Golpo |
হঠাৎই আলিফার রুমে দ্বিতীয় একজন আচমকাই বলে উঠলো,
-আলিফা তুমি কী দেখতে চাও তোমার জন্মদাতা পিতাকে?
আলিফা অনেকটা হতভম্ব হয়ে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
-হ্যাঁ দেখতে চাই আমার বাবাকে।
এরপর যে দৃশ্য দেখলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না আলিফা। এ কীভাবে সম্ভব?
তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন সুদর্শন লোক কিন্তু এই লোকটি আর কেউ নয় বরং সেই সাদা বিড়ালটিরই একটি প্রতিরূপমাত্র। তার মানে এই সাদা বিড়ালটিই তাঁর জন্মদাতা পিতা? একজন জ্বীন কীভাবে তাঁর পিতা হতে পারে? এটা কী আদৌ সম্ভব? উত্তেজনায় আলিফার প্রতিটা শিরা উপশিরা থেকে যেনো এক হাজার মাইল গতিবেগে রক্ত ছুটে চলছে। আলিফার ফর্সা ত্বক মুহূর্তেই রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।
-আলিফা! তোমার মনে হয়তো হাজারো প্রশ্ন বাসা বেঁধেছে যে একজন জ্বীন কীভাবে তোমার পিতা হতে পারে? তাইতো? কিন্তু প্রভু চাইলে সবকিছুই সম্ভব। আমি ছিলাম জ্বীন বংশের রাজপুত্র সেই হিসেবে অন্যান্য জ্বীনদের তুলনায় আমার প্রভাব প্রতিপত্তিও ছিলো বেশ উঁচুস্তরে। কিন্তু একটি কথা আছে যে ভালোবাসার মোহকে কোন বাধাই আটকে রাখতে পারেনা আমাকেও পারেনি। আমি প্রেমে পরে গিয়েছিলাম এক মহীমান্বিত মানবীর। যেই প্রেমে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো অসংখ্য নিয়ামক। আমাদের জ্বীন জাতির মধ্যে কিছু দুষ্টু জ্বীন ছিলো যারা মানুষের শিরাস্তরে ঘুরে বেড়িয়ে জীবনকে নরকময় করে ফেলতো। কিন্তু প্রভু আমার মধ্যে মানুষের প্রতি ভালোবাসার এমন একটি মায়াশক্তি দিয়েছিলেন যে কোনো মানুষের অসহায়ত্ব দেখলে নিজের মনটাও কেঁদে উঠতো। যখন দেখতাম আমার অন্যান্য জাতি ভাইয়েরা মানুষের ক্ষতি করছে তখন আমি স্থির থাকতে পারতাম না। সেই অসহায় মানুষের পক্ষ নিয়ে নিজ জাতি ভাইদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করতাম। এই নিয়ে ক্রমেই আমার সাথে জাতি ভাইদের বৈরীতা বাড়তে থাকে।
আশ্বিনের এক বৃষ্টিস্নাত সকালে এক মানবীকে দেখে আমার ক্ষুদ্র হৃদয়ে কিঞ্চিত ভালোবাসার আবির্ভাব ঘটে। ভালোবাসার সাগরে যে শুধু মানুষেরাই হাবুডুবু খায় তা কিন্তু নয়, মানুষের অনুরূপ জ্বীনদেরও একটি ভালো হৃদয় রয়েছে যেই হৃদয়ে তাঁরাও ভালোবাসা লোপন করতে জানে। আমি চাইলেই সেই মানবীকে নিজের দুষ্টু শক্তি দিয়ে ঘায়েল করতে পারতাম। কিন্তু আমার মনে সেদিন কোনো হিংস্রতা ছিলো না, ছিলো শুধু ভালোবাসায় ভরাডুবি এক হৃদয়। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে মানবরূপ নিয়েই আমি সেই মহিয়সীর নিকট প্রেম নিবেদন করবো। একদিন আমি সেই মানবীর বাড়িতে এক সুদর্শন যুবক রূপে অবস্থান করি। সেদিন আমি সেই মানবীর অসহায়ত্ব দেখে নিজের সবল মস্তিষ্কটাও যেন দুর্বলচিত্তের মনে হচ্ছিলো। মেয়েটির বাড়িতে ছিলো দুজন অসহায় বৃদ্ধ বৃদ্ধা। একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে বৃদ্ধা আর মেয়েটি হস্তশিল্পের কাজ করতো আর বৃদ্ধ সেগুলো বাজারে বিক্রি করতেন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে করেই হোক এই পরিবারের অভাব আমি দূর করবো। তাই প্রতিনিয়ত নিজের ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়ে তাঁদেরকে সাহায্য করতাম। কিন্তু একটা সময় মনে হচ্ছিল এগুলো তাঁদের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই জ্বীন জাতির নিয়ম ভঙ্গ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে আজ থেকে আমি একজন মানুষরূপেই বেঁচে থাকবো আর আমার হৃদয়ের মাঝে গেঁথে থাকা সেই ভালোবাসার মানবীকে বিয়ে করবো। বিয়ে করেছিলাম বটে কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছিল আমার মনের ভীতিটাও ক্রমেই তীব্র হচ্ছিল। কারণ আমার যেই জাতি ভাইদের বিরুদ্ধে মানুষের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করতাম তাঁদের নজর যদি একবার আমার হৃদয়ের অংশক এর উপর পরে তবে তাঁরা তাকে বাঁচতে দিবেনা। আমার সন্দেহটাই ঠিক হয়েছিলো, তাই আমি কখনো তোমার জন্মদাত্রীকে রেখে এক পা পিছু বা সামনে অগ্রসর হতাম না। যেদিন তাঁরা তোমার মায়ের কিছু না করতে পেরে তাঁর বৃদ্ধ বাবা মা কে হিংস্রতার সহিত মেরে ফেলেছিলো সেদিন তোমার মায়ের ক্রন্দন দেখে নিজেকেই নিজের নিকট খুব অসহায় মনে হয়েছিলো। আমার এতো প্রভাব থাকা সত্ত্বেও তাঁদেরকে বাঁচাতে পারলাম না? এরপরের দিনগুলো ছিলো সুখ আর দুঃখে মোড়ানো এক বিশৃঙ্খল জীবন। তোমার মা কীভাবে যেন বুঝে গিয়েছিলো আমি মানুষ নই বরং মানুষরূপী এক ভিন্ন সত্ত্বা। কিন্তু তোমার মা সেদিন একটুও ভয় পায়নি কারণ এই ভিন্ন সত্ত্বাই তাঁর অন্তর্মহলে এক বিশাল এলাকা জুড়ে বাস করেছিলো। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিলো তোমার মায়ের গর্ভে তোমার উপস্থিতি। আমি জানি না প্রভু এই অসম্ভব কে কেন সম্ভব করলেন কিন্তু অন্যান্য পুরুষ জাতির থেকে আমিই বোধহয় সর্বাপেক্ষা বেশি আনন্দিত ছিলাম। একদিন আমি নিজের প্রয়োজনের স্বার্থে দূরে কোথাও ভ্রমন করি তোমার মা কে রেখেই। কিন্তু এটাই ছিলো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভুল। সেদিন আমার বিরুদ্ধাচারণকারী জাতি ভাইয়েরা তোমার জন্মদাত্রীকে মেরে ফেলার এক প্রয়াস চালিয়েছিলো। আমি যথাসময়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু তোমার মাকে বাঁচাতে পারিনি। প্রভুর কী লীলাখেলা যে তিনি তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আমার কোনো বৈশিষ্ট্যই তিনি তোমাকে দেননি। আমার খুব ইচ্ছা ছিলো তোমাকে আমার সাথে রাখার কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা করলাম তিনজন প্রিয় মানুষের মতো তোমাকেও যদি হারিয়ে ফেলি তবে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবোনা। সেদিন অনেকটা নিরুপায় হয়েই তোমার এই বাবার নিকট তুলে দিয়েছিলাম। বন্যেরা বনে যেমন সুন্দর আমার মনে হয়েছিলো তুমিও মানুষের মাঝেই সুন্দর। আমি হয়তো প্রভুর কল্যাণে তোমার জন্মদাতা পিতা হতে পেরেছি কিন্তু সত্যিকারের পিতা হতে পারিনি। স্বজাতির নিয়ম ভঙ্গের কারণে আমার অনেক শক্তি আর ক্ষমতা নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে। হয়তো বেশিদিন এই প্রাণ আর স্থায়িত্ব লাভ করবেনা ঠিকই তবে যতদিন থাকবো তোমার প্রতি ধেঁয়ে আসা বিপদকে প্রশমিত করে যাবো।
আলিফা যেন এতক্ষণ যাবৎ অন্যজগতের কোনো রূপকথার গল্প শুনছিলো। কিন্তু এই অতীত আলিফার মনকে এতোটাই নরম করে দিয়েছে যে নোনা চোখের জলে পুরো বিছানার চাদরটাই ভিজে জুবুজুবু হয়ে গিয়েছে।
-বাবা।
আলিফার মুখে বাবা ডাক শুনে যেন তাঁর মনে হচ্ছিলো জীবনের পরিপূর্ণতা তাঁর হাতের মুঠোয়। নিজের পিতা জ্বীন হয়েও যে এতোটা সহজে আলিফা তাঁকে গ্রহণ করবে সেটা তাঁর ভাবনাতেই ছিলোনা।
-বাবা। তুমি এতো স্বার্থপর কেনো?
পরক্ষণেই আলিফার মুখে নিজের স্বার্থপরতার কথা শুনে উজ্জীবিত হৃদয়টি নির্জীব হয়ে গেলো তাঁর।
-তুমি খুব স্বার্থপর জানো? এতোদিন আমাকে নিজের থেকে কেনো লুকিয়ে রেখেছো? আমি কী তোমাকে দূরে ঠেলে দিতাম? যে শরীরে আমি জ্বীনের অস্তিত্ব বয়ে বেড়াচ্ছি সেই মন আর দেহ কীভাবে তোমাকে অস্বীকার করতে পারে? বলতে পারো?
আলিফার কথা শুনে কিছু বলার ভাষ্য হারিয়ে ফেললেন তিনি।
-বাবা! আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে? খুব ইচ্ছে করে তোমার মানুষরূপী দ্বিতীয় সত্ত্বার অস্তিত্ব অনুভব করতে।
আলিফার বাবা তাঁর হাতদুটো প্রসারিত করে আলিঙ্গনের অনুমতি দিলেন আলিফাকে। আলিফা একলাফে তার বাবার কোলে ঝাপিয়ে পরলো। এই ভালোবাসায় কোনো দ্বিজাতি তত্ত্বের ভেদাভেদ নেই আছে শুধুই পরম স্নেহ আর মায়ার বস্যতা স্বীকার।
এদিকে আলিফার মা লায়লা বেগমের মনে কিঞ্চিত ভয়ের আবির্ভাব ঘটলো। তিনি ভাবছেন, তাঁর মেয়েকে যদি কোনোভাবে ভৌতিক শক্তির রোষানলে পরে হারিয়ে ফেলেন তবে তিনি কীভাবে বেঁচে থাকবেন মেয়েকে ছাড়া। তাই তিনি একান্তই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি কোনো তান্ত্রিক কবিরাজের শরণাপন্ন হয়ে মেয়েকে এই ভৌতিক শক্তির হাত থেকে রক্ষা করবেন। পরদিন সকালে যখন জাহিদ মিয়া কাজের স্বার্থে বাহিরে গেলেন তখন তিনি আলিফাকে ঘরে একা রেখেই রওয়ানা দিলেন এক তান্ত্রিকের উদ্দেশ্যে। লোকমুখ থেকে শুনেছেন জঙ্গলের শেষদিকে নাকি এক কানা তান্ত্রিক থাকেন। তিনি অজস্র জ্বীনকে নিজের আয়ত্তাধীনে বস্যতা স্বীকারে বাধ্য করান আর যারা তার বিরুদ্ধাচারণ করে তাদেরকে কাঁচের বোতলে আটকে রাখেন।
