Golpo |
ছেলেগুলো কিছু একটি দেখেই ও মা গো বলে আলিফাকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে পালালো। আলিফা ততক্ষণে নিজের কাপড় ঠিক করতে ব্যস্ত। আরেকটু হলেই হয়তো নিজের জীবনের সবথেকে মূল্যবান যে জিনিস অর্থাৎ সতীত্বের মায়াটি হারাতে হতো। ছেলেগুলো কাকে দেখে পালালো তা এখনো ভেবে পাচ্ছেনা আলিফা।
ঝোপের দিকে তাকিয়ে দেখলো একটি সাদা বিড়াল মেও মেও করে ঝোপের মাঝেই ফের হারিয়ে গেলো।
আলিফার আজ বাড়ি ফিরতে বেশ সন্ধ্যা হয়ে যায়। তাদের বাড়িতে যাওয়ার পথে একটি টং দোকান রয়েছে। সেখানে এলাকার বখাটে ছেলেরা আড্ডা দেয় আর মেয়েদের দেখলেই অশ্লীল মন্তব্য ছুড়ে দেয়। আজ আলিফাকে একা পেয়ে ছেলেগুলো নিজেদের সুযোগটি আর মিস করলোনা। টেনে হিচড়ে পাশে থাকা ঝোপের আড়ালে নিয়ে গেল আলিফাকে। অনেকটা চিৎকার আর বাঁচার আকুতি করেও পার পায়নি। কারণ আশেপাশে কোনো বাড়িঘর ছিলোনা আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছিল ছেলেগুলো। শেষ মুহূর্তে যখন একপ্রকার অসহায় হয়েই নিজের সতীত্ব বিলিয়ে দিবে ঠিক তখনি অদ্ভুত কিছু দেখে ছেলেগুলো ভয়ে দৌড়ে পালালো। কিন্তু আলিফা সেদিকে তাকিয়ে তেমন কিছুই দেখতে পেলোনা শুধুমাত্র একটি সাদা বিড়াল ব্যতীত। তবে কী আলিফাকে অদৃশ্য কোন শক্তি বাঁচিয়ে দিয়েছে? এসব ভাবতে ভাবতেই বাড়ি ফিরলো আলিফা। বাড়িতে ফিরেই আলিফা ওর মাকে জড়িয়ে ধরে অজস্র ধারায় কান্না শুরু করে দিলো।
-কী হয়েছে বলবিতো নাকি? এসেই কান্না শুরু করে দিলি। আর তোর শরীরে এতো ধুলোবালি কীসের?
-মা! ঐ টং দোকানের ছেলেগুলো...
এই বলে ফের কান্না শুরু করে দিলো। আলিফার মায়ের বুঝতে বাকি রইলনা যে কী হয়েছে। তাঁর শরীরটাও এক অজানা কারণে ভয়ে কাঁপছে।
-তার মানে তোকে ওরা....
আর বলতে পারলোনা আলিফার মা। মায়ের ভুল ভাঙ্গাতে আলিফা বলে উঠলো,
-না মা কিছু করতে পারেনি।
কথাটি শুনে অনেকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো আলিফার মা। অতঃপর সমস্ত ঘটনা এক এক করে খুলে বললো আলিফা। আলিফার মা শুনে বেশ অবাক হলেও নিজের মেয়েকে সান্ত্বনা দেবার উদ্দেশ্য বললো,
-যাক আল্লাহ ফেরেস্তা পাঠিয়ে তোকে রক্ষা করেছে। দাঁড়া আমি তোর জন্য লোহা পোড়া পানি নিয়ে আসছি।
রাতে অনেকটা নিরিবিলি অবস্থায় আলিফার মা আলিফার বাবাকে সব ঘটনা খুলে বললেন। এই ঘটনা শুনে আলিফার বাবা জাহিদ মিয়া অনেকটা উত্তেজিত হয়ে গেলেন।
-এত্তো বড় সাহস! আমার মেয়ের গায়ে হাত দিছে? সবগুলারে আমি দেইখখা নিমু।
-শোনো তোমার এতো ঝামেলায় জড়ানোর দরকার নেই। শুনেছি ছেলেগুলো অনেক খারাপ, মানুষও নাকি খুন করে। যা হবার হয়েছে, এখন তুমি আলিফার জন্য পাত্র দেখো, একটু ভালো পাত্র হলেই বিয়ে দিয়ে দিবো।
-কী বলো লায়লা? মেয়ের স্বপ্ন পড়ালেখা করে বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াইবো আর তুমি কীনা?
-পড়ালেখা শ্বশুর বাড়িতেও করা যায়। আগে মেয়ের নিরাপত্তা তারপর পড়ালেখা।
আলিফার মায়ের কথায় অনেকটা হার মেনেই ফেললেন জাহিদ মিয়া। একমাত্র মেয়েকে তিনি খুব ভালোবাসেন কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার দিকে তাকিয়ে নিজেও ক্ষানিকটা নুইয়ে পরলেন।
-আচ্ছা দেখো আলিফা কী বলে। মেয়ের মতের বাহিরে তো আর বিয়ে দেওয়া যাবেনা। তাইনাহ?
-ও যা বলার বলুক। ওর কথা শোনার দরকার নেই। তুমি পাত্রের খোঁজ করো।
দুদিন পর...
আলিফা ওর মায়ের আদেশে এই দুদিন বাড়ির বাহিরে বের হয়নি। ভার্সিটিতে ক্লাস করার অনেক ইচ্ছা থাকলেও নিজের কাছেও মনে হচ্ছিল কদিন না যাওয়াটি ভালো। এমনিতেও মানসিকভাবে অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে সেদিনকার ঘটনার কারণে।
আজ হঠাৎ আলিফার মা এসে বললেন,
-সেজেগুজে রেডি হ। একটু পর তোকে দেখতে আসবে ছেলেপক্ষ।
আলিফা মায়ের কথা শুনে অনেকটা হতভম্ব হয়ে জবাব দিলো,
-মানে কী মা? আমাকে না জানিয়েই বলছো পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে? আর তুমিতো জানোই আমি পড়ালেখা...
আলিফাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি বললেন,
-পড়ালেখা যথেষ্ট হয়েছে। শ্বশুর বাড়িতে যেয়েও পড়ালেখা করতে পারবি। আর কোনো কথা নয়।
-না মা আমি বিয়ে করবোনা।
বলতে দেরী কিন্তু চড় মারতে দেরী করলেন না আলিফার মা। চড় খেয়ে চুপ মেরে গেল আলিফা। বাবার নিকট যেয়েও আলিফা তেমন আশানুরূপ বক্তব্য শুনতে পেলো না।
-মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। এখন ওদের আলাদা হয়ে কিছু কথা বলার সুযোগতো দেওয়া উচিৎ তাইনাহ?
ছেলের মায়ের কথা শুনে আলিফার মা বললেন,
-নাহ! আলাদা আর কী কথা বলবে?
-নাহ! তবুও ওদের বোঝাপড়ার একটি বিষয় রয়েছে।
ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে আলিফা ও সেই ছেলেটি। কারও মুখেই কোনো টু শব্দ নেই। নীরবতা ভেঙ্গে আলিফা বলে উঠলো,
-শুনেন! আমাকে বিয়ের পূর্বে দুমাস সময় দিতে হবে। হুটহাট আপনার সম্পর্কে না জেনেই আমি বিয়ে করতে পারবোনা। বুঝছেন?
ছেলেটির উত্তরের আশায় ছেলেটির দিকে ঘুরে তাকালো। হঠাৎই আলিফার হাত পা কাঁপতে শুরু করলো অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু একটি দেখে। ছেলেটি আলিফার কথার জবাবে বললো,
-হ্যাঁ তা তো অবশ্যই। আমিও এটাই বলবো ভেবেছিলাম। আপনি আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছেন কেন বলুনতো?
আলিফার মুখ দিয়ে এখনো কোনো কথা বেরোচ্ছে না শুধু ভয়ে কাঁপছে। কিন্তু ছেলেটিকে দেখে নয় বরং ছেলেটির ঠিক পিছনে সেদিনকার সেই সাদা বিড়ালটি দেখে। এটি সাধারণ কোনো বিড়াল হলেও কথা ছিল কিন্তু না। বিড়ালটির চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। হঠাৎই এক চিৎকার দিয়ে আলিফা অজ্ঞান হয়ে ছাদের মেঝেতে পরে গেলো। মাহিন আলিফার আকস্মাৎ ভয় পাওয়া আর অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে নিজেও ক্ষানিকটা হতভম্ব হয়ে গেলো। তৎক্ষনাৎই আলিফার চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে আসলেন। মূল ঘটনা জানতে মাহিনকে সবাই জেরা করতে শুরু করলো। মাহিনের নিজেকে আজ খুব ছোট মনে হচ্ছে। আলিফার মা লায়লা বেগম আলিফার মুখে পানি ছিটাতেই আলিফার জ্ঞান ফিরলো। অনেকটা ভয়ার্ত মুখে আলিফা তার মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো।
-কী হয়েছে মা? ভয় পেয়েছিস কেন?
-মা! ঐদিনের সেই বিড়ালটা...
আলিফার মা বিষয়টি বুঝতে পেরে বললেন,
-আরে ওসব তোর চোখের ভুল। কী না কী দেখেছিস আর ওমনি ছেলেটির সামনে অজ্ঞান হয়ে গেলি? তাঁরা কী ভেবেছে বলতো!
আলিফা মনে মনে ভাবছে, জানি তোমরা বিশ্বাস করবেনা কিন্তু ঐজায়গাতে তুমি থাকলে ঠিকই বুঝতে।
রাত ১০টা...
হঠাৎই আলিফার ফোনটি বেজে উঠলো।
-হ্যালো! কে?
-এভাবে কেউ অভ্যর্থনা না জানিয়ে জিজ্ঞেস করে?
আলিফার বুঝতে বাকি রইল না কে কল দিয়েছে?
-ও আচ্ছা আপনি! আর সকালের বিষয়টির জন্য আমি দুঃখিত। আসলে...
-হ্যাঁ শুনেছি। বিড়াল দেখে ভয় পেয়েছিলেন।
অনেকটা লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে আলিফা বললো,
-আসলে বিষয়টি ওরকম না...
এভাবেই অনেকক্ষণ যাবৎ কথা বলতে বলতে আলিফা একপ্রকার মাহিনের কথার প্রেমেই পরে গেলো। মাহিন এমনিতেও বেশ সুদর্শন আর কথার দিক দিয়েও যে যেকোনো মেয়েকে ঘায়েল করতে পারে সেটা আলিফা বেশ বুঝতে পারছে। এভাবেই কিছুদিন কথা হয় দুজনের মাঝে। বোঝাই যাচ্ছে দুজনই দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিছুদিন পর আলিফা মাহিনকে বললো,
-আমার একটি আবদার রাখবেন?
-অবশ্যই! কেন নয়? বলো তুমি।
-না মানে। বাবা মা তো চাইছে না যে আমি বিয়ের আগে আর পড়ালেখা করি। কিন্তু আমি খুব মিস করছি ভার্সিটির বান্ধুবী দের। আপনি যদি মাকে বলে...
-হ্যাঁ বুঝেছি। তুমি কাল থেকেই ভার্সিটিতে যাবে। আমি আন্টিকে ফোন দিয়ে বলে দিচ্ছি।
-থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। উম্মাহ।
-এটা কী?
-না মানে!
লজ্জায় আলিফা কলটি কেঁটে দিলো। ওর কেন যেন আজ খুব খুশি খুশি লাগছে। আলিফার মা লায়লা বেগম অনিচ্ছাসত্ত্বেও হবু জামাইয়ের কথায় আলিফাকে ভার্সিটিতে যাবার অনুমতি দিলেন।
আজ ভার্সিটিতে এসে আলিফার নিকট মনে হচ্ছে যেন বন্দি কারাগার থেকে অনেকদিন পর মুক্ত বাতাসের ছোয়া পেলো। ক্লাসে এসে বরাবরের মতোই বন্ধু বান্ধবীদের সাথে সেই বিগত দিনের মতোই হাসি ঠাট্টা আর মজা। হঠাৎই চোখ গেলো ক্লাসের কর্নারের বেঞ্চটির দিকে। ছেলেটি আলিফার দিকে একনজরে তাকিয়ে রয়েছে। আলিফা বেশ সুন্দরী হওয়ায় অনেক ছেলেই ওর দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু ছেলেটির চাহুনিটা কীরকম যেন অদ্ভুত। আলিফার মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে তাই ওর বেষ্টফ্রেন্ড সোনিয়াকে বললো,
-আমার মাথাটা ঘুরছে। একটু ওয়াশরুমে চলতো আমার সাথে।
সোনিয়া আলিফাকে নিয়ে ওয়াশরুমে যেয়ে মাথায় পানি দিয়ে দিলো। আলিফা অনেকটা কৌতুহলবসত সোনিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
-আচ্ছা দোস্ত! শেষ বেঞ্চের কর্নারের ছেলেটিকে দেখেছিস?
-কার কথা বলছিস? ঐযে ক্লাসে চুপচাপ থাকে ঐটা?
-হ্যাঁ হ্যাঁ।
-হুম কেন?
-না মানে আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলো। তারপরই মাথা ঘোরাটা শুরু হয়েছে।
-কী বলিস কত ছেলেইতো তোর দিকে তাকায়। এমনিতেও ছেলেটি অদ্ভুত। তুই যেদিন থেকে কলেজে আসিস না সেদিনের পর ছেলেটিকেও আর দেখিনি। আর আজ তুই আসলি ছেলেটিও আসলো। ডাল মে কুচ কালা হে।
সোনিয়ার কথা শুনে বেশ অবাক হলো আলিফা। ও যে আজ ভার্সিটিতে আসবে সেটাতো কাউকে বলেনি, তাহলে? নাকি ছেলেটি এমনিতেই এসেছে আজ?
-আর শোন! ছেলেটির ব্যাগে একটি সাদা বিড়াল দেখেছিলাম। খুব কিউট। ব্যাগের ভিতরে আটকে রাখে। একদিন ছুটির সময় আমি দেখেছিলাম ব্যাগ থেকে বের করতে।
-মানে? কী বলিস? সাদা বিড়াল?
সোনিয়ার সাথে অনেক কথা বলে বাড়ি ফিরলো আলিফা। যদিও ওর সাথে ঘট| অদ্ভুত ঘটনার কিছুই বলেনি।
রাতে আলিফা শুয়ে শুয়ে ভাবছে, নিশ্চই আমার সাথে যেই ভৌতিক ঘটনা ঘটেছে তার সাথে কোনো একটি কিছুর যোগসূত্র রয়েছে। এসব ভাবছিলো ঠিক তখনি আলিফার নাম ধরে কেউ ডেকে উঠলো। ভেবে পাচ্ছে না যে এতো রাতে ওকে কেইবা ডাকতে পারে। বাবা মাও তো নিজেদের ঘরে ঘুমোচ্ছে। ডাক দেওয়ার উৎস খুঁজতে খাঁট থেকে মেঝেতে নেমেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখে আলিফার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। এ কীভাবে সম্ভব? একটি বিড়াল আলিফাকে ঠিক মানুষের মতোই ডাকছে... অবিশ্বাস্য।
.
[To be continued]
.
Writer: Misk Al Maruf