--বাবাআআ,কমলা আন্টিইই!!!
এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বাবার রুমে দৌড়ে চলে আসলাম।আমার চিৎকারে সোফায় বসে আরাম করে যে লোকটা পায়ের উপর পা তুলে স্মোক করছিল তার এক হাতে থাকা মোবাইল ফোন টা ফ্লোরে পড়ে গিয়েছে। আমার ডাকে বাবাও শোয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে আসলেন।৷ হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন,,,
--কি হয়েছে জুইঁ?ভয় পেয়েছিস?
আমি বললাম,,,
--বাবা ওই লোকটা!ওই লোকটা!
--কে?(বাবা)
--তুমি ড্রইং রুমে চলো।তাড়াতাড়ি চলো।(আমি)
বাবাকে নিয়ে ড্রইংরুমে এসে দেখি টিভি ছেড়ে টি টেবিলের উপর দুই পা তুলে আরাম করে লোকটা টিভি দেখছে।বাবা উচু কন্ঠে বলে উঠলো,,,
--জায়েফ এটা একটা ভদ্রলোক এর বাড়ি। এগুলো কেমন বাচনভঙ্গি তোমার?আর এ বাড়িতে কি তোমার?
জায়েফ তখন সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো তার গায়ের জ্যাকেট টা ঠিক করতে করতে বলল,,,
--শশুর বাড়িতে যা থাকে আমারও এ বাড়িতে তা।
বাবা উত্তেজিত হয়ে বললো,,,
-- কিসের শশুর বাড়ি?
জায়েফ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ই উত্তর দিলো,,,
--আরে শশুরবাবা কয়দিন পরে নানা হবেন আর আজকে বলছেন শশুর বাড়ি কি জানেন না।
বাবা যে এবার রেগে গেছেন প্রচুর তা আমি ভালোই বুঝতে পারলাম। কিন্তু তাও চুপ করে বাবার পিছনে দাঁড়িয়ে রইলাম।বাবা বজ্রকন্ঠে বলে উঠলেন,,,
--ভদ্র ভাবে কথা বলো।আর এখানে কি চাই?
জায়েফ বাবাকে ক্রস করে কিছুটা দূরত্ব রেখে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলো। আমার বুকের ভিতর মনে হচ্ছে একটা ধকধক শব্দ বার বার ধাক্কা খাচ্ছে।দ্রুত গতিতে আমরা যখন কোনো কিছুর জন্য দৌড়ে হাঁপিয়ে পরি তখন আমাদের হার্ট যেমন দ্রুত বিট করতে থাকে এখন আমারও ঠিক তেমন ভাবে বিট করছে।জায়েফ আমার সামনা সামনি দাঁড়িয়ে বলল,,,
--আপাতত একটু দুধ হলেই চলবে।
আমি মাথানত করা অবস্থা থেকে মাথা তুলে অনেকটা বিস্ময়মূলক চাহনি নিয়ে তার দিকে তাকালাম।আমার চাহনি বুঝতে পেরে উনি আবার বললেন,,,
--মিল্ক!মিল্ক!আসলে আমার বাসায় দুধ শেষ হয়ে গেছে তো।তাই কফি খাওয়ার জন্য একটু দুধ নিতে আসলাম।
--ঢাকা থেকে গাজীপুর এসেছেন দুধ নিতে?
জায়েফ আমার দিকে চোখ মেরে বললেন,,,
--জুইঁবাবু এই রহস্য তো একটু পরেই বুঝবে।
তখন কমলা আন্টি দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো।এতক্ষণে উপলব্ধি করলাম কমলা আন্টি বাসায় ছিলনা। আসলে তার আজকে নাইট ডিউটি করতে হবে বলে সকাল সকাল আমাদের বাসায় এসে পরেছেন।তাকে দরজা খুলে দিয়ে আমি আমার রুমে এসে একটু শুয়েছিলাম।কমলা আন্টিকে দেখে বাবা বলল,,,
--কোথায় ছিলে তুমি?
বাবার কথায় আমি আর জায়েফ দুজনেই আন্টির দিকে তাকালাম। আন্টি মুখের ভিতর একটা পান চাবাতে চাবাতে বলল,,
--ভাইজান ময়লাওয়ালা নাকি আজকে আসবো না। ৩দিন এর ছুটি তে গেছে।তাই আমিই নিচে গিয়া ময়লা ফালাইয়া আইছি।খালি খালি জুইঁমনি নিচে যাইবো কেন?
বাবা একটু ধমকের স্বরে বললেন,,,
--দরজা কি বাইরে থেকে লক করে যাওয়া যেতো না?জুইঁ বা আমাকে ডাকলেই তো হতো।
--আমি তো ভাবছি দুই মিনিট এর কাম। তাই দরজাডা হালকা চাপাইয়া থুইয়া গেছিলাম। আরে জুইঁমনি এই ব্যাডা ডা কেডা?(আন্টি)
আমি জায়েফ এর দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললাম,,,
--একজন আগন্তুক।
আন্টি কিছুটা অবাক হওয়ার মতো করে বলল,,,
--আরে এই ব্যাডারে তো আমি নিচে যাওয়ার সময় দেখছিলাম।
জায়েফ গিয়ে আন্টির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,,
--কমলা সুন্দরী!রাইট?
আন্টি কিছুটা লাজুক হেসে বলল,,,
--আরে এহন আর সুন্দরী আছি কই।
এই কথাটা অবশ্য উনি ভুল বলেন নি।কমলা আন্টি আসলেই কমলা সুন্দরী। লাল ফর্সা গায়ের রঙে জোড়া ভ্রুযুগল তার রূপকে অনেকটা বাড়িয়ে তোলে।পান খাওয়ায় তার ঠোঁটে তার নামের মতোই একটা কমলা আর খয়েরী রঙের মিশ্রণে তাকে অন্যরকম লাগে।দেখলে তো মনে হয়না বয়স তার পঞ্চাশউর্ধ্ব।
এরমধ্যেই ঝাঝালো কন্ঠে বাবা বলে উঠলেন,,,
--শুরু হয়ে গেল তোমার। যাকে পাও তার সাথেই গল্প শুরু করে দাও।তুমি কি চেনো এই ছেলেকে?তোমাকেই বা কি বলছি।তোমার তো চেনা অচেনা লাগে না।মানুষ হলেই তোমার শুরু হয়ে যায়।আল্লাহ জানে কবে জেনো পশু পাখির সাথেও গল্প শুরু করে দিবে।
--ইশশশ!!শশুরবাবা কার রাগ কার উপর দেখাচ্ছেন? আমি জানি তো আপনি আমার উপর ক্ষেপে আছেন। তাই বলে কমলা সুন্দরীর সাথে রাগটা দেখাবেন?দিস ইজ নট ফেয়ার।(জায়েফ)
--কমলা আন্টি উনি দুধ নিতে এসেছেন,ওনাকে দুধ দিয়ে বিদায় করো তাড়াতাড়ি।(আমি)
--আরে পরিচয় হওন লাগবো না?(আন্টি)
এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না।জোড়ে বলে উঠলাম,,,
--আন্টি!!!!!!!!তাকে বিদায় করো।
দেখলাম জায়েফ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। হয়তো আমার এমন আচরণ দেখে ব্যাপারটা তার হজম হচ্ছে না।তার সাথে থাকাকালীন আমি কখনো তার সাথে জোড়ে শব্দ করে কথাই বলিনি।তখনকার আমি আর আজকের আমির মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত রয়েছে। তাকে তখন যেমন ভয় পেতাম আজও ভয় পাই।তবে সেই সময় আমার মধ্যে তার জন্য ভয় ছাড়া আর কিছু ছিল না। কিন্তু আজ আমার মধ্যে তার জন্য ক্রোধ,ঘৃণা, ক্ষোভ আর অভিমান ছাড়া কিছু নেই।
কমলা আন্টি তাকে ফ্রীজ থেকে এক প্যাকেট দুধ বের করে দিলেন।জায়েফ যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে বললেন,,,
--আই এম ইমপ্রেসড।
সে চলে যেতেই কমলা আন্টি এসে আমার কাছে জানতে চাইলো কি হয়েছে। আমি আন্টিকে সব খুলে বললাম। আমার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন আন্টি তার গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল। তার চাচাত ভাই ইন্তেকাল করেছিলেন। জায়েফ কে না চেনাটাই স্বাভাবিক। কমলা আন্টিকেও জায়েফ সম্পর্কিত তথ্য খুব একটা বেশি বলিনি।তাকেও একই কথা বলে কাটিয়ে দিয়েছি।আর তা হলো - আমি জায়েফ এর সাথে বেমানান। এখন নিজের কাছেও মনে হয় আসলেই তো আমি বেমানান। কোথায় একজন রকস্টার আর কোথায় আমি!!!
কমলা আন্টি দুপুরের খাবার টা আমাদের এখান থেকেই খেয়ে চলে গেলো তার ডিউটি তে।বিকেল বেলা আসর এর আযান দেবার আগে আগে একটু ঘুমিয়ে থাকি।তবে প্রতিদিন না,মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে থাকি। ঘুম না আসলে আমার বারান্দায় বসে বসে গল্পের বই পড়ি, কোনো দিন কফি খাই, কোনোদিন বসে বসে সামনের বিলের পানে নিশ্চিুপ হয়ে চেয়ে থাকি।আবার অনেক সময় এখানে বসে নাটক বা মুভি দেখি।বারান্দায় বসে হাতে চা পা কফি নিয়ে নাটক - সিনেমা দেখার মজাই আলাদা।
এতো কিছুর মাঝেও নিজেকে বড্ড একা মনে হয়।এখন বাবা থেকেও তার সাথে আগের মতো গল্প করা হয় না।সাদুও বড় হয়েছে ওকে ওর মা আগের মতো হুটহাট বাড়ির বাইরে বের হতে দেয় না।ভাইয়াও হয়তো বা ব্যস্ত থাকে।আগের মতো কথা হয়না।সব মিলিয়ে জীবনটা কেমন জেনো ছন্ন ছাড়া মনে হচ্ছে। একা একা যখন থাকি তখনই কষ্টেরা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। অন্যের সামনে কখনোই আমি নিজের কষ্ট দেখাতে পারি না।সবসময় হাসি-খুশি থাকি।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে এতো কিছু ভাবতে ভাবতে যখন আমি প্রায় ভাবুক হয়ে যাচ্ছিলাম তখনই আমার প্রাণভোমড়া তথা মোবাইলটা বেজে উঠলো।স্ক্রীনে "রাণু মন্ডলের ২য় ভার্ষণ" লেখাটা একেবারে চকচক করছে।ফোনটা কানে তুলতেই ওপাশ থেকে সাদু বলতে লাগলো,,,
--দোস্ত ওই পাদমান আমারে প্রপোজ করছে আজকে একটু আগে।
--কতোবার বলবো তোরে মানুষের নাম নিয়া ভেঙ্গাইস না।(আমি)
--আমারে ওই জোকার প্রপোজ করছে আর তুই পইরা আছোস নাম নিয়া?(সাদু)
--শোন তোরে প্রপোজ কইরা যে সাদমান ভাইর কপাল পুরাটাই পুড়ছে তা কি সাদমান ভাই জানে?(আমি)
--ও না জানলেও আমি জানি!(সাদু)
হাহাহাহাহাহাহহা!!!!দুজনেই ফোনের দুপাশে একেবারে হেসে কুটি কুটি হচ্ছি।
আসলে সাদু কিছুটা গুন্ডি টাইপ।একবার ক্লাসের বাইরে মাঠে বসে একটা ছেলে সাদুকে পটানোর চেষ্টায় ছিলো।তখন ছেলেদের ক্লাস ছিলো ১২:৩০ মিনিটে আর আমাদের ছুটির সময় ছিলো ১২ টায়। আমাদের শেষ ক্লাস চলছিলো তখন।আমরা দোতলায় ক্লাস করছিলাম।জানালার পাশে ছিলো সাদু।জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই করিডোরের পরে মাঠ দেখা যায়।সেখানেই একছেলে ওকে ইশারায় প্রেম বিনোদনের চেষ্টায় ছিলো।সাদু হঠাৎ ক্লাস চলাকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে যায়।আর স্যারকে বলে মাঠে দাঁড়িয়ে একজন ওকে ডিস্টার্ব করছে।একটু পরে ছুটির ঘন্টা দিলে স্যারকে নিয়ে সেই ছেলের কাছে গিয়ে একে বারে ধুয়ে রঙ উঠিয়ে এসেছিল।আরেক বার ক্লাস নাইনে কোচিং এর এক বড়ো ভাই ওকে প্রপোজ করেছিল।সাদু আগে থেকেই বুঝতে পেরে কোচিং এর নিচে যেখানে সিসি ক্যামেরা ছিলো সেখানে দাঁড়িয়ে পরে ছেলেটাও বলদের মতো ওকে ওখানে প্রপোজ করে বসে।আর তারপরের দিন কোচিং এ এসে ওই ছেলেরও কেল্লাফতে হয়ে যায়।এবার সাদমান ভাইর কি হয় আল্লাহ ই জানে।
আমাদের হাসাহাসির এক পর্যায়ে হঠাৎ আমার চোখ যায় পাশের বিল্ডিংয়ের বারান্দায়।জায়েফ একটা হালকা বাদামী রঙ এর থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট আর মেরুন রঙ এর টিশার্ট পড়ে পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে একটা ফোন, যা দেখে মনে হচ্ছে ফোনটার ক্যামেরা আমার দিকে তাক করা। কিছুটা ভিডিও করার ভঙ্গিতে সে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে এভাবে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। ফোনটা কেটে তার আরেকটু কাছে গিয়েই বুঝতে পারলাম এটা আসলেই জায়েফ স্ব শরীরে দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ করেই বুকের ভিতর মনে হচ্চে আমার শ্বাস - প্রশ্বাসেরা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আমি কোনো দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহন করে এসেছি। তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলার আগেই উনি বললেন,,,
--আরে জুইঁবাবু এটা আমিই।তোমার ওয়ান পিছ হাসবেন্ড।
--আমি ঢাকায় আসলাম কখন?(আমি)
--What?(জায়েফ)
--না মানে আপনি ঢাকায় আসলেন কবে?(আমি)
আমি যখন অতিরিক্ত মাত্রায় ঘাবড়ে যাই বা ভয় পাই তখনই আমি উল্টো পাল্টা কথা বলি।আসলে মাথায় এক কথা থাকলে মুখে বলে ফেলি আরেক কথা।উপন্যাস বা গল্পের চরিত্রের মতো ভয় পাই ঠিকই কিন্তু তাই বলে যে ভয় পেয়ে বোবা হয়ে যাবে তেমন টাও নই আমি।দেখতে হবে না কার সাথে থাকি। সাদুর স্বভাব একটু হলেও বাতাসে বাতসে উড়ে এসে আমার গায়েও লেগে গেছে। তখনি জায়েফ ওপাশ থেকে বলল,,,
-- জুইঁবাবু আমরা এখন গাজীপুরে।
--হ্যাঁ।মানে তাই ই।আপনি এখানে কি করেন।(আমি)
--তুমি যেখানে আমি সেখানে সে কি জানো না।(জায়েফ)
কিছুটা সুর তুলেই বললেন।
--বাবা আমি গ্রামের বাড়ি যেতে চাই।
নির্লিপ্ত গলায় বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ডান হাতের ব্যাগটা ফ্লোরে রাখতে রাখতে বলে উঠলাম আমি।বাবা টি টেবিলের উপর পত্রিকাটা রেখে আমার দিকে তাকালেন।সকাল সকাল এমন কথা শুনে বাবা কিছুটা অবাক হয়েই বলে উঠলেন,,,
--হঠাৎ!আমাকে বললি না যে? এখনি যাবি নাকি?তোর ব্যাগ গুছিয়েও ফেলেছিস?
--হ্যাঁ।আজ এক্ষুনি যাবো।কমলা আন্টিকে বলে দিয়েছি ফোন দিয়ে।তুমি কি আমাকে দিয়ে আসবে? না দিয়ে আসলেও সমস্যা নেই।একা চলে যেতে পারবো।এখন থেকে একা পথ চলাটাও শিখে নিতে হবে।(আমি)
--মা চল তোকে দিয়ে আসবো।তুই যা বলবি তাই ই হবে।(বাবা)
--এই কথাটা আগে বুঝলে আরো ভালো হতো।(আমি)
বাবা নিজের রুমে চলে গেলো কোনো প্রকার জবাব না দিয়েই। তার বলারই বা বাকি আছে কি।ইদানিং আমি কোনো কিছু বললে বা চাইলে বাবা সাথে সাথেই হ্যাঁ বলে দেয়।কিন্তু এখন হ্যাঁ বলে আর লাভ কি?বিয়ের সময় ভাইয়ার তত একটা সম্মতি ছিল না।আমার বিয়ের পরে কি করেছে জানি না তবে ডিভোর্স এর পর থেকে ভাইয়া বাবার সাথে কথাই বলে না।আমাকে সপ্তাহে ১-২ বার কল দেয়।আগে প্রতিদিন একবার করে খোঁজ নিতো।শুনেছি ভাইয়ার নাকি প্রমোশন হয়েছে হয়তোবা তাই ব্যস্ত ইদানিং।
বাসায় তালা দিয়ে বাবা আর আমি বাস স্টেশনের দিকে চললাম। সাদুকে একবার কল দিয়েছিলাম। ওর ফোনটা বন্ধ পাই।কাউন্টার থেকে দুই সিটের টিকেট কেটে বাসে উঠে বসলাম। ১৫ মিনিটের অপেক্ষাকে বিদায় দিয়ে বাস তার নির্দিষ্ট গতিতে চলতে লাগলো। বাসে জানালার পাশের সিটে বসেছি আমি। মাথাটা একটু বা দিকে এলিয়ে দিলাম।
পৃথিবীতে নানান রোগের নানান ঔষধ তৈরি করা যায় কিন্তু স্মৃতি, অনুভুতি,যন্ত্রণা দুঃখ কষ্ট ভুলে যাওয়ার কোনো ঔষধ তৈরি করা যায় না কেন?যদি এমন কোনো ঔষধ পৃথিবীতে থাকতো তাহলে যেকোনো কিছুর মূল্যেই আমি তা ক্রয়ের চেষ্টা করতাম।কারণ ওই লোকটাকে এই পর্যন্ত যতবারই দেখেছি ততবারই অতীত এসে আমাকে কষ্ট দিয়ে যায়।ওই লোকটাকে সামনে দেখলে কষ্ট হয় আমার। খুব কষ্ট হয়।
কালকে সকালে তাকে দেখে বুঝতে বাকি ছিল না যে সে পাশের বিল্ডিংয়ে উঠেছে।কিন্তু আমার জানা মতে তো তার নিজের বাড়ি আছে। কিন্তু তাও সে ভাড়া বাড়িতে কি করছে?আমার সাথেও কেমন আচরণ করছিল।যাইহোক, তার লাইফ তার ইচ্ছে। সে আকাশে, বাতাসে, পানিতে যেখানে খুশি সেখানে থাকুক আমার কি?আমি শুধু তার থেকে দূরে থাকতে চাই। অনেক দূরে। যেই লোক সামান্য দুধ নিতে ডিরেক্ট বাসায় এসে পরে সে কয়দিন পরে আদা রসুন নিতেও বাসায় এসে পরতে পারবে।এখন থেকে তার সঙ্গে হয়তোবা বার বার দেখা হয়ে যাবে।যা আমি চাই না।তার সামনে যেনো পরতে না হয় তাইতো আজ গ্রামের বাড়ি যাওয়া।
চোখে হালকা ঘুম এসে পরেছিল।বাসের ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুম চলে যেতেই দেখি বাসটা কিছুটা গ্রামের দিকে এসে পড়েছে। গ্রাম বললে আসলে ভুল হবে।কারণ পিচঢালা রাস্তার কোল ঘেষে চারপাশে অনেক বড় আর মোটা মোটা গাছ।এরপর দৃষ্টি যতটুকু যায় তাতে ফসলের মাঠ দেখা যাচ্ছে। সবশেষে ছোট ছোট ঘড় চোখে পরছে।নাকে একটা মাটির গন্ধ ভেসে আসছে। সব মিলিয়ে ভালো লাগার মতোই পরিবেশটা।
দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার বাস জার্নি করে বাস থকে নামলাম বাবা আর আমি।সময় টা এখন আসর আর মাগরিবের মাঝামাঝি। এখান থেকে একটা অটোতে করে ২০-২৫মিনিটের রাস্তা পাড়ি দিলেই আমাদের গন্তব্য "দাদু বাড়ি"পৌঁছে যাবো।
দাদু বাড়ি এসেছি আজ দু'দিন হলো।এখানে এসে কিছুটা ভালোই লাগছে।দাদু বাড়ি আর নানু বাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। এখানে একটা বাজার রয়েছে। বাজারের একপ্রান্তে দাদু বাড়ি আর আরেক প্রান্তে নানু বাড়ি।আমার আপন কোনো কাজিন নেই তবে দাদু আর নানু বাড়িতে আশেপাশে আমার সমবয়সী কয়েকজন মেয়ে আছে। ওদের সাথে একটুআধটু ভাব আছে।
দুপুর এর দিকে জাম মাখিয়ে খাচ্ছিলাম।সাথে সুমনা আপু ছিল,আঁখি ছিল, সুমাইয়া ছিল।সুমনা আপু এখানেই একটা ডিগ্রি কলেজে পড়ে।আঁখি আর সুমাইয়া আমার ক্লাসে পড়ে। ওরা সবাই ই দূর সম্পর্কের আত্মীয়।ওই গ্রামের বাড়ি পাশাপাশি বাড়ি যেমন থাকে ওদের বেলাতেও তেমনই আরকি।এমন সময় সাদুর কল আসে।ওর সাথে প্রায় ১ ঘন্টার মতো কথা বলে আমার ফোন টা কে ঘুমাতে পাঠাই।এই দুই দিন আমি কি কি করলাম।আর সাদু কি কি করলো এইসব নিয়েই কথা বলে কেটে দেই। ফোন রাখার পরে বুঝতে পারি যে আসলে পুরো ১ঘন্টা পাড় হয়ে গেছে।সাদুকে গ্রামে এসেই জায়ফের গাজীপুর আসার কথা, আমাদের বাসায় আসার কথা বলেছিলাম।
সাদুর সাথে কথা বলে সুমনা আপুদের সঙ্গে একসাথে পুকুরে গোসল করতে আসি।সুমনা আপুরা সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতা করছে।আমি বসে বসে ওদের জন্য রেফারির চাকরি করছি। ছোট থেকে বেশির ভাগ সময়টা গাজীপুর থাকা হয়েছে বলে সাঁতার টা শিখে ওঠা হয়নি।গোসলের পাট চুকিয়ে, খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে বিকেল বেলা নানু বাড়ি এসেছি। আজকে এখানেই থাকবো আবার ২-৩ দিন পরে দাদু বাড়ি যাবো।
নানুদের বাড়িতে নানা নানু আর মামা মামি থাকে।এই বাড়িতে বাচ্চা পার্টি বেশি।এখন কেবল রাত ৮টা বাজে। বাচ্চা পার্টি এতক্ষনে ঘুমিয়ে সমুদ্রের তলদেশে চলে গেছে। নানু বাড়ি এই এক সমস্যা, গ্রামে ওরা ৯-১০ টার দিকেই ঘুমিয়ে পড়ে। আর বাচ্চা গুলো আরও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। আমার তো ১১ টা ১২ টার আগে ঘুমই আসে না।তাই একা একা আমার রুমেই বসে থাকতে হয়।
বিকেলে বৃষ্টি হওয়ায় গাছগাছালি আর মাটির ভিজে গন্ধের সাথে হালকা ঠান্ডা পরিবেশটা এখন ভালোই লাগছে। জানালার পাশে একা একা অনেক সময়ই হলো বসে আছি।হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। নাম্বার টা অবশ্য আননোন।কারণ বাবা,ভাইয়া, সাদু ওদের নাম্বার ছাড়া আর কারো নাম্বার আমার ফোনে নেই। ২ বার ফোনটা বেজে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ৫-৬ মিনিটের মাথায় আবার বেজে উঠলো। একটু বিরক্তি হয়েই কল টা রিসিভ করলাম।সালাম দেয়ার সাথে সাথে অপর পাশ থেকে বলে উঠলো,,,
--জুইঁ আমি সাদমান।তোমাকে এতোবার কল করে বিরক্ত করার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত।
--না না।আমি বিরক্ত হইনি।আসলে নাম্বার টা অপরিচিত বলে আমি পিক করছিলাম না।(আমি)
--ওহ।আচ্ছা শোনো, তোমার সাথে কি সাদিয়ার কথা হয়েছে আজকে বা কালকে?(সাদমান)
--হ্যাঁ।আজকেও তো কথা বললাম আমরা।(আমি)
--আসলে ও আমার নাম্বার টা ব্লক করে রেখেছে মনে হয়।তুমি কি একটু ওকে বলে আমার সাথে ওর যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবে? (সাদমান)
আমি বুঝেও না বোঝার ভান করে বললাম,,,
-- ও আপনাকে ব্লক করে রাখবে কেন?(আমি)
--না মানে,আসলে।আমি ওকে প্রপোজ করেছি ২-৩ দিন আগে।ওকে একটা বই আর চকলেট দিয়েছিলাম।ও চকলেট টা নিয়ে কিছু না বলেই চলে যায়।এরপর থেকে ওকে কল করলেই ব্যস্ত বলছে।(সাদমান)
তার কথা শুনে চাপা হাসিটা আর রাখতে না পেরে ফিক করে হেসেই ফেললাম। পরমুহূর্তেই বুঝতে পারলাম হাসাটা উচিৎ হয়নি।বেচারা এসেছে তার সমস্যা নিয়ে।আর আমি বেআক্কলের মতো হাসছি। হাসি থামিয়ে বললাম,,,
-- ভাইয়া সরি! সরি!সরি!আপনি মনে করেন না কিছু। সাদু কেমন তা তো জানেনই আপনি।প্রেম করার মতো মেয়েতো আর ও নয়।আমি ওর সাথে কথা বলে আপনাকে জানাচ্ছি। (আমি)
--আচ্ছা তাহলে ওর সাথে একটু কথা বলো।আর ওকে বলো আমি ওকে প্রেম করতে বলছিনা আমার সাথে। আমি শুধু আমার মনের কথা ওকে প্রকাশ করেছি।এখন ওর মনে কি আমি শুধু তাই ই জানতে চাই।(সাদমান)
--জ্বি ভাইয়া ওর সঙ্গে কথা বলে দেখি। রাখছি তাহলে।(আমি)
সাদমান ভাইর কল টা কেটে সাদু কে কল দিলাম দুই বার রিং হতেই রিসিভ করলো।
--এতোই যখন তোর আমারে মনে পরে তাইলে গ্রামে গেলি কেন?(সাদু)
--তোর এতই যখন সাদমান ভাইরে অপছন্দ তাইলে তার চকলেট খালি কেন?আমারে দিলেই পারতি।(আমি)
--ওই ব্যাডা তোরে কল দিসিলো তাই না?(সাদু)
--তুই নাকি নাম্বার ব্লকে রাখছোস?(আমি)
--হ।শোন তোরে সিক্রেট একটা কথা কই।ওই ব্যাডারে নাকে দড়ি দিয়া ঘুরাইয়া দেখতে হইবো।যদি আমার কাছে পাশ করে তাইলে তো ভালোই আর পাশ না করলে আরো ভালো।(সাদু)
--তোরে তো আর এখনি প্রেম ট্রেম করতে হইতাছে না।ব্লক টা অন্তত খোল।(আমি)
--আচ্ছা দেখতাছি।ওই তুই গাজীপুরে আসবি কবে?(সাদু)
--যদি আর কোনো দিন না আসি?(আমি)
--মানে?আসবি না কেন? ওই শয়তান ব্যাডার জন্যে?
--হ্যাঁ।আমি তার সামনে পরতে চাই না।তাকে আমি দেখতে চাই না।(আমি)
--বাসা পাল্টে ফেল।তাইলেই কিচ্ছা খতম।(সাদু)
--বাসা কে খুজবো।তুই?মালপত্র কে টানবো।তুই?ভাইয়া নাকি সামনে মাসে আসবে।তাই ভেবেছি এই কয়েকদিন গ্রামে থাকবো।ভাইয়াকে বলেছি এসব।তাই ভাইয়াও বলেছে বাংলাদেশে এসে নতুন বাসা নিয়ে তারপর আমাকে গ্রাম থেকে নিয়ে যাবে।(আমি)
--আচ্ছা বোইন আমারে একটু কতো ওই ব্যাডা চায় টা কি?(সাদু)
--যাইয়া তারেই জিজ্ঞেস কর।ফোন রাখ আমি ঘুমাবো।(আমি)
সাদু কল টা কাটার সাথে সাথে আবার ফোন বেজে উঠলো।সেভ করা না বলে খেয়াল না করে সাদমান ভাই ভেবেই রিসিভ করে বললাম,,,
--নিন আপনার রাস্তা এখন ক্লিয়ার।এবার একটু মন ভরে আমাকে ট্রিট দেন।(আমি)
--নিজের রাস্তা নিজে ক্লিয়ার করে আবার নিজেই ট্রিট চাচ্ছো।
অন্যরকমের ভয়েস শুনে তাড়াতাড়ি করে নাম্বার টা চেক করে দেখলাম এটা সাদমান ভাইর নাম্বার না।হঠাৎ মনে হলো কন্ঠ টা জায়েফ এর মতো।ফোনটা আবার কানে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,,,
--কে আপনি?
--জানালা দিয়ে সোজা তাকাও।আমাকে স্ব শরীরেই দেখতে পাবে।
মনে মনে যা ভাবছি যদি তাই হয় তাহলে আমি কি করব?আস্তে আস্তে জানালার পর্দা সরিয়েই মনে হলো আমার পৃথিবী শুদ্ধ আমি চরকির ন্যায় ঘুরছি।জানালা দিয়ে তাকালেই বাড়ির উঠোন দেখা যায়।২৫-৩০ কদমের উঠোন টা পাড় হলেই বাড়ির গেট দেখা যায়।গেট টা এখনো খোলা আর গেট এর বাইরেই পাকা রাস্তায় জায়েফ কে দেখা যাচ্ছে।তার পিছনে তার সাদা রঙ এর গাড়ি টাও দাঁড়িয়ে আছে। রাতের বেলা বাইরে লাইট জ্বালিয়ে রাখা হয় এখানে। তাই লাইটের ফকফকা আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কালো জিন্সের সাথে সাদা টি-শার্ট পড়ে একহাতে একটা জ্যাকেট নিয়ে আরেক হাতে ফোনটা কানে ধরে জায়েফ দাঁড়িয়ে আছে।আমাকে দেখার সাথে সাথে ফোন হাতেই আমাকে ইশারা করলো।তার মুখে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা দেখে কেনো যেনো খুব রাগ লাগছে। তখন উনি আবার ফোনট কানে নিয়ে বলে উঠলেন,,,
--জুইঁফুল একটা বার বের হবে?যাস্ট দেখে চলে যাবো।
তার এমন কথায় মনে হলো আমার রাগে পুরো শরীর রিরি করে উঠলো।মনে মনে ভেবে নিলাম তার সাথে আজকে বোঝাপড়াটা শেষ করতে হবে।কয়কদিন ধরেই কেমন যেনো করে আসছে উনি।আজকে আমাকে দেখতেও চাইছে।উনি সত্যি সত্যি ই কি চায় আজ জানতে হবে।
ওনার ফোনটা কেটে গায়ে ওড়না টা ভালো করে পেচিয়ে উঠোনের লাইটটা অফ করে উঠোনটা অন্ধকার করে নিলাম। কেউ যেন না দেখে আর দেখলেও যেন চিন্তে না পারে।একট ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বললে তা গ্রামে দৃষ্টিকটু দেখায়।জায়েফকে মামা মামি,নানা নানু চিনলেও তো আর অন্য মানুষরা চেনে না।আমাদের সম্পর্কের কথা তো আর জানে না।তাই তো এই ব্যবস্থা করা। মোবাইলের আলোতেই বের হয়ে পড়লাম ঘর থেকে।
চলবে...
Writer:- হুমাশা এহতেশাম