> রোদ-শুভ্রর প্রেমকথন স্পেশাল পর্ব ৬, ১০ - ভালোবাসার গল্প - নৌশিন আহমেদ রোদেলা
-->

রোদ-শুভ্রর প্রেমকথন স্পেশাল পর্ব ৬, ১০ - ভালোবাসার গল্প - নৌশিন আহমেদ রোদেলা

বিশ বিশটা বার কান ধরে উঠবস করে যখন বাসায় ফিরলাম তখন রাত বাজে ---- ৯ঃ১৫। বাসায় এসে রুমে ঢুকতেই দেখি বিছানায় বেশ আয়েশ করে বসে আছে আপু। তারহাতে সাদা একটি কাগজ। আমাকে দেখেই কিছুটা ভাব নিয়ে কাগজটা মুখের উপর ধরে উচ্চকন্ঠে পড়তে লাগলো সে।

শ্যামলতা,

তুমি কি জানো? বর্ষাকাল প্রেমে পড়ার জন্য একটি আদর্শ সময়। এই সময় বৃষ্টির প্রাণোচ্ছ্বলতার সাথে মিশে যায় প্রেয়সীর মন মাতানো রূপ। শান্ত,স্নিগ্ধ ঘোর ধরানো সব। কিন্তু আমার ক্ষেত্রেই সবকিছু ব্যতিক্রম। আমি কোনো ঢালা বর্ষায় নয়, কোনো এক শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে প্রেমে মত্ত হয়েছি। বাচ্চা বাচ্চা চেহারার বড় বড় চোখ! অবাক করা চাহনী আর দুই ঠোঁটের মায়াবি হাসি। কি ভয়ানক একটি দিন ছিলো সেদিন! সেই রাতের কথা ভাবলেও কেঁপে উঠি আমি। "ভালোবাসা" -- নামক শব্দটা যে এতো যন্ত্রণা ধরায় সেদিনই জানতে পারি আমি। একটুতেই ভয় পেয়ে কেঁপে উঠা। আমাকে দেখেই চোখে-মুখে পালিয়ে যাওয়ার আকুতি, আরো বেশি পাগল করে তোলে আমায়। তাকে দেখার পর থেকেই দুটো রোগে আক্রান্ত হয়েছি আমি। প্রথমত প্রেমরোগ যার ঔষধ শুধুমাত্র সে-ই। অন্যটি হলো কালোরোগ। অবাক হচ্ছো? হলেই বা কি? রোগের উৎপত্তি তো তুমিই, শ্যামলতা। সেদিন রাতে কি পড়েছিলে মনে আছে তোমার? কালো রঙের জ্যাকেট আর কালো প্লাজু...সেই মুহূর্ত থেকে "কালো" রঙটাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রঙ বলে মনে হয় আমার। অন্যকোনো রঙ যেন চোখেই পড়ে না। কি একটা সর্বনাশ করে দিলে আমার! এখন দিন নেই রাত নেই হুটহাটই কালো রঙে মোড়ানো শ্যামলতাটাকে দেখতে ইচ্ছে হয় আমার। আরো কিছু ইচ্ছে করে... বলবো? না থাক, তুমি লজ্জা পাবে। আমি চাই না, তুমি চিঠি পড়ে লজ্জা পাও। তাহলে এই কাগজের টুকরোটির উপরও খুব হিংসে হবে আমার। লজ্জা পেলে আমার সামনে পাবে। দেখতে হলে শুধু আমিই দেখবো। দেখেছো? কি পরিমান হিংসুটে হয়ে গেছি আমি। তুমি খুব খারাপ শ্যামলতা। খুব খারাপ!এই যে দেখো, মায়ের এই লক্ষ্মী ছেলেটাকে কিভাবে নষ্ট করে চলেছো তুমি। তোমাতে এতো নেশা কেন শ্যামলতা? প্রতিটি মুহূর্তে এতো দমবন্ধ অনুভূতি নিয়ে কেনো আসো তুমি? জ্যোস্না ভরা রাতে ঠিকরে পড়া চাঁদের আলোয় আবারও কালো শাড়িতে মোড়ানো শ্যামলতাকে দেখতে চাই আমি। তার জন্যই আমার দমবন্ধকর সব প্রস্তুতি।

আমি...

চিঠিটা পড়ে চোখ তুলে তাকালো আপু। চোখদুটো চিকচিক করছে ওর। আপুর মতি গতি তেমন একটা সুবিধার ঠেকছে না আমার। আর শুভ্র ভাইয়ের দেওয়া চিঠিটাই বা কোথায় পেলো আপু? আমি একটা ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আপু বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে আমার সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,

--- কি? এই আমি টা কে? 

আমি না বোঝার ভান করে বললাম,

--- আম্মুর বড় মেয়ে।

আপু অবাক হয়ে বললো,

--- মানে? 

আমি চুড়ি খোলে রাখতে রাখতে বললাম,

--- তুমি কি জিজ্ঞেস করেছো?

--- আমি জিগ্যেস করেছি, আমি কে?

--- আমিও তো সেটাই বলছি। তুমি হলে আমার বাবার জ্যেষ্ঠ কন্যা, আমার ভাইয়ের দুইমাত্র বোনের বড়জন, আরাফ ভাইয়ার হবু বউ এবং আমার হবু বরের হবু বড় আপা। 

আপু কনফিউজড হয়ে বললো,

--- কিসব ফালতু কথা বলছিস তুই? এই চিঠিটা কে লিখেছে সেটা বল।

আমি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,

--- আমি কি জানি? চিঠি তোমার হাতে। চিৎকার করে করে পড়ছিলেও তুমি তাহলে আমি কি করে জানবো? 

আপু রেগে বললো,

--- এই একদম আমাকে ওভারটেক করার চেষ্টা করবি না। তলে তলে এসব করে বেড়াস তুই? আর আমি কিচ্ছু জানি না?

আমি শাড়ির পিন খুলতে খুলতে বললাম,

--- আমি তলে তলে কিচ্ছু করি না।তাই তুমি কিছু জানো না আপু। আমি যা করি সব প্রকাশে।

আপু আমার দিকে অবিশ্বাস্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

--- মিথ্যুক!একদম মিথ্যে কথা বলবি না। আরাফ আমাকে বলেছিলো, " রুহি?  আমার বিশ্বাস রোদ অবশ্যই কারো সাথে রিলেশনে আছে।" কিন্তু আমি? এই অধম! বোনের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখে তাকে ঝাড়ি দিয়ে দিয়েছি, অথচ আজ? 

আমি ওয়াশরুমের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললাম,

--- আহারে! কষ্ট! 

--- এই , একদম চুপ। ফাজিল মেয়ে। শুভ্র ভাইও বলেছিলো তোর ওপর নজর রাখতে। আমি তো ভেবেছিলাম তুই শুভ্র ভাইয়ের প্রতি ঝুঁকে আছিস কিন্তু এখানে তো টোটালি অন্য কাহিনী....তলে তলে "আমি-তুমি" চলছে অথচ আমি এক বান্দা যে কিনা কিচ্ছু জানি না?কিচ্ছুটি না? এই শাড়িটাও নিশ্চয় ওই ছেলেটাই দিয়েছে? মামানির বাসায় যাওয়ার নাম করে নিশ্চয় ওই ফাজিল ছেলেকে কালো শাড়ি দেখিয়ে এলি? 

আমি ওয়াশরুম থেকে বের হতেই চুপ করলো আপু। ইমোশনাল হয়ে বললো,

--- নিচে যে ছেলেটার সাথে কথা বললি সেই ছেলেটাই বুঝি তোর বয়ফ্রেন্ড? আমি বারান্দা থেকে দেখেছি। দেখতে তো ভালোই, আমাকে এটলিস্ট বলতে পারতি। ইউ হার্ট মি রোদু! 

আপুর কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। নিচে কোন ছেলের সাথে কথা বলেছি মনে করার চেষ্টা করলাম। কয়েক সেকেন্ড ভাবতেই ইভা আপুর ভাই ইভান ভাইয়ার কথা মনে পড়লো আমার। উনি শুভ্র ভাইয়ের বন্ধু। গেইটের কাছে দেখা হয়ে যাওয়ায়, "কেমন আছি?" এটুকুই জিগ্যেস করেছিলেন শুধু। পাশে শুভ্র ভাইয়াও ছিলেন হয়তো অন্ধকারে দাঁড়ানোতে তাকে চোখে পড়ে নি আপু। আমি গায়ে কাঁথা টেনে চোখ বন্ধ করে বললাম,

--- যত বকবক করার করতে থাকো বাট আম্মুর কানে গেলে খবর আছে। আরাফ ভাইয়ার নামে এমন বাজে বাজে কথা বলবো... তোমার বিয়েটা খট করে ভেঙে যাবে, হুম।

--- কিহ! তুই আমাকে থ্রেড দিচ্ছিস? এই দিনটিও দেখতে হলো আমায়? দাঁড়া, কালকেই শুভ্র ভাইকে তোর রিলেশনের কথা বলবো আমি। উনি তো চৌদ্দ দুনিয়ার সবাইকে বলে দিবেন। তখন বুঝবি মজা...বিএফের জন্য বোনকে ধমকি? নাহ, এটা আমি মানবো না। কিছুতেই না।

সেদিন রাতে চুপ করলেও পরের দিক বিকেলে যথারীতি শুভ্র ভাইকে বিচার দিয়ে দিলো আপু। বাসার কম্পিউটারে কিছু প্রবলেম দেখা দেওয়ায় শুভ্র ভাইকে ডেকে পাঠিয়েছিলো ভাইয়া। তখনই সুযোগ বুঝে শুভ্র ভাইয়ের হাতে চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে ইচ্ছে মতো বকবক শুরু করে দিলো সে। শুভ্র ভাই চিঠিটা দেখে হতবাক। বিস্ময় নিয়ে একবার আমার দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তেই হালকা কেশে উঠলেন উনি। আমিও খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলেও হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। লজ্জা আর হাসি দুটোকে ঢাকতেই অন্যদিকে মুখ ফেরালাম । শুভ্র ভাইয়ের অবস্থা তখন "ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি!" টাইপ লজ্জায় মাথায় উঠাতে পারছে না বেচারা। চিঠিতে যায় লেখা হোক না কেন, আমার সামনে কখনো এই টাইপের কথা বলেন না উনি তাই হয়তো এতো লজ্জা উনার। এদিকে আপুর মুখের দোলাই তো আছেই। আপু যদি জানতো ওর এতো সুন্দর সুন্দর কথাগুলো সামনে বসে থাকা মানুষটার জন্যেই তাহলে নির্ঘাত এখানেই হার্ট অ্যাটাক করতো সে। কারন শুভ্র ভাই শুধু আমার নয় আপুর জন্যও ভয়ের জম। এক পর্যায়ে, আপুর কথার মাঝেই উঠে দাঁড়ালেন শুভ্র ভাই। আমার হাতে চিঠিটা গুঁজে দিয়ে হালকা কেশে আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

--- বোন রে? চুপ যা। এভাবে ছেলেটাকে গালি দিলে তোর বোন বিয়ের আগেই বিধবা হয়ে যাবে। প্রেমই তো করতাছে করতে দে না। তুই তোর ফার্মের মুরগীরে সামলা।  দয়া করে আমার কান খাস না।

আপু অবাক হয়ে বললো,

--- শুভ্র ভাই? আপনি এ কথা বলছেন? রোদকে কিছুই বলবেন না আপনি? 

--- আমি কি বলবো? তুই যে সারাদিন ফার্মের মুরগী নিয়ে থাকিস তোরে কিছু বলেছি? তাহলে ওকে বললে কেমন দেখায় না? প্রেকটিক্যালি চিন্তা কর। তোর বোন এখন বড় হয়েছে ক'দিন পর বিয়ে হয়ে বাচ্চার মা ও হয়ে যাবে, এখন কি আমার কিছু বলা সাজে? তার থেকে তুই তোরটার কাছে যা আর তোর বোন...তোর বোনের কোথাও যাওয়ার দরকার নেই সে ঘরেই থাকুক কিন্তু আপাতত তুই সামনে থেকে যা বোন। প্লিজ...

হাসিতে পেট ফেটে যাচ্ছিলো আমার। শুভ্র ভাইকে এই প্রথম লজ্জা আর অস্বস্তিতে পড়তে দেখলাম আমি। কোনোরকম ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ফোনে মুখ গুঁজে বসে রইলাম। আপু যেতেই শুভ্র ভাইয়া দাঁতে দাঁতে চেপে বললেন,

--- আই সয়ার!  এতো গালি জিন্দেগীতে কেউ দেয় নি আমায়। তোর বোনটাকে কবে যে চান্দে পাঠাবো আমি আল্লাহই ভালো জানে। 

আমি কিছু বললাম না। শুভ্র ভাই রুম থেকে বেরুতেই হাসিতে ফেঁটে পড়লাম আমি। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাওয়ার অবস্থা আমার। তবে, শুভ্র ভাইকে লজ্জা পেলে ততটা খারাপ লাগে না বরং একটু বেশিই কিউট লাগে!



"বিরক্তি"---শব্দটাই আস্ত এক বিরক্তির ডিব্বা। সারাদিনে লক্ষবার বিরক্ত হই আমি। আমি এমন একটা মেয়ে যে কিনা নিজের রুম থেকে বের হয়ে ব্যালকণিতে যেতেও বিরক্ত হই। আর ভাগ্যক্রমে এইসব বিরক্তিজনিত বিষয়গুলো কেবলমাত্র আমার সাথেই ঘটে। আজও ঠিক তাই হলো। কয়েকদিন যাবৎ মনটা বেশ খারাপ। সেই সাথে রাতের ঘুমও হারাম।   সারারাত জেগে উপন্যাস পড়ে সকালের দিকে ঘুমোতে যাই। যার ফলাফল হিসেবে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দশটা। ফ্রেশ হওয়ার পর খাওয়া নামক যে বিষয়টি আছে তাতেও আমি চরম বিরক্ত ! সেই সাথে আতঙ্কিত। তাই খাবারটাকে অপশনাল সাবজেক্টের ভীরে ফেলে রেখেছি সেই অনেকদিন থেকে । অর্থাৎ,আম্মু বাসায় থাকলে আমার খাওয়া হয় নয়তো নয়। খাবার দেখলেই কিছুদিন যাবৎ কান্না কান্না পায়  কিন্তু মা-জননীর জন্য কাঁদতে কাঁদতেই খাবার গিলতে হয়। আপু একটু শুকনো বলেই হয়তো আমাকে গুলুমুলু গোল আলু বানানোর এতো পরিকল্পনা আম্মুর। সে যায় হোক, প্রতিদিনের মতো আজও পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিলাম। ঘড়িতে তখন ----- ১০ঃ১৫ কি ১০ঃ১৬ । ঘুমের মাঝেই কেউ একজন টেনে হিঁচড়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো আমায়। ভাত মাখিয়ে মুখের সামনে ধরে বললো,

--- হা কর।

আমি চোখ পিটপিট করে তাকালাম, আম্মু! সাথে সাথেই রাজ্যের বিরক্তি হানা দিলো আমার গায়ে। কোনোরকম বললাম,

--- ফ্রেশ তো হতে দাও। দাঁতও তো ব্রাশ করি নি।

আম্মু আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললেন,

--- তোর ফ্রেশ হতে দু'ঘন্টা লাগবে ততক্ষনে খাওয়ার কথা ভুলে যাবি। এখন আমি সময় পেয়েছি সো আগে ভাত খা, ঔষধ খা তারপর দাঁত ব্রাশ করবি না গোসল করবি সেটা আমার দেখার বিষয় না। কি হলো? বলদের মতো বসে আছিস কেন? হা কর!

আমি কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে "হা" করলাম। আমার আম্মু শুধু কথায় নয় কাজেও আমার আম্মু। একবার যে কথা বলবে সেই কথার কোনো নড়চড় হবে না। অর্থাৎ, এখন যেহেতু উনি ভেবে নিয়েছেন আমাকে খাওয়াবেন তারমানে খাওয়াবেন। ধম ফোঁটা হয়ে মরে গেলেও খাওয়াবেন, ব্যস! এইদিক থেকে শুভ্র ভাই আর আম্মুর ব্যাপক মিল। দু'জনেই ঘাড়ত্যাড়া। আমার ধারনা, এই ত্যাড়ামো নামক গুণের জন্যই আম্মু শুভ্র বলতে পাগল। আমি দু-তিনবার খাবার মুখে নিতেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো আপু। কাঁচা হলুদের মধ্যে সবুজ সুতোয় কাজ করা জামা পড়েছে সে। ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। এমনিতেই সাদা ফর্সা গায়ের রঙ গোসল করে ফর্সা ভাবটা যেন বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। আমি অবাক চোখে তাকালাম। মুখের খাবারটা গিলে নিয়ে বললাম,

--- এতো সকালে গোসল! কোথাও যাচ্ছো আপু?

আপু দায়সারা উত্তর দিলো,

--- হুম, যাচ্ছি। তবে একা নয় সাথে তুইও যাচ্ছিস।

আপুর কথায় মন খারাপ ভাবটা স্পষ্ট। তবে,এই মুহূর্তে আপুর মন খারাপ ভাবটা তেমন একটা ভাবালো না আমায়। আমি বিস্মিত গলায় বললাম,

--- কি? আমি যাচ্ছি মানে কি? কোথায় যাচ্ছি?ইম্পসিবল! আমি কোথাও যাচ্ছি না।

আম্মু শান্ত গলায় বললো,

--- তোর মামানি তৃষাল যাচ্ছে। ওইযে, শুভ্রর নূরজাহান খালামনির নাম শুনিস নি? হাইস্কুলের টিচার যে...উনাদের বাসায়। তোদের দু'জনকেও সাথে নিবে। খাওয়া শেষ করে ঝটপট রেডি হয়ে যা।

আমি অসহায় মুখে আপুর দিকে তাকালাম। আপুর মুখটাও ইতোমধ্যে  বাংলার পাঁচের আকার ধারন করেছে।  আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,

--- চরপাড়া থেকে তৃষাল!! অনেক সময় লাগবে আম্মু। আমি যাবো না। অনেক কাজ আছে আম...

আম্মু ঝাঁঝাঁলো গলায় বললো,

--- তোর কাজ তো ওই এক ফোনেই।এদিকে দুনিয়া ভেসে যাক, পারেলে কিয়ামত হয়ে যাক সেইদিকে কোনো মাথা ব্যাথা নেই তোর? কি লাভ এই ফোন নিয়ে বসে থেকে? কি লাভ? ইচ্ছে তো করে ফোন নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে আসি। বাপের আদরে সবকটা দিন দিন অসামাজিক জীব হয়ে যাচ্ছে। আমি একটা কথাও শুনতে চাই না। তোদের মামানি নিয়ে যেতে চাইছে তো যাবি, ব্যস।

কথাটা বলে খাবারগুলো মুখে ঠুসে দিয়ে প্ল্যাট হাতে বেরিয়ে গেলেন আম্মু। আপু মুখ কালো করে পাশে বসেই বলে উঠলো, 

--- শেষ রক্ষা আর হলো না, বুঝলি?

আমি অবাক হয়ে বললাম,

--- কেনো?

আপু কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

--- কেন মানে? শুভ্র ভাইয়ের আংকেলের কথা জানিস না তুই?ব্যাটার কাজই হলো ঘটকালি করা। একজন গভমেন্ট অফিসারের এমন স্বভাব মানায়, বল? আমাদের মতো প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য মূর্তমান আতঙ্ক উনি। দেখিস, যাওয়ার সাথে সাথেই ঘটকালী শুরু করে দিবেন। উনাকে দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের সব ইয়াং ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেওয়ার মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন উনি। যত্তসব!

আমি কিছু বললাম না। রেডি হয়ে এতোটুকু রাস্তা যেতে হবে কথাটা মনে হতেই মনটা বিরক্তিতে তেতো হয়ে যাচ্ছে আমার। আপুর মতো ঘটকালি জাতীয় টেনশনটা আপাতত নেই। বিরক্তির নিচে চাপা পড়ে জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত তারা। আর যদি ঘটকালি করেই বসেন তাতেই বা ক্ষতি কি? বিয়ে করা তো আহামরি কোনো বিষয় নয়। জাস্ট তিনবার কবুল বলে জ্বালানোর জন্য আস্ত একটা মানুষ পেয়ে যাওয়াটা তো দুঃখে বুক ফাঁটানোর মতো কিছু নয় বরং পরম আনন্দের। এমন হাজারও কথা মাথায় নিয়ে ওয়াশরুমে দরজা দিলাম আমি। ফ্রেশ হয়ে  কালো আর লালের মিশ্রণে একটা গাউন পড়ে নিয়ে ধীরে স্থিরে তৈরি হয়ে আপুর দিকে তাকালাম। আপুর মুখটাতে কাঁদো কাঁদো ভাব। ওকে দেখে মনে হচ্ছে, এখনই ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাকে আর সেই দুঃখে ভয়ানক রকম দুঃখী সে। কিছুক্ষণ পরই মামানি এলেন। শুভ্র ভাই গাড়ি আনতে গেছেন। শেষ মুহূর্তে আদিবাকেও সাথে নেওয়া হলো। গাড়িতে উঠার সময় একবার শুধু আড়চোখে তাকালেন শুভ্র ভাই। আর আমি? উনাকে প্রথমদিন দেখে যেমন ৮০ ভোল্টেজের ক্রাশ খেয়েছিলাম আজও তাই খেলাম। উনি কালো শার্ট পড়েছেন। চোখে-মুখে অসম্ভব রকম স্নিগ্ধতা। চোখ সরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাটাই যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি। মনে মনে আয়তুল কুরসি পড়তে লাগলাম, এতে যদি রক্ষা হয়! কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। মাথার ভেতর প্রেমভোমরাটা ভনভন করে ছুটতে লাগলো তার নিজস্ব গতিতে। আমি ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে সিটে গা এলিয়ে দিলাম। আচ্ছা? এই লোকটি কি জানে না? গায়ে কালো রঙ জড়ানোটা তারজন্য মারাত্মক এক অপরাধ! মামানির বোনের বাসায় ঢুকতেই দেখা হলো নূরজাহান আন্টির সাথে। এই মহিলাকে এর আগেও দু-একবার দেখেছিলাম আমি। আমাদের দেখে যে উনি সীমাহীন খুশি হয়েছেন তা তার চোখে-মুখে স্পষ্ট। আমরা সোফায় বসতেই আমাদেরকে কিভাবে আপ্যায়ন করবেন তা নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন উনি। কিছুক্ষণ পরই রুম থেকে বেরিয়ে এলেন মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক। মুখে অমায়িক হাসি। লোকটি যে যৌবনে হাজারও মেয়ের দীর্ঘশ্বাসের কারণ ছিলেন তা তার চেহারার শক্ত ভাজে অনেকটাই স্পষ্ট। গালের চাপা দাঁড়ি আর ছোট করে কাঁটা মাথার চুলগুলোতে পাক ধরেছে মাত্র। উনি আমাদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে সোফায় বসতে বসতে বলেন,

--- আসসালামু আলাইকুম, শরিফা। কেমন আছো? অনেকদিন পর দেখা...

মামানিও হাসিমুখে বলেন,

--- ওয়ালাইকুম সালাম, দুলাভাই। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

--- আছি ভালো। এটা তোমার ছেলে বুঝি? এত্তোবড় হয়ে গেছে? বাপরে...আমার থেকেও উঁচু হবে মনে হয়। কোথায় পড়াশোনা করছো বাবা?

শুভ্র ভাই হাসিমুখে বলেন,

--- চুয়েট-এ পড়ছি। মাস্টার্স লাস্ট টার্ম। এই বছরই শেষ হতো কিন্তু এই মহামারীর জন্য আটকে গেলাম। 

--- বাহ, গুড গুড। আমি তো চিটাগাং পড়তাম। তবে চুয়েট এ নয় চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে। তোমাদের মতো ইঞ্জিনিয়ারিং টিঞ্জিনিয়ারিং আমার মাথায় ঢুকতো না। তো লাস্ট সেমিস্টারে রেজাল্ট কেমন?

শুভ্র ভাইয়া ইতস্তত করে বলেন,

--- ৩.৯৪ আঙ্কেল।

লোকটি সরু চোখে তাকান। মুগ্ধ গলায় বলেন,

--- ব্রিলিয়ান্ট! এনিওয়ে, ওরা কারা? তোমাদের নাম কি মা?

আমরা নাম বলতেই, কে কোথায় পড়াশোনা করি তার খুঁটিনাটি জিগ্যেস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন উনি। আপু ইঞ্জিনিয়ারিং করছে শুনে চোখমুখ চকচক করে উঠে উনার। বিস্ময় নিয়ে বলেন,

--- তুমিও ইঞ্জিনিয়ারিং করছো? বাহ্! দেখতেও তো মাশাআল্লাহ। 

শুভ্র ভাইয়া বাঁকা হেসে বলেন,

--- দেখতে হবে না কার বোন? শুভ্রর বোন বলে কথা ,সবকিছুতেই মাশাআল্লাহ! 

লোকটি হাসেন। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলেন,

--- তা যা বলেছো। সুদর্শন পুরুষের সুন্দরী বোন বলে কথা! কিন্তু ও তোমার কেমন বোন হয়? চিনতে পারলাম না ঠিক।

শুভ্র ভাই স্বাভাবিক গলায় বলেন,

--- আমার একমাত্র ফুফাতো বোন।

লোকটি অবাক হয়ে বলেন,

--- সে কি! রুহি তোমার ফুপ্পির মেয়ে? চেহারায় মিল নেই একদম। তবে, রোদলাকে দেখে বুঝা যায় ও অরিয়ানার মেয়ে। চেহারায় বেশ মিল। কিন্তু, রুহিকে একমাত্র ফুফাতো বোন বললে কেন? রোদ-রুহি যে বললো ওরা দুইবোন! 

মামানি হেসে উঠেন।  শুভ্র ভাই সোজা হয়ে বসে খুব স্বাভাবিক গলায় বলেন,

--- রোদকে তো নদীর পাড় থেকে কুড়িয়ে এনেছে আংকেল। তাই ওর প্রতি বোন বোন ফিলটা আসে না। মাঝে মাঝে তো এটাও ভুলে যাই যে ওকে সবাই ফুপ্পির মেয়ে বলে চেনে।

শুভ্র ভাইয়ের কথায় চোখ-মুখ লাল করে তাকাই। সাথে সাথেই ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠেন শুভ্র ভাইয়ার আংকেল। কিছুক্ষন একটানা হেসে নিয়ে হাসি থামিয়ে মামানিকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

--- তোমার ছেলে তো দেখি ভারি রসিক। পড়াশোনাও তো শেষ। তা বাবা? বয়স কত তোমার?

শুভ্র ভাই অদ্ভুত চোখে তাকান। মৃদু হেসে ভদ্রতার খাতিরে বলেন,

--- ২৪। 

--- তাহলে তো বিয়ের বয়স হয়েই গেছে। এই বয়সে তো আমি দু'বার হানিমুনও কমপ্লিট করে ফেলেছি, হা হা হা। 

শুভ্র ভাই হাসেন। উনার হাসিতেও একরাশ বিরক্তি। বিরক্তি চেপে মৃদু গলায় বলেন,

--- সবই কপাল।

শুভ্র ভাইয়ের কথা উনার কান পর্যন্ত পৌঁছলো কিনা বুঝা গেলো না। লোকটি আগের থেকেও আমোদিত কন্ঠে বলেন,

--- তা শরিফা? ছেলেকে বিয়ে দিবে না? বলো তো পাত্রী দেখি। ছেলের রেজাল্ট ভালো ভবিষ্যৎ উজ্জল। বিয়েটা নাহয় দিয়েই দাও।

শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে মামানির দিকে তাকান। যার অর্থ, মা আমি বিরক্ত হচ্ছি। মামানি শুভ্র ভাইয়ার মুখটা একবার দেখে নিয়ে মৃদু হেসে বলেন,

--- আগে চাকরি করুক। স্যাটেল হোক তাছাড়া এখনকার ছেলেমেয়েদের তো নিজস্ব পছন্দ থাকে। সেদিক থেকে ধরতে গেলে পাত্রী খুঁজতে হবে না দুলাভাই।

মামানীর কথায় লোকটি  আশাহত হন। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। কিন্তু দমে যান না,  নতুন উদ্যোগে  রুহি আপুকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। শুভ্র ভাই ঠোঁট চেপে হাসেন। আপুর কানের কাছে ফিসফিস করে বলেন,

--- রুহি রে...বোন আমার, তোর ফার্মের মুরগীর কি হবে বল তো? বলিস তো, কয়েকটা মদের বোতল কিনে দিয়ে আসি। একদিকে তোর বিয়ে হবে অন্যদিকে তোর ফার্মের মুরগী ক্যাক ক্যাক করে গাইবে, " বন্ধু যখন বর নিয়া হাইটা যায়, বুকটা ফাইটা যায়।" কি রে? কিনে আনবো?

শুভ্র ভাইয়ের কথায় মুখ কালো করে বসে থাকে আপু। তখনই ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে দু'জন ছেলে। একজন হলদে ফর্সা, অন্যজন উজ্জল শ্যামা। আঙ্কেল উৎসাহ ভরা দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকান। হাসিমুখে বলেন,

--- আমার দুই ছেলে। চিনতে পারছো, শরিফা? 

মামানি ধাঁধা লাগানো চোখে বলেন,

--- ওমা! কতো বড় হয়ে গেছে। সেই ক্লাস নাইনে থাকতে দেখেছিলাম। নাহিদ কে? আর নাঈম কে? 

ছেলেরা হেসে আন্টিকে সালাম দেয়। শ্যামলা করে ছেলেটা বলে,

--- আমি নাহিদ আন্টি। আর ও নাঈম। 

মামনী হাসিমুখে বলে,

--- কোন ক্লাসে পড়ছো এখন? 

এবার ফর্সা ছেলেটা বলে,

--- দু'জনেই মাস্টার্স করছি আন্টি। আমি জাহাঙ্গীর নগরে ইকোনমিকসে আর নাহিদ রাজশাহীতে ইংলিশে।

--- মাশাআল্লাহ। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম শুভ্র আর তোমরা ইয়ারমেট। ক্লাস ফাইভে একসাথেই কোচিং করতে মনে নেই? তখন তো চড়পাড়ায় থাকতে। 

ছেলেদুটো হালকা হেসে মাথা দোলায়। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে,

--- এখানে বড়দের সাথে বসে থেকে বোর না হয়ে আমাদের সাথে ছাদে চলো। সবাই মিলে আড্ডা দেওয়া যাবে। 

কথাটা কানে যেতেই ঝটপট ওঠে দাঁড়ায় আপু।  এখান থেকে পালানোর এটাই তার সুবর্ণ সুযোগ। আপুর সাথে আমি আর শুভ্র ভাইও উঠে দাঁড়াই। নাহিদ ভাইয়া আদিবাকে কোলে নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতেই  শুভ্র ভাইকে ঝাঁপটে ধরে আদিবা। অপরিচিত কারো কাছে যেতে একদমই অভ্যস্ত নয় সে। শুভ্র ভাই হেসে আদিবাকে কোলে তুলে নিয়ে বলেন,

--- নাহিদ, ও আমার কাছেই থাকুক। তোমাকে চিনতে একটু সময় লাগবে ওর।

নাহিদ ভাইয়া হেসে সম্মতি জানান। ছাদের সিঁড়ি ধরে হাঁটতে হাঁটতে জানতে পারি উনারা দু'জন জমজ ভাই। নাঈম ভাইয়া দু'মিনিটের ছোট আর নাহিদ ভাইয়া বড়। নাঈম ভাইয়া ফর্সা হলেও নাহিদ ভাইয়াকেই বেশ লাগলো আমার। ছেলেদের শ্যামলা বর্ণেই বেশি মানায়। তাছাড়া, হাসিমুখে কথা বলেন আর মোষ্ট ইম্পোর্টেন্ট, শুভ্র ভাইয়ের মতো উনার গালেও টোল পড়ে। উনাদের ছাদটা বেশ বড়। ছাঁদের একপাশে বিভিন্ন ফুলের গাছ আর আরেকপাশে ছোট ছোট আম, লিচু আর লেবু গাছের টব। সবকটা গাছেই ঝুঁকে ধরে আছে ফল। তারমধ্যে সবচেয়ে সুন্দর গাছটি হলো কালো গোলাপের গাছ। এর আগে কখনো কালো গোলাপ দেখি নি আমি। কালো রঙটাও যে ভয়ঙ্কর সুন্দর তা কালো গোলাপ দেখে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ফুলের প্রতি আমার মুগ্ধতা দেখে এগিয়ে এলেন নাহিদ ভাইয়া। কালো গোলাপ নিয়ে হাজারও গল্প জুড়ে দিলেন উনি। উনার কথাগুলো সুন্দর বলে শুনতেও বেশ লাগছিলো আমার। কখনো হুট করেই গলা ছেড়ে হাসছিলাম তো কখনো একটু আধটু উত্তর দিচ্ছিলাম। শুভ্র ভাই ছাঁদের অন্যকোণায় দাঁড়িয়ে আদিবাকে কিছু একটা দেখাচ্ছিলেন। আপু আর নাঈম ভাইয়াও শুভ্র ভাইয়ার পাশে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়েই শুভ্র ভাইয়ার সাথে কিছু নিয়ে গল্প করছিলেন। আধাঘন্টার মাথায় নাহিদ ভাইয়া আর নাঈম ভাইয়ার সাথে বেশ মিলে গেলো আমাদের। হাসি মজায় মেতে উঠলাম সবাই। এক পর্যায়ে নাহিদ ভাইয়াদের রুমে গিয়ে বসলাম। আড্ডা যখন চরমে ঠিক তখনই শুভ্র ভাইয়ার ফোনটা হাতে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো আপু। আমরা অবাক চোখে তাকালাম। শুভ্র ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে বললেন,

--- আমার ফোনে তোর কি? ফোন দে।

রুহি আপু হাত উঁচিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় পড়তে লাগলো,

--- " শুভ্র ভাইয়া? আপনি বিশ্বাস করবেন না আমি কতোটা পাগল আপনার জন্য..."

এটুকু পড়ে সরু চোখে তাকালো আপু। সন্দেহী কন্ঠে বললেন,

--- পাসওয়ার্ড বলেন শুভ্র ভাই। আমরাও দেখতে চাই কে সে রমনী। বলুন বলুন।

শুভ্র ভাই রাগী গলায় বললেন,

--- একটা থাপ্পড় লাগাবো। ফোন দে বলছি। তোর সাহস দেখে আমি হতবাক। দে বলছি ফোন।

রুহি আপু এবার গো ধরে দাঁড়ালো। ম্যাসেজের সম্পূর্ণটা সে পড়বেই পড়বে। আমরাও আগ্রহ নিয়ে তাকালাম। শুভ্র ভাইয়া উঠে দাঁড়াতেই দৌড় লাগালো আপু। শুভ্র ভাইও কম না ফোন তো উনি নিবেনই।পাঁচ মিনিট এদিক সেদিক দৌঁড়াদৌঁড়ি করে হাঁপিয়ে উঠলো আপু। আমার হাতে ফোনটা দিয়ে বললো," এবার তুই দৌড়া!" আমি ফোনটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। স্কিনের উপরে অর্ধেক ভেসে থাকা ম্যাসেজটাই চোখ বুলালাম। "আফসানা ইয়াসমিন....."  আইডিটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে  ফেইক আইডি। আমি মাথা তুলে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকাতেই বিছানায় গিয়ে বসে পড়লেন উনি। আমি মৃদু গলায় বললাম,

--- পাসওয়ার্ড কি?

উনি আমার চোখের দিকে তাকালেন। শান্ত গলায় বললেন,

--- ভেবে দেখ, পেয়ে যাবি। 

আমি ভাবলাম। দু'তিনবার ট্রাই করার পর খুলেও গেলো। সাথে সাথেই ফোনের উপর হামলে পড়লো সবাই। আপু ফোনটা ছিনিয়ে নিতে গেলেই রাগী চোখে তাকালেন শুভ্র ভাই। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

--- ওই? খবরদার ফোন ধরবি না। "ফোন" মানেই পার্সোনাল বিষয়। ছাড় বলছি। নয়তো চড় মেরে দাঁত ফেলে দিবো।

আপু ফোনটা ছেঁড়ে দিয়ে ফুসফুস করে বললো,

--- রোদের হাতে থাকলে মনে হয় পার্সোনাল বিষয়ে ব্যাঘাত ঘটবে না। আজাইরা। 

শুভ্র ভাই আপুর কথায় পাত্তা না দিয়ে বালিশে গা এলিয়ে বসলেন। আমি ম্যাসেঞ্জার অপশনে গিয়ে ম্যাসেজটা অন করলাম। তাতে হেনতেন অনেক কিছু লেখা। মেয়েটা  শুভ্র ভাইয়ের জন্য কতো পাগল, না দেখেই কত্তো ভালোবাসে ব্লা ব্লা। আপু ম্যাসেজগুলো পড়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। গম্ভীর গলায় বললো,

--- ভার্চুয়াল লাভ। কাহিনী কি শুভ্র ভাই? মাইয়াটা কেডা?

শুভ্র ভাই কিছু না বলে আগের মতোই বসে রইলেন। নাহিদ ভাইয়া আর নাঈম ভাইয়া নিঃশব্দে হাসছেন। আপু আবারও জিগ্যেস করলো,

--- কি ব্যাপার? নীরবতা সম্মতির লক্ষ্মণ। আপনি কিছু বলছেন না কেন শুভ্র ভাই?

শুভ্র ভাই বিরক্ত গলায় বললেন,

--- তোরে কেন বলবো? 

আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম,

--- নিউ জিএফ নাকি শুভ্র ভাই?

উনি শীতল গলায় বললেন,

--- চিনি না। এমন ম্যাসেজ অনেক আসে। আমাকে কিভাবে চিনে জানি না। আন্সার দিই না। সীনও করি না। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে দু একটা ম্যাসেজের আন্সার দিয়ে জিগ্যেস করেছিলাম আসল কাহিনীটা কি। এটুকুই! চেইক করে দেখ। 

আমি ফোনটা উনার দিকে এগিয়ে দিয়ে আরাম করে বসলাম। আমি জানি উনি মিথ্যে বলছেন না। তাছাড়া, ম্যাসেজের স্পষ্ট কারণ থাকা সত্যেও উনাকে অবিশ্বাস করার কোন কারণই নেই। তবে, আপু ব্যাপারটাই অসন্তুষ্ট। তার আরো কিছু ম্যাসেজ পড়ার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু আমার জন্য হয়ে উঠলো না। সবাই যখন নীরবতা আর অস্বস্তিতে বিরক্ত ঠিক তখনই নূরজাহান আন্টি রুমে এলেন। কিছু হালকা খাবার টেবিলে রাখতে রাখতে নাহিদ ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

--- বাবু? ছাদ থেকে কয়েকটা আম আর লেবু নিয়ে আয়। পাকা-কাঁচা মিলিয়েই আনিস।

নূরজাহান আন্টি বেরিয়ে যেতেই উঠে দাঁড়ালেন নাহিদ ভাইয়া। আদিবার দিকে তাকিয়ে বললেন,

--- পিচ্চি আপু? আমার সাথে আম পাড়তে যাবে? 

আদিবা কিছু না বলে শুভ্র ভাইয়ার গলা জড়িয়ে ধরলো। নাহিদ ভাইয়া হাসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

--- তুমি যাবে রোদেলা? শুনেছি ছোটরা গাছ থেকে ফল ছিঁড়তে খুব পছন্দ করে। আদিবার পর তো তুমিই পিচ্চি। তো, পুচকি মেয়ে কি ছাঁদে যাবেন?

আমি হালকা হেসে উঠে দাঁড়ালাম। আমার এই স্বচ্ছ হৃদয়ের হাসিটা যে একজনের একদমই সহ্য হলো না তা তখন বুঝতে পারি নি আমি। ছাঁদ থেকে ফিরে এসেই খাবার টেবিলে বসতে হলো। পরে আসায় আমাকে আর নাহিদ ভাইয়াকে পাশাপাশিই বসতে হলো। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মজার মজার গল্পও শুনালেন নাহিদ ভাইয়া। খাওয়ার মাঝেই হঠাৎই বলে উঠলেন মামানি,

--- বাহ। রোদুমনি আজ অনেক খাবার খেয়ে ফেলেছে। এটা কি নূরজাহান আপার হাতের জাদু না তার ছেলের কথার জাদু? তবে যায় হোক না কেন, কাজে লেগেছে খুব। 

মামানীর কথায় হাসলেন সবাই। আপু খেতে খেতে বললো,

--- আম্মু দেখলে নাহিদ ভাইয়া আর নূরজাহান আন্টি দু'জনকেই বাসায় নিয়ে পার্মানেন্টলি আটকে রাখতো।

আপুর কথায় আবারও হাসির ঢল নামলো। কিন্তু একজনের মুখে হাসি ফুটলো না। চুপচাপ মাথা নিচু করে খাবার খাওয়াতে ব্যস্ত সে। বিকেলের দিকে সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম আমরা। তখনও জানি না কতোটা ঝড় অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ভয়ঙ্কর ঝড়!



নূরজাহান আন্টিদের বাসা থেকে সোজা মামানিদের বাসায় যেতে হলো আমাদের। আম্মু নাকি মামানির থেকে কি একটা বই চেয়েছেন। মামুদের বাসায় এসে কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দিলেন মামু। মামুর সাথে কুশলাদি বিনিময়ের মাঝপথেই ঘরে ঢুকলেন শুভ্র ভাই। উনার হাতে কিছু প্যাকেট ছিলো। কিছু প্যাকেটে নূরজাহান আন্টি আম,লিচু, পিঠা পাঠিয়েছেন আর কিছুতে দোকানের জিনিস। শুভ্র ভাই ড্রয়িংরুমে ঢুকেই প্যাকেটগুলো একরকম ছুঁড়ে ফেললেন সোফায়। আম আর লিচুর প্যাকেটটা উল্টে পড়লো মেঝেতে। কিছু আম গড়িয়ে গিয়ে ঠেকলো পায়ের তলায় আর কিছু সোফা আর টেবিলের নিচে। আমরা সবাই অবাক চোখে তাকালাম। হঠাৎ কি হলো উনার? শুভ্র ভাই সেখানে এক মিনিটও দাঁড়ালেন  না। ব্যাগগুলো ছুঁড়ে ফেলে রুমে ঢুকে দরজা লাগালেন। দরজা লাগাতে গিয়ে এতো শব্দ করলেন, মনে হলো ঘরটা খানিকের জন্য কেঁপে উঠলো। মামু ভ্রু কুঁচকে মামানির দিকে তাকালেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,

--- "ছেলের হলো টা কি? হঠাৎ এতো রাগ?"

মামানি কপাল কুঁচকে বললেন,

---" বুঝতে পারছি না। হঠাৎ কি হলো? নূর আপার বাড়িতে তো হাসি-খুশিই ছিলো।"

আমি আর আপু ঢোক গিলে একজন অন্যজনের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাইয়ের রাগের ভয়ে মারাত্মকভাবে ভীতু আমরা। আপু আরো খানিকটা সরে এসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো, 

--- "রোদু রে? এই পোলা নির্ঘাত বউ পিডাবো। আল্লাহ বাঁচাইছে তোর বিএফ আছে। আমি তো ভাবছিলাম তুই আর শুভ্র ভাই....। তবে যা হয় ভালোর জন্যই হয়। তোর জন্য কতো চিন্তা হতো আমার। না জানি কবে ঘুম থেকে উঠে শুনি আমার বোন আর নাই। সে শুভ্র ভাইয়ের রাগের নিচে পিষ্ট হয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। তোর ওই "আমি-তুমি" বয়ফ্রেন্ডই ঠিক আছে। চালিয়ে যা বইন..."

আমি বিরক্ত গলায় বললাম, 

--- "আপু চুপ করবা? "

মামু এবার আমাদের দিকে ফিরে বললেন,

--- "রোদ-রুহি? কাহিনি কি বল তো। "

আমি ঢোক গিলে অসহায় গলায় বললাম, 

---" আমরা জানি না মামানি। বলছি কি? আমরা আজ যাই। বইটা বরং পরে নিবো..."

মামানি বললেন,

--- "সে কি? রাতে খেয়ে তারপর যাবি। শুভ্র দিয়ে আসবে।"

 আমার আর আপুর এবার কেঁদে দিবো দিবো অবস্থা।  মামানি বললেন,

---" তোরা একটা কাজ কর। ফ্রেশ হয়ে নে। একজন মার রুমে চলে যা আরেকজন গেস্টরুমে আর আদিবাকে আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি। "

আমরা বাধ্য মেয়ের মতো রুমের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে ঢেকে উঠলেন মামানি,

---" রোদু? "

আমি ফিরে তাকাতেই একটা পেনড্রাইভ  এগিয়ে দিয়ে বললেন,

---" এটা একটু শুভ্রকে দিয়ে আয় না মা। আসার সময় কিনে আনলো আর প্যাকেটগুলোর সাথে এখানেই ফেলে গেছে। আমি আদিবাকে নিয়ে যাচ্ছি তুই একটু দিয়ে আয়।"

আমি ভীত গলায় বললাম,

---" মামানি? আমিই কেন? উনি আমাকে আছাড় দিয়ে এই চারতলা থেকে ফেলে দিবেন। প্লিজ মামানি...."

--- "তোকে কেন আছাড় দিবে? শুভ্র একজনের রাগ আরেকজনের উপর ঝাড়ে না। হয়তো ফ্রেন্ডদের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে। তুই যা..."

আমি ঠোঁট উল্টে কপাল কুঁচকে বললাম,

---" মামানি? প্লিজ! আমার ভয় লাগে উনাকে।" 

মামানি মুচকি হেসে বললেন,

---" ভয় কি রে পাগলী? যা তো! "

মামানিকে বুঝানোটা দায় হলো আমার। তাই বাধ্য হয়েই শুভ্র ভাইয়ের রুমের দিকে পা বাড়াতে হলো। উনার রুমের সামনে এসে দোয়া পড়ে বুকে ফু দিয়ে নিলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। ঘরে আবছা অন্ধকার। লাইট অফ তবে ডীম লাইটের আলোয় চারপাশটায় আবছা আলো। কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে আলোটা চোখে সয়ে এলে চারপাশে তাকালাম। জানালার পাশে উল্টো দিকে ফিরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন উনি। অন্ধাকারে সাদা টি-শার্টটা নজরে লাগছিলো খুব। উনি পকেটে হাত গুঁজে স্ট্রেট দাঁড়িয়ে আছেন। আমি খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বললাম,

--- "শুভ্র ভাই?"

উনি জবাব দিলেন না। আমি আবারও ডাকলাম, 

---"শুভ্র ভাই? আপনার পেইনড্রাইভটা সোফায় ফেলে এসেছিলেন। কোথায় রাখবো?"

শুভ্র ভাই এবারও কিছু বললেন না। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। উনার রাগের কারণটাও ধরতে পারছিলাম না। তাই জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললাম,

--- "আপনি রেগে আছেন কেন? সিরিয়াস কিছু হয়েছে? " 

শুভ্র ভাই শান্ত গলায় বললেন,

---"এই মুহূর্তে রুম থেকে চলে যা রোদু। আমার মেজাজ খারাপ উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে যাবে। প্লিজ যা..."

তখন আমার কি হলো কে জানে? বাড়াবাড়ি রকমের জেদ নিয়ে বলে উঠলাম,

---" আগে বলুন রেগে আছেন কেন? নয়তো যাবো না।" 

---" জেদ না করে যা রোদ।" 

---" বললাম তো যাবো না। নাহিদ ভাইয়াদের বাসায়..."

এটুকু বলতেই ঘুরে দাঁড়ালেন উনি। ধাক্কা দিয়ে পাশের দেয়ালের সাথে দাঁড় করিয়ে ডানহাতটা উঁচু করে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে রাগী গলায় বললেন,

---"নাহিদ কি? সারাদিন নাহিদ নাহিদ করিস কেন তুই? সমস্যা কি তোর?"

উনার কথায় কান নেই আমার। হাতের অসহ্য ব্যাথায় চোখ-মুখ কুঁচকে গেছে আমার। অন্ধকারে আমার মুখের ভাবটা ঠিক বুঝতে পারলেন না উনি। কিন্তু আমার তো জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। দাঁতে দাঁত চেপেও ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি। মুহূর্তেই থেমে গেলেন শুভ্র ভাই। অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন,

--- রোদু? এই রোদু? তুই কাঁদছিস? কি হয়েছে? ব্যাথা লেগেছে হাতে?

আমার ব্যাথার গতির সাথে কান্নার গতিও বাড়লো। উনি দ্রুত লাইট জ্বালালেন। সুইচ অন করে ব্যস্ত ভঙ্গিতে আমার সামনে আসতেই চমকে উঠলেন। দেয়াল বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। দেয়ালে লাগানো চিকন প্যারেকটা অসাবধানতায় ঢুকে গেছে আমার হাতে। আমি প্যারেকটা থেকে হাতটা ছুঁটানোর চেষ্টা করতেই সারা শরীরে তীক্ষ্ণ ব্যাথা খেলে গেলো। না চাইতেই মুখ থেকে হালকা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। শুভ্র ভাই স্তব্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। উনার হাত-পায়ের কম্পনটা খুবই স্পষ্ট। আমি চাচ্ছিলাম কোনো রকম প্যারেক থেকে হাতটা উঠিয়ে রক্ত লুকাতে নয়তো মামানি কেমন রিয়েক্ট করবে কে জানে? কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। আমার চিৎকারে ছুটে এলেন মামানি আর আপু। আমার হাতের অবস্থা দেখে আৎকে উঠেই চড় লাগালেন শুভ্র ভাইয়ের গায়ে। মামানি আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

--- "তোমার মামুকে ডেকে আনো রুহি। জলদি যাও। তোমার মামু ছাঁদে আছেন।"

আপু ছুটে বেরিয়ে গেলো। আদিবা দরজার এক কোণা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে  ভয়ে ভয়ে তাকাতে লাগলো। শুভ্র ভাইয়া কোনোরকম বললেন,

---" আম্মু, আম্মু আমি.."

মামানি উনাকে সেখানেই থামিয়ে দিয়ে রাগী কন্ঠে বললেন,

---"একদম চুপ। এতো রাগ কেন থাকবে তোমার? তোমাকে দেখে তো এখন ভয় লাগছে আমার শুভ্র। না জানি রাগের মাথায় আরো কি কি করতে পারো তুমি। মানুষ খুন করে ফেললোও অবাক হবো না আমি। এমন চলতে থাকলে একদিন তোমার হাতেই মরে যাবে মেয়েটা। "

শুভ্র ভাইয়া অবাক চোখে তাকালেন, 

---" আম্মু!"

---"আম্মু নেই। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। আজই শেষ শুভ্র এরপর থেকে রোদের আশেপাশেও যেন না দেখি তোমায়। ৩ বছর আগে যেমন বন্ধ ছিলো তেমনই বন্ধ।"

---" আম্মু! তুমি ওভার রিয়েক্ট করছো। আগে রোদের হাত থেকে প্যারেকটা খুলে ঔষধ লাগাই তারপর নাহয় তোমায় বুঝিয়ে বলছি। আমি...." 

--- "আমি যথেষ্ট বুঝি। এই বয়সে তোমার থেকে জ্ঞান নিতে হবে না আমায়। আর এটা ওভার রিয়েক্ট?  আজ তুমি ওর হাতটা এভাবে ক্ষতবিক্ষত করে বলছো ওভার রিয়েক্ট তাহলে কাল ওকে খুন করে হাসতে হাসতে বলবে সরি ওভার রিয়েক্ট করো না ভুলে হয়ে গেছে।"

---" কি সব বলছো আম্মু? আমি রোদকে.... "

---" রোদ নয় রোদেলা। আজ থেকে রোদেলাই বলবে তুমি। "

এরমধ্যেই মামু এলেন। আমার হাত থেকে প্যারেক বের করে দিয়ে নিচের তলার ফার্মেসীর আংকেলকে ফোন দিলেন। আংকেল   জায়গাটা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দুটো ইনজেকশন পুশ করলেন। শুভ্র ভাই এক কোণায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। উনার জন্য খুবই কষ্ট হচ্ছে আমার। যায় হোক, উনি তো ইচ্ছে করে করেন নি। সম্পূর্ণটাই জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট। মামানি এতোটা রিয়েক্ট কেন করছেন? মামানি আর মামু নিজে গিয়ে বাসায় পৌঁছে দিলেন আমাদের। মায়ের সকাল প্রশ্নের উত্তরও তারায় দিলেন। আবারও সবকিছু আগের মতোই চলতে লাগলো। হাতের ঘা ও ঠিক হতে লাগলো কিন্তু ঠিক হলো না শুধু একটা জিনিস। আর তা হলো, শুভ্র ভাই। সেদিনের পর থেকে সত্যি সত্যিই আমাদের বাড়ি আসা বন্ধ করলেন উনি। তার প্রায় চার/পাঁচদিন পর হঠাৎই ফোন বেজে উঠলো আমার। ফোনের স্ক্রিনে "শুভ্র ভাই" নামটা ভাসতেই বুক কেঁপে উঠলো আমার। তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিয়ে বললাম,

---" শুভ্র ভাই?"

ওপাশে নীরবতা। কোনো কথা নয় শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ। কিছুক্ষণ পর নরম গলায় বলে উঠলেন উনি,

---" কেমন আছিস রোদু? মাফ করে দিস প্লিজ। আমি বুঝতে পারি..."

এটুকু বলতেই কিছু একটা ঘটলো ওপাশে। শুভ্র ভাই বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলেন,

---" এসব কি আম্মু?  আমার ফোন দাও প্লিজ।"

তারপর মামানির কন্ঠ কানে এলো, 

---"তোমাকে আমি রোদুর থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম শুভ্র। ফোন দিয়েছো কোন সাহসে?"

---" মা প্লিজ!আমাকে ওর সাথে জাস্ট একটু কথা তো বলতে দাও। আমি শুধু জানবো কেমন আছে ও।"

---" ও খুব ভালো আছে। তোমার থেকে দূরে থাকলে অবশ্যই ভালো থাকবে রোদ।"

---"আম্মু আমার কথাটাও একটু ভাবো..."

তারপর আর কিছুই শোনা গেলো না। কানে এলো অদ্ভুত কিছু শব্দ। কিসের শব্দ বোঝতে না পেরে কল কেটে দিলাম আমি। মামানি সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এতোটা রিয়েক্ট কেন করছেন বুঝতে পারছি না আমি। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি, বড্ড কষ্ট হচ্ছে আমার। মামানি কি করে ভাবতে পারেন শুভ্র ভাইয়ের সাথে থাকলে ক্ষতি হবে আমার। আমি তো এমনটা ভাবতে পারি না। কারণ আমি জানি উনার সাথেই সব থেকে সুরক্ষিত থাকবো আমি। সেদিন থেকে ফেসবুক এমনকি ফোনেও ব্লক লিস্টের খাতায় চলে যাই আমি। অদ্ভুতভাবেই  অগোছালো হয়ে পড়ে আমাদের এই প্রেমকাহিনী। এখনও প্রতিদিন বিকেলে ছাঁদের কার্নিশে গিয়ে দাঁড়াই কিন্তু আগের মতো হুট করে এসেই ফালতু কথায় বিরক্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন না শুভ্র ভাই। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয় বিকেল থেকে রাত। দীর্ঘ রাত পেরিয়ে আবারও সকাল হয় কিন্তু সত্যিকারের সকালটা যেন আর হয় না। 



বাসায় জমজমাট পরিবেশ। ছেলেপক্ষ এলো বলে। মামানি,ফুপি আর আম্মুর কতো শলাপরামর্শ ---- "লাখে একটা ছেলে, এই ছেলেকে হাতছাড়া করা চলবে না। কিছুতেই না।" আপু আর রাফিয়া মিথি আপুকে সাজাতে ব্যস্ত। আর আমি? অস্থিরভঙ্গিতে বারবার দরজায় চোখ রাখতে ব্যস্ত। যদি শুভ্র ভাই আসেন! আজ দু-দুটো সপ্তাহ কেটে গেলো কোনো রকম যোগাযোগ করেন নি উনি। কে জানে কেমন আছেন? আজ তো মামু, মামানি সবাই এসেছে, আজও কি আসবেন না? অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতেই ছেলেপক্ষ এলো। ছেলের মামা,  মা,ভাবি আর ছেলে এসেছেন পাত্রী দেখতে। একসময় পাত্রী দেখাও শেষ হলো। সবাই মিষ্টি মুখও করলো। কিন্তু মিষ্টিটা আমার গলা দিয়ে নামলো না। নামবেই বা কিভাবে?  গলায় তো আটকে আছে জমে থাকা সব কান্না। সেখানে খাবার প্রবেশের জায়গা কোথায়? দুপুরে খেতে বসার সময় শুভ্র ভাইয়ার কথা মনে পড়লো আম্মুর। মামানিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

---" ভাবি? শুভ্র কই? ও আসে নি কেন? আজ তো আপনাদের সবারই দাওয়াত ছিলো ভাবি।" 

মামানি শক্ত কন্ঠে বললেন,

---"ওর এখানে আসার প্রয়োজন নেই অরি। বাসায় রান্না করে রেখে এসেছি।সমস্যা হবে না।"

আম্মু যেন তেতে উঠলেন৷ রাগটাকে ঢেকে না রেখে খোলা গলায় বললেন,

---"আপনি রান্না করেছেন কিনা সেটা তো আমার দেখার বিষয় নয় ভাবি। ওর ফুপ্পি ওকে খেতে ডেকেছে তারমানে সে এখানে খাবে। নাকি ভাতিজাকে একবেলা খাওয়ানোর অধিকারটুকুও আমার নেই।"

---"তুমি ভুল ভাবছো অরি। তেমন কিছু নয়। আসলে..."

---"আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। রোদ? আমার ফোনটা নিয়ে আয় যা..!"

আমি দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম। মনে মনে আম্মুকে হাজারটা ধন্যবাদ দিয়ে ছুটে গেলাম রুমে। ফোন এনে আম্মুর হাতে দিতে গিয়ে খেয়াল করলাম উত্তেজনায় হাতদুটো থরথর করে কাঁপছে আমার। আম্মু ফোনটা নিয়ে শুভ্র ভাইকে ফোন লাগাতেই বলে উঠলেন মামানি,

---"কি দরকার অরি? বাদ দাও না। তুমি জানো কেন আসতে বারণ করেছি আমি। তবুও.."

আম্মু তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, 

---" ভাবি? আপনি তো বাচ্চা নন। তাহলে এমন অবুঝের মতো কথা কেন বলছেন? ওটা শুধুই একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। আমার শুভ্র এমন কাজ কখনোই ইচ্ছেকৃতভাবে করবে না।"

মামানি কিছু বলবেন তার আগেই ফোন রিসিভ হলো। আম্মু মুচকি হেসে বললেন,

---"ওয়ালাইকুম আসসালাম, বাবা। কই তুই?তোর তো আজ বাসায় আসার কথা ছিলো।"

ওপাশে কি বললো শুনা গেলো না। তবে আম্মু বললেন,

---" শরীর খারাপ লাগলেও আয়। এখানে সবার সাথে থাকলে শরীর খারাপ এমনি ঠিক হয়ে যাবে।"

আমি কৌতূহলী দৃষ্টিতে আম্মুর দিকে তাকালাম।আম্মু গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,

---"কোনো প্লিজ ফ্লিজ চলবে না। আমি তোর কোনো কথা শুনছি না। দশ মিনিটের মধ্যে তুই বাসায় থাকবি ব্যস।"

আম্মু ফোন কেটে ফোনটা টেবিলে রেখে খাবার সার্ভ করতে লেগে গেলেন। আমি গোপনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালাম। বিছানায় গিয়ে বসতেই রাফিয়া পাশে এসে বসলো। ফোনে চোখ রেখে বললো,

---"রোদু? আমার ক্রাশ কই রে? এমনিতে তো দিনে একবার হলেও বাড়ির আশেপাশে দেখা যায়। আমি একসপ্তাহ ধরে এসেছি একবারও চোখে পড়লো না।" 

আমি অর্ধেকপা বিছানার বাইরে ঝুলিয়ে রেখেই সটান শুয়ে পড়লাম। দুর্বল গলায় বললাম,

---"জানি না।" 

রাফিয়া কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,

---"সত্যিই জানিস না?"

আমি উত্তর না দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। রাফিয়ার সাথে বকবক করার নূন্যতম ইচ্ছে আমার নেই। কয়েক মিনিট পর আম্মুর কন্ঠ কানে এলো। তার গলায় খুশি খুশি ভাব,

---" এইতো শুভ্র এসে গেছে। ইশ! চেহারা এমন শুকনো কেন লাগছে? খাস না ঠিকমতো?যা টেবিলে গিয়ে বস।"

আমি ফটাফট চোখটা খুলে দৌড়ে গেলাম দরজায়। দরজার দিকে একপাশ ফিরে  বসেছেন উনি। ফরসা গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর এলোমেলো চুলেও মারাত্মক লাগছে তাকে। ভালো লাগা জিনিসটাই এমন ঘোর ধরানো। কাউকে একবার  ভালো লাগতে শুরু করলে তার সবচে বিশ্রী অভ্যাসটা দেখেও মুগ্ধ হয়ে বলতে হয় ---- আহ! কি চমৎকার। কপালের চুলগুলো কানে গুঁজে ওড়নাটা ঠিক করে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। ইচ্ছে করেই  ঠিক উনার সামনের চেয়ারটাতেই গিয়ে বসলাম। উনি মাথা নিচু করে খাচ্ছেন। খাবারের ফাঁকে ফাঁকে আমি হাজারবার উনার দিকে তাকালেও উনি একটাবারও মাথা তুলে তাকালেন না। পাঁচমিনিটে খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন অথচ ফিরেও তাকালেন না। খাবারে পানি ঢেলে রুমে এসে দরজা দিতেই নীরব অশ্রুতে ভরে গেলো আমার চোখ। নিজের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে আমার। উফফ! এতোটা কষ্ট কেন লাগছে?কেন?ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়লো। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে এলো মুহূর্তেই। চোখের জল মুছে দরজাটা খুলতেই নিভে গেলো সব আশা। মামানি হাসিমুখে বললেন,

---"ভিতরে যেতে দিবি না?"

আমি সরে দাঁড়াতেই আমার হাত ধরে নিয়ে বসালেন খাটে। গালে হাত দিয়ে বললেন,

---"খুব শুকিয়ে গিয়েছিস মা।"

আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। উনি আবারও বললেন,

---" মিথির বিয়ে ঠিক হয়েছে জানিস তো? এই উপলক্ষে তোর জামালপুরের ফুপি দাওয়াত করেছে। সাথে আমাদেরকেও করেছে। কাল যাচ্ছি সবাই।"

এটুকু বলে একটু থামলেন। শ্বাস টেনে নিয়ে বললেন,

---"শুভ্রও যাচ্ছে। ওখানে একদিন থাকবে সবাই। ছেলেকে তো একা রেখে যেতে পারি না তাই সাথে নিচ্ছি।"

আমি মুখ তোলে তাকালাম। মামানি নরম গলায় বললেন,

---" শুভ্র থেকে দূরে দূরে থাকিস মা।"

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবারও কথা পাড়লেন উনি,

---" শুভ্রর যখন পাঁচ বছর বয়স তখনই একটা মেয়ের খুব শখ হলো আমার। মনে হচ্ছিলো ছেলের সাথে সাথে একটা মেয়ে হলেও কতো ভালো হতো। সাজাতাম, আদর করতাম। জানিস? মেয়েরা একটা বয়সে গিয়ে মায়ের বান্ধবী হয়ে যায়। আমিও চাইতাম আমারও এমন একটা মেয়ে হোক। তার গোপন কিছু দীর্ঘশ্বাসে আমায় সঙ্গী করুক। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বেবি নিতে পারলাম না। ডাক্তার দেখালাম কিন্তু কোনো সমস্যাও ধরা পড়লো না। তোর মামু একছেলে নিয়েই যথেষ্ট খুশি ছিলেন। তাই বেবি হবে কি হবে না তা নিয়ে তার মাথা ব্যাথাও ছিলো না। কিন্তু কেনো জানি, আমি স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। সিচুয়েশনটা মেনেই নিতে পারছিলাম না। একটা সময় নিজেকে অক্ষম, দুর্বল ভাবতে শুরু করলাম। আর ধীরে ধীরে শুরু হলো ডিপ্রেশন। তার একবছরের মাথায় তুই হলি। আমার অন্ধকার জীবনে রোদ হয়ে। তোর মা হয়তো আমার সমস্যাটা বুঝতে পেরেছিলো। তাই তোকে আমার কোলেই তুলে দিয়েছিলো সবার প্রথম। সেদিন মনে হয়েছিল আমি আমার মেয়ে পেয়ে গেছি৷ তোর মা আমাকে এতোটাই অধিকার দিয়েছিলো যে নিজের মেয়ে আর পরের মেয়ে বোধটায় ভুলে গিয়েছিলাম আমি। তোকে আমি মামানি নই মায়ের মতো ভালোবাসি। শুভ্রকে যতোটা ঠিক ততোটাই। তাই হয়তো আমার আদরে তোর আর রুহির মাঝে এতোটা বেশ কম।  রুহিকে তুমি করে বললেও তোকে আমার তুই বলতেই ভালো লাগে সবসময়। তুই যখন একবছরের হলি তখন শুভ্রর সাত বছর। একদিন রুহি,শুভ্র,রাহাত তোকে নিয়ে খেলছে উঠোনে। হঠাৎ করেই তোর কান্নার আওয়াজ কানে এলো। দৌঁড়ে উঠোনে গিয়ে দেখি রক্তে ভেসে যাচ্ছে উঠোন। রক্তের উৎপত্তিটা তোর মাথা। তোর মাথার অনেকটাই কেটে যাওয়ায় এই রক্তক্ষরণ। আর এই আঘাতের  কারণ ছিলো শুভ্র। সেদিন ওর হাত থেকেই পড়ে গিয়েছিলি তুই। "

মামানি থামলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবারও বললেন, 

---" এরপর যখন ৪ বছরের বাচ্চা ছিলি তুই তখনও এমন কিছুই ঘটে। খেলতে খেলতে রাগ করে হাতের কাঁচি দিয়ে তোর কচি হাতে ফেঁস দিয়ে দেয় শুভ্র। তোর বামহাতে এখনও একটা কালো দাগ আছে,তাই না?"

আমি মাথা নাড়লাম। ছোটবেলা থেকেই এই কালো দাগটা দেখে আসছি আমি। কিন্তু এই দাগের উৎপত্তির ইতিহাস এতোদিন পর জানতে পারলাম আমি। আমি কৌতূহলী দৃষ্টিতে মামানির চোখের দিকে তাকালাম। তারপর?
মামানি গম্ভীর গলায় বললেন,

---" তুই যখন প্লে তে পড়িস তখনও শুভ্রর জন্য আবারও মাথা ফেটে যায় তোর। আমি ভয় পেয়ে যাই যদি আরো বড় ক্ষতি হয়ে যায় তোর! সেই ভয় থেকেই তোদের আশেপাশে যাওয়া বন্ধ করি আমি। শুভ্রকেও ডুবিয়ে রাখি পড়াশোনায়। ব্যস্ত শুভ্রর মনে তোদের কথাটাও ফিকে হয়ে আসে। শুভ্র যখন থার্ড ইয়ারে উঠে তখন তোর কথা বলি ওকে। "তোকে আমার কাছে আনতে চাই" এই আবদারটাও করে বসি। ধরে বেঁধে তোদের বাসাতেও আনি। বিশ্বাস কর, আমি ভেবেছিলাম বয়সের সাথে সাথে রাগ বাড়লেও ওর মধ্যে নিজেকে কন্ট্রোল করার এভেলিটি এসেছে কিন্তু সেদিনের ঘটনায় সবটায় ভুল প্রমাণিত হলো। শুভ্র চেঞ্জ হয়নি রোদ। ও আগের মতোই আছে। আমার ছেলে খুব ভালো তা আমি নিজেও জানি কিন্তু ওর রাগকে খুব ভয় পাই আমি রোদ, খুব।শুভ্রকে আমি কতোদিন আটকে রাখবো বল? আমি জানি ও তোর প্রতি দুর্বল। আমিও শুভ্রর কাছে এটাই চেয়েছিলাম। আর ও আমার চাওয়াটা রেখেছে কিন্তু এখন ও আমার কথা শুনবে না রোদ। এখন তোর প্রতি ওর দুর্বলতাটা এতোটাই বেড়েছে যে আমার চাওয়াটা ও চেষ্টা করলেও মানতে পারবে না। আমি আমার ছেলেকে চিনি রোদ। ও নিজের মনেরটা ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না কিচ্ছু না। তাই তোকেই সাবধান হতে বলছি মা। মামানির কথাটা রাখিস। "

মামানির কথার মাঝেই হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলেন আম্মু। মামানিকে কি কাজে একরকম টেনেই নিয়ে গেলেন উনি। আমি ফ্যালফ্যাল চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকেই উঠে দাঁড়ালাম। এই ছোট্ট একটা কারণ নিয়ে এতোটা রিয়েক্ট কি মেনে নেওয়া যায়? সেই ছোট্ট বেলা কি না কি হয়েছে তা নিয়ে এতো ভাবনা মামানির? কি অদ্ভুত! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রুম থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে খুঁজেও শুভ্র ভাইয়ের দেখা মিললো না। সচেতন চোখে প্রতিটা রুম,ছাদ সব চেইক করেও যখন ব্যর্থ হলাম তখনই আদিবাকে ডেকে এনে জিগ্যেস করলাম,

---"আদিবা? তোমার দাদাভাই কোথায়? দেখেছো উনাকে?"

---" দাদাভাই তো খেয়েই চয়ে গেচে। আমি দিকছি।" 

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কে জানে এরপর কি হবে? এমন এলোমেলো ঘটনাগুলোই কি পাল্টে দিবে জীবন? ছোট্ট ছোট্ট ঘটনাগুলোও মাঝে মাঝে হাজারও দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারো হালকা ভয় কাউকে হারানোর ভয়ে পরিণত হয়। ধাঁধাময় এই জীবনের চারপাশটায় কেমন মায়াময়,কষ্টময়....!!!


বিকেল ৪ টা। সবাই মিলে দাঁড়িয়ে আছি মিথি আপুদের উঠোনে। ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরঘেষে মিথি আপুদের বাড়ি।যৌবন কালে বেশ শৌখিন লোক ছিলেন বড় ফুপা। সেই সুবাদেই হাফ বিল্ডিং বাড়ির চারপাশটা ছেয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের ফুল আর দেশী-বিদেশী গাছে। সকালে এখানে পৌঁছানোর পর পরই শুরু হয়েছিলো বৃষ্টি। সারা দিনের সেই মুশলধারার বৃষ্টি এসে থেমেছে এই বিকেলে। প্রকৃতিকে বৃষ্টিস্নান থেকে খানিক জিরুতে দিতেই যেন হঠাৎ এই নীরবতা। আগামীকাল শনিবার, আগামীকালই আবারও ময়মনসিংহের পথে পাড়ি জমাবো আমরা। তাই সবাই মিলে বেরিয়ে এসেছি খানিক ঘুরাঘুরির উদ্দেশ্যে। গন্তব্য ----  মিথি আপুর ছোট ফুপ্পির বাসা। মিথি আপুর ছোটফুপ্পি থাকেন জামালপুরের ঘোষপাড়ায়। ব্রহ্মপুত্রের তীর থেকে গাড়ি করে ১৫/২০ মিনিটের পথ। বাড়ির সামনে দু- দুটো  অটোরিকশা দাঁড়িয়ে আছে। দুটো অটোরিকশাই গ্রুপের বড়দের জন্য বরাদ্দ অর্থাৎ, বাবা-মা,মামু-মামানি,বড় ফুপ্পি-ফুপা, ছোট ফুপ্পি-ফুপা, আদিবা-জারিফ,মিথি আপু আর মিলাদ ভাইয়া। আর আমাদের জন্য বরাদ্দ তিনটি বাইক। বড়রা অটোরিকশায় উঠে যেতেই শুভ্র ভাইয়ার বাইকের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। কিন্তু মাঝপথেই বাঁধ সাধলো মামানি। অটোরিকশা থেকে ডেকে উঠে বললেন,

---" রোদু? রাহাত দাঁড়িয়ে আছে তোর জন্য। তুই আর রুহি রাহাতের বাইকে যা। তাড়াতাড়ি কর।"

মামানির কথায় মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো আমার সাথে কিছুটা অপমানিতও বোধ করলাম। রাগ আর অভিমান মাখা দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে পিছিয়ে এসে ভাইয়ার বাইকে চেপে বসলাম। সাথে সাথেই মামনির কন্ঠ কানে এলো। রাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলছেন,

---"রাফিয়া? দাঁড়িয়ে কেন? তুমি বরং শুভ্রর সাথে যাও। ওর বাইকটাতো খালি। যাও যাও..." 

কথাটা কানে যেতেই কানদুটো গরম হয়ে এলো আমার। মুখ দিয়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলে ভাইয়াকে উদ্দেশ্য  করে ঝাঁঝাঁলো কন্ঠে বললাম, 

---" ভাইয়া? বাইক স্টার্ট না দিয়ে বলদের মতো বসে আছিস কেন? স্টার্ট দিবি নাকি নেমে যাবো?"

ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,

---" চড়াইয়া কানপট্টি গরম করে দিবো। আমি কি চিনি মিথির ফুপুর বাসা? বললেই কি চলে যাওয়া যায় নাকি? চুপ করে বস ধৈর্যহারা রমনী!" 

আমি মুখ ফুলিয়ে বসে রইলাম। ভাইয়া ফুপাকে ডেকে কোনদিকে কোনদিকে যেতে হবে তার ডিরেকশন জেনে নিয়েই বাইক ছুটালো। প্রায় দশ/পনের মিনিটের মাথায় একটা ভারি লোহার গেইটের সামনে বাইক থামলো। গেইটের ওপাশে পাঁচতলা এপার্টমেন্ট। মিথি আপুর ফুপিরা পাঁচ তলার ঠিক কোন ফ্লোরের কোন ফ্ল্যাটে থাকে জানা নেই আমাদের। তাই গেইটের সামনেই অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। তার কয়েক মিনিট পরই রাফিয়াদের বাইক এলো। কিন্তু বাইক চালকের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হলাম আমি। আলিফ ভাইয়া!! কিন্তু রাফিয়া তো শুভ্রর বাইকে উঠেছিলো, তাহলে? আমার প্রশ্নের জবাবে প্রায় সাথে সাথেই এলো অদুদ ভাইয়ার বাইক। তার পেছনেই বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন শুভ্র ভাই। সবাই বাইক পার্ক করে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। রাফিয়া এসেই আমার আর আপুর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। আমি অনুসন্ধানী গলায় বললাম,

---" তুই না শুভ্র ভাইয়ের বাইকে উঠেছিলি? তাহলে আলিফ ভাইয়ার পেছনে কিভাবে চলে এলি?"

রাফিয়া আক্ষেপের সুরে বললো,

---" আর বলিস না, বাইক স্টার্ট দেওয়ার আগমুহূর্তে শুভ্র ভাইয়া বললেন উনার চোখ ব্যাথা করছে বাইক চালাতে পারবেন না। চালালে এক্সিডেন্টও হয়ে যেতে পারে। উনার চোখদুটোও লাল লাল লাগছিলো তাই আলিফ ভাইয়াকে এই বাইকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে অদুদ ভাইয়ার পেছনে গিয়ে বসলেন।" 

আমি ছোট্ট করে বললাম, 

---"ওহ।"

রাফিয়া মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাতেই আড়চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম আমি। উনি আমার থেকে বেশখানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আলিফ ভাইয়া, অদুদ ভাইয়া আর ভাইয়ার সাথে খোশগল্পে মেতে আছেন। গায়ে ব্ল্যাক টি-শার্টের উপর হোয়াট-ব্লু চেইক শার্ট। শার্টের সবগুলো বাটন খোলা। শার্টের হাতাদুটো কনুই পর্যন্ত মোড়ানো। বামহাতে কালো ঘড়ি, পরনে জিন্স আর ক্যাটস্। কপাল জুড়ে ছড়িয়ে আছে একরাশ সিল্কি বাদামী চুল। হঠাৎ করেই চোখে চোখ পড়ে গেলো দুজনের। সাথে সাথেই কেঁপে উঠলো বুক। সারা শরীরে বয়ে গেলো লজ্জারাঙা স্রোত। চোখের পলক ঝাপিয়ে দ্রুত চোখ সরিয়ে সামনে তাকালাম। কানে চুল গুঁজতে গুঁজতে আবারও আড়চোখে তাকাতেই উনার গভীর চাহনীতে চোখ আটকালো আমার। সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিজের কাজে মন দিলেন উনি। কয়েক মিনিট পর প্রত্যাশিত অটোরিকশা দুটো এসে থামতেই শুভ্র ভাই আরো দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। রাস্তার পাশে সামান্য কাদা থাকায় হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে খুব সাবধানে মামানিকে নামালেন উনি। মামানিও তৃপ্তির হাসি হাসলেন। কিন্তু আমার মুখে হাসি ফুটলো না৷ কেমন একটা অজানা ভয়ের শিহরণ বয়ে গেলো গায়ে৷ তবে কি, মায়ের খুশিকেই প্রাধান্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শুভ্র ভাই? তাহলে, তাহলে.... আমি? 




Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner