> রোদ শুভ্রর প্রেমকথন স্পেশাল পর্ব ৩৬, ৪০ এবং শেষ পর্ব - Love Story Bangla - রোমান্টিক লাভ স্টোরি - Bangla Love Story - ভালোবাসার গল্প
-->

রোদ শুভ্রর প্রেমকথন স্পেশাল পর্ব ৩৬, ৪০ এবং শেষ পর্ব - Love Story Bangla - রোমান্টিক লাভ স্টোরি - Bangla Love Story - ভালোবাসার গল্প

আকাশের কোণে মেঘ জমেছে। ভীষণ কালো, আষাঢ়ে মেঘ। সেই সাথে মেঘ জমেছে আমার মনেও। গুমট আকাশে বৃষ্টি নামার পূর্বাবাস দিয়ে চারপাশটা নীরব, নিস্তব্ধ। এই মিথ্যে পৃথিবীর ছলাকলাময় নির্লজ্জ মানুষদের দ্বারা ত্যক্ত, বিরক্ত আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বুকের ভেতর উথলে উঠল কান্না। চোখ দুটোতে খেলে গেলো নিদারুণ অসহায়ত্ব। অন্ধকারে ঢাকা সুপ্ত মনটা কোথাও একটা নির্ভরতা খুঁজতে লাগল। বুকে মাথা রেখে কাঁদার জন্য শক্ত, প্রশস্ত একটা বুক খুঁজতে লাগল। এমন সময় পেছনে এসে দাঁড়াল দীর্ঘকায় একটি ছায়া। নাকে এসে লাগল সেই চির পরিচিত সুগন্ধ। বুকের ভেতর পুষে রাখা কান্নাগুলো মুহূর্তেই বাঁধনহারা হয়ে উঠল। আমি দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। পেছনে থাকা মানুষটি ধীর পায়ে পেছনে এসে দাঁড়াল। শীতল হাতজোড়া দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বললেন, 

' মন খারাপ? '

আমি অভিমানী কন্ঠে বললাম,

' আপনি আসেন নি। এই যে আমার সাথে দাঁড়িয়ে আছেন এটা শুধুই আমার কল্পনা। তাই না?' 

তিনি হাসলেন। বললেন, 

' হ্যাঁ তাই।' 

' আপনি চলে যান। কাল্পনিক আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।' 

আমার কথার জবাবে হাতের বাঁধন আরও খানিকটা শক্ত করলেন তিনি। অত্যন্ত নরম গলায় বললেন,

' উহুঁ। যাব না। সহ্য না হলেও যাওয়া যাবে না। তোমার কী হয়েছে বলো? কাঁদছ কেন?' 

' আপনি আমায় 'তুমি' বলে সম্বোধন করছেন কেন? আপনি তো আমায় 'তুমি' বলে সম্বোধন করেন না কখনো।' 

শুভ্র ভাই আমার খোলা চুলে মুখ ডুবালেন। শান্ত কন্ঠে বললেন, 

' কখনো 'তুমি' সম্বোধন করি না কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। চিঠি,ক্ষুদে বার্তা আর বিশেষ মুহূর্তে আমি তোমাকে তুমি বলেই সম্বোধন করি। তুমি খেয়াল করো নি বলে জানো না।' 

' এখন কি কোনো বিশেষ মুহূর্ত?' 

' উহুঁ। এখন কল্পনা। আমি তোমাকে কল্পনাতেও তুমি সম্বোধন করি রোদপাখি। তুমি বারবার ভুলে যাচ্ছ কেন বুঝতে পারছি না।' 

আমি উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম, জবাব দিলাম না। শুভ্র ভাই নড়েচড়ে বেশ আয়েশ করে জড়িয়ে ধরে প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আমার ডান কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বললেন, 

' লাল শাড়িতে সুন্দর লাগছে। একদম পরীদের মতো সুন্দর। পরীরা সবার চোখে পরী হলেও তুমি আমার ব্যক্তিগত পরী। আমার রোদপরী।' 

আমি হাসলাম। ঘুরে উনার দিকে ফিরে তাকালাম। শুভ্র ভাই শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ালেন। তার হাতদুটো এখনও আমার কোমরে আবদ্ধ। গভীর, শান্ত চোখদুটো মেলে আমাকে দেখছেন। বলিষ্ঠ গায়ে বাদামী রঙের পাঞ্জাবি। হাতাদুটো কনুই পর্যন্ত গোটানো। গালে ছোট ছোট দাড়ি। গায়ের ফর্সা রঙটা ঠান্ডায় মিষ্টি গোলাপি। থুঁতনির কাছের তিলটা ঘন কালো। আমি নিবিষ্ট চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দুহাতে উনার গলা জড়িয়ে ধরলাম। অকপট কন্ঠে বললাম,

' আমি আপনাকে মিস করছিলাম খুব।' 

উনি চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বললেন, 

' আমি হয়তো বুঝতে পারছিলাম।' 

' জানেন? আমার ভীষণ মন খারাপ। আমার মন খারাপ হলেই আপনার কথা মনে পড়ে। আপনি ছাড়া অন্য কেউ আমার মন ভালো করতে পারে না।'  

' কেন মন খারাপ? কেউ কিছু বলেছে?' 

' বললে কি করবেন? মারবেন তাকে?'

এবারে শব্দ করে হেসে উঠলেন শুভ্র ভাই। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো ফুঁ দিয়ে সরিয়ে নিয়ে বললেন, 

' তোমার কী ধারণা? আমি যাকে তাকে ধরে মাইর লাগাই?' 

আমি জবাব দিলাম না। শুভ্র ভাই আমার মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে বললেন, 

' সবসময় মাইর লাগানোর জন্য আমি থাকব না। সব মানুষ সারা জীবন থাকেও না। তাই বলে রোদ্রাণীকে উদাস হওয়া চলবে না। দুঃখী হয়ে ভেঙে পড়াও চলবে না। পৃথিবীতে অনেক নিচু মনের মানুষ আছে যাদের কাজই হলো অন্যের গাঁয়ে কাঁদা ছুড়ে অন্যকে কুলষিত করা, অপদস্ত করা। তাদের লোকলজ্জা নেই। ভয় নেই। তাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করেও লাভ নেই। তাই বলে এই নিয়ে মন খারাপ করে, কেঁদে কেটে নিজেকে পরাজিত আর একা ভাবতেও নেই।'  

আমি নীরবে তার কথা শুনছিলাম। তার
বুকের ধুকপুক শব্দ, শরীরের উষ্ণতা আর মাদকীয় গন্ধে ব্যকুল হয়ে তার স্পষ্ট সুন্দর বাক্যগুলো শুনতে ভালো লাগছিল। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন। কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে বললেন, 

' যখনই খুব মন খারাপ হবে। পরিস্থিতিটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে মনে হবে। একদল বিশ্রী মানসিকতার মানুষের সামনে অপদস্ত আর ক্ষত বিক্ষত হয়ে নিজেকে অসহায় মনে হবে। তখন ভাববে তুমি একা নও। তোমার সাথে স্বয়ং আল্লাহ আছেন। এই ঘটনাপ্রবাহগুলোর পেছনেও শক্ত কোনো কারণ আছে। এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর সত্য কী জানো? এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সত্য হলো আমাদের সৃষ্টিকর্তা। পৃথিবীর কোথাও এমন কোনো ঘটনা ঘটে নি যা আল্লাহ জানতেন না বা তার পেছনে আল্লাহর কোনো সুদৃঢ় পরিকল্পনা বা ইচ্ছে ছিল না। আমাদের সাথে যা ঘটে, যেভাবে ঘটে সবই আল্লাহর ইচ্ছের ওপর নির্ভর করেই ঘটে। আর যা আল্লাহর ইচ্ছেতে ঘটে তা কি কখনো অভিশপ্ত হতে পারে? অসহায়ত্ব বহন করতে পারে? আমার তো মনে হয় না। তাই অপ্রিয় কোনো ঘটনা ঘটলেই তাতে মন খারাপ করা উচিত নয়। পরিস্থিতিটা যেহেতু আল্লাহর ইচ্ছেতেই সৃষ্টি হয়েছে। এর সমাধান বা মুক্তিও আল্লাহর ইচ্ছেতেই হবে। আল্লাহ কখনো তাঁর বান্দার জন্য অমঙ্গলকর কোনো ঘটনা ঘটান না। কিছু কিছু ঘটনা অপ্রিয় থাকে সত্যি কিন্তু সেই সকল ঘটনার পেছনেও লুকিয়ে থাকে সুন্দর কোনো শিক্ষা বা মঙ্গলকর কোনো প্রাপ্তি। তাই আমাদের উচিত কি বলো তো?' 

আমি বড় বড় চোখ মেলে জিগ্যাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। শুভ্র ভাই চোখ নামিয়ে আমার চোখের দিকে তাকালেন। মৃদু হেসে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললেন,

' আমাদের উচিত ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা করা এবং নিজ জায়গায় সৎ এবং স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করা। ব্যস, তাহলেই দেখবে জীবনটা মুহূর্তেই ভাবনাতীত সুন্দর হয়ে উঠেছে। দুই-একটা অপ্রীতিকর কাজ আর অপ্রীতিকর মানুষের জন্য ছোট্ট সুন্দর জীবনটার গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো মন খারাপ করে নষ্ট করার কোনো মানে আছে, বলো? মনে রেখো, দুষ্কৃতিকারীরা কখনোই বেশিদূর এগোতে পারে না। আর রোদ্রাণীদের এভাবে হা-হুতাশ করাটাও মানায় না। বি স্ট্রং মাই লেডি।' 

আমি বুক ভরে শ্বাস নিলাম। হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম আমার মনের কালো মেঘগুলো আর নেই। মনটা ঝরঝরে দুপুরের মতো রৌদ্রজ্জল। শুভ্র ভাই এবার কপাল কুঁচকে তাকালেন। আমার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বৃদ্ধাঙ্গুলের কিনারা দিয়ে ছড়িয়ে যাওয়া কাজল মুছতে মুছতে বললেন, 

' ইশ! কেঁদেছ নাকি? কার এতো বড় সাহস তোমাকে কাঁদাল? নাম বলো। এবার সত্যি সত্যিই মাইর লাগাব।' 

আমি হেসে ফেললাম। আঙ্গুলের কিনারায় লেগে থাকা কাজলটুকু আমার ঘাড়ে চুলের আড়ালে লাগাতে লাগাতে তপ্ত চুমু খেলেন কপালে। সুখী সুখী কন্ঠে বললেন,

' মাশাআল্লাহ! এই হাসিটাই তো চাই। এই হাসিটার জন্য হাজারটা দুনিয়াও কুরবান।' 

আমি আবারও মুখ ফিরিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। মাথার উপর থাকা বিশাল আকাশটির দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। মেঘলা আকাশে গুটিকয়েক পাখি উড়ছে। মুক্ত হাওয়ায় ডানা মেলে তাদের কত আনন্দ। কত সুখ। চারপাশে ধোঁয়ার মতো কুয়াশা হানা দিচ্ছে। স্বচ্ছ বিকেলে ধীরে ধীরে নেমে আসছে সন্ধ্যা। বাড়ির সামনের পাকা রাস্তাটা ধরে ছুটে চলেছে ফেরিওয়ালাদের দূরন্ত সাইকেল। সাইকেলে বাঁধা হরেক রঙের খেলনা আর সিসার হাঁড়ি-পাতিলের পসরা। আমি ডানহাতে আঁচল টেনে পিঠ  ঢাকার চেষ্টা করলাম। ঠিক তখনই খেয়াল করলাম শুভ্র ভাই নেই। তবে তার গায়ের সুগন্ধটা আছে। আঁচলের পাশে পেঁচিয়ে রাখা তাজা বেলীফুলের মালাটা এখনও সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। কিন্তু, কোথা থেকে এলো এই মালা? এই তীব্র সুবাস? আমার ভাবনার মাঝেই আকাশ বাতাস আলোড়িত করে বেজে উঠল সুমধুর আহ্বান, 'আল্লাহু আকবার' 'আল্লাহু আকবার'।  রাফিয়া সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ডেকে বলল,

' এই রোদু? সন্ধ্যায় ছাঁদে কি করিস? জলদি নিচে আয়। শুভ্র ভাই এসেছেন । সাথে মামানির বানানো একগাদা পিঁয়াজু আর সমুচা এনেছেন। সব শেষ হয়ে গেল। জলদি আয়।' 

আমি চমকে উঠে সিঁড়ি ঘরের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই এসেছেন? কিন্তু কিভাবে? উনার তো মাস্টার্সের এক্সাম চলে। দুই সপ্তাহ আগেই গেলেন চট্টগ্রাম। আজই ফিরে এসেছেন? রাফিয়া আবারও ডাকল,

' কি রে রোদু এলি না? জলদি আয়। জেঠিমণি বকছে।' 

শাড়ির আঁচলে পিঠ ঢেকে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম আমি। একহাতে শাড়ির কুঁচি অন্যহাতে বেলীফুলের মালা ধরা। মাথায় ধোঁয়াশা এক চিন্তা। একটু আগে ঘটে যাওয়া সময়টুকু কী সত্যিই কল্পনা? নাকি বাস্তব? আর এই বেলীফুলের মালা? সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন শুভ্র ভাই। গায়ে বাদামী রঙের পাঞ্জাবি। আমার চোখে বিস্ময়। ভাইয়ার সাথে গল্পে মশগুল শুভ্র ভাই বেখেয়ালি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। চোখ কপালে তুলে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, 

' যখন তখন শাড়ি পরে ঘুরঘুর করিস, ব্যাপার কি? রাহাত ভাই? তোমার বোনের মতিগতি কিন্তু ঠিক নাই। সদ্য প্রেমে পড়া টাইপ বিহেভিয়ার। ছকিনার মার শুধু ছুক ছুক স্বভাব।' 

ভাইয়া হেসে ফেলল। শুভ্র ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল,

' চলো ভেতরে যাই। রাতের বাসেই ফিরছ নাকি আবার? ঠিকঠাক একদিনও থাকতে পারলে না। এসে কি লাভ হলো?' 

শুভ্র ভাইয়ের সহজ উত্তর, 

' গোটা ময়মনসিংহটাই বোধহয় আমায় মিস করছিল রাহাত ভাই। হাজার হলেও প্রিয়তমা শহর আমার। তার ইচ্ছে পূরণের দায়িত্ব তো আমারই। তাই ব্যাগ উঠিয়ে চলে এলাম। প্রিয়তমার মন ভরলো এবার ফেরার পালা।' 

ভাইয়া হেসে উঠলো। শুভ্র ভাই আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মাদক হাসলেন। সাথে সাথেই বুকের ভেতর ছলকে উঠলো রক্ত। চারপাশটা ভরে উঠলো তীব্র শিউলি ফুলের সুগন্ধে। সুপ্ত মনটা মাথা চাড়া দিয়ে বলল, ' প্রিয়তমার মনটা এবার সত্যিই ভরলো। হাজারও মন খারাপ আর অসহায়ত্ব প্রিয়তমের শুভ্র চাঁদরে ঢাকা পড়লো। বেঁচে থাকাটা আরও একবার অদ্ভুত সুন্দর হয়ে উঠল!' আহা! পৃথিবীটা সত্যিই বড্ড সুন্দর। এই সুন্দর পৃথিবীতে নোংরা মানুষদের ভেবে সময় কাটানোর সময় কই? নেই! কোথাও নেই! 


