Golpo |
হঠাৎই একটি গাছের সাথে আটকে গেলো আলিফা, অপরদিকে আগুনের চোখ নিয়ে অনেকটা হিংস্রতার সহিত এগিয়ে আসলো বাঘটি ক্রমেই। আজ কী তবে আলিফার জীবনের বিদায় ঘন্টা বাঁজবে? এসব ভাবতেই ঠিক যখন ভয়ে চোখটা বন্ধ করে ফেললো ঠিক তখনই কই থেকে যেনো একটি বিশাল আকৃতির নাম না জানা সাদা জন্তু কালো বাঘটিকে প্রকান্ড এক আঘাত করলো। দুইটি জন্তুর মাঝে এতোটাই প্রতিদ্বন্ধীতাপূর্ণ মারামারি হচ্ছে যে আশেপাশের গাছগুলো বাতাসের তীব্রতায় মাটিতে নুইয়ে নুইয়ে পরছে। এসব দৃশ্য যেন আলিফার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ও এখনো ভেবে পাচ্ছে না এখানে এরকম অদ্ভুদ জন্তু আসলো কই থেকে আর কেনইবা একজন তাঁকে মারতে চাচ্ছে আর আরেকজন তাঁকে বাঁচাতে চাচ্ছে। তবে এরা কী কোনো ভৌতিক শক্তি? এসব ভাবছে আর হাত পা কাঁপছে আলিফার। কিছুক্ষণ অন্তর কালো জন্তুটি বাতাসের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেলো আর অদ্ভুত সাদা জন্তুটি আলিফার দিকে ক্রমেই এগিয়ে এলো। এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎই জন্তুটি তাঁর শারিরীক গঠন পরিবর্তন করে একটি সাদা বিড়ালে রূপ নিলো। তবে কী এটাই সেই ভৌতিক সাদা বিড়াল যে আলিফাকে চিরকুটের মাধ্যমে এখানে আসতে বলেছিলো?
এই পূর্ণিমা রাত্রিতে গোলাকার চাঁদটির আলো বিড়ালটির ধবল সুন্দর শরীরে পরতেই এতোটাই প্রতিফলিত হচ্ছে যে চারিপাশের পিপীলিকার হাঁটাচলাও খুব স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে।
-আলিফা! আমার ভাবনাতেই ছিলোনা যে ওরা তোমার খবর পেয়ে যাবে। আরেকটু দেরীতে আসলেই হয়তো তোমাকে আমি রক্ষা করতে পারতাম না।
আলিফা বিড়ালটির কথায় এখনো ভেবে পাচ্ছে না যে সে কার কথা বলছে। অনেকটা ভয়ার্ত গলায় আলিফা বললো,
-আপনি কার কথা বলছেন? আর আমার সাথে এসব কেনইবা ঘটছে?
-তুমি কী জানতে চাও তোমার জন্ম অতীত সম্পর্কে?
-হ্যাঁ। আমি আর এসব নিতে পারছি না। আর আপনিই বা কে?
-আমি কে সেটা তুমি সময় মতোই জানতে পারবে। আর তুমি যাদেরকে বাবা মা বলে সম্বোধন করছো তারা তোমার আসল বাবা মা নয়।
কথাটি শুনেই আলিফার রক্তে এক হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলো। কী বলছে এসব? তার মানে জাহিদ মিয়া আর লায়লা বেগম তার আসল বাবা মা নয়?
এদিকে লায়লা বেগম গভীর রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যখন ওয়াশরুমে যাবেন ঠিক তখনি তাঁর চোখ গেলো আলিফার রুমের দিকে। সচরাচর আলিফার রুমের দরজা খোলা থাকে না তাই তিনি কৌতুহলবসত রুমের দিকে এগিয়ে যেয়েই হালকা ধাক্কা দিলেন দরজাটি। হঠাৎই তাঁর হৃৎপিন্ডটা ধুক করে উঠলো, আলিফা ঘরে নেই তবে কোথায় গেল? তিনি অনেকটা হন্তদন্ত হয়ে ওয়াশরুমসহ প্রতিটি রুমের আনাচে কানাচে খোঁজ করলেন কিন্তু কোথাও আলিফার অস্তিত্ব নেই। অনেকটা ভয় পেয়েই তিনি জাহিদ মিয়াকে ডেকে তুললেন।
-কী হলো লায়লা? এতো রাতে কেউ ঘুম ভাঙ্গায়?
-আলিফাকে রুমে পাচ্ছি না। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পেলাম না ওকে।
জাহিদ মিয়ার অর্ধঘুমন্ত নেত্র দুটি হঠাৎই বড় আকার ধারণ করলো নিজ স্ত্রীর কথা শুনে। তিনি একমুহূর্ত বিছানায় শুয়ে না থেকে একলাফে উঠেই আরেকবার পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। এমন করে বোধহয় একজন মানুষ নিজের হারানো রত্নও খুঁজে বেড়ায় না। যখন তিনি বাড়ির ভিতরে আলিফাকে খুঁজে পেলেন না তখন একটি টর্চলাইট নিয়ে বাড়ির বাহিরে বের হলেন। তিনি জোরে জোরে কয়েকবার আলিফার নাম ধরে ডাক দিলেন কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ পেলেন না। শেষমুহূর্তে যখন হাল ছেড়েই দিচ্ছিলেন ঠিক তখনি তাঁর কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো বাড়ির পিছনের দিকটাতেতো যাওয়া হয়নি সেখানেওতো...। বাড়ির পিছনের বাগানে আসতেই তিনি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। একি! আলিফা একটি গাছের সাথে হেলান দিয়ে কার সাথে যেনো কথা বলছে কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো আলিফার সামনে কেউই নেই।
-আলিফা! আলিফা!
হঠাৎই আলিফা কারো ডাক শুনে বাস্তবে ফিরলো। ডান দিকে তাকাতেই দেখে তার বাবা দাঁড়িয়ে রয়েছে, তৎক্ষনাৎই সামনে তাকাতেই দেখে বিড়ালটি নেই।
-এতো রাতে এখানে কী করছিস? আর কার সাথে কথা বলছিলি?
আলিফা কী বলবে ঠিক বুঝতে পারছিলোনা।
আলিফার মা ঘরের দরজার সামনে বসে অজস্র ধারায় নিজের অশ্রুজল বিসর্জন দিচ্ছেন। একমাত্র মেয়ের যদি কিছু হয়ে যায় তবে তাঁর বাঁচাটাই দায় হয়ে যাবে। হঠাৎই সামনে তাকাতেই দেখতে পান আলিফাকে নিয়ে আলিফার বাবা হেঁটে আসছেন। অনেকটা দৌড়ে গিয়ে আলিফাকে জড়িয়ে ধরেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলেন তিনি।
-এতোরাতে কই গিয়েছিলি মা? তোর কিছু হয়ে গেলে আমার কী হবে? তোর অবলম্বনেইতো বেঁচে আছি।
-আহা লায়লা! তুমি ওকে রুমে নিয়ে ঘুম পারিয়ে দাও। এখন এতো জেরা করার দরকার নেই।
জাহিদ মিয়ার কথামতো তিনি আলিফাকে অনেকটা আকড়ে ধরেই রুমে নিয়ে ঘুম পারিয়ে দিচ্ছেন।
আলিফা মনে মনে ভাবছে,
-আপন বাবা মা না হয়েও কতোটা যত্নশীল তাঁরা আমার প্রতি। আমি কী এই বাবা মায়ের ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবো?
পাখির কলকাকলী আর কলরবে ঘুম ভাঙ্গলো আলিফার। পাশে তাকাতেই দেখতে পায় তাঁর মমতাময়ী মা আর প্রিয় বাবা ঘুম ভাঙ্গার জন্য অপেক্ষা করছে।
-মা উঠেছিস? এই দেখ তোর জন্য গরম গরম স্যুপ বানিয়ে নিয়ে এসেছি।
আলিফা অনেকটা সাবলীল ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
-আচ্ছা মা! তোমরা আমার আসল বাবা মা না হওয়া সত্ত্বেও কেনো এতো আমার যত্ন করো? নিজের মেয়ে হলে কী এর থেকেও বেশি যত্ন করতে?
আলিফার কথা শুনে লায়লা বেগমের হাত থেকে স্যুপের বাটিটা মেঝেতে পরে গেলো। তার হাত থরথর করে কাঁপছে। আর জাহিদ মিয়া অনেকটা তোতলানো ভঙ্গিতে বললেন,
-কী কী বলছিস মা এসব? আমরাইতো তোর আসল বাবা মা। এসব কথা তোকে কে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে বলতো আমাকে।
-বাবা আমি সব জানি। আর তোমরা যে আমাকে একটি পুরোনো বাংলো থেকে কুড়িয়ে এনেছো তাও জানি বাবা। কেনইবা মিথ্যা বলছো?
আলিফার কথা শুনে লায়লা বেগম এক বেদনাদায়ক ক্রন্দন এর মাধ্যমে আলিফাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
-মা বিশ্বাস কর তুই আমার মেয়ে।
-লায়লা থামো! আমি মনে করি আলিফার সত্যটা জানা দরকার। আর আমি এও জানি যে তুমি এসব ঘটনা কার কাছ থেকে শুনেছো।
২২ বছর আগের কথা...
লায়লা বেগমের বিয়ের প্রায় দশবছর হতে চলছে কিন্তু এখনো তিনি কোনো সন্তানের মুখ দেখেননি। এই নিয়ে পাড়া প্রতিবেশী আর শ্বশুর বাড়ি থেকে অনেক কথাই শুনতেন। কিন্তু জাহিদ মিয়া তার স্ত্রীকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন তাই তিনি সন্তানের জন্ম না দিতে পারাতেও লায়লা বেগমকে কিছুই বলতেন না বরং প্রতিনিয়তই উৎসাহ দিতেন যে আমাদের সন্তান হবেই। লায়লা বেগম নিজের প্রতি স্বামীর অব্যর্থহীন সান্ত্বনা যে শুধুই সান্ত্বনা তা খুব করেই বুঝতে পারতেন। জাহিদ মিয়া যখন দেখতে পেলেন পাড়া প্রতিবেশী ও পরিবার থেকে লায়লাকে অসংখ্য কটুকথা শোনানো হচ্ছে তখন তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে অন্যত্র চলে আসলেন।
একদিন গভীর রাতে জাহিদ মিয়া বাড়িতে ফিরছিলেন। হঠাৎই রাস্তার পাশে একটি পুরোনো বাংলো থেকে শিশুর কান্নার আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়ালেন। বেশ সাহসী হওয়াতে তিনি কান্নার শব্দের উৎস খুঁজতে বাংলোর দিকে এগিয়ে গেলেন। ভাঙ্গা দরজা ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই তিনি দেখতে পান সদ্য জন্মানো এক ফুটফুটে শিশু ক্ষুধার যন্ত্রনায় কান্না করছে। হঠাৎই একটু দূরেই দেখতে পান এক যুবতী মহিলা রক্তাক্ত শাড়ি নিয়ে মেঝেতে শুয়ে রয়েছেন। অতিদ্রুত তিনি মহিলাটির নিকট এসে হাতের পালস চেক করে বুঝতে পারেন এই নিথর দেহে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। তৎক্ষনাৎই তিনি চিন্তা করলেন শিশুটিকে নিজের সাথে নিয়ে যাবেন, কারণ এমন চঁন্দ্রমুখো ফুটফুটে শিশুকে রেখে চলে আসার ক্ষমতা তার তৈরি হয়নি আর তাছাড়া তিনিও নিঃসন্তান। লায়লা দেখলে হয়তো অবশ্যই খুশি হবে। যখনই শিশুটিকে কোলে নিবেন ঠিক তখনি দেওয়ালে প্রতিধ্বনির স্বরে অদৃশ্য কেউ বলে উঠলো,
-সাবধান! এই সন্তান তুমি স্পর্শ করবেনা।
জাহিদ মিয়া অদৃশ্য শক্তির শ্রবণকে তোয়াক্কা না করে তিনি বলেন,
-না আমি এই সন্তানকে আমার সাথে নিয়ে যাবো। আমি চাইনা এমন একটি ফুটফুটে শিশু অনাহারে এখানেই মৃত্যুবরণ করুক।
-আমি তোমার বক্তব্যে বিমুগ্ধ। তবে তোমাকে কথা দিতে হবে যে এই সন্তানের প্রতি তুমি কখনো অবিচার করতে পারবেনা। যদি করো তবে তোমার উপর নেমে আসবে এক কালো অধ্যায়।
সেদিন তিনি সেই অদৃশ্য শক্তিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েই আলিফাকে নিয়ে এসেছিলেন সেই বাংলো থেকে। লায়লা বেগমকে এব্যপারে কিছুই বলেননি শুধু এতোটুকুই বলেছিলেন
-ওর মা মারা গেছে তাই ওকে নিয়ে এসেছি। আজ থেকে তুমি ওর মা আর আমি বাবা।
সেদিন লায়লা বেগম নিজের স্বামীর নিকট এতোটা মূল্যবান উপহার পেয়ে সম্মান আর ভালোবাসাতে সরাসরি তাঁর পায়ে পরে গিয়েছিলেন। কারণ একজন স্বামী তাঁর স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসলে এতোকিছু করতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্বয়ং তার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। জাহিদ মিয়া সেই অদৃশ্য শক্তির কথা রেখেছিলেন। কারণ আলিফার এই ২২বছরের জীবনে তিনি আলিফার উপর উঁচু গলাতেও একটি কথা বলেননি আর গায়ে হাত তোলাতো দূরের ব্যপার।
এতক্ষণ যাবৎ অতীতের ঘটনার সারমর্ম বলছিলেন জাহিদ মিয়া নিজের মেয়েকে। বাবার কথা শুনে আলিফার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পরছে। এই অশ্রু বিসর্জন তার আসল জন্মদাত্রীর মৃত্যুর কথা শুনে নয় বরং তাঁর প্রতি তাঁর বাবা মায়ের এক নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মহীমায়, যেই ভালোবাসায় নেই কোনো সন্দেহের অবকাশ।
গভীর রাত...
আলিফা শুয়ে শুয়ে ভাবছে তাঁর মা নাহয় তাঁকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছিলো তবে তাঁর বাবা কে? সে কী এখনো বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে? আর কেনইবা তার মা সেই পরিত্যক্ত বাংলোতেই তার জন্ম দিয়েছিলো?
হঠাৎই তাঁর রুমে দ্বিতীয় একজন আচমকাই বলে উঠলো,
-আলিফা! তুমি কী দেখতে চাও তোমার জন্মদাতা পিতাকে?
আলিফা অনেকটা হতভম্ব হয়ে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
-হ্যাঁ। দেখতে চাই আমার বাবাকে।
এরপর যে দৃশ্য দেখলো তাঁর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা আলিফা। এ কীভাবে সম্ভব?
অবিশ্বাস্য...
.
[To be continued]
Writer: Misk Al Maruf