Golpo |
ডাক দেওয়ার উৎস খুঁজতে খাঁট থেকে মেঝেতে পা রাখতেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখে আলিফার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। এ কীভাবে সম্ভব? একটি বিড়াল আলিফাকে ঠিক মানুষের মতোই ডাকছে। অবিশ্বাস্য কিন্তু তার থেকেও ভয়ানক বিষয় হচ্ছে বিড়ালটির চোখ দুটো আগুনের মতো ঝলঝল করছে। আলিফা এক চিৎকার দিয়ে সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পরে গেলো। এদিকে আলিফার বাবা মা আলিফার চিৎকার শুনে নিজেদের রুম থেকে এসে আলিফাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে তারাও কিঞ্চিত ভয় পেয়ে গেলো। কারণ এমনিতেও এটা সুখকর কিছু নয় যে মেয়ে বারবার খারাপ স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে। সৌরভপূর্ণ সকালে পাখির কলকাকলী শুনে আলিফার ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ খুলতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো মায়ের মমতাময়ী কোলে। মাথাটা উঠানোর চেষ্টা করেও সফল হলোনা, কারণ মাথাটা অত্যন্ত ভারী হয়ে রয়েছে বোধহয় কেউ মাথায় দশ কেজি ওজনের বস্তা বেঁধে দিয়েছে।
-থাক মা ওঠার দরকার নেই শুয়ে থাক। কাল রাতে কী হয়েছে বলতো।
হঠাৎই মায়ের প্রশ্ন শুনে গতকাল রাতের সেই ভয়ানক দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো আলিফার। আলিফা ভাবছে, এই ভয়ঙ্কর ঘটনা বাবা মা কে বললে তারা কখনোই বিশ্বাস করবেন না উল্টো খারাপ স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিবেন।
-কী হলো বলছিস না কেন?
-তুমি বিশ্বাস করবে মা?
-বিশ্বাস কেন করবোনা? আর বারবার কীসব দেখে যে ভয় পাস এটাওতো ভালো লক্ষ্মন না।
অতঃপর আলিফা তার মাকে গতকাল রাতের সম্পূর্ণ ঘটনা এক এক করে খুলে বললো। আলিফার মুখে ফের একই ঘটনা শুনে এবার তিনি বিষয়টি উড়িয়ে দিতে পারলেন না। বেশ চিন্তায় পরে গেলেন যদিও তিনি এসব ভৌতিক বিষয়গুলো বিশ্বাস করেন না তেমন। আজ আলিফা ভার্সিটিতে এসে তেমন একটা মজা করলোনা বন্ধু বান্ধবীদের সাথে। এক অন্যরকম আলিফাকে দেখে সবাই বেশ অবাক হলো। কারণ সচরাচর ও ক্লাসে এতোটা চুপচাপ থাকে না। নিজেদের সন্দেহ ভাঙ্গাতে আলিফার বেষ্টফ্রেন্ড তমা জিজ্ঞেস করলো,
-কীরে আজ তুই এতো চুপচাপ কেন? কাল রাতে কী দুলাভাইয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি?
এই বলেই সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। আর আলিফা মুখে ক্ষানিকটা বিরক্তিভাব নিয়ে বললো,
-আরে সবকিছুতে মজা ভালো লাগেনা।
তমা বুঝতে পারলো বিষয়টা সিরিয়াস, তাই অনেকটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
-কী হয়েছে একটু স্পষ্ট করে বলতো?
-কিছুনা। আমি আসি আজ। ক্লাস করবোনা।
এই বলেই ক্লাস ছেড়ে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পরলো। আলিফার আজকে ভার্সিটিতে আসার মূল উদ্দেশ্যই ছিল শেষ বেঞ্চের সেই অদ্ভুদ ছেলেটির সম্পর্কে কিছু জানা। কিন্তু ছেলেটি এক অজানা কারণে ভার্সিটিতে আসেনি। কেনো আসেনি সেই বিষয়টি আলিফাকে বেশ করেই ভাবাচ্ছে। পরক্ষণেই চিন্তা করলো, ধুর। শুধু শুধু কীসের মধ্যে কী মিলাচ্ছি? ছেলেটি আসেনি তাতে আমার কী? এসব ভাবতে ভাবতেই সবুজ শ্যামলে ঘেরা ভার্সিটি ক্যাম্পাস দিয়ে হাঁটছিল সে। এই সময়টিতে ক্যাম্পাসে কোনো ছেলেমেয়ে থাকে না কারণ সবাই প্রায় ক্লাস করায় ব্যস্ত। হঠাৎই আলিফা থমকে দাঁড়ালো, হ্যাঁ যেই ছেলেটিকে ও খুঁজছে সেই ছেলেটিই ক্যাম্পাসের বিশাল বঁটগাছের নিচে পেতে রাখা বেঞ্চটির উপরে বসে আছে। কিন্তু তার থেকেও অবাক করা বিষয়টি হচ্ছে ছেলেটির হাতে একটি সাদা বিড়াল আর ছেলেটি বিড়ালটির সাথে কী যেন বিড়বিড় করে বলছে। এহেন দৃশ্য দেখে আলিফার শরীরের রক্তে এক হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলো। আলিফা এখনো ভেবে পাচ্ছে না যে ও কী ছেলেটির সামনে যেয়ে আগবাড়িয়ে কথা বলবে নাকি এই মুহূর্তেই স্থান ত্যাগ করবে? অনেক চিন্তা ভাবনার পর স্থির করলো যত ভয়ই আমাকে পিছু হটতে বাধ্য করুক না কেন আমি ছেলেটির সাথে আগবাড়িয়েই কথা বলবো। ধীর পায়ে এগিয়ে চললো ছেলেটির দিকে অনেকটা ভয়কে জয় করার মতোই সাহস নিয়ে। ছেলেটির সামনে যে আলিফা দাঁড়িয়ে রয়েছে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই ছেলেটির। অনেকটা জড়তা ভেঙ্গে আলিফা জিজ্ঞেস করলো,
-এখানে বসে আছেন কেন? আজ ক্লাস করেননি?
আলিফার দিকে না তাকিয়ে অনেকটা সাবলীল ভঙ্গিতে ছেলেটি জবাব দিলো,
-নাহ আমি ক্লাস করে কারো মাথা ব্যাথার কারণ হতে চাইনা। আর তাছাড়া আজ আমার বন্ধুকে নিয়ে সময় কাঁটানোর দিন।
আলিফা এবার ছেলেটির কথায় সত্যিই অবাক হলো। কাল যে ওর মাথা ব্যাথা হয়েছিল সেটা কীভাবে জানলো? অনেকটা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-হুম বুঝলাম। কিন্তু আপনিতো একা বসে আছেন বন্ধু কোথায়?
ছেলেটি বিড়ালটিকে হালকা আদর করে বললো,
-এই যে আমার বন্ধু।
-ও আচ্ছা! আপনার বিড়ালটা আই মিন বন্ধুটা খুব কিউট।
-ধন্যবাদ। তবে ও কিন্তু মানুষকে ভয় দেখাতেও ভালোবাসে যেমনটা কাল রাত্রে আপনাকে ভয় দেখালো।
ছেলেটির কথা শুনে আলিফার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করলো। কী বলছে এসব ছেলেটি? তার মানে গতকাল রাত্রে আলিফার নাম ধরে যেই বিড়ালটি ঢেকেছিলো সেটাই কী এটি? আর ছেলেটিই বা জানলো কীভাবে গতকাল রাত্রে আমার সাথে কী ঘটেছে? আলিফা আর কিছুই ভাবতে পারছে না। ওর মনে হচ্ছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা আর এ্যাভারেষ্টের উচ্চস্তরে দাঁড়িয়ে থাকাটা সমপর্যায়েরই কঠিন কর্ম বটে। ছেলেটি আলিফার এরকম ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখে মুখে এক উজ্জ্বল হাসি ফুটিয়ে বললো,
-ভয় পাবেন না। ও আপনাকে ভয় দেখাতে চায়নি কিন্তু আপনি না বুঝেই ভয় পেয়েছিলেন। ও আপনাকে খুব পছন্দ করেতো তাই আপনার পিছু ছাড়তে চায়না।
ছেলেটির কথা শুনে বিড়ালটি আকস্মাৎ এক চিকন কন্ঠে বলে উঠলো,
-মিথ্যা কেন বলো? তুমি তাকে ভালোবাসো সেটা বললেইতো হয়।
এমন অলৌকিক আর অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখে আলিফা আর একমুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালোনা। দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লাসের দরজা দিয়ে ঢুকেই অজ্ঞান হয়ে পরে গেল। আকস্মিক আলিফা এভাবে ঢুকে অজ্ঞান হয়ে পরে যাওয়াতে বাকি সব ছাত্র ছাত্রীরা বেশ অবাক হয়ে দৌড়ে এসে আলিফাকে মেঝে থেকে উঠিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগলো। তৎক্ষনাৎই একটি ছেলে ডিপার্টমেন্টের প্রধান শিক্ষককে ডেকে নিয়ে আসলেন। তিনি এক মুহূর্ত দেরী না করে ডাক্তারকে নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করলেন এবং সেই মুহূর্তেই আলিফার বাবাকে কল দিলেন। বিকালের এই সময়টিতে আলিফা পুকুরের পারে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে প্রতিদিনই মনের সুখে গান করে। কিন্তু আজ শূণ্য বেঞ্চটি আলিফাকে খুব মিস করছে। কারণ জ্বরটা যেন কিছুতেই কমছে না আলিফার। লায়লা বেগম বারবার মাথায় পানিতে ভেজানো ছোট্ট তোয়ালেটা লাগিয়ে দিচ্ছেন আর বারংবারই মাথা থেকে উত্তাপ হাওয়া বেরোচ্ছে। তিনি বিষয়টি বুঝতে পেরে কোনো কিছু গোপন না করে আলিফার বাবা এর নিকট অতীতের সমস্ত ঘটে যাওয়া ঘটনা এক এক করে খুলে বললেন। আলিফার বাবা তার স্ত্রীর মুখে মেয়ের সাথে বারংবার ঘটা ভৌতিক ঘটনা শুনে নিজেও ক্ষানিকটা চিন্তায় পরে গেলেন,
-আচ্ছা দেখি কী করা যায়? তুমি আলিফার সাথে থেকো সমসময়। ভুলেও ওকে একা ছাড়বেনা কিন্তু।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
এই ঘটনার প্রায় দশদিন পার হয়ে গেলো...
আলিফা এখন নিজ ইচ্ছাতেই ভার্সিটিতে যায়না উক্ত ঘটনার পর থেকে। এ কদিনে তেমন কোনো ভৌতিক ঘটনা ঘটেনি আর সেদিনকার ছেলেটির ঘটনাও কাউকেই বলেনি আলিফা। এদিকে আলিফা তার হবু স্বামী মাহিনের সাথেও প্রতিনিয়তই কথা বলে। আলিফার নিকট এখন মনে হয় মাহিন ব্যতীত তার পুরো জীবনটাই হয়তো বৃথা। কারণ আলিফার হৃদয়ে এখন শুধু মাহিনের অস্তিত্বই বিরাজমান।
-আচ্ছা বাবু। তুমি কী সত্যিই বিয়ে করবে? আমিতো ক্ষমা চেয়েছি আমার ভুলের কারণে। এই দেখো কান ধরেছি।
-শোনো রিয়া। আমি বিয়ে করছি এটাই ফিক্সড। আর একমাস পরেই আমার আর আলিফার বিয়ে। তুমি এখন তোমার পথ দেখো।
-প্লিজ! এই দেখো তোমার হাত ছুয়ে কথা দিলাম, আর কখনো কোনো ছেলের সাথে কথাই বলবো না আর ঘুরতে যাওয়াতো অনেক দূরের কথা।
-সরি! তুমি দেরী করে ফেলেছো। আমি আমার সিদ্ধান্তেই অটল। তুমি যা করার করতে পারো।
-মাহিন, শেষবারের মতো বলছি তুমি কী বিয়ে ভাঙ্গবে না?
-না।
মাহিনের মুখোশ্রবন থেকে নাবোধক শব্দ শুনে রেষ্টুরেন্টের টেবিলে থাকা ছুরিটা নিয়ে সরাসরি নিজ হস্ত বরাবর এক টান দিলো। রিয়ার এহেন উদ্ভট কান্ড দেখে মাহিন হতভম্ব হয়ে গেলো। পকেটে থাকা রুমালটি নিয়ে তৎক্ষনাৎ রিয়ার হাতটি বেঁধে ফেললো কিন্তু রক্তের প্রবাহ যেন কোনো ক্রমেই থামছে না। তাই একমুহূর্ত দেরী না করে রিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে সাথে সাথেই হসপিটালে ছুটলো মাহিন।
বিয়ের আর মাত্র দশ দিন বাকি...
মাহিন ভেবে পাচ্ছেনা যে আলিফাকে কী বলে বিয়েটা ভাঙ্গবে? এদিকে জাহিদ মিয়া একমাত্র মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতি আগেবাগেই শুরু করে দিয়েছেন। ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা তুলে বাড়ি ফিরছেন। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে কোনো কিছুরই ঘাটতি রাখতে চান না তিনি। অতি সাবধানতার সহিত টাকা নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, কেননা এই টাকাগুলো তাঁর সারাজীবনের একমাত্র সঞ্চয়। হঠাৎই দুজন কালো মুখোশ পরিহিত লোক জাহিদ মিয়ার সামনে দেশীয় অস্ত্রসজ্জ নিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
-জীবন নিয়া বাড়ি ফিরতে চাইলে টাকা গুলা দিয়া দে।
আকস্মিক ছিনতাইকারীর কবলে পরে অনেকটা ভয় পেয়ে গেলেন জাহিদ মিয়া। কিন্তু শেষ রক্ষাটা আর হলোনা তাঁর। অনেক ধস্তাধস্তি আর আঘাতের মাধ্যমে জাহিদ মিয়ার থেকে টাকা গুলো ছিনিয়ে নিলো ছিনতাইকারীর দল। রাস্তার মানুষগুলোর চেয়ে চেয়ে দেখা ব্যতীত আর কোনো উপায়ই ছিলনা। আলিফার বাড়িতে এখন শুধুই শোকের ছায়া। আলিফার বাবা মা কোনোভাবেই শোক কাঁটিয়ে উঠতে পারছেন না। জীবনের কষ্টার্জিত সঞ্চয় যে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে হারাতে হবে তা তাদের ভাবনাতেই ছিলোনা।
গভীর রাত....
জাহিদ মিয়া কীভাবে মেয়ের বিয়ে দিবেন এই চিন্তায় ঘুমাতেই পারছেন না। লায়লা বেগম শোকে শোকে কোনসময় যে ঘুমিয়ে পরেছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। হঠাৎই আলিফার বাবা কিছু একটির শব্দে চিন্তাদেশ থেকে বাস্তবে ফিরলেন। শোয়া অবস্থা থেকে বসেই তিনি চমকে উঠলেন। একটি সাদা বিড়াল একটি পলিথিনের পোটলা নিয়ে মেঝেতে বসে রয়েছে। তিনি এহেন দৃশ্য দেখে হুঁশ বলে ধমক দিয়ে বিড়ালটিকে তাড়িয়ে দিলেন। বিড়ালটি চলে গেলেও মেঝে থেকে পলিথিনের পোটলাটি নিয়ে গেলোনা। তিনি অনেকটা বিরক্ত হয়ে যেই পলিথিনের পোটলাটি ধরে ফেলে দিতে যাবেন তখন পলিথিনের ভিতরের দৃশ্য দেখে অবাক হবার চূড়ান্ত সীমায় পৌছে গেলেন।
একি! পলিথিনভর্তিতো টাকার বান্ডেল। এ কীভাবে সম্ভব? অবিশ্বাস্য.....
.
[To be continued]
Writer: Misk Al Maruf