> রোদ শুভ্রর প্রেমকথন ৬, ১০ পর্ব - ভালোবাসার গল্প - নৌশিন আহমেদ রোদেলা
-->

রোদ শুভ্রর প্রেমকথন ৬, ১০ পর্ব - ভালোবাসার গল্প - নৌশিন আহমেদ রোদেলা



দুপুর ১২ টা...মার জোড়াজুড়িতে পা বাড়াতে হলো মামুর বাসার দিকে।।বাঙালীর হোম কোয়ারেন্টাইনের এক অন্যরকম ধরন।বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই একসাথে সো রান্নার আমেজটাও অন্যরকম।।তাইতো সকাল সকাল কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করে মার মনে পড়ছে ভাইয়ের কথা।।তার একমাত্র ভাইয়ের একমাত্র ছেলের কতো প্রিয় খাবার এটা!!!তাকে না দিয়ে খাওয়া যায়??একদম না....তাই বাটি ভর্তি বিরিয়ানি নিয়ে আমাকেই যেতে হলো শুভ্র ভাইয়ের বাসায়।আমাদের বাসা থেকে হেঁটে গেলে ১০/১৫ মিনিটের দূরত্ব.... খুব বেশি তো নয়!!মামুর ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো মামানি।।আমাকে দেখে সে ভীষণ খুশি...হাত থেকে বাটিটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গোসল সারতে বললো আমায়...বাইরে থেকে এসেছি যদি করোনা থাকে তো??এই মা জাতিকে কখনো "না" শব্দটা বলে আটকানো সম্ভব নয়....তাই আমাকেও গোসল করতে হলো।।আর গায়ে জড়াতে হলো মামানির একটি রঙচঙা ভাজ ভাঙা নতুন শাড়ি।।গোসল করে বের হতেই মামানি বলে উঠলো -
.
রোদ মা?যা না তোর শুভ্র ভাইকে একটু ডেকে তোল।।১২ঃ৩০ টার বেশি বাজে...এখনও কেউ ঘুমায় বল??এতোক্ষণে ঘুম থেকে উঠলে খাবে টা কখন ??বাপ ছেলে একরকম হয়েছে...জ্বালিয়ে খেলো আমায়।।যা না মা একটু ডেকে তোল।।
.
মামানির কথায় এবারও মানা করতে পারলাম না।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শহীদ হওয়ার জন্য বাঘের খাঁচার দিকে রৌওণা হলাম।।শুভ্র ভাইয়ার রুমে ঢুকেই আমি অবাক...ঘরের মধ্যে কেউ নেই...ওয়াশরুমেও নেই।।তাহলে গেলো টা কই??অদ্ভুত!!কপাল কুঁচকে পেছনের দিকে তাকাতেই কারো সাথে ধাক্কা খেলাম...শুভ্র ভাই!!আজ বুঝতে পারছি উনি ঠিক কতোটা লম্বা....আমার থেকে ডাবল তো হবেনই!! কপালে এসে পড়া চুলগুলো কানের কাছে গুঁজতে গুঁজতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি।।কি অস্বস্তিকর ব্যাপার...কি যে বলবো বুঝতেই পারছি না...উনি আমার সামনে থেকে সরে গিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বললেন-
.
এমন সঙ সেজেই রাস্তা দিয়ে আসা হলো নাকি??বাহ্ পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ তো জেনেই গেছে নিশ্চয় যে,, তোর লম্বা লম্বা চুল আছে??একটা কালো পেড়ে শাড়িও আছে...আর পিঠের ঠিক মাঝ বরাবর একটা কালো তিলও আছে.. তাই না?
.
উনার কথায় অবাক হলাম আমি।আমার পিঠে যে তিল আছে এটা তো আমারও জানা ছিলো না আর উনি জেনে গেলেন??কিভাবে?আচ্ছা... পুরো পৃথিবীর মানুষের কি আর কোনো কাজ নেই যে আমার পিঠের তিল খুঁজতে রাস্তায় চলে আসবে... আজিব!!আমি মুখ কাঁচুমাচু করে বলে উঠলাম -
.
পৃথিবীর সব লোক কি রাস্তায় আমার পিঠের তিল খোঁজার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো শুভ্র ভাই??তাছাড়া এখন কোয়ারেন্টাইন চলছে...রাস্তায় আর্মিরা ছাড়া আর কেউ নেই বললেই চলে।
.
ওহহো অসাধারণ!! তার মানে আর্মিদের জানিয়ে এসেছিস??
.
আশ্চর্য!! আমি কেনো জানাতে যাবো শুনি??এই শাড়িটা মামানির...এখানে এসেই পড়েছি।
.
ওহ মাই গড!! তুই আমার বাসায় এসেই আম্মুর শাড়ি দখল করে নিলি??এখন নিশ্চয় আমার রুম দখল করতে এসেছিস!! কি সাংঘাতিক মেয়েরে তুই...
.
আমি আপনার রুম দখল করতে যাবো কেন??(রাগী গলায়)
.
তাহলে কি আব্বু আম্মুর রুম দখল করবি? ?কি সর্বনাশের কথা।।এই শোন...এই বাড়িতে চারটি বেডরুম আছে...একটা আব্বু আম্মুর দখলে,,একটা গেস্টদের জন্য ওখানে তোর প্রবেশ নিষেধ,,আর একটা দিদার আত্মার জন্য...মাঝ রাতে বসে বসে তসবি পড়ে তো... শী নিড প্রাইভেসি...আর অবশেষে এলো আমার রুম...এটাই একমাত্র রুম যেখানে তুই আক্রমন করতে পারিস...আই ওন্ট মাইন্ড...বুঝলি না??আমি হলাম মহৎপ্রাণ ব্যক্তি...।।
.
আপনি একটা ছাগলের প্রাণ...যত্তসব আজাইরা।।মনে মনে কথাটা বললেও মুখে প্রকাশ করলাম না মোটেই।এই বলদের সাথে কথা বলা মানেই ঝগড়া...কোনো রকম মুখ কাঁচুমাচু করে বলে উঠলাম -
.
আমি কারো রুম দখল করতে আসি নি শুভ্র ভাই।আপনাকে বিরিয়ানি দিতে এসেছিলাম জাস্ট..আপনি আপনার মহৎপ্রাণ হৃদয় নিয়ে রুমে আরাম করুন ...আমি আসছি!!
.
কিসের আসছি?দাঁড়া এখানে...তোর সাথে খুব ইম্পোর্টেন্ট কথা আছে আমার।
.
কককি কথা??
.
এই তুই তো দেখি সাংঘাতিক মেয়ে....আমাকে নিয়ে ফেসবুকে উথাল পাথাল শুরু করে দিয়েছিস??আর আমি কতো নিরীহ প্রাণী, কিচ্ছুটি জানি না!!সেদিন পুষ্পিতা না বললে তো জানতামই না...জান্নাত নামের একটা মেয়েও বললো...রোদ আপু তো অসাধারণ লেখে...ভাইয়া ইউ হেভ টু রিড ইট।।আমি তো হতবাক...এই এই তুই আমার নামে কোনো ষড়যন্ত্র করছিস না তো??পাবলিক দিয়ে পিটুনী টাইপ??এভাবে মারতে পারিস নি তাই এখন অন্য পথ ধরেছিস??বুঝি তো...সব বুঝি!!সেদিনও আম্মুর হাতে পাত্রীর ছবি ধরিয়ে দিয়েছিলি...মা তো প্রায় বিয়ে করিয়েই ফেলেছিলো আমার!!আমি যদি হার্ট অ্যাটাক করে মরে যেতাম তখন কি হতো??
.
এই সিম্পল একটা বিষয়ে হার্ট অ্যাটাক করে মরে যাবেন?বিয়েই তো করতেন ফাঁসি তো আর চড়তেন না.....আমি তো জাস্ট মামানিকে হেল্প করছিলাম...উনিই তো বলেছিলেন আমায়,, আমি যেনো খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে খুঁজে বের করি..(মুখ ফুলিয়ে)
.
আহারে আসছে মামানি ভক্ত!!এক থাপ্পড়ে সব দাঁত ফেলে দিবো...আমার বিয়ে.. আমার মাথা ব্যাথা নেই তুই এতো লাফাচ্ছিস কেন শুনি??তুই তো পুষ্পিতাকেও পাত্রী দেখতে বলে দিয়েছিস...বেয়াদব মেয়ে।।
.
এই রাত্রী পাত্রী ঠিক কি কি বলেছে আপনাকে??(রাগী গলায়)
.
কি আর বলবে যা সত্য তাই বলেছে...পুষ্পিতা বললো " জামাইবাবু রোদের মাথার তার ছিড়ে গেছে...ও আপনার জন্য পাত্রী খুঁজছে" শুনেই আমার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম... কি সাংঘাতিক মেয়ে রে তুই....হাত ধোয়ে আমার পিছে পড়ে আছিস!!দুনিয়ার সবাইকে আমার কথা বলে বেড়াচ্ছিস....মারাত্মক!!
.
আমি শুকনো ঢোক গিলছি আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছি... আর এই রাত্রির চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছি।।শালী হারামখোর...উনি আবারও বলে উঠলেন-
.
এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে কি প্রমাণ করতে চাস তুই নির্দোষ??
.
উনার কথায় দাঁত কেলিয়ে জোড় পূর্বক হাসি দিলাম...মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়ছি।।ব্যাটা বিয়ে তো একদিন করতেই হবে...তো আজ করলে কি এমন ক্ষতি হবে শুনি??এমন ভাব করছে যেনো আমি তার মহাক্ষতি করে দিচ্ছি...আরে পাত্রীই তো খুঁজচ্ছিলাম।।তবু পেলাম টা কই??এই হারামি রাত্রীকে বললাম সে আমায় বাঁশ খাইয়ে দিলো।।ওই জান্নাতকে বললাম সে আমায় জোড়পূর্বক ভাবি বানিয়ে দিলো।।কিছু বলতে গেলেই ভাবি ডাকে...কেমনডা লাগে??আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো নখ খুঁটছি... উনি এবার উঠে দাঁড়িয়ে শার্টের হাতা ফোল্ট করতে করতে বলে উঠলেন-
.
আমি খেতে যাচ্ছি...আলমারিতে আমার দুটো শার্ট আর দুটো প্যান্ট আছে...ওগুলো ধোয়ে দিয়ে যাবি...এটাই তোর পানিশমেন্ট।। এসে যদি দেখি ধোওয়া হয় নি...তাহলে কঠিন মাইর ।।
.
আমি কাঁদো কাঁদো ফেইস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি উনি যেতে নিয়েও আবার ফিরে এসে বলে উঠলেন-
.
আর হ্যা...যাওয়ার সময় চুলটা বেঁধে যাবি।।দেখ..এমনি মানুষ করোনায় আতঙ্কিত...তোর এই পেত্মীর মতো চেহারা দেখিয়ে মানুষকে আর আতঙ্কিত করে দিস না...একটু দয়া কর...(হাত জোড় করে)
.
কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলেন উনি।।ইচ্ছে তো করছে ব্যাটাকে ধরে এই ব্রক্ষ্মপুত্রর পানিতে চুবিয়ে মারি...আমি পেত্মী??তুই পেত্মী.... তোর বউ পেত্মী...তোর বউয়ের চৌদ্দগোষ্ঠী পেত্মী।।নিজের মা-ই যদি পর হয়ে যাই তাহলে ভাগ্যে তো কাপড় ধোওয়ায় থাকবে।।আমার থেকে আমার মায়ের কাছে তার ভাতিজা প্রিয়....একমাত্র ভাতিজা বলে কথা!!শালা বজ্জাত...তোকে আমি খুন করবোই করবো...দেখে নিস। রাগে গজগজ করতে করতে আলমারি খুলতেই অবাক হলাম আমি।উপরের তাকেই একটা কাঁচের বক্স আর তাতে একটা হলুদ কাগজ আটকানো..সেখানে লেখা "just for puchki" লেখাটা দেখেই অবাক হলাম আমি...আমার জন্য!!ঝটপট বক্সটা খুলে দেখি...লাল,নীল,হলুদ,সবুজ,বেগুনি আর কালো রঙের ১২ টা করে কাঁচের চুরি।।চুরিগুলো দেখেই খুশিতে নাঁচতে ইচ্ছে করছে আমার...চুরিগুলোর পাশেই গুঁজা একটা সাদা কাগজ তাতে লেখা-
.
"কেউ কিনে দিলো না।সে কোথায়?কেউ বলো তাকে কিনে দিতে- 5 January 2020...এতো আহাজারি কেনো তোমার??যাও দিলাম কিনে..."
.
লেখাটা পড়ে আমি স্তব্ধ।এটা ৫ জানুয়ারিতে করা আমার পোষ্ট!!এখনও মনে আছে??ঠিক তখনই মামানি ডেকে উঠলো আমায়...হঠাৎ ডাকায় চমকে ওঠে হাত থেকে পড়ে গেলো কাঁচের বাক্সটা...তারপরই তুমুল ঝনঝন শব্দ... সারা ঘরময় ছড়িয়ে গেল কাঁচ আর চুরির টুকরো।।মামানি এসে হতবাক..." এসব কি??চুরি কোথা থেকে?" আমি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি...কান্না পেয়ে যাচ্ছে আমার।ঠিক তখনই মামানির পেছন থেকে শুভ্র ভাইয়া বলে উঠলেন-
.
তোমার পুত্রবধূর জন্য কিনেছিলাম....তোমাদের আদরের দুলালি ভেঙে দিলো সব।।
.
ইশশ...এভাবে বলছিস কেন??ও কি ইচ্ছে করে ভেঙেছে??কবে আসবে বউ তার জন্য দরদ উতলে উঠছে...সর এখান থেকে...
.
যাচ্ছি তো...কিন্তু ওর পায়ে কাঁচের টুকরো বিঁধলো কি না দেখো।(যেতে যেতে)
.
মামনি আমায় নিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসিয়ে দিলেন।।হাতে পায়ে চেইক করে চলেছেন ক্রমাগত...কোথাও লেগেছে কি না??আমি ফ্রিজড হয়ে বসে আছি।।আমি কি শুভ্র ভাইয়ের দেওয়া এমন গিফ্টে শকড্??নাকি চুরিগুলো ভেঙে যাওয়ায় কাতর??


রাত ১০ঃ১৭। ড্রেসিং টেবিলের টোলটাতে চুপচাপ বসে আছি আমি।আমার ঠিক পেছনে বিছানায় পা গুটিয়ে বসে আছেন বাবা।।পাশে তেলের কৌটো.....খুব মনোযোগ দিয়ে আমার মাথায় তেল লাগাচ্ছেন তিনি।।আমি আয়নায় বাবাকে দেখছি আর মিটিমিটি হাসছি।আমার জীবনে বাবাকে এই কাজটা শুধু আমার সাথেই করতে দেখেছি.....হয়তো বা বাড়ির ছোট মেয়ে বলেই এমনটা করেন উনি।।আপু পাশে চেয়ার টেনে বসে ফোন চাপছে ঠিক তখনই ভদ্র ছেলের মতো রুমে ডুকলেন শুভ্র ভাই।।উনাকে দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আমার....এতো রাতেও ঠিক ঠিক ড্যাং ড্যাং করে আমাদের বাসায় চলে এসেছেন উনি।ফাজিল ছেলে....ফুপির বাড়ি হলেই কি মাথা কিনে নিতে হবে নাকি??এখন নিশ্চয় ফাউল ফাউল কথা বলে মাথা ধরিয়ে দিবেন আমার?উনি আমার পাশে বেড সাইড টেবিলটাতে বসলেন।।বাবার সাথে কুশল বিনিময় করে আমার দিকে তাকিয়েই বলে উঠলেন-
.
হায়রে দুনিয়া!!আর কতো কি দেখাবি তুই রোদু?বোন কাপড় ঠিক করে দিচ্ছে....ভাই নিজের ফোন দিয়ে দিচ্ছে...বাবা মাথায় তেল দিয়ে বেনুনী গাঁথছে....মা খাবারের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে....ন্যাকামোর চূড়ান্ত।। তোকে দেখে মনে হয় এই দুনিয়াতে তুইই একমাত্র মায়ের পেট থেকে এসেছিস আর সবাই যেনো আকাশ থেকে টুপটাপ করে পড়েছে....
.
উনার কথায় রাগটা চরম আকার ধারন করলো আমার।আব্বু সামনে থাকায় কিছু বলতেও পারছি না আবার সহ্যও করতে পারছি না।।কি এক ঝামেলা!!আয়নায় তাকিয়ে দেখলাম আব্বু মুচকি হাসছেন।।আমি মুখ ফুলিয়ে বসে আছি।আমার চুপ থাকাতে শুভ্র ভাই যেন আরো সুযোগ পেলেন...একটু নড়েচড়ে বলে উঠলেন-
.
ফুপা?আপনার এই মেয়েকে নিয়ে কিন্তু ভীষন সমস্যায় পড়তে হবে আপনাকে....
.
উনার কথায় বাবা ভ্রু কুঁচকালেন তারপর হাসিমুখে বললেন... "কেন বাবা?" বাবার হাসিমুখ দেখে যেনো ভরসা পেলেন উনি।।বাবাকে আমার সব কাজিনরা বেশ ভয়ই পায়...একদম কাঁপাকাঁপি ভয় যাকে বলে।।ভয় না পাওয়ার মাঝে আছি আমি আর শুভ্র ভাই,,দুজনেই ত্যাড়ামোর চূড়ান্ত।উনি চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বলে উঠলেন -
.
না মানে...আপনার অতি আদরের গুণবতী কন্যার জন্য পাত্র খুঁজা বেশ ঝামেলার ব্যাপার হবে না??পঞ্চগুণ সম্পন্ন পাত্র লাগবে তার।।যে তাকে গুছিয়ে দিবে....তাকে খাইয়ে দিবে....মাথায় তেল দিয়ে দিবে...বেনুনী করে দিবে....ফোন টোন সব দিয়ে দিবে।তারওপর আবার রোজগার করেও খাওয়াবে।।এমন ছেলে কি এখন আর পাওয়া যায় বলুন??কতো দুষ্কর না?
.
বাবা তখন বেশ মনোযোগ দিয়ে বেনুনি গাঁথছেন চুলে....সেদিকে চোখ রেখেই কিছু একটা বলতে যাবেন ঠিক তখনই আপু দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলেন -
.
কাহিনী কি শুভ্র ভাই?রোদকে নিয়ে চিন্তায় তো দেখছি রাতে ঘুম হচ্ছে না আপনার।।ওর সিরিয়াল অনেক দেরীতে......সামনে দাঁড়ানো বোনজাতিদের ছেড়ে পেছনের দিকে এতো নজর...উহুম...রহস্যময় গন্ধ পাচ্ছি।
.
আপুর কথায় বিষম খেলেন উনি।।কাঁশতে কাঁশতে আমার দিকে তাকালেন আমিও দাঁত বের একটা ক্লোজ আপ হাসি দিলাম ।বেশ হয়েছে....আপু একদম উচিত জবাব দিয়েছে।।এবার বুঝো ঠেলা।শুভ্র ভাইয়া নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠলেন-
.
আআরে সন্দেহ কিসের?ফুপা দেখেছেন?রুহির কি কথা ফুটেছে....একে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে বিদেয় করুন তো।।আমি রোদের জন্য কই চিন্তা করছিলাম?আমি তো চিন্তা করছিলাম ফুপার জন্য ।তোদের বিয়ে দিতে কি ফুপার এতো বেশি কষ্ট হবে নাকি?শান্তি শিষ্ট মেয়ে তোরা....জামাই আসবে হুটহাট তুলে নিয়ে চলে যাবে কিন্তু আমাদের রোদ তো তা নয়....সে বরকে বিয়ের দিনও ল্যাং মেরে ফেলে দিতে পারে।।তাই বলছিলাম কি,ফুপা?রোদেকে আত্মীয় স্বজনের মাঝেই বিয়েটা দিলে ভালো হয় না?যে ওর সম্পর্কে সবকিছু জানবে...নয়তো বর তো প্রথম দিনেই দৌড়ে পালাবে।
.
উনার কথা শেষ হতেই আবারও দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো আপু-
.
শুভ্র ভাইয়া কথাটা কিন্তু ঠিকই বলেছে বাবা।এমন একটা ছেলে দেখতে হবে যে কিনা রোদকে চুরি কিনে দিবে,,পায়ে পায়েল পড়িয়ে দিবে,,হাতে বেলীফুলের মালা গুঁজে দিবে,,শরীরে তেল ছিঁটবে বলে রান্না করে দিবে আর....
.
এটুকু বলতেই আবারও কাশতে লাগলেন শুভ্র ভাইয়া।।আপুকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বিমল হাসি হাসলেন।।আমতা আমতা করে বলে উঠলেন -
.
না মানে ফুপা... রুহি তো খারাপ কিছু বলে নি।।এ এমন বিষয়গুলো ছেলের মাঝে থ থাকতেই পারে।।আশেপাশে আত্মীয় স্বজনের মাঝে কতো ছেলে.. হে হে...এদের মাঝে দদেখুন এসব সুপ্ত প্রতিভা বিদ্যমান আছে কিনা??
.
এবার আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।। উনি কিসের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে কে জানে?আড়চোখে আয়নায় বাবার মুখের দিকে তাকালাম....বাবা মুচকি হাসছেন....চুলে রাবারটা লাগিয়ে বেনুনিটা আমার সামনে ঝুলিয়ে দিয়ে শুভ্র ভাইয়ার দিকে তাকিয়েই বলে উঠলেন -
.
আত্মীয়দের মধ্যে কাকে ইন্ডিকেট করছো তুমি শুভ্র?যাকেই করো না কেন...সে পরে দেখা যাবে।মেয়ে তো আমার নিতান্তই বাচ্চা আগে বড় হোক.... তারপর নাহয় ভাববো।।
.
কথাটা বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন বাবা।।কিছুক্ষণ পর ফোন কানে নিয়ে বাঁকা হেসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আপুও বেরিয়ে গেলো...হয়তো আরাফ ভাইয়া ফোন দিয়েছে.....আহা,,কতো প্রেম!!শুভ্র ভাইয়া এবার বিছানায় গিয়ে বসলেন...পা দিয়ে টোলটা ঘুরিয়ে আমাকে সহ নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়েই বলে উঠলেন -
.
তোর বাপ আর তুই দুটোই হিটলার।।এতো বড় ধিঙ্গি মেয়ে আবার বাচ্চা হয় কিভাবে??১৮ টা বছর কি এমনি এমনি চলে গেলো??আমার বয়স কতো??২৪...তোর বাপের হিসেবে আমি নিশ্চয় কচি খোঁকা।।আরে নিজে বিয়ে করেছে ২২ বছরে....বাচ্চার বাপ হয়ে গেছে ২৪ বছরে...তো আমার বেলায় আমরা শিশু!!!
.
আমি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থেকেই চোখ বড় বড় করে বলে উঠলাম -
.
আপনি বিয়ে করতে চান?
.
আপনি বিয়ে করতে চান মানে কি?তুই কি বলতে চাস আমি বিয়ে করবো না??আমার বিয়ের বয়স হয় নি??
.
আমি এটা কখন বললাম?(অবাক হয়ে) আমি বলছিলাম যে...আপনি তো মাত্র মাস্টার্স করছেন...এখনই..
.
তো?আমি মাস্টার্স করছি তাতে তোর বাপের কি??মাস্টার্স করলে বিয়ে করা যাবে না??তুই আর তোর বাপ এক টাইপ।তোদের দুজনেরই আমার বিয়ে নিয়ে এতো মাথা ব্যাথা কেন?হুয়াই?তোরা কি চাস?আমি বিয়ে না করে চিরকুমার থাকি??
.
আমরা কখন এ কথা বললাম?আপনার বিয়ে করার ইচ্ছে থাকলে বিয়ে করুন।শুধু একবার কেন?মন চাইলে হাজারটা করুন...আমাদের কি??কথায় কথায় বাবাকে দোষ দেন কেন শুনি?(রাগী গলায়)
.
দোষ দিবো না তো কি করবো??তোর বাপের মতো শশুড় পাওয়ায় মসজিদে মসজিদে জিলাপী বিলাবো??ডাফার!!আর হাজারটা বিয়ে কেন করবো?তোর কি আমাকে ক্যারেক্টারলেস মনে হয়??তোর বাপ আর তুই কি এখন আমাকে ক্যারেক্টারলেস প্রোভ করতে চাস??
.
আশ্চর্য!! আমি কখন বললাম আপনি ক্যারেক্টারলেস?আর আমার বাপের মতো শশুড় বলতে কি বোঝাতে চাইছেন?আমার বাবাকে নিয়ে ফাজলামো করবেন না বলে দিলাম....
.
হুহ...আসছে বাপ দরদী...আর আমি তোর বাপকে নিয়ে ফাজলামো করতে যাবো কেন শুনি?আমি তো আমার শশুড়মশাইকে নিয়ে ফাজলামো করছি..
.
কথাটা বলে হালকা হেসে হেঁচকা টানে আমার ডান পা'টা কোলের উপর নিয়ে নিলেন উনি....পায়ের মাঝারি আঙ্গুলটাতে একটা সাদা মোটা আংটি পড়িয়ে দিয়ে আবারও পা টা সযত্নে যথাস্থানে রেখে দিলেন।।পাঞ্জাবীর হাতা ঠিক করতে করতে উঠে দাড়িয়ে আবারও বলে উঠলেন উনি-
.
ওটা খুলবি তো এক চড়।।তোর বাপের টাকা দিয়ে কিনি নি যে খুলে রেখে দিবি....আর হ্যা...তোর বাপকে বলবি...আমার জান নিয়ে যেনো এমন টানাটানি না করে....নয়তো তাকে সহ তুলে নিয়ে যাবো।।
.
কথাটা বলেই শিষ দিতে দিতে বেরিয়ে গেলেন উনি।।আমি "হা" করে তাকিয়ে আছি।।একবার পায়ের দিকে তাকাচ্ছি তো একবার উনার যাওয়ার দিকে ...বাবা উনার জান ধরে টানাটানি করছে মানে কি??কি বলে গেলেন উনি??


সন্ধ্যা ৬ টা ২০। সবাই ইফতার গোছাতে ব্যস্ত।বাসায় একদম উৎসবমুখর পরিবেশ।কোয়ারেন্টাইনের বিষন্নতা আমাদের ছুঁতে পারে নি একদম। ফুপ্পি,,মামু,,,মামানি সবাই এসে হাজির...আজ একসাথে ইফতার করবে সবাই।।বলতে গেলে ইফতার পার্টি।আপু আর আম্মু রান্নার দায়িত্বে আছে....আমি এটা ওটা করে সাহায্য করছি মাত্র....রোযায় খানিক কাহিল হয়ে গেছি বললেই চলে।আমার থেকেও কাহিল অবস্থা যার সে হলো জারিফ।বেচারার জীবনের প্রথম রোজা এটি... ফুপ্পি যে কতো কিছু বুঝিয়ে এখন পর্যন্ত ওকে সতেজ রেখেছে আল্লাহ মালুম।।আদিবা আর জারিফ দুজনেই শুভ্র ভাইয়ের গলায় ঝুলে আছে....আর উনি অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প শুনাচ্ছেন তাদের।। রোযা রাখলে আল্লাহ এতো গিফ্ট দিবে,, রাজপ্রাসাদ দিবে এসব বুঝিয়েও আদিবাকে রোযা রাখতে রাজি করতে পারেন নি উনি।।যে মেয়ে রাজপ্রাসাদের মানেই বুঝে না তাকে রাজপ্রাসাদের লোভ দেখিয়ে কি লাভ কে জানে??ভাইয়া হাতে কয়েকটা নিমের ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে....এতোগুলো মেসহাকের মধ্যে কোনটা দিয়ে দাঁত মাজবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে।।আমি ড্রয়িং রুমে বিশাল এক পাটি বিছাচ্ছি.... সবাই মিলে নিচে বসে খাবে এটাই বাবা আর মামুর অর্ডার।তাদের মূলতত্ত্ব হলো...."আমাদের মূল যেহেতু গ্রামের মাটির সাথে মিশে আছে সেহেতু আমাদেরও উচিত গ্রামীণত্বের সাথে মিশে থাকা।আর সব ভুলা যাবে কিন্তু ঐতিহ্য ভুলা যাবে না।" শুভ্র ভাই একটু দূরে সোফায় বসে ছিলেন...আমাকে ওঠে যেতে দেখেই পেছন থেকে ডেকে উঠলেন।আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও উনার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন -
.
তোর সমস্যা কি বল তো?
.
আমার আবার কি সমস্যা? (অবাক হয়ে)
.
কোনো সমস্যা না থাকলে আমার সামনে এভাবে ঘুরঘুর করছিস কেন?কাহিনী কি বল তো?আমার রোযা নষ্ট করার প্ল্যান নাকি তোর?তুই তো দেখি আমার জীবনে হিটলারনীর রোল প্লে করছিস।
.
উনার কথায় রাগে মেজাজ চটে গেলো আমার।।এমনি ক্ষুধার জ্বালায় বাঁচি না আরেকজন আসছে বেহুদা আলাপ ঝাড়তে।আমি হালকা বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলাম -
.
শুভ্র ভাই?আপনি নিজেকে এতো ইম্পোর্টেন্ট কেন ভাবছেন?আমার কি দুনিয়াতে আর কোনো কাজ নেই যে আপনার সামনে ঘুরঘুর করবো....দেখছেন না আমি পাটি বিছাচ্ছিলাম।।আর আমার সামনে আসা যাওয়াতে আপনার রোযা নষ্ট হতে যাবে কেন শুনি??
.
অবশ্যই নষ্ট হবে।। মেয়ে মানেই নষ্টের কারবার....এদের জন্য জীবন নষ্ট,,,সময় নষ্ট,,টাকা নষ্ট,, রোযা নষ্ট সব নষ্ট।।দেখ আর মাত্র ১১ মিনিট বাকি ইফতারের....এই ১১ মিনিটের মধ্যে আমার সামনে তুই আসবি না।।আর এই নুপুরের বিরক্তকর শব্দ তো একদমই তৈরি করবি না।।বুঝলি??
.
রাগে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে....মেয়ে মানেই নষ্টের কারবার?এতোবড় অপমান??রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কিছু একটা বলতে যাবো ঠিক তখনই উনি আমাকে শুনিয়ে জারিফকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন -
.
জারিফ শোন!!অলওয়েজ মেয়েদের থেকে দশহাত দূরে থাকবি।মেয়ে মানেই ঝামেলা বুঝলি?এই ধর তোর সামনে দিয়ে যাবে....তাতে কিন্তু তাদের যথেষ্ট মোটিভ থাকে....শুধু শুধুু কোনো কাজ করে না এরা...
.
মোটিভ মানে কি দাদাভাই??
.
মোটিভ মানে হলো উদ্দেশ্য!! তারপর শোন...
.
উনাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আদিবা ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো -
.
দাদাভাই?উদ্দেশ্য অর্থ কি?
.
এবার আমি হেসে উঠলাম।উনি বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন-
.
তোদের দুই ভাইবোন কে কিছু বলতে গেলে আমাকে ডিকশনারি নিয়ে বসতে হবে বুঝলি??
.
আদিবা আবারও উৎসাহ নিয়ে বলে উঠলো -
.
দাদাভাই দিকশনারি মানে কি?
.
ডিকশনারি মানে হলো একটা বই।আর একটা প্রশ্ন করবি তো তোর ভাগের চকলেট কাট।।সব জারিফকে দিয়ে দিবো।।আর জারিফ তুই??এতো প্রশ্ন করে মেয়েদের সামনে মান ইজ্জত খোয়াচ্ছিস কেন?চুপচাপ সব প্রশ্ন মুখস্থ করে রাখ....ইফতার শেষে চুপিচুপি উত্তর দিবো ওকে?
.
আচ্ছা দাদাভাই।(মুখ কালো করে)
.
ততক্ষণে পাটির উপর সব খাবার সাজানো শেষ প্রায়...পায়ের পায়েলটা অনেকটা খুলে যাওয়ায় ওটা লাগাতেই টি-টেবিলের উপর পা টা রাখলাম।।সেদিকে নজর যেতেই কৌতূহলী হয়ে পায়ের আঙ্গোটের দিকে ইশারা করে বলে উঠলো আদিবা-
.
ওটা কি দাদাভাই?
.
শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে আমার পায়ের দিকে তাকালেন।।তারপর ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন -
.
কি জানি চিনি না।।
.
আমি ওটা নিবো।(মুখ ফুলিয়ে)
.
নিবিই তো নিবি না?দুনিয়ার সব জিনিস হাতে ধরিয়ে দিলেও তোর নজর শুধু ওইদিকে।।তোরা সব কটা বোন তো এক টাইপ.... ত্যাড়ামোর চূড়ান্ত।। খুঁজে খুঁজে পায়ের আংটিও বের করে ফেলেছিস....কি বুদ্ধি তোদের...
.
কথাটা বলে রাগি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন -
.
এই তুই যাবি এখান থেকে?নাকি কানের নিচে মারবো?
.
আমি মুখ ভেঙিয়ে সেখান থেকে চলে আসতেই পেছন থেকে উনার গলা ভেসে এলো।।উনি আদিবাকে আঙ্গোটের অপকারিতা বুঝাচ্ছেন....ওটা নিলে যে তার কতোবড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে....তাই উনার আলোচনার প্রধান বস্তু।।কিন্তু ছোট্ট আদিবা এতো যুক্তি বুঝলে তো??তারও প্রশ্নের শেষ নেই...শুভ্র ভাইয়ের মুখের অবস্থা এখন " ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি" টাইপ।অবশেষে ইফতারের টাইম হলো...হৈ -হল্লোড় করে ইফতার শেষে হাত ধুতে গিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন উনি-
.
তোরা সবগুলো বোনই এতো ডেঞ্জারাস কেন?এর শোধ কিন্তু আমি নিবো বুঝলি??আমার বাচ্চাকে এর থেকেও ডেঞ্জারাস বানাবো.....তারপর হাতে প্রশ্নের লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বসিয়ে দিবো আদিবা আর জারিফের বাসরে।।সারারাত বসে বসে প্রশ্ন করবে....বেশ হবে না??
.
উনার এমন বাচ্চামো কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলাম আমি।।উনি কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলেন -
.
তোকে না এমন দাঁত বের করে হাসতে বারন করেছি??হাসবি না একদম....মুখ বন্ধ।।
.
আমি মাথা নেড়ে মুখ চেপে হাসতেই আবারও বলে উঠলেন উনি-
.
আমার প্রিন্সেসকে তোর সব খারাপ গুণগুলো শিখাবি রোদ।।এই দায়িত্ব তোর...একদম তোর কার্বন কপি হওয়া চাই।।চাই ই চাই।।
.
কথাটা বলে আমার ওড়না টেনে হাত মুছেই নামাযের জন্য চলে গেলেন উনি।।আমি পেছন থেকে উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি চুপচাপ।।এই নিঃশব্দ চাহনীতে আজও কতো প্রশ্নের ছড়াছড়ি....কতো উত্তরের অপেক্ষা!!


রাত ৮ টা কি ৯ টা বাজে, ছাঁদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশে রাফিয়া।রাফিয়া হলো আমার চাচাতো বোন।যেমন সুন্দরী তেমন ঢঙ্গী একটা মেয়ে।তবে আমার সাথে তেমন ঢং দেখায় না বলে তাকে নিয়ে আমার তেমন কোনো আপত্তি নেই।।ছাঁদের লাইট অন...রাফিয়া অন্ধকারে ভয় পায় তাই এমন ব্যবস্থা।নয়তো আমি কখনো লাইট অন করে ছাঁদে দাঁড়াই না। দুজনের গল্পের টপিকস হলো "কলেজের ইংরেজি স্যার"। ব্যাটাকে দেখে সব মেয়েই ক্রাশ। আমার ধারনা দেশের সব কলেজেই একজন করে ক্রাশ টিচার থাকেন যার দিকে মেয়েরা " হা" করে তাকিয়ে থাকে আর হা-হুতাশ করে।আমাদের আড্ডা যখন জমে এসেছে ঠিক তখনই ছাদে এলেন শুভ্র ভাই।।গায়ে কচুপাতা রঙের পাঞ্জাবি,, হাতা দুটো গুটিয়ে কনুই পর্যন্ত উঠিয়ে রেখেছেন। একহাতে একটা বই আর কিছু গোলাপ,হাসনাহেনা আর কি কি জানি ফুল আর অন্যহাতে মাথার টুপিটা বাজ করে ধরে রেখেছেন।আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েই ঝটপট বলে উঠলেন -
.
ওই রোদু?মা একটা বই চেয়েছে...কি জানি নাম?(কপাল কুঁচকে)ওহ হ্যা..."বার চান্দের ফজিলত" অর সামথিং। যা দৌড়ে গিয়ে বইটা নিয়ে আয় ...ফাস্ট।
.
আম্মুকে বলেন।আমাকে বলছেন কেন?আমি হাদিসের বই পড়ি নাকি?
.
তুই না পড়লেই এনে দেওয়া যাবে না?আমিও তো পড়ি না তবু তো নিয়ে যাচ্ছি নাকি? ফুপি নামায পড়ছে...তুই আয়..
.
আমি এখন পারবো না। রাফিয়ার সাথে গল্প করছি আপনি দেখে নিয়ে যান।
.
শুভ্র ভাই এবার রাফিয়ার দিকে তাকালেন।মুচকি হেসে বললেন-
.
আরে রাফিয়া নাকি?কেমন আছো?খেয়ালই করি নি।
.
শুভ্র ভাইয়ার কথায় রাফিয়া যেনো আকাশের চাঁদ পেয়ে গেলো।।খুশিতে গদগদ হয়ে বলে উঠলো -
.
জি ভাইয়া ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?
.
ভালো আর থাকি কি করে?যে পৃথিবীতে তোমার বোনের মত কেউ (আমাকে ইশারা করে)আছে সে পৃথিবীতে ভালো থাকার কোনো উপায় নেই।একদম ফাজিল মহিলা।
.
রাফিয়ার গদগদ ভাব দেখেই রাগ উঠে গিয়েছিলো আমার। এবার উনার কথায় যেনো রাগের উপর এক বালতি ঘি এসে পড়লো।।ইচ্ছে হচ্ছে চিবিয়ে খেয়ে ফেলি উনাকে।উনার কথা শুনে রাফিয়া খুশিখুশি মুখ নিয়ে বলে উঠলো -
.
ও একটু ওরকমই ভাইয়া।সবাই তো আর একরকম হয় না।।ওর কথা ছাড়ুন তো।।আপনি কিন্তু আগের থেকে আরো বেশি হ্যান্ডসাম হয়ে গেছেন ভাইয়া।(মুচকি হেসে)
.
রাফিয়ার কথায় রাগে মাথা ভনভন করতে লাগলো আমার।শুভ্র ভাই কথাটা শুনে একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়েই কেশে উঠলেন।কোনমতে নিজেকে ঠিক করে জোড়পূর্বক হাসি দিয়ে বললেন-
.
তুমি তো দেখি অনেক বড় হয়ে গেছো বোন।লাস্টবার যখন দেখেছিলাম তখন অনেক ছোট ছিলে।হয়তো সেভেন এইটে পড়তে।
.
হ্যা ভাইয়া।(লাজুক হেসে)সবাই একই কথা বলে।আমি নাকি আগের থেকে সুন্দর হয়ে গেছি।
.
শুভ্র ভাইয়া হাসলেন।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
.
এই রোদু চল না প্লিজ।।দেরি হয়ে যাচ্ছে তো...
.
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে হাত ভাঁজ করে রেলিং এ ঠেস দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম।ভ্রু হালকা কুঁচকে আছে আমার।কেনো জানে প্রচন্ড রাগ লাগছে....আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই পাশ থেকে রাফিয়া প্রশ্ন করে বসলো-
.
ভাইয়া?আপনার হাতে এতো ফুল কেন?
.
ওহ... এগুলো তিথি আপু দিয়েছেন।তীর্থর কাছে আমার একটা বই ছিলো ওটা আনতে গিয়েই তিথি আপুর সাথে দেখা।ছাঁদে নাকি ফুলের বাগান করেছেন ওখান থেকেই জোড় করে ফুল দিয়ে দিলো।
.
ওয়াও...ফুলগুলো অনেক সুন্দর তো।।গোলাপের রংগুলো কিন্তু বেশ হয়েছে.....আমি নিই?
.
নিবা?ওকে নাও।
.
কথাটা বলে দুটো ফুল ওর হাতে দিলেন শুভ্র ভাই।হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়েই হুট করে রাফিয়ার হাত থেকে ফুলগুলো কেঁড়ে নিলেন উনি।রাফিয়া অবাক হয়ে বলে উঠলো -
.
কি হলো?
.
না মানে।ফুলগুলো বাইরে থেকে আনলাম তো.. করোনা ভাইরাস থাকতে পারে।এগুলো নেওয়ার দরকার নেই তোমার।ভাই হয়ে তো বোনের এতো বড় সর্বনাশ করতে পারি না...তাই না??এগুলো আমার কাছেই থাকুক....(জোড়পূর্বক হাসি দিয়ে)
.
আমি একটা রাগী লুক নিয়ে উনার দিকে তাকিয়েই হাঁটা দিলাম।উদ্দেশ্য নিচে যাবো।।দু'পা এগিয়েই বুঝতে পারলাম পা থেকে পায়েলটা খুলে পড়েছে...তবু দাঁড়ালাম না আমি...যার পায়েল সেই ই নিয়ে যাক...চাই না আমার।পেছন থেকে রাফিয়া ডেকে বলে উঠলো -'"এই রোদু?তোর খুলে পড়লো তো!'" আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ নিচে নেমে এলাম।রুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম আম্মু এখনও নামায পড়ছে...আপু বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ফোন ঘাটছে....ভাইয়া আর আব্বুও নিশ্চয় যার যার রুমে।কেন জানি রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না আমার...রুমের বাতাসটা বিষাক্ত লাগছে খুব।গুটি গুটি পাশে গেস্টরুমের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখান থেকে আকাশটা বেশ পরিষ্কার দেখায়।।হঠাৎ করেই পেছন থেকে কেউ একজন হাত টেনে ধরলো।আমি আঁতকে উঠে পেছনে তাকাতেই দেখি শুভ্র ভাই।আমাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে নিচে হাঁটু ভেঙে বসলেন উনি।বাম পায়ে হাত দিতেই ছিটকে সরে গেলাম আমি।উনি রাগী চোখে একবার তাকিয়েই শক্ত করে পা'টা ধরে নিজের হাঁটুর উপর রেখে খুব যত্নে পায়েলটা পড়িয়ে দিলেন।আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি।কোনো কথা নেই মুখে।উনি উঠে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলে উঠলেন -
.
এতো রাগ কেন তোর?কথায় কথায় রেগে যাস.....।
.
আমি উনার কথার জবাব না দিয়ে উনাকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিতেই আমার হাত ধরে আবারও রেলিং এর গা ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে দিলেন।রেলিং এর উপর দুইহাত রেখে খানিকটা ঝুঁকে বলে উঠলেন -
.
যেতে বলেছি আমি?চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।দুটো ফুলের জন্য এতো জেলাস হওয়ার কি আছে?জেলাসি ভাবটা একটু কমা বুঝলি...নয়তো জ্বলে পুড়েই মরে যাবি।
.
কথাটা বলে একটা ফুল আমার কানে গুঁজে দিয়ে বাকিগুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন -"নে,সব তোর।" আমি কোনো কথা না বলে ফুলগুলো নিচে ফেলে দিলাম।উনি এবার শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডানহাতটা শক্ত করে চেপে ধরলেন।মনে হচ্ছিল এই বুঝি মট শব্দ করে ভেঙে যাবে হাত।।ব্যাথায় আত্মা কেঁপে উঠছে বারবার।তবু আমি চুপ।একটা টু শব্দও বের হলো না মুখ থেকে।কেন কে জানে??উনি এবার একহাতে গাল দুটো চেপে ধরে বললেন-
.
কথা বল!কথা বলিস না কেন?এখানে কি বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকার জন্য দাঁড় করিয়ে রেখেছি তোকে?এতো তেজ ভালো লাগে না রোদু।আমার রাগ উঠাবি না বলে দিলাম....
.
আমি এবারও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম...গালের চোয়াল যেনো ভেঙে চুরমার হয়ে খুলে পড়ে যাবে এখনই...উনি আবারও কিছু বলতে যাবেন তখনই ডায়নিং থেকে আম্মুর কন্ঠ কানে এলো।।আমি উনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ডায়নিং এর দিকে হাঁটা দিলাম।পেছন থেকে উনার কন্ঠ ভেসে আসছে কানে-"রোদু?এই রোদু?আরে বাবা শোন না!!আমি কি করেছি? এমন করছিস কেন?রোদু?"
.
.
ডায়নিং এ বসে আছি।টেবিলের এক কোনায় আমি আমার ঠিক সামনে রুহি আপু।টেবিলের আরেককোনায় শুভ্র ভাই।শুভ্র ভাইয়ার সামনের চেয়ারে ভাইয়া। রাফিয়া হেলে দুলে হেঁটে শুভ্র ভাইয়ের পাশের চেয়ারটাতে বসে পড়লো।গা জ্বলানো হাসি দিয়ে শুভ্র ভাইয়ার সাথে গল্প জমাতে লেগে গেলো।।শুভ্র ভাই হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ালো.... আম্মু অবাক হয়ে বললেন-"কি রে?কি হলো?উঠলি কেন?খাবারই তো দিলাম না এখনও..!" উনি মুচকি হেসে বললেন-" একটা কল আসছে ফুপ্পি... কথা বলে আসছি" প্রায় পাঁচমিনিট পর ফিরে এসে আমার আর ভাইয়ার মাঝে যে চেয়ারটা ফাঁকা ছিলো তাতে বসে পড়লেন শুভ্র ভাই।রাফিয়া ব্যস্ত হয়ে বললো-"আরে ভাইয়া?আপনি তো এখানে বসে ছিলেন" শুভ্র ভাই মুচকি হেসে বললেন-
.
" ওহ, তাই নাকি?ভুলে গিয়েছিলাম বোন।ব্যাপার না একজায়গায় বসলেই হলো...খাওয়াটা ইম্পোর্টেন্ট...বসাটা নয়...তুমি খাওয়াতে কনসেন্ট্রেট করো বনু"
.
কথাটা বলে খেতে শুরু করতেই রুহি আপু হেসে বলে উঠলো-
.
আহা! রাফিয়া?তুই খেয়াল করেছিস?শুভ্র ভাই তোকে কতো আদর করে...এক সেন্টেন্সে দু'বার করে বোন ডাকছেন।কি ভাগ্য তোর।এদিকে আমাদের রোদুকে দেখ....বেচারীকে কিন্তু বছরেও বোন ডাকেন না উনি...ভুলেও না।।আহারে...শুভ্র ভাইয়ের আদরটা তুই পেলি না রোদু...কষ্ট!!
.
শুভ্র ভাই আবারও বিষম খেলেন।রাগী চোখে আপুর দিকে তাকিয়ে বললেন-
.
রুহি রে...বোন আমার চুপ হয়ে যা।এমনি তো কথা বলিস না যখন বলিস তখন একদম ছুঁড়ি ঢুকিয়ে দিস।একটু চুপ যা,, নয়তো ওই ফার্মের মুরগীর সাথে বিয়েতে আমি ভাঞ্জী দিবো কনফার্ম।
.
আপু দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলে উঠলো -
.
আমি ছুঁড়ি ঢুকাতে যাবো কেন?আমি তো জাস্ট বলছিলাম রোদুর কপাল খারাপ.... একমাত্র মামাতো ভাইয়ের আদর পেলো না....আমাদের কতো আদর করেন অথচ ওকে!!আহারে...কষ্ট।
.
এবার যদি চুপ না করিস তো গ্লাস ছুঁড়ে মারবো বলে দিলাম।সবার আদর একরকম হয় না.....আদরের ক্লাসিফিকেশন আছে বুঝলি?
.
ওওওও....তো রোদ কোন কেটাগরিতে পড়লো??(দাঁত কেলিয়ে)
.
আমি চুপচাপ খাচ্ছিলাম...আপুর এসব কথায় প্লেটটা নিয়ে চুপচাপ উঠে চলে এলাম।পেছন থেকে শুভ্র ভাইয়ার কন্ঠ ভেসে উঠলো। ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলছেন উনি-
.
ভাই?এই জঞ্জাটটাকে বিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বিদেয় করো তো।।হারামিটা অলওয়েজ বেশি কথা বলে....ওর বিয়ে হলে সব ঝামেলা শেষ...রাস্তা একদম পরিষ্কার...
.
আমি সোফায় পা গুটিয়ে বসে বসে খাচ্ছি আর ভাবছি,,কি বললেন উনি?আদরের ক্লাসিফিকেশন?? আদরের ক্যাটাগরি থাকে নাকি?অদ্ভুত!!



রাত ১০ টা। সব কাজিনরা মিলে বসেছি ছাদে। উদ্দেশ্য আজকের রাতটা গল্পের আড্ডায় কাটিয়ে দিবো। সেহেরী খেয়ে তারপর ঘুমাতে যাবো সবাই, এর আগে নয়,,কিছুতেই নয়। আমাদের সাথে পুচকো দুটোও বসেছে আড্ডার আসরে। গল্পের টপিক হলো "বিয়ে"। গল্প করতে করতে গল্পের মোড়টা এলো আমার বাবা-মায়ের বিয়ের দিকে। সবচেয়ে রোমান্টিক এন্ড কিউট প্রেমের কাহিনী ছিলো আমার বাবা-মার। মামাতো ভাইয়ের সাথে বেশ ভালোই প্রেমে মেতেছিলো মা।।পরবর্তীতে পরিবারের সিদ্ধান্তে বিয়ের কাজটা শেষ হয় তাদের। আমার এক বড় ভাইয়া এই গল্পটুকু বলা শেষ করতেই সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো।। আমি অস্বস্তি নিয়ে বলে উঠলাম-
.
কি হলো?আমার দিকে তাকাচ্ছো কেন?
.
আলিফ ভাইয়া সরু চোখে তাকিয়ে বলে উঠলেন -
.
তোকে বেশ সন্দেহ সন্দেহ লাগছে রে রোদু।। রুহির তো বয়ফ্রেন্ড আছে।। ও বিয়ে ওই বয়লার মুরগীকেই করবে। কিন্তু তুই??কাকিমনিও কিন্তু বাড়ির ছোট মেয়েই ছিলো।।
.
উনার কথায় সবার সন্দেহ যেনো প্রখর থেকে প্রখরতর হলো। আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেনো আমি কোনো ভিনগ্রহী প্রাণী।। আমি মুখ কাঁচুমাচু করে বলে উঠলাম -
.
আলিফ ভাইয়া?তুমি কিন্তু বেশি বলছো।। ঘটনার পুনর্বৃত্তি বারবার হয় না।। সো চুপ থাকো।আজগুবি পেঁচাল পারবা না।
.
আমার কথা শেষ হতেই পাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো রাফিয়া ।।আমরা সবাই চমকে ওর দিকে তাকাতেই বলে উঠলো সে-
.
রোদু রে...বিশ্বাস কর! এখন আমারও কেমন সন্দেহ সন্দেহ হচ্ছে। নয়তো তোর মতো মাইয়ার এখনও বিএফ নাই কেন??
.
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো সে-
.
তারমানে শুভ্র ভাই!!শুভ্র ভাই ছাড়া তো তোর আর কোনো মামাতো ভাই নাই।।হে মাবুদ!!শেষমেষ শুভ্র ভাই আমার দুলাভাই??
.
রাফিয়ার কথায় চারপাশে যেনো বজ্রপাত হলো।।চারপাশে পিনপতন নীরবতা।।রাফিয়া অলওয়েজ রং জায়গায় রং কথা বলে এটা তার অভ্যাস।।এতোক্ষণ সবাই মজা করলেও ওভাবে নেয় নি ব্যাপারটা কিন্তু রাফিয়া যেন ঢোল ফাঁটালো।সবাই একবার আমার দিকে তো একবার শুভ্র ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছে।।লজ্জায় আর রাগে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। শুভ্র ভাই এতক্ষন রেলিং এ ঠেস দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে গেইম খেলছিলেন।।কিছুক্ষন পর চুয়িংগাম চিবুতে চিবুতে বলে উঠলেন উনি-
.
এই? তোরা কি আমার দিকে তাকিয়ে আছিস??
.
আদিবা ফটাফট জবাব দিয়ে দিলে-
.
হু দাদাভাই।ছব্বাই ১, ২,৩,৪...... পনেলো জন।
.
জারিফ সাথে সাথেই আদিবার মাথায় চাটি মেরে বলে উঠলো -
.
চুপপ...গাধী!! এখানে ১৫ জন নয় ১০ জন।
.
শুভ্র ভাইয়া ঠোঁট কামড়ে ভ্রু দুটো কুঁচকে গেইমে আরেকটু মনোযোগী হয়ে উঠলেন। কয়েকসেকেন্ড পড়ে হঠাৎই বলে উঠলেন -"ওহ্ শীট!!ড্যাম ম্যান" তারপর ফোনটা পাশে রেখে সিল্কিচুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে পেছনে ধাক্কা দিয়ে শার্টের ওপরের দুটো বোতম খোলে কলার ঝাঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন -
.
প্রচুর গরম পড়েছে আজ।হয়তো বৃষ্টি হবে। (আমাদের দিকে তাকিয়ে) কি রে?তোরা এখনও এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? অদ্ভুত!! তোদের চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে তোদের সবার বউ ভাগিয়ে নিয়ে চলে গেছি আমি....আর তোদের জামাইদের হাটে বেঁচে এসেছি।।এভাবে তাকাবি না...অন্যদিকে তাকা।।বিয়ে করবো বলে যাকে সন্দেহ করছিস তাকালে সে তাকাবে,, তোরা তাকাস কেন?অন্যের জামাইয়ের দিকে এমন আবুলের মতো তাকিয়ে থাকিস, লজ্জা করে না??
.
উনার কথায় ফিক করে হেসে উঠলো সবাই।।আমি চুপচাপ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছি।।এতোক্ষণে হালকা-মৃদু বাতাস বইছে চারপাশে।।হঠাৎ করেই তনিমা আপু বলে উঠলেন...
.
দাদাভাই?সত্যি রোদকে বিয়ে করবা তুমি??
.
তনিমা আপুর কথায় বিষম খেলাম আমি।।উফফ...বারবার আমার টপিকই কেনো টানছে ওরা??এই মাটিটা ফাঁক হচ্ছে না কেন??তাহলেই তো তার মাঝে ঢুকে গিয়ে কিছুটা নিস্তার মিলতো আমার।।শুভ্র ভাইয়া উদাসী গলায় বলে উঠলেন -
.
তোর ননদীনিকে বিয়ে করবো তনিমা।
.
সাথে সাথেই পাশ থেকে অদুত ভাই বলে উঠলেন -
.
আমার তো কোনো বোন নাই শুভ্র।কারে বিয়া করবি তুই?(অদুত ভাই আমার জেঠাতো ভাই।তনিমা আপুর সাথে তার প্রেম প্রায় দু'বছরের)
.
শুভ্র ভাই এবার ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন -
.
নাই নাকি?খুঁজে দেখ...আছে নিশ্চয়।বিয়ে তো আমি তোর বোনকেই করবো তা যেভাবেই হোক।
.
অদুত ভাইও ভ্রু কুঁচকালো।।তারপর কি ভেবে হেঁসে উঠলেন।।তনিমা আপু,,আপু,, রাফিয়া সহ আরো কয়েকজন গেলো আম ভর্তা করতে।।আলিফ ভাই আর ভাইয়া গেলো বাগানের গাছ থেকে আম পাড়তে....আর অদুত ভাই আর তুষার ভাইয়া গেলো সিগারেট টানতে।।বলতে গেলে একে একে সবাই পাঁচ দশমিনিটের ব্রেকে চলে গেলো।।জারিফ আদিবা উঠে দৌঁড় দিতেই আমিও উঠতে গেলাম।।তার আগেই হাত টেনে বসিয়ে দেওয়া হলো আমায়।।কাজটা শুভ্র ভাই ছাড়া কেউ করেনি বুঝতে পেড়েই রাগী চোখে তাকালাম। উনি কিছুই হয় নি এমন ভাব নিয়ে বলে উঠলো -
.
কই যাস?
.
নিচে যাবো হাত ছাড়ুন।
.
হাত ধরেছি নাকি?ওহ শীট!!সরি রে। তবে ধরেই যখন ফেলেছি তখন আর ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।।এখন মুড নেই বুঝলি?কিছুক্ষণ পর মনে করিয়ে দিস।।মুড থাকলে ছেড়ে দিবো।।
.
আমি রাগ নিয়ে হাত ছাড়াতে গেলেই আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন উনি।।চুয়িংগাম চিবুতে চিবুতে বলে উঠলেন -
.
এক্টু বেশি বেশি করে হরলিক্স খা বুঝলি?তোর হাইট তো মাত্র ৫।আর আমি ৬ ফুট ২। তোর থেকে পুরো ১ ফিট ২ ইঞ্চি লম্বা।। আমার গলা পর্যন্ত পৌঁছাতেই তো তোর তিনদিন লাগবে রে।।
.
উনার কথায় রাগটা চরম আকার ধারন করলো আমার।।একটু লম্বা বলে এতো বড়াই??আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলাম-
.
আপনার গলা পর্যন্ত পৌঁছানোর কোন ইচ্ছে আমার নেই।।হাত ছাড়ুন বলছি নয়তো কামড়ে দিবো।
.
ওহ মাই গড্। তুই তো ওদের বিয়ের ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছিস।এখনই কামড়াকামড়ি??
.
আমি রাগে লাল হয়ে বসে আছি৷ উনি যে ইচ্ছে করেই ফাঁদে ফেলছেন আমায় তা বেশ বুঝতে পারছি।।তাই এই নীরবতা... কোনো ভাবেই উনার ফাঁদে পা দেওয়া চলবে না।।কিছুতেই না।।আমাকে এভাবে চুপ করে বসে থাকতে দেখে মুচকি হেসে ফু দিয়ে সামনের চুলগুলো উড়িয়ে দিয়ে বললেন-"পাগলী!" তারপর শার্টের পকেট থেকে বের করলেন হিজল ফুল।।হাত ভর্তি লাল টকটকে হিজল ফুল এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। আমার ধরে রাখা হাতটি টেনে কোলে নিয়ে হিজলফুলের মালা জড়াতে লাগলেন হাতে....তার সাথে সাথে গলা কাঁপিয়ে আবৃত্তি করে উঠলেন-
.

তোমায় দিলাম অযুত জারুল ফুল,
তোমায় দিলাম হিজল ফুলের বন,
রোজ নিশীথে একলা থাকার কালে,
আমায় দিও খানিক তোমার মন।
আমায় দিও একটুখানি ছায়া,
একটু দিও শান্ত শীতল জল,
তোমার জন্যে বুকের ভেতর তবু,
সাত সাগরের অশ্রু টলমল।
আমার ভোরের আলোকজুড়ে দ্বিধা,
আমার সকাল বিষণ্নতায় ঠাসা,
একজনমের রাত্রি-দিবসজুড়ে,
তোমার নামেই নিত্য যাওয়া আসা।
আমায় দিও একটুখানি ছুঁয়ে,
আমায় দিও একটুখানি মন,
এই জনমের জন্ম-মৃত্যু জানে,
তুমি মানেই আমার সমর্পণ।
___ সাদাত হোসাইন
.
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি।উনার কন্ঠটা এমনিতেই সুন্দর তারমাঝে এই কবিতা!!কবিতার প্রতিটি লাইনে যেন নিজের সবটা আবেগই ঢেলে দিয়েছেন উনি।। আমাকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে উঠলেন উনি-
.
বাসার পাশে যে হিজল গাছটা আছে...আজ প্রথম ফুল ফুটেছে তাতে।।জানিস?কতো কষ্ট হয়েছে মালা গাঁথতে?ইশশ আঙ্গুলগুলো সুঁচের গুঁতোই কাহিল!!এই এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন??প্রেমে পড়ে যাবি তো....পরে বিয়ে করতে মন চাইবে.....আমি আবার খুব আবেগী মানুষ বুঝলি...রাজী হয়েও যেতে পারি।।তখন আমাকে সারাজীবন তোর মতো পুতুল টাইপ মেয়ের জামাই হয়ে থাকতে হবে।।তাই বলছি, প্রেমে পড়ে আমার এতোবড় সর্বনাশ করিস না।
.
আমি হাতটা টেনে নিয়ে বলে উঠলাম -
.
প্রেম আর আপনার? কোনো কালেই না।।আমি বরং এক কাজ করি রাফিয়াকে কনগ্রাচুলেশনটা জানিয়েই দিই....সে তো আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেই....বিয়ের শখটাও জেগে গেছে নিশ্চয়....আর আপনি তো খুব আবেগী মানুষ নিশ্চয় রাজি হয়ে যাবেন?রাফিয়া একদমই পুতুল টাইপ না...কপালটা এবার খুলে গেলো আপনার।
.
আমার কথায় মুচকি হাসলেন উনি।।চুলগুলো ঝাঁকিয়ে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলে উঠলেন -
.
আহারে...রাজি হতে পারলে বেশ হতো বুঝলি।।বাট জ্বলন্তী কন্যা, রাজি হওয়ার সিস্টেমটা খারাপ হয়ে গেছে বুঝলি?ইচ্ছে থাকলেও উপায় নাই।।মন, মেজাজ, শরীর সবকিছুই অন্যদিকে ডাইবার্ট হয়ে গেছে।।তাছাড়া আমার মা জননীর আবার পুতুল টাইপ বউমা চায়,,যেনো তার নাতিপুতি সব পুতুলের মতো গুলুমুলু হয়....এজ ইউজাল "" মায়ের হুকুম শিরধার্য "" টাইপ ছেলে আমি।।তো পুতুল টাইপ ছাড়া বিয়ে করি কেমনে বল?(চোখ টিপে)
.
আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলাম।নিচ থেকে কথার আওয়াজ আসছে...সবাই নিশ্চয় ছাদে ফিরছে??উনি হুট করেই একটানে মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে দুইগালে হাত রেখে কপালে হাল্কা ঠোঁটে চুমু একে দিলেন।ধীর কন্ঠে বললেন-"চুলটা বেঁধে নে" কথাটা বলেই উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের এক কোণায় কার্নিশ ঘেষে দাঁড়ালেন উনি।কানে হেডফোন গুঁজে উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।এমন ভাব যেন কিছুই হয় নি...কিচ্ছুটি না।।আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি...এরমধ্যে সবাই এসে গেছে।।আমি মালা জড়ানো হাতটা ওড়নার নিচে লুকিয়ে বসে আছি চুপচাপ। গলা শুকিয়ে কাঠ!! সবার হৈ-হুল্লোড়ে কেনো জানি সঙ্গ দিতে পারছি না একদম।।চোখে জমে চলেছে বিন্দু বিন্দু জল।।কিসের জল কে জানে??



NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner