> রোদ-শুভ্রর প্রেমকথন স্পেশাল পর্ব ১, ৫ - ভালবাসার গল্প - রোমান্টিক লাভ স্টোরি - নৌশিন আহমেদ রোদেলা
-->

রোদ-শুভ্রর প্রেমকথন স্পেশাল পর্ব ১, ৫ - ভালবাসার গল্প - রোমান্টিক লাভ স্টোরি - নৌশিন আহমেদ রোদেলা

আমার একমাত্র মামুর একমাত্র ছেলে শুভ্র ভাই। উনার সাথে আমার সাপে-নেউলে সম্পর্কটা জন্মগত নয়। আর উনাকে "আপনি" বলে ডাকাটাও আমার জন্মগত অভ্যেস নয়। মার কাছে শুনতাম, ছোট সময় শুভ্র ভাই আমাদের বাসায় এলে সারাটা দিনই নাকি উনার গলায় ঝুলে থাকতাম আমি নয়তো পেছন পেছন ঘুরে বেড়াতাম সারাক্ষণ । বলতে গেলে অনেকটাই "শুভ্র ভাই পাগল" টাইপ ছিলাম আমি। কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছুই পরিবর্তন হলো। আমরা থাকতাম শেরপুর শহরে আর উনারা থাকতেন ময়মনসিংহ। আমি যখন মাত্র প্লে তে ভর্তি হই তখন উনি ক্লাস ফাইভের স্টুডেন্ট।  ধীরে ধীরে উনার পড়ার চাপ বাড়ে আর ধীরে ধীরে আমার সাথে উনার যোগাযোগটাও কমে আসে। সাথে কমে আসে শুভ্র ভাইয়ের প্রতি আমার পাগলামোও। একসময় বাবা ডিসিশন নিলেন ময়মনসিংহে বাড়ি কিনবেন। মা তো অনেক খুশি যখন ইচ্ছে ভাইয়ের বাসায় ছুটতে পারবেন। যায়হোক, বাবার সিদ্ধান্ত মতে শেরপুরের নিজের বাড়ি রেখে পাড়ি জমালাম ময়মনসিংহ। তখন আমি ক্লাস থ্রী তে পড়ি আর শুভ্র ভাইয়া ক্লাস এইটে কি নাইনে পড়েন। শুভ্র ভাই এজ ইউজাল ভালো স্টুডেন্ট তাই অলওয়েজ পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। আমরা ময়মনসিংহ থাকলেও তার সাথে আমার দেখা হয় নি বললেই চলে। আমরা তখন তৃষালে একটা ভাড়াবাড়িতে থাকতাম আর উনারা থাকতেন চড়পাড়ায় নিজস্ব বাড়িতে। তৃষাল আর চড়পাড়ার মাঝে দূরত্ব অনেক। এতো টাইম নষ্ট করে এখানে আসা মানেই উনার পড়াশোনার লস। বলতে গেলে ব্যাপক লস। আমিও ছিলাম ঘরকুণো টাইপের মেয়ে তাই আর মামুর বাড়িতেও যাওয়া হয়ে উঠে নি তেমন । ততদিনে শুভ্র ভাই আর আমার পরিচিয়টা হয়েগিয়েছিলো নামে মাত্র পরিচয়। আমি শুধু এটাই জানতাম আমার একটা মামাতো ভাই আছে।যে কিনা অনেক বেশি টেলেন্টেট। উনিও হয়তো আমার সম্পর্কে এতোটুকুই জানতেন! তারপর ২০১৫ সাল,  আমি তখন জিএসসি এক্সাম দিয়েছি মাত্র। সেই সময়ই চড়পাড়ায় মামুর বাসা থেকে দশ -পনের মিনিটের দূরত্বে জায়গা কিনে বাসা কমপ্লিট করলেন বাবা। আমরাও উঠে পড়লাম নতুন বাড়িতে। নতুন বাড়িতে উঠার পর সবাইকে যখন দাওয়াত করা হলো তখনও শুভ্র ভাই এলেন না। উনি তখন সুদূর চট্টগ্রামে চুয়েটের কোনো একটা ক্লাসে ইঞ্জিনিয়ারিং এর বই মুখস্থ করছেন। মার কাছে শুনেছিলাম, উনার মনটাও নাকি তখন ছিলো ব্যাপক খারাপ। বেচারা এডমিশনের আগে আগে অসুস্থ হয়ে পড়ায় বুয়েটে চান্স পায় নি বলে তখন সে ছিলো ব্যাপক হতাশ। তার কি আর তখন এসব মিলাদ -মাহফিলে মন দেবার সময় আছে? একদম না। এর পরের দু'বছর উনি আমাদের বাসায় বেশ কয়েকবারই এসেছেন কিন্তু কাকতালীয়ভাবে আমার সাথে দেখা হয়ে উঠে নি। উনি যখন এসেছেন দেখা গেল আমি স্কুলে বা কোচিং এ নয়তো ঈদের ছুটিতে চলে এসেছি গ্রামের বাড়ির দিকে। আবার আমি যখন মামুদের বাসায় গিয়েছি তখন দেখা গেছে শুভ্র ভাই তখন চট্টগ্রামে। বছরের বেশির ভাগ সময় উনি চটগ্রামেই পড়ে থাকতেন। ভার্সিটিতে ভারি রকমের ছুটি পেলেই বাড়ি ফিরতেন উনি নয়তো না। এভাবে দু'দুটো বছর কেটে যাওয়ার পর এলো উনার সাথে আমার দেখা হওয়ার দিন। একই শহরে থাকার পরও পুরো ১১ বছর পর উনার সাথে আমার দেখা হতে চলেছিলো সেদিন । ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত।  আমি নিজে যখন ভেবেছি নিজের কাছেও ব্যাপারটা ভীষণ অদ্ভুতই লেগেছে।  এনিওয়ে এবার মেইন পয়েন্টে আসা যাক, উনার সাথে যখন আমার দেখা হয় তখন ২০১৭ সাল, আমি মাত্রই দশম শ্রেনীতে উঠেছি। জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকের 
শীতের রাত ছিলো ওটা। আমি চুলগুলো দুই বেনী করে মাথায় লাল টকটকে একটা শীতের টুপি পড়েছিলাম। গায়ে ছিলো একটা সাদা টি-শার্টের সাথে কালো জিন্সের জ্যাকেট তারসাথে ছিলো কালো রঙের প্লাজু। সবাই মিলে ড্রয়িং রুমে লুডু খেলছিলাম ঠিক তখনই কলিং বেলের শব্দ কানে এলো। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করতে করতে শেষ পর্যন্ত আমাকেই উঠতে হলো দরজা খোলার জন্য। ধীর পায়ে হেলে দুলে দরজা খুলে তাকাতেই দেখি মামানি। মামানি মানেই আমার জন্য এক্সট্রা আদর। তাই মামানিকে দেখেই খুশিতে লাফিয়ে উঠে দৌঁড়ে গিয়ে মামানিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম,

--- কেমন আছো তুমি মামানি? কতোদিন আসো না। আমাকে তো ভুলেই গেছো।

মামানি শুধু হেসে কপালে চুমু খেয়েছিলেন সেদিন। আমিও হেসে মামানিকে ছেড়ে দাঁড়াতেই চোখে পড়েছিলো একটি ছেলে। মামনির পেছনে একটু দূরেই পকেটে হাত রেখে স্ট্রেট দাঁড়িয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে  ছিলেন উনি। গায়ে এ্যাশ রঙের টি-শার্টের সাথে ব্লু জ্যাকেট। আমি অবাক চোখে তাকিয়েই ছিলাম শুধু। প্রথমত, ছেলেটাকে আমি চিনি না। দ্বিতীয়ত, ছেলেটা একটু বেশিই সুন্দর ছিলো কিনা! হা হা হা এখন ভাবলেই হাসি পায় তখন কতো বুদ্ধুরাম ছিলাম আমি। সেদিন মামানি ঘরে ঢুকে বলেছিলো, "কি রে শুভ্র? ভেতরে আয়।" তখনই বুঝতে পেরেছিলাম এটাই আমার বিখ্যাত মামাতো ভাই, আমার শুভ্র ভাই। আমি সেদিন দৌঁড়ে আমার রুমে চলে গিয়েছিলাম। কি ভীষণ লজ্জাটায় না পেয়েছিলাম সেদিন,উফফ! 
কিছু মুহূর্তের জন্য ভেবেছিলাম আর উনার সামনেই যাবো না আমি কিন্তু মার চেঁচামেচিতে সেদিনও বের হতে হলো আমায়। আমি যখন বের হলাম ড্রয়িংরুমে শুভ্র ভাইয়া ছিলেন না। সেই সুবাদে সবার সাথে আবারও হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছিলাম আমি। শুভ্র ভাইয়ার কথাটা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। গল্পের মাঝেই আম্মু  হঠাৎ বলে উঠছিলো,

--- রোদ? ছাদ যে আচঁড়ের বয়াম শুকাতে দিয়েছিলাম সেটা তো আনা হয় নি রে। চট করে গিয়ে নিয়ে আয় তো। তোর মামানিকে এক বয়াম আচঁড় দিয়ে দিবো। যা যা,, জলদি যা।

আমিও আর দেরী করি নি। মার কথায় দৌড়ে গিয়েছিলাম ছাদে। ছাদে গিয়ে বয়ামগুলো হাতে নিবো তার আগেই পেছন থেকে কারো কন্ঠ ভেসে এলো কানে,

--- এই পিচ্চি? এদিকে তাকাও।

নির্জন ছাদে অপরিচিত কারো কন্ঠ শুনে আমি তো ভয়ে মরি মরি অবস্থা।  মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়ে পেছনে না ঘুরেই দৌড় দিবো দিবো অবস্থা ঠিক তখনই ডানহাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করালেন আমায়। আমি চোখ মুখে একরাশ ভয় ভাসিয়ে সামনে তাকাতেই দেখি কোনো ভূত নয় শুভ্র ভাই । যদিও তখন তিনি ভূতের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর ছিলেন আমার জন্য। শুভ্র ভাইয়া একদম ফর্সা একজন মানুষ তারসাথে ঠোটগুলোও কালচে লাল।আমার আপু,ভাইয়া,আম্মু, মামানি,মামু সবাই একদম সাদা ফর্সা তাই ফর্সা মানুষ দেখে আমি অভ্যস্ত কিন্তু উনি একদমই অন্যরকম ছিলেন। সাদা মুখের সাথে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো খুব মানিয়েছিলো সেদিন। সুঠাম বড়সড় শরীর ছিলো উনার ওই হিসেবে আমি ছিলাম পিঁপড়া টাইপ। আর হওয়ারও ছিলো তাই আমি তখম মাত্র দশম শ্রেনীর স্টুডেন্ট আর উনি ইঞ্জিনিয়ারিং তৃতীয় বর্ষের ধামড়া ছেলে। আমি যখন উনার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকতে ব্যস্ত তখন উনি হাত ছেড়ে দিয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন,

--- কোন ক্লাসে পড়ো তুমি পিচ্চি? নাম কি? বাসা কোথায়? 

উনার কথায় চরম অবাক হয়েছিলাম আমি। আমার বাসায় দাঁড়িয়ে থেকেই আমার বাসার কথা জিগ্যেস করছেন উনি, কি অদ্ভুত!  আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আবারও একই কথা জিগ্যেস করেছিলেন উনি। আমি ভয়ে ভয়ে আস্তে করে বলেছিলাম,

--- আমার নাম রোদ। এটাই আমার বাসা।

এটুকু বলতেই চোখ বড়বড় করে তাকিয়েছিলেন উনি। আবারও হাত টেনে ধরে নিজের একদম কাছে দাঁড় করিয়ে বিস্ময় মাখা কন্ঠে বলে উঠেছিলেন,

--- তুই রোদ? ওই পুচকিটা? আই কান্ট বিলিভ!



--- তুই রোদ? ওই পুচকিটা? আই কান্ট বিলিভ!

উনার কথার কোনো উত্তরই খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। মনে মনে শুধু একটা দোয়ায় করছিলাম এই লোকটা যেনো আমাদের বাড়িতে আর কখনো না আসে। কখনোই না। কিন্তু আমার দোয়াটা হয়তো আল্লাহর পছন্দ হয় নি। তাই সেই দোয়ার উল্টো প্রতিক্রিয়ায় হয়ে চলেছে প্রায় তিন বছর যাবৎ। যায় হোক, এবার গল্পে ফেরা যাক। আমি যখন মনে মনে  দোয়া  দুরুদ পড়ছিলাম আর মনে প্রাণে চাচ্ছিলাম শুভ্র ভাই নামক প্রাণীটা এই মুহূর্তে আমার সামনে থেকে সরে যাক, এখনই যাক!  ঠিক তখনই আমার নরম হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে আমাকে আরেকটু কাছে দাঁড় করিয়ে মাথাটা নিচু করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন উনি। আমি চোখ পিটপিট করে ভয়ে ভয়ে উনার দিকে তাকাতেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে, অন্যদিকে তাকিয়ে হেসে উঠেছিলেন উনি। উনার সেই হাসির কারণটা এখনও আমার অজানা। একটু হেসে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উনার ঘন পাঁপড়িতে ঢাকা চোখদুটো আমার মুখের দিকে স্থির করে বলে উঠেছিলেন,

--- রোদু? ছোট বেলা তো তুই পেত্নী ছিলিই এখন আরও ভয়ানক ধরনের পেত্নী হয়ে গেছিস। আচ্ছা? তোর স্কুলের বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়েরা তোকে দেখে অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে যায় না? প্রাইমেরি স্কুলে পড়িস নাকি প্রাইভেটে?

উনার কথায় মুখ ফুলিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন। সেই মুহূর্তে উনার সাথে মোটেও কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না আমার। আপু তো বলতো ছোট বেলায় আমি অনেক কিউট ছিলাম।  ছোট ছোট আঙ্গুল আর কিউট কিউট ফেইস ছিলো আমার। কই কেউ তো আমায় বলে নি আমি দেখতে পেত্মীর মতো ছিলাম। কথাগুলো ভাবতেই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো আমার। হা হা হা... বাচ্চাদের মতো কি বাচ্চা বাচ্চা চিন্তায়  না করতাম তখন। আমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দু'বেনীর একটিতে শক্ত করে টান দিয়ে বলে উঠেছিলেন উনি,

--- ওই কি জিগ্যেস করেছি? উত্তর দে।

আমি তখন মনে মনে ভাবছিলাম, "এই বিশ্রী লোকটার মাথায় একটা ইট মারতে পারলে কতো শান্তি পেতাম আমি। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেলেও বেশ হতো।" কিন্তু মুখে বলেছিলাম,

--- আমি প্রাইমারিতে পড়ি না। এবার ক্লাস টেনে পড়ি। ১৮ -তে এসএসসি দিবো। 

আমার কথা শুনে উনি যেনো অবাকের চরম মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিলেন । কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে বিরবির করে বলে উঠেছিলেন ,

--- পার্ফেক্ট!

--- জি? 

--- নাথিং। তুই যে এসএসসি দিবি এটা শুনে আমার মিচিউয়াল হার্ট অ্যাটাক চলে এসেছিলো। মাই গড, এতো তাড়াতাড়ি টেন -এ কি করে উঠে গেলি বল তো? আমি তো ভেবেছিলাম বড়জোড় সিক্সে পড়িস। দেখেও তো তাই মনে হয়। তোর মধ্যে কিশোরী টাইপ কোনো ন্যাচারও চোখে পড়ছে না রে যা চোখে পড়ছে সবই নিতান্ত বাচ্চাদের ন্যাচার। এনিওয়ে, এদিকে আয় তো....কি হলো? এদিকে আয়!

উনার ধমকে দু'কদম এগিয়ে গেলাম আমি। আমি এগিয়ে যেতেই দুই হাতে আমার গাল গুলো টেনে দিয়ে বলে উঠলেন, 

--- যখন বাবু ছিলি তখন তো তোর গাল শক্ত ছিলোই এখন আরো বেশি শক্ত। এটা কোনো কথা? 

উনার এমন বিহেভে আমি  ঝটপট উনার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। গালে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলাম শুধু। উনার কোনো কথায় তখন পছন্দ হচ্ছিলো না আমার।  ইচ্ছে হচ্ছিল ছেলেটাকে ছাঁদ থেকে ধাক্কা দিয়ে এক ধাক্কায় আল্লাহর কাছে পাঠিয়ে দিই। বেয়াদব! উনি কিন্তু আমার চাহনী বা বিরক্তির ধারও ধারেন নি সেদিন। যদিও এখনও ধারেন না। উনার কথা হলো,  "আমি যা চাই তা চাই এবং সেটা আমি পাবো। তোর সেটা  ভালো লাগলো কি না তা আমার দেখার বিষয় নয়। " সেবারও ঠিক তাই করেছিলেন। আমার বিরক্তির ধার না ধেরে আমার একদম কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে  মাথা নিচু করে কানের কাছে এসে বলেছিলেন,

--- ছোট বেলা তো কোলে উঠলে নামতে চাইতি না। এখনও কোলে উঠার শখ আছে নাকি রোদপাখি? থাকলে বলতে পারিস.... আমি কিন্তু মাইন্ড করবো না। তুই এখনও আমার কাছে সেই পুচকিটাই আছিস। কি উঠবি নাকি কোলে?

উনার কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছিলাম সেদিন। মনে মনে ইচ্ছেমতো গালি দিয়ে পাকাপোক্তভাবে বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম যে " এই ছেলেটা আস্ত এক অসভ্য তারসাথে চরম বেয়াদব।" যে বিশ্বাসটা এখনও আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করে চলেছি উনি আসলেই একটা অসভ্য এবং চরম রকম বেয়াদব। সেদিনই প্রথম আপুর কথা অবিশ্বাস করেছিলাম আমি। কেননা আপু বলেছিলো, শুভ্র ভাইয়ের মতো ভদ্র ছেলে দুনিয়া ছেঁকেও দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। আমার মতে আপুর ধারনাটা ভুল ছিলো উনার মতো ভদ্র নয়, উনার মতো অভদ্র ছেলে দুনিয়া ছেঁকেও দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। সেদিন উনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছিলাম। কিন্তু নেমে যেতে পারি নি। সেখানেও বাঁধ সেধেছিলেন উনি। ডানহাতটা শক্ত করে মুচরে দিয়ে বলেছিলেন, 

--- আমাকে ধাক্কা দেওয়া সাহস কোথায় পেলি? আমার শশুড়বাড়ি আমাকেই ধাক্কা মারিস। মারবো এক চড়। আমি তোর বড় সো সম্মান দিয়ে চলাচল করবি, মনে থাকবে?

উত্তরে কাঁদোকাঁদো মুখে বলেছিলাম,

--- ছাড়ুন ব্যাথা লাগছে। 

--- ব্যাথা লাগার জন্যই তো দিচ্ছি। ব্যাথা লাগবে সেটাই স্বাভাবিক।  এনিওয়ে আবার আপনি করে বল তো....তোর মুখে আপনিটা চরম লাগে।

আমি শুধু টলমলে চোখে তাকিয়েছিলাম সেদিন। সেই হাত ব্যাথার কথাটা এখনও মনে আছে আমার। পুরো দশ দশটা দিন হাত নাড়াতে পারি নি আমি। কি ভয়াবহ ব্যাথা, উফফ! বলতে গেলে প্রথমবারের সাক্ষাৎ এ আমার হাওয়া টাইট করে দিয়েছিলেন উনি। সেদিন থেকেই আমাদের দু'জনের মাঝে এক অদৃশ্য প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যায়। কে কাকে জ্বালাতে পারে তার এক অদৃশ্য প্রতিযোগীতা। যা এখনও চলছে। আমাদের দুজন নিজের ইচ্ছে থেকেই দুই ধরনের হাতিয়ার বেছে নিয়েছিলাম । একজন শারিরীক তো একজন মানুষিক। আমার হাতিয়ারটা ছিলো মানুষিক আর এজ ইউজাল উনার জ্বালানোটা ছিলো শারিরীক!!  আর উনাকে আপনি বলে ডাকার শুরুটাও সেখান থেকেই। হঠাৎ দেখা হওয়া এতোবড়  মামাতো ভাইকে তুমি বলে ডাকা পসিবল ছিলো না তখন। এখন তো সেটা রীতিমতো ইম্পসিবল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যায়হোক, সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাকে জ্বালানোর নিউ নিউ টেকনিক আবিষ্কার করে চলেছেন উনি। যেখানে বছরে মাত্র এক থেকে দু'বার বাড়ি ফিরতেন উনি। সেখানে এখন প্রায় প্রতি মাসেই  উনার দেখা মিলে যায় ময়মনসিংহের এই শহরে। জ্বালানোর জন্য নতুন নতুন উপায়ে  হাজির হোন উনি। কখনও বা গভীর রাতে....কখনো বা কাক ডাকা ভোরে! আর তখনই ফোনে বেজে উঠে আমার। আর ফোনের ওপাশ থেকে একটা কথায় ভেসে আসে প্রতিবার,

--- আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি।  দু'মিনিটের মধ্যে নিচে আয়। ইউর টাইম স্টার্টস নাও....দু'মিনিটের মধ্যে তোকে চোখের সামনে না পেলে ডিরেক্ট খুন করবো। মাইন্ড ইট!



হাতে ওমন জবরদস্ত চোট পাওয়ার পর আমি আর শুভ্র ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াই নি সেদিন । দাঁড়াতামই বা কি করে? হাতে এত্তো ব্যাথা তারওপর বাচ্চা একটা মেয়ে ছিলাম তখন, কান্না আটকাতে পারলে তো? রুমে দরজা দিয়ে কান্না আটকাতেই ব্যস্ত ছিলাম সেদিন আর মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম এই লোকটার যেনো কখনো বিয়ে না হয়। কখনো না। হা হা হা। আমার সেই দোয়া কবুল হয়েছে কিনা জানি না তবে পরের দিন বিকেল বেলা আবারও মুখোমুখি হলাম দুজনে। আমার ভাগ্যটা এতোটাই খারাপ ছিলো যে, সেদিনই মা আমার ম্যাথের দুর্বলতা নিয়ে আলাপ করার উৎসাহ খুঁজে পেলেন। শুভ্র ভাইয়া বাসায় আসতেই আমার ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে ম্যাথে আমার দুর্বলতা এবং আপু আর শুভ্র ভাইয়ের প্রখরতা ব্যাখা করতে লাগলেন উনি। সেদিন ইচ্ছে করছিলো, মরে যাই। এই মুহূর্তে মরে যাই। এই অপমান কি সহ্য হয় কারো? এদিকে আমার ম্যাথের রেজাল্টও ছিলো মারাত্মক খারাপ। যেখানে শুভ্র ভাইয়া ম্যাথে অলওয়েজ ৯৮% মার্কস পান সেখানে আমি মাত্র ৪৫/৫৫%। এই রেজাল্টকে চোখ বন্ধ করে টিটিপি অর্থাৎ "টাইনাটুইনা পাস" বলা যেতে পারে। আমার এই অযোগ্যতাটা শুভ্র ভাইয়ার জন্য ছিলো একটা সুবর্ণ সুযোগ। আর আমার জন্য সেটা প্রথম যুদ্ধে হেরে যাওয়ার প্রধান কারণ। সেই মুহূর্তে রাগে গা টা রি রি করছিলো আমার। মনে মনে স্কুলের ম্যাথের ম্যামকে ইচ্ছেমতো গালি দিয়ে আল্লাহর কাছে কোনো ম্যাজিকের জন্য দোয়া করছিলাম। যে ম্যাজিকে এই শুভ্র নামক সাদা বিলাইটা ম্যাথে ফেইল মারবে আর আমার খাতা ভরে যাবে শুধু নাম্বারে। আহা! ভাবতেই কতো শান্তি লাগছিলো তখন। কিন্তু এবারও আমার মতো বাচ্চা মেয়েটার দোয়া কবুল হলো না, উল্টো যা হলো তা আমি জীবনে কল্পনাও করতে পারি নি। আমার ভাষ্য মতে এই "মারাত্মক অসভ্য" ছেলেটাকে আমার ম্যাথ টিচার নিযুক্ত করা হলো। সেই মুহূর্তে ইচ্ছে করছিলো দশটাকা রিক্সাভাড়া দিয়ে পাশের রেললাইনে গিয়ে শুয়ে পড়ি। এই পৃথিবীতে কি আমার কোনো প্রয়োজন আছে? নেই! একদম নেই! থাকলে নিশ্চয় মা আমার সাথে এতো বড় অন্যায়টা করতে পারতো না। আম্মুর সাথে আমার চেহারার মিল না থাকলে সেদিন আমি বিশ্বাসই করে নিতাম যে মা আমায় নদীর পাড় থেকে কুড়িয়ে এনেছেন নয়তো নিজের আদরের ভাতিজার গুণ কীর্তন করে আমার মতো ছোট্ট মেয়েটাকে এই বদমাশটার হাতে তুলে দিতে পারতো?সেদিন সুইসাইড করা নিয়ে কতো জল্পনা-কল্পনায় না করেছিলাম। ভাবছিলাম মরেই যাই। এ জীবন রেখে আর কি হবে? কেউ ভালোবাসে না আমায়। আজকাল বেস্টুকেও দেখি পাশের ব্রেঞ্চের মেয়েটার সাথে কি ভাব। বাবাও কতো বকে এখন.....এ জীবন আর রাখবোই না। কিছুতেই না। হা হা হা, শেষ পর্যন্ত সব জল্পনাগুলোকে জলে ভাসিয়ে বই নিয়ে বসতে হলো শুভ্র ভাইয়ের ঠিক সামনের চেয়ারটাতে। আপু তখন ইন্টারের স্টুডেন্ট, বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সে থাকে কোচিং ক্লাসে। রুম তখন একদম ফাঁকা। সেই ফাঁকা রুমটা শুভ্র ভাইয়ার জন্য ছিলো এক্সট্রা সুযোগ। এনিওয়ে, গল্পে ফেরা যাক। প্রথমদিন উনার কাছে পড়তে বসতেই একটা গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বললেন,

--- কি রে? শুনলাম তোর ম্যাথের খাতায় গোল গোল ডিম ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। তো এতো ডিম দিয়ে করিস টা কি তুই? চাইলে কিন্তু ব্যবসা শুরু করতে পারিস...প্রতি পিস ডিমের দাম সাড়ে সাত টাকা। 

এমনিতেই মেজাজ ছিলো জলন্ত চুলো। উনার কথাটা শুনেই সেই চুলোই পড়লো এক ড্রাম ঘি। রাগে জ্বলতে জ্বলতে নাক-মুখ ফুলিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। ইচ্ছে তো করছিলো এই ফাজিলটার মাথাটায় চিবিয়ে খেয়ে ফেলি। উফফ! অসহ্য! আমার রাগী মুখ দেখে শুভ্র ভাইয়া যেনো আরো উৎসাহ পেলেন। আরোকটা গা জ্বলানো হাসি দিয়ে বললেন,

--- নাইন থেকে টেনে যে উঠেছিস প্রোগ্রেস রিপোর্ট কই? দেখা দেখি। 

আমি এবারও চুপচাপ শক্ত হয়ে বসে রইলাম। আর মনে মনে প্রতীজ্ঞা করে ফেললাম "এ জীবন গেলেও প্রোগ্রেস রিপোর্ট উনাকে দিবো না। কিছুতেই না।" কিন্তু আমার এই প্রতীজ্ঞাও বেশিক্ষণ টিকলো না। উনার রাম ধমকে ঝটপট রেজাল্ট শীট বের করে উনার হাতে ধরিয়ে দিলাম। উনি মুচকি হেসে রেজাল্ট শীটটা হাতে নিলেন। কিছুক্ষণ রেজাল্ট শীটের দিকে তাকিয়ে থেকে কপাল কুঁচকে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠলেন- 

--- ইংলিশে নাইনটি এইট পার্সেন্ট নাম্বার। জিওগ্রাফিতে এইট্টিফাইভ প্লাস, হিস্ট্রিতেও এইট্টি প্লাস। সবকটাতেই তো ভালো মার্কস পেয়েছিস তাহলে ম্যাথে মাত্র চুয়ান্ন কেন?

--- এক্চুয়েলি,  আমাদের স্কুলের ম্যাথ টিচারটা এতো ড্যাশিং যে আমি তিনঘন্টার মাঝে দুইঘন্টা উনার দিকে "হা" করে তাকিয়ে থেকেই কাটিয়ে দিয়েছি তাই.... ওভারঅল লাড্ডু! 

আমার কথায় সেদিন উনি খানিকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিলেন।  টেবিলের কোণা থেকে একটা কাঠের স্কেল হাতে নিয়ে গণিত বইটা বের করে বিশ বিশটা ম্যাথ সল্ভ করতে দিয়ে বলেছিলেন,

--- প্রতিটার সলুউশনের জন্য তোর কাছে জাস্ট পাঁচ মিনিট করে আছে। একটি ভুল হলে পাঁচটা করে মাইর। নির্দিষ্ট টাইমের বাইরে প্রতি মিনিটের জন্য দশটা করে মাইর। ইউর টাইম স্টার্টস নাও!

উনি আমাকে মোট বিশটা অঙ্ক করতে দিয়েছিলেন। সবকটায় ছিলো সরল অঙ্ক। আমার পক্ষে এতো বড় বড় সরল পাঁচ মিনিটে করা সম্ভব ছিলো না। ব্যাপারটা আমার কাছে অসম্ভবের কাছাকাছিই ছিলো।আমার হাতে ছিলো ১ ঘন্টা ৪০ মিনিট। তার মাঝে দশমিনিট উনার দিকে "হা" করে তাকিয়ে থেকেই পাড় করে দিয়েছিলাম আমি। তখন বুঝি নি বাট এখন বুঝি কাজটা উনার ইচ্ছেকৃত ছিলো। ম্যাথ টিচারকে ড্যাশিন বলায় জ্বলে পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছিলেন উনি। অথচ উনি জানতেনই না আমার স্কুলের ম্যাথ টিচার ছিলেন একজন মেয়ে! 


সেদিন একঘন্টা চল্লিশ মিনিটে আমি মাত্র ৯ টা অংক করতে পেরেছিলাম বাদবাকি ১১ টায় বাকি পড়ে ছিলো। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। শুভ্র ভাই তখন একদৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন আর আমি ব্যস্ত ছিলাম ক'টা মার খাবো তার হিসেব করতে।সেদিন ভেবেছিলাম আজই হয়তো এই পৃথিবীতে আমার শেষ দিন। শুভ্র ভাইয়ের যে শক্তি তাতে দুটো মারলেই আমার এই জগতে থাকার ইচ্ছে ঘুচে যাবে  তার উপর অতোগুলো মার! মরণ তো আমার নিশ্চিত। হা..হা.. হা.. কিন্তু সেদিন শুভ্র ভাইয়া আমাকে মারেন নি। তার থেকেও ভয়ানক কাজ করেছিলেন। ফোনের ক্যামেরা অন করে বলেছিলেন,

--- মোট একশোবার কান ধরে উঠবস করবি৷ আমি এটা ভিডিও করে সবাইকে দেখাও। নে, শুরু কর।

আমার অবস্থা তখন "ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি" টাইপ।এর থেকে তো মারই ভালো ছিলো আপাতত মানসম্মানটা বেঁচে যেতো। আমি আবারও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিলাম জীবন গেলেও কান ধরে উঠবস করবো না। এজ ইউজাল, আমার এই প্রতিজ্ঞাটাও বেশিক্ষণ টিকে নি। শুভ্র ভাই এতো জোড়ে টেবিলে আঘাত করছিলেন যে চমকে ওঠে  দৌঁড়ে গিয়ে কানে ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম আমি। সেদিন যদি জানতাম যে, আমাকে মারতে গেলে উনার হাত কাঁপে তাহলে কখনোই কান ধরে উঠবস করতাম না আমি। কখনোই না। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয় আরকি। আবারও হারতে হলো আমাকে আর শুভ্র ভাই আমার বিরুদ্ধে আরেকটা অশ্র পেয়ে গেলেন খুব সহজেই। সেদিনের পর থেকে দুটো বছর আমি এই ভয়েতেই আড়ষ্ট ছিলাম, না জানি কখন সবাইকে  ভিডিওটা দেখিয়ে দেন শুভ্র ভাই । এরপর আরো পাঁচদিন ময়মনসিংহ ছিলেন উনি। প্রতিটি দিন নতুন নতুন পদ্ধতিতে জ্বালিয়েছেন আমায়। মূলত এই ছয় দিনেই আমার লাইফে জমরাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন উনি। ১৫ জানুয়ারির দিকে উনি আবারও চট্টগ্রাম ফিরে যান। উনার যাওয়ার খবর শুনে সেদিন কি খুশিই না হয়েছিলাম আমি। পারলে সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করবো এমন অবস্থা হয়েছিলো আমার। প্রায় একঘন্টা বিছানায় উঠে লাফালাফি করে বাইরে বের হতেই খেয়েছিলাম এক বাঁশ। দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন শুভ্র ভাই। আমাকে বের হতে দেখেই আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠেছিলেন,

--- ফুপ্পি? আম্মু রোদকে একটু ডাকে। আমাকে পাঠালো ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি ওকে নিয়ে যাই? এক দু'ঘন্টার মাঝে আবার দিয়ে যাবো।

--- কেনো ডেকেছে?

--- আজ তো আমি চলে যাবো। মা কতোকিছু রান্না করেছে।  রোদকে তো একটু বেশি ভালোবাসে হয়তো সেগুলো টেষ্ট করানোর জন্যই ডেকেছে ওকে। নিয়ে যাবো ফুপ্পি?

--- তোর বোন তুই নিয়ে যাবি, তাতে বলার কি আছে? নিয়ে যা। তা তোর বাস কয়টায়? 

--- রাত বারোটায় বাস ফুপ্পি। আসি তাহলে...

কথাটা বলেই আমাকে টেনেটুনে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন উনি। উনাদের বাসায় এসে বাসার ভেতরে না ঢুকে চুপচাপ টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন ছাঁদে। ভয়ে আমার আত্মা ধুরুধুরু করছিলো তখন। উনি যখন পেছন ফিরে ছাদের দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলেন তখন আমার হাত-পা চলা বন্ধ হয়ে গেছে প্রায়। মনে মনে শুধু একটা কথায় ভাবছিলাম, এই ছেলেটা নিশ্চয় এখন ছাদ থেকে ফেলে দিবে আমায়। কিন্তু কেনো ফেলবে? কি করেছি আমি? উনার জিন্সের পকেটে আচার ঢুকিয়ে দিয়েছি বলে ? কিন্তু জিন্সটা তো পরে আমাকে দিয়েই পরিষ্কার করিয়েছেন উনি। তাহলে? এতো এতো চিন্তা যখন কানের কাছে ভো ভো করছিলো ঠিক তখনই আমার দিকে তেঁড়ে এলেন উনি। আমি তখন ভয়ের চোটে শুকনো গলায় বারবার ঢোক গিলে চলেছি। উনি আমার দুপাশে ছাঁদের রেলিং-এ হাত রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিলেন,

--- ওই ছেলেটা কে?

উনার কথায় অবাক হয়েছিলাম আমি। মুখ কাঁচুমাচু করে বলেছিলাম,

--- কোন ছেলে?

--- যার সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলি তুই। রণিত বলছিলো ওটা নাকি তোর বয়ফ্রেন্ড। এই বয়সে বয়ফ্রেন্ড পালিস? 

উনার চোখ-মুখ রাগে লাল হয়ে ছিলো তখন৷ কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। উনি কোন ছেলের কথা বলছেন তাই তখন বোধগম্য হচ্ছিলো না আমার৷ ভয় পাওয়া চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজই ছিলো না আমার। উনি আবারও ধমকে উঠে বলেছিলেন,

--- কথা বলিস না কেন? কে ওই ছেলে? তোর বয়ফ্রেন্ড? এতো প্রেম করার শখ? নাকি আরো কিছু করার শখ আছে? ফুপ্পিকে বলে বিয়ে দিয়ে দিই তাহলেই সব সমস্যার সমাধান। রাস্তায় রাস্তায় প্রেম করে বেড়াবি আর আমাদের বংশের নাম খারাপ করবি তা তো হবে না। 

--- কককোন ছেলে ভাইয়া? আ আ আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। আমি তো ছেলেদের সাথে তেমন একটা কথাও বলি না । বিলিভ মি..আমি সত্যি বলছি।

আমার কথায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিলেন  উনি। ব্যাথা পাওয়া আমার সেই ডান হাতটা আবারও চেপে ধরে যন্ত্রনার শেষ সীমানায় নিয়ে গিয়ে রাগী গলায় বলেছিলেন,

--- তাহলে আজ দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার সময় কার সাথে কথা বলছিলি তুই?লাল শার্ট পড়নে ছিলো ছেলেটার।

--- ওহ ওটা? আমি তো ওই ছেলেকে চিনিই না ঠিকঠাক। আমাকে হঠাৎ করে এসে জিগ্যেস করলো স্কুল ছুটি হয়েছে কি না? সাথী নামের কোনো মেয়েকে চিনি কি না? এবং মেয়েটা স্কুল থেকে বেরিয়েছে কি না। ব্যস!  এটুকুই।

--- তাহলে রণিত কেন বললো ওটা তোর বয়ফ্রেন্ড?

--- আজব তো! রণিত কে তাই তো চিনি না আমি।

আমার কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন উনি। কিছুক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলে উঠেছিলেন,

--- নেক্সট টাইম রাস্তাঘাটে এসব দেখলে ডিরেক্ট ফুপ্পিকে জানাবো। আমি চলে যাচ্ছি বলে এটা ভাবিস না খবর পাবো না আমি। এলাকার সব ছেলেদের বলা আছে। এসব কিছু দেখলেই ডিরেক্ট আমাকে জানাবে ওরা। বুঝেছিস? 

সেদিন উনার সেই ধমকিতে পুরো দু'দুটো বছর আমি রাস্তা ছাড়া বামে ডানেও তাকিয়ে দেখি নি কখনো। সেদিন রাতে উনি আমাকে কিছু একটা গিফ্ট দিয়েছিলেন। গিফ্টটা কি ছিলো ঠিক খেয়াল নেই আমার। তবে এটা মনে আছে জিনিসটা আমি নিবো না বলে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছিলাম। আর তার শাস্তি হিসেবে পুরো দু'ঘন্টা উইথআউট সোয়েটার ছাদের ফ্লোরে বসে থাকতে হয়েছে আমায়। তখন জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি, কি ঠান্ডাটায় না ছিলো তখন। তারপর প্রায় একমাস উনার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ ছিলো না আমার৷ সেই একমাস আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন ছিলো। উনার ওই ঠান্ডা থেরাপির পর প্রায় এক সপ্তাহ জ্বরে ভুগেছিলাম আমি। কি ভয়ানক ছিলো সেই দিনগুলো। তারপর ফেব্রুয়ারি মাসের তের তারিখ রাত ১১ টা ৫৫ মিনিটে দীর্ঘ একমাস পর উনি ফোন দিলেন আমায়।এতো রাতে উনার ফোনটা পেয়ে বেশ অবাকই হয়েছিলাম আমি।অবাকের পালা শেষ করে ফোনটা কানে নিয়ে সালাম দিয়েই বলেছিলাম,,

--- শুভ্র ভাই এতো রাতে?

--- ওয়ালাইকুমুস সালাম,,নিচে আয়।

--- মানে??(অবাক হয়ে)

--- মানে হলো।।তোরা যে দু' তলায় থাকিস।।তার সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে নিচে নেমে আয়।।আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি।

--- মানে কি?এতো রাতে আপনি রাস্তায় কি করছেন??

--- মশাদের সাথে পিকনিক করি,,ডাফার।।এতো কথা বলিস কেন??নিজে নামতে বলছি নিচে নাম ব্যস

--- আমি পারবো না।।এতো রাতে নিচে ইম্পসিবল।

--- সবই পসিবল।।দুই মিনিটের মধ্যে নিচে আয়,,

--- পারবো না।

--- তুই পারবি,,,তোর বাপসহ পারবে

--- তাহলে বাবাকেই বলুন,, রাখছি

--- খবরদার রোদ,,,দুইমিনিটের মধ্যে নিচে না নামলে তোর অবস্থা যে আমি কি করবো,,তুই চিন্তাও করতে পারবি না।

কথাটা বলেই ফোনটা কেঁটে দিয়েছিলেন শুভ্র ভাই।কি একটা ঝামেলা ,,শুভ্র ভাইকে তখন আমি যথেষ্টই ভয় পেতাম,,আম্মুকে তারচেয়েও বেশি ভয় পেতাম।।তবুও ভয় ভয় পায়ে আম্মুর রুমে উঁকি দিলাম,,আম্মু তখনো ঘুমায় নি।।কি করবো এখন?অনেক ভেবে আম্মুকে বললাম,,নিচ তলার মাহিমা আপুর কাছ থেকে ক্যালকুলেটার আনতে যাচ্ছি আমারটা কাজ করছে না।।আম্মু কিছুক্ষণ আমার দিকে নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিজের কাজে মন দিলেন।।আমিও দোয়া দুরুদ পড়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়।সোডিয়ামের আলোতে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলাম এলোমেলো চুলে,, একরাশ ক্লান্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শুভ্র ভাই।।গায়ে ব্রাউন টি-শার্ট,,একটা ব্ল্যাক জ্যাকেট,,ব্লু জিন্স,,কেটস আর ঘাড়ে একটা ব্যাগ।।আমাকে দেখেই ক্লান্তিমাখা হাসি দিয়েই বলে উঠলেন,,

--- এসেছিস??

--- হুম,,এখানে কোনো ডেকেছেন??বাসায় চলেন।।

--- নাহ,,এতো রাতে বাসায় গেলে ফুপি সন্দেহ করবে।

--- কেনো??

--- তুই বুঝবি না হাদা,,

কথাটা বলেই একগুচ্ছ টকটকে লাল গোলাপ বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে।।।কোনো ফর্মালিটি না করেই বলে উঠলেন,,,

--- ফুলগুলো হাতে নে।।তোর জন্য।।খবরদার রোদ ছুড়ে ফেলবি না বা এটা বলবি না যে নিবি না।।নিজের টিউশনির টাকায় কিনেছি,,টাকার মায়া বড় মায়ারে পিচ্চি,,সো ছুড়াছুঁড়ি করবি তো এক চড়।

--- কিন্তু এগুলো কেন??(কনফিউশড হয়ে)

--- দেখ রোদ,,,তুই আমার দিকে ভাই ভাই নজরে তাকালেও আমি কিন্তু তোর দিকে ওলওয়েজ প্রেম প্রেম নজরেই তাকাই।।বুঝছিস??বুঝিস নি??

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম যে বুঝি নি।।উনি চরম বিরক্তি নিয়ে আমার হাতে একটা উপন্যাসের বই গুঁজে দিয়ে বলে উঠলেন,,,

--- তোর বুঝা লাগবে না।।এখন উত্তর দক্ষিণ না তাকিয়ে সোজা রুমে যা।।

--- কিন্তু??

--- দেখ রোদ,,পুরো আট ঘন্টা জার্নি করে আসছি।।এখন বাসায় গিয়ে রেস্ট নিবো কাল আবারো বেক করতে হবে।। সো কাহিনী না করে যা এখান থেকে...

আমিও আর কিছু না বলে ঘুরে দাঁড়ালাম।।দুই কদম ফেলতেই পিছে থেকে ডাক পড়লো,,

--- রোদ??

-- হু(পিছু ফিরে)

--- এদিকে আয়...

আমি উনার কাছে আসতেই নিচে বসে আমার পায়ের দিকে হাত বাড়ালেন। আমি ওমনি লাফিয়ে উঠলাম,",করেন কি শুভ্র ভাই??" তার উত্তরে বিরক্তিমাখা চাহনী দিয়ে বলে উঠলেন,,"এতো লাফাস কেন??চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।।তোর পা কেটে নিয়ে যাবো না।" আমিও এবার চুপচাপ মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলাম।।উনি আমার পায়ে একটা কিছু পড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েই কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলেন,,"ভালোবাসি তোকে,, এটা বুঝতে এতোক্ষণ লাগে??" কথাটা শুনে দুই মিনিট হ্যাং মেরে দাঁড়িয়ে থেকে বোকার মতে বলেছিলাম,," আপনি কি আমায় প্রোপোজ করছেন শুভ্র ভাই?"আমার কথাটা কানে যেতেই ধমকে উঠেছিলেন উনি ।।সেদিন উনার এক ধমকে দৌড়ে পালিয়েছিলাম ।। হি হি হি। সেই দিনের কথা এখনও মনে পড়লে হাসিতে লুটোপুটি খাই আমি। সেদিন উনার কথার ভাবার্থ না বুঝলেও এখন বুঝি। কিন্তু উনার কাছে এখনও অনেকটাই অবুঝ আমি। উনার বুঝানো এতো এতো কেমিস্ট্রিও আমি বুঝতে নারাজ। তাই নিয়ে কতো আফসোস তার...আহা! কতো হতাশা। এখানেই উনার হার আর আমার জিত। 



ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছি। দৃষ্টি কিছুটা দূরে বসে থাকা শুভ্র ভাইয়ের মুখে। সব-সময় হাসি-মজা নিয়ে মাতিয়ে রাখা মানুষটি আজ গম্ভীর মুখে বসে আছেন। উনি যে ঈদের পরদিন থেকে আমার সাথে কথা বলছেন না তা আমি বুঝতে পারি ঈদের আরো দু'দিন পর। সবাই মিলে নদীর পাড়ে বেড়াতে যাচ্ছিলাম। সবার পা খালি। হুট করেই আমার পায়ে মস্ত এক কাঁটা ফুটে গেলো। উনি আলিফ ভাইয়াদের সাথে আমাদের পেছনেই ছিলেন। আমাকে আর রাফিয়াকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে উঁকি দিয়ে নিচের দিকে তাকালেন। শুভ্র ভাইয়াকে দেখে রাফিয়া করুণ গলায় বললো,

--- ভাইয়া? রোদের পায়ে কাঁটা ফুটেছে। আমি খুলতে পারছি না। ভয় লাগছে। আপনি একটু খুলে দিবেন?

শুভ্র ভাইয়া কিছু বললেন না। খুব সাবধানে কাঁটাটা খুলে চুপচাপ উঠে চলে গেলেন। আমার মুখের দিকে একবার তাকালেনও না উনি। পা থেকে খানিকটা রক্ত পড়ছিলো বলে রাফিয়া দুবলা ঘাস হাত দিয়ে পিষে লাগিয়ে দিলো। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই আমার। আমি তো ভাবছিলাম শুভ্র ভাইয়ার কথা। এতোটা নীরব কেন উনি? এতোক্ষণে তো বকাঝকা করে মাথা খেয়ে ফেলার মতো অবস্থা হওয়ার কথা ছিলো, তাহলে? সবাই নৌকায় ওঠে হৈ-হুল্লোড় শুরু করায় চিন্তাটা খুব সহজেই মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো আমার। ভাবলাম, হয়তো এমনি মুড অফ। কিন্তু উনার মুড অফের কারণটা যে আমিই তা জানতে পারি আরো দু'দিন পর। গ্রামের বাড়ির পেছনের দিকটাই হাওয়া আসে প্রচুর। তাই সবাই মিলে বসেছি পেছন দিকের পাকা দরজায়। একসময় আলিফ ভাইয়া বললেন,

--- রোদ রাফিয়া? বোনেরা আমার, একটু মু্ড়ি মাখা করে এনে দে না। সবাই মিলে খাই। ঝাল ঝাল করে আনবি আড্ডাটা একদম জমে যাবে। প্লিজ যা না।

আমি আর রাফিয়া একগাদা বকা দিতে দিতে উঠে গেলাম মুড়ি মাখা আনতে। কিছুক্ষণ পর মুড়ির বাটিটা এনে সবাইকে দিয়ে শুভ্র ভাইয়ার সামনে ধরতেই হাতটা ঝটকা দিয়ে সরিয়ে উঠে চলে গেলেন উনি। আমি সহ সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম। কি মনে করে বাটিটা রেখে উনার পিছু পিছু উঠে গেলাম আমিও। ঘরে ঢুকতেই শুনলাম শুভ্র ভাইয়া বলছেন,

--- আম্মু? আমি বাসায় যাবো এবং আজ এই মুহূর্তে যাবো।

মামানি অবাক হয়ে বললেন,

--- কেন রে?  হঠাৎ কি হলো?

--- কিচ্ছু হয় নি। আমি জাস্ট বাসায় যাবো ব্যস। এখানের বাতাস আমার সহ্য হচ্ছে না।

--- কিন্তু শুভ্র? তোর ফুপ্পি আরো দুটো দিন থাকতে বলছে আমাদের। কতোবছর পর এলাম তারপর সবাই একসাথেই চলে যাবো।

--- তো? তোমরা থাকো বাট আমি থাকছি না। আমার দরকার আছে আমায় যেতে হবে।

এটাই আমার জন্য সুবর্ণ সুযোগ হয়ে দাঁড়ালো। এমনিতেও বাসায় আসার জন্য চেঁচামেচি করছিলাম আমি কিন্তু একা বলে গ্রেন্টেট হয় নি। তাতে কি? এবার হবে। আম্মুকে গিয়ে বললাম শুভ্র ভাই ময়মনসিংহ চলে যাচ্ছে আমিও যাবো ব্যস! মা শুভ্র বলতে অন্ধ তাই রাজিও হয়ে গেলেন কিন্তু বাধ সাধলো শুভ্র ভাই। সে আমাকে সাথে নিবে না। কিছুতেই না। আমি জেদ ধরতেই মার দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে উঠলেন উনি,

--- ফুপ্পি? তুমিও কি ওর মতো বাচ্চা? ও একটা মেয়ে মানুষ হয়ে আমার সাথে কি করে যেতে পারে? থাকবে কই ও?

মা কিছু না ভেবেই অবাক হয়ে বললেন,

--- থাকবে কই মানে? বাসায় থাকবে। এমনিতেই তিনদিন যাবৎ প্যানপ্যান করে কান খেয়ে ফেলেছে। ওকে তোর সাথেই নিয়ে যা বাবা।

শুভ্র ভাই এবার আরো রেগে গেলেন। নিজেকে শান্ত করে বলে উঠলেন,

--- ফুপ্পি? বাসায় ও একা কি করে থাকবে? 

এবার মামানি বললেন,

--- একা কই? তুই তো আছিসই। 

--- হোয়াট!  তোমরা কি পাগল হয়ে গেছো? তোমরা এতোটা কেয়ারলেস কি করে হতে পারো? নিজেদের মেয়েকে যার তার সাথে একা পাঠিয়ে দিবে? 

মা অবাক হয়ে বললেন,

--- যার তার সাথে বলছিস কেন শুভ্র? তুই তো ফ্যামিলি মেম্বারের মধ্যেই পড়িস।

শুভ্র ভাইয়া ব্যাগ গোছাতে গোছাতে স্পষ্ট গলায় বললেন,

--- আমি ফ্যামিলি মেম্বার হলেও ওকে আমার সাথে নিচ্ছি না। প্লিজ ফুপ্পি এডাল্টদের মতো চিন্তা করো।  

আমি বুঝলাম এবারও ট্রেন ছুটে যাচ্ছে আমার। শুভ্র ভাই একবার যদি বলেন "না" তাহলে সেটাকে "হ্যা" করার ক্ষমতা স্বয়ং আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। তাই আব্বুকে খুঁজে বের করে আব্বুর গলায় ঝুলে পড়লাম। মামু আর আব্বুকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে শুভ্র ভাইয়ের কাছে পাঠিয়েও লাভ হলো না। উনার এককথা উনি আমাকে একা উনার সাথে নিবেন না, ব্যস। শেষ পর্যন্ত আব্বুই রেডি হলেন আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। তাছাড়া বাবার ১ তারিখ থেকে অফিস খোলা সো ময়মনসিংহ তো যাওয়ারই ছিলো। এবার আর শুভ্র ভাইয়া কিছু বললেন না। শেরপুর থেকে ময়মনসিংহ দু'ঘন্টার পথে উনি আমার সাথে কথা বলা তো দূরে থাক তাকিয়েও দেখলেন না। অথচ বাবার সাথে অবলীলায় গল্প করে চলেছেন উনি। মনে মনে রাগে ফেটে যাচ্ছিলাম। উনি আমার পদ্ধতি আমার উপরই এপ্লাই করছেন, হাও স্মার্ট! বাসায় ফিরে উনি নিজের বাসায় চলে যেতে চাইলেও বাবা আটকে দিলেন। বললেন যে ক'দিন মামানি না ফিরে ততদিন আমাদের সাথেই থাকতে হবে উনাকে। প্রথমে একবার অবাধ্য হয়েছিলেন বলে এবার আর কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ বাবাকে হেন তেন বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করে রাজি হয়ে গেলেন। এই চার-পাঁচটি দিন আমার জন্য নরকীয় একটা সময় ছিলো। এই পাঁচদিনেও উনি আমার সাথে একটি কথাও বলেন নি। বাবার সাথে টুকটাক কথা বলেই দরজায় ছিটকানি দিতেন। খাওয়ার সময় বাবার সাথে খেয়ে নিয়ে আবারও একই কাজ। ব্যাপারটা ক্রমেই আমার কাছে চরম অসহ্যকর হয়ে উঠছিলো।ধৈর্যের শেষ সীমানায় পৌঁছে উনার সাথে বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টাও করি কিন্তু বরাবরের মতোই ব্যর্থ হই। উনি আমাকে পাত্তা দিলে তো? আমি কোনো কাজে উনার সামনে গেলেও রাগে শক্ত হয়ে বসে থাকতেন উনি। আমি বুঝতাম কিন্তু রাগের কারণটাই বুঝতে পারতাম না। অবশেষে আজ মা-মামানি সবাই ফিরে এসেছেন।  সাথে শুভ্রর মাথায় এক নতুন ভাব উদয় হয়েছে। উনার কথা হলো এখন লকডাউন ছেড়েছে সো উনি চট্টগ্রাম চলে যাবেন। তা নিয়েই গম্ভীর আলোচনা চলছে আমাদের বাসায়। মামানি কাঁদু কাঁদু কন্ঠে বলছেন,

--- কি বলছিস এসব? চট্টগ্রাম যাবি মানে কি? এখন তো ভার্সিটি অফ। তাহলে কেন যাবি? আর ১১ তারিখের পর হয়তো আবারও লকডাউন শুরু হবে। দেশের এই পরিস্থিতিতে ওখানে তোকে যেতে দিবো না আমি।

--- সরি আম্মু! বাট আমি যখন বলেছি যাবো মানে যাবো। দেটস ইট! আর ১১ তারিখের পর লকডাউন শুরু হলে আমি ওখানেই থাকবো।

মামানি এবার কেঁদেই দিলেন। মামু-আব্বু হাজার বুঝিয়েও কোনো কাজ হলো না। কালকের টিকেট কেটেছেন জানিয়ে বিরক্ত হয়ে উঠে চলে গেলেন উনি। আমি শুধু গালে হাত দিয়ে বসে রইলাম। আমার জন্য এতোকিছু হচ্ছে ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার। কিন্তু রাগটা কেন? সেদিন সারাদিন চিন্তা-ভাবনা করার পরও কিছুই মাথায় এলো না আমার। সন্ধ্যার দিকে মামানি ফোন দিয়ে বললেন,

--- রোদু মা? 

--- আসসালামু আলাইকুম মামানি।

--- ওয়ালাইকুম আসসালাম, রোদু তুই একটু শুভ্রকে বোঝা না। দেশের যে পরিস্থিতি এই অবস্থায় ওখানে যাওয়া কতোটা রিস্ক তুই তো বুঝতে পারছিস। ওকে একটু বোঝা না, মা।

আমি দুঃখী দুঃখী গলায় বললাম,

--- তোমাদের কথায় তো শুনছে না। সেখানে আমি ছোট মানুষ আমার কথা শুনবে নাকি? পরে দেখা যাবে ধরে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে।

মামানি ধমক দিয়ে বললেন, 

--- একদম বাজে কথা বলবি না রোদু। এটা মজা করার সময়? আমি জানি ও তোর কথা শুনবে। তুই এটলিস্ট চেষ্টা তো করবি।  

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললাম, "হ্যাঁ তাই তো। তুমি প্ল্যান করো আর তোমার সেই রগচটা ছেলে রাগের মাথায় আমাকে ছাদ থেকে ছুঁড়ে মারুক। মারবে তো আমায় তোমার তো কিছু না। " কিন্তু মুখে বললাম,

--- আচ্ছা।  আমি বলে দেখবো মামানি।

--- বলে দেখবি মানে কি? এখনই বলতে হবে। তুই আমাদের বাসায় চলে আয়। তোর মা কে আমি বলছি। জলদি আয়।

আমি কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে দিলেন মামানি। যে ছেলে গত দু সপ্তাহ যাবৎ আমার সাথে কথা বলছেন না সে নাকি আমার কথায় চট্টগ্রাম যাওয়া ক্যান্সেল করে দিবেন। অবিশ্বাস্য!  আমার বুক চিঁড়ে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আলমারি থেকে জামা বের করতে গিয়েই শুভ্র ভাইয়ের দেওয়া শাড়িটা চোখে পড়লো। কি ভেবে শাড়িটা পড়ে নিলাম। হালকা সাজুগুজু করে বের হতেই পড়লাম আরেক ঝামেলায়।  আম্মু!!!! ভয়ে আমার বুক তখন ধুকপুক ধুকপুক  করছে। আম্মু আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। গম্ভীর মুখে বললেন,

--- এই শাড়ি কোথায় পেলি?

আমি কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলে উঠলাম, 

--- আ আসলে মা। কি হয়েছে বলো তো? আজ না সোহার জন্মদিন। সকাল থেকে ফোন করে জ্বালাচ্ছিলো। তুমি তো বাসা থেকে বের হতে মানা করছো তাই ভেবেছিলাম যাবো না। কিন্তু মামানি ফোন দিয়ে ওই বাসায় যেতে বললো তাই ভাবলাম সোহার সাথেও দেখা করে যাই। ওর বাসা তো রাস্তাতেই পড়ে।  আর আশু, হ্যাপি সবাই এসেছে। যাই??

মা কিছু বললেন না। আমি হাফ ছেঁড়ে বেঁচে দৌঁড়ে বেরিয়ে এলাম। নয়তো আবারও শাড়ির কথা জিগ্যেস করলে কি বলতাম আমি? কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। মামুর বাসায় যাওয়ার পর দরজা খুলেই মামানিও তার অসম্ভব সুন্দর মুখ থেকে এই ভয়ানক প্রশ্নটাই করলেন,

--- রোদু, এই শাড়ি কবে কিনলি? দারুন হয়েছে তো। তোর মার পছন্দ আছে বলতে হবে।

আমি আবারও আগের উত্তরটাই কপি পেষ্ট করে দিয়ে বললাম, 

--- শুভ্র ভাইয়া কোথায়?

--- শুভ্র তো ছাদে। 

--- ও আচ্ছা। আমি দেখা করে আসছি।

মামানি হঠাৎ আমার হাত টেনে ধরে বললেন,

--- তুইই শেষ ভরসা মা। ওকে একটু রাজি করিয়ে নিস। রাজি করাতে পারলে তুই যা চাবি  তাই দিবো তোকে, প্রমিজ।

আমি হাসলাম। মামানির হাতে হাত রেখে বলে উঠলাম, 

--- যদি ছাদ থেকে জীবন নিয়ে ফিরতে পারি তবেই না চাইবো। তোমার যা ছেলে...

আমার কথায় মামানি হেসে উঠলেন। বললেন,

--- এই! এভাবে বলবি না। আমার ছেলে রগচটা হলেও এতোটাও রাগী নয় যে তোর গায়ে হাত তুলবে। ও তোকে এটলিস্ট কিচ্ছু করবে না।

আমি হেসে বললাম,

--- না করলেই ভালো। আল্লাহ ভরসা।

মামানি হাসলেন। আমি চুপচাপ ছাদের দিকে হাঁটা দিলাম। সিঁড়ির একধাপ থেকে আরেক ধাপে পা রাখছি আর আমার মন বলছে, "রোদ দৌঁড় দে, ওখানে বিপদ সঙ্কেত ঝুলছে রে। যাস নে, যাস নে।" মনের কথা না শুনেও যেতে হলো আমায়। ছাঁদের দরজায় দাঁড়িয়ে বার কয়েক জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে উনার দিকে এগিয়ে গেলাম। উনি উল্টোদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন। উনার গায়ে সাদা টি-শার্ট আর থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট। আমি উনার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো আমার। যা যা বলবো ভেবেছিলাম সবকিছুই যেন অগোছালো হয়ে গেলো। অথচ শুভ্র ভাই আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জানি, ছাঁদে পা রাখতেই উনি বুঝে গিয়েছিলেন যে আমি এসেছি তবু একটুও নড়াচড়া করেন নি উনি। আমার পায়ের পায়েলের শব্দটা নাকি একদমই অন্যরকম। সেই শব্দ নাকি রোদু রোদু বলেই কানে বাজে উনার। যদিও কথাগুলো ফাসকা আলাপ বলেই মনে হয় আমার তবুও কিভাবে যেন বুঝে যান উনি। সব কথা এলোমেলো করে ফেলে হুট করেই বলে ফেললাম আমি,

--- সরি!

শুভ্র ভাই এতোক্ষণ সামনে তাকিয়ে ছিলেন। এবার অন্যদিকে মুখ ঘুরালেন। আমিও কম যাই নি। অন্যপাশে দৌঁড়ে গিয়ে উনার মুখের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম,

--- আবারও সরি!

উনি আবারও মুখ ঘুরিয়ে সামনে তাকালেন। আমারও  জেদ চেপে গেলো। ছাঁদের রেলিং-এ রাখা উনার ডানহাতটা টেনে সরিয়ে উনার সামনে রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আবারও উনার হাতটা রেলিং এর উপর রেখে দিলাম। এমন একটা কান্ড করার পরও উনি আমার দিকে তাকালেন না। এমন একটা ভাব করলেন যেন সব স্বাভাবিক।  আমি কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে হাসি হাসি মুখে বললাম, 

--- কালো শাড়িতে আমায় কেমন লাগছে বলুন তো? আপু তো বলছিলো আমাকে নাকি অসম্ভব মায়াবতী লাগছে।  

উনি এবার আমার দিকে তাকালেন। একনজর দেখে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

--- একদম পেত্নী লাগছে। চাঁদের আলোতে পেত্নী।

আমি হেসে উঠলাম। বুঝতে পারলাম রাগটা একটু কমের দিকে আসছে। আমি মৃদু গলায় বললাম,

--- রাগ করে আছেন?

কথাটা শুনে উনি চলে যেতে নিলেই টি-শার্টের কলার চেপে ধরে দাঁড় করালাম আমি। এক হাত উনার কাঁধে রেখে অন্যহাতে উনার চুলগুলো এলোমেলো করতে করতে বললাম,

--- একদম নড়াচড়া না। আমি না বলা পর্যন্ত এখান থেকে যাওয়ার চেষ্টা করলে খবর আছে। আচ্ছা? বলুন না, রাগের কারণটা না বললে বুঝবো কিভাবে? 

উনি আমার ব্যবহারে কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর ভ্রু কুঁচকে দাঁতে দাঁত চেপে আমাকে দুই হাতে রেলিং এর সাথে চেপে ধরলেন। আমি ভেবেছিলাম, এই বুঝি দিন শেষ হলো আমার। নিশ্চয় ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলবেন। কিন্তু না, উনি তেমন কিছু করলেন না। রাগী গলায় বললেন,

--- শাড়ি কি আমি তোকে গুছিয়ে রাখার জন্য দিয়েছি? ঈদের দিন পড়িস নি কেন? 

উনার কথা শুনে আমি হতবাক। এই সামান্য একটা কারনে এতো কাহিনি করলেন উনি। ভাবা যায়? আমি বিস্মিত কন্ঠে বললাম,

--- এইটুকুর জন্য?

উনি অভিমানী গলায় বললেন,

--- এটা এইটুকু? তোর কোনো ধারনা আছে কতো কষ্ট করে কতো দোকান ঘুরে ঘুরে শাড়িটা কিনেছি আমি। লকডাউনের আগের লাস্ট দু'মাসের টিউশনির টাকা তোর এই শাড়ির পেছনে গিয়েছে। অথচ তুই গুরুত্বই দিলি না।

আমি কিছুক্ষণ বিস্ময় নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থেকে হাসি চেপে বলে উঠলাম, 

--- আচ্ছা সরি। তাছাড়া আমি কিভাবে পড়তাম বলুন? সবাই যদি জিগ্যেস করতো শাড়ি কোথায় পেলাম তখন? ছি! কি বিশ্রী অবস্থা হতো।

উনি আগের মতোই মুখ ফুলিয়ে বললেন,

--- হলে হতো।




আপনার জন্য আরোঃ-


১. ফিরে পাওয়া

২. লেডি হ্যাকার 

৩. রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর সেরা ৫০টি উক্তি 

৪. হুমায়ুন ফরিদী উক্তি 

৫. জীবন যেখানে যেমন বই থেকে নেওয়া একটা গল্প


* আমাদের ফেইসবুক পেজে লাইক
   দিয়ে একটিভ থাকুন। The Trend Reporter


* নিত্য নতুন কিছু পেতে আমাদের ইউটিউব
   চ্যানেলেটি Subcribe করুন। The Trend Reporter


* ব্লগ সাইটটি যাতে খুঁজে পেতে সমস্যা না হয়,
  সেজন্য Boipoka365 সাইটটি বুক মার্ক করে রাখুন।






আমি হাসলাম। উনার হাত সরিয়ে উনার সামনে থেকে সরে পাশে দাঁড়িয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। একটু চুপ থেকে বললাম,

--- কাল নাকি চট্টগ্রাম যাচ্ছেন? 

উনি সামনের দিকে তাকিয়েই বললেন,

--- না যাচ্ছি না। এখন আর যেতে ইচ্ছে করছে না। যাওয়াটা কি বেশি জরুরী? 

আমি হেসে দিয়ে বললাম,

--- আপনার যাওয়া জরুরি কিনা জানি না তবে আমার বাসায় যাওয়াটা খুব জরুরি। প্রায় সাড়ে আট বাজে। 

কথাটা বলে নিচের দিকে হাঁটা দিতেই পেছন থেকে বলে উঠলেন উনি,

--- দাঁড়া। একা যাবি না আমি দিয়ে আসছি....

নিচে নেমে মামানির সাথে দেখা হতেই মামানি জিগ্যেস করলো রাজি হয়েছে কি না। আমি চোখের ইশারায় "হ্যা" বুঝাতেই মামানি ঝাঁপটে ধরলেন আমায়। হাসিমুখে বললেন,

--- আমি বলেছিলাম না? তোর কথা নিশ্চয় শুনবে। এবার মিললো তো?

আমি কিছু বলার আগেই পেছন থেকে বিস্মিত কন্ঠে বললেন শুভ্র ভাই,

--- আম্মু? এসব তোমার প্ল্যান ছিলো? তাই তো বলি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি হয় কিভাবে!  

কথাটা বলেই আমার দিকে রাগী চোখে তাকালেন। উনার চোখদুটো যেন চিৎকার করে বলছে, "আজ তোর খবর আছে রোদ, ইউ আর গন !" উফফ! লাস্ট মোমেন্টে এসে আবারও ফেসে গেলাম আমি। অথচ প্ল্যানিং অফিসার আমার মামানি কি সুখের হাসি হাসছেন। অসহ্য!!





Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা



NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner