Comics |
ইমনের বাবা আব্বাস সাহেব ওকে হাত খরচের জন্য কখনো একসাথে বেশি টাকা দেননা। ছেলেটা বোকাসোকা, একেবারে হাদারাম পর্যায়ের। একটার বেশি দুটো নোট দিলেই হারিয়ে ফেলে। একবার ওকে দুই হাজার টাকা দিয়েছিল স্কুলের দুমাসের বেতন দেয়ার জন্য। ছেলে ঘরে ফিরেছে এক মাসের বেতন দিয়ে। আরেক মাসের টাকা হয়তো রাস্তার কোথাও উড়ছে। কিভাবে হারিয়েছে ও বলতে পারে না। তখন থেকেই প্রতি মাসে ওর মা নিজে গিয়ে স্কুল আর কোচিংয়ের স্যারের বেতন দিয়ে আসে। শুধু টাকা সামলানোর ক্ষেত্রেই যে ইমন এরকম গর্দভ তা নয়, অন্যান্য কাজেও ইমন ছোট থেকেই সমানতালে নিজেকে গর্দভ প্রমাণ করে যাচ্ছে।
একবার ওর বাবা ওকে বলল, “আব্বু লাইনের মাথায় যেই কালামের দোকান আছে না? ওখান থেকে দুই হালি ডিম নিয়ে এসো ঠিকাছে!”
ইমন মাথা নেড়ে চললো কালামের দোকানে। গিয়ে দেখে ডিম শেষ। পাশের দোকানের সালাম মিয়া বললো, “ইমন আমাদের দোকানে ডিম আছে। নিয়ে যাও। কয়টা দিব দুই হালি?”
ইমন তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো, “আব্বু আপনার দোকান থেকে ডিম নিতে নিষেধ করেছে।“
একথা শুনে সালাম মিয়া তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। পরে এ নিয়ে বিরাট কাহিনী।
ইমনের এরকম অদ্ভুতুড়ে কীর্তি দেখে আব্বাস সাহেব মাঝেমাঝে সরাসরি বলেই বসেন যে এটা মোটেও আমার জাতের মতো হয়নি। আমার চৌদ্দ গুষ্টিতেও এরকম গাধা মানব কেউ নেই। এটা হয়েছে ওর মামাদের মতো। ইমনের মা রোকেয়া বেগম একথা শুনতে পেলেই তাদের মধ্যে আবার একচোট ঝগড়া শুরু হয়ে যায়।
- একদম আমার ভাইদের টানবেনা বলছি। তুমি নিজে যেরকম ছেলেও হয়েছে সেরকম। বলদের ঘরে বলদ হয়েছে।
- এ্যাহ! নিজে যেন একেবারে চালাকের বাক্স। আর আমি কোন বলদামিটা করেছি শুনি।
- বলদামি করোনি? বলদ না হলে কি কেউ শ্বশুর বাড়িতে খালি হাতে যায়?
- হেহ! দুই যুগ পুরনো শ্বশুরবাড়িতে আবার খালি হাত ভরা হাত আছে নাকি? যত্তসব ফালতু কথাবার্তা।
দুদিন পরপরই তাদের মাঝে এরকম ঝগড়া হয়। তবে তারা এখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি যে কার জাতের দিকটা বেশি বলদ। এর মধ্যেই ইমন বড় হয়ে গেছে। এবার নবম শ্রেণীতে উঠেছে। আব্বাস সাহেব ভাবছে এখন ছেলেটাকে যে করেই হোক একটু ঝেড়েঝুড়ে চালাক বানাতে হবে। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি ছেলেকে এবার পাঁচশ টাকার একটা নোট দিলেন হাত খরচের জন্য। তার মতে যে টাকা খরচ করতে পারে সে টাকা কামাতেও পারে। আর টাকা কামানোই চালাক হওয়ার মূল উপায়। এদিকে ইমনের জীবদ্দশায় এই প্রথম ও একসাথে পাঁচশ টাকা পেয়েছে হাত খরচের জন্য। খুশিতে ও টাকাটা খরচ না করে বইয়ের ভিতর এক সপ্তাহ পর্যন্ত রেখে দিল। অবশেষে এক শুক্রবারের সন্ধ্যায় ও সুমনের সাথে বের হলো সেই নোটের কিছুটা খরচ করার উদ্দেশ্যে। সুমন ইমনের ক্লাসমেট। তবে সে ইমনের মতো বোকা না, আবার চালাকও না। সে হচ্ছে অতিচালাক পর্যায়ের প্রাণী। দু’জনে সাইকেল থাকা স্বত্তেও হেঁটে বেড়াচ্ছে। কারণ ইমন সাইকেলে চড়তে ভয় পায়। হাঁটতে হাঁটতে ওরা পাঁচ নম্বর লেনের মাথায় এলো। সুমন বলল, “দোস্ত, প্রচুর তৃষ্ণা পেয়েছে। একটা ঠান্ডা নে।“
“কিন্তু চল্লিশ টাকার ঠান্ডা কিনলে কি দোকানদার পাঁচশ টাকা ভাংতি দিবে?” দ্বিধাগ্রস্ত গলায় প্রশ্ন করলো ইমন।
“আরে হ্যা দিবে। তুই নে তো।“
সুমন সাইকেল নিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে রইলো আর ইমন গেল পাঁচ নম্বর লেনের প্রথম দোকানটায়।
“আংকেল পাঁচশ টাকা ভাংতি হবে?”
কথাটা শোনামাত্রই দোকানদার ক্ষেপে উঠলো। এমনিতেই সারাদিন ধরে বেচা কেনা নেই তার উপর এই পিচ্চি এসে কিনা পাঁচশ টাকা ভাংতি চায়!
“নাহ, হবে না।“ একটু রাগের সুরে বললো দোকানদার।
*কিন্তু একটা কোক নিতাম।“ অসহায়ত্ব মাখিয়ে বললো ইমন।
কথাটা শুনেই দোকানদার ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। এরকম চাহনি তিনি শেষবার দিয়েছিলেন এক হাতিকে। যখন সেটা এলাকার সব দোকান থেকে চাঁদা তুলছিল এবং তিনি না পারছিলেন হাতিটিকে কিছু কইতে না পারছিলেন সইতে।
ইমন তার চাহনি দেখে একটু ইতস্তত বোধ করে চলে এলো। দোকানদার পিছন থেকে ডাকলেও ও আর ফিরে তাকালো না।
“কিরে! কোক আনিস নি?”
“ভাংতি নেই এই দোকানে।“
“সামনের টায় গিয়ে দেখ তাহলে…..”
এবারও একই কাহিনী। ইমন প্রথমে ভাংতি চায়, পরে অসহায়ত্ব মাখিয়ে কোক চায়। দোকানদার ওর দিকে অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে তাকালে ও ফিরে আসে।
অবশেষে সুমন বলল, “এই তুই আমাকে নোটটা দে তো। কিভাবে ভাংতি না দেয় দেখি।“
সুমন লেনের শেষ দোকানটায় গেল। যেটায় মোটা এক মহিলা বসা।
“আন্টি একটা কোক দিনতো।“ রীতিমতো ঝাড়ি দিয়ে বললো সুমন।
ঝাড়ি খেয়ে মহিলা সুমনের দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। তিনি শেষবার এরকম চাহনি দিয়েছিলেন এক পাওনাদারকে। যিনি তার দোকানে এসে পাওনা টাকার জন্য চেঁচিয়ে গিয়েছিলেন।
মহিলা ফ্রিজ থেকে একটা কালো পানীয় বের করে দিলেন যেটা দেখতে অবিকল কোকের মতো হলেও কোক নয়। সুমন পাঁচশ টাকার নোট দিল, চারশত ষাট টাকা ফেরত পেল।
ইমন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ভালোভাবে পুরো ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো। ও বুঝে গেছে যে প্রথমেই ভাংতি চাইতে নেই। আগে সদাই কিনলে দোকানদার এমনিতেই ভাংতি করে দেয়।
পরের মাসের শুরুতেও আব্বাস সাহেব ছেলেকে পাঁচশ টাকার নোট দিলেন চালাক বানানোর উদ্দেশ্যে। ইমন আর এবার বইয়ের ভিতর টাকা ভাজ করে রাখলো না। পাওয়া মাত্রই চলে গেল মুদির দোকানে। দুই টাকা দামের দুইটা সেন্টার ফ্রুট নিয়ে দোকানদারকে পাঁচশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলো। দোকানদার ফ্যালফ্যাল করে ইমনের দিকে চেয়ে রইলো। তিনি শেষবার এরকম চাহনি দিয়েছিলেন এক গাধাকে। যখন সেটা চিড়িয়াখানার বেড়া ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল।
( সমাপ্ত )
লেখা: মোঃ ইয়াসিন