'সপ্তাহ' ----- এই চার বর্ণের ছোট্ট শব্দটা উচ্চারণ করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। কিন্তু, এই সপ্তাহের মাঝে লুকিয়ে থাকা ছাপ্পান্নটি প্রহর পাড়ি দিতে শুধু যে বেগ পেতে হয় তা নয়, ভয়ানক এক যুদ্ধে নামতে হয়। সেই যুদ্ধটা হয় কখনো মনের সাথে মস্তিষ্কের তো কখনো মনের সাথে চামড়ায় ঢাকা এই শরীরটার। আপাতদৃষ্টিতে যুদ্ধটা কিন্তু করতেই হয়। নির্ঘুম রাত, খাবারের প্লেট এমনকি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দুগুলোর সাথেও চলে বিষাক্ত মুহূর্তগুলোর নির্মম যুদ্ধ। আমিও যুদ্ধ করেছি। এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা দিয়েই পাড় করেছি আস্ত একটা সপ্তাহ। 'পড়ছি' বাহানায় ঘন্টার পর ঘন্টা শান্ত, নিথর বসে থেকেছি। সারাদিন দরজা বন্ধ রেখে, ব্যস্ততার নামে দুঃখ লুকিয়েছি। কাঁথা দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে ঘুমের নামে নির্ঘুম রাত পার করেছি। 'পড়াশোনা নিয়ে ডিপ্রেশড' বাহানা দিয়ে সকালের খাবার দুপুরে আর দুপুরের খাবার মধ্যরাতের রুটিনে ফেলে রেখেছি। তবুও হেরে যাই নি। কারো সামনে এক বিন্দু কাঁদি নি, হা-হুতাশ করি নি। কিন্তু, আমার এই হেরে না যাওয়াটা বেশিদিন টিকলো না। যেখানে আমার তীব্র ভয়, তীব্র অস্বস্তি সেখানেই বিশাল এক ভুল করে ফেলল রাফিয়া। রাফিয়ার 'ভেঙে যাবে যাবে' সম্পর্কটা তখনও ভাঙে নি। কোনো একটা উপায়ে সম্পর্কটা আবারও জোড়া লেগে গিয়েছে। শুধু জোড়া লেগেও ক্ষান্ত হয় নি। আগামী এক-দুই মাসের জন্য কাটা-ছেঁড়া সম্পর্কের হায়াতটাও বেড়ে গিয়েছে। কিভাবে বেড়েছে, কে জানে? জানালার শিকে পা তুলে বিছানায় বেশ আরাম করে শুয়ে ছিলাম আমি। মুখের সামনে একটা বই নিয়ে গম্ভীর মুখভঙ্গিতে তাকিয়ে আছি। এমন সময় রাফিয়া এলো। বিছানা থেকে আমার ফোনটা তুলে নিয়ে বলল,
----" ব্যালেন্স আছে?"
আমি বই থেকে চোখ তুলে তাকালাম। ভ্রু বাঁকিয়ে বললাম,
----" না। নেই।"
রাফিয়ার মুখটা চুপসে এলো। বিছানায় বসে আমার ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল,
----" সিফাতের সাথে কথা বলতে বলতে ফোন অফ হয়ে গিয়েছে। মোস্ট ইম্পোর্টেন্ট কথা চলছিল, বুঝলি?"
আমি জবাব দিলাম না। বিরক্ত চোখে বইয়ের পাতায় মুখ ডুবালাম। রাফিয়া কিছুক্ষণ একা একা বকবক করে হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠলো। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
----" রোদু? শুভ্র ভাই হোয়াইটস্ অ্যাপে আছেন। উনাকে টাকা পাঠাতে বলি?"
আমি অসচেতন গলায় বললাম,
----" হু।"
----" কত টাকা পাঠাতে বলব? ত্রিশ?"
আমি এবার চোখ তুলে তাকালাম। কপাল কুঁচকে বললাম,
----" কি?"
----" শুভ্র ভাইকে ব্যালেন্স দিতে বলি তোর ফোনে, ত্রিশ টাকা।"
আমি চোখ বড়বড় করে বললাম,
----" অসম্ভব। তুই উনাকে কখনোই ম্যাসেজ করবি না। আমার ফোন থেকে তো ভুল করেও না।"
রাফিয়া বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। অসহায় মুখে বলল,
----" খুব ইম্পোর্টেন্ট, প্লিজ রোদু।"
বইটা পাশে রেখে উঠে বসতে বসতে বললাম,
----" কোনো প্লিজ ফ্লিজ চলবে না। দরকার হলে অন্য কাউকে বল তবু শুভ্র ভাইকে না।"
----" আর কাকে বলবো? আলিফ ভাই, অদুদ ভাই আমার ভাই সব কয়টা ফাজিল। আমি বলতে বলতে মরে গেলেও টাকা সেন্ড করবে না। কিন্তু শুভ্র ভাই ওমন না। আর তুই সেজে ম্যাসেজ দিলে মুহূর্তেই দিয়ে দেবে। তোকে খোঁচা মারার জন্য হলেও দেবে।"
আমি লাফিয়ে উঠে বললাম,
----" একদম না রাফিয়া। উনার কাছে টাকা চাইব আর আমি! ছি...! তুই আমার ফোন দে বলছি।"
আমাকে বিছানা থেকে নামতে দেখেই তাড়াহুড়ো করে টাইপ করতে লাগল রাফিয়া। আমি দৌঁড়ে গিয়ে ওর হাত থেকে ফোন নিতে নিলেই দৌঁড়ে বিছানার উপর উঠে গেলো সে। বেশ কিছুক্ষণ ছুটোছুটির পর বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল রাফিয়া। দাঁত কেলিয়ে বলল,
----" ম্যাসেজ সীন হয়ে গিয়েছে। আহা! আহা!"
আমি দ্রুত হাতে ফোনটা নিজের কাছে নিলাম। উদ্বিগ্ন চোখে ম্যাসেজের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই ম্যাসেজ সীন করেছেন। রাগে-দুঃখে কান্না পেয়ে যাচ্ছে আমার। রাফিয়াকে ধরে ঠাটিয়ে চড় বসাতে ইচ্ছে করছে। আমি শুভ্র ভাইকে আরেকটা ম্যাসেজ দিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব কি বলব না সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই ফোনে ম্যাসেজ টুন বাজলো।
: 207: Account refilled TK 50....... ম্যাসেজটা দেখেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। রাফিয়া উনাকে ত্রিশ টাকা রিচার্জ করে দিতে বলেছেন আর উনি এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মিনিটের মধ্যে পঞ্চাশ টাকা রিচার্জ করে দিয়েছেন। বিষয়টা আমার আত্মসম্মানে তীব্র আঘাত হানলো। রাগে চোখদুটো টলমল করে উঠলো। ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে তুমুল আক্রোশ নিয়ে রাফিয়ার দিকে তাকালাম। রাফিয়া প্রথমবারের মতো আমার চাহনী দেখে ভয় পেলো। ওর ঠোঁটে লেগে থাকা দুষ্টু হাসিটা মিলিয়ে গিয়ে চোখে-মুখে একরাশ অস্বস্তি ভর করলো। মুখ কাঁচুমাচু করে বলল,
-----" তুই হঠাৎ এমন সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছিস কেন, রোদু? সিম্পল একটা ব্যাপার নিয়ে...."
আমি ফুঁসে উঠে বললাম,
----" সিম্পল? কিসের সিম্পল? এটা তোর কাছে সিম্পল হলেও আমার কাছে নয়। তোকে আমি মানা করার পরও ম্যাসেজ কেন করলি উনাকে? তাও আবার আমার নাম করে? সব সময় এমন ছ্যাচড়ামো না করলে চলে না তোর?"
রাফিয়ার মুখটা কালো হয়ে গেল। আমি আরো কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। রাফিয়াকে এভাবে বলাটা উচিত নয় নি। আর যায় হোক, বেড়াতে এসে কেউ এমন ধরনের কথার শিকার হতে চায় না। নিশ্চয় ভীষণ অপমানিত ফিল করছে মেয়েটা। আমি কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। দরজা খুলতে খুলতে বললাম,
----" মাথার ঠিক ছিলো না, সরি। মন খারাপ করিস না।"
রাফিয়া আমার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
----" কই যাচ্ছিস?"
----" ফেক্সিলোডের দোকানে।"
আমার কথায় থমকে দাঁড়াল রাফিয়া। আৎকে উঠে বলল,
----" দোকানে মানে? রাত দশটা বাজে রোদ। এতো রাতে দোকানে!"
আম্মু টেবিল গোছাচ্ছিলেন। রাফিয়ার কথাটা কানে যেতেই ভ্রু কুঁচকালেন,
----" কি হয়েছে?"
রাফিয়া উত্তর দিলো না। আমি দৃঢ় গলায় বললাম,
----" আমি ফেক্সিলোডের দোকানে যাব। দরকার আছে।"
----" এতো রাতে কিসের দোকান? দিন দিন বুদ্ধিশুদ্ধি কমছে নাকি তোর? যা ঘরে যা।"
আমি আগের থেকেও দৃঢ় গলায় বললাম,
----" আমি যাব।"
আমার দৃঢ় জবাবে হঠাৎই কোনো কথা খুঁজে পেলেন না আম্মু। আব্বু আর ভাইয়া এসে বুঝালো, কাজ হলো না। শেষ পর্যন্ত ভাইয়ার মতো কুঁড়ে মানুষটাও দোকানে গিয়ে লোড করে এনে দিতে রাজি হলো কিন্তু আমিও বদ্ধপরিকর, যাব মানে যাবই। ভাইয়াকে শুভ্র ভাইয়ের নাম্বারে টাকা পাঠাতে বললে কি একটা বিশ্রী অবস্থার সৃষ্টি হবে! তার থেকে আমার যাওয়াটাই ভালো। ঘড়ির কাটা যখন সাড়ে দশটায় পৌঁছালো তখন ভাইয়াকে সঙ্গে নিয়ে ফেক্সিলোডের দোকানে গেলাম। শুভ্র ভাইয়ের নাম্বারে পঞ্চাশ টাকা সেন্ড করেই ক্ষান্ত হলাম। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উনাকে ম্যাসেজ পাঠালাম,
----" আগের ম্যাসেজটা রাফিয়া ফাজলামো করে পাঠিয়ে ছিলো, সরি। আপনার ফোনে টাকাগুলো রিটার্ন করেছি।"
এক মিনিটের মাথায় ম্যাসেজ সীন হলো কিন্তু রিপ্লাই এলো না। দু'মিনিট পর ফোনে আবারও ম্যাসেজ টুন বাজলো। :207: Account refilled TK 100...... ম্যাসেজটা দেখেই মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা হলো আমার। এই কাজটা যে উনার তা আর বলার অপেক্ষা রাখলো না। মুহূর্তেই রাগে শরীরটা জ্বলে উঠলো আমার। বর্তমানে কলেজ, প্রাইভেট কিচ্ছু নেই তাই হাত খরচা নামক উপরি টাকাটাও নেই। শুভ্র ভাইয়ের সাথে এই খেলায় আমি জিততে পারব না। সম্ভবও নয়। আমি আবারও ম্যাসেজ পাঠালাম,
----" সমস্যা কি? আবার টাকা পাঠালেন কেন আমার নাম্বারে? টাকা বেশি হয়ে গিয়েছে আপনার? টাকা বেশি হয়ে গেলে নিজের গার্লফ্রেন্ডকে দেন, আমাকে নয়।"
সাথে সাথেই ম্যাসেজ সীন করলেন শুভ্র ভাই কিন্তু রিপ্লাই দিলেন না। আমি উনার রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা করতে লাগলাম.... এক দুই তিন করে আধাঘন্টা পেরিয়ে গেলেও কাঙ্ক্ষিত রিপ্লাইটা পেলাম না। রাগ লাগল, মেজাজ খারাপ হলো, এক সময় কান্নাও পেলো কিন্তু কোনো সমাধান মিললো না। নির্ঘুম রাতটার একটা সময় এসে মনে হলো, ' এই পৃথিবীতে শুভ্র ভাইয়ের আত্মীয় হয়ে জন্মানোটাই ছিলো আমার সবচেয়ে বড় ভুল। সবচেয়ে বড় পাপ। এর থেকে বড় ভুল আমার জন্য আর কিছু হতে পারে না।' এই লোকটাকে আমি ভালোবাসি না আবার ঘৃণাও করতে পারি না। উনার প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায় কিন্তু জুতো ছুঁড়ে মারার ইচ্ছে বা সাহস জাগে না। উনার প্রতি আমার তীব্র শ্রদ্ধাবোধ কোনো কিছুর বিনিময়েই এক তিল পরিমাণ টলে না। উনার প্রতি আমার এই অবিচল শ্রদ্ধাবোধকে কেন্দ্র করেই উনাকে আমি নিজের মনেও গালি দিতে পারি না। একটাবারের জন্য 'তুই' বলে সম্বোধন করতে পারি না। উনি আমার মাঝে এমন একটি শুভ্রকে বপন করেছেন যাকে আমি চাইলেও উপড়ে ফেলতে পারি না। সে নিজের মতো গম্ভীর মুখভঙ্গি নিয়ে বসে থাকে। আমাকে দেখে আর আকাশ- পাতাল ভাবে, আমার হাজার ধিক্কারেও মুখ ফেরায় না। কয়েক মুহূর্তের জন্যও না।
_____________________
সকালের খাবারটা শেষ করে মাত্রই বিছানায় এসে বসেছি আমি। বিছানায় রাখা এডমিশনের বইটা উল্টেপাল্টে দেখছি আর নানান কথা ভাবছি। এমন সময় ফোন বাজলো। এদিক-সেদিক খুঁজে কম্বলের নিচ থেকে ফোনটা বের করতে করতে কল কেটে গেলো। দু'মিনিট পর আবারও বাজলো। আমি অনিচ্ছাসত্বেও ফোন রিসিভ করে কানে নিলাম। ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় বলে উঠলেন মামানি,
----" হ্যালো, রোদু বলছিস?"
----" হ্যাঁ মামানি। কেমন আছো?"
----" আমার কথা ছাড়। তোদের মধ্যে সব ঠিকঠাক আছে তো?"
আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
----" আমাদের মধ্যে মানে? কার কথা বলছ?"
----" তুই খুব ভালো করে জানিস কার কথা বলছি। আমার ছেলের পাগলামোর মাত্রা দেখেই বুঝতে পারছি কিছু একটা ঘটেছে। শুভ্র আমায় কিছুই বলবে না। তুুুই বল, কাহিনী কি?"
----" কোনো কাহিনী নেই মামানি।"
মামানি চিন্তিত গলায় বলল,
----" শুভ্রর কার্যকলাপ দেখে তো মনে হচ্ছে না যে কোনো কাহিনী নেই। সেদিন বাসায় এসে কোনো কথা নেই বার্তা নেই রুমের জিনিসপত্র ভেঙেছে। তারপর যখন মনে পড়েছে ওর বাবা অসুস্থ, বাসায় উচ্চশব্দ করা যাবে না তখন ভাঙচোর থামিয়ে থমথমে মুখ নিয়ে বসে থেকেছে। সেদিন আবার জ্বর শরীর নিয়ে কোন পুকুর থেকে সাঁতার টাতার কেটে এসেছে। রাগ উঠলে ছেলের মাথা ঠিক থাকে না। কারো কথা শুনে না। তবুও সাহস করে তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টাতে বললাম। কিন্তু ছেলের সেকি কান্ড! পোশাক না পাল্টিয়ে আরো দু'ঘন্টা ওয়াশরুমে শাওয়ার নিচে বসে থাকলো। রাগ দেখানোর জায়গা পাচ্ছে না বলে নিজের উপর ঢালছে। বল, এগুলো ভালো লাগে? কাল আবার কাঁচের ফুলদানিতে লাথি মেরে পা কেটে ফেলেছে। সকালে ওঠে দেখি ছেলের পায়ে ব্যান্ডেজ, চাদরে রক্ত লেগে আছে। অথচ আমাকে বলে নি পর্যন্ত। আমার এই রাগী ছেলেটাকে নিয়ে কি করি বল তো?"
আমি জবাব দিলাম না। বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো একটি দীর্ঘশ্বাস। মামানি একটু থেমে আবারও বললেন,
----" আজ সকালে ধরে-বেঁধে জিগ্যেস করেছি, কি হয়েছে? এইটুকু জিগ্যেস করেই যেন ফাঁদে পড়ে গিয়েছি আমি। ছেলে জোর গলায় বলে দিয়েছে, সে বিয়ে করতে চায় এবং বিয়ে করবে।"
মামানির কথায় চোখ বড় বড় হয়ে এলো আমার। নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু গলায় বললাম,
----" বিয়ে করতে চাইছে তো বিয়ে করিয়ে দাও, ধরে রেখেছে কে?"
মামানি হতাশ গলায় বললেন,
----" এটা বিয়ে করার সময় ওর? এখনও মাস্টার্সটাই শেষ হলো না। তবু, আজ বিকেলে যাব তোদের বাসায়। তোর মাকে বলে দেখবো কথাটা। কে জানে কেমন রিয়েকশন হবে তোর মায়ের।"
আমি আৎকে উঠে বললাম,
----" আমার মাকে বলবে মানে? কি বলবে?"
----" কি আবার? তোদের বিয়ের কথা।"
----" মানে কি? কি সব বলছ মামানি? আমি এখনও বাচ্চা একটা মেয়ে। তাছাড়া, তুমি সিওর শুভ্র ভাই আমার কথা বুঝিয়েছেন?"
মামানি অবাক হয়ে বললেন,
----" বুঝাবে কি রে? ও তো তোর কথায় বললো।"
----" তোমার ছেলে পাগল হয়ে গিয়েছে মামানি। উনার সাথে তুমিও পাগল হয়ে যেও না প্লিজ। উনার কথায় মাকে কিছু বলবে না তুমি, কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তাছাড়া, তোমার কথা মেনে নিয়ে উনার থেকে দূরে সরে এসেছি আমি। এখন এসব অদ্ভুত প্রস্তাবের প্রশ্নই আসে না।"
আমার কথায় বিস্মিত হলেন মামানি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
----" নির্ঘাত আবারও ঝামেলা বাঁধিয়েছিস দু'জনে, আমি প্রথমেই ধারণা করেছিলাম। শোন, কেলেঙ্কারি হলেও কিছু করার নেই। তোর মাকে বলবি আজ বিকেলে তোকে দেখতে আসছে। শুভ্র ডিরেক্ট বলে দিয়েছে, আজ বিকেলের মধ্যে তোর মায়ের সাথে কথা না বললে সে বাসায় থাকবে না, চট্টগ্রাম চলে যাবে।"
আমি বিরক্ত আর উদ্বেগ নিয়ে বললাম,
----" প্লিজ মামানি। এসব মজা ফজা ভাল্লাগছে না আমার। তুমি অবশ্যই আমাদের বাসায় আসবে না আর মাকে এই বিষয়ে কিছু বলবেও না।"
----" শুভ্র মানবে না। জানিস তো ও কেমন...."
আমি রাগ নিয়ে বললাম,
----" দাঁড়াও আমি আসছি তোমাদের বাসায়। তোমার ছেলের ঢং দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি আমি। উনাকে জাস্ট খুন করে ফেলবো আজ। সবকিছু উনার ইচ্ছেমতো হতে হবে কেন? এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? ফাজলামোর একটা লিমিট আছে।"
আমার কথার মাঝেই উৎসাহী গলায় বলে উঠলেন মামানি,
----" শাড়ি পড়ে আসিস রোদু।"
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
----" কেন? শাড়ি পড়ব কেন?"
----" শাড়ি পড়লে তোকে সুন্দর দেখায়, তাই বললাম। দেখা গেল শুভ্র তোকে দেখেই রাগ ভুলে গেল।"
আমি তেঁতে উঠে বললাম,
----" মামানি! তুমি মাঝে মাঝে তোমার ছেলের থেকেও অদ্ভুত সব কথা বলো। তোমার ধারণা আমি উনার রাগ ভুলাতে যাচ্ছি? কক্ষনো না। আমি তোমার ছেলেকে খুন করতে যাচ্ছি, খুন। সো, বি রেডি।"
কল কেটে ওড়নাটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম আমি। বসার ঘর অতিক্রম করতে করতে রান্নাঘর উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
----" আম্মু? আমি মামুর বাসায় যাচ্ছি। মামানি ফোন দিয়েছিলো। একটু পরেই ফিরে আসব।"
আমাদের বাসা থেকে শুভ্র ভাইদের বাসার দূরত্ব ১০/১৫ মিনিট। আমি উল্কার বেগে মামুর বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। মামানি দরজাটা খুলতেই প্রথম প্রশ্নটা করলাম,
----" তোমার ছেলে কই?"
মামানি দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে হাসলেন। বললেন,
----" একদম রৌদ্রমূর্তি! তোকে দিয়েই হবে। আমার ছেলে রুমেই আছে, বেচারার জ্বর।"
আমি শুভ্র ভাইয়ের রুমের দিকে যেতে যেতে বললাম,
----" একদম বেচারা বলবে না। পুরো দুনিয়া বেচারা হয়ে গেলেও তোমার ছেলে বেচারা হতে পারে না।"
মামানি হাসলেন। আমি শুভ্র ভাইয়ের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিলাম। শুভ্র ভাই বিছানায় বসে ফোন ঘাটছিলেন। আমি দরজায় ধুমধাম শব্দ করে বললাম,
----" আসতে পারি?"
শুভ্র ভাই চোখ তুলে তাকালেন। একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে পায়ের দিকে তাকালেন। তারপর আবারও আমার মুখের দিকে তাকালেন কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না। আমি আবারও বললাম,
----" আসতে পারি?"
শুভ্র ভাই এবারও উত্তর দিলেন না। মুহূর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আমার। আমি চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
----" মামানি? দেখো তোমার ছেলে কেমন করছে।"
মামানি তাড়াহুড়ো করে এদিকে এসে অবাক হয়ে বললেন,
----" তুই এখনও দরজায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন?"
এবার আমি শুভ্র ভাইয়ের ট্রিক ইউজ করে বললাম,
----" তোমার ছেলে আমায় ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না। বলছে, আমার মতো ফাউল মেয়ে তার ঘরে পা রাখলে তার ঘর নাকি অপবিত্র হয়ে যাবে।"
মামানি এবার চূড়ান্ত অবাক হলেন। বিস্ময় নিয়ে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালেন। বললেন,
----" সত্যি? তুই এমনটা বলতে পারিস, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।"
শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ গম্ভীর চোখে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কারো কথার জবাব না দিয়ে বারান্দার দিকে চলে গেলেন। মামানি আর আমি একে অপরের দিকে তাকালাম। মামানি ফিসফিস করে বললেন,
----" ছেলের ভাবভঙ্গি দেখে সুবিধার মনে হচ্ছে না। একটু বেশিই শান্ত লাগছে। একটু সাবধানে কথা বলিস, মা।"
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে রুমে ঢুকে গেলাম। সেইদিন মনে মনে করা 'উনার ঘরে পা রাখবো না' প্রতিজ্ঞাটা ভেস্তে গেলো। সরাসরি বারান্দার দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। তেজ নিয়ে বললাম,
----" কি সমস্যা? এমন ভব ধরার কারণ কি?"
উনি ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালেন। উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে নিতেই উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। উনার টি-শার্ট খামচে ধরে ধারালো গলায় বললাম,
----" খবরদার নড়বেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। আমার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকবেন।"
উনি দাঁড়িয়ে রইলেন। উনার নতুন ঢং দেখে মেজাজটা এবার চরমে উঠলো আমার। চড়া গলায় বললাম,
----" কি সমস্যা? কথা বলছেন না কেন? নাকি প্রেমিকা ছাড়া অন্যকারো সাথে কথা বলতে মানা আছে? এতোই যখন প্রেমিকাভীতি তখন এসব ঢং এর মানে কি? ফ্রেন্ডদের কাছে গেয়ে বেড়াচ্ছেন তাসনিম আপনার প্রথম ভালোবাসা। তাসনিম ছাড়া আপনার এই পৃথিবীটা পৃথিবী না মঙ্গল গ্রহ, খুবই ভালো কথা। থাকুন আপনার তাসনিমকে নিয়ে, আমাকে খোঁচাচ্ছেন কেন? আপনার বন্ধু এসে আমাকে অপমান করলো, আমার গায়ে থার্ড পার্সোনের তাকমা লাগিয়ে দিলো, আপনি আপনার সো কল্ড ফার্স্ট লাভের সামনে আমায় অপমান করলেন... এভ্রিথিং ইজ ফাইন। মেনে নিয়েছি আমি। সরে দাঁড়িয়েছি। তবু আপনার মন মানছে না। আমাকে শান্তিতে থাকতে দেওয়াটা আপনার পোষাবে কেন? পোষাবে না তো। সত্যি করে বলুন তো, আমি একদিন শান্তিতে ঘুমালে আপনার শান্তি বিনষ্ট হয়ে যায়, তাই না?"
উনি কপাল কুঁচকে তাকালেন। বললেন,
-----" আস্তে কথা বল পাশের ঘরে বাবা আছেন। আর যা বলবি স্পষ্ট বল। আমার ফ্রেন্ড তোকে অপমান করেছে, থার্ড পার্সোন, প্রথম ভালোবাসা এগুলোর মানে কি? কি বলতে চাইছিস তুই?"
আমি রাগে ফুঁসে ওঠে বললাম,
----" কি বলছি মানে? আপনি বুঝতে পারছেন না? ন্যাকা সাজছেন? সাজবেনই না বা কেন? আজকাল নতুন প্রেমিকা যেহেতু জুটে গিয়েছে এসব ছোটখাটো ব্যাপার মনে থাকবে নাকি আপনার? আপনার তো রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রেমিকার সাথে করা ফোনালাপের কথা মনে থাকবে। কিভাবে ক্রিকেট খেলার নাম করে প্রেমিকার সাথে পার্কে ঘুরে বেড়ানো যাবে, ফুসকা খাওয়া যাবে সেগুলো মনে থাকবে, তাই না?"
শুভ্র ভাই বিরক্ত গলায় বললেন,
----" আজাইরা কথা-বার্তা আমার সাথে করতে আসবি না। কিসের ফোনালাপ? কি সব বলছিস তুই?"
----" ওহহো! এখনই ভুলে গিয়েছেন? সেদিন রাতের বেলা ঘন্টার পর ঘন্টা কার সাথে কথা বলছিলেন আপনি? আর তাসনিম আপু আপনার ওয়াশরুমে কি করছিলো? আর পার্কে বসে ফুসকাটাই বা কে খাচ্ছিলো? আমাকে বলদ মনে হয় আপনার?"
আমার কথার মাঝেই শুভ্র ভাইয়ের ফোন বাজলো। স্ক্রিনে তাসনিম নামটা দেখেই জ্বলে উঠলাম আমি। শুভ্র ভাইয়ের হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে কানে নিলাম,
----" সমস্যাটা কি আপনার? ফোন দিচ্ছেন কেন? ছ্যাঁচড়ামোর যে একটা লিমিট থাকে, তা জানেন? ডাক্তার মানুষ হয়েও কার্টিসি শিখেন নি? কারো লাইফে জোরজবরদস্তি ঢুকে পড়াটা কেমন ভদ্রতা? বেয়াদব মহিলা!"
কথাটুকু বলেই ফোনটা ছুঁড়ে ফেললাম আমি। ফোনটা আমার থেকে দু-তিন হাত দূরে কার্পেটের ওপর গিয়ে পড়লো। ফোনটা ছুঁড়ে ফেলার পর বুঝতে পারলাম, রাগের মাথায় ব্যাপক বড় ভুল করে ফেলেছি। শুভ্র ভাইয়ের ফোনটা নির্ঘাত ভেঙে গুড়োগুড়ো হয়েছে। এবার আর নিস্তার নেই। দুই-তিনটা চড় তো কনফার্ম। আমি মনে মনে চড় খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। শুভ্র ভাই দুঃখী দুঃখী গলায় বললেন,
----" শিট! ফোনটা বোধ হয় গেছে। আশ্চর্য তো! এই বেয়াদব মেয়ে, ফোন ছুঁড়ে মারলি কেন? আমি রাগ হলে ফোন ছুঁড়ে মারি বলে কি তোরও মারতে হবে? আমাকে কপি করছিস, ফাজিল!"
আমি থমথমে গলায় বললাম,
----" আপনাকে কপি করতে যাব কেন? রাগ লাগছিলো তাই ছুঁড়ে মেরেছি। ওই অসহ্যকর মেয়েটা আপনাকে কেন ফোন করেছে?"
শুভ্র ভাই ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকালেন। ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন,
----" রাগের মাথায় ছুঁড়ে ফেলেছিস বলে মাফ করে দিচ্ছি। শশুরের থেকে ফোনের টাকাটা যৌতুক নেবো, সমস্যা নাই। আর তাসনিম আমাকে কেন ফোন দিয়েছে সেটা তাকে জিগ্যেস করে জেনে নেওয়া যেতে পারে, জিগ্যেস করব?"
----" আপনি ফাজলামো করছেন আমার সাথে?"
----" না। করছি না। এতোক্ষণ তোকে ঠাটিয়ে কয়েকটা চড় মারতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু এখন আর মারতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে, তোর গায়ে হাত তোলা আমার দ্বারা সম্ভব না। এমন কেন মনে হচ্ছে বল তো?"
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
----" আপনার জ্বরটা হয়তো বাড়ছে।"
শুভ্র ভাই বিছানায় গিয়ে বসলেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
----" নুপুর খুলেছিস কেন?"
----" আপনি খেলার নাম করে তাসনিম আপুর সাথে দেখা করতে কেন গিয়েছিলেন? সত্যটা বলে গেলে তো কেউ আটকাতো না। তাহলে এই লুকোচুরি কেন?"
শুভ্র ভাই অবাক হয়ে বললেন,
----" আমি মোটেও তাসনিমের সাথে দেখা করতে যাই নি। তাছাড়া, আমি সব রেখে ওর সাথে দেখা করতে যাবই বা কেন? তোর মাথায় হঠাৎ এমন অদ্ভুত বিষয় কেন এলো, বল তো? আমি মাঠে ক্রিকেট খেলছিলাম, তাসনিম হয়তো ওই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলো। আমাকে দেখতে পেয়ে ডাকলো, আমি গেলাম। তারপর বলল, কিছু কথা আছে। পার্কে বসে বললে ভালো হয়। পার্ক আর মাঠ পাশাপাশি বলে মানা করার কোনো কারণও খুঁজে পেলাম না। পার্কে তো আর এমনি এমনি বসে থাকা যায় না। তাই ওকে জিগ্যেস করলাম ফুসকা খাবে কি না। ব্যস এটুকুই। আর তুই সেটাকে টেনেটুনে কত কি বানিয়ে ফেললি। এজন্যই বলে মেয়েদের 'ক' বললে কলকাতা বুঝে।"
আমি মুখ কালো করে বললাম,
----" এটুকুই! তাহলে সেটা তখন কেন বললেন না?"
----" তখন কখন? আমি তো আগে থেকেই জানি মহারাণী ক্ষেপে ঢোল হয়ে আছেন। তাকে ঘাটতে গেলেই বিপত্তি। পাব্লিক প্লেসে মানসম্মান কিছু থাকবে না।"
আমার রাগ ততক্ষণে নিভে এসেছে। আমি গুটি গুটি পায়ে শুভ্র ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলাম। মৃদু গলায় বললাম,
----" সেদিন তাসনিম আপু আপনার ওয়াশরুমে কেন ছিলো? এই বাসায় কি আর কোনো ওয়াশরুম নেই?"
----" আমরা তো কথা বলছিলাম রে বাবা।'
এটুকু বলে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন উনি। তারপর মৃদু গলায় বললেন,
----" বাবা ভালো নেই রোদ। বাবার হাত-পা নাড়াচাড়া করতে সমস্যা হচ্ছে। স্টোকের পর অনেকেই প্যারালাইসড হয়ে যায়। আমি বাবাকে প্যারালাইসড অবস্থায় দেখতে চাই না। আম্মুকে তো জানিস? পুরাই বাচ্চাদের মতো বিহেভিয়ার আম্মুর। আম্মুকে এই নিয়ে কিছু বললে দেখা যেত বাবার টেনশনে আম্মুও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যেহেতু তাসনিম ডাক্তার তাই তাসনিমের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সারা বাড়ি তখন মেহমানে ভরপুর। কথা বলার জন্য আমার রুম ছাড়া আর কোনো জায়গার কথা মাথাতেই এলো না। তাই..."
এটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শুভ্র ভাই। আমার বুকে চিনচিনে একটা ব্যথা খেলে গেল। নিজেকে কি ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগলো আমার। শুভ্র ভাই হঠাৎই ফ্লোরে বসে পড়লেন। আমার হাতটা নিজের হাতে টেনে নিয়ে নিলেন। উনার গা গরম। শরীরটা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। উনার তপ্ত হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলাম আমি। উনি বললেন,
----" তুই এতো বাচ্চা কেন বল তো? আরেকটু বড় হলে কি হতো? একটু তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যা তো। এই এতো এতো সমস্যা, টেনশন আর নিজের মধ্যে আটকে রাখতে পারি না আমি। কাউকে বলতে ইচ্ছে করে। কোনো সমাধানের আশায় নয় শুধু নিজেকে হালকা করার জন্য হলেও বলতে ইচ্ছে করে। আম্মু নিজেই তো অসুস্থ, উনাকে এসব বলা যায় না। বাবাকে তো আরো বলা যায় না। আমার তো আর কেউ নেই। একটা নিজের মানুষ প্রয়োজন আমার। কবে বড় হবি তুই?"
আমি নরম গলায় বললাম,
----" সরি।"
উনি হাসলেন। ফ্লোর থেকে উঠে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। চোখ দুটো বোজে নিয়ে বললেন,
----" তুই যেদিন তাসনিমের সাথে কথা বলেছিলি সেদিনই শেষ। এরপর আর কখনও তাসনিমের সাথে ফোনে কথা হয় নি আমার।"
আমি অবাক হয়ে বললাম,
----" তাহলে সেদিন রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার সাথে কথা বলছিলেন?"
উনি চোখ মেলে তাকালেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
----" কোনদিন রাতে?"
----" ওইযে যেদিন তাসনিম আপু এখানে ডিনার করলেন সেদিন।"
শুভ্র ভাই ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
----" তুই আসলেই একটা বলদ। তোকে নিয়ম করে দিনে তিনবার চড়ানো উচিত। ওটা আমার স্টুডেন্ট ছিলো। যার জন্য চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম আমি। সে এডমিশনের জন্য আমার কাছেই পড়তে চায়। কিন্তু এটা আপাতত সম্ভব নয়, এসবই বুঝাচ্ছিলাম।"
আমি বিস্ময়ে 'হা' হয়ে বসে রইলাম। শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফিচেল গলায় বললেন,
----" খুব জ্বলছিল বুঝি? তোর এতো জ্বলাজ্বলির কারণ কি? আমার প্রেমে টেমে পড়ে যাস নি তো আবার?"
আমি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
----" ছি! দুনিয়ায় কি ছেলের অভাব হয়েছে নাকি যে আপনার প্রেমে পড়তে হবে? এসব দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করুন।"
উনি নিঃশব্দে হাসলেন। দুর্বল গলায় বললেন,
----" এই তাসনিম নামক পোকাটা তোর মাথায় কিভাবে ঢুকলো বল তো? আরেকটু হলে তো আমার মতো ভার্জিন ছেলেকে তাসনিমের বাচ্চার বাপ হওয়ার অপবাদ লাগিয়ে দিতি। তোর জন্য কিছুই অসম্ভব নয়।"
আমি কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে তুষার ভাইয়ার কথাগুলো খুলে বললাম। কথাগুলো শোনার সাথে সাথেই উঠে বসলেন শুভ্র ভাই। গম্ভীর গলায় বললেন,
----" ফোনটা তুলে দেখ তো ব্যবহারযোগ্য আছে কি না।"
আমি ধীর পায়ে গিয়ে ফোনটা উঠালাম। স্ক্রিনের এককোণা ফেটে যাওয়া ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষতি হয় নি। শুভ্র ভাই ফোনটা হাতে নিয়েই বাঁকা হাসলেন। কাউকে ফোন লাগাতে লাগাতে বলল,
----" শশুরের যৌতুকের টাকা বেঁচে গেল দেখছি।"
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। ততক্ষণে ওপাশের মানুষটি ফোন রিসিভ করেছে। শুভ্র ভাই ছোট্ট করে বললেন,
----" তুই হলি জন্মগত বলদ। আমার সামনে আয় একবার তারপর তোর গার্লফ্রেন্ড তো দূরে থাক তোর মা তোকে চিনতে পারবে কিনা সেটাই ভাবনার বিষয়।আমার সংসার ভাসিয়ে দিয়ে শান্তিতে বসে আছিস ডাফার।"
এটুকু বলেই ফোন কাটলেন শুভ্র ভাই। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
----" আমার নুপুর আমায় ফেরত দিন, আমি বাসায় যাব।"
শুভ্র ভাই যেন আকাশ থেকে পড়লেন। নিষ্প্রভ গলায় বললেন,
----" নুপুর তো তাসনিম নিয়ে নিয়েছে। ওর নাকি ভীষণ পছন্দ হয়েছে।"
আমি তেজ নিয়ে বললাম,
----" আমার নুপুর তাসনিম আপু কেন নেবে?"
----" তুই তো ওকেই দিয়েছিস। কেউ জোর করে দিলে নেবে না?"
আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,
----" ভালো হচ্ছে না কিন্তু। আমি জানি নুপুর আপনার কাছেই আছে। দেন বলছি। নয়তো আমি মামানিকে বিচার দেব।"
শুভ্র ভাই হাই তুলতে তুলতে বললেন,
----" আরে বাবা, থাকলে তো দেব। তোর নুপুর আমি নিয়ে কি করব? আমি কি নুপুর পরি?"
----" আমি কিচ্ছু জানি না। আমার নুপুর আমার চাই মানে চাই।"
আমার কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন শুভ্র ভাই। পকেটে হাত ঢুকিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
----" আচ্ছা দেব। কিন্তু নুপুরের বদলে আমি কি পাব?"
আমি সন্দেহী গলায় বললাম,
----" কি চাই আপনার?"
উনি নিজের মুখটা ঝুঁকিয়ে এনে বললেন,
----" আমি?"
আমি মাথাটা খানিকটা পিছিয়ে নিয়ে বললাম,
----" হু।"
উনি অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বললেন,
----" বিশবার কানে ধরে উঠবস কর। প্রতিবার উঠবস করার সময় বলবি, রোদ পৃথিবীর নির্বোধ বালিকা। দি গ্রেট শুভ্রর উচিত রোদকে ক্ষমা করে দেওয়া।"
----" কিহ! জীবনেও এমনটা করব না আমি।"
----" তাহলে নুপুরের কথা ভুলে যা।"
আমি চোখ-মুখ ফুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলেই এক গোছা চুল টেনে ধরলেন। আমি ব্যথা পেয়ে আৎকে উঠলাম। শুভ্র ভাই আমার ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ালেন। চুলগুলোকে আরো একবার শক্ত হাতে টেনে দিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন। আমি শিউরে উঠতেই আমার ডান গালে আচমকাই পর পর দুটো আলতো চুমু দিলেন শুভ্র ভাই। ফিসফিস করে বললেন,
-----" শুভ্র সরি। মেন্টাল প্রেশারে ছিলাম তো, মাথার ঠিক ছিলো না। রোদপাখি কি এখনও রেগে আছে?"
উনার এহেন কাজে চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেলো আমার। সারা শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেল। আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই সুযোগে নিচে বসে পায়ে নুপুর পরালেন উনি। নুপুর পরানো শেষ করে মেঝের উপরই বসে পড়লেন। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফিচেল গলায় বললেন,
----" দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আরো চাই?"
এতোক্ষণে টনক নড়লো আমার। আমি একমুহূর্ত দেরী না করে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলাম। মনের মাঝে একটা প্রশ্নই উদয় হলো, ছি! লোকটা এতো অসভ্য কেন?
অগ্রহায়নের শেষের দিক। বাতাসে পৌষের ঠান্ডা স্পর্শ। স্পৃহাদের গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল দেবকাঞ্চন গাছের মাথা ভর্তি লাল রঙা ফুল। সামনের রাস্তার উপর ঝুঁকে পড়া ডালটা যেন বিনয়ে নত হওয়া আস্ত এক রূপকথা। বাড়ির ফটকের সরু পাকা রাস্তাটায় বিছানো দেবকাঞ্চন ফুলের রঙিন বিছানা। জুতোগুলো হাতে নিয়ে দেবকাঞ্চন ফুলের ওপর আলতো পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম আমি। চারদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ঝরে পড়া ফুলের ডগায় ডগায় স্নিগ্ধ শিশিরের ভীড় জমেছে। শিশির ভেজা নরম ফুলে খালি পা জুড়া রাখতেই অদ্ভূত ভালো লাগায় শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। স্পৃহা তাদের দোতালা বাড়িটার সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলো। একহাতে আমার ব্যাগ আর অন্যহাতে মুঠোফোনে প্রেমিকার কানে মিষ্টিবুলির ঝড় উঠাচ্ছিল।
' আজ কিন্তু তুই থেকে গেলেই পারতি রোদু। থেকে যা না প্লিজ।'
স্পৃহার কন্ঠে ফিরে তাকালাম আমি। ততক্ষণে মুঠোফোনটা কান থেকে নামিয়ে বারান্দা থেকে সরু রাস্তায় নেমে এসেছে স্পৃহা। আমি হালকা হেসে হাওয়ায় লাফিয়ে উঠে ঝুঁকে পড়া দেবকাঞ্চনের ডালটা ধরার চেষ্টা করলাম। দু'একটা ফুল মুঠোবদ্ধ করে নিয়ে কানের পাশে গুঁজলাম। খানিকটা রাজকীয় ভাব নিয়ে বললাম,
' হেই বিউটিফুল লেডি! বলো তো আমায় কেমন লাগছে?'
স্পৃহা নিরস গলায় বলল,
' একদম ভূতের মতো।'
আমি মুখ ভেঙিয়ে বারান্দার সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম। স্পৃহা আমার পাশে বসতে বসতে বলল,
' থেকে যা না প্লিজ। আজ বাবা বাড়ি নেই, রাতে অনেক মজা হবে। তাছাড়া, পড়াগুলোও কমপ্লিট করে ফেলব দু'জনে মিলে। প্লিজ প্লিজ।'
আমি সরু চোখে তাকিয়ে জারি দিয়ে বললাম,
' একটু আগে অপমান করে এখন থাকতে বলছিস? থাকব না আমি।'
স্পৃহা হেসে ফেলে বলল,
' যা! অপমান তুলে নিলাম। তোকে একদম অচীনপুরের রাজকন্যার মতো লাগছে। এই রূপের বাণে রাজকুমারের মৃত্যু আজ নিশ্চিত। '
আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম,
' একদম মজা করবি না আমার সাথে। এই ভাইয়াটা যে কেন এখনও আসছে না। একমাত্র ওর জন্য এই ম্যানহলের গার্লফ্রেন্ডের সাথে বসে পকপক করতে হচ্ছে।'
' এহ্ আমার বয়ফ্রেন্ড ম্যানহল হলে তোর জামাই হবে বুড়িগঙ্গা নদী। ইয়াক! এখনই গন্ধ আসছে নাকে।'
স্পৃহার উত্তরের প্রেক্ষিতে কিছু বলব তার আগেই চোখ কুঁচকাল স্পৃহা। গেইটের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল,
' রোদু? ওইটা শুভ্র ভাই না?'
স্পৃহার কথায় উঠে দাঁড়ালাম আমি। রাস্তার ওপাশে উঁকি দিয়ে কপাল কুঁচকালাম। স্পৃহা জামা ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়াল। রাস্তার দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,
' তোকেই নিতে এসেছে বোধহয়।'
আমি অবিশ্বাস্যের স্বরে বললাম,
' ধুর! আমাকে কেন নিতে আসবে? ভাইয়ার আসার কথা ছিলো তো। আর উনি...'
আমার কথার মাঝেই ফোন বাজল। বহু কসরতে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে কানে নিতেই ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলেন আম্মু,
' তুই নিচে নাম রোদু। শুভ্র স্পৃহাদের বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। জলদি নিচে নাম।'
আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
' আশ্চর্য! তোমার ভাইয়ের ছেলে স্পৃহার বাসার সামনে কি করে? তোমার নিজের ছেলে নাই? মেয়েকে নিতে অন্যের ছেলে ধার করে আনা কেন, শুনি?'
আম্মু অবাক হয়ে বলল,
' অন্যের ছেলে মানে কি? শুভ্র কি আমাদের পর? তোদের কাছে তো পর লাগবেই। ও তো আমার ভাইয়ের ছেলে। তোর ফুপ্পিদের ছেলে হলে না হতো তোদের নিজের মানুষ। আমার বাপের বাড়ির মানুষকে তোর বাবারও সহ্য হবে না, তোদেরও না।'
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
' উফ্ মা! তোমার ভাই, আমার ভাই স্লোগানটা বন্ধ করে আমার ভাইকে পাঠাও। আমি শুভ্র ভাইয়ের সাথে যাব না, ব্যস।'
' কেন আসবি না? শুভ্র তোকে করেছেটা কি? সে তোর সাথে কোনোরকম মিসবিহেভ করেছে?'
আমি আগলা গলায় বললাম,
' শুভ্র ভাই সারা জীবনই আমার সাথে মিসবিহেভ করে মা। এটা নতুন কিছু না। উনার ধারণা পৃথিবীতে সবচেয়ে ফাজিল আর বেয়াদব মেয়ে হলাম আমি। আমাকে দিনরাত থাপড়াইয়া ঠিক করা না হলে অদূর ভবিষ্যতে সাগরে ভেসে যাব আমি।'
আম্মু স্বাভাবিক গলায় বলল,
' খারাপ তো কিছু বলে নি। তুই আসলেই বেয়াদব হচ্ছিস দিন দিন। এখন এসব আশেপাশের কথা বন্ধ করে শুভ্র নিচে দাঁড়িয়ে আছে নিচে নাম।'
' ভাইয়াকে পাঠালে কি হতো?'
' তোর ভাইয়ার মাথা ব্যাথা। টেবলেট খেয়ে দরজায় খিল দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আলিফ বলল শুভ্র সার্কিট হাউজের আশেপাশেই টিউশনি করাতে গিয়েছে। তাই ওকে ফোন দিয়ে আসার সময় তোকে সাথে আনতে বললাম। ছেলেটা কি লক্ষ্মী আর তোরা ওকে পছন্দ করিস না।'
আমি ফোন কাটলাম। আম্মুর পরের লাইনগুলো শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছে আমার। সেই কথাগুলো এখন শুধু বিরক্ত নয়। বিরক্তর থেকেও অনেক উপরের কিছু বলে বোধ হয়। আমি চোখ-মুখ কুঁচকে স্পৃহার হাত থেকে ব্যাগটা নিতেই হাসি হাসিমুখে বলে উঠল স্পৃহা,
' এত্তো কিউট একটা কাজিনের সাথে যেতে কারো প্রবলেম হতে পারে জানা ছিলো না। যদিও শুভ্র ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড আছে তবুও রাস্তার মানুষ তো আর জানে না।'
কথাটা বলে চোখ টিপলো স্পৃহা। আমি সরু চোখে ওর দিকে তাকালাম। মুখ ঝামটি দিয়ে বললাম,
' অশ্লীল।'
স্পৃহা হেসে ফেলল। দু'জনেই বারান্দা থেকে নেমে সরু রাস্তা ধরে হাঁটা দিলাম। গেইট পেরিয়ে স্পৃহাকে বিদায় দিয়ে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। চোখে চোখ পড়ার পরও দৃষ্টি ফেরালেন না শুভ্র ভাই। কয়েক সেকেন্ড পর হালকা কেশে অন্যদিকে তাকালেন। আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটা দিলাম। শুভ্র ভাই আমার পেছন পেছন হাঁটছেন। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর রাস্তার পাশের ফার্নিচারের দোকানের গ্লাসে শুভ্র ভাইকে চোখ পড়ল। উনি হাঁটার তালে তালে নিমগ্ন চিত্তে ফোন চাপছেন। ছাই রঙের শার্ট আর অফ হোয়াইট জিন্সে সুন্দর লাগছে উনাকে। ঘড়ি পরা বামহাতটা দিয়ে যখন কপালের চুল সরিয়ে অসচেতন চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন তখন এই সুন্দর লাগাটা যেন বহুগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফার্নিচারের দোকানটা পাশ কাটিয়ে খানিকটা এগুতেই একটা টং দোকান চোখে পড়ল। সেই টং দোকানে কয়েকজন ছেলে দল বেঁধে চা খাচ্ছে। আরেকটু এগুতেই ছেলেদের কয়েকটাকে চিনতে পারলাম আমি। এই ছেলেগুলো হাইস্কুলে থাকতে আমাদের সাথেই ব্যাচে পড়ত। প্রত্যেকটা মেয়েকে ভাবি, বউ হেনতেন নাম দিয়ে প্রাইভেটের পরিবেশের ইন্না-লিল্লাহ করে ছাড়ত। আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত পা চালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। কোনো একভাবে ছেলেগুলোর চোখে পড়ে গেলাম আমি। সাথে সাথেই নিজেদের মধ্যে ফুসফাস করে হৈহৈ করে উঠল ওরা। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ালেন শুভ্র ভাই। ফোন স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে তাকালেন। চায়ের স্টলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
' এই তুই সাকিব না? তোর পাশেরটা কে? জিহাদ, আসাদ?'
ছেলেগুলো মুহূর্তেই নীরব হয়ে গেল। সাকিব নামক ছেলেটি মাথা চুলকে বলল,
' ভাইয়া, কই গেছিলেন?'
শুভ্র ভাই ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। ডান চোখের ভ্রু টা উঁচু করে বললেন,
' ছোয়াতকে পড়াতে গিয়েছিলাম। তোরা এই সময়ে এখানে কি করছিস? সমস্যা কি?'
তাদের মধ্যে থেকে একজন মুখ কাঁচুমাচু করে বলল,
' কোনো সমস্যা নাই ভাই। আসলে পড়তে পড়তে মাথা জ্যাম হয়ে গিয়েছিল তাই মামার দোকানের চা খাইতে আসছি।'
শুভ্র ভাই মাথা দুলিয়ে বললেন,
' গুড গুড। এভাবে জ্যাম লাগতে থাকলে এডমিশনও সাকসেসফুলি জ্যাম লাগবে ইনশাআল্লাহ। এই সাকিব? আংকেলকে বলে দিস নেক্সট উইক থেকে তোদের আর পড়াচ্ছি না।'
সাকিব ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
' কেন ভাই?'
শুভ্র ভাইয়ের সহজ উত্তর,
' পড়াতে ইচ্ছে করছে না তাই।'
' ভাই আব্বায় বিশ্বাস করবো না। নির্ঘাত ভাববো কিছু একটা পুন্টামি করছি।'
শুভ্র ভাই আমাকে ইশারা করে বললেন,
' রাস্তায় মেয়েদের সাথে ফাজলামো করা কি খুব ভালো কাজ? আংকেলকে বলবি আমায় ফোন দিতে।'
' সরি ভাই। রোদরে নিয়ে কিছু বলি নাই, কসম। আমরা তো গল্প করতেছিলাম। আব্বারে কিছু বইলেন না। সরি ভাই। রোদ বইন সরি, হ্যাঁ?'
শুভ্র ভাই একটা রিকশা ডাকলেন। আমি রিকশায় উঠে বসতেই পাশে এসে বসলেন উনি। সাকিব গলা উঁচু করে বলল,
' সোমবারে পড়াতে আসবেন না ভাই?'
শুভ্র ভাই পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বললেন,
' তোদের ব্যাচ ক্যান্সেল। মামা চলো।'
রিকশা ছুটলো। সাকিবের চোখ-মুখের অসহায় ভাব দেখে এতোদিনের জমিয়ে রাখা ক্ষোভে কিছুটা শীতল পরশ খেলে গেলো। তবে, মনের আনন্দটা বেশিক্ষণ টিকলো না। হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম, চারপাশের মানুষগুলো কেমন অদ্ভুত চোখে দেখছে আমায়। একটা ছেলে তো রীতিমতো বাইক থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। আমার শরীরে রাজ্যের অস্বস্তি ভর করলো। হাত বাড়িয়ে কানের পাশে গুঁজে রাখা ফুলগুলো খুলে আনলাম। তাতেও খুব একটা সুবিধা হলো না। তাকিয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা কোনো অংশে কমছে না। আমি আড়চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকাল। উনি গভীর মনোযোগে ফোন ঘাটছেন। আমি মৃদু গলায় ডাকলাম,
'শুভ্র ভাই? শুভ্র ভাই?'
শুভ্র ভাই ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই ক্ষীণ গলায় জবাব দিলেন,
' হু।'
'আমার দিকে তাকান।'
শুভ্র ভাই কপাল কুঁচকালেন। আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,
' কেন? তোর দিকে তাকাতে হবে কেন?'
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
' তাকাতে বলেছি, তাকাবেন। ব্যস। এতো প্রশ্ন করছেন কেন?'
শুভ্র ভাই আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে বললেন,
' তুই বললেই তাকাতে হবে? আমার চোখকে কি তুই টেক্স দিস, তাকাতে বলবি আর ফট করে তাকিয়ে ফেলব? বাপের মতো সুবিধাভোগী একটা।'
আমি রাগে চোখ-মুখ ফুলিয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলাম। মাথায় গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন ঘুরছে, এই মুহুর্তে এই লোকটাকে রিকশা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে কি সে মারা যাবে? মারা না গেলে ধাক্কা দেওয়া যেতে পারে। আমি শক্ত গলায় বললাম,
'খবরদার আব্বুকে নিয়ে উল্টোপাল্টা কিছু বলেছেন তো। আর আমি মোটেও আব্বুর মতো হই নি। সবাই বলে, আমি আম্মুর মতো হয়েছি।'
আমার কথায় শুভ্র ভাই হেসে কুটিকুটি। উনার হাসির ধামক দেখে মনে হচ্ছে, হাসতে হাসতে রিকশা থেকে গড়িয়ে পড়লেও তার বিশেষ একটা আফসোস থাকবে না। শুভ্র ভাই কোনোরকম হাসি থামিয়ে বললেন,
-' তুই ফুপ্পির মতো? ভেরি ফানি! শোন, আমার ফুপ্পি হলো আমাদের ময়মনসিংহের রক্ত, খাঁটি সোনা। আমার ফুপ্পির মতো রূপবতী আর গুণবতী হতে চাইলে তোকে আরো দশবার জন্মাতে হবে। তবুও হতে পারবি কিনা সন্দেহ। তোর জন্য তোর বাপই পার্ফেক্ট। দুইটাই সেইম সেইম.... এক নাম্বারের ধান্দাবাজ।'
আমার রাগটা এবার আকাশ ছুঁলো। আমাকে যেনতেন আব্বুকে ধান্দাবাজ বলার অপরাধে এই বিরক্তকর লোকটিকে রিকশা থেকে ফেলা দেওয়া যেতেই পারে। শুধু রিকশা থেকে ফেলা দেওয়া নয় এর থেকেও ভয়ানক কোনো শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। আমি থমথমে কন্ঠে বললাম,
' আপনি তাকাবেন?'
শুভ্র ভাই হুট করেই তাকালেন। আমার চোখে চোখ রেখে নির্ণিমেষ তাকিয়ে রইলেন। রিকশার সরু সিটে পাশাপাশি বসে আছি দুজনে। সন্ধ্যার হলদেটে আলো এসে পড়ছে উনার গালে, ঠোঁটে। রিকশার ঝাঁকিতে উনার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো অবাধ্য হয়ে ছুটোছুটি করছে। ভারী পাঁপড়িতে ঢাকা চোখদুটোতে কোনো এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য হানা দিয়েছে। আমার চোখে মুগ্ধতা। ঘোর লাগা চোখদুটোতে পলক পড়ার বিরতিটাও যেন সইছে না। শুভ্র ভাই ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
'তাকালাম। তারপর?'
উনার কথায় চোখদুটোতে পলক পড়ল। অদ্ভুত ঘোরটা ভেঙে টুকরো হলো। কন্ঠটা আরো খানিকটা নিচু করে প্রশ্ন ছুঁড়লাম,
' এভ্রিথিং ইজ ওকে?'
শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন,
' মানে?'
' মানে, আমার সব ঠিকঠাক আছে?'
' তোর সব ঠিকঠাক আছে, মানে? ঠাডায় একটা চড় লাগাবো বেয়াদব। বাপের মতো ঘুরাই পেঁচাই কথা বলিস কেন? কি বলতে চাস ডিরেক্ট বল। বাপ মেয়ে এক টাইপ, সুযোগ পেলেই আমার মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার পায়তারা করিস। তোদের তো পৃথিবীতে থাকতে দেওয়াটাই মহাপাপ। তোরা হলি পৃথিবীর বাইরের মানুষ। ঘুরন্তি মানব। তোদের থাকতে হবে পৃথিবীর বাইরে। মহাকাশে ঝুলাঝুলি করাই তোদের কাজ।'
আমি দাঁত কিরমির করে উনার দিকে তাকালাম। চোখে আস্ত একটা আগ্নেয়গিরি পুরে নিয়ে শক্ত গলায় বললাম,
' আপনি যে একটা অসহ্য ধরনের মানুষ তা কি আপনি জানেন? কথায় কথায় আমার আব্বুকে না টানলে চলছে না আপনার?'
শুভ্র ভাই যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,
' আমি কথায় কথায় তোর বাপকে টানি? আমি? তোর বাপ কি দেশের প্রেসিডেন্ট নাকি যে তাকে নিয়ে নাচানাচি, টানাটানি করতে হবে? আমি কথা বলা শুরু করলে তোর ধান্ধাবাজ বাপ অটোমেটিকলি আমার এক্সামপলে চলে আসে। তাকে নিয়ে টানাটানি করার সময় আছে নাকি আমার?'
আমি চোখ-মুখ কুঁচকে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। কন্ঠে কম্পিত রাগ নিয়ে বললাম,
' হাহ্! আরেকবার যদি 'তোর বাপ' 'তোর বাপ' করে আমার আব্বুকে অপমান করার চেষ্টা করেন তাহলে আপনাকে একটা ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফেলে দেব। তারপর নায়ক উমর সানির মতো স্মৃতি হারিয়ে সারাজীবন 'আমেনার মা' 'আমেনার মা' বলে চেঁচাতে চেঁচাতেই জীবন কেটে যাবে। ল্যাংড়া ট্যাংরাও হয়ে যেতে পারেন। হু নোস?'
শুভ্র ভাই চোখ বড় বড় করে তাকালেন। অত্যন্ত দুঃখী কন্ঠে বললেন,
' তুই তো সাংঘাতিক ধরনের ফাজিল মেয়ে। দি শুভ্র অর্থাৎ এত্তো এত্তো মেয়ের ক্রাশকে তুই রিকশা থেকে ফেলে ল্যাংড়া বানিয়ে দিতে চাইছিস? নির্লজ্জর মতো ল্যাংড়ার সাথে আবার ট্যাংরাও লাগিয়ে দিচ্ছিস! কি সাংঘাতিক!'
আমি খানিকটা ভাব নিয়ে বললাম,
' এখানে সাংঘাতিকের কিছু নেই শুভ্র ভাই। আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়াটা কখনোই সাংঘাতিকের পর্যায়ে পৌঁছায় না। আর কি যেন বলছিলেন? ক্রাশ? হাহ্! এটা নির্ঘাত আপনার দিবাস্বপ্ন শুভ্র ভাই। কোনো মেয়ের মাথায় সামান্যতম ঘিলু থাকলেও সে আপনার উপর ক্রাশ খাবে না। তবে পাবনায় এডমিটকৃত মেয়েরা খেতেই পারে। আপনার যা অবস্থা, কিছুই অসম্ভব না।'
শুভ্র ভাই বাঁকা হেসে বললেন,
' এইতো আবারও প্রমাণ দিয়ে দিলি তোর বাপের মতো তোর বুদ্ধিও হাঁটুতে। নয়তো এমন উদ্ভট কথা কখনোই বলতি না তুই। আমার আশেপাশের সব মেয়েরা যে আমার ওপর ফ্ল্যাট তা তো দেখেই বুঝা যায়। তবে, হাঁটুতে মস্তিষ্ক নিয়ে ঘুরা মানুষের পক্ষে তা বোঝা খানিকটা দুষ্কর।'
আমি চোখে- মুখে থমথমে ভাব নিয়ে বসে রইলাম। উনি আবারও আমাকে অপমান করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। চালাচ্ছেন বলে ভুল হবে ইতোমধ্যে অপমান করে ফেলেছেন। আমি কিছুক্ষণ আকাশ-পাতাল চিন্তা ভাবনা করে বললাম,
' আপনার ধারণা আপনার আশেপাশের সব মেয়েরা আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে?'
শুভ্র ভাই ভারি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন,
' অবশ্যই।'
' কই আপুর মাঝেও তো আপনার উপর হাবুডুবু খাওয়া টাইপ কোনো আচরণ চোখে পড়ল না। তাহলে আপনার প্রেমে আসলে পড়লটা কে? আমি তো দূর-দূরান্তে প্রেমে ডোবা কাউকে দেখছি না শুভ্র ভাই।'
' নাউজুবিল্লাহ। রুহি আমার বোন হয়। আমার একমাত্র ফুপ্পির একমাত্র মেয়ে। ও আমার প্রেমে হাবুডুবু কেন খাবে? তোর চিন্তা-ভাবনা যে এতোটা কলুষিত তা আমার ধারণাতেই ছিলো না।'
উনার কথায় মুখটা অটোমেটিক 'হা' হয়ে গেলো আমার। চোখ পিটপিট করে তাকালাম। জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললাম,
' একমাত্র! তো? আমি কে? আমি কি আকাশ থেকে টুপ করে পড়েছি নাকি?'
শুভ্র ভাই স্বাভাবিক মুখভঙ্গি নিয়ে বললেন,
' আকাশ থেকে টুপ করে কেন পড়বি? তোকে যে নদীর পাড় থেকে কুড়িয়ে আনা হয়েছিলো, বলেছিলাম না? আর যায় হোক, কোনো কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েকে তো আর বোনের পরিচয় দেওয়া যায় না। দুনিয়া উল্টো গেলেও তুই আমার বোনের যোগ্যতা অর্জন করতে পারবি না। নো, নেভার।'
শুভ্র ভাইয়ের কথার মাঝেই কিছু প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে ক্ষান্ত হলাম আমি। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি ছেলে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজন তো হাত দিয়ে ইশারাও করছে। ওদের এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আগের অস্বস্তিটা যেন আবারও দানা বাঁধলো। আমি মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম,
' মেয়েদের মতো ঝগড়া না করে আমার সব ঠিক আছে কিনা দেখুন তো।'
শুভ্র ভাই আমার কথাটা বুঝতে না পেরে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,
' কি দেখবো?'
' আমার ড্রেসআপ সব ঠিক আছে কিনা সেটা দেখতে বলছি। রাস্তার ছেলেরা কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে।'
শুভ্র ভাইয়ের কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো। আশেপাশে তাকিয়ে বললেন,
' তাকিয়ে আছে নাকি?কই? কে তাকিয়ে আছে?'
' উফ! এতো কথা কেন বলেন আপনি? আপনাকে যা বলতে বলেছি তা বলুন। ইজ এভ্রিথিং ওকে?'
শুভ্র ভাই দুই হাত জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে আমার থেকে খানিকটা দূরে সরে বসলেন। তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত বেশ কয়েকবার নিরক্ষণ করে নিয়ে ভ্রু কুঁচকালেন। আমি অস্বস্তি নিয়ে বললাম,
' আশ্চর্য! এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?'
শুভ্র ভাই নরম গলায় বললেন,
' কিভাবে তাকিয়ে আছি?'
' খুবই বাজে ভাবে তাকিয়ে আছেন।'
শুভ্র ভাই ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন,
' আমার এই বাজে ভাবে তাকানোই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে মেয়েরা। কিন্তু আফসোস! কারো দিকে তাকাতে পারি না।'
উনার কথায় রাগটাকে গিলে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
' কেন? আপনার চোখ দুটো কি কেউ বেঁধে রেখেছে? তাকালে তাকাবেন মানা করেছে কে?'
শুভ্র ভাই আফসোসের সুরে বললেন,
' মানা করে নি মানে? আরে, পারমিশমই তো দিচ্ছে না। আমার মা আর আমার মন দুজনে মিলে আমার চোখদুটোকে এমনভাবে আটকে দিয়েছে এখন আর একজন ছাড়া অন্য কাউকে চোখে পড়ে না। ইনিয়ে বিনিয়ে মায়ের থেকে পারমিশন পেলেও মিরজাফর মনের থেকে পারমিশন পাওয়া যায় না। এ জীবনে মন সেই পারমিশন দেবে বলেও মনে হচ্ছে না।'
আমি ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
' সেই একজনটা যে কি পরিমাণ কিউট জানিস? একদম মাত্রাতিরিক্ত কিউট। তোরা তো ওর আশেপাশেও ঘেঁষতে পারবি না। আমি এই বিষয়ে খুব ভেবেছি বুঝলি? এইযে আমার মনটা তার ওপর ফ্যাভিকলের মত আটকে বসে আছে, এর এক্চুয়াল কারণটা কি? এমনি এমনি তো আর আটকাআটকি বাঁধিয়ে বসে থাকতে পারে না, তাই না? অনেক ভেবে টেভে যা খুঁজে পেলাম তা হলো, ওর বাচ্চাদের মতো মিষ্টি দুটো গাল আর হাসি! উফ! মাস্টারপিস হাসি দেখেছিস কখনো? কতটা সুন্দর হয় জানিস? মাঝে মাঝে তো ইচ্ছে করে...'
শুভ্র ভাইয়ের কথার মাঝে রিকশার ব্রেক কষলো। আমি রিকশা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বললাম,
' আপনার 'তার' প্রসংশা শেষ হলে এবার আমি আসি শুভ্র ভাই। বাকিটা নাহয় অন্যদিন শুনবো।'
শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন,
' তুই শুনতে চাইলেই আমি তোকে শুনাতে যাব কেন? তোরা তো ভালো মানুষ না। পরে দেখা যাবে বাচ্চা মেয়েটার ওপর নজর টজর লাগিয়ে ফেলেছিস। খবরদার ওর দিকে নজর দিবি না। নজর দিবি তো এক চড়। এই মামা চলো তো... আজাইরা।'
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রিকশাটি নিজের গন্তব্যে ছুটলো। আমি নিজের মনেই হেসে উঠলাম। উৎফুল্ল মনে গেইটের দিকে পা বাড়াতেই ম্যাসেজ টুন বাজলো। শুভ্র ভাইয়ের ম্যাসেজ,
' তার চোখদুটো এতোটা সুন্দর না হলেও পারত। প্রথম দৃষ্টিতে মনের এতোবড় সর্বনাশটা সে না করলেও পারতো। চুলে গুঁজা দেবকাঞ্চনে তাকে মায়াদ্বীপের পরীটির মতো না দেখালেও পারত। তার নামটা সর্বনাশী, এই শুভ্র প্রেমিকের সর্বগ্রাসী না হলেও পারত!'
উনার পাঠানো ছোট্ট এই বার্তায় আমার বুকের ভেতর উথাল পাথাল ঢেউ বইতে লাগল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। চেহারায় একরাশ লাজুকতায় আর মনে ভর করলো অদ্ভুত এক চঞ্চলতা। ইশ, কি লজ্জা!
সারা শহর যখন শৈত্য প্রবাহের প্রকোপে দিশেহারা ঠিক তখনই ঢাকার পথে ছুঁটে চলেছি আমরা। বাসের জানালা দিয়ে বিকেলের নরম আলো আসছে। সেই সাথে আসছে হিমময় তীক্ষ্ণ বাতাস। বাসের জানালা আটকে দিয়েও বাতাসের কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। চুলগুলো ছন্নছাড়ার মতো উড়ছে। শরীরটা থেকে থেকেই কাঁপছে। বিষাক্ত মনটা বিরক্তিতে চিমসে আছে। কলি আপুর বিয়ে উপলক্ষে বাধ্য হয়েই গোষ্ঠীসুদ্ধ ছুটতে হচ্ছে ঢাকা। গাড়িতে সিট নেই। বড় এবং ছোটরা দুই গাড়িতে ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছে। কাজিনরা সব এক বাসে থাকলেও সিটের যাচ্ছে তাই অবস্থা। একজন সামনে তো একজন পিছনে। একজন মাঝখানে তো একজন ড্রাইভাইরের কোলে। উফ! এটাকে কি ফ্যামিলি ট্রিপ বলে? গাড়ির সর্বশেষ সিটটির দু'সিট সামনেই বসেছি আমি আর রাফিয়া। দু'জনের মুখই থমথমে। বমি বমি ভাব। ঠিকঠাক এক ঘন্টাও হয় নি গাড়িতে ওঠেছি এর মধ্যেই বমি টমি করে বিদিগিস্তা কান্ড। রাফিয়ার অবস্থাটাও বেশ খানিকটা নুইয়ে এসেছে ততক্ষণে। আরো কিছুটা পথ এগিয়ে, হঠাৎ ব্রেক কষার ধকলটা সামলে উঠতে না পেরে আবারও বমি হলো আমার। বাসে থাকা অধিকাংশ চোখ আমার ওপর এসে পড়ল। আমাদের এই অবস্থা দেখে সামনে থেকে ওঠে এলেন শুভ্র ভাই। বিরক্ত গলায় বললেন,
' গাড়িতে উঠতে না পারলে উঠেছিস কেন? যে হারে বমি করছিস মনে তো হচ্ছে বিয়ে বাড়ি নয় মৃগী রোগী নিয়ে ডাক্তার বাড়ি যাচ্ছি। ইচ্ছে তো করছে চড়াইয়া- থাপড়াইয়া বাস থেকে নামিয়ে দেই, বেয়াদব।'
আমি দুর্বল চোখে উনার দিকে তাকালাম। মাথাটা এমনিতেই ধপধপ করছিল। উনার কথায় সেই ধপধপ ভাবটা আরো একটু জ্বলে উঠল। অপমান আর দুর্বলতার যৌথ প্রয়োগে মুখে কথা জুগাতে পারলাম না। গাড়ির সিটে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। এই অসহ্যকর লোকটিকে এতোটা গুরুত্ব দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। শুভ্র ভাই কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে নরম গলায় বললেন,
' রাফিয়া, তোমার শরীর খারাপ লাগছে?'
রাফিয়া খুশিতে ঝলমল করে উঠল। কন্ঠস্বর যথাসম্ভব দুঃখী করার চেষ্টা করে বলল,
' জ্বী ভাইয়া।'
' পেছনের দিকে বসলে তো আরো খারাপ লাগবে। তুমি বরং একটা কাজ করো। উঠে গিয়ে সামনে আলিফের সাথে বসো। ওটা আমার সিট।'
রাফিয়া বিস্ময় চাপা দিয়ে বলল,
' তাহলে আপনি?'
শুভ্র ভাই নির্বিকার গলায় বললেন,
' আমাকে নিয়ে সমস্যা নেই। আমি তোমার সিটেই বসতে পারব। তুমি যাও, সামনে গিয়ে বসো। এখানে প্রবলেম হবে।'
রাফিয়া খানিকক্ষণ ইতস্তত করে উঠে গেলো। যাওয়ার সময় উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে ধন্যবাদও জানাল। শুভ্র ভাই বেশ আয়েশ করে আমার পাশে বসলেন। আমার পাশে বসার সাথে সাথেই উনার রং পরিবর্তন হলো। রাফিয়ার সাথে করা অমায়িক ব্যবহারের ইতি ঘটিয়ে নিজস্ব রূপে অবতরণ করলেন। বিরক্ত গলায় বললেন,
' মেয়ে মানুষ মানেই সমস্যা। সিম্পল একটা বাস জার্নি করতেই নাকে-মুখে রক্ত উঠে যাচ্ছে। তোদেরকে এসব সভ্য দুনিয়ায় মানায় না, বুঝলি? তোরা বংশগত ভাবেই আমাজনের বাসিন্দা। তোদের উচিত গোষ্ঠীসুদ্ধ আমাজনে গিয়ে বসবাস করা। পৃথিবীর সভ্য বাসিন্দারা তো তোদের যন্ত্রণায় বাঁচতে পারছে না।'
উনার অদ্ভুত কথাগুলো বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ সহ্য করলেও এবার একটা তীক্ষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। উনার দিকে ঘুরে বসে ধারালো গলায় বললাম,
' আপনার সমস্যাটা কি? সবসময় এমন উদ্ভট কথা কোথায় পান আপনি? আজাইরা যত্তসব। আমার গোষ্ঠী বাদ দেন। আপনার মতো শুভ্র দুটো থাকলেই এই পৃথিবী রসাতলে যাবে। মানুষ সেচ্ছায় সুইসাইড করবে।'
শুভ্র ভাই ভ্রু উঁচিয়ে তাকালেন। বাঁকা হেসে বললেন,
' করতেই পারে। আজকালকার টিনেজ মেয়েরা প্রেমে পড়ে সুইসাইড টুইসাইড করে, এটা স্বাভাবিক। তাদের জন্মই হয় সুইসাইড করে মরে যাওয়ার জন্য।'
আমি দুইহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে ঘন নিঃশ্বাস ফেললাম। রাগ মাখা থমথমে কন্ঠে জবাব দিলাম,
' আপনি যে কতটা হার্টলেস আর বিরক্তিকর সেই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে আপনার?'
উনি ভাবাবেগশূন্য গলায় বললেন,
' হয়ত আছে।'
' আপনি নিজেকে একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন শুভ্র ভাই।'
' ভাবাভাবির কি আছে? আমি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ।'
কথাটা বলে মৃদু হাসলেন উনি। আমার দিকে ঘন হয়ে বসে হাতে পানির বোতল ধরিয়ে দিলেন। কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
' পাশের সিটের মেয়েটাকে দেখ। বারবার তাকাচ্ছে। আই থিংক শী ক্রাশড অন মি।'
কথাটা বলে সোজা হলেন উনি। একটু সরে বসে স্বাভাবিক গলায় বললেন,
' পানি খেতে খেতে ঝগড়া করো ছকিনার মা। তোর মতো ক্যাঙ্গারুর শরীরে পানি, রক্ত হেনতেন সবরকম শূন্যতা দেখা দেয়। পানি খা, ঝগড়া কর। ঝগড়া ছাড়া তো আর কিছু পারিসও না। ফাজিল!'
আমি পাশের সিটের মেয়েটির দিকে তাকালাম। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই তাড়াহুড়ো করে চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। রাগে শরীরটা জ্বলে উঠল আমার। বাসে কি ছেলের অভাব আছে নাকি? সবাইকে রেখে এই অদ্ভুত মানুষটার দিকেই এতো তাকানো কেন? আর তাকাতেই যদি হয় তাহলে এই মুহুর্তেই তাকাতে হলো কেন? আমাদের ঝগড়াটা শেষ হলে তাকাতে পারত না? আমি রাগে বোতলের সম্পূর্ণ পানি এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম। মেয়েটির দিকে কয়েকবার রক্তচক্ষু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সন্দিহান গলায় বললাম,
' পানির স্বাদটা এমন লাগল কেন?'
শুভ্র ভাই ততক্ষণে ফোনের স্ক্রিনে মনোনিবেশ করেছেন। আমার কথায় কপাল কুঁচকালেন। নির্বিকার গলায় বললেন,
' কেমন লাগল?'
' কেমন যেন। অন্যরকম।'
' তাহলে খেলি কেন?'
আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। মৃদু আর্তনাদ করে বললাম,
' আপনি কিছু মেশান নি তো?'
' তাতে আমার লাভ?'
উনার প্রশ্নের প্রেক্ষিতে হঠাৎই কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না আমি। সত্যিই তো, পানিতে কিছু মিশিয়ে উনার কি লাভ? আমি ঢোক গিলে বললাম,
' অনেক লাভ হতে পারে। পানির বোতলটা তো আপনার, তাই না?'
শুভ্র ভাই আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। উনার ভ্রু জোড়া খানিকটা কুঁচকে এলো। তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে বললেন,
' তোর ধারণা আমি তোকে উল্টাপাল্টা কিছু খাইয়ে খারাপ কিছু করতে চাই?'
উনার বলা কথাটা নিজের কানেই ভীষণ বিদঘুটে শোনাল। আৎকে উঠে বললাম,
' ছি! না। কক্ষনো না। আমি ওভাবে বুঝাই নি।'
উনার নির্বিকার প্রশ্ন,
' তো কিভাবে বুঝিয়েছিস?'
আমি জবাব দিলাম না। উনি কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বাঁকা হাসলেন। বাম চোখটা টিপে দিয়ে বললেন,
' আসলেই মিশিয়েছি।'
আমি কপাল কুঁচকে অন্যদিকে তাকালাম। উনি আবারও বললেন,
' আরেহ! বিশ্বাস করলি না? কি একটা যন্ত্রণা, তুই তো দেখি আমার সত্য মিথ্যা কোনোটাই বিশ্বাস করিস না রে বাপ।'
আমার থেকে কোনোরূপ জবাব না পেয়ে আলিফ ভাইয়াকে ফোন লাগালেন শুভ্র ভাই। আলিফ ভাইয়া ফোন পেয়ে পেছনের দিকে তাকালেন। শুভ্র ভাই ঠোঁটের ইশারায় বললেন,
' ব্যাগ থেকে আমার চাদরটা দে।'
উনার ঠোঁটভঙ্গি বেশ কিছুক্ষণ নিবিষ্ট দৃষ্টিতে নিরক্ষণ করে চোখ বন্ধ করলাম আমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তন্দ্রচ্ছন্ন ভাব হলো আমার। তার মধ্যেই একটা উষ্ণ পরশ অনুভব করলাম। এতোক্ষণের শরীর কাঁপানো ঠান্ডাটা ধীরে ধীরে কমে এলো। নারীকণ্ঠী আবছা একটা কন্ঠ কানে এলো,
' উনি কি আপনার ছোট বোন, ভাইয়া?'
শুভ্র ভাইয়ের গরম নিঃশ্বাস আমার মুখের ওপর আছড়ে পড়ল। শুভ্র ভাই গম্ভীর গলায় বললেন,
' না।'
' তাহলে নিশ্চয় গার্লফ্রেন্ড বা ওয়াইফ।'
শুভ্র ভাই প্রথমেই কোনো উত্তর দিলেন না। উনার প্রকৃতি অনুযায়ী নারীকন্ঠীর অতিরিক্ত কৌতূহল উনার পছন্দ হওয়ার কথা নয়। শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
' ওয়াইফ বা গার্লফ্রেন্ড কিছুই না।'
উনার উত্তরে নারীকণ্ঠী হয়ত বেশ অবাকই হলো। বিস্ময় নিয়ে বলল,
' তাহলে?'
শুভ্র ভাই মৃদু গলায় বললেন,
' খুব আকাঙ্ক্ষিত কেউ।'
' জ্বি?'
শুভ্র ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
' কিছু একটা হয়।'
তারপর গাড়ির চাকা আর রাস্তার ঘর্ষণের শব্দ। মুখের ওপর অদ্ভুত সেই মানুষের আছড়ে পড়া উত্তপ্ত দীর্ঘশ্বাস। তারপর নিমগ্ন এক ঘুমের জগৎ। এরপর যখন ঘুম ভাঙলো তখন বাস ঢাকা শহরে ঢুকে পড়েছে। শুভ্র ভাই নিবিষ্ট চিত্তে ফোন ঘাটছেন। উনার ফোনের স্ক্রিনে রঙ-বেরঙের শাড়ি আর পাঞ্জাবির ছবি। আমি ভ্রু কুঁচকে খানিকটা বিস্ময় নিয়েই বললাম,
' আপনি শাড়ির ছবি দেখছেন কেন?'
আমার কন্ঠটা কানে যেতেই আমার বাহু থেকে বাম হাতটা সরিয়ে নিলেন শুভ্র ভাই। একটু নড়ে চড়ে বসে হালকা কাশলেন। চাদরটা টেনে নিয়ে বললেন,
' সোজা হয়ে বস। বাসে উঠে ঘুমানো কোন ধরনের অভ্যাস? এক তো ঘুমিয়ে পড়েছিস তারওপর অন্যের গায়ে ঢলে পড়ছিস। দিন দিন বেয়াদব হচ্ছিস। চরম বেয়াদব। সরে বস।'
আমি কপাল কুঁচকে সরে বসলাম। প্রতিবাদ করে বললাম,
' আমি মোটেও ঢলে টলে পড়ি নি। নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো কাহিনি আছে।'
' তাই তো বলবি এখন। বাপের মতো ধান্ধাবাজ হলে যা হয় আরকি।'
আমি রাগে নাক-মুখ লাল করে বললাম,
' আপনি আবার বাবাকে টানছেন!'
শুভ্র ভাই বিরক্ত গলায় বললেন,
' তোর বাপকে টানতে হয় না। ব্যাটা জোরপূর্বক চলে আসে। এইযে এতো করে বললাম, আমি ঢাকা ফাকা যাব না কিন্তু তোর ধান্ধাবাজ বাপ আমাকে জোরপূর্বক নিয়ে এলো। ক্যান বাপ? অন্যের মেয়ের বিয়েতে টেনে হিঁচড়ে আমার জ্বালা বাড়ানোর পায়তারা করছে নাকি বুড়ো?'
' এটা কখনোই বাবার দোষ নয়। কণা আপুরা আপনাদের দাওয়াত দিয়েছিলেন। মামু-মামানি যেহেতু আসতে পারছেন না সেহেতু দাওয়াত রক্ষার দায়ভারটা তো আপনারই নাকি?'
শুভ্র ভাই ঠেস লাগা গলায় বললেন,
' আমার কোনো দায়ভার নেই। কোথাকার কে দাওয়াত দিল। এর আগে কখনো দেখি নি পর্যন্ত, সেই দাওয়াত রক্ষা করার জন্য আমাকে টেনে হিঁচড়ে ঢাকা পর্যন্ত আনা হলো। মানে, বাড়াবাড়ির একটা লিমিট আছে। এর পেছনে নির্ঘাত কোনো ধান্ধা আছে।'
' আশ্চর্য! এভাবে বলছেন কেন? বাবা আপনাকে স্নেহ করে বলেই আসতে বলেছেন। আর জোরটা বাবা নয় মামানি করেছে।'
শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ গুজগুজ করে চুপ করে রইলেন। চোখ-মুখ বিরক্তিতে থমথম করছে। কণা আপুর বিয়েতে জোরপূর্বক ধরে আনায় বাবার প্রতি রাগটা তার কয়েকগুণ বেড়েছে বলেই বোধ হচ্ছে। তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, বড়দের মুখের ওপর 'না' করতে পারার গুণটা না থাকায় তিনি নিজের ওপরই ভয়ানক রুষ্ট এবং বিপন্ন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুখ কাঁচুমাচু করে জিগ্যেস করলাম,
' আপনার না মেয়েদের জিনিসের ওপর কোনো ইন্টারেস্ট নেই? তাহলে এতো মনোযোগ দিয়ে শাড়ির ছবি দেখছিলেন যে?'
শুভ্র ভাই আমার দিকে তাকালেন। আমি একটা ঝাঁঝালো উত্তরের জন্য মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলাম। কিন্তু উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিলেন। থমথমে গলায় বললেন,
' একটা শাড়ি পছন্দ করে দে তো। আমি কনফিউজড।'
আমি বিস্ফারিত চোখে উনার দিকে তাকালাম। ফোনটা হাতে নিয়ে বললাম,
' শাড়ি? হঠাৎ শাড়ি কেন?'
' তোকে যা করতে বলেছি কর। অতিরিক্ত প্রশ্ন করবি তো দিবো এক থাপ্পড়।'
উনার ধমকে খানিকটা নিভে গেলাম আমি। কিছুক্ষণ ঘেটে একটা লাল শাড়ি দেখিয়ে বললাম,
' এই শাড়িটা অনেক বেশি সুন্দর।'
শুভ্র ভাই তাকালেন। কপাল কুঁচকে কিছু একটা ভেবে আমার উচ্ছ্বাসিত মুখের দিকে তাকালেন। বললেন,
' আম্মু এমন লাল শাড়ি পরবে বলে মনে হয় না। আম্মুকে এমন শাড়ি পরতে দেখি না তো।'
' মামানির জন্য নাকি?'
' হু। আর কার জন্য হবে?'
আমি ঠোঁট কামড়ে ফোন স্ক্রল করতে লাগলাম। আর উনি সিটে গা এলিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, অপলক।
' এই শাড়িতে মামানিকে বেশ মানাবে। কিন্তু হঠাৎ শাড়ি কেন?'
শুভ্র ভাই আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে শাড়ি অর্ডার করলেন। মুখে বললেন,
' পঁচিশ তারিখ আম্মুর ম্যারেজ ডে। এই দিনটি না এলে এই পৃথিবীতে আমার আসাটাই হতো না। সো, এই দিনটা আমার জন্য স্পেশাল হওয়া উচিত, তাই না?'
উনার কথাটা বেশ ভাবালো আমায়। সত্যিই তো, বাবা-মার বিবাহ বার্ষিকিটা আমাদের জন্য স্পেশাল হওয়াই উচিত। শুভ্র ভাই লাল শাড়িটা অর্ডার করতেই তাড়াহুড়ো করে মনে করিয়ে দিলাম আমি,
' আরে, এটা কোনো অর্ডার করছেন? এটা মামানি সত্যিই পরবে না।'
শুভ্র ভাই অর্ডার দেওয়া শেষ করে ফোনটা পকেটে রাখলেন। আমার দিকে তাকিয়ে ভীষণ মিষ্টি করে হাসলেন। থুতনিতে থাকা তিলটা মাদকের মতো আভা ছড়ালো। সিট থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
' শাড়িটা তোর মামানি না পরলেও মামানির পূত্রবধূ পরবে। শাড়িটা তার পছন্দ মানেই অনেক কিছু্। সবাই নেমে যাচ্ছে, জলদি নাম।'
আমি কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালাম। শুভ্র ভাই সিট থেকে উঠে খানিকটা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি সিট থেকে বেরিয়ে দরজার দিকে হাঁটতেই পেছন পেছন হাঁটতে লাগলেন উনি। দু'পাশে উনার শক্তপোক্ত হাতের বেড়ি। এতো এতো মানুষের মাঝেও উনার গায়ের পরিচিত গন্ধটা নাকে এসে লাগতে লাগল। মুহূর্তেই মোহিত হয়ে উঠলো চারপাশ!
_____________________
রাত দশটা নাগাদ কলি আপুদের বাসায় গিয়ে পৌঁছালাম আমরা। কলি আপুদের বাসায় তখন হুলস্থুল অবস্থা। আগামী কাল গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম হবে বিধায় ঘরভর্তি জানা-অজানা মেহমান। শান্তিতে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা এখানে নেই। শুভ্র ভাই পুরোটা সময় বিরক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমাদের থাকার জন্য যে রুমটা বরাদ্দ করা হলো সেখানে সারিবদ্ধ তোশক আর কম্বল বিছানো। আমরা যে যেখানে পাই সেখানেই গা এলিয়ে দিলাম। ক্লান্ত মনে বারবার একটা কথায় ভাসতে লাগল, ' আরো দু'দুটো দিন থাকতে হবে এখানে। উফ!' সকাল বেলা সবাই মিলে রাস্তা হাঁটতে গেলাম। আমরা বোনেরা সামন সামনে হাঁটছি। আমাদের পেছনেই হাঁটছেন ভাইয়েরা। তাদের পেছনে, বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে হাঁটছে বড়রা। আলাপ চারিতার এক পর্যায়ে আলিফ ভাইয়া গদগদ গলায় বললেন,
' স্নিগ্ধা নামের মাইয়াটাকে দেখছ শুভ্র ভাই? হেব্বি দেখতে। এইটাকে কিভাবে পটানো যায় বলো তো?'
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
' তার আগে কিভাবে পেটানো যায় সেটা বলি। আমাদের নিচের তলার নতুন ভাড়াটিয়ার মেয়েকে দেখে নাকি ' বুঝে না সে, বুঝে না' গান গাস তুই?'
আলিফ ভাই হতাশ গলায় বললেন,
' কি বলো এসব শুভ্র ভাই? আমি কত্তো ইনোসেন্ট পোলা তুমি জানো না? গানটা আসলে আমি না ভাইয়া গাইছিল।'
অদুত ভাই লাফিয়ে উঠে বললেন,
' আস্তাগফিরুল্লাহ! বড় ভাইয়ের নামে অপবাদ দিতে লজ্জা করে না তোর? শালা, আব্বা-আম্মায় তোরে যে ক্যান ডাউনলোড করছিল আল্লাহ মালুম। তুই সবদিক থেকেই বেজাল। ডাউনলোড হওয়ার সময়ও সীন করেছিলি নির্ঘাত।'
অদুদ ভাইয়ের কথায় হুহা করে হেসে উঠলেন সবাই। মিলাদ ভাইয়া আমোদিত গলায় বললেন,
' আলিফ ছোটবেলা জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। আর রাস্তা দিয়ে যাওয়া কোনো মধ্যবয়স্ক পুরুষ দেখলেই 'আব্বা' 'আব্বা' করে চিল্লাতো। আর এখন যুবতি মেয়ে দেখতেই 'বউ' 'বউ' করে চিল্লায়। আলিফকে তোরা আন্ডারেস্টিমেট করতে পারিস না।'
ঠিক ওই সময়ই আমাদের অপজিট রাস্তার কোণে একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। আমার ভাইজাতি তাকে দেখে হঠাৎ করেই 'বউ' 'বউ' করে চেঁচিয়ে উঠল। মেয়েটি চমকে তাকাতেই সব কটা নিশ্চুপ হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। চোখে-মুখে ভারী নিষ্পাপ ভাব। মেয়েটি আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থেকে দ্রুত পায়ে রাস্তার বেগে হারিয়ে গেলো। সাথে সাথেই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো সবাই। আপু ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে বলল,
' তোমরা কি ফাজিল!'
অদুত ভাই বিরহী গলায় বলল,
' থাপড়া না খাইতে চাইলে সামনে তাকা। এখানে ভাইদের সিক্রেট কথাবার্তা চলছে। বোনেরা এখানে এলাউট নয়। চোখ-কান বন্ধ করে চুপচাপ হাঁট।'
আলিফ ভাইয়া অদুত ভাইয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,
' এইসব বাদ দে তো। এখন স্নিগ্ধাকে কিভাবে পটানো যাবে সেটা বল। এই মাইয়াকে পটানো না গেলে এই দুইটা দিনই নষ্ট। এক্কেবারে ওয়েস্ট!'
' ওহ। আরেকটা কথা তো বলতেই মনে নাই। কলির ফ্রেন্ড, ওই চ্যাংড়া ছেলেটা আছে না? শ্যামা করে, লম্বা ছেলেটা? ওই পোলায় কাল রাতে এসে রাফিয়ার বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা জিগ্যেস করছে। শালার, আমার ছোট বোনের বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা সেটা আমাকে এসেই জিগ্যেস করছে, ভাবা যায়? মেজাজটা যে কি পরিমাণ খারাপ হয়েছিল।'
রাতুল ভাইয়ার কথায় আবারও হুহা করে হেসে উঠলো সবাই। রাফিয়া উৎসাহ নিয়ে বলল,
' কোন ছেলেটা ভাইয়া?'
অদুত ভাইয়া ধমক দিয়ে বললেন,
' ভাইদের কথাবার্তায় নাক গলাইতে মানা করলাম না? যা, সামনে তাকা। নয়ত নগদে থাপ্পড় খাবি। নো বাকি ছাকি।'
রাফিয়া মুখ কালো করে সামনের দিকে তাকাল। আলিফ ভাই উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
' আমি তো ভাবছি, রাহাত ভাইকে রোদ,রুহির কথা জিগ্যেস করলে তার কেমন রিয়েকশন হবে। রাহাত ভাই? কি করবা?'
ভাইয়া কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই রাতুল ভাইয়া বললেন,
' ধুর! রাহাত ভাই না। এটা ভাব শুভ্র ভাইকে রোদের কথা জিগ্যেস করলে তার কেমন রিয়েকশন হবে।'
আলিফ ভাইয়া লাফিয়ে উঠে বললেন,
' ইশ! কি একটা সীনই না হতো তাহলে। শুভ্র ভাই? পোলা ভাড়া করে হলেও আমি রোদের পেছনে লাগাব দেইখো। টাকা যায় যাক তবু মুভি মিস করা চলবে না।'
শুভ্র ভাই চাপা গলায় বললেন,
' ধুশ্ শালা। থামবি? নাকি মুভিটা তোকে দিয়েই শুরু করব?'
ভাইজাতির ভয়ানক সব কান্ড কারখানা সহ্য করতে করতে রাস্তার একপাশে গিয়ে থামলাম আমরা। ঘন কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে আগুণ জ্বলছে। সেই আগুণে হাঁড়ি চাপিয়ে বিরস মুখে পিঠা বানাচ্ছেন এক বৃদ্ধা। আমরা হৈ হৈ করে পিঠা নিলাম। আমি পিঠা হাতে খানিকটা দূরে পাকা ডিপির ওপর গিয়ে বসলাম। আমার পায়ের কাছে এক টুকরো সোনালি রোদের আভা। ফোনের স্ক্রিনে সময় তখন আটটা চল্লিশ। আমি বসার কয়েক মিনিট পরই শুভ্র ভাই এলেন। আমাকে আগাগোড়া নিরক্ষণ করে বললেন,
' কি রে? শীতের কাপড় কই? সুয়েটার টুয়েটার তো কিছুই পরিস নাই। তোর বাপ যে এমন হার পর্যায়ের কিপ্টা জানা ছিল না।'
আমি বিরক্ত গলায় বললাম,
' সকালে ঘু্ম থেকে উঠেই আমার বাবার নিন্দা না করলে চলছে না আপনার? আমার বাবা কিপ্টেমির কি করল শুনি?'
উনি নির্বিকার ভঙ্গিতে পিঠায় কামড় দিলেন। পিঠা চিবোতে চিবোতে বললেন,
' এইযে খরচের ভয়ে মেয়েকে সুয়েটার কিনে দিচ্ছে না। এর থেকে বড় কিপ্টেমি কিছু হয় নাকি?'
' বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সুয়েটার আনতে ভুলে গিয়েছি। এর মানে এই নয় যে বাবা আমায় সুয়েটার কিনে দেয় না।'
' ওহ্। তারমানে কিনে দেয়।'
' অবশ্যই দেয়।'
শুভ্র ভাই ধীরে সুস্থে নিজের পিঠাটা শেষ করলেন। আমার ওড়নায় জোরপূর্বক হাত মুছে উনার গায়ে থাকা চাদরটা আমার গায়ের উপর ছুঁড়ে মারলেন।
' আমার ভীষণ গরম লাগছে। চাদরটা তোর কাছে রাখ। বাসায় ফিরে নিয়ে নেব।'
আমি অবাক হয়ে বললাম,
' এই ভয়ানক ঠান্ডায় আপনার গরম লাগছে?'
' কেন? লাগতে পারে না?আমি কি তোর মতো ক্যাঙ্গারু নাকি? আমি হলাম দূরন্ত যুবক। আমার শরীরের রক্ত অলওয়েজ গরম।'
আমি পূর্ণ দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম। উনার গায়ে সাদা রঙের পাতলা একটা শার্ট আর ডেনিম জিন্স। মুখের ফর্সা চামড়ার লাল আভা আর হাতের লোমের দাঁড়িয়ে থাকাটা উনার ঠান্ডার তীব্রতার প্রমাণ দিচ্ছে। তবুও কি অদ্ভূতভাবে মিথ্যা বলছেন উনি। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু নাচালেন শুভ্র ভাই।
' এভাবে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছিস কেন? চাদরটা হাতে নিয়ে বসে না থেকে গায়ে জড়িয়ে রাখলেও তো পারিস। নাকি চাদর কি করে গায়ে দিতে হয় সেটাও জানিস না?'
আমাদের কথার মাঝেই গুটি গুটি পায়ে দুটো বাচ্চা এসে দাঁড়ালো সামনে। গায়ে ময়লা জামা-সুয়েটার। শুভ্র ভাই তাদের দিকে তাকাতেই ফুল এগিয়ে দিয়ে বলল,
' ভাইয়া ফুল কিনবেন? এক্কেবারে তাজা ফুল।'
শুভ্র ভাই মেয়েটিকে ভালো করে নিরক্ষণ করে বললেন,
' নাম কি?'
' ছন্দা।'
' আমার নাম রাণি।'
শুভ্র ভাই গম্ভীর গলায় বললেন,
' সুন্দর নাম। তবে, ছন্দা রাণী দুটো একজনের নাম হলেই বেশি মানাতো। দুটো আলাদা নাম বলে মনে হচ্ছে না। কেন মনে হচ্ছে না বল তো?'
মেয়েদুটো জবাব দিল না। তাদের নাম নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হচ্ছে না। শুভ্র ভাই ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফুলগুলোকে ইশারা করে বললেন,
' হাতে এগুলো কি ফুল?'
' গোলাপ ফুল। ২০ টাহা কইরা।'
শুভ্র ভাই রাণীর হাতের দিকে ইশারা করে বললেন,
' আর এগুলো?'
ছন্দা উত্তর দিল,
'এগ্লা বকুল ফুলের মালা। আপনে তো দেহি কোনো ফুলই চিনেন না।'
শুভ্র ভাই হাসলেন। ঠোঁট উল্টে বললেন,
' আম্মু আমাকে একটা বউফুল এনে দিয়েছে। ওই ফুল ছাড়া আর কোনো ফুলই চোখে পড়ে না আমার। সব ফুলই একরকম লাগে।'
ছন্দা রাণী অবাক হলো। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
' বউফুল দেখতে কেমন? এমন ফুল সত্যসত্য আছে?'
শুভ্র ভাই হাসি হাসি মুখে বললেন,
' একদম সত্য সত্য আছে। আমি কেন মিথ্যা বলব বলো? আমার বউফুলটা তো পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর ফুল। গোলাপ, জবা কোনো ফুলই এর সামনে কিছুই না। তা, বকুলের মালা কত করে?'
বিস্মিত ছন্দা কোনোরকম উত্তর দিল,
' পাঁচ টাহা কইরা। লইবেন একটা মালা?'
' একটা নিবো না। সবগুলোই নিবো। তোমার হাতের গোলাপ গুলোও নিবো। সব মিলিয়ে কত চাই?'
ছন্দা কিছুক্ষণ ভাবল। খানিকক্ষণ পর দ্বিধাভরা গলায় বলল,
' ১০০। উহু, ২০০। '
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
' আচ্ছা। আমি তোমাদের তিনশো টাকা দেব। তার আগে তিনজনে মিলে চুপিচুপি একটা কথা বলবো, এদিকে এসো। কানে কানে বলতে হবে। চুপিচুপি বলা কথাগুলো কানে কানে শুনতে হয়। জোরে বলার নিয়ম নেই।'
ছন্দা-রাণী একে-অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে শুভ্র ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাল। দ্বিধাভরা পায়ে এগিয়ে গিয়ে বলল,
' কন।'
শুভ্র ভাই মুচকি হেসে ওদের কানে কানে কিছু একটা বললেন। আমি খানিকটা ঝুঁকে শোনার চেষ্টা করতেই রাম ধমক দিয়ে সরে বসতে বললেন। উনার ধমকে ঝুঁকাঝুঁকি বন্ধ করে চুপ করে বসে রইলাম। কয়েক মুহূর্ত পর ধীর পায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো ছন্দা। গোলাপ ফুলগুলো আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
' আমি তোমাকে আকাশের সমান ভালোবাসি। তুমি কি আমার বউ হবে?'
ছন্দার কথায় হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমি। হতভম্ব ভাবটা কেটে যেতেই একঝাক লাল, নীল লজ্জায় লাল হলাম আমি। সাথে সাথেই বকুলের মালাগুলো এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো আরেকটা কন্ঠ,
' আমি তোমাকে আকাশের সমান ভালোবাসি রোদপাখি। তুমি কি আমার বউ হবে?'
আমি ফুলগুলো হাতে নিয়ে মাথা নিচু করলাম। লজ্জায় চোখ-মুখ অন্ধকার করে আসছে আমার। শুভ্র ভাই এবার একটু পাশ ঘেঁষে বসলেন। ফিসফিস করে বললেন,
' একটা লাইন বাদ পড়েছে। সেটা আমি বলে দিই? তোমাকে ভীষণ আদরও করব। সত্যি বলছি, বউ হবে?'
উনার কথায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো আমার। আমাকে এভাবে শক্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে খুব হাসলেন শুভ্র ভাই। ফিচেল গলায় বললেন,
' শ্বাস নে, শ্বাস নে। মজা করছিলাম আমি। তোর বাপ তো আমার ওপর এট্যাম্প টু মার্ডারের কেস লাগিয়ে দেবে রে। সেখানে বড় বড় করে লেখা থাকবে," শুভ্র নামক এক নির্দয় যুবকের, কথার ফাঁদে ফেলে কোমলমতি শিশুকে শ্বাসরোধ করে মারার চেষ্টা"। তোর বাপের পক্ষে সব সম্ভব। সব মানে সব।'
উনার কথার প্রত্যত্তুরে কিছু বলার আগেই আম্মুর কন্ঠ কানে এলো। চেঁচিয়ে উঠে বললেন,
' শুভ্র-রোদ? কি করছিস ওখানে?'
আম্মুর কন্ঠে শুভ্র ভাই খানিকটা তটস্থ হলেন। পকেট থেকে টাকা বের করে পিচ্চিদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমার হাতে থাকা ফুলগুলো নিয়েও তাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন। তারপর কি ভেবে বকুল ফুলের মালাগুলো ফিরিয়ে নিয়ে আমার হাতে দিলেন। ওদের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললেন,
' এগুলো থাকুক। সব দিয়ে দিলে এই মহিলা আমার ঘাড় মটকে ফেলবে। একে দেখতে পেত্নীর মতো লাগে না?'
ছন্দা-রাণী শুভ্র ভাইয়ের কথার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল। ততক্ষণে আম্মুসহ প্রায় সবাই আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আম্মু আমার হাতে এতোগুলো মালা দেখে ভ্রু কুঁচকালেন।সন্দিহান গলায় বললেন,
' এতোগুলো মালা কোথায় পেলি রোদ?'
আমি ফট করেই উত্তর দিলাম,
' শুভ্র ভাই কিনে দিয়েছেন।'
শুভ্র ভাই হতাশ গলায় বললেন,
' তোমার মেয়ে ফুলের মালা কেনার জন্য মারা যাচ্ছিল। তাই কিনে দিলাম। নয়ত মানুষ ভাববে এতো বড় মেয়ে ফুলের জন্য কান্নাকাটি করছে অথচ কেউ কিনে দিচ্ছে না। বিষয়টা চোখে লাগতো। মান-সম্মানের ব্যাপার। ঠিক কাজ করেছি না ফুপ্পি?'
আম্মু আমার দিকে একবার রক্তচক্ষু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তারপর মুগ্ধ গলায় বললেন,
' তুই সব সময় ঠিকই করিস বাবা।এখন ওঠ। নয়টার বেশি বাজে। চল চল।'
কথাটা বলেই ফেরার পথে হাঁটা দিলেন আম্মু। ফুপ্পিরাও গল্পে মগ্ন হয়ে আম্মুর পাশে পাশে হাঁটতে লাগলেন। আম্মু খানিকটা সরে যেতেই পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটলেন আলিফ ভাই,
' আমরা কান্দে কাইটা মরে গেলেও তো ফুল কিনে দাও না শুভ্র ভাই। গায়ের চাদরও দিয়ে দিয়েছ দেখছি। বোনদের প্রতি এতো ভালোবাসা আর ভাইদের ভাগ্যে ফুটা কলস! ভাইদের প্রতি একটু বেশিই না-ইনসাফি হয়ে গেল না শুভ্র ভাই?'
শুভ্র ভাই চোখ কটমট করে তাকালেন। আমি অনুভূতিশূন্য পায়ে আম্মুর পিছু নিলাম। হঠাৎ করেই উপলব্ধি করলাম, আমার মনটা আসলে ভালো নেই। শুভ্র ভাইয়ের ফালতু মজাটা আমার ভালো লাগে নি। একটুও না।
ঘড়িতে কয়টা বাজে জানা নেই। ঘুম ভেঙেই ঘড়ি দেখার বাতিকও আমার নেই। অলস মানুষেরা প্রায়শই ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে চলাচল করার চেষ্টা করে। সময়,খাওয়া, সমালোচনা কোনো কিছুতেই তাদের পাত্তা পাওয়া যায় না। যাওয়ার কথাও নয়। অলস মানুষ উদাসীন থাকবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। সময় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার মত কঠিন কর্মটা তাদের জন্য নয়। আমিও অনেকটা সেই শ্রেণীরই মানুষ। চারপাশের সমালোচনায় মাথা খাটানোর সময় নেই। কিন্তু আজ খাটাতে হল। ঘুমন্ত আমিকে কেন্দ্র করে এতোগুলো কন্ঠের ফিসফিস শুনে চুপচাপ শুয়ে থাকা গেল না। সকাল সকাল কানের পাশে ভয়ানক রহস্য ঝুলিয়ে রেখে ঘুমের ভাব ধরা যায় না। আমি চোখ মেলে তাকালাম। চোখের সামনে ভেসে উঠল কয়েকজোড়া কৌতূহলী চোখ। আমাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখেই তীব্র কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল সবাই,
' সারপ্রাইজ।'
আমি সারপ্রাইজড হলাম না। কানে হাত চেপে ওঠে বসলাম। এরা সবাই আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। দু'বছরের মাঝে দেখা সাক্ষাৎ হয় নি বললেই চলে। আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
' তোরা কোথা থেকে টপকালি?'
অরিন উৎসাহ নিয়ে বলল,
' সারপ্রাইজড হয়েছিস?'
আমি বিরস মুখে বললাম,
' সারপ্রাইজড হওয়ার কি আছে? তোরা যদি দুই তিনটা জামাই সঙ্গে করে আনতিস তাহলে নাহয় সারপ্রাইজড হওয়ার মতো কিছু হত। আসছিস তো সেই আগের মতই। সারপ্রাইজড কেন হব?'
ছামি ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
' ধুরু! আমি আগেই বলেছিলাম এসব নাটক ফাটক করার দরকার নেই। এই হারামি সারপ্রাইজড হবে না। কিন্তু কে শুনে কার কথা? এই রোদু? তুই এই ঢঙীদের লাত্থি দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দে তো। এদের জ্বালায় সকালের খাওয়াটা পর্যন্ত জুটে নি আমার। ভাব-ভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছিল আমি এখানে না এলে এদের বিয়ে টিয়ে হবে না। জামাই হারিয়ে বিধবা হয়ে যাবে। বেয়াদব। আন্টিকে খেতে দিতে বল তো, ফ্যাস্ট।'
আমি আড়মোড়া ভেঙে হাসলাম। অলি লেপের ওপর হাত পা ছড়িয়ে দিল। ক্লান্ত গলায় বলল,
' হিমির নাকি স্যারের সাথে জবরদস্ত প্রেম চলছে? স্যারকে বলে একটা গাড়ি কেন পাঠাল না বল তো? কত্ত জার্নি করতে হলো, উফ!'
আমি ফিচেল গলায় বললাম,
' আরে...স্যারের গাড়ি তোর জন্য কেন পাঠাবে? স্যার পার্সোনাল, গাড়িও পার্সোনাল। সেখানে হিমি পার্সোনালি জার্নি করবে। আমাদের মতো আমজনতার সেখানে অধিকার নেই। এতোবড় আবদার করে ফেলাই তোকে ভয়ানক শাস্তি দেওয়া উচিত অলি।'
স্পৃহা গম্ভীর গলায় বলল,
' একদম। তোর উচিত ক্ষমাপত্র জমা দেওয়া। তাও যেনতেন ক্ষমাপত্র নয়। লেফাফায় মোড়া ক্ষমাপত্র।'
কথাটা শুনেই খিলখিল করে হেসে উঠল সবাই। আমি বেশ সিরিয়াস মুখভঙ্গি নিয়ে বললাম,
' দেখ হিমি। দেবর ছাড়া ছেলে পছন্দ করে এমনিতেও তুই ভয়ানক অপরাধ করে ফেলেছিস। আমরা দয়ালু বলে ক্ষমা করেছি। কিন্তু বিয়ের সময় ক্ষমা টমা করব না। তোর বিয়েতে সবাই ভয়ানক সাজব। হলুদ আর বিয়েতে আমাদের শাড়ি,গহনা, সাজগোজ সবকিছুর দায়িত্ব তোর জামাইয়ের। ব্যাটা এতো টাকা দিয়ে করবেটা কি?'
ছামি পানি খেতে খেতে বলল,
' আমার জন্য হাই হিলটা মাস্ট। ওই জুতো দিয়ে তোর জামাইয়ের পায়ে পাড়া দেব। এটা তার ছোট ভাই না থাকার শাস্তি।'
স্পৃহা বলল,
' হলুদের গাজরাটা একদম তাজা ফুলের হওয়া চাই। এই রোদু? গেইটে কত ধরা হবে?'
আমি গম্ভীর কন্ঠে ঘোষণা করলাম,
' সব মিলিয়ে পনেরো হাজার,হবে না?'
বিস্মিত হিমি উত্তর দিল,
' স্যার আমাকে প্রোপোজই করল না আর তোরা গেইট ফেইট সাজিয়ে ফেললি? সাংঘাতিক।'
'গেইট কি রে? আমি তো আঠারো প্লাস কথাবার্তাও সাজিয়ে ফেলেছি। শোন হিমি, বিয়ের কনের এভাবে গেইটের সাথে ঝুলাঝুলি করাটা মানায় না। টুপ করে বাসর ঘরে ঢুকে যা। তোকে শুনাবো বলে বেশ কিছু আঠারো প্লাস গল্প সিলেক্ট করেছি আমি। আজ থেকে সব আঠারো প্লাস চলবে। খাওয়া,ঘুম, গোসল সবসময়। ননস্টপ চলবে।'
ছামির কথার ভঙ্গিতে হাসিতে গড়াগড়ি খেলাম সবাই। ছামি স্বাভাবিক মুখে বলল,
' এই রোদু? তোকে খাওয়ার কথা বললাম না? পাত্তাই তো দিচ্ছিস না রে মামা। ক্ষুধায় মরে গেলাম।'
তারপর হঠাৎই গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল,
' শোন, আন্টির সামনে আমি খুবই ভদ্র,শান্ত, লক্ষ্মী মেয়ের ভং ধরে থাকব। ভদ্রতা বজায় রেখে বলব, আর না আন্টি। প্লিজ প্লিজ। তুই তখন বলবি, আরে নে। আম্মু ওকে দাও তো। বেশি করে দাও। বুঝছিস? ভদ্রতা দেখাতে হবে। আই হেভ প্রচুর ভদ্রতা। এবার যা।'
ছামির কথায় আবারও অট্টহাসিতে মেতে উঠল প্রত্যেকটি কন্ঠস্বর। সারাদিন হৈচৈ করে বিকেলে শহর ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। অনেকদিন পর আবারও একসাথে একই তালে হাঁটছি ভেবেই সবার কি উথালপাথাল আনন্দ। চরপাড়া থেকে শুরু করে সার্কিট হাউজ চষে বেড়ানোর সেই পুরাতন উন্মদনা। কখনও পার্কের ব্রেঞ্চে বসে আড্ডা তো কখনও নৌকায় ওঠে চিল্লাপাল্লা। আইসক্রিম হাউজে ঢুকে একজন আরেকজনের আইসক্রিমে কি বিভৎস হামলা। প্রায় দু'বছর পর আবারও ফুসকার রেস্টুরেন্টে ছয়টি উচ্ছল কিশোরীর আনন্দিত কন্ঠস্বর। প্রচন্ড ঝাল ফুসকার সাথে বর্তমান ক্রাশ আর বয়ফ্রেন্ডদের নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সমালোচনা। আমাদের আড্ডার মাঝেই শহরে সন্ধ্যা নামল। রাস্তায় রাস্তায় জ্বলে উঠল সোডিয়ামের আলো। অলি, অরিন, হিমি, ছামি সবাই এসেছ ভিন্ন সব শহর থেকে। আজ রাতে আমার বা স্পৃহার বাসাই হবে তাদের একমাত্র আবাসস্থল। ফুসকা শেষ করে সবাই মিলে স্পৃহাদের বাসায় থাকার পক্ষে যুক্তি দিল অলি। রাতভর হৈচৈ করার জন্য এর থেকে ভালো জায়গা হওয়ার নয়। আমরাও রাজি হলাম। বাসায় ফোন দিয়ে জানালাম আজ আর ফিরছি না। আপু কিছুক্ষণ গুজগুজ করে বলল,
' জন্মদিনের আগের রাতে অন্যের বাসায় থাকবি এটা কেমন কথা?'
আমি বললাম,
' অতি সুন্দর কথা।'
আপু কৃত্রিম রাগ নিয়ে ফোন কাটল। বান্ধবীদের ফিসফাস শুনে বুঝতে পারলাম তারা কিছু একটা পাকাচ্ছে। হয়ত সারপ্রাইজ টারপ্রাইজের ব্যবস্থা করছে। আমার সমস্যা হল কখনই ঠিকঠাক সারপ্রাইজড হতে পারি নি। কেউ সারপ্রাইজ দিতে গেলে চট করেই বুঝে যায়। কিন্তু এমনটা বাঞ্চনীয় নয়। কেউ একজন সারপ্রাইজ দিতে চাইলে সারপ্রাইজড হতে হয়। সারপ্রাইজড না হলেও সারপ্রাইজড হওয়ার ভব ধরতে হয়। আমিও সারপ্রাইজড হওয়ার ভব ধরব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। স্পৃহাদের বাসায় পৌঁছেই শাড়ি পড়ার ধুম পড়ল। আমাদের থেকে আন্টির উৎসাহই বেশি। কাকে কোন শাড়ি, কোন গহনায় মানাবে তা নিয়ে হুলস্থুল অবস্থা করলেন। রাত সাড়ে ১১ টার দিকে চায়ের ট্রেটা রুমে আসতেই অলি ঘোষণা করল ছাদে গিয়ে চা খাবে। শীতের রাতে ছাঁদে চা না খেলে মজা নেই। অতএব সবাই মিলে ছাঁদে চললাম। সিঁড়ির আলো নেভানো। চারপাশের গাঢ় অন্ধকারটা কাটিয়ে দিচ্ছে সিঁড়ির গোড়ায় থাকা মোমের আলো। আমি বিস্ময় নিয়ে সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করছি। সাথে সাথেই আমার গা ঘেঁষে পেছন থেকে দৌঁড়ে সামনে এল অরিন আর অলি। হাতে থাকা লাল ওড়নার এক কোণা ধরে রেখে অপর দিকটা ছুঁড়ে দিল আমার পেছনে থাকা হিমি আর ছামির হাতে। আমার বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁলো। মাথার ওপরের ওড়নার সামিয়ানাটা একবার দেখে নিয়েই চোখ ঘুরিয়ে অলি-অরিনের দিকে তাকালাম। সাথে সাথেই মিস্টি হেসে চেঁচিয়ে উঠল অলি,
' সং প্লিজ।'
গান বাজল। সাউন্ড বক্স ফাটিয়ে গেয়ে উঠল 'হ্যাপি বার্থডে' গান। তার সাথে সুর মেলাল বান্ধবীরাও। সামিয়ানার নিচে ধীর পায়ে সিঁড়ি অতিক্রম করতে করতে নিজেকে এক মুহূর্তের জন্য অচিনপুরের রাজকুমারী বলে বোধ হল। বিস্ময়ে বোবা বনে গেলাম। ছাঁদ জুড়ে লাল গোলাপের পাপড়ি। মোমের হলদে আলো। অরিন গানের সুরকে ছাপিয়ে দিয়ে চেঁচাল,
' এবার সারপ্রাইজড হয়েছিস?'
আমি দু'হাতে মুখ চেপে ধরলাম। ছামি রাজকীয় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। মাথা নুইয়ে ঢং করে বলল,
' রাজকন্যাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। রাজকন্যার ঠোঁটে হাসি ফুটলে কৃতার্থ হব। নয়তো রাজকুমার আমাদের গর্দান নেবে।'
ছামির কথায় হেসে ফেললাম আমি। সেই সাথে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা জল। অলি মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে বলল,
' ন্যাকা কান্না করে মেকাপটা খারাপ করিস না তো। ছবি তুলব।'
স্পৃহা,অরিন দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
' হ্যাপি বার্থডে দোস্ত। লাভ ইউ মোর দেন ইউ লাভ আছ।'
আমি হাসলাম। হিমি দু'কদম এগিয়ে এসে বলল,
' এই এরেঞ্জমেন্ট কিন্তু আমাদের একার নয় রোদবালিকা। প্ল্যান, খরচ সবই অন্যকারো। কিন্তু সে কে তা আমরা বলব না। প্রমিজ ইজ প্রমিজ, ইউ নো? তবে তুই গেইস করে ফেললে সেটা অন্য ব্যাপার। গেইস ইট!'
আমি গেইস করতে পারলাম না। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলাম। সাউন্ড বক্সে গান বদলানো হল। সবার গায়েই নাচের পোকা ছুটল। আমিও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। নাচের ধাপে ধাপে চিন্তাটা আর চিন্তা রইল না। চিন্তাগুলো যেন ঠান্ডা বাতাসে ভেসে গেল। প্রায় আধাঘন্টা লাফলাফি করার পর সাউন্ড বক্সে ফোনের রিংটন বাজল। স্পৃহা দৌঁড়ে গিয়ে ফোন রিসিভ করল। আবারও দৌঁড়ে এসে বলল,
' রুহি আপু ফোন দিয়েছিল। তোকে নাকি ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না? তোর মামানি তোর সাথে কথা বলবে। ফোন অন করতে বলল আপু।'
এবার টনক নড়ল আমার। এতো হৈ-হল্লোড়ের মাঝে ফোন যে কোথায় রেখেছি মনে পড়ছে না। সবাই নাচ-গান বন্ধ করে ফোন খোঁজায় মন দিলাম। অনেক খুঁজাখুঁজির পর ফোন পেলাম কার্পেটের তলায়। ফোনটা অন করতেই শুভ্র ভাইয়ের কল এল। ফোনটা রিসিভ করতেই উনার বাজখাঁই ধমকে পিলে চমকে উঠল,
' ঠাডাইয়া চড় দিয়ে দাঁত ভেঙে ফেলব। বাপের মতো মতলববাজ হয়েছিস। বড়রা ফোন দিলেই ফোন অফ করে রাখছিস। তুই যে দিন দিন চূড়ান্ত বেয়াদব হচ্ছিস সে সম্পর্কে ফুপ্পিকে জানান উচিত। তার আগে তোকে ইনস্ট্যান্ট ব্রহ্মপুত্র নদে চুবানো উচিত।'
আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। জন্মদিনের ঠিক এক মিনিট আগে কেউ কাউকে ঠাডিয়ে চড় মারার হুমকি দিতে পারে জানা ছিল না। শুধু চড় নয় প্রয়োজনে যে ব্রহ্মপুত্র নদে চুবাতেও পারে সেটাও জানা ছিল না। আমি দুর্বল গলায় বললাম,
' আপনি আমাকে জন্মদিনের দিন চড় মারতে চাইছেন? জন্মদিনে কি কেউ কাউকে চড় মারে?'
উনি বিরক্ত গলায় বললেন,
' কেউ না মারলেও আমি মারি। তুই এমনভাবে জন্মদিন জন্মদিন করছিস যেন জন্মদিন একটা ভয়ানক দিন। এই দিনে চড় মারলে হাত খসে পড়ে যাবে। শোন, জন্মদিন ইজ জন্মদিন। গরু, ছাগল,ভেড়া, মানুষ সবারই জন্মদিন থাকে। এটা নিয়ে আবেগে মরে যাওয়ার কিছু নেই। যেসকল মানুষ তোর মতো বলদ তারাই শুধু জন্মদিন জন্মদিন করে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। তোর কথাবার্তার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে তুই একাই জন্মেছিস আর সবাই আকাশ থেকে টুপটুপ করে পড়েছে। ডাফার।'
আমি ক্লান্ত গলায় বললাম,
' আপনি কি আমার সাথে ঝগড়া করতে ফোন দিয়েছেন শুভ্র ভাই?'
' অবশ্যই না। তুই কি নিজেকে দুনিয়াদারীর প্রেসিডেন্ট মনে করিস যে তোর সাথে ঝগড়া করতে হবে আমায়। তুই অতিকায় বাচ্চা মেয়ে। দি শুভ্র তোর মতো পুচকু মেয়েকে ঝগড়া করার মত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না।'
উনার কথায় ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙল আমার। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
' গুরুত্বপূর্ণ মনে না করলে ফোন দিয়েছেন কেন? ফোন রাখুন। আপনার সাথে বাজে বকার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আমার।'
' দিব এক থাপ্পড়। এতো মুখ চলে কেন তোর? মুখটা এত না চালিয়ে পা চালা। তরতর করে নিচে নেমে আয়। দরকার আছে।'
' আমি বাসায় নেই।'
' তুই যেখানে আছিস সেখান থেকেই নিচে নাম।'
' আমি কোথায় আছি আপনি জানেন?'
শুভ্র ভাই বিরক্ত কন্ঠে বললেন,
' কথায় কথায় এত প্রশ্ন করিস কেন? নিচে নামতে বলেছি নিচে নামবি ব্যস। এতো প্রশ্ন-উত্তরের প্রয়োজন কি? তোর কী ধারণা? আমি রাতদুপুরে তোর সাথে দাদাগিরি খেলছি?'
আমি স্পষ্ট কন্ঠে উত্তর দিলাম,
' আমি এখন নামতে পারব না।'
' নামিস না। এখন ১২ বেজে ৫ মিনিট। ঠিক বারোটা দশে তুই রাস্তায় এসে দাঁড়াবি। আর যদি না দাঁড়াস তাহলে যা হবে তার জন্য আমি দায়ী নই।'
আমি বিরক্ত গলায় বললাম,
' এতো রাতে কি করে বেরুব আমি? স্পৃহাদের বাসায় আছি। আন্টি কি ভাববে?'
শুভ্র ভাই দায়সারাভাবে বললেন,
' উনি কি ভাববে সেটা উনিই ভালো জানেন। আমাকে জিগ্যেস করছিস কেন? আমি তোকে নামতে বলেছি তুই নামবি ব্যস।'
' আমি পারব না।'
' না পারলে নেই। ফোন রেখে বারোটা দশ পর্যন্ত অপেক্ষা কর।'
কথাটা বলেই ফোন কাটলেন শুভ্র ভাই। আমি যেন অথৈজলে পড়লাম। শুভ্র ভাইয়ের পক্ষে সব সম্ভব। সহজ-সরল কথাকে উত্তর-দক্ষিণ করে কাউকে হার্টের রোগী বানিয়ে দেওয়া উনার জন্য দু'মিনিটের ব্যাপার। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্পৃহার কাছে ছুটলাম। স্পৃহাকে হেনতেন বুঝিয়ে গেইট খুলতে বলেই নিচে নেমে গেলাম। আন্টি শুয়ে পড়েছিলেন। আমাকে ঢুকতে দেখে ওঠে বসলেন। আমি মৃদু গলায় বললাম,
' আন্টি আমি একটু নিচে যাচ্ছি। আসলে, আলমারির চাবিটা ভুলে আমার ব্যাগে থেকে গিয়েছিল। ওটা নিতেই কাজিনকে পাঠিয়েছে আম্মু। আমার কাজিন নিচে দাঁড়িয়ে আছে।'
আন্টি অবাক হয়ে বললেন,
' এতো রাতে?'
আমি ঢিপঢিপ বুক নিয়ে দ্বিতীয় মিথ্যেটা বলে ফেললাম,
' হয়ত কোনো প্রয়োজন। বাবার অফিসের ফাইলগুলো তো আলমারিতেই থাকে। আমি চাবিটা দিয়ে আসি?'
আন্টি ব্যস্ত হয়ে বললেন,
' চলো। আমিও যাই তোমার সাথে। নিচে অন্ধকার।'
' না না। বাইরে তো জ্যোৎস্না। তাছাড়া স্পৃহাও যাবে সাথে। আপনি ঘুমোন।'
' তুমি শিওর?'
' জি, আন্টি।'
স্পৃহার মাকে ছাইপাঁশ বুঝিয়ে বেরিয়ে এসেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। বুকে হাত দিয়ে বার কয়েক শ্বাস টেনে নিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করলাম। আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। আকাশ থেকে ঠিকরে পড়া জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে দেবকাঞ্চন ফুল আর সিমেন্টে ঢাকা সরু পথ। ঘাসের কচি ডগাগুলো লাজুক ভঙ্গিতে নুইয়ে আছে। পাতায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু শিশির কণা জ্যোৎস্নার আলোয় হয়ে উঠেছে প্রাণোচ্ছল। আমি একহাতে শাড়ির কুঁচি সামলে নেমে গেলাম রাস্তায়। হাত ভরা কাঁচের চুড়ি আর নুপুরের রিনঝিন শব্দে চারপাশটাই আলৌকিক এক সুর বাজল। তার সাথে বাজল নিশাচর পাখির করুণ কন্ঠ। আমি গেইট পেরিয়ে মূল রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম। পায়ে জুতো নেই। রাস্তার ছোট ছোট নুড়ি পাথরগুলো পায়ের নিচে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। বামহাতে চুলগুলোকে হাত খোঁপা করে আশেপাশে তাকালাম আমি। নির্জন,জনমানবহীন রাস্তায় কাঁচের চুড়ির নিরন্তর কান্না ছাড়া অন্যকোনো শব্দ নেই। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক করে শুভ্র ভাইকে চোখে পড়ল আমার। আমার থেকে কিছুটা দূরে একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। নীল পাঞ্জাবীর ওপর কালো চাদর জড়িয়েছেন । পাঞ্জাবির হাতাদুটো কনুই পর্যন্ত গোটানো। চুলগুলোতে ঢেকে আছে প্রশস্ত, ফর্সা কপাল। গম্ভীর, ভাবুক চোখগুলো ফোনের স্ক্রিনে আবদ্ধ। আমি শাড়ির কুঁচি সামলে দৌঁড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম উনার সামনে। উনি চোখ তুলে তাকালেন। পুরু ভ্রু'জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে অনেকটা ফিসফিসিয়ে বললাম,
' ডেকেছেন কেন? কি দরকার?'
উনি জবাব দিলেন না। চোখের ঘন পাঁপড়িগুলো ঝাঁকিয়ে আগাগোড়া নিরক্ষণ করলেন। গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বললেন,
' বাপরে! এতো সেজেছিস কেন? মানুষ তো বিয়ে বাড়িতে গেলেও এতো সাজে না। ধান্ধা কি বল তো? তোর বান্ধবীর ভাই টাই আছে নাকি? সেই ধান্ধা ধরেই এতো সাজ?'
আমি নাক ফুলিয়ে বললাম,
' আপনি কি আমাকে এসব লেইম কথা বলার জন্য ডেকেছেন? সাজগোজ মেয়েদের জন্যই। মেয়েরা শুধু ছেলেদের জন্য নয় নিজের জন্যও সাজে।'
' সাজে নাকি?'
আমি জবাব দিলাম না। উনি রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে মৃদু গাইলেন,
' How do I live? How do I breathe?
When you're not here I'm suffocating
I want to feel love, run through my blood.
Tell me is this where I give it all up?
For you I have to risk at all
Cause the writing's on the wall.'
আমি দৌঁড়ে তার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম। ভ্রু বাঁকিয়ে বললাম,
' আপনি সবসময় ইংলিশ গান কেন গান? বাংলা গান গাইলেই পারেন।'
শুভ্র ভাই মৃদু হাসলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন,
' ফিলিংস এক্সপ্রেস করাটাই মূখ্য বিষয়। কি ভাষায় গাইলাম সেটা মূখ্য বিষয় না।'
' এটাকে ফিলিংস এক্সপ্রেস করা বলে? এত দ্রুত গাইলেন প্রথম লাইন বুঝতে বুঝতেই লাস্ট লাইন শেষ।'
আমার কথায় হেসে উঠলেন শুভ্র ভাই। নিস্তব্ধ রাস্তায় শুভ্র ভাইয়ের হঠাৎ হাসিতে ঘেউ ঘেউ করে উঠল দুটো কুকুর। আমি ভয়ে শুভ্র ভাইয়ের শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালাম। শুভ্র ভাই হাসি থামিয়ে বললেন,
' এই জন্যই গাইলাম। জানতাম তোর মাথায় কিছু ঢুকবে না। বাপের মতো হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিরেট মাথা তোর।'
আমি দাঁড়িয়ে পড়ে বললাম,
' আপনি আবার আব্বুকে টানছেন? আপনি একটা অসহ্য। আমি কখনও আপনার বাবাকে নিয়ে কিছু বলি?'
শুভ্র ভাই বিরস কন্ঠে বললেন,
' বলিস না বলবি। আমি তো তোর মুখ চেপে বসে নেই। তোর মামু তুই যা ইচ্ছে বলতে পারিস। কি বলতে চাস, বল।'
আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
' আপনি অত্যন্ত খারাপ একজন মানুষ। আপনার মতো খারাপ ব্যক্তি এই পৃথিবীতে দুটো নেই।'
উনি স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
' না থাকারই কথা। আমি তো এক পিসই।'
কথাটুকু বলে আবারও হাঁটতে লাগলেন শুভ্র ভাই। গলা ছেড়ে গাইতে লাগলেন,
' বালিকা তোমার প্রেমের পদ্ম দিও না এমন জনকে-
যে ফুলে ফুলে ঘুরে মধু পান করে
অবশেষে ভাঙে মনকে।
একটা হৃদয় বার বার নয় একবারই প্রেমে পড়ে
সেই হৃদয়-এর সুখ লুঠ হয় নিঠুর মৌন ঝড়ে।
বালিকা..... '
আমি আবারও দৌঁড় গিয়ে তার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম। রাগী গলায় বললাম,
' গান বন্ধ করে চুপ করে দাঁড়ান। আপনার এসব ছাইপাঁশ গান অসহ্য লাগছে আমার।'
শুভ্র ভাই ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালেন। ল্যাম্পপোস্ট আর জ্যোৎস্নার মিশ্র আলো এসে পড়ছে তার মুখে। চুলগুলো শীতের বাতাসে মৃদু মৃদু উড়ছে। আমি বিমোহিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। শুভ্র ভাই ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন,
' এখন আরও জোরে গাইব। তোর ভালো না লাগলে কানে আঙ্গুল ঢুকা। আমি হলাম স্বাধীন দেশের নাগরিক। তোর মতো পুচকু আমার স্বাধীনতা খর্ব করবে আর আমি তা মেনে নেব, তা হতে পারে না।'
আমি বিরক্ত গলায় বললাম,
' আপনি একটা যাচ্ছে তাই মানুষ। আপনার সাথে তর্কে জড়ানো মানেই নিজের পায়ে কুড়াল মারা। আপনি আমাকে কেন ডেকেছেন বলুন। আমার ফ্রেন্ডরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।'
শুভ্র ভাই দায়সারা কন্ঠে বললেন,
' করুক।'
আমার রাগ তখন সপ্তমাকাশে। আমি ফুঁসে উঠে বললাম,
' করুক মানে? আপনি কারণটা বলবেন? নাকি আমি এমনি চলে যাব?'
শুভ্র ভাই এবার দাঁড়ালেন। আমার দিকে নরম দৃষ্টিতে তাকালেন। ভীষণ আদুরে গলায় বললেন,
' আমি কি তোকে শুধু কারণেই ডাকি? অকারণে ডাকি না?'
আমি নিভে গেলাম। সরু চোখে তাকালাম। আমাকে এভাবে তাকাতে দেখেই শব্দ করে হেসে উঠলেন শুভ্র ভাই।
' হাসছেন কেন?'
উনি ঝট করে হাসি থামালেন। চোখে-মুখে গম্ভীরতা এনে বললেন,
' আজ কি জ্যোৎস্না দেখেছিস? এটা কে বলে মুনলিট নাইট। তোকে আজ প্রেকটিক্যালি 'মুনলিট নাইট' কম্পোজিশন শেখাব বলে ডাকলাম। চল। লেট'স স্টার্ট।'
এই অসহ্য লোকটির কথায় রাগে কান্না পেয়ে গেল আমার। জন্মদিনের দিন। প্রাণের বন্ধুদের অপেক্ষা করিয়ে সে আমাকে মুনলিট নাইট কম্পোজিশন শেখাবে। ভাবা যায়? রাগে আর বিরক্তিতে নিজের চুল টানতে ইচ্ছে করছে আমার। কেন এলাম আমি? এই লোকটির কথায় নেচে নেচে রাস্তায় নেমে আসাটাই বিরাট ভুল হয়েছে আমার। শুভ্র ভাই ধমক দিয়ে বললেন,
' কি রে? পড়ার কথা শুনে আট্যাক ফ্যাট্যাক খেয়ে গেলি নাকি?'
আমি জবাব দিলাম না। শুভ্র ভাই নিজের চাদরটা আমার কাঁধে ছড়িয়ে দিয়ে চুলগুলো মুক্ত করে দিলেন। ডানহাতটা চেপে ধরে বললেন,
' চল।'
' আমি কোথাও যাব না।'
' না গেলে ফিরে যা। আসার সময় দুইটা মারমুখো কুকুর দেখে এলাম। যাওয়ার সময় তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে যাস। যা যা...'
আমি আবারও ভয়ে সিটিয়ে গেলাম। শুভ্র ভাই সবসময়ই আমায় ট্রেপে ফেলেন। এইবার তিনি মারাত্মক এক খেলা খেলেছেন। এই খেলা থেকে বেরুনো আপাতত অসম্ভব। আমি মুখ কালো করে হাঁটতে লাগলাম। বিরক্তি আর ভালো লাগার মিশ্রণে ঢাকা ওই মানুষটির হাতে হাত রেখে কিছুটা পথ হাঁটতেই উপলব্ধি করলাম, আমার ভালো লাগছে। এমনই এক রাতের, নির্জন রাস্তার, বিশ্বস্ত হাতের স্বপ্নই তো বুনেছিল এই সুপ্ত, অবুঝ মন। এর থেকে সুন্দর ইচ্ছে-পূরণ কি হয়? হতে পারে? আধঘন্টা মতো হাঁটার পর প্রথম কথা বললেন শুভ্র ভাই। নরম গলায় বললেন,
' তোর পায়ে জুতো নেই কেন? পায়ে ব্যথা লাগছে না?'
আমি তখন দমবন্ধ ভালো লাগায় চারপাশটা দেখতে ব্যস্ত। শুভ্র ভাইয়ের ছোট্ট কথাতেও খুশিতে ঝুমঝুম করে ওঠে বললাম,
' অনেকদিন খালি পায়ে হাঁটা হয় না। ভালো লাগছে।'
শুভ্র ভাই মৃদু হাসলেন। রাস্তার ধারের টং দোকানটা ইশারা করে বললেন,
' চল, চা খাই।'
আমরা টং দোকানের দাওয়ায় দাঁড়ালাম। অন্ধকার দোকানটায় টিমটিম করে জ্বলছে হলুদ আলো। পানির কেতলি থেকে নিরবিচ্ছিন্ন ধোঁয়া উড়ছে। খদ্দেরবিহীন টং দোকানে বিরসমুখে চুলো সামলাছেন দোকানী। গায়ে তার লাল টকটকে শীত কাপড়। শুভ্র ভাই দু'কাপ স্পেশাল চা অর্ডার করে ব্রোঞ্চোাা বসলেন। আমার হাত টেনে পাশে বসালেন। দোকানী ছাঁকনিতে চা ঢালতে ঢালতে বার কয়েক আড়চোখে তাকালেন। কৌতূহল দমন করতে না পেরে বললেন,
' নতুন বিয়া করছেন নাকি মামা? মামি মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর।'
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
' দেখে বউ মনে হচ্ছে নাকি মামা?'
' তাই তো মনে হইতাছে। এতোদিন ধইরা দেখতাছি। একবার দেখলেই বুইঝা যাই কোনটা পাটক্ষেত আর কোনটা গইঞ্চা ক্ষেত।'
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
' গইঞ্চা ক্ষেত কি?'
শুভ্র ভাই জবাব না দিয়ে হাসলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
' চা'টা কিন্তু অস্থির বানিয়েছ মামা। মামি বোধহয় চা খেয়েই ফিদা।'
দোকানী পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসলেন। শক্তপোক্ত তামাটে চমড়াই ঈষৎ লজ্জার ছায়া। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। ঠান্ডা শিরশিরে বাতাসে বুক ভরে এলো। শুভ্র ভাই চা শেষ করে অল্প কিছুক্ষণ ফোন ঘাটাঘাটি করলেন। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
' চল। মামা আসি।'
দোকানী বিগলিত হেসে বললেন,
' আইচ্ছা।'
টং দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতেই সামনে এসে দাঁড়াল একটি রিক্সা। শুভ্র ভাই কোনো ভূমিকা না করেই রিক্সায় ওঠে বসলেন। উনার ভাবভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে রিক্সাটা যে এখানে পাবেন তা উনার আগে থেকেই জানা বা রিক্সাটা হয়তো আমাদের জন্যই বরাদ্দ।
' আর হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। বলদের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে ওঠে আয়। জলদি।'
আমি উঠে গেলাম। ফাঁকা রাস্তায় টুনটান শব্দ তুলে ছুটে চলল রিক্সা। কনকনে শীতের বাতাসে শুভ্রময় সুবাস। আকাশ ভরা তারা আর বিরাট এক চাঁদ। জ্যোৎস্নায় মাখামাখি দালান-কোঠা। পিচে ঢালা রাস্তা। মনের মাঝে অন্যরকম এক স্বস্তি। শম্ভুগঞ্জ বিজ্রের ওপর রিক্সা থামল। ঘড়িতে কয়টা বাজে জানা নেই। হয়ত শেষ প্রহর চলছে। শুভ্র ভাই আমাকে নিয়ে নেমে দাঁড়ালেন। ব্রিজের রেলিং ঘেঁষে বেশ দূরত্ব রেখেই দাঁড়ালেন। আমি বিস্মিত চোখে নদী দেখছি। জ্যোৎস্নার আলোয় নদীর কি অলৌকিক রূপ! আমি চোখ ঘুরিয়ে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তিনি আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। চোখে চোখ পড়ল। শুভ্র ভাই চোখ সরালেন না। তার গম্ভীর, গভীর দৃষ্টি আমার চোখে-মুখে ঘুরতে লাগল। অস্বস্তিতে কাটা হয়ে উঠল শরীর। শুভ্র ভাই চোখের ইশারায় সামনের দিকে তাকাতে বললেন। উনার দৃষ্টি লক্ষ্য করে সামনের দিকে তাকালাম। নদীর ঠিক মাঝ বরাবর চোখ যেতেই থমকে গেলাম আমি। নদীতে মাটির প্রদীপ ভাসছে। একটা দুটো নয়। অসংখ্য প্রদীপ। প্রদীপের হলদে আলো নদীর পানিতে প্রতিফলিত হয়ে জ্বলজ্বল করে উঠছে। প্রদীপগুলোর দু'পাশে দুটো নৌকা। দুই নৌকা থেকে দুটো হাত একে একে সাজাচ্ছে সেই প্রদীপ। প্রদীপগুলো ধীরে ধীরে নতুন রূপ নিলো। নদীর বুকে আলো ঝলমলে রোদপাখি লেখাটা ভেসে উঠল। ঠিক তার নিচেই ভাসলো আরো একটা শব্দ 'ভালোবাসি'। আমি বিস্ময়ে মুখ চেপে ধরলাম। উথালপাতাল আনন্দ নিয়ে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাইয়ের মুখ-চোখ স্বাভাবিক। আমাকে তাকাতে দেখে কপাল কুঁচকে বললেন,
' বাপরে! শহরের আনাচে কানাচে প্রেমিক জুটিয়ে ফেলছিস দেখছি। নদীতেও রোদপাখি। আকাশেও রোদপাখি। কাহিনী কী?'
তার ইশারায় আকাশের দিকে তাকালাম আমি। নৌকা থেকে ফানুশ উড়ানো হচ্ছে। জ্যোৎস্নার আলো ছাপিয়ে হলদে আলোয় ছেঁয়ে গেছে ঝাপসা অন্ধকার। আমি কয়েক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম। বুকের খাঁচায় আটকে থাকা মনটা চেঁচিয়ে উঠে বলল,
' এমনটা কখনই হয় নি। এতোগুলো সুপ্ত ইচ্ছে কখনও তো একসাথে পূরণ হয় নি। হঠাৎ এতোটা ভালোলাগা তো কেউ উপহার দেয় নি। এটাই প্রথম।'
আমি বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। পৃথিবীটা হঠাৎ করেই খুব বেশি সুন্দর হয়ে উঠল। ফানুসগুলো অদূরে হারিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি নির্ণিমেষ তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর হাতে শুভ্র ভাইয়ের আলতো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম। শুভ্র ভাই ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন,
' এই? এমন পাবদা মাছের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মরে টরে যাস নি তো?'
আমি হাসিমুখে তাকালাম। কোনো এক অদ্ভুত কারণে শুভ্র ভাইয়ের অদ্ভুত কথাগুলোও ভীষণ ভালো লাগছে। অযথায় খিলখিল করে হাসতে ইচ্ছে করছে। জন্মদিনের প্রথম প্রহরটাকে খোঁদাই করে রেখে দিতে ইচ্ছে করছে বুকের গুপ্ত কোনো পাটাতনে। শুভ্র ভাই ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘড়ি দেখলেন। চিন্তিত গলায় বললেন,
' এতো হাসি দেখিয়ে লাভ নেই। এসব কিছু আমি করি নি।'
আমি আবারও হাসলাম। শুভ্র ভাই কপাল কুঁচকে বললেন,
' পাগল নাকি? অযথা হাসছিস কেন? চল। অল মোস্ট দুটো বাজে।'
শুভ্র ভাই আমার হাত ধরে রিক্সায় ওঠে বসলেন। কেউ কোনো কথা বলছি না। ফাঁকা রাস্তায় কনকনে বাতাস ভেদ করে ছুটে চলছে রিক্সা। শুভ্র ভাই বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন। উনার এই তাকানোতেও ভীষণ হাসি পাচ্ছে আমার। স্পৃহাদের বাসার কাছাকাছি আসতেই নড়েচড়ে বসলেন শুভ্র ভাই। গেইটের সামনে রিক্সা থামল। আমি রিক্সা থেকে নামতেই রিকশাওয়ালা মামা বেশ কয়েকটা গোলাপ এগিয়ে দিলেন। সাথে দিলেন ধবধবে সাদা এক লেফাফা। আমি ইতস্তত করে ফুল আর লেফাফাটা নিলাম। শুভ্র ভাই ডানপাশে চেপে বসলেন। রিক্সা থেকেই হাতটা চেপে ধরে কাছে দাঁড় করালেন। খানিকটা ঝুঁকে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন,
' হ্যাপি জানুয়ারি রোদপাখি। তোমার জীবনটা জানুয়ারিময় হোক।'
আমি কপাল কুঁচকে তাকালাম। কোনো প্রশ্ন করার আগেই রিক্সা ছুটলো। মুহূর্তেই হারিয়ে গেল মোড়ের বাঁকে। আমি দ্রুত পায়ে বাড়িতে ঢুকলাম। গেইটটা এখনও খোলা। আমি তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। বান্ধবীরা বিছানায় আকাঁ বাঁকা হয়ে শুয়ে আছে। আমাকে রুমে ঢুকতে দেখেই সব কটা সরু চোখে তাকাল। ছামি চেঁচিয়ে উঠে বলল,
' মহারাণীর আগমন শুভেচ্ছার স্বাগতম। কুত্তা। যাবি তো যাবি কেকটা কাইটা যেতে পারলি না? আমরা একা একাই কেটে ফেলছি।'
আমি অপরাধীর দৃষ্টিতে তাকালাম। স্পৃহা হাই তুলতে তুলতে বলল,
' ফ্রেশ টেশ হয়ে বাঁশ খাওয়ার জন্য রেডি হয়ে আয় যা। তোকে সাময়িক বিরতি দেওয়া হলো।'
আমি দ্রুত পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। আঁচলের নিচ থেকে ফুল আর লেফাফাটা বের করলাম। ফুলগুলো ভেসিনের ওপর রেখে লেফাফা খুললাম। লেফাফার ভেতর লম্বা একটা চিঠি। তাতে লেখা,
' "তখন ২০১৭ সাল। জানুয়ারি মাসের শীতটা জমে এসেছে মাত্র। চট্টগ্রাম থেকে ফিরেছি দু'দিন হলো। হঠাৎই আম্মু এসে বললেন, ' শুভি? তোর কোনো পছন্দ আছে?' আমি মনে মনে অবাক হলেও হেসে বললাম,' কেন? বিয়ে টিয়ে করাবে নাকি? মাত্র থার্ড সেমিস্টার সো ওসব চিন্তা করো না।' আম্মু বললেন, 'আরে ধুর! বিয়ে করাব কেন? অন্য একটা কথা আছে। আগে বল, পছন্দ আছে নাকি নেই?' আমি হাতের ফোনটা পাশে রেখে হাসিমুখেই বললাম, 'নেই।' সাথে সাথেই কিশোরী মেয়েদের মতো খুশি হয়ে উঠলেন আম্মু। তার আনন্দে ঢাকা মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, ছেলের পছন্দ না থাকার মতো আনন্দময় ঘটনা এই দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি ঘটতে পারে না। কিছুক্ষণ হাসি হাসি মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা পাড়লেন, ' শুভি? ফোনটা রেখে মায়ের কথাটা মনোযোগ দিয়ে শোন। মা তো তোর একটাই তাই না?' আম্মুর কথায় দমফাটা হাসি হাসলাম আমি। হাসতে হাসতেই বললাম, ' কি বলবা বলে ফেলো। এতো পেচিয়ে পুচিয়ে বলার প্রয়োজন নেই।' আম্মু আর পেঁচালেন না। খুব সহজ সরল ভাষায় জানালেন তিনি পুত্রবধূ হিসেবে অসাধারণ একটা মেয়ে পছন্দ করেছেন। যাকে বিয়ে না করলে আমার জীবনটা ব্যর্থ হলেও হতে পারে। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, 'হঠাৎ বিয়ে নিয়ে পড়লা কেন? বুঝলাম না। আমি এখন বিয়ে টিয়ে করতে পারব না।' আম্মু ভীষণ উৎসাহ নিয়ে বললেন, 'তোকে আমি একবারও বলেছি যে বিয়ে কর? আমি শুধু মেয়ের কথা বলছি। বিয়ের কথা নয়। তোর কাজ হলো প্রেম করা। তারপর যখন ইচ্ছে হবে তখন বিয়ে করবি, ব্যস।' আমি হতভম্ব চোখে আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কোনোরকম জিগ্যেস করেছিলাম, 'মেয়েটা কে?' আম্মু বেশ আগ্রহ নিয়ে মেয়ের অতীত,বর্তমান, ভবিষ্যৎ, হাঁটা-চলা, ঘুম সব বিশ্লেষণ করলেন। আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, ' অসম্ভব। তুমি পাগল হয়ে গিয়েছ মা। ওই বাচ্চাটা? আল্লাহ! কি বলছ? প্লিজ আম্মু, এসব পাগলামো বন্ধ করো।' আম্মু পাগলামো বন্ধ করলেন না। পৃথিবীতে হয়ত তিনিই প্রথম মা যিনি প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে প্রেমে পড়ার জন্য হাজার হাজার মাসলা দিলেন। কিন্তু কাজ হল না। আমি প্রেমে পড়লাম না। অবশেষে সেই ঠান্ডার রাতেই আমাকে বগল দাবা করে নিয়ে গেলেন মেয়ে দেখাতে। মনে মনে আমি তখন প্রণোদ গুণছিলাম। 'আমার প্রেমিকা আছে' এই ছোট্ট মিথ্যাটা বলতে না পারার জন্য নিজেকেই গালি দিচ্ছিলাম। মেয়ের বাড়ি বেশি দূরে নয়। আমার একমাত্র ফুপুর বাড়িতেই তার বসবাস। কাকতালীয়ভাবে ফুপির বাড়ির এই মেয়েটির সাথেই আমার দেখা সাক্ষাৎ নেই প্রায় অনেক বছর। আমি যখন বাসার বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করছিলাম, আম্মুকে বিরাট এক ধমক দিয়ে এসব পাগলামো বন্ধ করতে বলব ঠিক তখনই ছোট্ট একটা মেয়ে দরজা খুললো। আমার মায়ের সাথে অল্প কিছুক্ষণ জড়াজড়িও করল। আমি যে হুট করেই গায়ে কালো সুয়েটার আর মাথায় টুপি পরা মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেলাম তেমনটা নয়। মেয়েটা ভীষণ ছোট। তাকে দেখে আমার প্রথম ভাবনাটা ছিল, এই পিচ্চির গালগুলো নিশ্চয় খুব নরম হবে? তারপর, সময় করে জানলাম এই সেই পিচ্চি যাকে পুত্রবধূ হিসেবে না পেলে আমার আম্মুর জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। আমাকে এটা সেটা বুঝিয়ে মিনিটে মিনিটে মারা যাচ্ছেন। আমি মেয়েটাকে বেশ খেয়াল করে দেখলাম। সুন্দরী নয় মিষ্টি। চোখে-মুখে উপচে পড়া মায়া। তবে বয়স নিতান্তই অল্প। এই ১৪/১৫ হবে। আমি কোনো আকর্ষণ বোধ করলাম না। প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা আমার মাথাতেই এলো না। তবে প্রবল আগ্রহ হলো। যে মেয়ের জন্য মায়ের এতো পাগলামো তাকে জানার আগ্রহ হওয়াটা স্বাভাবিক। আর সেই আগ্রহটাই আমার কাল হলো। জানুয়ারি পেরিয়ে ফেব্রুয়ারিতে এসেই বুঝতে পারলাম ঘটনা ঘটে গিয়েছে। আম্মুর রোগ আমার মধ্যেও ছড়িয়ে গিয়েছে এবং তা সময়ের সাথে সাথে আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। আজ ২০২১। সেই জানুয়ারি মাস। রোগটা এখন রক্তে রক্তে মিশে গিয়েছে আমার। চারটা বছর ধরে ছিন্নভিন্ন রোগে আহত হচ্ছি। মরছি। ভাঙছি। ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েও তাকে চাইছি। শুধুই তাকে চাইছি। এই রোগটা খুব প্রিয় আমার। এই অপেক্ষা, এই দূরত্ব সব কিছুতেই প্রিয়তার স্বাদ। সেই সাথে প্রিয় এই জানুয়ারিটাও। এই রোগময় গোটা জানুয়ারিটা। রোদপাখি? তুমি কি আমার জানুয়ারি হবে? ব্যক্তিগত জানুয়ারি? যে জানুয়ারিটাকে কুয়াশার মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখব। সকালের সোনালী রোদের মতো অসহ্য মিষ্টি কিছু আবদার রাখব। এই মেয়ে?হবে কি আমার জানুয়ারি? একান্তই ব্যক্তিগত জানুয়ারি?'
আমি চিঠিটা উল্টেপাল্টে দেখতেই চোখ পড়ল গোলাপের পাতায়। ভ্রু কুঁচকে ফুলগুলো তুলে নিয়ে সূক্ষ্ম চোখে পাতাগুলোর দিকে তাকালাম। প্রত্যেকটা পাতায় সাদা কালীতে লেখা ' আই ওয়ান্ট টু কিস ইউ!' বাক্যটা পড়েই থতমত খেয়ে গেলাম আমি। চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। তারপর লজ্জায় চোখমুখ লাল হয়ে এলো। ছিঃ কি বিশ্রী কথা! উনি এতো বিশ্রী কথা বলতে পারেন? এতোটা? ছিঃ কখনোই না।
'আকস্মিক' শব্দটাই বড় গোলমেলে। হুটহাট ঘটে গিয়ে আলগোছে অগোছালো করে দেয় সব। জমাট বাঁধা প্রশ্নগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভ্রান্ত করে দেয়। আমাকেও করল। হঠাৎ এক রাতে আকস্মিক এক ঘটনা ঘটে গেল। শুভ্র ভাই আর আমার মাঝে বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই, তা সত্য। আবার কোথাও একটা অনেক কিছু আছে, সেটাও সত্য। সেই অনেককিছুর মাঝেই ভয়ানক এক প্রশ্ন উঠল। আমি ভীত হলাম,উদভ্রান্ত হলাম। কিন্তু কেন হলাম? জানা নেই। বয়সের দোষ? অপরিপক্কতা? নাকি অন্যকিছু?
শীতের রাত। রাতের খাওয়া শেষ করে মাত্রই কম্বল মুড়িয়ে শুয়েছি। ঘড়িতে দশটা কি এগারোটা বাজে। ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটল। অপরিচিত এক নাম্বার থেকে কয়েকটি দীর্ঘ ম্যাসেজ এলো। তাসনিম আপুর ম্যাসেজ। আমি বিস্মিত হলাম। কৌতূহলী হলাম। কিন্তু কিছুটা পড়েই বুকের কোথাও চিনচিনে ব্যথা, অদ্ভুত এক ভয় আর চাপা কষ্ট কাজ করতে লাগল। উদ্ভ্রান্তের মতো কাঁদতে ইচ্ছে হল। আমি আবারও তাসনিম আপুর লেখাটা পড়লাম। তিনি লিখেছেন,
' রোদেলা, তুমি খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে। খুবই বাচ্চা। কিন্তু আমি তোমাকে মেনে নিতে পারছি না। আমাকে ভুল বুঝো না, প্লিজ। সবকিছুর পেছনেই কারণ থাকে, তাই না? তোমাকে আমার মেনে নিতে না পারার পেছনেও হয়ত আছে। অবশ্যই আছে। শুভ্র তোমাকে আমার সম্পর্কে কিছু বলেছে কি-না জানি না। না বলার সম্ভবনাটাই হয়তো বেশি। আমার বয়স তখন খুবই অল্প। পনেরো কি ষোল হবে। বাচ্চামো আর চঞ্চলতায় ভরপুর এক কিশোরী। আমার সেই জীবনটাতে কোনো কষ্ট ছিল না। বাবা-মার একমাত্র মেয়ে আমি। বাবা ডাক্তার। সম্ভ্রান্ত বংশ পরিচয়। আদর, ভালোবাসা, বন্ধুমহল সব দিক থেকেই আমি সুখী। কিন্তু এই সুখের জীবনটা বেশিদিন টিকল না। সুখটাকে তছনছ করে, আমার ছোট্ট জীবনটায় এলো শুভ্র। তোমার শুভ্র ভাই। শুধু এসেই ক্ষান্ত হলো না। কিশোরী মনের প্রবল ভালোবাসা নিয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য করল। আমি ওকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেললাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে। এতো এতো মেয়েদের মাঝে এই আমাকেই প্রোপোজ করল শুভ্র। আমাকেই ভালোবাসলো। শুভ্রর মুখে ভালোবাসার কথা শুনে আমি যেন হাওয়ায় উড়তে লাগলাম। সারাটা রাত বুকে বালিশ চেপে কাঁদলাম। হাসলাম। নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সুখী মনে হচ্ছিল সেদিন। যার একটা শুভ্র আছে সে কী সুখী না হয়ে পারে, বলো? আমি ছোট্ট থেকেই টিপিক্যাল বাঙালি মেয়ে, রোদেলা। ভীষণ আবেগী আর রক্ষণশীল। তবুও রক্ষণশীল চিন্তাভাবনার গন্ডি পরিয়ে, সেই প্রথম আমি শুভ্রর হাত ধরলাম। ধুরু ধুরু বুক নিয়ে সিনেমার হলে পা রাখলাম। ওসব আমার জন্য প্রথম ছিল। অন্যরকম ছিল। তবু আমি করেছিলাম। কারণ একটাই ,শুভ্রর মন রাখা। কিন্তু এক সপ্তাহের মাথায় সব যেন থমকে গেল। শুভ্র হঠাৎই জানাল, তার আর আমার সঙ্গ ভালো লাগছে না। আমাদের আর না এগুনোই ভালো। তার ব্রেকআপ চাই। কথাটা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম রোদেলা। আমি ওই অতটুকুন মেয়ে, ওই অতটুকুন বয়সে বুক উজাড় করা ভালোবাসা নিয়ে প্রত্যাখাত হলাম। আমার রঙিন দুনিয়াটা ভেঙে গেল। আমি শুভ্রকে রিকুয়েষ্ট করলাম। শুভ্র আমাকে বুঝাল, তার মন থেকে আসছে না। জোর করে কিছু হয় না। অসহায় আমি শুভ্রকে আমার ভালোবাসাটা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। শুভ্র একদমই আলাদা ধাঁচের মানুষ। ওর সিদ্ধান্ত হের ফের করার ক্ষমতা হয়তো সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কারো ছিল না। আমারও না। আমার থমকে যাওয়া পৃথিবীটা ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে এলো। আমার রিস্ট্রেক্টিক ফ্যামিলি ব্যাপারটা জেনে গেল। ম্যান্টাল প্রেসার বাড়ল। আমি এতোটাই ডিপ্রেশড হয়ে পড়লাম যে সুইসাইড এট্যাম্প করা ছাড়া অন্যকোনো রাস্তা পেলাম না। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত বেঁচে গেলাম। বাবা তখন দিশেহারা হয়ে পড়লেন। শুভ্রর সাথে কথা বললেন। কি কথা বললেন জানি না। তবে শুভ্র খুবই অদ্ভুত এক কাজ করলো। বাসায় এসে কোনো কথাবার্তা ছাড়াই আমার গালে ভয়ানক এক চড় বসালো। বাবা-মা হতভম্ব। চোখে-মুখে অবিশ্বাস। একটা ছেলে এতোটা বেয়াদব আর অসভ্য কি করে হতে পারে? কিন্তু শুভ্র তো এমনই। বেপরোয়া। অসহ্য। সেই সাথে পাগল করা। কখনো ভীষণ ভালো তো কখনো ভয়ানক খারাপ। সেদিন রাতে কষ্টে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। শুভ্র চড় মেরেছে বলে নয়। ওই বেপরোয়া, অসভ্য ছেলেটাকে আমি পেতে পারছি না বলে। করলামও তাই। এক গাদা ঘুমের ঔষধ খেলাম। কিন্তু এবারও...এবারও এই নষ্ট ভাগ্যের অজুহাতে বেঁচে গেলাম আমি। শুভ্র তার সিদ্ধান্তে অটল রইল। আমায় ভালোবাসলো না। চোখ তুলে তাকালও না। একটা খোঁজ পর্যন্ত নিল না। তুমিই বলো, মানুষের কি এতোটা পাষাণ হওয়া সাজে? কিন্তু শুভ্রর সাজল। আর এই পাষাণ, নির্বিক শুভ্রকে আমি আরো বেশি ভালোবেসে ফেললাম। সেই সাথে আমার অসুখটাও বাড়লো। এই শুভ্রময় অসুখে থিতু হয়ে রইলাম পরবর্তী নয় নয়টা বছর। আমি খুবই দুর্বল মনের মানুষ রোদেলা। শুভ্রহীন জীবনটা আমার সহ্য হয় না। এই নয়টা বছর কি নিদারুণ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি তা কি তুমি উপলব্ধি করতে পারছ রোদেলা? তুমি এখন যে বয়সটাতে আছো। তার থেকেও দু-তিন বছরের ছোট ছিলাম আমি। সেই ছোট্ট, অপরিণত বয়সে কতটা ব্যথা হতে পারে বুঝতে পারছ? আমার সেই ব্যথাটা দিনের পর দিন বাড়ছে। এই ব্যথার কষাঘাতে এই নয় বছরে আরো বার দুয়েক আত্মহননের চেষ্টা করেছি আমি। মুক্তি চেয়েছি। কিন্তু, ওই যে? নষ্টভাগ্য!
তুমি নিশ্চয় ভীষণ ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখছ আমায়? কিন্তু এই ঘৃণাটা কি সত্যিই আমার প্রাপ্য? সবার জীবনই যদি একটা উপন্যাস হয় তাহলে আমার জীবনের পাতাগুলোই এতোটা শূণ্য কেন, বলতে পারো? আমিই কেন ভালোবাসাটা পেলাম না? শুভ্র আমাকে ভালোবাসতে গিয়েও কেন ভালোবাসল না? বুক উজাড় করে ভালোবেসেও 'তৃতীয়ব্যক্তি' উপাধিটা কেন আমিই পেলাম? কেন-ই-বা কিছু কিছু মানুষের নজরে ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠলাম?
আমার জীবনের প্রতি আমার অনেক অভিযোগ রোদেলা। আমি এই অভিযোগগুলো তোমার ঝুলিতে ঢেলে দিতে চাই। আমি জানি না, তুমি কে। শুভ্রর কতটা জুড়ে আছো। কিন্তু কোথাও একটা আছো। আর আছো বলেই ওর ভয়। আমি সেদিন শুভ্রর চোখে ভয় দেখেছিলাম। তোমার নুপুরহীন, শূন্য পায়ের দিকে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলাম। আমার ভাবনাটা যদি সঠিক হয় তাহলে আমি ভীষণ স্বার্থপরের মত চাইব, শুভ্র ভেঙে গুড়িয়ে যাক। ওর ভয়টা সত্যি হোক। ওর পাষাণ হৃদয় বুঝুক সেই কষ্ট। তোমার মৃত্যু হোক। আল্লাহ নাকি সবার দোয়ায় কবুল করেন? আমার তো প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্ত, প্রতি ওয়াক্ত নামাযের পর ওই একটিই দোয়া থাকে। তবু তুমি মরবে না? জানি অদ্ভুত কথা বলছি। কিন্তু আমি চাই ব্যাপারটা সত্যিই ঘটুক। খুব জলদি ঘটুক।'
এটুকু পড়েই থমকে গেলাম আমি। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলাম। কি আশ্চর্য! একজন মানুষ নিরবিচ্ছিন্নভাবে, নিঃসংকোচে মৃত্যুকামনা করছে আমার। এই পৃথিবীর একটি মানুষের কাছে আমার মৃত্যুটাই বৃহৎ প্রাপ্তি। তার গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো সে আমার মৃত্যুকামনায় ব্যয় করছে। কথাগুলো ভাবতেই গা শিউরে উঠলো। আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম। ধীরে ধীরে সারা শরীরে বয়ে গেল মন খারাপের মেঘ। রাতে আমার ঘুম হলো না। অর্ধেকটা রাত কম্বলের নিচে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে রইলাম। গুমট মনটাই বাজতে লাগল একটাই বাক্য, 'তবুও তুমি মরবে না?' সত্যিই তো। তবুও আমি মরব না? অদ্ভুত এক খারাপ লাগায় সারা শরীর অবশ হয়ে এলো আমার। গলা শুকিয়ে এলো। হঠাৎ করেই মনে হলো, সত্যিই হয়তো খুব বেশিদিন বাঁচব না আমি। কিছুতেই না। ঘড়ির কাটা একটায় পৌঁছাতেই শুভ্র ভাইকে ফোন লাগালাম। দু'বারের মাথায় তিনি ফোন ধরলেন। অত্যন্ত ব্যস্ত গলায় বললেন,
' কি সমস্যা? কি চাই?'
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। হঠাৎ কি বলব বুঝতে পারলাম না। শুভ্র ভাইকে কখনোই খুব প্রয়োজন ছাড়া ফোন করা হয় নি। কিন্তু এই মুহুর্তে প্রয়োজনীয় কিছু মনে পড়ছে না। আচ্ছা? শুভ্র ভাইকে তাসনিম আপুর ব্যাপারটা বলা কি প্রয়োজনীয় কিছু হতে পারে?শুভ্র ভাই অধৈর্য্য গলায় বললেন,
' ঠাডিয়ে চড় লাগব একটা। ফাইজলামি চলছে? মাঝরাতে ফোন দিয়ে ভং ধরার মানে কি? কি বলবি বলে ফোন কাট।'
আমি কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে অত্যন্ত দুঃখী গলায় বললাম,
' সবসময় এতো নিকৃষ্ট ব্যবহার কেন করেন শুভ্র ভাই। চড়-থাপড়া ছাড়া কি আর কোনো শব্দ আপনার ডিকশনারিতে নেই? আজ বাদে কাল যদি মরে টারে যাই তখন কি হবে? '
শুভ্র ভাই অত্যন্ত স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
' কি হবে? মানুষ মরে গেলে যা হয় তাই হবে। জানাজা করে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হবে।'
শুভ্র ভাইয়ের উত্তরে হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। মাটি চাপা দিয়ে দিবে? এইটুকুই? আর কিছুই না? এজ আ কাজিন, তার বিন্দুমাত্র খারাপ লাগা কাজ করবে না? তার প্রাক্তোনের অভিশাপের ঠেলা সামলাতে না পেরে যে আমি মরে গেলাম, তাতে তার বিন্দুমাত্র আফসোস হবে না? এমন একটা অসহ্যকর মানুষের জন্য আমাকে মরে যেতে হবে? আমার এই মুহুর্তে তাসনিম আপুর জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে। বেচারা যে ভুল মানুষের জন্য বদদোয়া করে সময় নষ্ট করছে সেটা তাকে বুঝাতে ইচ্ছে করছে। শুভ্র ভাইয়ের যে আমার বাঁচা-মরা নিয়ে কোনো প্রকার যায় আসে না তা না বুঝিয়েই মরে যাওয়াটা ভীষণ অন্যায় হবে। শুভ্র ভাই আবারও ধমকে উঠলেন।
' সমস্যা কি তোর? মাঝরাতে ঢং লাগাইছিস কেন? দ্যাখ! আমি এখন এসাইনমেন্ট করছি। ভীষণ টিপিক্যাল কেস। গ্রাফ টাফ করতে গিয়ে মাথা ঘুরে যাচ্ছে। তাই থাপড়া না খেতে চাইলে ফোন দেওয়ার কারণটা বলে ফোন রাখ।'
শুভ্র ভাইয়ের কথায় দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। একটা মানুষ এতটা অসহ্যকর কি করে হতে পারে? এতটা বিশ্রী ব্যবহার কি করে করতে পারে? আমি থমথমে কন্ঠে বললাম,
' আপনি একটা অসহ্য, শুভ্র ভাই।'
' সেটা এর আগেও বহুত বলছিস। তারপর?'
' তারপর আপনার মাথা। একটা মেয়ে আপনাকে তার মরে যাওয়ার কথা বলছে আর আপনি তাকে নাচতে নাচতে মাটি চাপা দিয়ে দিচ্ছেন। মানবিকতা বলে কিছু নেই?'
শুভ্র ভাই মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে বললেন,
' মাঝরাতে আজাইরা আলাপ। কোন মেয়ে কোন দুনিয়ায় মরে যাচ্ছে তার জন্য কি এখন মানববন্ধন করতে বলিস তুই? শোন, বি প্রেকটিক্যাল। অতো মানবতা আসলে আমার নাই। কেউ ইচ্ছে করে মরে যেতে চাইলে তাকে আমি বড়জোর বুঝাতে পারি কিন্তু জোর করে বাঁচিয়ে রাখতে পারি না। তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও আমার না। আমার দায়িত্ব নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা আর আমার ঠিকঠাক বেঁচে থাকার জন্য যাদের বেঁচে থাকা দরকার তাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করা। এর বাইরে কে মরছে, কে বাঁচছে আই ডোন্ট কেয়ার।'
শুভ্র ভাইয়ের কথায় আবারও বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম আমি। কোন কথাটা আলোচনার মূখ্য বিষয় ছিল তাই ভুলে গেলাম। কিছুক্ষণ আকাশ পাতাল চিন্তা করে বললাম,
' আপনি খুবই হৃদয়হীন নিষ্ঠুর একটা মানুষ। আর যায় হোক, কাজিন হিসেবে আমার প্রতি একটু হলেও সহানুভূতি থাকা উচিত আপনার। আমার মৃত্যুর কথাটা শুনেই মাটি চাপা দেওয়ার জন্য উতলা হয়ে যাওয়াটা বোধহয় ঠিক না। মানুষের মৃত্যুর খবরে খুশি হতে নেই। আমি মরে যাওয়ার আগে আম্মুকে বলব আপনাকে যেন আমার মৃত্যু সংবাদ না জানানো হয়। আপনার মতো নিষ্ঠুর মানুষ হাসতে হাসতে আমার জানাজায় অংশ নিবে তা আমি চাই না।'
শুভ্র ভাই ক্লান্ত গলায় বললেন,
' মানে কি? ফাজলামো হচ্ছে? তুই কি মাঝ রাতে মশকরা করতে ফোন দিয়েছিস আমায়? আমার মেজাজ এমনিতেই ব্যাপক খারাপ। এসব আউলফাউল কথা বলে মেজাজ খারাপ ভাবটা বাড়াস না, প্লিজ। নয়তো সিরিয়াসলি চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব। মাথা পাগল মেয়ে।'
' আপনার মত একজন মানুষের জন্য আমি অলমোস্ট মারা যাচ্ছি তাতেই কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার।'
কথাটা বলেই ফোন কাটলাম আমি। ফোনটা পাশে রেখে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ তাসনিম আপুর ব্যথায় ব্যথিত হওয়ার চেষ্টা করলাম। চেষ্টা সফল হলো না। যে প্রতিনিয়ত আমার মৃত্যুকামনা করছে তার জন্য দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খাওয়ার কোনো কারণ নেই। আচ্ছা? আমি যদি তাসনিম আপুর জায়গায় থাকতাম তাহলেও কি এমনটাই করতাম? আমার ভোঁতা মস্তিষ্ক তুমুল প্রতিবাদ করলো, কক্ষনো না। আমি হয়তো ব্রেকআপের দিনই ঠাডিয়ে দুটো চড় লাগাতাম শুভ্র ভাইয়ের গালে। তারপর ধীরে ধীরে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতাম কিন্তু তাসনিম আপু যা করছেন তা তো রীতিমতো পাগলামো। আচ্ছা? এই অসহ্য মহিলাটা কি মেন্টালি সিক? এই মহিলা কি প্রতিদিন দু'হাত তুলে বলে, রোদেলা তুমি এই মুহুর্তে মরে যাও? কি সাংঘাতিক! তাহলে কি আমার উচিত
' আমি মরব না। মরব না।' বলে প্রার্থনা করা? আমার উলোটপালোট চিন্তার মাঝেই ফোন বাজল। আমি ফোনটা সাইলেন্ট করে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একবার, দুইবার, তিনবার। ঠিকঠাক দশবারের মাথায় ফোন তুললাম আমি। এতো ধৈর্য্য সহকারে ফোন করে যাওয়া মানুষটি অত্যন্ত উচ্ছল গলায় বললেন,
' কি অবস্থা রোদপাখি? কেমন আছিস?'
কেমন আছি, মানে কি? একটু আগে মহিষের মতো আচরণ করে এখন আমার কেমন থাকা-না-থাকার প্রশ্নটা ঠিক কতটুকু যৌক্তিক বুঝতে পারছি না। এই লোকের সমস্যাটা কি? উনি কি কিছুক্ষণ আগের ব্যাপারটা ভুলে গেলেন? এটা কি শর্ট টাইম মেমোরি লস টাইপ ব্যাপার? আশ্চর্য!
' কি রে? কথা বলছিস না কেন? কি অবস্থা? ভালো? নাকি খারাপ?'
আমি থমথমে কন্ঠে বললাম,
' আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই না। আপনি এই মুহুর্তে ফোন কাটুন।'
শুভ্র ভাই স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
' তোর ধান্দাবাজ বাপ কি ঘুমিয়ে পড়েছে? নাকি এখনও ভূতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে?'
আমি শক্ত কন্ঠ বললাম,
' আপনি আবার বাবাকে টেনে কথা বলছেন! একদম বাবাকে নিয়ে বাজে কথা বলবেন না।'
' আচ্ছা যা। সুন্দর করে বলছি। তোর শ্রদ্ধীয়, নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক পিতা মহোদয় কি এখনও জেগে আছেন? নাকি ভূতগ্রস্তের মতো ঘরময় পায়চারি করছেন?'
আমি ফুঁসে উঠে বললাম,
' আপনি ফাজলামো করছেন? আমার বাবাকে নিয়ে মজা করবেন না বলে দিচ্ছি।'
শুভ্র ভাই ভারি ইনোসেন্ট কন্ঠে বললেন,
' এই যা! তুই তো ব্যাপক জিনিস রে রোদু। কত সুন্দর শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে প্রশ্ন করলাম। তুই সেই শ্রদ্ধাবোধটাকে একদম ফাজলামো বানিয়ে ফেললি? কাজটা একদম ঠিক করিস নি তুই। আল্লাহ কষ্ট পাবে।'
' আপনি খুবই খারাপ একজন মানুষ। সবসময় আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। আমি আপনার সাথে কথা বলব না। আপনি ফোন রাখুন।'
শুভ্র ভাই বললেন,
' কথা বলতে হবে না। ছাঁদে আয়। আসার সময় এন্টিসেপটিক আর তুলো আনিস। হাতে পায়ে কেটে গিয়েছি। রক্ত পড়ছে।'
আমি বিস্মিত কন্ঠে বললাম,
' মানে কী? কোন ছাঁদের কথা বলছেন আপনি? আর রক্তই বা পড়ছে কেন?'
শুভ্র ভাই বিরক্ত গলায় বললেন,
' তুই অত্যন্ত বেশি প্রশ্ন করিস। অতিরিক্ত প্রশ্ন করা আমার পছন্দ না। ফোনে তো একদমই না। আমি তোদের ছাঁদে আছি, ছাঁদে আয়। গেইট বন্ধ। দেয়াল টপকাতে গিয়ে কাটাতাঁরে হাত-পা চিঁড়ে গেছে। তোর বাপ চরম বেয়াদব। এক নাম্বারের ধান্ধাবাজ। কি দরকার ছিল দেয়ালে কাঁটাতার দেওয়ার? সবকিছু আমাকে ঘিরে ষড়যন্ত্র।'
আমি রাগে ক্লান্ত গলায় বললাম,
' আবার বাবা! আপনার সমস্যাটা কোথায়? শখ করে দেয়াল টপকে হাত-পা কেটে বাবাকে দোষ দিচ্ছেন কেন? বাবা কি বলেছিল দেয়াল টপকাতে? আপনি জোরপূর্বক দেয়াল টপকেছেন। আপনাকে তো পুলিশে দেওয়া উচিত। এই মুহুর্তে থানায় ফোন দিব আমি।'
' তোর কাছে তো থানার নাম্বারই নেই গর্দভ। তোর মতো গর্দভের কাছে কখনোই থানা-পুলিশের নাম্বার থাকে না। এ্যাম্বুলেন্সের নাম্বারও থাকে না। তোদের ফোনলিস্ট ওলওয়েজ কিছু ইডিয়ট বন্ধুবান্ধবের মা, বাবা, বোন, চাচা, জ্যাঠা, চৌদ্দগোষ্ঠীর নাম্বারে বোঝাই থাকে।'
আমি অসহায় মুখ নিয়ে বসে রইলাম। শুভ্র ভাইয়ের কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে না। আমার কাছে সত্যি সত্যিই থানা পুলিশের নাম্বার নেই। ফোনে থানার নাম্বার না থাকায় যদি কাউকে গর্দভ বলা যায়। তাহলে আমি নিঃসন্দেহে একটা গর্দভ। কথাটা ভেবে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। শুভ্র ভাই হঠাৎই ভীষণ মায়া মায়া কন্ঠে বললেন,
' কোনো দয়া নেই না? এই যে আমার শরীর থেকে রক্ত পড়ে ভেসে যাচ্ছে তবু তুই তুলো টুলো নিয়ে ছুটে আসছিস না। অন্যকেউ হলে কিন্তু ঠিক আসতো। কি নিষ্ঠুর তুই।'
আমি কয়েক সেকেন্ড থমথমে মুখে বসে থেকে বললাম,
' আমি যাব না।'
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
' ঠিক তো? আচ্ছা।'
'যাব না' বলেও না গিয়ে থাকা গেল না। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক পায়চারী করে মস্তিষ্কের বিপক্ষে গিয়েও ছাঁদের দিকে পা বাড়াতে হলো। ডাইনিং এ থাকা ছাঁদের চাবিটা তুলে নিয়ে সাবধানী পায়ে বেরিয়ে গেলাম। শুভ্র ভাই ছাঁদের রেলিং-এ বসে রুমাল দিয়ে হাত বাঁধার চেষ্টা করছেন। দরজা খোলার শব্দ শুনেই ফিরে তাকালেন। হাতদুটো পকেটে ঢুকিয়ে রেলিং থেকে নেমে দাঁড়ালেন। সাথে সাথেই কুঁচকে গেল তার চোখ-মুখ৷ আকাশে তখন বিশাল চাঁদ। চারদিকে ঘন কুয়াশার সাদা সাদা কুন্ডলী। ছাঁদের পাটাতনে বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝড়ে পড়ছে একটা দুটো শিশির ফোঁটা। শুভ্র ভাইয়ের গোছালো চুলগুলো নিয়ম মেনেই কেঁপে কেঁপে উঠছে। চাঁদের চকচকে আলোয়, গোলাপী শার্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে পৃথিবীর বাইরের কেউ বলে বোধ হচ্ছে। একদম স্বচ্ছ, পবিত্র কেউ। শুভ্র ভাইয়ের এই বিস্ময়কর রূপ দেখতে দেখতে হঠাৎই মনে হলো, এই ছেলেটাকে না পাওয়ার দুঃখে বেদুইন হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে জাগাটা দোষের কিছু নয়। মরে যাওয়ার ইচ্ছেটা তো আরো নয়। আমি কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন ছুঁড়লাম,
' এতো রাতে এখানে কেন এসেছেন? তাও আবার লুকিয়ে চুরিয়ে?'
শুভ্র ভাই অস্বস্তি নিয়ে তাকালেন। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে এদিক ওদিক উদাসী দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই তার বামগালের মোহনীয় গর্তটা চোখে পড়ল।
' হঠাৎ ভয় করছিল।'
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
' কিসের ভয়?'
শুভ্র ভাই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দায়সারা কন্ঠে বললেন,
' জানি না।'
' বাসায় ভয় পাচ্ছিলেন আর এখানে আসতে ভয় পেলেন না? রাস্তায় যদি ভূত টূত ধরত?'
শুভ্র ভাই প্রথম দফায় হতাশ চোখে তাকালেন। তারপর প্রচন্ড রাগ নিয়ে ধমকে উঠলেন। গলার স্বর খানিকটা নিচু করে বললেন,
' আমার জন্য অলমোস্ট মরে যাচ্ছিস মানে কি? কেন বললি সেই কথা?'
আমি জবাব দিলাম না। শুভ্র ভাই কয়েক পা এগিয়ে এলেন। প্রায় সাথে সাথেই জুতোই ল্যাপ্টে থাকা রক্তটুকু চোখে পড়ল আমার। আমি আৎকে উঠে বললাম,
' একি! আপনার পায়ে রক্ত। হাতও কেটেছে, না? রক্ত বন্ধ হয় নি? দেখি।'
শুভ্র ভাই সুন্দর করে হাসলেন। তার সুন্দর মুখটা মুহূর্তেই উচ্ছ্বাসে ভরে উঠল। ফোনের ফ্ল্যাশটা অন করে উনার পায়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললাম,
' হাসছেন কেন? ব্যথা পেলে কেউ হাসে?'
শুভ্র ভাই আবারও হাসলেন। বললেন,
' মাঝে মাঝে ব্যথা পেতে ভালোই লাগে।'
আমি ভ্রু কুঁচকে উপরে তাকালাম,
' ব্যথা পেতে ভালো লাগে?'
' হ্যাঁ লাগে। এখন পায়ের ওপর ঝুঁকা ঝুঁকি না করে উঠে দাঁড়া। তোর সাথে কথা আছে। কথাটা বলে চলে যাব। জলদি।'
আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে পকেট থেকে হাত বের করে কয়েক গাছি চুল টেনে ধরলেন। আমি ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে বাধ্য হয়েই উঠে দাঁড়ালাম। নিজের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে মুখ ফুলিয়ে তাকালাম। শুভ্র ভাই ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
' কাহিনী কি? আমার জন্য মরে যাচ্ছিস মানে কি?'
তারপর হঠাৎই খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে চোখ বড়বড় করে বললেন,
' এই? কোনভাবে তুই আমার প্রেমে টেমে পড়ে যাস নি তো? কি সাংঘাতিক! প্রেমে পড়ে সুইসাইড করতে চাইছিস? তোর বাপ তো আমায় জেলে দিয়ে দিবে রে।'
কথাটুকু বলে খানিকক্ষণ আকাশ-পাতাল চিন্তা করলেন শুভ্র ভাই। তারপর সিরিয়াস মুখভঙ্গি নিয়ে একরকম ফিসফিস করেই বললেন,
' শোন, সুইসাইড যেহেতু করবিই তাহলে যেনতেন উপায় অবলম্বন করে লাভ নেই। খুব ইউনিক কিছু চিন্তা করতে হবে, বুঝলি? যাতে সুইসাইড করার পর পরই সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোরণ পড়ে যায়। ধর, মরতে মরতে সেলিব্রিটি বনে গেলি। ব্যাপারটা দারুণ না? আর শোন, সুইসাইডের আগে কাগজে বড় বড় করে লিখে যাবি, " আমার অাত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়। ব্লা ব্লা ব্লা।" নয়তো...'
আমি হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলাম। বিস্ফারিত কন্ঠে বললাম,
' আপনি হাত-পায়ে রক্ত ঝরিয়ে, এই এতো রাতে আমাকে সুইসাইড করার ক্লাসিফিকেশন জানাতে এসেছেন শুভ্র ভাই? সত্যিই? আমি জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না।'
' আশ্চর্য! তুই ফোন করে বললি মরে যাবি। তাও আবার আমার জন্য। তুই ঠিকঠাক মরতে পারছিস কিনা সেটা দেখার দায়িত্বটা তো আমার, নাকি?'
রাগে সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল আমার। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
' আপনাকে কোনো দায়িত্ব দেখাতে হবে না শুভ্র ভাই। আপনার মতো হার্টলেস মানুষের জন্য সুইসাইড করার মানেই হয় না। সবাই কী আর আপনার প্রাক্তোনের মতো পাগল নাকি? নিজে সুইসাইড করছে তো করছে আবার আমাকেও মরে যেতে বলছে। আশ্চর্য!'
শুভ্র ভাই এবার সরু চোখে তাকালেন। চোয়াল শক্ত করে বললেন,
' তোকে মরে যেতে বলছে, মানে? তাসনিম কি তোকে সুইসাইড করার জন্য কুমন্ত্রণা দিচ্ছে নাকি? আশ্চর্য! তুই ওর কথা শুনছিস কেন? ওর যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে তাহলে সেটা আমার সাথে। তোর সাথে ওর যোগাযোগ থাকবে কেন?'
কথা বলতে বলতেই চোখ-মুখ শক্ত হয়ে এলো শুভ্র ভাইয়ের। ফর্সা মুখটা ঝাপসা অন্ধকারেও হয়ে উঠল টকটকে লাল। শুভ্র ভাই হেঁচকা টানে ডানহাতটা পেছন দিকে চেপে ধরে আমার দিকে তাকালেন। রাগে তার কন্ঠ কাঁপছে। সেই কম্পিত কণ্ঠেই বলে উঠলেন,
' ওর সাথে তোর যোগাযোগ কেন থাকবে? ওর কথায় মরার শখ জাগছে তোর? এতো সহজ মরে যাওয়া? প্রত্যেকটা মানুষ সারাটাক্ষণ বুক দিয়ে আগলিয়ে রাখছে তোকে। ভালোবাসছে। আর তুই বাইরের মানুষের কথায় নাচছিস? এতো মরার শখ? চল, আজ তোকে জ্যান্ত মাটিচাপা দিয়ে আসব আমি।'
ততক্ষণে ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে আমার। শুভ্র ভাইকে আমি যথেষ্ট চিনি। উনার রাগ মানেই ধ্বংসাত্মক কিছু। আমি কাতর চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনার দানবীয় হাতজোড়ায় আটকে থেকে প্রায়শই আমার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার জোগার। আমি উনার চোখে চোখ রেখেই বিপন্ন গলায় বললাম,
' আমি মরে যাব কখন বললাম? আমি দোয়া করি যেন আমি একশো বছর বাঁচি। শুধু একশো না প্রয়োজনে পাঁচশ বছর বাঁচব। আমার বেঁচে থাকতে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা তো তাসনিম আপুর। উনি চান আমি মারা যাই কিন্তু আমি চাই না আমি মারা যাই। উফ! আমি আপনাকে ব্যাপারটা বুঝাতে পারছি না। একটু ছাড়ুন। দমবন্ধ লাগছে আমার। আপনি এভাবে ধরে রাখলে পাঁচশ বছর তো দূর পাঁচ মিনিটও বেঁচে থাকতে পারব কিনা সন্দেহ।'
শুভ্র ভাই আমাকে ছেড়ে দিলেন। আমি শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজের হাতের দিকে তাকালাম। কব্জির ওপর নিশ্চয় দাগ বসিয়ে দিয়েছে এই লোক? অন্ধকারে হাতের ছাপটা দেখতে না পেলেও কব্জির ওপর উনার হাতের চটচটে রক্তের অস্তিত্ব ঠিকই টের পেলাম। শুভ্র ভাই ফুঁসে উঠে বললেন,
' তাসনিম কি বলেছে তোকে? ও চাই মানে কি? ও এমনটা চাইবে কেন? তুই ওকে কি করেছিস?'
' আমি কিছুই করি নি। যা করার আপনি করেছেন। আর কে কি চাইবে তা তো আর আমাদের হাতে নেই। তিনি আমার মৃত্যু চাইতেই পারেন। এটা সম্পূর্ণই তার ব্যাপার।'
শুভ্র ভাইয়ের মুখ আরো খানিকটা শক্ত হলো। তিনি থমথমে গলায় বললেন,
' এটা কখনোই সম্পূর্ণই ওর ব্যাপার নয়। ও এমন ফলিস কিছু চাইতে পারে না। আর যা করার আমি করেছি, মানে কি? কি করেছি আমি? সেই নয় বছর আগে, সাত দিনের প্রেমের জন্য এতোটা কাহিনী করার কি আদৌ কোন মানে আছে? আমি তাকে বাজে ভাবে টাচ করি নি, চুমু খাই নি, তার সাথে ঘুমাইও নি। পাঁচ মিনিটের জন্য হাত ধরেছিলাম হয়ত। তবুও শুধু ধরতে হয় বলেই ধরা। অথচ তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি তার সর্বনাশ করে দিয়েছি। চরম নাটকবাজ মেয়ে একটা। ছোটবেলায় ওকে চড় লাগিয়েছি বেশ করেছি। আরো দুটো দেওয়া উচিত ছিল।'
উনার কথায় ফিক করে হেসে উঠলাম আমি। উনার চোখে-মুখে বাচ্চামো অভিমান। আমাকে হাসতে দেখে কথা থামিয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ তাকিয়ে থেকে দুই পা এগিয়ে একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন। বিরবির করে কিছু একটা বললেন। তারপর আমার শরীরে পরপর তিনবার ফু দিলেন। উনার কাজে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম আমি। কৌতূহল নিয়ে বললাম,
' বিরবির করে কি বললেন? ভূত তাড়ানোর সূরা? আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?'
শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। পরমুহূর্তেই হেসে ফেলে বললেন,
' তোর মতো বলদ এই দুনিয়ায় দুটো আছে বা থাকতে পারে তা আমি বিশ্বাস করি না। আল্লাহ রোদপাখি নামক বলদ একটাই বানিয়েছেন। একদম ওয়ান পিস।'
আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। চোখ-মুখ ফুলিয়ে বামহাতে থাকা মেডিসিনের বাক্সটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,
' এই নিন আপনার এন্টিসেপটিক আর তুলো।'
শুভ্র ভাই বললেন,
' প্রয়োজন নেই।'
তার কন্ঠে কোথাও একটা অভিমানের সুর এসে ধাক্কা দিয়ে গেল। আমি উনার ডানহাতটা টেনে নিলাম। ডানহাতের এক জায়গায় বাজেভাবে কেঁটে গিয়েছে। অন্যহাত চোটহীন। আমি আরো একপা এগিয়ে গিয়ে এন্টিসেপটিক আর তুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম শুভ্র ভাই আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার চোখের ভাষা ভিন্ন। আমার মাথায় চট করেই গোলাপের পাতায় পাতায় লেখা ওই বাক্যটা খেলে গেল। আমি ধুরু ধুরু মনে হাতে ব্যান্ডেজ লাগালাম। কাজ শেষে যখন সরে আসার চেষ্টা করলাম ঠিক তখনই উপলব্ধি করলাম আমি আগে থেকেই শুভ্র ভাইয়ের বাহু বেষ্টনীতে আবদ্ধ। শুভ্র ভাইয়ের অন্যরকম দৃষ্টিটা তখন আমার চোখে-ঠোঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুভ্র ভাই মাথাটা নিচু করতেই পিলে চমকে উঠল আমার। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতেই এক ঝটকায় চোখ বন্ধ করলাম। শুভ্র ভাইয়ের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস নাকে-মুখে এসে ঠেকল। আর তপ্ত ঠোঁটদুটো এসে ঠেকল কপালে। কপালে গভীর এক চুমু দিয়ে মোহনীয় কন্ঠে আবৃত্তি করলেন,
' জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি
তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,
যতো পাই তোমায় আরো ততো যাচি
যতো জানি ততো জানি নে।'
শুভ্র ভাইয়ের কন্ঠ সবসময়ই সুন্দর, প্রাণোবন্ত। কিন্তু এই কবিতাটা আরো বেশি প্রাণোবন্ত লাগল আমার কানে। লজ্জায় মুখে লালাভ রঙ ছড়ালো। আমি চোখ মেলে তাকাব এমনটা সিদ্ধান্ত নিতেই ডানগালে তপ্ত ঠোঁটের স্পর্শ পেলাম। আমি চমকে উঠলাম। আমার শরীরের ওপর থেকে সরে দাঁড়াল সেই ছায়া মূর্তি। পরমুহূর্তেই অসহ্য সুন্দর কন্ঠস্বরটা ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
' শ্যামবতীকে ঘিরে থাকা হাজারও বদদোয়া গুলো শুভ্র চাদরে ঢাকা পড়ুক। হৃৎস্পন্দনের তালে তালে স্পন্দিত হওয়া পবিত্র দোয়াগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে দামী পাখিটির নামে লেখা হোক। আমার প্রাণভোমরার ছোট্ট শরীরটিতে নজর না লাগুক। পৃথিবীর সবটা সুখ শুধু তার খামেই লেখা হোক। আমিন।'
আমি বিস্ময় নিয়ে চোখ মেলে তাকালাম। ততক্ষণে শুভ্র ভাই রেলিং পেরিয়ে নেমে গিয়েছেন আম গাছের ডালে। সেখানে থেকে চোখের পলকেই দেয়াল টপকে শূন্য রাস্তায়। আমি দৌঁড়ে গিয়ে ছাঁদের রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। গোলাপী শার্ট গায়ে আশ্চর্য সুন্দর ছেলেটি হালকা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। শার্টের হাতা ভাঁজ করে রাখা ডানহাতের কব্জিটিতে সিলভার রঙের ঘড়িটা চকচক করছে। আমার মনের কোথাও একটা শীতল শিহরণ বইছে। নদীর কূলকূল ধ্বনির মতো নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বলে চলেছে,
' শুনছো রোদপাখি? তোমার অদ্ভুত এই পৃথিবীতে পাগলাটে এক শুভ্র আছে। তোমার এক পৃথিবী দুঃখ, ভয়, সংকোচগুলো তার ভয়ে সর্বদা তটস্থ। যার এমন এক পুরুষ আছে তাকে কি মানুষের ধ্বংসাত্মক চাহনীগুলো এক বিন্দুও ছুঁতে পারে?'
আমার ঠোঁটের কোণে অজান্তেই এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। অগোছালো মনটা মাথা চাড়া দিয়ে বলে,
' নাহ্। কক্ষণো না।'
চলবে...
Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা