> বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব ১৯, ২০ - Bangla Love Story - রোমান্টিক গল্প - Bangla New Story - Love Story Bangla
-->

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব ১৯, ২০ - Bangla Love Story - রোমান্টিক গল্প - Bangla New Story - Love Story Bangla

--ওহে আঙ্কেল ইহার চেয়েও উচ্চ শব্দের রিংটোন মোর মুঠোফোনে রহিয়াছে।আপনার কি লাগিবে? (সজল ভাইয়া)

সজল ভাইয়ার এমন ভাবে কথা বলা দেখে আমরা সবাই এক ধাপ হেসে নিলাম।কিন্তু সবাই মুখ চেপে হাসি থামানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।মোর্শেদ খালু তখন তার ফোনটা উচু করে এপাশ ওপাশ করছে।সজল ভাইয়ার কথা তার কর্নপাত হয়নি।খালু আমাদের কে দেখে বললেন,,,

--নেটওয়ার্কের নাতি পুতিকেও দেখা যাচ্ছে না। 

তখন সজল ভাইয়া বলল,,,

--আঙ্কেল নিয়াজদের এবাড়িতে তো আর আম গাছ নেই।

-- হ্যাঁ তাইতো কি যে করি। (খালু)

তখন সার্থক ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

--আঙ্কেল আমার কাছে কিন্তু একটা আইডিয়া আছে। যদি চান তো আমি আপনাকে বলতে পারি।

খালু উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু করলেন,,,

-- আরে বল বল। তাড়াতাড়ি বল। 

--আসলে আমার জানামতে নিয়াজ দের বাড়ির পিছনে কিন্তু একটা নারিকেল গাছ আছে। তো আপনি যদি চান ওটায় ট্রাই করতে পারেন।

--ইউ মিন টকিং টু নারিকেল গাছ?(খালু) 

-- আরে না না না। আমি সেটা বলিনি তো।(সার্থক ভাইয়া)

তাদের দুজনের কথা শুনে আমার হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। আস্তে করে নিচু স্বরে সবাইকে শুনিয়েই বললাম,,, 

--আমাদের খালু একবার মাধ্যমিক ফেল। 

এমন ভাবে বললাম যেনো খালু শুনতে না পায়।

সার্থক ভাইয়াও আমাদের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,,, 

-- আগে বলবা না। এই পিছ তোমার খালামণি পাইল কিভাবে?

--আরে লাভ ম্যারেজ।তাই তো খালু খালামনিকে হালকা পাতলা ভয়ও পায়। (আমি)

আমাদের ফুসুরফাসুর করার মধ্যেই খালু বলে উঠলেন,,,

--আচ্ছা গাছে উঠব কিভাবে?আগের বার তো আম গাছে উঠেছিলাম।এটা তো নারিকেল গাছ। লুঙ্গি কেন, সব খুলেও তো উঠতে পারব না।

খালুর এমন বোকা বোকা কথায় আমরা তার সামনেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি। তখন খালুকে খুঁজতে খুঁজতে খালামণি ছাদে এসে পড়ে আর খালু কে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। খালু চলে যাওয়ার পর আমরা অনেক সময় ছাদে বসে সবাই গল্প করি।

নিয়াজ ভাইয়ার রিসেপশনের অনুষ্ঠান টা ভালোয় ভালোয় কেটে গেল। রিসিপশনের পরে আরো দুই দিন কেটে গিয়েছে। এই দুই দিনে আমরা অনেক মজা করেছি। খুব ভালো কেটেছে এ দুটো দিন। কাল আমরা তাসফি আপুকে নিয়ে গাজীপুর চলে যাব। আমাদের এ বাড়িতে কাল শেষদিন বলে আজকে আমরা সবাই মিলে ঘুরতে বের হওয়ার প্ল্যান করেছি।দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা সবাই রেডি হচ্ছি ঘুরতে যাওয়ার জন্য।

আমরা মূলত একটা নদীর পাড়ে ঘুরতে যাচ্ছি। আজকে যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে মেলা দেখা। সেই ছোটবেলায় একবার মেলায় ঘুরতে এসেছিলাম। এরপর আর মেলা দেখা হয়নি। আমরা আজ যেই মেলায় যাচ্ছি সেটা টানা ৩ দিন ব্যাপী চলবে। আজকে দ্বিতীয় দিন চলছে মেলার।

আমরা সবাই বাড়ির সামনে থেকেই অটোতে করে মেলায় এসে পৌঁছালাম। নদীর পাশে বড় মাঠের মতো বিস্তর জায়গাজুড়ে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় আমরা মোট আটজন এসেছি। আমি, সাদু, রাফিদা আপু, তাসফি আপু, নিয়াজ ভাইয়া, সজল ভাইয়া, আলআবি ভাইয়া, আর সার্থক ভাইয়া।

মেলায় আনন্দের সাথে বিরক্ত বলে একটা জিনিস আছে। তা হচ্ছে কিছু মানুষের ইচ্ছাকৃতভাবে গা লেগে হেঁটে যাওয়া। এত এত মানুষের ভিড়ে একজন আরেকজনের সাথে ধাক্কা লাগতেই পারে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছে ইচ্ছাকৃতভাবেই তারা এসে ধাক্কা দিয়ে যায়। এ পর্যন্ত মেলায় এসে তিনবার করে ধাক্কা খেয়েছি আমি। তাও আবার একজনের সাথেই।এখন একেবারে স্পষ্ট ছেলেটা ইচ্ছে করে এসে ধাক্কা লেগেছে। এমন পরিস্থিতিতে বলাও যাবে না যে লোকটা ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দিচ্ছে। বললে বলবে এমন ভিড়ে একটু আকটু ধাক্কা লেগে যায় এটা স্বাভাবিক। তাই এসব বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে মেলায় মনোযোগ দেই। হঠাৎ করে মনে হল আমার দুই বাহু পেছন থেকে কেউ চেপে ধরেছে। পিছন ফিরে আমি হতবাক হয়ে যাই। দেখি আলাবি ভাইয়া আমার দুই বাহু ধরে পেছন পেছন আসছেন। ভিড়ের মাঝে কেউ অত একটা আমাদের লক্ষ্যও করছে না। ছোটবেলায় যেমন আমরা একজন আরেকজনের কাঁধে হাত রেখে ট্রেন ট্রেন খেলতাম ঠিক সেইরকম আলাবি ভাইয়া আমার কাঁধে হাত  না রেখে কেবল দুই বাহুতে হাত রেখেছেন। তিনি যদি আমার কাঁধে হাত রাখতেন তাহলে যেকোনো বাচ্চা দেখলেই বলতো আমরা দুজন ট্রেন ট্রেন খেলছি। মুহুর্তের মধ্যেই আমার মনে হল আমি মনে হয় সবচেয়ে সুরক্ষিত কোন খাঁচার মধ্যে আবদ্ধ আছি। কোন খারাপ স্পর্শ আমাকে ছুতে পারবে না। অদ্ভুত একটা ভালো লাগা কাজ করে গেলো মনে। আমার আর বুঝতে বাকি নেই যে আলআবি ভাইয়া আমাকে প্রটেক্ট করার জন্যই এভাবে আমার পেছন পেছন আসছেন। তাকে এখন মন থেকে খুব বড় করে একটা ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে ভেবে রাখলাম বাড়ি গিয়ে তাকে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে দেবো। 

আমরা যে মেলায় এসেছি এটাকে এক ধরনের গ্রাম্য মেলাই বলা চলে। আর এই গ্রাম্য মেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রকরণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে পুতুল নাচ। আমরা এখন পুতুল নাচ দেখার জন্য টিকেট কেটে বসে আছি।একটু পরে পুতুলদের নাচ শুরু হবে। পুতুলনাচের মঞ্চের পেছনে একজন লোক সুতো দিয়ে পতুল বেঁধে তাদের নানাভাবে নাচাচ্ছে। ছোট ছোট পুতুলগুলোর ছোট ছোট হাত-পা হেলিয়ে দুলিয়ে নাচ গুলো বেশ উপভোগ করছি। প্রায় বিশ মিনিটের মত পুতুল নাচ দেখে আমরা "পুতুল নাচ ঘর" থেকে বের হয়ে এলাম।

মেলার আরেকটা মজার জিনিস হল বাইস্কোপ। সাধারণত বাইস্কোপ দেখানোর সময় ছড়া কেটে বাইস্কোপের ভিতর দেখানো চিত্রের বর্ণনা দেওয়া হয়। বাইস্কোপ দেখতে গিয়ে সাদু আর আমি এক দফা ঝগড়া করেছি। মেলাতে খাবারের মধ্যে অনেক ধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবার রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে মজার হল হাওয়াই মিঠাই। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার অনুভূতিটাই অন্যরকম। মেলাটা ঘুরে দেখতে দেখতে আমার চোখ যায় একটা কাচের চুড়ির দোকানের দিকে। চুড়ির দোকানে গিয়ে আমরা সবাই চুড়ি কিনলাম। সাদু সবুজ রঙের কাঁচের চুড়ি কিনেছে আর আমি কিনেছি সাদা রঙের কাঁচের চুড়ি। আসলে সাদাটা আমার বরাবরই একটু বেশি পছন্দের। চুড়ির দোকানের সামনে সার্থক ভাইয়া রাফিদা আপুকে চুড়ি পরিয়ে দেয়। নিয়াজ ভাইয়াও তাসফি আপুকে চুড়ি পরিয়ে দেয়। দুই জোড়া কপোত-কপোতীদের এমন একটা রোমান্টিক সিন দেখে সাদু,আমি আর সজল ভাইয়া এক সঙ্গে বলে উঠলাম,,, 

--হাউ রোমান্টিক!!!

সজল ভাইয়া তখন একটু কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বলে উঠলো,,,

--ওভাই আমারেও একটা বউ আইনা দে।আমিও একটু চুড়ি পরাইতে চাই।

সজল ভাইয়ার কথায় আমরা একটু হেসে উঠলাম। চুড়ি কেনা শেষ করে আমরা নাগরদোলায় উঠলাম। নিয়াজ ভাইয়া, তাসফি আপু, সার্থক ভাইয়া আর রাফিদা আপু একসাথে উঠেছে।  আমি, সাদু, সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়া একসাথে উঠেছি। নাগরদোলা ২বার ঘুরে আসতেই সজল ভাইয়া আলআবি ভাইয়ার বাহুধরে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলতে লাগলো,,, 

--ভাই আমারে নগরদোলায় উঠাইছোস নাকি রকেট দিয়া পৃথিবী ঘুরাইতাছোস?ভাই রে ভাই আমার তো দুনিয়টাই ঘুরতাছে।থামা ভাই থামা।তুই আমার আলুবাবু,গুলুমুলু,তুলুতুলু।প্লিজ ভাই থামা।

সজল ভাইয়া ভয়ের চোটে যে কি বলছে তা নিজেও বুঝতে পারছে না। আলআবি ভাইয়া কে ওইভাবে নাম ধরে ডাকায় আমি আর সাদু হাসি চেপে রাখতে না পেরে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের উপর হেলে দুলে পড়ছি। এমন সময় আমার অসাবধানতায় হাত ফসকে আমার হাতে থাকা চুড়ি গুলো পড়ে গেল। চুড়িগুলো পড়ে একেবারে চুরমার হয়ে গিয়েছে তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চুড়ি গুলো পড়ে যাওয়াতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঠিক তখনই আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,, 

--হাসো আরো বেশি বেশি করে হাসো। হাহাহা। 

কথাটা বলেই উনি হাহাহা করে আমাদের ব্যঙ্গ করলেন। আমি মুখটা গোমড়া করে চুপচাপ বসে রইলাম। সজল ভাইয়া তার প্রলাপ বকে যাচ্ছে। সে কি বলছে তা নিজেও জানেন না।

কিছু সময় পর নাগরদোলা থেমে গেলে আমরা সবাই নেমে আসি। তখন সজল ভাইয়া বলে,,, 

--আরেকটু হইলেই তো যাইতাম ফুটুস হইয়া। তখন আমার হবু বউ টা রে কে চুড়ি পড়াইত

নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলো,,, 

--তোর হবু বউয়ের জামাই।

মেলা থেকে ফিরে আসার সময় আমরা ফুচকা খায় ফুচকা খেতে গিয়ে সেখানে ঘটে আরেক ঘটনা। ফুচকায় বরাবরই ঝাল বেশি দিয়ে খেতে ভালো লাগে। আমি, সাদু তাসফি আপু,আর রাফিদা আপু ঝালের প্রতিযোগিতায় নেমে পরি।কে কত বেশি ঝাল খেতে পারি। অবাক করার বিষয় হলো আমাদের সাথে আলআবি ভাইয়াও ফুচকা খেতে বসেছে। তাকে ফুচকা খেতে দেখে অবাক হয়েছি তার কারণ, একটু গম্ভীর টাইপের ছেলেরা ফুচকা খেতে চায় না। এটা আসলে আমার ধারণা। ভেবেছিলাম হয়তো আলআবি ভাইয়াও  বলবে এসব বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার আমি খাই না। আমার ধারনা কে ভুল প্রমাণ করে সেও বসে পড়ে খেতে। 

ভাইয়াদের খাওয়া শেষ কারণ তারা এক প্লেট  করে ফুচকা খেয়েছে। আমরা মেয়েরা একবার ফুচকা খেয়ে এরপর দ্বিতীয় প্লেট ফুচকা নিয়ে বসেছি  তাও আবার আগের তুলনায় ঝাল বেশি। দ্বিতীয় প্লেটের কয়েকটা ফুচকা খাওয়ার পরে  আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করল। মুখটা "ও" আকৃতি করে মুখের ভেতর বার বার বাতাস ঢুকাচ্ছি। ঝাল আমি খেতে পারি তবে আজকের ঝাল টা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গিয়েছে। তাই আর খেতে পারছি না। চারপাশে তাকিয়ে পানি খুঁজতে লাগলাম। তখনই দেখি আলআবি ভাইয়া এক বোতল পানি আমার সামনে ধরে রেখেছেন। দেখে মনে হচ্ছে বোতল টা পুরোই নতুন। হয়তোবা এইমাত্র কিনে আনা। আমি সাতপাঁচ না ভেবে তাড়াতাড়ি বোতলটা নিয়ে বোতলেই মুখ লাগিয়ে খেতে শুরু করলাম। তার এমন কাজে অবাক হইনি। কিন্তু পরবর্তীকাজে অবাক না হয়ে পারলাম না। কারণ আমার পাশের চেয়ারে বসে আমার মুখ লাগিয়ে খাওয়া বোতল টায় আলআবি ভাইয়া ও মুখ লাগিয়ে পানি খেতে শুরু করলেন। আমি তড়িৎগতিতে বলে উঠলাম,,,

-- ভাইয়া এটায় আমার মুখ লাগানো। 

আমার কথা শুনে আলআবি ভাইয়া একবার আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। এরপর পুনরায় আগের মত করেই বোতলে মুখ লাগিয়ে আমার অর্ধেক খাওয়া পানিটা পুরো খেয়ে বোতলটা ফেলে দিলেন। আমি ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু সে একটা গা ছাড়া ভাব নিয়ে নিজের মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তখন আমি আমতা আমতা করে আলআবি ভাইয়াকে বললাম,,, 

--ধন্যবাদ ভাইয়া।

তখন আলাবি ভাইয়া ফোন থেকে তার দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করে বললেন,,,

-- কোনটার জন্য?

ভাব দেখলে আর বাঁচি না। মনে হয় যেন সারা জীবন আমাকে সাহায্য করে উদ্ধার করেছেন। এই জুইঁয়ের কাছ থেকে ধন্যবাদ পাচ্ছে তাও আবার বলছে কোন টার জন্য? 
আমি পুনরায় বললাম,,, 

--তখন মেলায় আমাকে সেফ রাখার জন্য।

আমার কথার পৃষ্ঠে কোন জবাব না দিয়ে তিনি কেবল "হুম" বলে আবার ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

বাড়িতে এসে আমরা রাতে খাবার কেউই খেতে পারলাম না। মেহমান এর চাপ একটু কমে যাওয়ায় আমার রুমে আমি আর সাদু ঘুমালাম। এই কয়দিন আমাদের দুজনের মাঝে কোন দেশের বর্ডার দিতে পারিনি, মানুষজন বেশি ছিল বলে। আজকে ঘুমানোর সময় সাদু আর আমার মাঝখানে একটা বর্ডার দিয়ে দিলাম অর্থাৎ কোলবালিশ দিয়ে দিলাম। তারপর আমি আর সাদু কথা বলতে বলতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। 

এলার্মের শব্দে সকালে ঘুম ভাঙ্গলো। ফোনের এলার্ম টা বন্ধ করে বিছানায় বসেই একটু মোচড়ামুচড়ি করছিলাম। বাইরে একটা মোরগ অনবরত ডেকে যাচ্ছে। ঘরে বসেই বাইরে কারও উঠোন ঝাড়ু দেওয়ার শব্দ পাচ্ছি। সকালের নাস্তা খেয়েই ব্যাগপত্র গুছিয়ে আমরা চলে যাব। এই কথা মনে পরতেই বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালাম। পাশেই ড্রেসিং টেবিলের উপর চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম।


--ওরে চান্দু! তলে তলে তুমি জাহাজ চালাইয়া ফালাইতাছো আর আমি জানি না কিছু।

হঠাৎ করেই সাদুর গলার আওয়াজ পেয়ে হকচকিয়ে উঠলাম। পিছনে ফিরে দেখি সাদু বিছানার উপর বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর তাকানো দেখে মনে হচ্ছে ও গোয়েন্দা বিভাগের জন্য কাজ করে একে বারে সব উদ্ধার করে ফেলবে।আমি ওকে বললাম,,, 

--জাহাজ চালাইতে পারলে কি আর এই জায়গায় বইসা থাকতাম নাকি?

--আমি তো দেখতাছি তুই এই জায়গায় বইসাই জাহাজ চালাইতাছোস।কিরে কাহিনী কি?

ওকে বলা শুরু করলাম,,,

সকালে ড্রেসিং টেবিলের দিকে চোখ পরতেই দেখি টেবিলের উপরে একটা ছোট বেলিফুলের চারা আর নীচে একটা গোলাপ গাছ।গাছের দুই ডালে দুইটা হালকা হলুদ রঙের ফুল ফুটে আছে।দুইটা ডালেই একটা একটা করে চিরকুটের মতো কাগজ বেঁধে রাখা। একটা খুলে দেখি আমার সেই চেনা হাতের নীল কালিতে লেখা,,,

"গাছ টা তোমার জন্যই।আমি জানি তুমি গাছটাকে আগলে রাখবে। তাই আর বলার প্রয়োজন নেই"।

দ্বিতীয় টায় লেখা,,,

" বেলিফুল আমার #বর্ষণ_সঙ্গিনীর পছন্দের আর এই হলুদ গোলাপ তোমার বর্ষণ সঙ্গির পছন্দের। তাই দুটো একসাথে দিলাম।এখন আপাতত এতটুকু জেনে রাখ"। 

--কি?বুঝলি কিছু?(আমি) 

-- বুঝলাম তোর ও ভালোবাসার মানুষ আইসা পড়ছে। (সাদু)

কথাটা বলেই সাদু ফ্রেশ হতে চলে গেল। সাদুর কথা শুনে আমি দুই হাতে দুইটা চিরকুট  নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। সত্যিই কি আমাকে কেউ ভালবাসে? আমি ও কি বেলা শেষে একটা ভালোবাসার হাত পাব? লোকটা যদি আমাকে সত্যিই ভালোবেসে থাকে তাহলে আমার সামনে আসে না কেন? ভালোবাসার মানুষকে কি না দেখে থাকা যায়? ধুর! কি যে চিন্তাভাবনা করছি।লোকটা আমাকে কেন ভালোবাসবে? সে তো আর আমাকে বলেনি সে আমাকে ভালোবাসে।

সকালে হালকা-পাতলা নাস্তা করে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে অটোতে উঠাচ্ছিল নিয়াজ ভাইয়া। বাড়ি থেকে দশ পনেরো মিনিটের রাস্তা আমরা অটো করে যাব। মেইন রোডে আমাদের ভাড়া করা মাইক্রো আসবে। আমার ব্যাগের পাশে নিয়াজ ভাইয়া গাছ দুটো দেখে বলল,,, 

--এই গাছপালা নিয়ে যাবি নাকি?

আমি বললাম,,,

-- হ্যাঁ।

ভাইয়া কপালটা একটু কুঁচকে আবার আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল,,,

-- এই দুইটা কোথায় পেলি?

ভাইয়ার প্রশ্নে আমি অনেকটা ঘাবড়ে গেলাম। হুট করেই সাদু বলে উঠল,,,

-- আরে ভাইয়া এগুলোতো ওকে সুমনা আপু দিছে।

আমি সাদুর দিকে তাকাতেই আমাকে একটা চোখ মেরে পুনরায় ভাইয়া কে বলল,,,

-- আমাদের জুঁইফুলের বেলিফুল খুব পছন্দের। এই জন্যইতো সুমনা আপু ওরে বেলিফুল দিছে।সাথে গোলাপ ফুলও এক্সট্রা ফ্রী দিল।

ভাইয়া "ওহ আচ্ছা " বলে গাছ দুইটা উঠিয়ে নিল। আসলে গাছ দুইটা পেয়ে আমিও মনে মনে একটু খুশি হয়েছি।

গাড়ির সামনে এসে খেয়াল করলাম এটা আগের তুলনায় একটু বড়। আর মানুষও আমরা আগের তুলনায় ৩-৪ জন বেশি। গাড়িতে ওঠার সময় সাদু বলল,,,

--সজল ভাইয়া আমি তোমার পাশে বসব।

--ওই সজল ভাইয়ার সাথে বসবি কেন?(আমি)

--বিয়ার সব পিক নিতে হইব না?(সাদু)

--আগে কি করছিলি? (আমি)

--পিক তুলছি।(সাদু) 

--সাদমান ভাই জানে তার বউ সজল সজল করে।(আমি)

--ওই তো কইছে সজল ভাইর থিকা আমার বিয়ার সুন্দর সুন্দর পিক নিয়া যেন ওরে দেই।(সাদু)

--তোর আবার বিয়া হইলো কবে?(আমি)

--আরে বা* তোর ভাইর বিয়াতে আমি যেই পিক তুলছি ওগুলি চাইছে।বুঝছোস নাকি আরও কইতে হইব?(সাদু)

--ওহ্।ভালো কইরা কবি না।(আমি)

গাড়িতে আমার পাশে আলআবি ভাইয়া বসে। তার পাশে সজল ভাইয়া আর তার পরে বসে সাদু। রাতে সাদুর সাথে ঘুমানোর কারণে ভালোভাবে ঘুম হয়নি। কারন ও আমার উপর একটু পর পর হাত পা উঠিয়ে দিয়েছিল। তাই এখন একটু ঘুম ঘুম ভাব আসছে। অনেক চেষ্টা করেও চোখটাকে মেলে রাখতে পারছি না। চোখটার সাথে  অনেক সময় যুদ্ধ করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মাথায় কারো স্পর্শ পেয়ে হঠাৎ করে চোখ মেলে তাকালাম। দেখি আলআবি ভাইয়া তার ডান হাতে আমার হিজাব পরিহিত মাথাটার একপাশ চেপে ধরে আছেন।আরেকটু হলেই তার কাধে গিয়ে আমার মাথা ঠেকতো। এমন অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি করে নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের এমন অবস্থা কেউ দেখেনি। সজল ভাইয়া সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে মুখটা হা করে ঘুমাচ্ছে। সাদু কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিয়ে মাথাটা জানালায় ঠেকিয়ে  চোখ বুজে আছে।ঘুমাচ্ছে কিনা তা বুঝা মুশকিল। এবার আলাবি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি মোবাইলে কিছু একটা করছেন। তাই আমি আর কিছু না বলেই বাইরের দৃশ্যের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। তখনই আলআবি ভাইয়া আস্তে করে বলে উঠলেন,,,

-- ম্যানার্স ভুলে গেলে?

তার কথার মানে বুঝতে পেরে আমিও আস্তে করেই তাকে বললাম,,,

-- সরি। 

বলে আবারো বাইরের দিকে তাকালাম। কারণ বাইরের এই দৃশ্য টাকে মিস করতে চাইনা। অন্যদিকে ঘাড় ঘোরানোর সাথে সাথে আবার আলআবি ভইয়া বলে উঠলেন,,,

--ধন্যবাদ কে বলবে?

তার এমন ভাব দেখে মনে হচ্ছে তাকে এক্ষুনি ধাক্কা মেরে গাড়ি থেকে ফেলে দেই। একটুখানি মাথা ধরে ভাব এমন করছে যেন পুরো দেশকে করোনা মুক্ত করে ফেলেছে। তাকে আস্তে করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,,,

-- আমি কি বলেছিলাম আপনাকে আমার মাথা ধরে বসে থাকেন? 

--আমিও তো বলিনি বারবার আমার কাধের উপর এসে ঢোলে পড়ো।(আলআবি ভাইয়া)

--আমার মাথা আমার ইচ্ছে।আমি ঢোলে পড়বো না হলে লাফিয়ে পড়বো তাতে আপনার কি?(আমি)

--অবশ্যই আমার কিছু। আমার গায়ে পড়বে কেন তুমি?(আলআবি ভাইয়া) 

--আমি ইচ্ছা করে কি পড়েছি নাকি?(আমি)

--সেটা তুমিই ভালো জানো।(আলআবি ভাইয়া)

--কথা কম বললেও ঝগড়া তো কম পারেন না।(আমি)

-- সামনে তোমার মত একটা ঝগড়াটে মেয়ে থাকলে সবাই এসে এসে একটু করে ঝগড়া করে যাবে।(আলআবি ভাইয়া)

আমি এবার আর না পেরে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,,,

--আমি ঝগড়াটে মেয়ে?

গাড়ির সবার দৃষ্টি এখন আমার দিকে। সাথে সাথে সাদু বলে উঠলো,,, 

--এতদিন পরে বুঝলি?

ওর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতেই নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলো,,, 

--হঠাৎ করে তোর নিজের পরিচয় দিতে ইচ্ছা হল কেন?

এমনভাবে যে ফেঁসে যাবো তা বুঝতেই পারিনি। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে এখন।আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি আরাম করে ফেসবুকে নিউজ ফিড স্ক্রল করেছেন। কাউকে আর কোন কিছু না বলে সোজা বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে ঘুম নামক কোন বস্তু যদি আমার সামনে পেতাম তাহলে তার সাথে এখন বক্সিং খেলতাম।

বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের সাড়ে তিনটার মতো বেঁজে যায়। আজকে অবশ্য রাস্তায় জ্যাম একটু বেশি ছিল। বাসায় আসার সময় নিয়াজ ভাইয়া বিরিয়ানি কিনে নিয়ে আসে। আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে যে যে যার যার রুমে চলে আসি। রুমে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। একটা জিনিস ভেবে খুবই ভালো লাগছে যে এখন বাসায় আমাদের একজন সদস্য বেড়ে গেল। এখন বাসায় তাসফি আপুও থাকবে। আমার গল্প করার জন্য খুব ভালো একজন পার্টনার পেয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে নিয়াজ ভাইয়া আর বাবার সম্পর্কটা ও স্বাভাবিক হচ্ছে। এখন আমার একটা হ্যাপি ফ্যামিলি হবে। এই হ্যাপি ফ্যামিলি তে যদি আম্মু থাকতো তাহলে আরো অনেক বেশি ভালো হতো। এসব ভেবেই মনে অনেকটা প্রশান্তি পেলাম।

কারো ডাকে আমার ঘুম ভাঙলো। চোখটা মেলে দেখি আমার সামনে তাসফি আপু বসে আছে আর আমাকে ডাকছে। তাসফি আপুর ডাকের সাথে চারপাশে থেকে আজানের ধ্বনি কানে এসে লাগছে। আমার সামনে তাসফি আপু কে দেখে উঠে বসলাম। আপু বলল,,,

-- মাগরিবের আজান দিচ্ছে? এখনো ঘুমাচ্ছ?  তাড়াতাড়ি ওঠ।

আপুকে এভাবে ডাকতে দেখে কতটা যে ভালো লাগলো তা বলে বোঝানোর মত নয়। বিছানায় বসেই আপুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। তখন আপু বলে উঠলো,,,

--কি দেখছ? নামাজ পড়বে না?

আপুর দিকে তাকিয়েই বললাম,,, 

-- জানো ছোটবেলায় বাবা ডেকে ঘুম থেকে উঠাতো।বড় হওয়ার পরে ফোনের এলার্ম শুনে শুনে উঠতে হয়। অনেক কয়েক বছর পর এই প্রথম আমাকে কেউ এভাবে ডেকে তুলেছে।তোমার এভাবে ডেকে তোলায় আমার যে কতটা ভালো লেগেছে তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না।

--এখন থেকে আরও অনেক কিছইু ভালো লাগবে।এই পিচ্চি মেয়েটাকে আমিই দেখে শুনে রাখব এখন থেকে।

বলেই আমার গালটা একটু টেনে দিল।তারপর আবার বলল,,,

--এবার ওঠ তাড়াতাড়ি। মাগরিবের আযানও শেষ হয়ে গিয়েছে।  

আপু রুম থেকে বের হতেই উঠে অযু করে নামাজ পড়ে জায়নামাজ টা ভাজ করছিলাম তখন তাসফি আপু আবার এসে হাজির। আমার সামনে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল,,,

-- বাসায় তো তুমিই রান্না করতে তাইনা?

আমি বললাম,,,

-- হ্যাঁ। মাঝে মাঝে কমলা আন্টি করে দিত। কেন? 

--আসলে কিচেনে গিয়ে কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না ভালো ভাবে। তাই তোমার কাছে জানতে আসলাম কোথায় কি রাখা হয়।একটু আসো আমার সাথে।(তাসফি আপু)

--এসেই রান্নাঘরে পাকনামো শুরু করে দিয়েছো?(আমি) 

--আরে বেশি কিছু না একটু কফিই শুধু বানাতে যাচ্ছিলাম। নিজের হাতে কফি তৈরি করে নিজের শশুর়কে, হাসবেন্ডকে আর এই পিচ্চি মেয়েটাকে খাওয়াতে চাই। বুঝেছ?(তাসফি আপু)

--জ্বি বুঝেছি ম্যাডাম(আমি)

আমার কথা শুনে তাসফি আপু হেসে দিল। তারপর বলল,,,

--দুই ভাইবোন তো দেখি একই ধাঁচের।

আমি বললাম,,, 

--কিভাবে জানো?

--তুমি যে ভঙ্গিতে আমাকে ম্যাডাম বললে তোমার ভাইয়া ও মাঝে মাঝে এভাবে আমাকে বলে।(তাসফি আপু)

-- প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ! তোমাদের লাভ স্টোরি কিন্তু শোনাবে আমাকে। (আমি)

--আচ্ছা চলো কফি খেতে খেতে শোনাবো(তাসফি আপু)

কফি বানিয়ে তার সাথে ফ্রিজে রাখা সিঙ্গারা ভেজে আমি আর তাসফি আপু ভাইয়া আর বাবাকে ড্রইংরুমে দিয়ে আসলাম। তাসফি আপুকে নিয়ে আমার বারান্দায় এসে টুল ছাড়াই ফ্লোরে বসে পড়লাম আমরা। কফির মগে একবার চুমু দিয়ে তাসফি আপুর দিকে তাকালাম। তারপর বললাম,,, 

--এবার কিন্তু বলতে হবে। শুরু করো।

তখন আপু একটু মুচকি হেসে বলল,,,

-- আচ্ছা বলছি তাহলে শোনো।



চলবে...



Writer:- হুমাশা এহতেশাম




NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner