১৬ বছর বয়সে একটি পেপারে যেই সাইন করেছিলাম, ১৮ বছর বয়সেও সেই একই সাইন করেছিলাম। তফাৎ ছিলো শুধু পেপারে। ১৬ বছর বয়সে সাইন করে মিসেস হয়েছিলাম আর ১৮ বছর বয়সে হয়েছিলাম ডিভোর্সি। হ্যাঁ আমি একজন ডিভোর্সি নারী। আজ ৬ মাস হয়ে গেলো স্বামী নামক মানুষটির থেকে আমি দূরে।
যেই বয়সে আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা ছিলো সেই বয়সে আমি কাজী অফিস নামক স্থানের থেকে তিন অক্ষর এর মিসেস শব্দ আমার নামের পাশে বসিয়ে বাবা এর বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছিলাম।
শুধু মাত্র আমার আম্মুর ইচ্ছে পূরণ এর জন্যে তার প্রাণ প্রিয় বান্ধবীর ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দেয়া হয়েছিল।
মা আমার ১০ বছরের সময় ব্রেন স্টোকে ইন্তেকাল করেছিলেন।আমার একটা বড় ভাইও আছে।সে বিগত ৩ বছর ধরে ফ্রান্সের প্রবাসী।ভালো বেতনে চাকরি করছে সেখানে।আমার বাবা খুব ভালোবাসে আমাকে।মায়ের চলে যাওয়াতে সে খুব একা হয়ে যায়।কেবল আমার জন্য বাবা কোনো নতুন বন্ধনে এখনো আবদ্ধ হন নি।বাবা ছিলেন স্কুল টিচার। এখন অবশ্য রিটায়ার্ড হয়ে গেছেন। ভালোই চলতো আমাদের বাপ মেয়ের ছোট্ট সংসার।বাসায় একজন আন্টি আসতেন। এসে কাপড়চোপড় ধুয়ে দিতেন আর ধোয়ামোছা করে যেতেন।আমিই রান্না করতাম।রান্নার প্রচুর শখ ছিলো।আর রান্নাও ভালো হতো বলে বাবা কিছু বলতেন না।প্রথম প্রথম গা হাতে তেলের থেকে ফোসকা পরতো বা ছেঁকা খেতাম তবে আস্তে আস্তে মানিয়ে নিয়েছি।মা তো ছোট বেলা থকেই ছিলো না।তাই অনেক কিছুই নিজে নিজে করতে গিয়ে শেখা হয়ে গেছে।বাবা কখনো আদর স্নেহ কম দিতেন না।কিন্তু তাও মনে তো একটা চাপা কষ্ট থেকেই যেতো।সেই সাথে মন ভালোর ঔষধ ছিলো ভাইয়া আর আমার নেংটু কালের বান্ধবী সাদিয়া।
বর্তমানের অতি পরিচিত মুখ ৩০ বছরের এক বিখ্যাত ও জনপ্রিয় কন্ঠ শিল্পী হলো জায়েফ এহমাদ।কন্ঠের জন্য যেমন সে পরিচিত। তেমনি চরিত্রের জন্য কন্ঠের চেয়ে আরো বেশি পরিচিত। যদি কোনোদিন সেরা ফ্লার্টবাজের অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠিত হয় তবে কর্তৃপক্ষ তাকে প্রথম স্থান দিতে বাধ্য।যেদিন জানতে পারলাম এমন এক লোকের সাথে বাবা আমার বিয়ে দিচ্ছে সেদিন বাবাকে বলেছিলাম,,,
--বাবা তুমি যদি এই লোক কে বিয়ে করার কথা না বলে আমাকে বিষ খেতে বলতে আমি তাও হাসিমুখে খেয়ে নিতাম।
বাবা বলেছিলো,,,
--জুইঁ তুমি যদি তোমার মাকে ভালোবেসে থাকো তো ওকেই বিয়ে করতে হবে।আর ওর মধ্যে খারাপ কি আছে বলো আমাকে।
-- সে এতই খারাপ যা তোমাকে এই মুখ দিয়ে বলতেও আমার বাঁধবে (মনে মনে বললাম)
বাবাকে বললাম,,,
-- বাবা আমার মাধ্যমিক এর রেজাল্ট এখনো দেয় নি।বয়স তো কেবল ১৬।আর তার বয়স ৩০বছর।১৪ বছর এর বড়। তুমি না একজন টিচার। বাবা আমার সাথে এমন করো না দয়া করে।
-- জুইঁ মা, ওর মা এই পৃথিবী থেকে চলে গেছে ১ বছরও হয়নি।ওর বাবা বর্তমানে অনেক অসুস্থ। ওর মায়ের ইচ্ছে পূরণ করতে চায় ওর বাবা।আর তোর মায়ের ও তো একই ইচ্ছে ছিলো। মা আমার রাজি হয়ে যা ওরা তোকে পড়াবে বলেছে তো।
এভাবে আরো অনেক ইমোশনাল হয়ে বাবা বুঝালেন।আমিও ভাবলাম সেলিব্রিটি দের নিয়ে তো গুজন কতোই ছড়ায়।তার বেলাতে ও এমন হতে পারে।আর তারা পুরো পরিবার আগে থাকতো লন্ডনে। মায়ের মৃত্যুর পরে সে আর তার বাবা দেশে এসেছে। তার বড় দুজন নাকি বোনও আছে স্বামী সন্তান নিয়ে তারা ওই খানেই সেটেল্ড। বিদেশে থাকতেই তিনি গান করতেন। তবে তা বাংলা। বাংলাদেশে এসে আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।নিজেই নিজেকে বুঝ দিলাম আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করে থাকেন।
বিয়ের দিন খুব বেশি ই অবাক হয়েছিলম।কারণ তার পক্ষ থেকে তার দুই বোন,বাবা আর তার এসিস্ট্যান্ট ছাড়া কেউ ছিলো না।এটা কে তো কোনো মতেই আমার বিয়ে বাড়ি বলে মনে হচ্ছিলো না।আমার বাবা ছিলো একাই।আমার কোনো চাচা বা ফুপু নেই।আছে কেবল একজন খালামনি আর একজন মামা।তারা এসেছিলেন বিয়েতে।কাজিনরা সবাই ছোট ছোট। খালাতো ভাই একটা পড়ে ফাইভে আর মামাতো বোন একটা ওয়ানে।আমার ভাইয়াও সেদিন আমার পাশে ছিলো না।তবে সাদিয়া ছিলো।সাদিয়াকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করেছিলাম।সেদিন আম্মুকে অনেক মনে পড়ছিলো।আর শুধু মনে হচ্ছিলো এভাবে কোনো বিয়ে হয়? আমিতো চেয়ে ছিলাম ধুমধাম করে ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরবো।বিয়েতে অনেক মানুষ আসবে।বাবা বলেছিলো জায়েফ নাকি বলেছে এভাবে বিয়ে করবে।গায়ে হলুদেও কেবল ওই কয়জনই মানুষ ছিলো।
সব শেষে আমিও চলে আসি স্বামী বাড়ি।গাজীপুর থেকে চলে এসেছিলাম ঢাকায়।তবে এখানে এসে বুঝলাম স্বামী বাড়ি কেবল নামেই।স্বামী টাও আমার ছিলোনা কোনোদিন আর না বাড়িটা।
তার জন্য রান্না করতাম, তার জামাকাপড় ধুয়ে দেয়া থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা কাজ করতাম।শুধু তার সাথে রাতে ঘুমাতাম না। সে ইচ্ছে করে আমাকে তার বারান্দায় রাখতো রাতের বেলা।তার বারান্দা টা খুব বড় ছিলো।তার বাবা অসুস্থ বলে তাকে আবার লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।একজন কাজের মহিলা (আমেনা আন্টি) এসে শুধু বাড়ি ঘড় আর আসবাবপত্র পরিষ্কার করে দিয়ে যেতেন।প্রথমে প্রতিবাদ করেছিলাম।তবে কোনো লাভ হয়নি।
আমাকে বলেছিলো পড়াবে। তবে কোনোদিন কলেজে যেতে দেন নি।বাসায় একজন টিচার রেখেছিলেন।কিন্তু সেটাও পরে আর জোটে নি।কারন স্যারটা সুবিধার ছিলোনা।তাকে দেখে আগেই বুঝেছিলাম লোকটা ভালো হবে না।কিন্তু জায়েফ কে যে বলবো সেই সাহসও ছিলো না।একদিন পড়তে বসে হঠাৎ আজব আজব কাজ করছিলেন।হাত ধরতে চাচ্ছিলেন, বার বার পায়ে স্লাইড করছিলেন।হঠাৎ তার আচরনে ভয়ে কলিজার পানি শুকিয়ে গিয়েছিলো।সেই সময় জায়েফ এসে হাজির হয় রুমে।সচারাচর এই সময় তাকে পাওয়া যায় না।সে যায় বেলা ১২ টায় আসে রাত ১টা বা ২টার দিকে।তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো আমার কলিজায় পানি এসেছে।জায়েফ এসে তার কলার ধরে টেনে উঠিয়ে এতো জোড়ে জোড়ে ঘুষি দিচ্ছিলেন যার ফলে লোকটার নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। তাকে বাড়ি থকে বের করে দিয়ে সেদিন আমাকেও মেরেছিলেন। তার বক্তব্য ছিলো আমাকে কীভাবে ওই লোক টাচ করলো।আমি কি করছিলাম বসে বসে।সে আমাকে মেরেছিলো ঠিকি তবে হাত দিয়ে নয় লাঠি দিয়ে।আর দুই আঙুলের মধ্যে কলম দিয়ে চাপ দিয়েছিলেন।সেদিন আঙুলে অনেক ব্যাথা পেয়েছিলাম।
এভাবেই চলছিলো দিন। রাতে প্রতিদিন আসতো মাতাল হয়ে।তবে আমার ধারে কাছেও আসতো না।সেদিক দিয়ে সে খুব সচেতন ছিলো।কথায় কথায় বলতো আমার মতো মেয়ে তার পছন্দ নয়।আমি তার সাথে বেমানান।
দেখতে দেখতে একবছর চলে যায়।আমি শুধু কলেজে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসতাম।সেজন্য কোনো ফ্রেন্ডও আমার ছিলো না।এতো দিন তার সব কিছু মেনে আসলেও বিয়ের একবছর পরে আর পারছিলাম না।কারণ সে দুদিন এক দিন পর পরই কোনো না কোনো মেয়ে নিয়ে এসে হাজির হতো।সারা রাত একসাথে থাকতো।তখন আমি থাকতাম অন্য ঘরে।আর বেলা ১২ টায় দুজন একসঙ্গে চলে যেতো।কেউ আমার পরিচয় যানতে চাইলে এক নিমিষে বলে দিতো তার কাজের মেয়ে।অনেক সময় কেউ ভালো চোখে দেখতো।কেউ আবার অন্য চোখে। ওই সময় টাতে আমি শুধু মোনাজাতে আমার মৃত্যু কামনা করতাম আর চোখের পানি ফেলতাম। সে আমার দিকে কখনো তাকিয়ে দেখত ও না।
তার অত্যাচারও দিন দিন বেড়ে গিয়েছিল। ১৯ থেকে ২০ হলেই মারতো।একদিন রাতে সে আগের মতোই একটি মেয়ে নিয়ে এসেছিলেন।আমি প্রতিবার এর মতো তাকে বাধা দিতে গেলে আমাকে পেটানো শুরু করে। সেদিন সে হয়তো বেশি ড্রাঙ্ক ছিলো।ভুলবশত আমার তলপেটে তার লাথি লাগে।সে আর যাই করতো আমাকে হাত দিয়ে কখনো মারতো না।বেল্ট বা লাঠি দিয়ে মারতো।আমার পিরিয়ড এর তারিখ ছিলো সেদিন। একপর্যায়ে আমি বুঝতে পারছিলাম আমার ব্লিডিং শুরু হয়েছে। তল পেটে প্রচুর ব্যাথা হচ্ছিল। আমি সহ্য করতে না পেরে সেন্স হারাই।সকালে উঠে দেখি আমি বিছানায়। পাশে আমেনা আন্টি বসা।সেও সব কেবল দেখে যেতো বলতে পারতো না কিছু।
এরপর কয়েক মাসের ব্যবধানে আমাকে ডিভোর্স দেয় আর গাজীপুর পাঠিয়ে দেয়।সেদিন কেবল একটা কথাই বলেছিলাম আমাকে কেন বিয়ে করে ছিলো।সে বলে তার গার্লফ্রেন্ড এর সাথে রাগারাগি করে আমাকে বিয়ে করেছিলো।পরে আবার তাদের সব নাকি মিটমাট হয়ে গেছে।
বাবাকে সব কিছু বলিনি।কিছু কিছু বলেছি।আমাকে তার পছন্দ না।আমি তার সাথে বেমানান এগুলো বলে কাটিয়ে দেই।বাবাও আমাকে এখন আর ওই লোকের ছায়াও পরতে দিতে চায়না আমার জীবনে।
--একটা কথা বলবি জুইঁ?
সাদু জিজ্ঞেস করলো আমাকে।ওকে সাদিয়া ডাকিনা আমি। সাদুই বলি।
আমি বললাম,,,
-- এতেকথা যখন বললাম তাহলে আরেকটা কেনো বলবো না?
সাদু আবার বলল,,,
--ভালোবাসিস তাকে?
আমি মৃদু হেসে বললাম,,,
--২ বছরে তার বাড়ির কাজের মহিলাকে যদি ভালোবেসে আন্টিমা ডাকতে পারি তাহলে তাকে তো.............
বলেই থেমে গেলাম।আমি আবারও বললাম,,,
-- জানিস এতো কিছুর মাঝেও কিন্তু সে একটা ভালো কাজ করেছে আর তা হলো কাউকে না জানিয়ে আমাকে বিয়ে করা।যদি এই সমাজ জানতো আজ আমি ডিভোর্সি তাহলে এই সমাজে আমি টিকে থাকতে পারতাম না।
শুধু এক তপ্ত নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসলো। তখন সাদু বলল,,,
-- আচ্ছা চল এবার আপুর হলুদ শুরু হবে এখন।
আমি বললাম,,,
-- হমম।চল।
আসলে আজ সাদুর বড় বোন রাফিদা আপুর বিয়ে।তাদের লাভ ম্যারেজ হচ্ছে। সার্থক ভাইয়ার সাথে তার ৪বছর এর সম্পর্ক। ভাইয়ার ফ্যামিলি পলিটিক্স এর সাথে যুক্ত। তার বাবা, চাচা, দাদারা মনে হয় জন্ম গ্রহন করেই পলিটিক্স করে আসছে। তাই হলুদের জন্যে ও সেন্টারে অনুষ্ঠান করছে।সাদুর অনেক জোরাজোরি তে এসেছি এখানে।
আজ অফ হোয়াইট কালার এর সাথে গোল্ডেন কালার এর সুতো আর পাথর এর কাজের একটা শাড়ী পড়েছি।এই শাড়ী টা অনেক পছন্দের আমার।সাথে গোল্ডেন রঙ এর থ্রী কোয়াটার ব্লাউজ পরেছি।এই প্রথম কোনো অনুষ্ঠানে হিজাব ছাড়া এসেছি। মাথায় খোপা করে বেলীফুল দিয়েছি।বেলী ফুল পছন্দের আমার।আমার রুমের বারান্দায় বেলীফুলের গাছও আছে।সাদুর সাথে আমার পরিচয় ছোটবেলার। যার কারণে ওর প্রায় কাজিনকেই আমি চিনি।
মনে মনে ভেবে নিয়েছি এখন থেকে অতীত কে বিদায় দিবো।ভাববো না আর ওই লোকটার কথা।যে অতীত কেবল আর কেবলই মাত্র কষ্ট দেয় তা নিয়ে ভেবে নিজেকে কষ্ট দেয়া বোকামি ছাড়া কিছু না।পাগলেও তো নিজের ভালো নিজে বুঝে। আজ থেকে নিজেই নিজের মন ভালোর ঔষধ হবো।নিজেই যদি নিজের মনকে ভালো রাখতে না পারি তবে অন্য কেউ যে এসে মন ভালো রাখবে তা ভাবি কি করে।
আজ মন খুলে অনেকদিন পরে হাসলাম।রাফিদা আপুকে হলুদ দিলাম।সবার সাথে আড্ডাও দিলাম।বাসায় যাবো বলে একটু ওয়াশরুমে যেয়ে শাড়ী টা ঠিক করতে হবে।মুখেও ওরা হলুদ দিয়ে ভূত বানিয়ে দিয়েছে।তাই সাদুকে খুজে চলেছি কিন্তু কোথাও তো পাচ্ছি না।রাত বেড়ে যাচ্ছে বলে একাই গেলাম ওয়াশরুমের দিকে।দুই একজনকে দেখা যাচ্ছে এদিকে।তবে সবই অপরিচিত মুখ। কিছুটা ভিতরের দিকে গেলেই হঠাৎ এদিকের আলো নিভে গেলো।কিছুটা ভয় পেলেও ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।পার্সের মধ্যে আমার ফোন ছিলো।কিন্তু পার্সটাতো সাথে আনি নি।
হঠাৎ মনে হলো কেউ পিছনের দিক থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।যখনি জোড়ে চিৎকার দিতে যাবো তখন ওই ব্যাক্তি আমার মুখ চেপে ধরলো।এতোক্ষনে বুঝে গিয়েছি কোনো পুরুষ লোক আমাকে এভাবে ধরে রেখেছে। ভয়ে আমার হিতাহিত বুদ্ধি শক্তি মনে হচ্ছিলো লোপ পেয়েছে। নিজেকে ছুটানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি তবে কোনো লাভ হচ্ছে না।হঠাৎ লোকটা আমাকে একটা ওয়াশরুমের ভিতর নিয়ে গেলো।লোকটা এবার দেয়ালে তার সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরলেন আমাকে।লোকটা বলে উঠলো,,
--জুইঁফুল!!! তোমার ঘ্রাণ নিতে দিবে একটু?
তার কন্ঠ শুনে আমার অন্তর আত্মা কেপে উঠলো। সেই পরিচিত কন্ঠ।কিন্তু এখানে কেনো?লোকটা আমার কপালে তার কপাল দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাস একে অপরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।ধাক্কাও দিতে পারছি না।হাতে ব্যাথা পাচ্ছি। চোখ দিয়ে পানি পরতে শুরু করলো।লোকটা আবার বলল,,,
--তোমার গালে স্পর্শ করেছিলো তাই না?
বলেই সে আমার যে গালে হলুদ ছিলো সে গালে তার বৃদ্ধা আর তর্জনি আঙুল দিয়ে জোড়ে গালটা টেনে ধরলেন।ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে শব্দ করে কান্না করে দিলাম।হঠাৎ করে লাইট জ্বলে উঠলো। সামনের মানুষটিকে দেখে মনে হলো চারদিকে অন্ধকার আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীর মনে হলো কোনো কালো রঙের সাথে আমি মিশে গেলাম।
--তুই সত্যিই আমার বোনের বিয়েতে যাচ্ছিস তো?
সাদু কিছুটা সন্দেহ করার মতো ভাব নিয়ে বলল।
--মানে?(আমি)
--তুই যেভাবে নিজেরে প্যাকেট করলি মানে বোরকা, হাত মুজা, পা মুজা পরলি মনে তো হচ্ছে আজকেই হজে চলে যাবি।(সাদু)
--ওই খারাপ লোকটা আবারো আসলে?(আমি)
--আরে ধুর ওই ব্যাডার তো খাইয়া দাইয়া কাম নাই।এতো দিন তোমারে ধরে নাই আর কালকে আইসা একেবারে জড়াইয়া ধরলো তাও আবার কই?ওয়াশরুমে!!!(সাদু)
সাদু আমাকে আবারও বলল,,,
--হয়তো তোর মনের ভুল। আচ্ছা একটা কথা বলবি?
-- কী?(আমি)
-- k-drama কি বেশি দেখছ ইদানিং? (সাদু)
--না বোইন। তোর মতো আমারে রাণু মন্ডলের ফাগলে গুতা মারে নাই।(আমি)
--ওহহ।তাহলে নিশ্চয়ই C-drama দেখছ।তাই না?(সাদু)
--ধুর কি শুরু করলি? ওই সব খচ্চর মার্কা ড্রামা তুই ই দেখ বইসা বইসা।(আমি)
--বাট তুই আর যা বলবি তাই বিশ্বাস করবো কিন্তু তোর এক্স জামাই আইসা যে তোরে জরাইয়া ধরছে এই কথা বিশ্বাস করতে পারবো না।আর এই টপিক এখানেই শেষ।(সাদু)
হ্যাঁ।গত কালকে আমি ওনাকে দেখেছিলাম।ওটা জায়েফ ই ছিলো।ওখানে নাকি আমি সেন্স হাড়িয়ে ফেলেছিলাম। ওয়াশরুম এর দরজার কাছে নাকি পড়েছিলাম।আমাকে আমার বাসায় সাদু নিয়ে আসে।আর আজ একপ্রকার ভয় পেয়েই বোরকা পরে বিয়েতে যাচ্ছি।সে কেনো এসেছিলো আমি জানিনা।আর না জানত চাই। শুধু তার থেকে দূরে থাকতে চাই।
যেকোনো অনুষ্ঠান নিয়ে আমি আবার এক্সাইটেড একটু বেশি ই থাকি।কোনো দাওয়াত ই আমি মিস করতাম না আগে।আমি আর সাদু আগে ঘুরতেও যেতাম এক এক জায়গায়। সাথে রাফিদা আপু থাকতো।মাঝে মাঝে সার্থক ভাইয়াও থাকতো।
আমার ডিভোর্স এর পরে এই প্রথম বার আমি আর সাদু একসাথে কোনো অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। বাইরে ও আগের মতো যেতাম না।সাদু প্রায়ই বলতো চল ঘুড়ে আসি এই করি ওই করি কিন্তু আমার ওই সময় বাসায় থাকতেই ভালো লাগতো বেশি।বাসায় কাজ বেশি থাকতো না।আমি আর বাবা।কাজ শেষ করে সময় পেলে বারান্দায় বসে থাকতাম।বাবার সাথেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতাম না।এখনো কথা কম বলি তার সাথে। কেমন যেনো একটা অভিমান কাজ করে।মাঝে মাঝে সাদু বাসায় এসে আমার সাথে গল্প করে যেতো।
হঠাৎ চলন্ত অবস্থা থেকে সব কিছু স্থির হয়ে যাওয়াতে আমার ভাবনার সুতোঁ কাটলো।আমরা বিয়ের সেন্টারে এসে পরেছি।কাল যেটা ছিল আজো সেটাই। শুধু ডেকোরেশনটা আলাদা। ভালোই বুঝতে পারছি যে কালো বোরকা পড়ে আসাতে সবাই এমন ভাবে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করছে মনে হচ্ছে আমি চাঁদের দেশ থেকে নেমে এসেছি।
এখানে সাদুর কাজিন সার্কেল এর সাথে ভালোই মিশে গিয়েছি।ওর একটা মামাতো ভাই আছে সাদমান ভাই।সে ঢাকার একটা ভার্সিটিতে অনার্স প্রথম বর্ষে অধ্যায়নরত অবস্থায় আছে।লোকটা অনেক হাসাতে পারে।সাদু কে সে পছন্দ করে।তবে তা অপ্রকাশিত এখনো।অনেক খেয়াল রাখে সাদুর।আগে কেবল সাদুর মুখে শুনেছিলাম।কাল নিজ চোখে দেখা হয়ে গেছে।সাদুর কাজিনগুলোর মধ্যে ছেলেমেয়ে সবাই আমরা সমবয়সি, ২-৩বছর এর ছোট বড় হবো।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে রাফিদা আপুকে এখন বিদায় দেয়ার পালা।সবাই কান্না করছে।সাদু তো আপুকে জড়িয়ে ধরে সেইযে কান্না শুরু করেছে থামার নামই নেই।আমারও কিছুটা খারাপ লাগছে।গেট এর কাছে একপ্রকার নিউমার্কেটের ভিড় জমে গেছে।হঠাৎ আমার কানের কাছে এক পরিচিত কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,,,
--বাহ জুইঁফুল!কালকের গাল ধরে টেনে ধরা তাহলে কাজে দিয়েছে।কিন্তু তুমি ভাবলে কি করে এমন ভাবে নিজেকে কয় গজ কাপড়ে আবদ্ধ করলেই আমি তোমাকে চিনতে পারবো না।
তড়িৎ গতিতে আমি পিছনে তাকালাম।কালো পাঞ্জাবি পরে মুখে সাদা মাস্ক আর চোখে কালো সানগ্লাস পড়ে জায়েফ দাঁড়িয়ে আছে।
আমি কিছুটা ভীতু রূপে বলে উঠলাম,,,
--আপনি?
সাথে সাথে তাকে ভিড়ের মাঝে হাড়িয়ে ফেললাম। তাকে দেখে আমি নিজেই আশ্চর্য হলাম।তার মাথার চুল অনেক বড় বড় হয়েগেছে।এতটা বড় যাতে একটা পনিটেল করা যাবে।মুখে তার চাপ দাঁড়ির ঘনত্ব বেড়েছে।
তাড়াতাড়ি করে আর কিছু না ভেবে বাসায় এসে পড়লাম।মনের মধ্যে শান্তি পাচ্ছি না। বাসায় আসতে আসতে এরমধ্যে সাদু কল করেছে ৭বার।ওর কল ধরি নি ইচ্ছে করে।কেনো যেনো খুব ভয় করছে।এক অজানা আতঙ্ক আমায় চেপে ধরেছে।তাকে দেখার পর একটা চাপা কষ্ট মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।ওয়াশরুমে গিয়ে ঝর্নাটা ছেড়ে দিয়ে বসে বসে ইচ্ছে মতো কান্না করলাম। আজ আমার কান্নার কারণ কী নিজেও জানি না।বিছানায় এসে ফুল স্প্রীডে ফ্যানটা ছেড়ে শুয়ে পড়লাম রাত এখন ১১ টা।যখন চোখে আধো আধো ঘুম এসে পড়েছে আমার মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তা টের পেয়েছি।ফ্যান এর স্প্রীডও কমানো বুঝতে পেরেছি। এটা আমার বাবা।আমি জানি সে প্রতিদিন এসে এভাবে আমাকে দেখে যায়।
সকালে ফজর এর নামাজ পরতে পারিনি। ঘুমিয়েছিলাম বলে টের পাই নি।কাল এলার্ম টাও দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।সকালে সব সময়ই এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে।সেটা নামাজ এর জন্যই হোক বা অন্য কোনো কারণে। উপন্যাসের চরিত্রে মতো আমার কোনো কালেই পাখির কিচিরমিচির কিংবা আযানের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে না।
বাবার রুমে চা দিয়ে এসে নিজে এক কাপ চা খেলাম।সকালে শহরে আমার জানা মতে হয়তো খুব কম লোকজন আছে যারা ভাড়ি খাবারে অভ্যস্ত।আমি সকালে চা বিস্কুটে অভ্যস্ত।আমার বাবাও তাই।
একটু পরে কমলা চাচি আসলো।সে আসলে আমি ছোট থাকতেই আমাদের বাসার কাজ করে দেয়।বয়স তার ৫০ - ৫৫ হবে তবে এখনো হাজার কাজ সে এক সাথে করতে পারে।অনেক টা রসিক টাইপের সে।কিন্তু আমাকে সবসময় ভালো উপদেশ দেয়।কীভাবে যেন আমার প্রয়োজন অপ্রয়োজন টাও বুঝেন তিনি।তাকে আমি অনেক শ্রদ্ধা করি।ছেলেমেয়ে নেই তার।বলতে গেলে মেয়ের মতো দেখেন আমাকে।আমিও তাকে মায়ের মতোই ভাবি।আমার প্রথম পিরিয়ড এর সময় আমার এই মা টা আমার পাশে ছিলেন। আমাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।আমার এই কমলা মা নাকি টেন পর্যন্ত পড়া লেখা করেছে।সে বর্তমানে একটা বাচ্চাদের ডে-কেয়ারে হাফবেলা চাকরি করেন।আর কিছুটা সময় আমাদের বাসার আর তার বাসার কাজ করেন।তাকে বলে ছিলাম তোমাকে কাজ করা লাগবে না।আমাকে এসে কেবল দেখে যেও।কিন্তু কে শোনে কার কথা।সে এসে হাতের কাছে যেই কাজ পায় তাই করে দিয়ে যায়।
দুপুরে শাওয়ার নিতে ঢুকেছি এমন সময় মনে হচ্ছিলো কেউ ওয়াশরুমের দরজায় টোকা দিচ্ছে। পানির আওয়াজে শুনতে পাচ্ছি না ঠিক কি বলছে।সব কল বন্ধ করে বুঝতে পারলাম সাদু এসেছে।ওকে বললাম,,,
-- কি এই ঠাডা পরা গরমে তোর আবার কি চাই?
ও বললো,,,
-- শাওয়ারে বসেও যদি তোর গরম লাগে তাইলে আমার কি হবে?বের হ এখন।
আমি বললাম,,,
--আমি কি এমনেই বের হইতে পারবো নাকি।যা বসে বসে মদ খা আর মানুষ হ।আমি একটু গোসল করি।যা তো!
--তুই বের হবি নাকি আমি এখানেই হিসু করে দিবো।(সাদু)
--ওই তোর বাসায় বাথরুম নাই? তুই চোইদ্দো মাইল হাইট্টা আইছোস আমার বাসায় মুততে।(আমি)
--রাস্তায় আসার সময় হাফ লিটার এর সেভেন আপ খাইছিলাম।(সাদু)
-- নিজের টাকায় তো মনে হয় না খাইছোস।(আমি)
সাদু চিৎকার করে বলল।
--তুই বাইর হবি?
আমি বললাম,,,
--বেশি ধরছে বাবু?
--হ।বাইর হ তুই।(সাদু)
--আমার বাপের টায় যা।(আমি)
--না। আঙ্কেল এর টায় যাইতে কেমন জানি লাগতেছে।(সাদু)
--তাইলে আর কি করবি বইসা থাক(আমি)
--জুইঁইইই!!!(সাদু)
--চিল্লাস কে?এক কাজ কর আমার খাটের নীচে আমার নেংটু কালের হিসুর পট আসে।তোর মনে নাই?ওই যে নীল রঙের।যা ওই টায় যাইয়া বইসা পর।(আমি)
--একবার খালি বের হ তুই।তোরে আমি দেখাইয়া ছাড়বো।(সাদু)
--থাক তোর টা দেখবো না।আমি দেখলে তোর জামাই কি দেখবো?৫ মিনিট দাড়া তুই। আমি ১০ মিনিটে বের হইতাছি।(আমি)
আমি বের হতেই তড়িৎ গতিতে সাদু ওয়াশরুমের দিকে ছুটে গেলো।আমি বারান্দায় জামাকাপড় গুলো রোদে দিয়ে এসে রুমে সাদুকে বসে থাকতে দেখে বললাম,,,
--এমন জোড়ে দৌড় দিলি ডায়াবেটিস এর রোগীরাও তো এমনে দৌড় দেয় না।
--চুপ থাক।তোর সাথে কথা নাই।কালকে তুই হুট কইরা আইসা পরলি কেন?কতবার কল দিলাম। মোবাইল কি চান্দের দেশে থুইয়া দেছ?(সাদু)
ওর কথা শুনে কালকের কথা মনে পরতেই চুপচাপ বারান্দায় চলে আসলাম।আমার বারান্দার সাথে পাশের বাসার বারান্দার দূরত্ব এক হাতেরও কম।বারান্দার সামনের দিকে দৃষ্টি রাখলে একটা ছোট বিলের মতো চোখে পড়ে।এটা আসলে পিছনের সাইড।তাই কোনো রাস্তা ঘাট নেই এদিকে।বিলটার পাশ ঘেঁষেই এই ৬ তলা বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে।আমরা এই ভাড়া বাড়িটির ৩ তলাতে থাকি।
আমার পাশে সাদু এসে দাঁড়ালো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো,,,
--কি হয়েছে রে?
আমার মন খারাপের সময় এই মেয়েটার মুখে শুদ্ধ ভাষার বুলি ফোটে।আমি বললাম,,,
--বললে তো বিশ্বাস করবি না। লাভ কি বলে?
--অতীতের কথা মনে করে মন খারাপ করছিস?(সাদু)
--অতীত যদি বার বার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরে, মন খারাপ কি হবে না?(আমি)
--তুই কি আবারও কিছু দেখেছিস?(সাদু)
ওকে সব খুলে বললাম। সব শুনে ও বলল,,,
--এখন নবাবজাদা তোকে চিনতে আসছে কে?২বছর আগে কি করছিলো?
--তাকেই যেয়ে জিজ্ঞেস কর।(আমি)
সাদু আমাকে ওর বোনের রিসিপশনের জন্যে নিতে এসেছিল। আমার মনের এমন অবস্থা দেখে আর জোড়াজুড়ি করে নি।
এইভাবেই একসপ্তাহ চলে গেলো।কয়দিন পর আমার এইচএসসি এর রেজাল্ট দিবে।একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ড্রইং রুমে এসে ধপ করে সোফায় বসে পড়লাম ঘুম তখনো কাটেনি।আমার এই একটা বাজে অভ্যাস।ঘুম থেকে উঠে কোনো দিনই সাথে সাথে ফ্রেশ হতে যাই না।এই রুম ওই রুম হাটা হাটি করে ঘুম টা কাটলে তার পর ফ্রেশ হতে যাই।সোফায় বসে থেকেই পাশে তাকিয়ে মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যতম বস্তু আমার সামনে।
চলবে...
Writer:- হুমাশা এহতেশাম