একটা ডকুমেন্ট ফটোকপি করার জন্যে গতকাল ফটোকপির একটা দোকানে যাই। দোকানে খুব বেশি ভিড় ছিলো না। ফটোকপি করার দায়িত্বে যিনি ছিলেন, তাকে বেশ ভদ্র এবং বিনীত গলায় আমি বললাম, 'ভাই, যদি একটু তাড়াতাড়ি কাজটা করে দেন তো খুব উপকার হয়। একটু পরেই ব্যাংকিং আওয়ার শেষ হবে। সময়মতো না যেতে পারলে তারা আমার কাজটা করতে চাইবে না আর'।
আমার অনুরোধটুকু তার কাছে কেমন লাগলো বলতে পারবো না, তিনি বেশ কটমটে চেহারায় এবং বিতৃষ্ণ গলায় আমাকে বললেন, 'এতো তাড়াহুড়ো করলে পারবো না ভাই। সময় দেন। আমার পরিচিত লোক এখানে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কাজ রেখে আপনার কাজ করে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়'।
আমি তার কথাটায় একটু দমে গেলাম বটে, তবে তার শব্দচয়নটা আমার মাথায় কীভাবে যেন গেঁথে গেলো। তিনি যদি আমাকে বলতেন, 'আপনার আগে আসা লোকও এখানে অপেক্ষা করে আছে। তাদের কাজ না করে আপনার কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়', তাহলে আমি বেশ খুশিই হতাম। কিন্তু তিনি আমাকে সেভাবে বলেননি। তিনি বললেন যে, তার পরিচিত লোকের কাজ রেখে আমার কাজ করে দিতে তিনি অপারগ।
যাহোক, তিনি তার সুবিধামতো সময়েই কাজটা করে দিলেন আমাকে।
তবে, তিনি যে দোকানে ফটোকপি মেশিন নিয়ে বসেছিলেন বা যে লোকের অধীনে তিনি কাজ করেন সেখানে, ঘটনাচক্রে ওই লোক আমার পূর্ব-পরিচিত এবং আমাদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
বেশ অদ্ভুতভাবে, আমি যখন ওই দোকান থেকে বের হতে গেলাম, ঠিক তখনই সেখানে আমার ওই বন্ধু, অর্থাৎ দোকান-মালিক এসে হাজির হলেন এবং আমাকে দেখামাত্রই তিনি বেশ সরস গলায় বললেন, 'আরে, ভাইসাহেব যে, কখন এলেন? আপনাকে তো আজকাল দেখাই যায় না। কী খবর, কেমন আছেন বলুন।'
যদিও আমার খানিকটা তাড়াহুড়ো ছিলো, কিন্তু বিনয়ের খাতিরে তাকে উপেক্ষা করে যাওয়া সম্ভবপর ছিলো না বলে আমাকেও মজে যেতে হলো খানিকটা খোশ আলাপে।
আমাদের খোশ আলাপের প্রাক্কালে, আমি খেয়াল করলাম ফটোকপি মেশিনের দায়িত্বে থাকা লোকটা, যিনি খানিক আগেই আমার সাথে অবজ্ঞা সহকারে কথা বলেছিলেন, তিনি বেশ ভ্যাবাচেকা খেলেন যেন। তার চোখেমুখে বিস্ময় এবং চেহারায় বিপন্ন অবস্থা। বিস্ময়ের কারণ বোধকরি তিনি কল্পনাতেও ভাবেন পারেন নি যে— একটু আগে যার সাথে কড়া ভাষায় কথা বলেছিলেন সে তার মালিকের বন্ধু মহলের কেউ হয়ে যাবে। আর, বিপন্ন বোধ করার কারণ হতে পারে এই— তিনি মনে করেছেন আমি খানিক আগে তার রূঢ় আচরণের ব্যাপারে তার মালিকের কাছে অভিযোগ জানাবো এবং এতে করে তার চাকরিটা আবার চলে যায় কি-না!
মানুষের এই আচরণটা আমার কাছে বড্ড অদ্ভুত লাগে! সবাই নিজ নিজ চেয়ারে নিজেদের এতো প্রতাপশালী ভাবে যে— নিতান্ত সৌজন্যতাবোধ এবং মানবিকতাটুকুও তাদের মধ্য থেকে লোপ পেতে শুরু করে। আমি তার পরিচিত হলে তিনি কিন্তু ঠিকই আমার কাজটা দ্রুততা সহকারে করে দিতেন তাতে যদি আমার আগের দশ জনকে অপেক্ষা করিয়ে রাখতে হতো— তবুও। অথবা, আমি যদি দোকানে ঢুকেই তাকে দোকান মালিকের পরিচয় দিতাম এবং বলতাম যে— আপনার মালিক আমার ঘনিষ্ঠজন, তখন কিন্তু সে নিজের চেয়ার ছেড়ে আমাকে বসতে দিতো এবং দরকারে আপ্যায়ন করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতো। কাজের টাকা তো নিতোই না, দিতে গেলেই লজ্জায় পড়ে যেতো।
এই যে দুটো অবস্থায় দু'রকম আচরণ, এই দ্বিচারিতা মানুষ কেনো করে?
আমার ধারণা— অন্তরে তাকওয়ার অভাব থেকেই সাধারণত মানুষ এমনটা করে থাকে। মানুষ ভাবে— কেবল মসজিদে গেলেই মনে হয় তারা আল্লাহর পর্যবেক্ষণের আওতায় আসে শুধু। অথবা, সালাতে দাঁড়ালেই। এর বাইরে, দুনিয়ার আর বাদ বাকি যা কিছু তারা করে, এসবের কোনোটাই মনে হয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা তদারকি করেন না বা তিনি সেসবে নজরও দেন না। এমন ধারণা থেকেই মানুষ ইবাদাতের বাইরে অনেকবেশি অন্যায়, অনাচার, যুলুম করে থাকে।
কিন্তু, এই ধারণা অবশ্যই ভুল। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা যে আমাদের ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখেন, আমাদের ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ— সকল কর্মকান্ডই যে তার পর্যবেক্ষণের বাইরে নয়, সুরা আল-হাদীদে সেটা খুব পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে।
'তোমরা যেখানেই থাকো না কেনো, আল্লাহ সারাক্ষণ তোমাদের সাথে আছেন এবং তোমরা যা-কিছুই করো, তা সম্পর্কে তিনি অবশ্যই ওয়াকিবহাল'- আল হাদীদ ০৪
আমরা যা-কিছুই করি, তা কখনোই আল্লাহর নজর এড়ায় না। পরিচিত নয় বলে আমি একজনের সাথে রূঢ় আচরণ করলাম, তাকে কড়া ভাষায় জবাব দিলাম, তার কাজ দ্রুত করে দেওয়ার অবকাশ থাকলেও করে দিলাম না, অন্যদিকে যখন সেই অপরিচিত লোকটা মালিকপক্ষের পরিচিত হয়ে উঠে, তখন ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকলাম— এসব কি আল্লাহর নজর এড়ায়?
কোন কাজ আমি আজকে করে দেওয়ার এখতিয়ার রাখি, কিন্তু জবাবে বললাম, 'আজকে হবে না। অন্যদিন আসেন'। অথচ, যখন অফিসের বস ফোন করে বলেন, 'অমুকের কাজটা দ্রুত করে দেন', তখন কিন্তু সুড়সুড় করে আমি তার কাজটা করে দিই। একটু আগে যাকে জবাবে 'হবে না' বলেছিলাম, বসের ফোন পেয়ে যখন সেই একই কাজ আমি মিনিট কয়েকের মধ্যে সেরে দিই, আমার ওই মুহূর্তের দ্বিচারিতা কি আল্লাহর নজর এড়ায়?
আমাদের সামান্য অবহেলা, সামান্য অবজ্ঞা, সামান্য খবরদারি— কোনোকিছুই আল্লাহর নজর এড়ায় না। এমন টুকরো টুকরো বিষয়গুলো যখন কিয়ামতের দিন আমার জন্য আল্লাহর দরবারে অভিযোগ হিশেবে জমা হবে, কতোখানি ভারি হবে সেই অভিযোগের পাল্লাটা, ভাবা যায়?