৩টা পাখিই ছেড়ে দেয়ার পর দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পাখিদের চলে যাওয়া দেখছি আলআবি ভাইয়া কে উদ্দেশ্য করে বললাম,,,
--একটা কথা বলি?
আলআবি ভাইয়া আকাশ পানে তাকিয়েই বললেন,,,
--বলে ফেলো
--সাদা রঙ ছাড়া আপনি অন্য রঙ এর জামা পড়েন না কেন?(আমি)
--সাদা জামায় দাগ ভরলে কিছু দাগ উঠবে কিছু দাগ উঠবে না।যে দাগগুলো উঠবে সেগুলো তাদের ছাপ রেখে যাবে সারাজীবন এর জন্য। আমি যখন সাদা পাঞ্জাবি পড়ি তখন সবসময় দাগ থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করি।আমি যে পথে চলছি এ পথে সৎ থাকাটা কিছু টা কষ্টের।রাজনীতির মাঠে নামলে আমার এই সাদা পাঞ্জাবি ই আমাকে মনে করিয়ে দেয় চরিত্রে দাগ লাগানো যাবে না।সময়ের তালে তালে দাগ ফিকে হয়ে যাবে ঠিকই কিন্তু আজীবনের জন্য একটা ছাপ রেখে যাবে। (আলআবি ভাইয়া)
--আরেকটা কথা বলি?(আমি)
আলআবি ভাইয়া এবার আমার দিকে দৃষ্টি দিয়ে ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি বজায় রেখে নরম কন্ঠে বললেন,,,
--বলো।
তার এই "বলো" শব্দ টা অতি সামান্য হলেও কেন যেন আমার কাছে অন্য রকম লাগলো।এ মুহূর্তে খুব আবেদনময় লাগছে তাকে। মনে হচ্ছে কোনো ছোট বাচ্চার থেকে মুখের বুলি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,
--ধন্যবাদ এতো সুন্দর মুহূর্ত উপহার দেয়ার জন্য।
আলআবি ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসি হাসলেন।মনে হলো হাসিটা হুট করেই আমাকে লজ্জায় ফেলে দিল। কাউকে ধন্যবাদ দিলেও কি লজ্জা লাগে নাকি?এ দিনও আমার দেখতে হচ্ছে। নাকি আমারই কোনো অসুখ হলো? কথাটা বলে আর একমুহূর্তও দেরি করলাম না। সোজা ঘুড়ি উড়ানোর স্পটে এসে পরলাম।
আজ বান্দরবান আমাদের ২য় দিন।পরশুরাতে আমরা এখান থেকে বিদায় নিব।একটু আগেই আমাদের প্ল্যান চেঞ্জ হলো।তাহলো,ভিলায় আমরা আর ব্যাক করবো না।পরশুদিন পর্যন্ত আমরা নতুন রিসোর্টে ই থাকবো। তার কারণ হলো রিসোর্ট থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরেই চিম্বুক পাহাড় অবস্থিত। তাই ভিলায় ব্যাক না করেই আমরা ওখান থেকে ই চিম্বুক পরিদর্শন করতে পারি। এতে জার্নিটাও কম হবে।
সকাল এখন ৯ টা বেজে ১৫ মিনিট। আমরা সবাই আলআবি ভাইয়ার রিসোর্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরেছি।অনেকটা সময় পথ অতিক্রম করে আমরা আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত রিসোর্টে পৌঁছালাম৷
রিসোর্টের প্রতিটা কটেজই দৃষ্টি কেঁড়ে নিবে প্রত্যেকের।এখানে মোট ১৩ টা কোটেজ আছে।সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষনের দিক হলো প্রত্যেকটা কটেজই ছোটখাটো একটা গোলাপ বাগানে ঘেরা।সাথে বেলিফুলও রয়েছে।গোলাপ আর বেলি বাদে কিছু নাম না জানা অপরিচিত ফুলও রয়েছে।কটেজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিটা কটেজ কাঠের তৈরি যা মাটি থেকে একটু উঁচুতে।কটেজে ওঠার জন্য রয়েছে কাঠের সিঁড়ি। এই রিসোর্টের সীমানা গোলাকৃতির।এখানে যার নামে কটেজ বুক করা হয় তার নামের নেমপ্লেট টানিয়ে দেয়া হয় দরজায়।এখানে খাবার এর ও ব্যবস্থা আছে।তবে খাবারটা নাকি যার যার কটেজে এসে দিয়ে যাওয়া হয়।আরো ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো খাবার রান্না হয় মাটির চুলোয়।বাঙালি খাবার ছাড়া মেনুতে অন্য কোনো বাইরের ফুড নেই।এক কথায় বলতে গেলে রিসোর্ট প্ল্যান টা খুব ই দারুণ।
আজকে রিসোর্টে বাইরের কোনো পর্যটক নেই। অফিস স্টাফ, আর আমরাই পুরো রিসোর্টে।এখানে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে রিসোর্টটা সবাই মিলে ঘুড়ে দেখলাম।এখানে আসার পরেই আলআবি ভাইয়া কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গিয়েছেন।কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির মুখ দর্শন করতে না পেরে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল।রিসোর্ট টা ভালো করে দেখা শেষ হলে আমার আর রেনুমার জন্য বরাদ্দকৃত কটেজে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমের দেশে পারি জমালাম।রাতে একটা ছোটখাটো পার্টি হবে। হয়তোবা অনেক সময় রাত জেগে থাকা হবে।
দরজায় কড়া আঘাতের শব্দে চোখ মেলে তাকালাম। দেখি রেনুমা পাশের সিঙ্গেল বেডে বেঘোরে অগোছালো ভাবে ঘুমাচ্ছে।আমার বেড থেকে উঠে গিয়ে ওকে একটু ঠিকঠাক করে দরজা খুলে দিলাম। দেখি রিসোর্টের একজন স্টাফ দাঁড়িয়ে আছে। আমার হাতে দুটো শপিং ব্যাগ ধড়িয়ে দিয়ে বলল,,,
--ম্যাম এটা স্যার এর পক্ষ থেকে আপনাদের দুজন এর জন্য।
--কোন স্যার?(আমি)
--আলআবি স্যার এর পক্ষ থেকে। (স্টাফ)
সে তার কথা শেষ হতেই চলে গেলেন। দরজা আটকে ভিতরে এসে দেখি টেবিল ঘড়িতে বিকেল পাঁচ টা বাজে। শপিং ব্যাগ দুটোয় খেয়াল করলাম একটার মধ্যে রেনুমা লেখা আর একটার মধ্যে জুইঁ লেখা। ওয়াশরুম থেকে একটু ফ্রেশ হয়ে এসে ভাবলাম এক সাথেই না হয় দুটো ব্যাগ খুলবো। তাই রেনুমা ডেকে তুললাম। ওকে ফ্রেস হয়ে আসতে বললাম কিন্তু ও আগেই ব্যাগ দুটো খুলে ফেলল। ব্যাগ থেকে দুটো বেগুনি রংয়ের শাড়ি পেলাম। আমাদের দুজনের শাড়ি একরকমের ই দেখতে। আমার ব্যাগ থেকে একটা কালো রঙের হিজাব স্কার্ফও পেলাম। রেনুমাকে আমি হিজাব পরতে দেখিনি।ওর ব্যাগ থেকে কোনপ্রকার হিজাব পেলাম না।রেনুমা আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো,,,
--এগুলো কি সন্ধ্যার ইভেন্টের জন্য? নাকি এমনি এমনি দিয়ে গেলো?
--দাঁড়াও ভাইয়াকে কল দিয়ে জেনে নেই। (আমি)
নিয়াজ ভাইয়া কে কল করতেই ভাইয়া জানালো এই শাড়ি পরে একেবারে রেডি হয়েই যেন আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে বাইরে আসি। ভাইয়ার কথামতো শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে নিলাম। আগে থেকেই প্ল্যান করে এসেছিলাম শাড়ি পড়বো। তাই সাথে দুটো শাড়ি আর তার সাথে দুটো ব্লাউজ নিয়ে এসেছিলাম। এখান থেকে একটা রেনুমাকে দিলাম।
কটেজের বাইরে খোলামেলা স্থানে এসে দেখি নিয়াজ ভাইয়া, ভাবি, ফারাবী ভাইয়া, মিথিলা আপু সহ অন্যান্য কলিগরাও একসাথে এক জায়গায় ভিড় জমিয়েছে। সকল মেয়েদের পড়নেই আমাদের মতো বেগুনি বর্ণের শাড়ি। ছেলেদের মধ্যে কেউ কেউ সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে। পুরো রিসোর্টটা ও মরিচ বাতি দিয়ে হালকা পাতলা ডেকোরেশন করা হয়েছে। স্পিচ দেয়ার জন্য ছোটখাটো একটা স্টেজ সাজানো হয়েছে। স্টেজের সামনে সারি সারি চেয়ার আর গোল টেবিল বসানো হয়েছে তবে এখনো মরিচ বাতি গুলো জ্বালানো হয়নি। এক অংশে বারবিকিউ এর জন্য স্টোভ সাজানো হচ্ছে। চারপাশে কিছুটা রমরমা পরিবেশ হলেও আমার কাছে পুরো পরিবেশটাই নির্জীব মনে হচ্ছে সবকিছুই ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে এখন পর্যন্ত আলআবি ভাইয়ার দেখা মেলেনি। কয়েকদিন ধরে আলআবি ভাইয়া আশেপাশে থাকলে সবকিছু পরিপূর্ণ লাগে। আজকে হঠাৎ তার অনুপস্থিতিতে মনে হচ্ছে আমার চারপাশ অপূর্ণতায় ঘিরে যাচ্ছে। আমরা যেখানটায় বসে রয়েছি সেখান থেকে রিসোর্টে ঢোকার প্রধান রাস্তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বারবার শুধু আশেপাশে পরখ করে যাচ্ছি। সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়ার দুজনের একজনকেও দেখতে পাচ্ছি না।কাউকে জিজ্ঞেস ও করতে পারছি না। আমার জায়গায় উল্টো দু-তিনবার রেনুমা আমাকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছে সজল ভাইয়ার কোন খোঁজ জানি নাকি।
আমি বসে বারবার যখন চারপাশে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি তখন আমার চোখ এক জায়গায় আটকে যায়।দেখি আলআবি ভাইয়া রিসোর্টে ঢোকার রাস্তা দিয়ে এদিকে আসছেন।তার কোলে একটা ৫-৬ বছরের বাচ্চা।বাচ্চাটাকে এক হাতে আগলে কোলে নিয়ে অন্যহাতে একটা লাগেজ নিয়ে এদিকে এগোচ্ছেন।তার পাশেই হেটে হেটে একটা মেয়ে আসছে।মেয়েটার মুখমন্ডলে সাজসজ্জার কোনো কমতি নেই।তবে তার পোশাক-আশাকে শালীনতার ছাপ রয়েছে। তিনজনকেই খুশি খুশি দেখাচ্ছে। লক্ষ্য করলাম তাদের পিছনে ই সজল ভাইয়া আসছে।ওদের দেখে মনে কুচিন্তার পাহাড় জমা হয়ে যাচ্ছে। তিনজন কে দেখে মনে হচ্ছে একটা সুখি পরিবার হেঁসে খেলে এদিকেই আসছে।মনের মধ্যে এমন ভাবনা আসতেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো।বাচ্চা ছেলেটা কি যেন বলতে বলতে আসছে আর আলআবি ভাইয়া হেঁসে হেঁসে তার জবাব দিচ্ছেন। তারা আমাদের কাছে আসতেই শুনতে পেলাম বাচ্চা টা মিষ্টি গলায় বলে উঠলো,,,
--আমার বাবাই বেস্ট বাবাই।
বলেই তার গলা জড়িয়ে ধরে তার সাথে আরো লেপ্টে গেলো।ওদের কে চোখে পরতেই মিথিলা আপু বলে উঠলো,,,
--আরে অনুরাধা!!!
মেয়ে টা আমাদের সামনে এসে ই সুন্দর করে গাল ভরা হাসি দিয়ে মিথিলা আপুর উদ্দেশ্যে বলল,,,
--কেমন আছো ভাবি?
এই কথাটা আমার পুরো শরীর অসাড় করে করে ফেলল।মস্তিষকে একটা কথা বারবার যন্ত্রণাদায়ক খোঁচা দিচ্ছে। "উনি বিবাহিত"।
ভগ্নহৃদয়ের আর্তনাদ গুলো হয়তো বালিশে মুখ গুঁজে তার কাভার আর তুলোগুলোর মধ্যে ই সীমাবদ্ধ রাখতে হয়।আমিও এমুহূর্তে তাই ই করছি।তবে আমার আর্তনাদে মিশে আছে প্রিয় মানুষ টার থেকে প্রতারিত হওয়ার আর ধোঁকা খাওয়ার চাপা কষ্ট।
ওখানে তখন অন্তু নামের বাচ্চা টা বারবার বাবাই বাবাই করে আলআবি ভাইয়া কে ডাকছিল।অনুরাধা নামের মেয়েটাকে মামুনি বলে ডাকছিল।মেয়েটার আগমন শুধু আমাকেই অস্বস্তিতে ফেলছিল।অন্য সবার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল অন্তু আর অনুরাধা সবার সাথে ই পূর্ব পরিচিত।তাসফি ভাবিকে তো দেখে মনে হচ্ছিল আমার থেকেও বুঝি আগন্তুক মেয়েটা তার কাছে অধিক পরিচিত। সবার ব্যবহারে প্রচুর রাগ উঠছিল।আলআবি ভাইয়ার ব্যবহারে তো রাগ দ্বিগুণ হচ্ছিল।অনুরাধার সাথে কেমন দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে হাসছিলেন। যদি আল্লাহ তাকে ৩২ পাটি দাঁত না দিয়ে ৩৫ পাটি দাঁত দিত তাহলে মনে হয় ৩৫ পাটি দাঁতের সবগুলোই বের করে ভেটকি মাছের মতো মেয়েটার সাথে বসে বসে ভেটকাতে থাকতেন। তাকে ওই মুহূর্তে জঘন্য থেকে জঘন্যতম গালি গুলো দিতে ইচ্ছে করছিল।
আর থাকা সম্ভব হয়নি ওখানে। একপ্রকার রাগের বশেই এসে পরি কটেজে। ওরা জিজ্ঞেস করেছিল আমার কি হয়েছে,কিসের জন্য কটেজে আসতে চাচ্ছি। আমি সোজাসাপটা জবাব দিয়েছিলাম আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। আমার জবাবে ওরা আর আটকায়নি।সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল তখন যখন চলে আসছিলাম আর আলআবি ভাইয়া কিছুই বলেন নি। বলবেন কিভাবে? উনিতো তার অন্তুকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।আমি চলে এসেছি হয়তো সেটাও তার চোখে পরেনি।
কটেজে এসেছি তো রাগের বশেই কিন্তু এখন আর রাগটা নেই।এখন বারবার মনে হচ্ছে এই ছিল তার ভালোবাসা? এতো সুন্দর অভিনয় মানুষ করে কীভাবে?এতোদিন তাহলে আমাকে কেন তার সারাজীবন এর বর্ষণ সঙ্গিনী বানানোর স্বপ্ন দেখিয়েছেন?বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পরছি।কোনোমতেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না।আমার সাথে ই কেনো এমনটা হয়?আমার সাথে এমন করে তার লাভ টা কি হলো?
চোখের অশ্রু কে এখন আর থামিয়ে দেয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না। মন ভরে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।মনের ইচ্ছে টাকেই প্রাধান্য দিয়ে মুখে ভালো করে বালিশ গুঁজে দেই।জানি সকালে উঠেই দেখব সর্দি লেগে গিয়েছে।গলার স্বরও স্বাভাবিক থেকে কিছু টা মোটা হয়ে যাবে। এভাবে অনেক সময় চোখের অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে একসময় কান্নার বেগ কিছুটা কমে আসে।একপর্যায়ে ফোপাঁতে ফোপাঁতে ই চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসে। গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই আমি।
দরজায় খুব জোরে শব্দ হওয়া তে ঘুম ভাঙলো। রেনুমার শব্দ পেতে ই উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। লক্ষ্য করলাম ওর হাতে খাবারের প্লেট। মাথা টা ব্যাথা করছে অনেক।তাই রেনুমার সঙ্গে কোনো কথা না বলেই আমার বেডে এসে পুনরায় শুয়ে পরলাম।রেনুমা বলল,,,
--জুইঁ আপু তোমার খাবার।আমরা সবাই বাইরেই খাচ্ছি। তুমি নেই বলে নিয়াজ ভাইয়া বললেন তোমাকে যেন ভিতরে এসে দিয়ে যাই।
ওর সাথে কথা বলতে মোটেও ইচ্ছে হচ্ছে না।একই ভাবে শুয়ে থাকলাম।তবে রেনুমার অস্তিত্ব এখনো টের পাচ্ছি।রেনুমা আবার বলে উঠলো,,,
--আপু তোমার কি বেশি খারাপ লাগছে? ভাইয়াদের বলবো গিয়ে?
রেনুমার কথায় আমি তাড়াতাড়ি করে শোয়া থেকে বেডে বসে ওর দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে জোরপূর্বক কৃত্রিম হাসি টেনে বলে উঠলাম,,,
--না! না! আমি ঠিক আছি।আসলে চোখের ঘুম ঘুম ভাব টা কাটেনি তো তাই আবার একটু শুয়েছিলাম।তুমি যাও আমি খেয়ে নিব।
--ওহহ!আমি ভাবলাম তোমার বোধ হয় খারাপ লাগছে বেশি।আচ্ছা খেয়ে নিও কিন্তু।
কথাগুলো বলেই রেনুমা চলে গেলো। রেনুমা যেতেই টেবিলের উপরে থাকা আমার মোবাইলটা বেজে উঠলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি সাদু কল করছে। কল টা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সাদু বলতে লাগলো,,,
-- আলআবি ভাইর লগে ঘুরতে যাইয়া তো আমারে ভুইল্লাই গেছো।ভুলবাইতো, উডবির সাথে থাকলে আমারে কি আর মনে থাকবো নাকি? তা রোমান্স শোমান্স কেমন চলে?
সাদুর কথা গুলো কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার চেয়ে কম কিছু ছিল না।মোবাইল কানে দিয়েই ফোপাঁতে লাগলাম।ওপাশ থেকে সাদুর কোনো কথার আওয়াজ আসছে না।কল এখনো ডিসকানেক্ট হয়নি।ধীরে সুস্থে নিজেকে শান্ত করলাম। মোবাইলের স্ক্রীন টা একবার চেক করে দেখলাম। দেখি ১১ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড চলছে। এখনো কল যেহেতু কেটে যায়নি তাই আবার কানে দিলাম ফোনটা।ওপাশ থেকে সাদু নরম কন্ঠে বলে উঠলো,,,
--এবার বল কি হয়েছে?
--সাদু সে অনেক খারাপ একটা লোক।একটা প্রতারক,ধোঁকাবাজ।জঘন্য লোক!(আমি)
--আচ্ছা! আচ্ছা!রিলাক্স!বল কি হয়েছে। খুলে বল।(সাদু)
তারপর সাদু কে সব বলতে লাগলাম। আমার সব কথা শুনে সাদু বলল,,,
--একটা কথা কই বোইন?তোর মাথায় তো মনে হয় গরুর গোবরেরও অভাব আছে। গোবরেও সার হয়।তোর তো তাও নাই।মনে তো হইতাছে তোর মাথায় গন্ডারের চামড়া ভরা।বাপ ডাকলেই কি কেউ বাপ হইয়া যায়? রাস্তা ঘাটে তো কত জনরেই মামা,চাচা,খালা ডাকি আমরা তাই বইলা কি তারাও মামা,চাচা হইয়া যায় নাকি?
কোন সিচুয়েশনে ও কি বলছে?সাদুর কথায় আমি ওকে ঝাঁঝাল কন্ঠে বলে উঠলাম,,,
--আমি মরি আমার কষ্টে আর তুই ফালাছ আমার মাথায় গন্ডারের চামড়া তার লেইগা?আর ওই পিচ্চি রে কোলে কইরা নিয়া আসছে।রাস্তা ঘাট থেইকা তুইলা আনে নাই। ফোন রাখ তুই।এই জন্মে আমারে আর কল দিবিনা।
কলটা কেটে চুপচাপ বসে আছি। সব কিছু অসহ্য লাগছে।এখন সাদুর মাথার কয়েকটা চুল ছিঁড়তে পারলে ভালো হতো।সাদুর জায়গায় যদি ওই অনুরাধা না ফনুরাধার চুল ছেঁড়াছিঁড়ি অভিযানে নামতে পারতাম তাহলে আরও বেশি ভালো হতো।আমার মোবাইলটা একনাগাড়ে বেজে ই চলেছে। মোবাইলটা উল্টো করে রাখা বলে কে কল করছে দেখতে পারছি না।তবে মনে হচ্ছে সাদুই কল করছে।অনেক কয়েকবার রিং হওয়ার পরে কল টা রিসিভ করে বলতে লাগলাম,,,
--তোরে কইছি না কল দিবি না।ওই কানা ব্যাডার যা ইচ্ছা করুক।একটা ক্যান আরও দশটা বিয়ে করুক।দুনিয়ার সব মাইয়া বিয়ে কইরা ফেলুক।আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আই ডোন্ট কেয়ার।
--সত্যি কিছু যায় আসে না?
অপর পাশ থেকে পরিচিত পুরুষালি কন্ঠ কর্ণপাত হতেই আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। মোবাইলের স্ক্রিনটা চোখের সামনে এনে টাস্কি খেয়ে গেলাম। এটাতো আলআবি ভাইয়ার নাম্বার।তাড়াতাড়ি করে আবার ফোনটা কানে ধরলাম।ওপাশ থেকে উনি গম্ভীর গলায় আবার বলে উঠলেন,,,
--আমি কানা ব্যাডা?বের হও এক্ষুনি। বোঝাপরা আছে তোমার সাথে। আমি কানা কিনা তা তোমায় বুঝিয়ে দেব আজ।২ মিনিটের মধ্যে তোমার কটেজের পেছনে আসো।যাস্ট টু মিনিটস।
এহ আমাকে হুকুম দেয়া?আমি ও তেজি কন্ঠে বলে উঠলাম,,,
--আসছি আমি। দুই মিনিট কেন, এক মিনিটের মধ্যে ই আসছি আমি। বোঝাপড়া তো আমি আপনার সাথে করবো।
তাড়াহুড়ো করে মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কটেজের পেছনে এসে পড়লাম।আবছা আলোতেই আলআবি ভাইয়া কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুতপায়ে তার কাছে গিয়ে মাথাটা হালকা একটু উঁচু করে তার পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে বলতে লাগলাম,,,
--কেন করলেন আপনি এমন?আপনি বিবাহিত হয়ে ঘরে বউ রেখে আবার আমাকে আপনার সারাজীবনের বর্ষণ সঙ্গিনী বানাতে চেয়েছিলেন কেন?
কথাগুলো বলার সময় মনে হচ্ছিল আমার কন্ঠনালিতে কেউ অনেক ওজনের পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। ধরা গলায় আবার বলতে লাগলাম,,,
--আপনি তো জানতেন আমি আপনাকে প্রচুর পরিমানে ভালোবাসি।অনেক ভালোবাসি। অনেক!অনেক!অনেক!
চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলাম না। আমার গাল বেয়ে জলকণা পরতে লাগলো।সেই সাথে আকাশ গর্জে উঠলো।ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি কণা এসে পরতে লাগলো আমার গায়ে।এই বৃষ্টি কণা কাউকে ভিজিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে না।ক্ষনে ক্ষনে আকাশ গর্জে উঠছে।আলআবি ভাইয়ার কলার ছেড়ে একটু পিছিয়ে আসতেই উনি বলে উঠলেন,,,
--এই কথাটাই তো শুনতে চাইছিলাম। শেষমেশ তাহলে ভালোবাসি বলেই দিলে।
তার কথা শেষ হতে ই বিকট একটা আওয়াজ হলো।হুট করে আলআবি ভাইয়া আমার মাথাটা হালকা বা পাশে আকাশের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন।ওদিকে তাকাতেই দেখি একটা লেখা চোখে স্পষ্ট ফুটে উঠলো----
"Will you be mine forever & ever?"
লেখাটা মুছে যেতেই এরপর আরেকটা বিকট শব্দ হওয়ায় আবার আকাশে আরেকটা লেখা ভেসে ওঠে ----
"Will you marry me"?
হঠাৎ করেই কটেজের পেছনের আলো জ্বলে উঠলো। আমাদের থেকে কিছুটা দূরে ই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাসফি ভাবি,মিথিলা আপু আর রেনুমা মুখ চেপে হাসছে।
--শশুর বাবাই!ফাটিয়ে দিয়েছ।
বাচ্চা কন্ঠ শুনে পিছনে তাকাতেই দেখি অন্তু অনুরাধার হাত ধরে সাথে দাঁড়িয়ে আছে।অনুরাধা মুচকি হেসে আমাদের কিছুটা কাছে আসলো।সবার ভাব ভঙ্গি তে এতক্ষনে বুঝে গিয়েছি আমার সঙ্গে অনেক বড় একটা গেম খেলা হয়েছে। সামনে তাকিয়ে দেখি আলআবি ভাইয়া মিটমিটিয়ে হাসছেন।অন্তু দৌড়ে এসে আমার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,,,
--শাশুড়ী আম্মু, আমার শ্বশুর বাবাই তো অপেক্ষা করছে।তাড়াতাড়ি উত্তর টা দাও।
এইটুকু বাচ্চার মুখ থেকে শশুর শাশুড়ী ডাক শুনে ঠিক হজম করতে পারছি না।অন্তু আবারও আমাকে বলল,,,
--কি হলো তুমি নাকি আমার শাশুড়ী আম্মু। তাহলে আমার শশুর বাবাইয়ের উত্তর দিচ্ছ না কেন।
--জুইঁ আপু এক্সেপ্ট করে ফেলো তারাতাড়ি। (রেনুমা)
রেনুমার কথায় ওদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখি সজল ভাইয়া আর শাফিন ভাইয়া ও এসে উপস্থিত।এখন শুধু নিয়াজ ভাইয়া আর ফারাবী ভাইয়া বাদে সকলেই উপস্থিত এখানে। এতো জনগণের মধ্যে আমি কিভাবে বলব "আমিও আপনাকে বিয়ে করতে চাই"।এরাও কেমন বেআক্কল!ওদের তো বোঝা উচিৎ আমার ও লজ্জা বলে কিছু আছে।
ওয়েট!ওয়েট! জুইঁ তোর সাথে এতো বড়ো গেম খেলল আর তুই কি না নির্লজ্জের মতো তার প্রপোজাল এক্সেপ্টের চিন্তা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস।এই পুচকো ছেলে আর অনুরাধা কে সেটাও তো জানা হলো না। নিজের মনের সঙ্গে কথাগুলো বলে মনে মনেই কঠোর এক সিদ্ধান্ত নিলাম।সবাইকে একবার পরখ করে আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,
--আপনার না একটা বাচ্চা আছে। আবার বউ ও তো আছে।বউ বাচ্চার সামনে আমাকে বেহায়ার মতো বলছেন "আমাকে বিয়ে করবে"?আপনাকে তো জিন্দেগীতেও বিয়ে করবো না।আপনাকে তো আমি জেলের রুটি খাওয়াবো।
আর কিছু বলার আগেই চারপাশ হাসির শব্দে মুখরিত হয়ে উঠলো। আলআবি ভাইয়া কোনো মতে হাসি থামিয়ে বললেন,,,
--আরে ওইটা শাফিনের বউ আর বাচ্চা।আমার নাকি ছোট একটা প্রিন্সেস হবে আর ও প্রিন্সেসটাকে বড় হলে বিয়ে করবে। সেই জন্য এখন থেকেই বাবা ডাকার প্রেক্টিসে আছে।
কথা টা বলে একটু থেমে আবার বলে উঠলেন,,,
-- আমাকে নাকি মানতে পারবে না। তাই তোমাকে একটু মজা দেখালাম।
কথার শেষে আমাকে একটা চোখ টিপ মারলেন।
তার কথা আর কাজে প্রচুর রাগ হলো।এমন মজা কেউ করে?আমার চোখের কতগুলো পানি খরচ হলো!কতো কষ্ট হচ্ছিল সে কি তা জানে?জোড়ালো গলায় বললাম,,,
--সবাই খারাপ!সবাই!নিয়াজ ভাইয়ার কাছে এক্ষুনি আমি বিচার দিব।
এরপর আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,
--আর আপনি!আপনার সাথে আগামী এক বছর এর জন্য কথা বলা বন্ধ।আমাকে বিয়ের স্বপ্ন এ জীবনে আর দেখা লাগবে না।করবো না আমি আপনাকে বিয়ে।আমার দিকটা কেউ ভাবলেন না।
আলআবি ভাইয়া একটু নিচু স্বরে বলতে নিলেন,,,
--জুইঁ আসলে....
তার কথায় কর্ণপাত না করে আমি আমার কথা শেষ করে গটগট করে আমি কটেজে এসে পরলাম। পিছন থেকে ওরা ডাকাডাকি করছিল।কিন্তু আমি না শুনেই এসে পরেছি।কি ভেবেছে?আমাকে কান্না করিয়ে উনি বলবে এটা মজা ছিল আর আমিও মজা ভেবে ধেই ধেই করে তার প্রপোজাল এক্সোপ্ট করে ফেলবো?আমাকে তো চেনো নাই।কি মনে হয়?আমি গেম খেলতে পারি না।দাড়াও বাছা ধন!এবার দেখবা এই জুইঁয়ের কেরামতি।খুব সুন্দর করে মুখে একটা হাসি টেনে ধীর পায়ে নিয়াজ ভাইয়ার কটেজে এসে উপস্থিত হলাম।কথার শব্দে মনে হচ্ছে মোটামুটি সবাই ই এখানে জটলা পাকিয়ে বসে আছে।দরজায় পরপর দুবার নক করতেই আলআবি ভাইয়া দরজা খুলে দিলেন।তার দিকে না তাকিয়ে দরজায় দাড়িয়ে ই সোজা নিয়াজ ভাইয়া কে উদ্দেশ্য করে বললাম,,,
--নিয়াজ ভাইয়া তোমার ফোনটা একটু দিবে?বাবাকে কল করবো।আমার ফোনের বেল্যান্স শেষ।
--আচ্ছা আয়!ভিতরে আয়।আর তোর কি এখন একটু ভালো লাগছে?(নিয়াজ ভাইয়া)
ভিতরে থাকা সকলের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললাম,,,
--হ্যাঁ ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে। সবাই মিলে আমাকে অনেক বড় একটা সারপ্রাইজ দিয়েছে।এখন কি ভালো না থেকে পারি?(আমি)
নিয়াজ ভাইয়া সবার দিকে তাকিয়ে কৌতুহল নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল,,,
--কি সারপ্রাইজ রে।যা আমি জানি না।
ভাইয়া কে তারা দেখিয়ে বললাম,,,
--পরে বলব।আগে মোবাইলটা দেও তো।বাবার সাথে কথা বলিনি আজকে সারাদিন।
ভাইয়া আর কথা না বাড়িয়ে আমার হাতে মোবাইল দিয়ে দিল।আমি মোবাইলটা নিয়ে ভাইয়ার কটেজ থেকে একটু দূরে আসলাম। ভাইয়ার ফোনের সেভ নাম্বারে গিয়ে একটা নাম্বার আমার ফোনে টুকে নিলাম। নাম্বার টা খুব সুন্দর করে "রাইয়ান বাবু" লিখে আমার ফোনে সেভ করে নিলাম। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বাবাকে কল করলাম। বাবার সাথে কিছু সময় কথা বলে পুনরায় ভাইয়ার কটেজে গিয়ে ভাইয়াকে মোবাইলটা দিয়ে কারো দিকে দৃষ্টি না দিয়ে সোজা আমার কটেজে চলে আসলাম।
চলবে...
Writer:- হুমাশা এহতেশাম