Golpo |
আলিফার বাবা অনেকটা বিরক্ত হয়ে যেই পলিথিনের পোটলাটি ধরে ফেলে দিতে যাবেন তখন পলিথিনের ভিতরের দৃশ্য দেখে অবাক হবার চূড়ান্ত সীমায় পৌছে গেলেন। এ কীভাবে সম্ভব? পলিথিন ভর্তিতো টাকার বান্ডেল। তিনি অনেকটা নিস্তব্ধ হয়ে মেঝেতে বসে পরলেন। হঠাৎই লায়লা বেগমের ঘুভ ভাঙ্গতেই তিনি দেখতে পান তাঁর স্বামী একটি পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে মেঝেতে বসে রয়েছে। চেহারার পানে তাকাতেই দেখতে পান মুখে এক কৌতুহলভাব। নিজের সংশয় দূর করতে বলে উঠলেন,
-কী হলো? মেঝেতে বসে রয়েছো কেন? আর তোমার হাতে ওটা কী?
-লায়লা! আমি জানিনা কী হচ্ছে? এই দেখো এগুলো কী?
এই বলেই পলিথিনটা লায়লা বেগমের দিকে এগিয়ে দিলেন জাহিদ মিয়া। পলিথিনের ভিতরে টাকা দেখে লায়লা বেগমও বেশ অবাক হলেন। অনেকটা সন্দেহচক্ষু নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-একি! তুমি এই টাকা পেলে কোথায়? আজ সকালেইতো ব্যাংক থেকে আসার পথে টাকা ছিনতাই হলো।
লায়লা বেগমের সন্দেহ দূর করতে কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া অবিশ্বাস্য ঘটনার ধারাবর্ণনা দিলেন আলিফার বাবা। নিজের স্বামীর মুখে এরকম অদ্ভুত আর অলৌকিক ঘটনা শুনে একমুহূর্ত স্থির থাকতে পারলেন না তিনি। স্বামীর কথা যে অবিশ্বাস করবেন তারও কোনো অবকাশ নেই। কারণ পৃথিবীতে যদি সত্যবাদী লোকের একটি তালিকা করা হয় তবে তাঁর স্বামী উপরের লিষ্টেই থাকবে এটাই লায়লা বেগমের মনের দৃঢ় বিশ্বাস। হঠাৎই তাঁর মনে পরলো মেয়ের সাথে ঘটা ভৌতিক ঘটনার কথা। আলিফা যতবারই অসুস্থ হয় বা অজ্ঞান হয় ততোবারই সুস্থ হবার পর একটাই কথা আর তা হলো ও কোনো সাদা বিড়াল দেখেছিলো। আর প্রথম যেদিন আলিফা বখাটে ছেলেগুলোর থেকে শ্লীলতাহানির স্বীকার হয়েছিলো সেদিনওতো ছেলেগুলো সেই সাদা বিড়ালটিকে দেখেই ভয়ে পালিয়েছিলো। তার মানে এই ঘটনার সাথে কী আলিফার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার কোনো যোগসূত্র রয়েছে? বিড়ালটি কী সত্যিই বিড়াল নাকি ভৌতিক কোনো শক্তি যাকে বলে জ্বীন। সে কী আমাদের কল্যাণ চায়?
লায়লা বেগমের ধ্যান ভাঙ্গিয়ে আলিফার বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
-এসব ঘটনার উদ্দেশ্য কিছু বুঝতে পারছো লায়লা?
-হ্যাঁ ঠিক বুঝতে পারছি। কিন্তু এসবের কিছুই আলিফাকে বলার প্রয়োজন নেই। তুমি বলবে বিয়ের জন্য টাকা ধার করেছি।
দুদিন পার হয়ে গেল...
আলিফা আর মাহিনের বিবাহের সময়ক্ষণ আর বেশি দূরে নয়। কিন্তু আলিফাকে এই দুদিন একটি বিষয় খুব করেই পীড়া দিচ্ছে। কারণ এই দুদিন মাহিনের আচরণটা কীরকম যেন একটু ব্যতিক্রমধর্মী মনে হয়েছে আলিফার নিকট। গত দিনগুলোতে মাহিন নিজেই কল করতো কিন্তু এই দুদিনে মাহিন একটিও কল দেয়নি উল্টো আলিফা কল ব্যাক করলেও ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে ফোন রেখে দিয়েছে। আলিফার সহজ সরল মনটি মাহিনের এই অবহেলায় কেন যেন বারবার কেঁদে উঠছে। পুকুরপারে পেতে রাখা কাঠের বেঞ্চিটার উপর বসে এসব ভাবছিলো ঠিক তখনি ফোনটি বেঁজে উঠলো। স্ক্রীনে থাকা নামটি দেখেই আলিফা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো। হ্যাঁ ঠিকই ভাবছেন, দুদিন পর আজ মাহিন স্বদিচ্ছায় কল দিয়েছে। ফোনটি রিসিভ করতেই দুজন সালাম বিনিময় করলো। হঠাৎই মাহিন অনেকটা ইতস্তত গলায় বললো,
-আলিফা তোমাকে একটি কথা বলার ছিলো।
-হ্যাঁ বলুন। এতো ঘুড়িয়ে বলার কী দরকার?
-না মানে তুমি কথাটা ঠিক কীভাবে নিবে জানিনা কিন্তু আজ আমাকে কথাটি বলতেই হবে। এ ব্যতীত আমার নিকট আর কোনো পথ নেই।
মাহিনের বচনভঙ্গি শুনে আলিফা বুঝতে পারলো বিষয়টা সত্যিই বোধহয় সিরিয়াস। তাই মাহিনকে সহজ করার স্বার্থে বললো,
-আপনি বলেনতো! আমি কিছু মনে করবোনা।
-আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবোনা আলিফা।
কথাটি শুনে আলিফার মাথাটা কেমন যেন ঝিম ধরে গেলো। আলিফা ভুল কিছু শুনেনিতো? এই কদিনে যাকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন দেখে এসেছে সেই আজকে বলছে বিয়ে করতে পারবেনা?
-দেখো আলিফা! আমি তোমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমিও আজ নিরূপায় হয়ে এক অদৃশ্য শিকলে আবদ্ধ। তোমাকে যদি বিয়ে করি তবে আরেকটি মেয়ে প্রেমের ব্যর্থতায় নিজের জীবনকে শেষ করে দিবে। এই ঘটনা ঘটুক সেটা কী তুমি চাও বলো? তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী! আমি জানি বিষয়টি তুমি বুঝতে পেরেছো। ক্ষমা করে দিয়ো আমায়। হ্যালো, হ্যালো! আলিফা।
বাকি কথাগুলোর একবিন্দুও মনে হয় আলিফার মধ্যকর্ণে আঘাত করেনি। আলিফার কানে কানে শুধু একটি কথাই ঘুরেফিরে বাজছে, আর তা হলো "আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবোনা আলিফা"। আলিফার শরীরটা প্যারালাইজড রোগীর মতোই যেনো অবশ হয়ে গেলো। জীবনের প্রথম ভালোবাসার পরিণতিটা যে তীরে এসে তরী ডোবার মধ্য দিয়ে শেষ হবে সেটা ভাবতেই আলিফা পাথর হয়ে গেল। এদিকে আলিফার বাবা বেশ ঘটা করে বিয়ের জিনিসপত্রের লিষ্ট করছেন। ঘর থেকে বাজারে যাওয়ার উদ্দেশ্য রওয়ানা দেবার পথে হঠাৎই তার চোখ গোলো পুকুরপারের বেঞ্চের দিকে। আলিফা বেঞ্চে শুয়ে শুয়ে হেঁচকি তুলে কান্না করছে সেটা তিনি দূর থেকে দেখেই বুঝে ফেললেন। কৌতুহলবসত দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়েই আদরের একমাত্র মেয়ের মাথায় পরশ দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-কী হয়েছে মা কাঁদছিস কেন?
বাবার ছোয়া পেয়ে আলিফা জাহিদ মিয়াকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো। মেয়ের আকস্মাৎ ক্রন্দন দেখে নিজের মনটাও কীরকম তুলাসদৃশ নরম হয়ে গেলো।
-আহা! বলবিতো কী হয়েছে?
-বাবা মাহিন আমাকে বিয়ে করবেনা।
কথাটি শুনে আলিফার বাবা ১২০ ভোল্টের শকড খেলেন বোধহয়। কী বলছে মেয়েটি? আর পাঁচদিন পর বিয়ে আর এখন বলছে বিয়ে করবে নাহ? এটা কী হাডুডু খেলা পেয়েছে নাকি?
অনেকটা রাগান্বিত হয়েই জাহিদ মিয়া মাহিনের মায়ের নিকট কল দিলেন এমনকি অনেক কথা শুনালেনও বটে। কিন্তু মাহিনের মা শ্রোতার ভূমিকা পালন করে কেবল শুনেই গিয়েছেন কারণ এখানে তাঁর বলার মতো কোনো ভাষাই নেই। এতোদিন নিজ ছেলেকে নিয়ে গর্ববোধ করলেও আজ কেনো জানি মনে হচ্ছে এই ছেলেকে জন্ম দেওয়াটাই বোধহয় তার বড় পাপ ছিলো।
বিয়ে ভাঙ্গার প্রায় পাঁচদিন পার হয়ে গেলো। আজ ঠিক এই সময়টিতেই মাহিনের সাথে আলিফার বিয়ে হবার কথা ছিলো কিন্তু এখন সেগুলো রূপকথার গল্প বৈ কি কিছু নয়। আলিফা একপ্রকার খাওয়া দাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়েকে হাজার সান্ত্বনা দিয়েও কষ্ট ভুলিয়ে সুন্দর জীবনে আনতে পারছেন না লায়লা বেগম আর জাহিদ মিয়া। তারাও যে কম কষ্ট পাননি তাও কিন্তু নয়।
বিকালের মনোরম আবহাওয়ার মাঝে ছাদের এককোণে বসে রয়েছে আলিফা। কিন্তু আলিফার নিকট এই সৌন্দর্য্য বিষাদময় মনে হচ্ছে। হঠাৎই একটি সাদা বিড়াল আলিফার পাশে এসে যে বসেছে সেদিকে আলিফার খেয়ালই নেই। ও শুধু দূর আকাশের অস্তমিত রক্তিম সূর্যটার দিকে একনয়নে তাকিয়ে রয়েছে। এই অস্তমিত সূর্যের মতোই যে আলিফার ভালোবাসাটাও নদীর মাঝে বিলীন হয়ে গেছে তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। হঠাৎই বিড়ালের ডাক শুনে আলিফা কিছুটা চমকিত হয়ে পাশে তাকালো। আগের মতো কেন জানি আলিফা বিড়ালটিকে দেখে অতটা ভয় পাচ্ছেনা তবুও হাত পা কিছুটা কাঁপছে। বিড়ালটি আলিফার তাকানোকে তোয়াক্কা না করে সেটিও দূর আকাশের নীলিমায় তাকিয়ে রয়েছে। আলিফার ভয়ে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কোন এক অদৃশ্য শক্তি যেনো তাকে চিৎকার দিতে বাঁধা দিচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো বিড়ালটি অন্যান্য দিনের মতো আলিফার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। এভাবে দুই মিনিট বিড়ালটি বসে থাকার অন্তর অনেকটা সাবলীল ভঙ্গিতে আবার হেঁটে চলে গেলো। আলিফার নিকট এই দুই মিনিট অবস্থানকালে মনে হচ্ছিলো ও বোধহয় হাজার বছরের কোনো জীবন শঙ্কার মধ্যে ছিলো। বিড়ালটি চলে যাওয়াতে অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো আলিফা। হঠাৎই চোখ গেলো বিড়ালটির বসে থাকার জায়গাতে। সেখানে একটি ছোট্ট চিরকুট পরে রয়েছে। অনেকটা কৌতুহলবসত চিরকুট টা উঠিয়েই দেখলো সেখানে কিছু লেখা রয়েছে।
"আলিফা! আমি জানিনা তুমি কেন এতো ভয় পাও আমাকে। কিন্তু আমি তোমার কোনো অকল্যাণের জন্য আসিনি। সামনে তোমার খুব বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। আর তুমি আমাদের জ্বীন বংশের রক্ত বয়ে বেড়াচ্ছো তাই আমাকে পাঠানো হয়েছে তোমার সুরক্ষার স্বার্থে। আজ গভীর রাতে তুমি তোমাদের বাড়ির পেছনে চলে এসো তবেই তুমি তোমার জন্ম বৃত্তান্ত এবং অতীত সম্পর্কে জানতে পারবে।"
চিরকুটটি পড়ে আলিফার হাতটা থরথর করে কাঁপছে। তবে কী সত্যিই আলিফার রক্তে জ্বীনের বংশ পরম্পরার অস্তিত্ব রয়েছে? নাকি এটা কেবল তাকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য কোনো ভৌতিক শক্তির একটি চাল? এই মুহূর্তে আলিফা কিছুই ভাবতে পারছে না।
গভীর রাত....
মাহিনের বিষয়টি যেনো আলিফার মাথায় এক ঘুনাক্ষরও ঘোরাফেরা করছেনা ওর মাথায় এখন শুধুই বিকালের সেই চিরকুটটির কথা খেলা করছে। আলিফা এখন একপ্রকার দোটানায় পরে রয়েছে, আমি কী যাবো? পরক্ষণেই আবার ভাবলো গেলে যদি কোনো বিপদ হয়?
অবশেষে সকল ভাবনা চিন্তার পর স্থির করলো যা হবার হোক আমি যাবোই। আমাকে জানতেই হবে অতীতের সব নিয়ামকগুলো।
আলিফা হাতে একটি হারিকেন নিয়ে বাড়ির পিছনের দিকটায় অনেক সাবধানতার সহিত যেতে শুরু করলো। আলিফার খুব ভয় করছে কিন্তু অজানা এক শক্তি যেনো তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির পিছনের দিকটায় বেশ কিছু ফলের গাছ থাকলেও তেমন ঝোপঝাড় নেই। বাগানের মাঝে আসতেই চারদিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলোনা। হঠাৎই বাঘের হুংকারে আলিফার শরীরটা ভয়ে একটি ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। পিছনে তাকাতেই আলিফা ভয়ে নিজের হাতে থাকা হারিকেনটি মাটিতে ফেলে দিলো। একটি কালো বাঘ সদৃশ জন্তু আলিফার দিকে এগিয়ে আসছে আর আলিফাও ভয়ে ভয়ে এক পা দুপা করে পিছনে যাচ্ছে। হঠাৎই একটি গাছের সাথে আটকে গেলো আলিফা অপরদিকে আগুনের চোখ নিয়ে অনেকটা হিংস্রতার সহিত বাঘটি এগিয়ে আসছে ক্রমেই। আজ কী তবে আলিফার জীবনের বিদায় ঘন্টা বাঁজবে??
প্রশ্নের উত্তরটা আপনাদের কাছেই....
.
[To be continued]
.
Writer: Misk Al Maruf