃপর মিমির থেকে বিদায় নিয়ে আমি অফিসের কাজে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। পথিমধ্যে আমি আধঘন্টা পরপরই মিমিকে ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। এভাবে সেদিন রাত কেঁটে গেলেও পরদিন বিকাল থেকে হঠাৎই আমি মিমির নাম্বার বন্ধ পাচ্ছি। সচরাচর চার্জশূণ্য ব্যতীত কখনোই মিমির নাম্বার অফ থাকেনা। কিন্তু এক এক করে একঘন্টা যাবৎ ওর নাম্বারতো বন্ধ থাকার কথা নয়। কারণ মিমি নিশ্চই জানে আমি আধঘন্টা পর পর কল দিবো আর সেকারণে তাঁর ফোনটাও দশমিনিটের মধ্যে অন করার কথা। প্রায় একঘন্টা পার হবার পর আমি আর একমুহূর্ত দেরী না করে হোটেল থেকে বের হয়ে গেলাম। একটি রিকশা নিয়ে আমার বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা দেওয়ার মাঝেও বারবার মিমির নাম্বারে কল দিচ্ছি কিন্তু পূর্বের মতোই বন্ধ দেখাচ্ছে। দশমিনিটের মধ্যে বাড়িতে উপস্থিত হতেই রিকশাওয়ালাকে বিশটাকা দিয়ে অতি তাড়াহুড়ার সহিত আমার ফ্ল্যাটের দরজার সামনে উপস্থিত হতেই ভেতর থেকে কিছু ভাঙ্গচূড়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আস্তে করে নিজের পকেট থেকে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলতেই ভিতরের দৃশ্য দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই হয়েছে। আমার চাচা মিমির সাথে জোরপূর্বক খারাপ কিছু করার চেষ্টা করছে কিন্তু মিমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য ঘরের আসবাবপত্র তাঁর দিকে ছুড়ে দিয়ে উল্টো প্রতিরক্ষার চেষ্টা করছে। আমি আর একমুহূর্ত দেরী না করে পেছন থেকে যেয়েই সাথে থাকা লোহার রডটি দিয়েই সজোরে চাচার মাথায় আঘাত করলাম। মুহূর্তেই সে আর তাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে লুটিয়ে পরলো। পরক্ষণেই মিমি দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে অজস্র ধারায় কাঁদতে লাগলো আর এদিকে আমার হাতও থরথর করে কাঁপছে।
আজ যদি আমি অফিসের কাজে বরিশাল যাওয়ার ফন্দিটা না আঁটতাম তবে মিমি কখনোই আমার চাচার আসল রূপ দেখার সুযোগ পেতোনা। কিন্তু সত্যি সত্যিই যদি আমি অফিসের কাজে বরিশাল যেতাম তাহলে আদৌ কি আমার স্ত্রী নিজেকে এই নরপশুর থেকে রক্ষা করতে পারতো? প্রশ্নটা থেকেই যায়...
কিছু কিছু ফুলের সৌন্দর্য্য দেখে আপনি মুগ্ধ হলেও আপনাকে প্রথমেই ফুলটির সৌন্দর্য্যের কথা না ভেবে এটা বিষাক্ত কিনা সেটা ভাবতে হবে। তবেই প্রকৃত চরিত্রবান কিংবা ফুলকে শনাক্ত করা সম্ভব।
.
( সমাপ্ত )
.
Writer: Misk Al Maruf