লায়লা বেগম অনেকটা ভীতরূপেই জঙ্গলের পথে হেঁটে চলছেন। বোঝাই যাচ্ছে এই পথে লোক সমাগমের অস্তিত্ব বেশ বিরলই বটে। তবুও তিনি ভয়কে জয় করে নিজের মেয়েকে বাঁচাতে হেঁটেই চলছেন। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে প্রায় আধঘন্টা হাঁটার পর দূরে একটি কুড়েঘর দেখতে পান। যতই সামনে এগোচ্ছেন ততই তাঁর শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে। হঠাৎই তিনি একটি কিছুর সাথে হোঁচট খেয়ে পরে যান। যখনই উঠে দাঁড়ান তখনই সামনের দৃশ্য দেখে তাঁর হাত পা থরথর করে কাঁপতে থাকে। কারণ তাঁর সামনে একজন ভৌতিক টাইপের লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথম দেখাতে মনে হবে এটা হয়তো কোনো বনমানুষ কিংবা জঙ্গলের হিংস্র কোনো জন্তু। আর ভয় পাবার প্রধান কারণ হলো লোকটির ডান চোখের জায়গাটিতে কিছুই নেই অর্থাৎ একটি গর্তের মতো। ভিতর থেকে মস্তিষ্কের সামান্য অংশ স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে। অনেক ভয়ঙ্কর গলায় লোকটি লায়লা বেগমকে বলে উঠলো,
-এখানে কেন এসেছিস?
-না মা মানে! আ আমার মেয়েকে বাঁচান বাবা। একটি জ্বীন আমার থেকে ওকে কেড়ে নিতে চাইছে।
-বাড়ি ফিরে যা। সময়মতো আমি পৌছে যাবো।
-বাবা আমার ঠিকানা না রাখলে যাবেন কীভাবে?
-হাহাহা বোকা! আমার কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। দূর হ সামনে থেকে মূর্খের দল।
লোকটির ধমকে অনেকটা ভয় পেয়েই ফিরে এলো লায়লা বেগম।
এদিকে আলিফা ছাদে বসে বসে প্রতিনিয়তই তাঁর বাবার সাথে কথা বলে কিন্তু তাঁর বাবাকে আলিফা ব্যতীত আর কেউ দেখতে পায়না। জাহিদ মিয়া ব্যপারটা বুঝতে পারলেও লায়লা বেগম ভাবছেন তাঁর মেয়ে বোধহয় সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। দিনকে দিন তাঁর চিন্তা ক্রমেই বাড়তে থাকে মেয়েকে নিয়ে।
একদিন গভীর রাতে বাহিরে একজন লোকের মন্ত্রপাঠ শুনে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন জাহিদ মিয়া এবং লায়লা বেগম। লায়লা বেগম সেই তান্ত্রিক কে দেখে খুশি হলেও জাহিদ মিয়া এর আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছেন না।
-লায়লা! এসব কী? আর ইনি কে?
-ইনি তান্ত্রিক বাবা! আলিফার সাথে যেই জ্বীন আছে সেটাকে তিনি মেরে ফেলবেন।
-কী বলছো এসব? তুমি কিছু জানো আলিফার ব্যপারে? এক্ষণি একে চলে যেতে বলো নয়তো আমিই কিন্তু বের করে দিবো একে।
-না। আমি চাইনা আমার মেয়ে পাগল থাকুক। তুমি কিচ্ছু করবেনা।
লায়লা বেগমের কথা শুনে জীবনে প্রথমবারের মতো অতি আক্রোশে নিজের স্ত্রীকে চড় মারলেন জাহিদ মিয়া। পরক্ষণেই যেই তান্ত্রিককে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে যাবেন ঠিক তখনি এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হলেন তিনি।
তবে কী তান্ত্রিক তাঁর শক্তির ফাঁদে আটকে ফেলেছেন তাঁকে???
প্রশ্নটা থেকেই যায়...
.
[To be continued]
.
Writer: Misk Al Maruf