শোবার ঘরের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছি। বুকের ভেতর আবদ্ধ হৃদপিণ্ডটা ভীত হরিণীর মতো লাফালাফি করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। খিঁচে বন্ধ করে রাখা চোখদুটোর একটি খুলে ক্ষ্যাপা মা জননীকে দেখার চেষ্টা করলাম আমি। আম্মু রক্তলাল চোখে তাকিয়ে আছেন। রাগে তার ছোটখাটো শরীরটা মৃদু কাঁপছে। আম্মুর অগ্নিমূর্তি দেখে এই ঠান্ডাতেও হাত-পায়ে ঘাম দিচ্ছে আমার। কিছুক্ষণ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে থেকে ঢোক গিললাম আমি। অনুযোগের স্বরে বললাম,

' আম্মু...' 

সাথে সাথেই গর্জে উঠলেন আম্মু। কিছুক্ষণ আগেই বাবার সাথে বিশ্রী ঝগড়া হয়েছে আম্মুর। আর সেই দূর্দশাময় সময়েই আম্মুর হাতে পড়েছে শুভ্র ভাইয়ের দেওয়া শাড়ি, চুড়ি, দুল। পরিস্থিতিটা প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক হলে মা হয়তো ব্যাপারটা ততটা খারাপভাবে নিতেন না। কিন্তু এখন নিচ্ছেন। সেই সাথে আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে। বাড়িভর্তি মানুষ। আম্মুর চিল্লাচিল্লিতে কত বিশ্রীভাবেই না প্রকাশ পাবে ব্যাপারটা। মান-সম্মানের আর কিছু বাকি থাকবে না। আম্মুর ধমকে আরও একদফা কেঁপে উঠলাম আমি। 

' কী? কথা নেই কেন মুখে? কে দিয়েছে এসব? তোদের কী এসব করার জন্য বড় করেছি? এসব শিখেছিস আমার থেকে? তোর বাবা ঠিকই বলে, উচ্ছের ঝাড় আমি। আমার শিক্ষা খারাপ। এইজন্যই তো আমার মেয়েরা এতোটা নীচে নেমে গিয়েছে। এই বয়সে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। বড়টা তো ছিলই এখন ছোটটাও। লজ্জা করে না তোর?' 

কথাটা বলেই হাতের কালো শাড়িটা ছুঁড়ে ফেললেন আমার গাঁয়ে। আমি অসহায় কন্ঠে বললাম, 

' এভাবে বলছ কেন আম্মু। বিশ্বাস করো, আমি এসব কিছু করি নি। বিশ্বাস করো।' 

আম্মু গর্জে উঠে বলল,

' বিশ্বাস করব? চোখের সামনে প্রমাণ পেয়ে বিশ্বাস করব? আচ্ছা যা। বিশ্বাস করলাম। তাহলে বল এই জিনিসগুলো কই পাইছিস? বল শুনি। আমি তো কিনে দিই নি।' 

আমি হতাশ চোখে তাকালাম। বিপন্ন কন্ঠে বললাম, 

' এ এগুলো তো আপু... আপু কিনে দিয়েছিল।' 

আপু ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল। আমার কথায় চমকে আমার দিকে তাকাল। পরমুহূর্তেই  মাথা নাড়িয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,

' হ্যাঁ। আমিই কিনে দিয়েছিলাম। আসলে...' 

আপু কথাটা শেষ করার আগেই শক্ত চড়ে গাল লাল হয়ে গেল আমার। আম্মু রাগে ফুঁসে উঠে বাক্সে থাকা চিরকুটগুলো ছুঁড়ে ফেললেন মেঝেতে। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আপুও মাথা নিচু করল। আম্মু বাঘিনীর মতো গর্জন তুলে বললেন,

' এই চিঠিগুলোও তুই দিয়েছিস? আমার সাথে মিথ্যা? তোরা আর কত মিথ্যা লুকিয়েছিস আমার থেকে?' 

ভয়ে হাত-পা কাঁপছে আমার। শুভ্র ভাই এখন শহরে থাকলে এতো কাহিনী হয়তো ঘটতো না। আর ঘটলেও এতোটা বাজেরূপ নিত না। শুভ্র ভাইয়ের কাছে অদ্ভুত এক ম্যাজিক আছে। সেই ম্যাজিকটা মুহূর্তেই পরিস্থিতি সামলে নিতে পারে। সামলে নিতে পারে আমাকেও। আমাকেও! শব্দটা মাথায় বার বার ঘুরতে লাগল। আম্মু চোখ-মুখে রাগের ঝিলিক ফুটিয়ে তুলে বললেন,

' তোর কী টাকা-পয়সার আহাল পড়ছিল? আমাকে বা তোর বাপকে বললে কিনে দিত না এসব? অন্যের থেকে নিতে হবে কেন? তোর বাপ কী ফকির?' 

আমি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে বললাম, 

' তুমি ব্যাপারটাকে খুব বিশ্রীভাবে নিচ্ছ আম্মু। আমি আমার প্রয়োজনীয়তার জন্য নয়...' 

এটুকু বলতেই আরও একটা শক্ত চড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। আম্মু দক্ষ গোয়েন্দার মত প্রশ্ন করলেন,

' ছেলেটার নাম কী? কী করে?' 

আমি মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে রইলাম। আম্মু হুঙ্কার দিয়ে বললেন,

' নাম জিগ্যেস করেছি আমি। নাম কী ছেলের?' 

আমি কেঁপে উঠে বললাম,

' নাম দিয়ে কী করবে?' 

আম্মু চিঠি আর চিরকুটগুলো ভালো করে ঘেঁটেও পত্রপ্রেরকের কোনোরূপ নাম ধাম খুঁজে পেলেন না। আম্মুর রাগ আকাশ ছুঁলো। উত্তপ্ত কন্ঠে বললেন,

' আত্মসম্মানহীন মেয়ে। মুখে মুখে কথা বলছিস, লজ্জা করছে না? একে তো বাজে সম্পর্কে জড়িয়েছিস তারওপর এতোগুলো জিনিস নিয়েছিস। ছিঃ! একটাবারের জন্যও নিজের আত্মসম্মানে লাগে নি? আমার মেয়ে হয়ে এতোটা বেহায়া কিভাবে হলি তুই?' 

আম্মুর কথাটা যেন শূলের মত বিঁধল আমার মনে। মস্তিষ্কের ভেতর হাতুড়ির মতো পেটাতে লাগল প্রতিটি শব্দ। সুপ্ত কিন্তু প্রগাঢ় আত্মসম্মানবোধটা প্রবল নাড়ায় বিক্ষিপ্ত করে দিল আমাকে। আমি চমকে উঠলাম। মনের গভীর থেকে ছুটে এলো একটাই প্রশ্ন, আমি কী সত্যিই অত্যন্ত বেহায়ার মতো কাজ করেছি? মস্তিষ্ক উত্তর দিল, হ্যাঁ। অবশ্যই। কী করে পারলে তুমি এই সকল উপহার গ্রহণ করতে? কীসের অধিকারে? বিবেকে বাঁধল না? সেই মানুষটা না-জানি কতটা ঠুনকো, কতটা স্বস্তা ভাবছে তোমায়। ছিঃ রোদ ছিঃ। কথাগুলো ভাবতেই দুনিয়াটা ঘুরে গেল আমার। প্রচন্ড কান্নায় সারা শরীর কেঁপে উঠল। জিহ্বার কাছে এসে আটকে গেল একটাই বাক্য, আমি এতোটাই সস্তা!! মস্তিষ্ক আর মনের দ্বিমুখী অত্যাচারে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম আমি। আম্মুর বিষবাক্যগুলো মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাল না। সদ্য যৌবনে পা রাখা আত্ম-প্রত্যয়ী মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। আম্মুর চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললাম,

' তুমি এখন কী চাইছ আম্মু?' 

আম্মু থমকালেন। আমার স্পষ্ট প্রশ্নে কিছুটা অগোছালো হয়ে পড়লেন। হঠাৎ কথা খুঁজে পেলেন না। আম্মু কী সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন? তার চোখে-মুখে একটু দ্বিধা কাজ করছে কী? আম্মু কিছুক্ষণ চুপ থেকে উঁচু কন্ঠে বললেন, 

' কী চাইছি মানে? কী শুনতে চাইছ তুমি?...' 

আম্মুকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে বললাম,

' আস্তে আম্মু। আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। অযথা চেঁচিয়ে পাড়াসুদ্ধ করবে না। যা বলার ধীর গলায় বলো। আমি শুনছি।' 

আম্মু বক্রচোখে তাকালেন। কিছু কড়া কথা বলতে নিয়েও থেমে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীর কন্ঠে বললেন, 

' আমি তোমার মা। আমার সিদ্ধান্তে তোমার ক্ষতি হবে না, তা বিশ্বাস করো?' 

আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,

' তুমি ছোটবেলা শিখিয়েছিলে, একটি মেয়ের পৃথিবীতে মা ভিন্ন অন্যকাউকে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করতে নেই। নিজের বাবাকেও নয়। মায়ের মতো বিশ্বস্ত বন্ধু, যোদ্ধা পৃথিবীতে অন্যকেউ হতে পারে না। অনেক বছর আগে সেই শিক্ষাটা আমি মেনে নিয়েছিলাম আম্মু। আমি তোমাকে আমার সৃষ্টিকর্তা, আমার ধর্মের পর সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি।' 

আম্মু কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মৃদু কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,

' ছেলেটা কে?' 

আমি মাথা নিচু করে বললাম, 

' তার নামটা বলে তাকে তোমার কাছে নিন্দার পাত্র বানাতে চাইছি না আম্মু।' 

আম্মু থমথমে কন্ঠে বললেন, 

' নিন্দার কাজ করলে নিন্দার পাত্র হবে না? তার ঠিকানা দাও। তার সাথে কথা বলতে চাই আমি। একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে যে বাজে সম্পর্কে জড়াতে পারে সে কতটা সৎপাত্র আমিও দেখতে চাই।' 

আমি সাহস নিয়ে বললাম,

' আমরা কোনো বাজে সম্পর্কে নেই আম্মু। আর তার কোনো দোষও নেই। দোষটা হয়তো আমার। আমার প্রশ্রয় দেওয়াটা ভুল ছিল। আমিই হয়তো ছেলেমানুষীর বশে তার কাছে নিজেকে ছোট করেছি। সেই সাথে ছোট করেছি তোমার শিক্ষাকেও। সরি, আম্মু।' 

আম্মু শান্ত হলেন। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানার উপর বসলেন। দু'হাতে মুখ চেপে জোরে শ্বাস টানলেন। বেশ কিছুক্ষণ নীরবে জানালার বাইরে তাকিয়ে থেকে বললেন, 

' কোনো সম্পর্কে জড়ানোর মতো বয়স তোমার হয় নি। যদিও আমার বিয়েটা তোমার বয়সেই হয়েছিল তাই বলে নিজের মেয়েকেও সেদিকে ঠেলব না আমি। ছেলেটা যে-ই হোক। তার সাথে গড়ে ওঠে সম্পর্কের সাথে সাথে তার কোনো চিন্হও তোমার জীবনে চাইছি না আমি। আপাতত তিন-চার বছরের মধ্যে তো নয়ই।' 

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আম্মুর সামনে এমন একটা বিষয় নিয়ে অপদস্ত হতে হবে কল্পনাও করতে পারি নি আমি। আম্মু উঠে দাঁড়িয়ে শোবার ঘর ছাড়তে ছাড়তে বললেন, 

' আমি কী বুঝাতে চেয়েছি। বুঝেছ?' 

আমি অনুতাপের স্বরে বললাম, 

' জিনিসগুলো আজই ফিরিয়ে দিব, আম্মু।' 

আম্মু দাঁড়ালেন। এক নজর আমার দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বললেন, 

' সেই ছেলের সাথে দেখে করবে আজ? আমিও যাব  সাথে। ছেলেটিকে দেখতে চাই আমি।' 

আমি আৎকে উঠলাম। ঢোক গিলে নিয়ে মাথা নুঁয়ালাম। বললাম, 

' না আম্মু। দেখা করব না। আমরা আলাদাভাবে কখনও দেখা করি নি আম্মু। আর না আমাদের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক আছে। জিনিসগুলো কুরিয়ার করব। শহরের বাইরে থাকেন তিনি।' 

আম্মু কিছুক্ষণ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। সন্দিহান কন্ঠে বললেন,

' বেশ! কুরিয়ার অফিসে আমার সাথেই যেও তবে।' 

আম্মু বেরিয়ে যেতেই ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলাম। মাথায় তখন আত্মসম্মানের পোকা দৌঁড়াতে ব্যস্ত। চোখে-মুখে চিন্তা। আম্মু সাথে থাকায় জিনিসগুলো মামানির কাছে পাঠানো সম্ভব নয়। পাঠাতে হবে শুভ্র ভাইয়ের হাতে। কিন্তু, পার্সেলগুলো শুভ্র ভাইয়ের হাতে পৌঁছানোর পর কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন তিনি? প্রতিক্রিয়া দেখালেই বা কী? তার জিনিস তার কাছে পৌঁছাবে তাতে এতো প্রতিক্রিয়া দেখানোর কী আছে? তবে, আমার এই চিন্তাটা বেশিক্ষণ টিকল না। পার্সেলগুলো কুরিয়ার করে দেওয়ার পর পরই ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। শরীরের ভেতর থাকা বাচ্চা, ভীত মনটা ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। সন্ধ্যার পর অস্থিরতা বেড়ে দ্বিগুণ হলো। টেনশন রুমময় পায়চারী করতে লাগলাম। আপু আমার শুকনো মুখ দেখে মায়াভরা কন্ঠে বলল,

' তোর খুব খারাপ লাগছে, তাই না? আমি বুঝতে পারছি তোর পরিস্থিতিটা। আচ্ছা? তোর বয়ফ্রেন্ডের সাথে কী তোর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল?' 

আমি ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালাম। জবাব না দিয়ে আবারও হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। আপু আবারও বলল,

' তোর অস্থিরতা দেখেই বুঝতে পারছি। এতো অস্থির হোস না। আমি না-হয় আম্মুর সাথে কথা বলব। তুই এখন ভালো করে পড়াশোনা কর। ভার্সিটিতে এডমিশন নিলেই মোটামুটি স্বাধীনতা পেয়ে যাবি। তখন নাহয় কন্টিনিউ করিস রিলেশন।' 

আমি হতাশ চোখে তাকালাম। বিরক্ত কন্ঠে বললাম, 

' আপু থামবা প্লিজ? কোনো রিলেশন টিলেশনে নেই আমি। ওসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনাও নেই আমার। আমার চিন্তা আমার জীবন নিয়ে। আমি আর বেশিদিন বাচঁব না বুঝছ? হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখবে বোন তোমার ঠুস করে আল্লাহ পেয়ারা হয়ে গিয়েছে।' 

' কী বলছিস এসব? পাগল টাগল হয়ে গেলি নাকি?' 

আমি বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে বললাম,

' নিজেকে পাগল পাগলই লাগছে রে আপু। তুমি চিন্তাও করতে পারছ না কতোটা ভয়ানক ঘটনা ঘটতে চলছে তোমার এই কচি বোনের সাথে। উনি কতটা রাগী তা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। পার্সেলটা হাতে পড়ার সাথে সাথেই লাশ পড়ে যাবে আমার। এক্কেবারে কনফার্ম।' 

আপু যেন ভয় পেয়ে গেল এবার। চোখ বড় বড় করে তাকাল। ফিসফিসিয়ে বলল,

' এই? তুই কোনো সন্ডা টন্ডার সাথে রিলেশনে জড়াস নি তো?' 

আমি বাঁকা চোখে আপুর দিকে তাকালাম। আপুর থেকে বেশি ফিসফিস করে বললাম,

' শুধু সন্ডা নয়। সন্ডার বাপ। তবে রিলেশনে জড়িয়েছি ব্যাপারটা ভুল৷ বারবার রিলেশন রিলেশন করবে না। তার থেকে বরং এক গ্লাস পানি খাওয়াও। দুই দিন পর তো আর পানি খাওয়ানোর জন্য আমারে পাবা না। দুঃখের বিষয়।' 

আপু কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। গাঁয়ের ওড়নাটা ঠিকঠাক করে নিয়ে দরজার দিকে এগুতেই স্প্রিং-এর মতো উঠে বসলাম আমি। অবাক হয়ে বললাম,

' কই যাও?' 

' আম্মুর কাছে।' 

আমি কপাল কুঁচকে বললাম, 

' কেন?' 

আপু বিজ্ঞদের মতো বলল,

' আম্মুকে ব্যাপারটা জানাতে হবে না? সন্ডা, গুন্ডারা কত খারাপ হয় জানিস? তোকে যদি তুলে নিয়ে  যায়? এখন দেশের যা পরিস্থিতি। গন্ডায় গন্ডায় ধর্ষণ কেইস হচ্ছে, বিচার নেই।' 

আপুর কথায় চোখ বড় বড় করে তাকালাম আমি। সটান দাঁড়িয়ে পড়ে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললাম, 

' আপু! তুমি তো দেখি খুব একটা ভালো মানুষ না। তুমি যে এতোটা লো চিন্তা-ভাবনা করতে পারো ভাবনাতেই ছিল না আমার। তুমি আম্মুকে সন্ডা-মন্ডা, ধর্ষণ-টর্ষণের কথা বলবা আর আম্মু বেচারাকে বিনাদোষে ধর্ষণকারী বানিয়ে ছেড়ে দিবে। ইয়া মাবুদ! আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ করে বসো।'  

আপু হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমার কথার আগেমাথা বুঝতে না পেরে চোখে-মুখে অসহায়ত্ব মেখে ফোনের স্ক্রিনে মনোযোগ দিল৷ আমার টেনশন সময়ের সাথে সাথে হুহু করে বাড়তে লাগল। পরবর্তী দু-দুটো দিন টাকি মাছের মতো লাফাতে লাফাতেই কেটে গেল আমার। ফোনের শব্দেই ধরফর করে উঠতে লাগলাম। দরজায় কলিং বেল বাজতেই চমকে উঠতে লাগলাম। দু-দিন পর এক বিকেল বেলায় সেই ভয়ানক ফোনটা এলো। স্ক্রিনে শুভ্র ভাইয়ের নামটা দেখেই হাতে-পায়ে কাঁপন দিলো। দুই থেকে তিনবার বাজার পর ফোন কেটে ব্লক লিস্টে ফেলে দিলাম নাম্বার। আপুর ফোনটা সামনে পেয়ে আপুর ফোন থেকেও ব্লক লিস্টে ট্রান্সফার করলাম উনাকে। আপুর সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও সরিয়ে দিয়ে খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় গা এলাতেই মনে পড়ল আম্মুর ফোনের কথা। অনেক কৌশলে আম্মুর ফোন থেকে নাম্বারটা ব্লক করার পর  মনে খুশির জোয়ার এলো।তবে খুশিটা বেশিক্ষণ টিকল না। বসার ঘর থেকে বাবার রাশভারী কন্ঠ ভেসে এলো,

' রোদু? আম্মু? শুভ্র ফোন করেছে। তোমাকে এডমিশনের ব্যাপারে জরুরী কিছু বলবে। জলদি এসে ফোনটা নিয়ে যাও।' 

বাবার কথায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল আমার। তাড়াহুড়ো করে লেপের তলায় আশ্রয় নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম,

' আপু? বাবাকে বল আমি ঘুমিয়েছি। শুভ্র ভাই টুভ্র ভাইয়ের সাথে কথা বলার সময় নেই। রোদু নামের কোনো ব্যক্তি এই দুনিয়াতেই নেই।' 

এমন সময় দরজার পাশে এসে ধমকে উঠলেন আম্মু,

' এই ফাজিল মেয়ে? বাপে ডাকছে কানে ডুকে না? শুভ্র ফোন দিয়েছে, নে কথা বল।' 

আমি লেপের তলা থেকেই বললাম,

' আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি আম্মু।'

' দুই গালে দুটো থাপ্পড় দিলেই ঘুম ভেঙে যাবে তোমার। বেয়াদব মেয়ে।' 

আমাকে বাধ্য হয়েই উঠতে হলো। আম্মু ফোনটা এগিয়ে দিতেই চোখে-মুখে কান্নাভাব এনে বললাম,

' আমি উনার সাথে কথা বলব না। উনি শুধু বকে।' 

' তুই বকার মতো কাজ করলে বকবে না? ফোন ধর বলছি।' 

আমি চোখ-মুখ অন্ধকার করে ফোন কানে নিলাম। শুকিয়ে থাকা গলা দিয়ে অনেক কষ্টে বললাম,

' আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।' 

ওপাশ থেকে জবাব এলো না। আমি ফোনটা কান থেকে নামিয়ে দেখলাম ফোন এখনও কাটা হয় নি। ফোনটা কানে নিয়ে আবারও সালাম দিলাম আমি। ওপাশে পিনপতন নীরবতা। কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পরই কানে এলো তপ্ত দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। তারপরই কেটে গেল লাইন। মনের মধ্যে একটা মন খারাপ দানা বাঁধতে লাগল। নিজের পাগলামো আর বাচ্চামোকে প্রশ্রয় দিয়ে শুভ্র ভাইকে অপমান করে ফেললাম না তো? নিজের আত্মসম্মানের খেয়াল রাখতে গিয়ে  অপর পাশের মানুষটির আত্মসম্মানে আঘাত হানাটা তো অন্যায়। ভয়ানক অন্যায়। 


গ্রাম বাংলায় মেয়ের বাড়িতে শীতের পিঠা। গ্রীষ্মের আম, কাঁঠাল পাঠানোর একটা রীতি ছিল। রীতিটা এখন বিলুপ্তির পথে হলেও আমার বৃহৎ গোষ্ঠী তা  আকঁড়ে ধরে আছেন খুব নিয়ম করে। বাবা ছোট থেকেই ছোট ভাই-বোনদের মাথায় বটগাছের মতো ছায়া দিয়ে আসছেন। ভাই-বোনের জীবনে বাবার ভূমিকা পালন করে আসছেন। ফুপ্পি-চাচ্চুরা সন্তান-সন্ততির বাবা-মা হয়ে যাওয়ার পরও বাবার এই সংযম, এই বটগাছের মতো আগলে রাখাটা হারিয়ে যায়নি। তাই এখনও মাকে হাঁড়ি হাঁড়ি পিঠা বানাতে দেখি। আর সেই পিঠা ব্যাগ ভর্তি করে তিন ফুপ্পি আর দুই চাচ্চুর বাড়িতে চালান হতেও দেখি। সাথে থাকে বছরের যত ফলমূল, চিড়ামুড়ি। রীতি অনুযায়ী এবারও তাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হলো না। হঠাৎ আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়ায় এতো পিঠা বানানোর মতো ধৈর্য্য আর সাহস কোনোটাই আম্মুর জুটলো না। অভিমানী ফুপ্পিরা ছেলে-মেয়ে-স্বামী নিয়ে উঠলেন বাসায়। দুই চাচ্চুকেও ফোন দিয়ে ঢেকে আনালেন ময়মনসিংহ। চরপাড়ায় আমাদের ছোট্ট বাসাটা এক দিনেই হয়ে উঠলো উৎসবমূখর আর জনাকীর্ণ। বাবা ফোন দিয়ে মামানিদেরও ডেকে পাঠালেন। ময়মনসিংহে থাকা কয়েকজন আত্মীয়র মাঝে নিমন্ত্রিত হলেন নাহিদ ভাইয়াদের পরিবার আর মিথি আপুর শশুর বাড়ির লোক। প্রত্যেক পরিবারেই হয়ত ননদ-ভাবির মধ্যে চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বাড়ির বড় বউয়ের প্রতি সেই ক্ষোভ থাকে আরো জোড়াল। আর নিরীহ বড় বউও থাকে ননদদের প্রতি খানিকটা ত্যক্ত, বিরক্ত। আর সেই বিরক্তির ভারটা খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে গড়ায় বড় বউয়ের মেয়েদের চোখে-মুখে। এই সহজাত ধর্মটা ধরে রাখতেই হয়তো বাবা পাগল  আমরা দুই বোনও খানিকটা বিরক্ত হলাম। বিক্ষিপ্ত মনটা ফুঁসফুঁস করে বলতে লাগল, আম্মুর অসুস্থতার খবরটা জানার পরও জাতি-গোষ্ঠী নিয়ে ঘুরতে আসার মানে কী? আম্মুকে শুধু শুধু হেনস্তা করা ছাড়া কী আর কোন কাজ নেই এদের? বাড়ির বড় বউ বলে কী মাথা ছিঁড়ে খেতে হবে? আশ্চর্য!' 
তবে ফুপ্পিরা এবার আর কোনো ঝামেলা করলেন না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফুপ্পি আর চাচিরা মিলে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। মাকে খানিকটা নিস্তার দিয়ে নিজেরাই পিঠা বানাতে উদ্যোগী হলেন। বাসায় ছোট-বড় সবার মাঝে হৈ-হৈ শুরু হলো, আজ রাতে পিঠা উৎসব হবে। সব কাজিনরা একসাথে হতে পেরে এমনিতেই আমরা মহাখুশি। তারওপর পিঠা উৎসব? আহা! বেঁচে থাকতে আর কি চাই? বিকেল দিকে বাবা আর চাচ্চুরা মিলে ব্যাগ ভরে মাছ নিয়ে ফিরলেন। মা-চাচিদের টিটকারি আর ঠাট্টাকে কেন্দ্র করে বাবা আর চাচ্চু বসলেন মাছ কাটতে। আর আমার মতো 'বেগুণ' মানুষটিকে হতে হলো তাদের বিশেষ সহকারী। বাবা-মেয়ে কোমর বেঁধে লেগে গেলাম 'অসহ্য বস্ত' অর্থাৎ মাছ কাটতে। আট-দশ মিনিট সময় নিয়ে একেকটা মাছ কেটেও চলছিল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল আধঘন্টা পর। বাসার মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে এসে দাঁড়াল দীর্ঘকায় এক পুরুষ। রান্না ঘরের কিনারা থেকে তাকে দেখতে পেয়েই  বুকের ভেতর রক্ত ছলকে উঠল আমার। ছাই রঙের পুলওভার আর কালো টাওজার পরে দাঁড়িয়ে আছেন শুভ্র ভাই। দু'হাত টাওজারের পকেটে গুজা । চুলগুলো নিয়ম মেনে পড়ে আছে কপালে। খানিকটা শীর্ণ হয়ে আসা গাল ভর্তি ছোট ছোট মিষ্টি দাঁড়ির বাহার। ঠোঁটের নিচের কালো তিলটা স্বাভাবিকের থেকে বেশি ঝলঝলে। আমার হৃদপিণ্ড হাজার স্পিডে ছুটতে লাগল। শুভ্র ভাই ফিরে এসেছেন। তারমানে উনার মাস্টার্সের পরীক্ষা শেষ? কি সর্বনাশ! কবে শেষ হলো? ইয়া মা'বুদ এখন কি হবে? শুভ্র ভাই কি মাছের মতো বটি দিয়ে কেটে-কুটে ব্রহ্মপুত্র নদে ভাসিয়ে দিবেন আমায়? আমার গলা শুকিয়ে এলো। শুভ্র ভাই উদ্বেগহীন পায়ে রান্না ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। সবাই আমাদের ঘিরে মাছ কাটা দেখছিল। শুভ্র ভাই আমাদের দিকে একবার তাকিয়েই মামানিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

' আম্মু? বাসার চাবি তোমার কাছে রাখো। পরে আমায় খুঁজে পাবে না।' 

' কেন? কোথায় যাবি? আজ অনেক ঠান্ডা পড়েছে। খবরদার জ্বর শরীর নিয়ে সন্ধ্যায় বেরুবি না।' 

' কোথাও যাব না। আবার যেতেও পারি, ঠিক নেই। তুমি চাবিটা রাখো তো।' 

মামানি গো ধরে বললেন, 

' নিব না। চাবি নিলেই তুই এই ভর সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে চলে যাবি। বাইক নিয়ে টু টু করে ঘুরবি। আজ বাসার বাইরে যাওয়া বারণ।' 

শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকালেন। বিরক্ত কন্ঠে বললেন,

' আচ্ছা, তাহলে থাকো। এখন আমাকে আরও খুঁজে পাবে না। কাল সকালের আগে বাসাতেই ফিরব না। তুমি আর তোমার বর ননদের বাসাতেই ঘুমাও। গুড নাইট।' 

আমি শুভ্র ভাইয়ের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। উনি রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে কাঁপন ধরেছিল। সেই কাঁপন এখন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। শুভ্র ভাইয়ের কথা-বার্তা শুনেই বুঝা যাচ্ছে তিনি ভয়ানক রেগে আছেন কিন্তু প্রকাশ করছেন না। মামানিও অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ছেলের জেদ সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা আছে তার। ভালোর সময় মহাভালো আর মেজাজ খারাপ হলেই বিশ্ব বেয়াদব। শুভ্র ভাইয়ের চিন্তায় বেখেয়ালি হয়ে পড়তেই আবারও এক সর্বনাশ ঘটে গেল। বটি দিয়ে ডান হাতের আঙ্গুল কেটে বলি হলো। ছাই আর মাছের আঁশ দিয়ে মাখামাখি হাত দিয়েই চেপে ধরলাম কাঁটা স্থান। মুহূর্তেই ভয়ানক রক্তপাত শুরু হলো। আমার রক্তে সমস্যা থাকায় রক্ত জমাট বাঁধতে সময় নেয়। রক্তপাত অপেক্ষাকৃত বেশি হয়। এবারও হলো তাই। সবাই আমার হাত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও শুভ্র ভাইয়ের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা দিল না। মামানির হাতে জোরপূর্বক চাবিটা ধরিয়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হাতের ব্যথা নাকি অভিমানের চাপে জানি না, তবে এতক্ষণে চোখ উপচে জল গড়াল। প্রচন্ড অভিমানে কিশোরী মনটা ফুঁসে উঠল। শুভ্র ভাই মামানির সাথে চোটপাট করে বেরিয়ে যাওয়ার ভয় দেখালেও কোথাও গেলেন না। বাসার এখানে সেখানে অদুদ-মিলাদ ভাইয়াদের সাথে আড্ডারত অবস্থাতেই দেখা গেল তাকে। সারাটা সময় এমন একটা ভাব নিয়ে থাকলেন যেন আমাকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। আমার উপস্থিতি তিনি বুঝতে পারছেন না। আমার পরিকল্পনায় জল ঢেলে নিরুদ্ধেগ ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। আমার পরিবর্তে সে নিজেই আমাকে পুরোদস্তুর এড়িয়ে চলতে লাগলেন। অভিমানী মন বেশ কয়েকবার ফুঁসে উঠে বলল,' এর থেকে ভয়ানক রাগ আর দু-একটা চড় থাপড়া কি বেশি ভালো ছিল না?' বিক্ষিপ্ত মন পরমুহূর্তেই চিন্তা করে, ' যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে। চলুক না এড়িয়ে। আমিও এড়িয়ে চলব। কি দরকার শুধু শুধু ঝামেলায় জড়ানোর? ঝামেলা কেটে গেছে, বেশ হয়েছে।'  এভাবেই দুটানা আর মান-অভিমানে কেটে গেল পুরো সন্ধ্যা। 

রাত আটটার দিকে যথারীতি ছাঁদে আড্ডা বসল। নাহিদ ভাইয়াদের সাথে সাথে  মিথি আপু আর চয়ন ভাইয়াও আড্ডায় যোগ দিলেন। পিঠা সাপ্লাই করতে করতে ক্লান্ত আমি আর রাফিয়া আড্ডায় যুক্ত হলাম সবার পরে। দুই হাতে ভাঁপা আর পুলি পিঠার বাঁটি নিয়ে যখন ছাঁদে পৌঁছালাম তখন সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ছে টাইপ অবস্থা। আমরা পাটির ওপর বসতেই রাতুল ভাইয়া বললেন,

' আরে ধুর, চয়ন ভাই। আমারটা বাদ দিয়ে আলিফের কাহিনী শুনেন। আলিফ সেদিন নিব্বি গার্লফ্রেন্ড নিয়ে নদীর ওপারে গিয়েছিল। পার্কের ছাতা তো এখন আর নাই তাই বাধ্য হয়েই ঝোপঝাড়ের নিচে। সব ঠিকঠাক। প্রেম একদম জমে ঘি  টাইপ অবস্থা। কিন্তু ঝামেলা হইলো অন্য জায়গায়। বাচ্চা মাইয়া। তোতাপাখির জীবন নিয়ে প্রেম করতে গিয়েছে। আমাদের আলিফ বোধহয় ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেনি। গিয়েছে চুমু খেতে। চুমু খাওয়া তো দূর, মাইয়া চুমু খাওয়ার কথা শুনেই ভয়ে অজ্ঞান। আলিফ তো ভ্যাবাচ্যাকা। আমারে ফোন দিয়ে বলে, ভাই? কাহিনী তো একটা ঘটে গিয়েছে। এখন কি করি?'

রাতুল ভাইয়ার কথায় বিস্ময়ে মুখ চেপে ধরলাম আমি। শুভ্র ভাই আর চয়ন ভাইয়া হুহা করে হেসে উঠলেন। আপু মুখ চোখ কুঁচকে বলল,

' ছিঃ অশ্লীল। তোমরা এতো খারাপ? বোনদের সামনে এসব বলছ! লজ্জা করে না?' 

আলিফ ভাইয়া রাতুল ভাইয়ের পিঠে ধুম করে একটা চড় বসিয়ে চোখ রাঙালেন। নিচু কন্ঠে বললেন, ' শালা! কথা সামলায় বলতে পারিস না? যেখানে সেখানে ছেড়ে দেস।'  রাতুল ভাই দাঁত কেলিয়ে বললেন, ' আমার আর তোর বোন সেইম। শালা বলে লাভ নেই।' আলিফ ভাই দাঁতে দাঁতে চেপে বললেন, 'হারামি! খাড়াও, তোমারটা লাইভ টেলিকাস্ট করব।'  অদুত ভাই জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে বললেন,

' এই রুহি? তোরে না বলছি? ভাইয়েরা যখন কথা বলবে তখন চোখ-কান-নাক-মুখ সব বন্ধ করে রাখবি? এতো ফাজিল তোরা? ভাইদের ফুঁসফাস কথা শুনে ফেলিস।' 

' তোমরা বলো কেন? না বললেই তো শুনি না। আমি ফুপ্পিকে বলব দাঁড়াও।' 

' আমিও বলব।' 

' কি বলবা?  কি বলবা শুনি?'

শুভ্র ভাই এবার ধমকে উঠে বললেন,

' তোরা দুইটা চুপ করবি নাকি ঠাডায় দুইটা লাগাব? এই ঠান্ডায় কি তোদের ঝগড়া শোনার জন্য বসে আছি?' 

শুভ্র ভাইয়ের ধমকে কেউ আর কথা বাড়াল না। এতোক্ষণ চুপ থাকা নাহিদ ভাইয়া প্রসঙ্গ পাল্টালেন। উচ্ছল কন্ঠে বললেন,

' পিচ্চি? তোমাকে আজ বড় বড় লাগছে। পিচ্চি নামটা বেশিদিন টিকবে বলে মনে হচ্ছে না।' 

নাহিদ ভাইয়ার কথায় দপ করে জ্বলে উঠলেন শুভ্র ভাই। সামনে রাখা পিঠার প্লেটটা সম্পূর্ণ নিজের কোলে তুলে নিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। ভাবসাব এমন, আরেকটা কথা বললেই পিঠা ছুঁড়ে মারব তোর মাথায়। আমি নাহিদ ভাইয়ার কথায় মৃদু হাসলাম। বললাম,

' আর কত পিচ্চি থাকব? বড় হয়ে গিয়েছি না? কয়েকদিন পর অর্নাস স্টুডেন্ট হবো।' 

নাঈম ভাইয়া উৎসাহ নিয়ে বললেন, 

' তোমাকে দেখতে অনেকটা আমার ফ্রেন্ড তিন্নির মতো লাগে। প্রথম দিন দেখে ভেবেছিলাম তুমি তিন্নির ছোট বোন।' 

নাঈম ভাইয়ের কথায় সহজ হয়ে গেলেন শুভ্র ভাই। বুঝলাম, শুভ্র ভাইয়ের নির্দিষ্ট নাহিদ ভাইয়া ব্যতিত অন্য কাউকে নিয়ে তেমন সমস্যা নেই। শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন,

' তোমার ফ্রেন্ড তিন্নিকে হয়ত আমি চিনি। চট্টগ্রাম গিয়েছিলে না একবার? তিন্নিও ছিল সাথে।' 

নাঈম ভাইয়া হেসে বললেন,

' ও তোমার অ্যাডমায়ারার। ভীষণ রকম ক্রাশড ছিলো। এই লকডাউনে বিয়ে হয়ে গেল বাচারীর। দাওয়াতও পেলাম না। তোমার সাথে বিয়ে হলে এটলিস্ট দাওয়াতটা পেতাম। ধুর!' 

শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন। আলিফ ভাইয়া উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললেন,

' নাঈম ভাই? তোমাদের ক্যাম্পাসের মাইয়াগুলোরে সামলাও কেমনে? জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের এতো তেজ। বাপরে বাপ! আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড ছিল ওখানের। দুই বছর সিনিয়র গার্লফ্রেন্ড। জীবনটা ত্যানাত্যানা করে দিয়ে লাস্ট ইয়ার ব্রেকআপ করে দিয়েছে। সিনিয়র গার্লফ্রেন্ডগুলো মাস্টার্নী টাইপ হয় তবু সিনিয়রই ভাল্লাগে।' 

নাঈম ভাই হেসে বললেন, 

' নাম কি? কততম ব্যাচ? কোন ডিপার্টমেন্ট?' 

আলিফ ভাইয়া বিরস কন্ঠে বললেন,

' তোমাদের ইকোনমিক্স ডিপার্মেন্টেরই। এবার অর্নাস শেষ করল।' 

' ওহ্।' 

' জুনিয়র বয়ফ্রেন্ডগুলো একটু আলাভোলা হয়। আমাকে এক জুনিয়র প্রপোজ করেছিল। দেখতে হেব্বি কিউট। ভেবেছিলাম কয়েকদিন ভাব নিয়ে একসেপ্টটা করেই নেব। এমন টাইমে তোদের ভাইয়া কোথা থেকে টপকে এসে বিয়ে করে ফেলল। আমার আর জুনিয়রের সাথে প্রেম করা হলো না। কষ্ট!' 

মিথি আপুর কথায় চোখ বড় বড় করে তাকালেন চয়ন ভাইয়া। শুভ্র ভাইয়া ফোঁড়ন কেটে বললেন, 

' চয়ন ভাই তোরে বিয়ে করে উদ্ধার করেছে বইন। এখন এইসব আজাইরা কথা বললেও জাতি বিশ্বাস করবে না।' 

রাফিয়া লাফিয়ে উঠে বলল,

' আহ! আমিও তাহলে জুনিয়রের সাথে প্রেম করব। এক্সপিরিয়েন্স থাকা ভালো।' 

রাতুল ভাই মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, 

' একটা থাপড়া দিয়ে শশুর বাড়ি ফালাই দিয়ে আসব। বেদ্দপের আছাড়ি। বড় ভাইয়ের সামনে প্রেমের কথা কস। আম্মারে কইতাছি খাঁড়া। তোরে বিদেয় না করে শান্তি নাই।' 

আমি ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,

' আমিই বোধহয় একমাত্র বালিকা যে প্রেম করলে সিনিয়র সিটিজেনের সাথেই প্রেম করতে ইচ্ছুক। জুনিয়রকে বিয়ে করলে দেখা যাবে, বিয়ের পর পোলা "আপু আপু"ডেকে মুখের ফ্যানা তুলে ফেলছে। বাচ্চারা বাপের দেখাদেখি আন্টি ডাকছে। কি সাংঘাতিক!' 

আমার কথায় হেসে ফেলল সবাই। শুভ্র ভাই বাঁকা  হেসে বললেন, 

' হু।  তাই তো করবি। সিনিয়র বিয়ে করে বিয়ের পর বরকে ভাইয়া ডেকে নিহত করে দেওয়ার পরিকল্পনা তোর। বুঝি, সবই বুঝি। ভয়ানক মহিলা।' 

আমি কন্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বললাম,

' ডাকলে ডাকব, তাতে আপনার কি? আমার বর। আমি যা ইচ্ছে তাই ডাকব। আপনার কোনো সমস্যা?' 

' অনেক সমস্যা। নিউ জেনারেশন মানেই হলো দেশের ভবিষ্যৎ। তুই ভাই ডেকে দেশের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে ফেলবি আর আমি চুপ করে বসে থাকব তা তো হয় না। হাজার হলেও আমি একজন সচেতন নাগরিক। তোর মতো পুচকিকে ভাই ভাই করে চেঁচিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করতে দিতে পারি না।' 

আমি হতভম্ব চোখে তাকালাম। বিস্ময় নিয়ে বললাম,

' আমি ভাই ডাকলে দেশের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে? আপনি আমার ভাই ডাকার সাথে দেশের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে ফেলছেন?' 

শুভ্র ভাই অত্যন্ত স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন, 

' হ্যাঁ ফেলছি। তোর বাপ তো বহুত ধুরন্ধর ব্যক্তি। মাইয়াকে তো বিশিষ্ট পন্ডিত ছাড়া বিয়ে-শাদি দিবেন না। তুই তো তোর বাপের থেকেও ধুরন্ধর। দেখা গেল বিয়ের রাতে তুই তোর বিশিষ্ট পন্ডিত বরকে বারবার 'ভাইয়া' ডেকে নিহত করে ফেললি। তখন কি হবে জানিস? তখন এই দেশ একজন বিশিষ্ট পন্ডিত হারাবে। দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। পৃথিবী থেকে একজন বিশুদ্ধ মানুষের প্রাণ নাশ হয়ে যাবে। আহা! আমি কী এই ভয়ানক অন্যায় আদৌ মেনে নিতে পারি?' 

শুভ্র ভাইয়ের যুক্তিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম আমি। একটা মানুষ কতটা ফালতু হলে এমন অদ্ভুত যুক্তি দিতে পারে তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। চারপাশে সবাই হাসতে হাসতে পাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। আমি নাক-মুখ ফুলিয়ে বললাম,

' আপনি না মানতে পারলে সেটা আপনার নিজস্ব সমস্যা। আমি তো ভাই-ই ডাকব। শুধু বরকে নয়। অতি শীঘ্রই একটা প্রেম করব। প্রেমিক পুরুষকেও ভাইয়া ডেকে নিহত করে ফেলব। দেশের ভবিষ্যৎ-এ অমাবস্যা লাগলে লাগুক।' 

আমার কথাটুকু শেষ হতেই লাফিয়ে উঠলেন আলিফ ভাইয়া। খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, 

' এই না হলে বোনের মতো কথা। রোদু? আমার না বহুত দিনের শখ তোর প্রেম করা দেখব। তুই শুধু একবার হ্যাঁ বল। দরকার পড়লে বাড়ির সামনে ছেলেদের লাইন লাগিয়ে দেব। তা না-হলে টাকা দিয়ে বয়ফ্রেন্ড ভাড়া করে আনব, কোনো সমস্যা নেই। তবুও তুই প্রেম কর। আমি আশেপাশের আবহাওয়াটা একটু দেখতে চাই। নিউটনের তৃতীয় সূত্র মোতাবেক, প্রত্যেক ক্রিয়ারই  সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। আমি তোর প্রেমের বিপরীত প্রতিক্রিয়াটা দেখতে চাই। ' 

কথাটা বলেই শুভ্র ভাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকালেন আলিফ ভাইয়া। দাঁত বের করে বললেন, 

' শুভ্র ভাইও হেল্প করবে। তাই না ভাই?' 

শুভ্র ভাই হেসে বললেন, 

' হু। অবশ্যই। ফুপি যখন জানবে তার বাচ্চা মেয়েটাকে প্রেম নামক অশ্লীল পথে হাঁটার প্ররোচনা দিয়েছিস তুই তখন তাঁর বিপরীত প্রতিক্রিয়া কি হবে সেটা দেখারই মারাত্মক শখ জাগছে আমার। ক্যারি অন। আমি আমার একমাত্র ফুপ্পিকে এক ডজন ঝুড়ি গিফ্ট করে সাহায্য করব।'  

আলিফ ভাইয়া অসহায় মুখে তাকালেন। মৃদু কন্ঠে বললেন, 

' কল্পনায় প্রতিক্রিয়া দেখা হয়ে গিয়েছে। বোন তুই প্রেমটেম করিস না। প্রেম করা মহাপাপ।' 

কথাটা বলে থামলেন। তারপর আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন,

' তবে লুকিয়ে করতে পারিস। লুকিয়ে করলে পাপ হয় না।' 

আলিফ ভাইয়ের কথায় আবারও হেসে উঠল সবাই। আড্ডা শেষ হলো দশটায়। নিচ থেকে খাবারের ডাক পড়েছে। খাবারের ডাক পেয়েই হুরমুর করে নিচে নেমে গেলেন সবাই। শুভ্র ভাই চুপচাপ পাটির ওপর বসে রইলেন। বিন্দুমাত্র নড়লেন না। কেউ  জিগ্যেস করতেই বললেন, 'একটু দরকার আছে। তোমরা যাও। আমি আসছি।' সবাই বিদায় নিলেও থেকে গেলাম আমি আর নাহিদ ভাইয়া। আমার এক পাটি জুতো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেল? এখানেই তো ছিল! নাহিদ ভাইয়া বললেন,

' কী খুঁজছ পিচ্চি? নিচে যাবে না?' 

' জুতো খুঁজে পাচ্ছি না।' 

' আচ্ছা। আমি হেল্প করছি। এখানেই থাকার কথা।' 

শুভ্র ভাই এবার উঠে দাঁড়ালেন। পকেটে হাত ঢুকিয়ে  মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ালেন। কৃত্রিম হাসি নিয়ে বললেন,

' তুমি যাও নাহিদ। সবাই হয়তো খুঁজছে তোমায়। আমি জুতো খুঁজে দিচ্ছি। আমাদের দেরী হলেও সমস্যা নেই।' 

শুভ্র ভাইয়ের কথায় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক হয়ে উঠল আমার। এই জুতো হারানোর ব্যাপারটা নির্ঘাত শুভ্র ভাইয়ের ইচ্ছেকৃত কাজ। এখন আমায় একা পেয়ে  ইচ্ছেমতো পিটাবে নিশ্চয়? আমার গলা শুকিয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে বললাম,

' কি দরকার? আপনি নিচে যান শুভ্র ভাই। আমি আর নাহিদ ভাইয়া জুতো নিয়ে আসছি।' 

শুভ্র ভাই ধমক দিয়ে বললেন, 

' মেহমানকে দিয়ে জুতো খুঁজাবি তুই? দেব এক চড়। নাহিদ তুমি যাও।' 

নাহিদ ভাইয়া হাসার চেষ্টা করে বললেন, 

' ইট'স ওকে। আমার সমস্যা নেই।' 

শুভ্র ভাই থমথমে কন্ঠে বললেন,

' তোমার না থাকলেও আমার আছে। আই মিন, ফুপ্পি মেহমানদের বিষয়ে একটু বেশি সেনসেটিভ। তোমাকে নিচে না দেখলে হয়ত উল্টো রোদকে বকাঝকা করবে। তারথেকে বরং নিচে যাও। আমরা খুঁজে নেব।' 

নাহিদ ভাইয়া সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালেন। একবার আমার তো আরেকবার শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, 

' আর ইউ শিওর?' 

শুভ্র ভাইয়া ভারি বিরক্ত কন্ঠে বললেন, 

' হান্ড্রেড পার্সেন্ট!' 

নাহিদ ভাইয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিচে নেমে গেলেন। আমি অসহায় চোখে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নাহিদ ভাই চলে যেতেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল ছাঁদের পরিবেশ। সেই নিস্তব্ধ, ছমছমে পরিবেশে আমি একা এক অভাগা কিশোরী আর সামনে দাঁড়ানো সুঠাম, সুপুরুষ দৈত্য। শুভ্র ভাই একপর্যায়ে হালকা শিষ দিয়ে সরে দাঁড়ালেন। আমি শিষের সুরে চমকে তাকালাম। সাথে সাথেই লেবু গাছের টব থেকে উঁকি দিল আমার হারিয়ে যাওয়া দূর্ভাগা স্যান্ডেল। স্যান্ডেলটা দেখে আমার কেঁদে দেওয়ার অবস্থা। শুভ্র ভাই তাহলে কাজটা ইচ্ছে করেই করেছেন। লেবু গাছের মাথায় তখন জমাট বাঁধা অন্ধকার। চারপাশে সাদা সাদা কুয়াশার কুন্ডলীতে ফিকে হয়ে এসেছে বৈদ্যুতিক বাল্বের লালচে আলো। আমি ভয়ে ভয়ে লেবু গাছের কাছে গিয়ে জুতোটা উদ্ধার করতেই পেছনে এসে দাঁড়ালেন শুভ্র ভাই। 

আমি লেবু গাছের পাশে রেলিং-এ পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে, কিছুটা তফাৎ-এ পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শুভ্র ভাই। মুখভঙ্গি থমথমে। চোখদুটো ঈষৎ লাল। কঠিন দৃষ্টি আমার মুখের উপর স্থির। উনার কঠিন দৃষ্টি দেখেই ঘাম ছুটে গেল আমার। ঢোক গিলে রেলিং-এর ওপাশে নিচের দিকে তাকালাম। অস্থির মন গননা করতে লাগল, 'আচ্ছা? দুই তলার ছাঁদ থেকে পড়ে গেলে কি মানুষ মরে যায়? মরে না বোধহয়। আবার মরতেও পারে। কাউকে দুইতলা থেকে পড়ে গিয়ে দৌঁড়াতে তো দেখিনি। চোখের দেখায় বড় দেখা। প্রমাণহীন গননা চলে না। নৈব নৈব চ।' মনের যুক্তিতর্কে পারদর্শী অংশ বলল, ' তাহলে কি দুই তলা থেকে পড়ে গিয়ে তৎক্ষনাৎ মরতে দেখেছিস কখনও?' তাও ঠিক। এমনও কাউকে দেখা হয়নি। দুই পাশেই যুক্তি জবরদস্ত। সুতরাং গননা বা জরিপ সম্ভব নয়। এইসব আজগুবি চিন্তা করতে করতেই আবারও আড়চোখে তাকালাম আমি। শুভ্র ভাই আগের থেকেও কুটিল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ফর্সা চেহারায় রক্তবর্ণ চোখদুটো ভয়ানক দেখাচ্ছে। শুভ্র ভাই এক পা এগিয়ে এলেন। সাথে সাথেই হাত পায়ে কাঁপন ছুঁটে গেল আমার। শুভ্র ভাই আমাকে আগাগোড়া নিরক্ষণ করে মাত্রাতিরিক্ত শীতল কণ্ঠে বললেন,

' ভয় লাগে?' 

আমি জবাব দিলাম না। শুভ্র ভাই আরেকটু এগিয়ে এলেন। ভয়ে আমার হাত-পা অবশ হওয়ার উপক্রম। মুখে অসংখ্যবার চড়-থাপ্পড় মারলেও বাস্তবে খুব একটা চড়-থাপ্পড় মারেননি তিনি। এক বা দুইবারের বেশি তো নয়ই। কিন্তু এবার বোধহয় রেকর্ড ভঙ্গ হবেই হবে। একবারে  দশ বারোটা থাপ্পড় মেরে তবেই থামবে। শুভ্র ভাই থাপ্পড় মারলেন না৷ ঝুঁকে এসে আমার দুই পাশে রেলিং-এ হাত রাখলেন। আমি অস্থির হয়ে বললাম, 

' আল্লাহ! দেখুন। সরুন জলদি। কেউ এভাবে দেখে ফেললে কেলেংকারী হয়ে যাবে। আম্মু খুন করে ফেলবে আমায়। প্লিজ সরুন।'

শুভ্র ভাইয়ের মধ্যে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না। শান্ত চোখ মেলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি আবারও অনুরোধ করলাম,

' প্লিজ। হাত জোর করছি, যেতে দিন। বাড়ি ভরা মানুষ। কেউ দেখলে তিল থেকে তাল বানিয়ে ফেলবে।' 

' আর যদি তালই দেখে?' 

উনার শান্ত কন্ঠে কেঁপে উঠলাম আমি। হৃদপিণ্ডের গতি ধীর হয়ে গেল। সারা শরীর অবশ লাগছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। কান্নায় গলা আটকে আসছে। এসব দেখলে আম্মু নির্ঘাত কেটে কুঁচিকুঁচি করে ফেলবে আমায়। ফুপ্পি, চাচিমণিরা কত কথা শোনাবে আল্লাহ মালুম। আমি দুর্বল কন্ঠে বললাম, 

' আমি কিন্তু আম্মুকে বলে দেব। যার জিনিস তার কাছেই পৌঁছেছে। এতে এতো রিয়েক্ট করার কি হলো?' 

শুভ্র ভাইয়ের চোয়াল শক্ত হলো। রাগে ফর্সা গালে গোলাপি আভা ফুটলো। পরমুহূর্তেই বাঁকা হেসে সুর তুলে বললেন, 

' রোদ মানেই সুন্দর কিছু! তারপর কি যেন? ওহ হ্যাঁ। 
"বালিকা তুই ভুল করিয়া
খুলিসনে তোর চুল
না হয় আমি নয়ন জুড়িয়ে
করতে পারি ভুল
নয়ন জুড়ানো রেশমি চুলে
হৃদয় ছুঁয়ে যায়
আদর করে দিবো তোকে
আমার স্বপ্নে আয়।" ' 

আমি আবারও ঢোক গিললাম। যতদূর মনে পড়ছে, এই লাইনগুলো নাহিদ ভাইয়া তার কমেন্টে লিখেছিলেন। একটা আমার কভার ফটোতে। অন্যটি প্রোফাইল পিকচারে। প্রোফাইল পিকচারের কমেন্টে কবিতাটা লিখে নিচে লিখেছিলেন,' তোমার ছবিটা দেখে এই কবিতাটা মাথায় এলো। কিছু মনে করো না। ভীষণ মিষ্টি লাগছে।' আর যতদূর মনে পড়ছে আমার  প্রোফাইল আমি সাথে সাথেই অনলি মি করেছি এবং কমেন্টটাও প্রায় সাথে সাথেই ডিলিট করেছি। তাহলে এই কবিতাটা শুভ্র ভাই দেখলেন কিভাবে? আশ্চর্য! আমি চোখ খিঁচে বন্ধ করে দোয়া আওড়াতে লাগলাম। বিপদের দোয়া,' ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, আল্লাহুম্মা আজিরনি ফি মুসিবাতি ওয়া আখলিফ-লি খাইরাম মিনহা।' শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে অদ্ভুত কন্ঠে বললেন, 

' অন্যকারো স্বপ্নে ঢুকার আকাঙ্খা জেগে গেলে পুরোনো জিনিস, পুরোনো মানুষ কিছুই ভালো লাগার কথা নয়। আর না তার মান-অপমানের খেয়াল থাকার কথা। তাই না?' 

আমি চট করে চোখ মেলে তাকালাম। টেনশনে সারা শরীর ঝিমঝিম করছে আমার। ছাঁদের দরজাটা সটান খোলা। যে কেউ, যেকোনো মুহূর্তে ছাঁদে আসতে পারে। আর আমাদের এই অবস্থায় দেখলে....।  আমি আর ভাবতে পারছি না। মৃদু কন্ঠে বললাম, 

' সরুন। কেউ আসলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।' 

শুভ্র ভাই শক্ত কন্ঠে বললেন, 

' আই ডোন্ট কেয়ার।' 

ঠিক তখনই সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। আমি আর্তনাদ করে উঠে বললাম, 

' প্লিজ সরুন। কেউ আসছে। আম্মু খুন করে ফেলবে আমায়।' 

শুভ্র ভাই সরলেন না। আমি চোখ খিঁচে বন্ধ করলাম। রুদ্ধ কন্ঠে দোয়া আওড়াতে লাগলাম। সিঁড়ি ঘরের দরজা থেকে বিস্মিত মেজো চাচিমণির কন্ঠ ভেসে এলো,

' রোদ-শুভ্র? এখানে কি করছ? নিচে সবাই খাচ্ছে।' 

আমি চোখ মেলে তাকালাম। শুভ্র ভাই আমার থেকে অনেক তফাৎ-এ দাঁড়িয়ে আছেন। দুইহাতে তিনটা লেবু। শুভ্র ভাই চাচিমণির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন,

' লেবু গাছে ব্যাপক লেবু ধরেছে এবার। আমার ফুপ্পি লাগিয়েছে বলে কথা! আপনি নিশ্চয় আমাদের ডাকতে এসেছেন আন্টি?' 

চাচিমণি কিছু বলার আগেই শুভ্র ভাই আমাকে ইশারা করে অত্যন্ত বিরক্ত কন্ঠে বললেন,

' আম্মু এই বলদকে লেবু নিতে পাঠিয়েছিল। এসেছে আর খোঁজ নেই। তাই বাধ্য হয়ে আমাকেও পাঠাল। এসে দেখি কাটা হাত নিয়ে লেবু টানাটানি করছে মাত্র। একটাও ছিঁড়তে পারেনি। আপনাদের এই বলদ মেয়ের শশুরঘর জুটবে না আন্টি।' 

শুভ্র ভাইয়ের কথায় হেসে ফেললেন চাচিমণি। হাসিমুখেই বললেন, 

' তোমাদের ডাকতে আসিনি। ছাঁদে বিকালে একটা চাঁদর শুকোতে দিয়েছিলাম। রাফিয়াকে নিতে বলেছিলাম, সে নাকি ভুলে গিয়েছে। যেটুকু শুকিয়েছিল এই অকর্মা মেয়ের জন্য সেটুকুও  কুয়াশায় ভিজল বোধহয়।' 

শুভ্র ভাই তাড়াহুড়ো করে বললেন,

' ওহ্। আপনি দাঁড়ান। আমি এনে দিচ্ছি। আপনার এত্তোবড় ছেলে থাকতে আপনাকে কেন আনতে হবে?' 

চাচিমণিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছাঁদের অন্য কিনারায় গিয়ে চাঁদর এনে দিলেন শুভ্র ভাই। শুভ্র ভাইয়ের ভদ্রতায় চাচিমণির চোখ-মুখ চিকচিক করছে। চাঁদরটা হাতে নিয়ে খুশিতে ঝলমল কন্ঠে বললেন,

' কি লক্ষ্মী ছেলে! তোমার মা লাখে একটা ছেলে জন্ম দিয়েছে। এই রোদু? ভাই থেকে কিছু শিখতে পারো না তোমরা? সারাদিন খালি ঢিং ঢিং করে ঘুরো।' 

আমি জবাব দিলাম না। চাচিমণির মুখে 'ভাই' শব্দটা শুনেই কেশে উঠলেন শুভ্র ভাই। তারপর মৃদু হেসে চাচিমণিকে বিদায় দিলেন। আর আমরা যে খুব শীঘ্রই নিচে আসছি সেটাও জানালেন। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। শুভ্র ভাই মুহূর্তেই আগের রূপে ফিরে এলেন। আগের মতোই চোখ-মুখ শক্ত, লাল।  আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, 

' নয়ন জুড়ানো রেশমি চুল আর আদর আদর খেলার হায়াৎ ফুরিয়ে এসেছে রোদপাখি। এই কয় বছরে আমাকে ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারোনি তুমি। এবার চিনবে।'

কথাটা বলেই দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেলেন। আমি মোহাচ্ছন্নের মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। কি থেকে কি হয়ে গেল! আগেই রাগের পাল্লা ভারী ছিল তারপর যুক্ত হলো নাহিদ ভাইয়া নিয়ে ভুল বোঝাবোঝির বহর। আমি দুই হাতে মুখ চেপে নিচে বসে পড়লাম। শুভ্র ভাইয়ের এই শান্ত ধমকির ফলশ্রুতি যে কি হতে পারে, জানি নেই। অতো ভাবতেও পারছি না। শরীর-মাথা কিচ্ছু চলছে না। সবকিছু অসহ্য থেকে অসহ্য লাগছে। কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থাকার পর ফোনে কথা বলতে বলতে ছাঁদে এলেন নাহিদ ভাইয়া। আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ফোন কেটে জিগ্যেস করলেন,

' তুমি এভাবে বসে আছ কেন? ঠান্ডা লাগছে না?'

আমি চট করে উঠে দাঁড়ালাম। একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, 

' না। আপনি থাকুন। আমি নিচে যাচ্ছি।' 

নাহিদ ভাইয়া হাসলেন। 'আচ্ছা' বলেও ফট করে প্রশ্ন করলেন,

' শুভ্রর সাথে ঝামেলা হয়েছে নাকি?' 

আমি চমকে তাকালাম। বললাম, 

' জি? উনার সাথে ঝামেলা কেন হবে?' 

' আমার মনে হয়েছিল শুভ্র তোমার প্রতি কিছুটা হিংস্র অনুভূতি পোষণ করে।' 

আমি থতমত খেয়ে বললাম, 

' হিংস্র অনুভূতি মানে? তেমন কিছু নয়। উনার কাজিনের মাঝে আমি সবার ছোট তো। আর চঞ্চলও বেশি। তাই একটু বকাঝকা বেশি করে। এছাড়া কিছু নয়।' 

' বকল নাকি?' 

আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, 

' না তো। আপনি নিচে যাবেন? আম্মু বোধহয় আমায় খুঁজছে। আমি নিচে যাব।' 

নাহিদ ভাইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, 

' আমিও যাব। চলো।

আমরা একসাথেই নিচে নেমে এলাম। নাহিদ ভাইয়া বিনাবাক্যে ডাইনিং স্পেসের দিকে চলে গেলেন আর আমাকে বসার ঘরে আটকে দিলেন আম্মু। আমি তখনও জানতাম না এরপরের গল্পটুকু ঠিক সুখকর হবে না। বসার ঘরে তখন কেউই নেই। আম্মু শীতল কন্ঠে জিগ্যেস করলেন,

' কোথায় ছিলি?' 

আমি হাসিমুখেই বললাম, 

' ছাঁদে।' 

' কার সাথে?' 

এবার আমার একটু খটকা লাগল। আমি আম্মুর চোখের দিকে তাকিয়ে ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করলাম। আম্মু একপা এগিয়ে এসে রাগ থমথমে অথচ নিচু স্বরে বললেন, 

' নাহিদই কি সেই ছেলে? ওর সাথেই সম্পর্কে জড়িয়েছিস তুই?' 

আম্মুর প্রশ্নে হতবাক হয়ে গেলাম আমি। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেকে বললাম, 

' কি বলছ মা? ছাঁদে আমি একা ছিলাম। নাহিদ ভাইয়া তো...' 

এটুকু বলতেই দানবীয় এক চড় এসে পড়ল আমার গালে। আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম। আকস্মিক এই আক্রমণ, এই অপমানে কাঁদতেও ভুলে গেলাম। চড়ের শব্দ সবার দৃষ্টি তখন আমার উপর। ঘরভর্তি মানুষের সামনে এতোবড় মেয়ের গায়ে হাত তোলার মতো মানুষ আম্মু নন। তাহলে আজ হঠাৎ এই রণচণ্ডী রূপ কেন? অপমান আর লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারছি না আমি। এই মুহূর্তে দুনিয়াদারি ছেড়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে বহুদূরে। এর থেকে মরণটাই কি ভালো ছিল না? আমি আড়চোখে একবার শুধু শুভ্র ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। উনার ফর্সা মুখটা খানিক ফ্যাকাশে লাগল কি? সবসময় সবরকম পরিস্থিতিতে আগলে রাখা সেই মানুষটি আজ এগিয়ে এলো না। ছুটে এলো মামানি। আমাকে শক্ত করে জাপটে ধরে আম্মুর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, 

' খবরদার গায়ে হাত দিবে না। এতোবড় মেয়ের গায়ে হাত তুলো কি করে তুমি, অরি? হাত কাঁপলো না।' 

আম্মু জবাব না দিয়ে রক্তিম চোখে তাকিয়ে থাকেন আমার মুখে। রাগ, লজ্জা, অপমান আর ক্ষোভে শরীর তখন মৃদুমন্দ কাঁপছে। শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। মামানি তপ্ত কন্ঠে বললেন,

' পেটে ধরলেই শুধু মা হয়ে যায় না অরি। রোদ আমারও মেয়ে। তোমার থেকে কম ভালোবাসি না আমি। আমার মেয়ের গায়ে যখন তখন, এক ঘরভর্তি মানুষের মাঝে হাত তুলবে না। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি। ও আজ আমার সাথেই থাকবে।' 

আম্মু এবারও জবাব দিলেন না। মামানি আমাকে এক হাতে বুকে আগলে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলেন। যেতে যেতে মামুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 

' বোনকে ঠিকঠাক শাসন করলে আজ এতোবড় মেয়ের গায়ে হাত তুলতে পারত না। বোনকে তো কোনোদিন শাসন করতে দেখলাম না।' 

মামু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মৃদু গলায় ধমক দিলেন আম্মুকে। আমার গায়ে হাত তোলার কারণটা সবার মনে আস্ত একটা রহস্য হিসেবে থেকে গেল। মামুদের বাসায় এসে, নিজের রুমে ঢোকার পর, কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। মামানি কিছুক্ষণ আমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাশে বসে রইলেন। আমি কাঁথায় চোখ-মুখ ঢেকে নিরবে চোখের জল ফেলতে লাগলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক পর শুভ্র ভাই ফিরলেন বাসায়। তখন বোধহয় বারোটা কি সাড়ে বারোটা বাজে। মামানিকে ডেকে চাপাস্বরে জিগ্যেস করলেন,

' রোদু ঘুমিয়ে পড়েছে?' 

মামানি ক্ষোভ নিয়ে বললেন, 

' কেন? রাগ পোষানো এখনও বাকি আছে?' 

শুভ্র ভাই অসহায় কন্ঠে বললেন,

' আমি কি করলাম?' 

' জানো না কি করেছ? অরিকে কি বলেছ তুমি? আমি খুব ভালো করে জানি সবকিছুর পেছনে তোমার হাত আছে।' 

' আমি তেমন কিছুই বলিনি আম্মু। আর যতটুকু বলেছি তাতে ফুপ্পির এতোটা রিয়েক্ট করারও কথা ছিল না। বেশি হলে একটু বকাঝকা করত, ব্যস।' 

' আমি তোমাকে পেটে ধরেছি। খুব ভালো করে চিনি তোমায়। তোমার এসব জেদ আর রাগের জন্য একদিন অনেক বেশি সাফার করতে হবে। এখনও সময় আছে শুধরে যাও।' 

শুভ্র ভাই ক্লান্ত কন্ঠে বললেন,

' আম্মু প্লিজ! তোমার সাথে তর্ক করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে এখন নেই। শরীরটা ভালো লাগছে না। মিথ্যা আশা রেখো না, আমি শুধরাতে পারব বলেও মনে হয় না। তবে আজ আমি শান্ত আছি। রাগ,জেদ সবই কন্ট্রোল করেছি। নয়তো তোমার আদরের রাজকন্যার কপালে শনি ছিল।' 

'  ছোটবেলা থেকে তো তাই করছিস। মেয়েটাকে এতো জ্বালাস কেন তুই? ছোট থেকে জ্বালাচ্ছিস।' 

' তোমার শুধু আমার দোষ চোখে পড়ে। ওর দোষ চোখে পড়ে না? তুমি এই মেয়েকে যতটা পবিত্র আর অবুঝ ভাবছ সে ততটা নয়। ফাজিলের হাড্ডি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে থাপড়াইয়া ঠিক করে ফেলি।' 

' কি বললি?' 

' কিছুই বলিনি। বাবা রুমে একা। নিশ্চয় তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। গো টু ইউর রুম এন্ড এট্যান্ড ইউর হাজবেন্ড। এখানের থেকে ওখানে তোমার প্রয়োজন বেশি।' 

মামানি হয়ত শুভ্র ভাইয়ের বাহুতে থাপ্পড় লাগালেন  'চটাস' এক শব্দ হলো। তারপর মিষ্টি শাসনের কন্ঠে বললেন,

' অসভ্য! মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?' 

শুভ্র ভাই হেসে বললেন,

' ধুর! কিসের মা? তুমি তো আমার বান্ধবী। তোমাকে আজ থেকে রেনু আপা বলে ডাকব।' 

' ফাজিল! একটা থাপ্পড় দেব। দিন দিন ফাজিল হচ্ছিস। সবসময় ফাজলামো। বের হ রুম থেকে। আমি আজ রোদের সাথেই থাকব। তোকে আমি বিশ্বাস করি না।' 

' এইতো মায়েদের মতো ব্যবহার করা শুরু করলে। তুমি নিজেও খুব ভালো করে জানো যে, তোমার এই 'উরে এসে জুড়ে বসা' মেয়ের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে  এমন কিছুই করব না আমি।' 

' সারাদিনই তো ক্ষতি করছিস।' 

' উফ! আম্মু যাও তো।' 

মামানি চলে যেতেই ধীর পায়ে বিছানায় এসে বসলেন শুভ্র ভাই। এতকিছুর পর আমার উচিত প্রচন্ড রাগে ফেটে পড়া। কিন্তু অদ্ভুতভাবে আমার রাগ লাগছে না। শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আলতো হাতে আমার মুখ থেকে কাঁথা সরিয়ে কপালের ওপর হাত রাখলেন। সাথে সাথেই সারা শরীর শিউরে উঠল আমার। শুভ্র ভাইয়ের শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এতো জ্বর নিয়ে বিছানায় শুয়ে আবোল তাবোল বকার কথা কিন্তু সে একদম ফিট। শুভ্র ভাই খুব সাবধানে আমার চোখের সামনে হাত নাড়লেন। আমি ঘুমের ভাব ধরে পড়ে থাকার যথেষ্ট চেষ্টা চালালাম। আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি বিষয়টি স্পষ্ট হতেই শুভ্র ভাইয়ের ঠোঁট দুটো নেমে এলো আমার গালে, কপালে। কেঁটে যাওয়া ডানহাতটায় আলতো  আদর করে মৃদুস্বরে বললেন, 

' সরি!' 

আমি এবার নড়েচড়ে উঠে চোখ মেলে তাকালাম। শুভ্র ভাই বেশ অপ্রস্তুত হলেন কিন্তু হাত ছেড়ে দিলেন না। হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন, 

' না খেয়ে পাবদা মাছের মতো শুয়ে আছিস কেন? না খেয়ে থেকে প্রমাণ করতে চাইছিস, আমাদের বাসায় তোকে যত্ন-আত্তি করা হয় না?' 

আমি জবাব নিয়ে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে রইলাম। শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন,

' আশ্চর্য! আমি এদিকে বসে আছি, তুই ওদিকে কাকে দেখছিস? এদিকে তাকা।' 

আমি আগের মতোই চুপচাপ শুয়ে রইলাম। শুভ্র ভাই আমার জবাবের ধার ধারলেন না। হুট করেই আমাকে পাঁজা কোলে নিয়ে দরজার দিকে হাঁটা দিলেন। আমি আৎকে উঠলাম। চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেলাম। চাপা কন্ঠে বললাম,

' হচ্ছেটা কি? নামান বলছি। আমি কিন্তু মামানিকে ডাকব।' 

শুভ্র ভাইয়ের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। দরজার বাইরে উঁকি দিয়ে চারপাশটা দেখে নিয়ে সোজা বসার রুমে গিয়ে থামলেন। আমাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বললেন, 

' বাসায় রান্নাবান্না হয়নি আজ। বল, কি খাবি?' 

আমার বিস্মিত চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, 

' কম সময়ে একটা খাবারই রান্না সম্ভব, নুডুলস। নুডুলসই চলবে? নুডুলসই খা। পেট ভরলেই হলো।' 

আমি মৃদুস্বরে বললাম,

' আপনার শরীরে অনেক জ্বর।' 

শুভ্র ভাই যেন শুনেও শুনলেন না। আমাকে বসিয়ে দিয়ে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। আমি সোফার উপর চুপচাপ বসে রইলাম। ব্যালকণির দরজা লাগানো। জানালাগুলোতেও পর্দা টানা। বাইরের কোন শব্দই ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে পারছে না৷ চারদিকে ঝিম ধরা নীরবতা। বসার ঘরে টিমটিম করে অল্প আলো জ্বলছে। নীল রঙের আলো। সেই আলোতেই সামনের দেয়ালটা চোখে পড়ল। দেয়ালে বেশকিছু ছবি লাগানো হয়েছে। যতটুকু মনে পড়ে এর আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন দেয়ালটাতে কিছু প্যাইনটিং ছিল, ছবি ছিল না। আমি উঠে গিয়ে দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেয়ালের মাঝ বরাবর মামানি আর মামুর বাঁধাই করা হাস্যোজ্জল ছবি। সেই ছবিকে কেন্দ্র করে চারদিকে ফ্রেমেবন্দী আরও কিছু মুহূর্তে। একটি ছবিতে স্বাস্থ্যবান একটি বাচ্চা দন্তহীন হাসছে। হাতে তার লাল বল। কপালে কাজলে আঁকা নজর ফোঁটা। বাচ্চাটাকে দেখেই কোলে তুলে নিতে ইচ্ছে করছে আমার। তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে হাত বাড়িয়ে দিলেই ঝাঁপিয়ে কোলে উঠে আসবে সে। ইশ! কি মিস্টি। তার ওপরের ছবিটি কিশোর বয়সী এক ছেলের। স্নিগ্ধ মুখ জুড়ে দুষ্ট হাসি। ঠোঁটের নিচে, থুতনিতে কালো কুচকুচে একটি তিল। গায়ে সাদা টি-শার্টের ওপর চেইক শার্ট। তারউপরে যুবক শুভ্র ভাইয়ের টি-শার্ট পরা একটা ছবি। গম্ভীর, সুন্দর চোখদুটোতে কালো সানগ্লাস। চারপাশে সবুজ গাছপালার বহর। সেই গাছপালার মাঝে দুই হাত কোমরে রেখে দাঁত বের করে হাসছেন উনি। আশ্চর্য সুন্দর সেই হাসি। তারপাশের ছবিটিতে নীল পাঞ্জাবি পরা শুভ্র ভাই। এই ছবিটাতে গম্ভীর, পরিপূর্ণ পুরুষ লাগছে তাকে। সুঠাম শরীর। ফর্সা মুখে ছোট ছোট দাঁড়ির আভাস। গভীর চোখদুটো ডানহাতের ওপর নিবদ্ধ। ভীষণ মনোযোগে হাতের ঘড়ি ঠিক করছেন তিনি। তারপাশে শুভ্র ভাইয়ের গত জন্মদিনে তোলা মামানি আর শুভ্র ভাইয়ের ছবি। তারপাশে সেইদিনের তোলা ছবিটা। যেখানে শুভ্র ভাইয়ের হাতে বন্ধী আমার একগোছা চুল। আর আমার চোখে বন্ধী শুভ্র ভাইয়ের হাস্যোজ্জল মুখ। আমি বিস্মিত চোখে ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। শুভ্র ভাইয়ের কথাটা সত্যি। ছবিটি আসলেই অসম্ভব সুন্দর। 

' এভাবে দেখার মত কি আছে এতে? যাকে দেখার তাকে তো দেখিস না।' 

শুভ্র ভাইয়ের কথায় চমকে তাকালাম আমি। ছবি দেখতে মগ্ন হয়ে পড়ায় শুভ্র ভাইয়ের উপস্থিতি টের পাইনি এতক্ষণ। শুভ্র ভাইয়ের দিকে একবার তাকিয়েই বাচ্চা শুভ্রর দিকে তাকালাম। ছবিটিকে ইশারা করে বললাম, 

' এই মিষ্টি বাচ্চাটাকে কোলে নিতে ইচ্ছে করছে আমার। এতো কিউট কেন হবে একটা বাচ্চা! এই পুচকুকে ছবি থেকে বের করে আনা যায় না কোনোভাবে?' 

শুভ্র ভাই হেসে ফেলে বললেন,

' আনা যায়। তবে এভাবে নয় অন্যভাবে।' 

আমি বুঝতে না পেরে বললাম, 

' জি?' 

' কিছু না।' 

আমি আরেকটা ছবি দেখিয়ে বললাম, 

' এই দুষ্টু ছেলেটার প্রেমে পড়ে গিয়েছি আমি। ড্রেস আপ সেন্স কি চমৎকার। তারওপর ওই হাসিটা!' 

শুভ্র ভাই ঠিক ওভাবেই হাসলেন। ঘাড়ে হাত ঘষতে ঘষতে বললেন, 

' খাবি চল। অলমোস্ট একটা বাজে। ঘুম পাচ্ছে আমার। জলদি খেয়ে উদ্ধার কর। তোর বাপ যে হিটলার। দেখা যাবে, তোকে না খাইয়ে রাখার অপরাধে আমার নামে মামলা টামলা ঠুকে দিয়েছে।' 

আমি সোফার দিকে এগিয়ে যেতেই শুভ্র ভাই বললেন, 

' আমি এখন রুমে যাব। হালকা পাতলা কাজ আছে রুমে। তুই এখানে একা বসে খেতে পারবি? নয়ত আমার রুমে বসে খেতে পারিস। শর্ত একটায়, খাওয়া শেষ করেই উত্তর দক্ষিণ না দেখে বেরিয়ে যাবি। আমার ঘরে রাতের বেলা মহিলা মানুষ এলাউড নয়। চরিত্র খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।' 

আমি একবার ভাবলাম এখানেই থাকি কিন্তু পরমুহূর্তেই চারপাশের থমথমে পরিবেশে খানিকটা ভয় করতে লাগল। আবার ভাবলাম, খাব না। খাবারটা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ব। খেতে ইচ্ছে করছে না। তারপর আবার মনে হলো, শীতের রাতে এই ঘুমন্ত শহরটাতে, একলা জেগে একশো তিন ডিগ্রি জ্বর নিয়ে যে মানুষটি আমার জন্য রান্না করলেন। তার খাবারটা ফেলে রাখা বড্ড নির্দয়ের মতো কাজ হবে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার পিছু পিছু তার রুমের দিকে হাঁটা দিলাম। শুভ্র ভাই রুমে ঢুকেই আলো জ্বালালেন। উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল চারপাশ।  ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানার ওপর বসলেন। ল্যাপটপটা কোলে নিয়ে ক্লান্ত কন্ঠে বললেন, 

' খেয়ে নে দ্রুত।' 

আমি টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটাতে বসলাম। শুভ্র ভাইয়ের রুমটা নতুন লাগছে। কোথায় যেন কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে পরিবর্তনটা ধরতে চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ পরই বুঝতে পারলাম আসবাবপত্রগুলো এদিক-সেদিক করা হয়েছে। বিছানার ওপর আর বুক সেল্ফের পাশে বেশকিছু ছবি লাগানো হয়েছে। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম ছবিগুলোতে আমার আর মামানির ছবির প্রাধান্যই বেশি। আমাকে ছবির দিকে 'হা' করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধমকে উঠলেন শুভ্র ভাই,

' ওই বেআক্কল মাইয়া? তুই কি কোনোভাবে আমার রুমে থেকে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছিস নাকি? এমন কিছু ভেবে থাকলে ভুলে যা। আমি আমার রুমে কাউকে এলাউ করব না।' 

' আপনার রুমে কেন থাকব? আমার কি থাকার জায়গার অভাব হয়েছে?' 

কথাটা বলে আবারও আড়চোখে ছবিগুলোর দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। ছবিগুলোকে ইশারা করে বললেন, 

' বারবার এদিক-ওদিক তাকাবি না। ওসব আমার ব্যক্তিগত জিনিস। তুই বোধহয় আমার রুম থেকে যেতে চাইছিস না। তাই না-খেয়ে তব্দা মেরে বসে আছিস। দে আমি খাইয়ে দিই।' 

শুভ্র ভাই আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমার সামনে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসলেন। হাতের প্লেটটা নিজের হাতে টেনে নিয়ে বললেন, 'হা কর।' আমি অন্যদিকে তাকিয়ে খাবার মুখে নিলাম। শুভ্র ভাই তার তপ্ত হাত দিয়ে আমার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, 

' যতক্ষণ খাবি ততক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকবি। চোখ অন্যদিকে সরিয়েছিস তো কেটে বস্তা ভরে বহ্মপুত্রে ফেলে আসব। এবার আমি সিরিয়াস।' 

শুভ্র ভাইয়ের শক্তপোক্ত কথায় অন্যদিকে তাকানোর সাহস আর হয়ে উঠল না আমার। অস্বস্তি নিয়েই শুভ্র ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরই বুকের ভেতর থাকা অনুভূতিগুলো উথাল-পাতাল ঢেউ তুলতে লাগল। হঠাৎ-ই আমি বাম হাতটা তার কপালে রেখে জ্বর পরীক্ষা করতে উদ্যত হলাম। শুভ্র ভাই চোখ বোজলেন। আমি আৎকে উঠে বললাম, 

' আপনার গায়ে অনেক বেশি জ্বর। তবুও এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন? আমাকে খাইয়ে দিতে হবে না। আমি...' 

আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েই শুভ্র ভাই মৃদু হেসে আবৃত্তি করলেন,

' প্রিয় জ্বর আর কিছুদিন থাকো
অন্তত এই বাহানায় আর কিছুদিন সে আসুক।
আমার কপাল হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে
সে যদি আমার ভিতরের অসুখ বুঝতে পারে!

যদি সে বুঝতে পারে আমার চোখে কতটা অসুখ
তাকে চোখের দেখা দেখতে চেয়ে। 
যদি সে বুঝতে পারে আমার হাতে কতটা অসুখ,
তার হাতের আঙ্গুল ধরতে চেয়ে।

প্রিয় জ্বর আর কিছুদিন থাকো,
অন্তত এই বাহানায় আর কিছুদিন তাকে দেখি।
তার দু'চোখ হাতের আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে,
আমার না বলা অসুখ যদি তাকে বলতে পারি।
                       
----রুদ্র গোস্বামী '

আমি মুগ্ধ চোখে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। অনুভূতির উথাল পাতাল যন্ত্রণায় হঠাৎ অদ্ভুত এক কাজ করে বসলাম। জীবনের প্রথম নিজে থেকে উনার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। উনি চমকে উঠলেন। হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলেন। চমকালাম আমিও। লজ্জা, সংকোচ আর অস্বস্তিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম। শুভ্র ভাই আগের মতোই বজ্রাহতের মত বসে রইলেন। আমি দরজার দিকে দৌঁড় লাগাতেই ডানহাত ধরে আটকে ফেললেন তিনি। ততক্ষণে লজ্জা আর ভয়ে মরে যাওয়ার দশা আমার। শুভ্র ভাই কোন কথা বললেন না। আমিও ফিরে তাকালাম না। তিনি আমার হাতে ঠান্ডা, শক্ত কিছু একটা ধরিয়ে দিয়ে হাত ছেড়ে দিলেন। আমি এক দৌড়ে নিজের ঘরে এসে দরজা দিলাম। হৃদপিণ্ড তখন ভয়ানক গতিতে ছুটছে। ছি! কি করে ফেললাম আমি? কেন করলাম? কিভাবে যাব এবার উনার সামনে? দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই হাতের মুঠো খুলে দেখলাম একটা চাবি। চাবি? এই চাবি দিয়ে কি হবে? তাছাড়া এর তালায় বা কোথায়? আমি আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে করতে চাবিটা উল্টেপাল্টে দেখলাম। আচ্ছা? এই ঘরে থাকা আসবাবগুলোতে এই চাবি খাটে কিনা তা খুঁজে দেখলে কেমন হয়? এই ঘরটাতে চাবি সংক্রান্ত দুটো আসবাব আছে। একটি কাঠের শোকেস। আরেকটা মাঝারি আকারের আলমারি। আমি শোকেসের তালায় বেশ কয়েকবার চাবি ঘুরালাম, কাজ হলো না। তবে আলমারির তালায় চাবি দিতেই খুলে গেল তার পাল্লা। পাল্লাটা খুলে ভেতরে তাকিয়েই অবাক হলাম আমি। শুভ্র ভাইকে ফিরিয়ে দেওয়া জিনিসগুলো খুব যত্ন করে গুছানো। সুপ্ত মনটা খুশিতে নেচে উঠল। প্রত্যেকটা জিনিস উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতেই চুড়ির বাক্সটা চোখে পড়ল। বাক্সর ঢালা ভাঙা। ভেতরের সব চুরি ভেঙে টুকরো। সেখানে হলুদে রঙের ছোট্ট এক চিরকুট, 

' রাগ করে ভেঙে ফেলেছি তোমার শখের চুড়ি। নতুন কিনেও এনেছি আবার। তবে, সেগুলো সেদিনই পাবে যেদিন আমার বুকের কালো মেঘটা সরিয়ে রোদ ছড়াতে পারবে। এবার একটু রোদ হয়ে নামো প্লিজ। তোমার উষ্ণতার অপেক্ষায় আমি ক্লান্ত।' 

প্রিয় জিনিসগুলোর নিচে সেই নতুন চুড়ির বক্সটাও পাওয়া গেল। সেইসাথে পাওয়া গেল নতুন নীল শাড়ি। মিষ্টি দেখতে লাল টুকটুকে একটি পুতুল। তারপাশেই যত্নে রাখা একটি ডায়েরি। ডায়েরির গায়ে লাল সুতো দিয়ে বাঁধা এক চিঠি। আমি চিঠিটা নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম। সেখানে চিরপরিচিত অক্ষরে লেখা,

' শ্যামলতা, 

তুমি ঠিক কবে এবং কখন চিঠিটা পড়বে জানি না। তবে সেই সময়টা নিশ্চয় বিশেষ কোনো সময় হবে। কেননা, কোনো বিশেষ সময় ব্যতিত এই গুপ্ত অনুভূতির চাবির সন্ধান তুমি পাবে না। পাওয়ার কথাও নয়। আমি পেতে দেব না। আমি যেদিন অনেক বেশি খুশি হবো। কষ্ট, অবহেলা, রাগ, অভিমানকে ছাপিয়ে দিয়ে তোমার দেওয়া সুখে ভাসব ঠিক সেদিনই এই চাবি হাতে পাবে তুমি। নয়তো না। 

আমাকে এই বিশেষ অনুভূতিটা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ রোদপাখি। তোমার তৃষ্ণায় আকন্ঠ ডুবিয়ে এই মহমান্বিত পানীয় খুবই প্রয়োজন ছিল। তুমি নাহয় চিরকালই এমন নিষ্ঠুর, উদাস থেকো। আমাকে প্রচন্ড তৃষ্ণায় ছটফট করিয়ে হঠাৎ একটু তৃষ্ণা মিটিও। এই এক ফোঁটা পানীয়ের জন্য লক্ষ বছরের তৃষ্ণা, ক্লান্তি আমি মাথা পেতে নেব। 

ইতি..
আমি '

চিঠিটা হাতে নিয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম আমি। বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। চোখে ভর করল এক রাজ্য ঘুম। মনের কোথাও বয়ে বেড়াতে লাগল অকল্পনীয় সুখ। অতৃপ্ত তৃষ্ণা!  


ঝুম বৃষ্টির সকালবেলা কোনো এক হিন্দি সিরিয়ালের তুমুল ঝগড়াঝাটির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমার। আপু ইউটিউব দেখছে। সাউন্ডে কান ফেটে যাওয়ার জোগার। আমি বিরক্তি নিয়ে উঠে বসলাম। আপু আজকাল সুযোগ পেলেই ইউটিউব ছেড়ে কান ফাটিয়ে ফেলার মহান দায়িত্বটা পালন করছে। হঠাৎ ঘুম ভাঙায় ঝিমঝিম করছে মাথা। সারা শরীরে বিশ্রী অলসতা। আম্মু রান্নাঘর থেকেই চেঁচিয়ে উঠলেন,

' রোদ? এখনও উঠলি না? সবার খাওয়া-দাওয়া শেষ। এখনও পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস তুই? উঠবি নাকি মাইর লাগাব?' 

আমি আগের মতোই থম ধরে বসে রইলাম। নড়তে-চড়তে ইচ্ছে করছে না। আপু চেঁচিয়ে জানাল, আমি উঠেছি। চিল্লাচিল্লির দরকার নেই। আম্মু তবুও চেঁচালেন। এখনও বিছানায় কেন বসে আছি তা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ গজগজ করলেন। 'নড়তে চড়তে একদিন' --- প্রবাদটাকে সম্পূর্ণ অর্থবহ করে ওয়াশরুমে গেলাম আমি। সকালের নাস্তা খিচুড়ি আর ডিম ভুনা। ভালো খাবার। আমি খাবারের প্লেট হাতে সোফায় পা তুলে বসতেই আব্বু-আম্মুর নিচু স্বরে বলা কথোপকথন কানে এলো। আমি একরকম হামলে পড়ে বললাম,

' কী নিয়ে কথা বলো? কী হয়েছে আম্মু?' 

আমার দাঁত কেলানো হাসিতে আম্মুর মন গলল না। ভয়ানক এক ধমক দিয়ে বললেন, 

' সব জায়গায় এতো কান পাতা স্বভাব কেন? যা, খাবার টেবিলে গিয়ে বস।' 

আমি আগের মতোই ঠাঁই বসে কান পেতে রইলাম। তবে খুব বেশি তথ্য জোগার হলো না। আপুর পাত্র বিষয়ক কোনো আলোচনা চলছিল, ব্যস। আমি হতাশ মুখে খাবার শেষ করলাম।

ঠিক দুপুরে, ফোনের ভেতর অলমোস্ট ঢুকে গিয়ে নিউজফিড স্ক্রল করছিলাম আমি। ঘর ফাঁকা, আপু টিউশনিতে গিয়েছে। এমন সময় ভেতরে ঢুকলেন আম্মু। আমার পাশে বসে বললেন,

' সারাদিন ফোনের ভেতর কী করিস? ঘরদোরও তো একটু গোছাতে পারিস। যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। ফোনে কাজ আছে বলে সারা দুনিয়া অন্ধকার করে বসে থাকবি, এটা কেমন কথা?'

আমি উত্তরে চোখ তুলে চাইলাম। আম্মু গলার স্বর খানিকটা নামিয়ে এনে বললেন,

' তোর মামু রুহির সাথে শুভ্রর বিয়ের কথা বলছেন। এখন কী করি বল তো?তোর বাবা বলেছেন, রুহি রাজি হলে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। রুহির মতের বাইরে গিয়ে কিছু করবেন না। রুহি কী রাজি হবে? তোর বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। কয়েকদিন পর রিটায়ার্ড করবেন। কখন কোন দূর্ঘটনা ঘটে যায় কে জানে? রুহিকে বললাম, আরাফের পরিবারকে বিয়ের প্রস্তাব আনতে বল, সেটাও তো আনছে না। এভাবে হাত গুটিয়ে বসেও থাকতে পারি না। তোর বাবা আমাকে নিয়ে আবার হজ্জে যেতে চান। এতো বড় মেয়েকেঘরে রেখে হজ্জে কী করে যাবেন? আবার শুভ্রর সাথে বিয়ের বিষয়টাও কেমন খচখচ করছে। রুহিকে শুভ্র ছোট থেকেই বোনের মতো স্নেহ করে। এখন হঠাৎ বিয়ে।  আমার তো মাথা ঘুরছে। ভাইয়া হুট করেই কেমন একটা প্রস্তাব দিয়ে ফেলল, বল তো? তবে বিয়েটা হলে খুব একটা খারাপও হবে না। শুভ্র ভালো ছেলে। তুখোড় ছাত্র। ভবিষ্যতে ভালো কিছু একটা করবে অবশ্যই।' 

আমি হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলাম। আম্মু চেয়ে আছে আমার মুখে। আম্মুর চাহনী দেখে হঠাৎ লজ্জা লাগছে আমার। নিশ্চয় কোনো উত্তর প্রত্যাশা করছেন? আমি মস্তিষ্ক হাতড়েও বলার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,

' হঠাৎ বিয়ে কেন? ভাইয়াকে বলেছ? ভাইয়া কী বলল?' 

আমাদের পরিবারে একটা বদ্ধমূল নিয়ম হলো যেকোনো কাজে পরিবারের সকলের থেকে আলাদা আলাদাভাবে মতামত নেওয়া হয়। বাবার ধারণা, আমরা এখন বড় হয়েছি। পরিবারের ছোটবড় সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার সময় এসেছে। আম্মু উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,

' রাহাত তো কিছু বলল না। শুধু শুনল। সব শুনে বলল, আমি কী বলব? তোমরা দেখো। এবার তুই বল। কী করা উচিত?' 

আমি হেসে ঠিক ভাইয়ার মতো করে বললাম,

' আমি কী বলব? তোমরা দেখো।' 

আম্মু উদ্বিগ্ন মুখে বসে রইলেন। আমার কাছে গোটা ব্যাপারটাই ভয়ানক বিশ্রী লাগছে। আপু আর শুভ্র ভাই? ছি! ভাবতেই কেমন গা গোলাচ্ছে। আপুর জায়গায় অন্যকেউ হলেও ঠিক ছিল কিন্তু? আম্মু বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

' তুই একটু রুহিকে বুঝা। রুহি ৪/৫ বছর সময় চাইছে। শুভ্রর সাথে বিয়ে হলে স্যাটেল হওয়ার জন্য ৪/৫ বছর সময় এমনিতেই পেয়ে যাবে ও। শুভ্র এই সেপ্টেম্বরে স্কলারশিপের জন্য জাপান যাচ্ছে। ওর জাপানের পড়াশোনা শেষ হতে চার, পাঁচ বছর লাগবেই। ততদিনে...  ভাইয়ার শরীরও ভালো না। আল্লাহ না করুক এর মধ্যে খারাপ কিছু ঘটে গেলে একমাত্র ছেলের বিয়েটাও দেখে যেতে পারবে না। ভাইয়ার প্রস্তাব তো ফিরিয়েও দিতে পারি না। তুই একটু বুঝা রুহিকে।' 

আমি শান্ত কন্ঠে বললাম,

' আম্মু?আমি আপুকে বুঝাব, তুমি এখন যাও। আমার পুরো বিষয়টা খুব বিশ্রী লাগছে। বারবার শুনতে ইচ্ছে করছে না। এক কথা বারবার বলবে না।' 

' বিশ্রী লাগার কী হলো?' 

' বিশ্রী লাগার কী হলো সেটা তুমি বুঝতে পারছ আম্মু। ওদের বিয়ে জায়েজ হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আত্মিক বাধা থাকে। আপু ভাইয়াকে যেভাবে দেখে, শুভ্র ভাইয়ের প্রতি তার দৃষ্টিও সেরকম। আমি এখন তাকে কী বুঝাব? ভাইয়ের দৃষ্টি সরিয়ে বর বর দৃষ্টিতে তাকাও। প্লিজ আম্মু, যাও তো। আমার মেজাজ খারাপ লাগছে।' 

' তারমানে তুই ওকে কিছু বলবি না?' 

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

' তাকে কিছু বলব না এমন তো বলিনি আম্মু। আমি বুঝাব। তুমি যাও। এই বিষয়ে আর কিছু শুনব না আমি, প্লিজ।' 

আম্মু বেরিয়ে গেলেন। আমার মেজাজ খারাপ তরতর করে বাড়তে লাগল। চারপাশের সবকিছু অসহ্য লাগছে।ফোনে টুংটাং শব্দ হচ্ছে। স্পৃহা নক দিচ্ছে বারবার। নোটিফিকেশন টুন, ম্যাসেজ টুন সবকিছুতে মাথা ধরে গেল আমার। ভেতরের মনটা ক্ষণে ক্ষণে চেঁচাতে লাগল, উফ, অসহ্য! অসহ্য! অসহ্য! আমি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সরে এলাম। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার ডিলিট করে, সীম বন্ধ করে, হাত- পা ছড়িয়ে পড়ে রইলাম বিছানায়। দুপুরে খাওয়া-গোসল কিছু হলো না। আম্মুর সাথে অযথা মেজাজ দেখালাম। সেল্ফের সব বই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করল। ড্রেসিং টেবিলের আয়না ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করল। অযথা এই রাগে নিজের প্রতিই বিরক্ত হয়ে উঠলাম আমি। আপু ফিরল বিকেলে। আপুকে কীভাবে, কী বুঝাব মাথায় এলো না। থম ধরে বসে রইলাম। আম্মু শেষ বিকেলে বুঝানোর ব্যাপারটা মনে করিয়ে দিলেন। আপুকে বলতে না পেরে সন্ধ্যার আগে আগে সীম অন করে শুভ্র ভাইকে ফোন লাগালাম আমি। শুভ্র ভাই ফোন তুললেন না। দুই থেকে তিনবার ফোন দেওয়ার পর ফোন তুলে বললেন,

' বলে ফেল।' 

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। অগোছালো কথাগুলো গোছানোর চেষ্টা করলাম। শুভ্র ভাই অধৈর্য কন্ঠে বললেন,

' তুই কী ফোঁস ফাঁস নিঃশ্বাসের শব্দ শোনানোর জন্য ফোন দিয়েছিস আমাকে? শোন রোদু, মোবাইল ফোনটা ফোঁস ফাঁস নিঃশ্বাস শোনানোর জন্য আবিষ্কার করা হয়নি। প্রয়োজনীয় কথা বলার জন্য আবিষ্কার করা হয়েছে। সুতরাং ফোন দিয়ে প্রয়োজনীয় কথা বলবি। তোর মতো বলদরাই শুধু অপ্রয়োজনীয় ফোন কল করে অন্যের প্রয়োজনীয় সময় নষ্ট করে। বেয়াদব, কথা বল।'

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এই হারামখোর, নিষ্ঠুর, বেয়াদব ছেলেটাকে এই মুহূর্তে মাথা ফাটিয়ে দিতে পারলে কেমন হতো? অথবা বিশ্রী কিছু গালি দিতে পারলে? ভাবনার সমুদ্র হাবুডুবু খেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালাম আমি। শান্ত কন্ঠে বললাম,

' আপনাকে অযথা ফোন দিয়ে আপনার প্রয়োজনীয় সময় নষ্ট করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। প্রয়োজনেই ফোন দিয়েছি। আর প্রয়োজনটাও আপনার নিজের। আম্মু আপুকে বুঝানোর দায়িত্ব আমার ঘাড়ে দিয়েছেন। আমি কিছু বুঝাতে টুঝাতে পারব না। আপুর সাথে আপনি নিজেই কথা বলুন এবং তাকে বুঝান। ব্যস, এতটুকুই।' 

শুভ্র ভাই আকাশ থেকে পড়ার মতো ভাব করে বললেন,

' তোর বোনকে কী বুঝাব আমি? আমাকে কী ফ্রীতে   বুঝানোর কামলা মনে হয় তোর? তোর বাপেরও তো তাই ধারণা। শুভ্র মানেই কামলা। এনিওয়ে, কী হয়েছে ওর? ফার্মের মুরগীর সাথে ভেগে টেগে গিয়েছে নাকি? ওকে বুঝানো আমার প্রয়োজন কীভাবে? আমাকে বেতন দিবি? তোর ধারণা আমার টাকা পয়সা নাই? আমার  অন্যকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে টাকা রোজগার করতে হবে? আমি হতদরিদ্র, ভিখিরি? যাহ ফুট!' 

আমি হতবাক। একটা মানুষ ছোট্ট একটা কথাকে ঠিক কতভাবে পেঁচাতে পারে! আশ্চর্য! আমি মৃদু কন্ঠে বললাম,

' আপনাকে ভিখিরি কখন বললাম শুভ্র ভাই? বিয়ে যেহেতু আপনার তো আপনার হবু বউকে বুঝানোর দায়িত্বও আপনার। নিজের বউকে বুঝানোর জন্য বেতন দিতে হবে এখন?' 

শুভ্র ভাই কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ধমকে উঠে বললেন,

' আমার বিয়ে মানে কী? আমার হবু বউকে বুঝানোর সাথে রুহির কী সম্পর্ক? আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। উল্টাপাল্টা কথা বলে মাথা না খেয়ে ফোন রাখ।' 

আমি সত্যি সত্যিই ফোন রেখে দিলাম। ফোন-টোন অফ করে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। রাতে খাওয়া-দাওয়া কিছু হলো না। মেজাজ খারাপ, খেতে ইচ্ছে করছে না। আপুকে তখনও কিছু বলা হয়নি। আচ্ছা? আপুকে জানানোর পর কেমন রিয়েকশন হবে তার? অবাক হবে? রাজি হয়ে যাবে? নাকি থমথমে মুখে নাকোজ করবে প্রস্তাব? সারারাত নির্ঘুম কাটল আমার। বইয়ে মন বসল না। চা খেতে ইচ্ছে হলো না। ঘুমানোরও কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। আচ্ছা? ঘুমানোর জন্যও বুঝি কারণ প্রয়োজন? মানুষ শরীরের প্রয়োজনে ঘুমায়? নাকি স্বপ্ন দেখার প্রয়োজনে? সারারাত বারান্দাময় পায়চারী করে সকাল সাতটার দিকে ঘুমোতে গেলাম আমি। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে একটা বাজল। গত দুইদিনে আজ কিছুটা খাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু খাওয়া যাচ্ছে না। বিস্বাদ খাবার মুখে তুলা মুশকিল। খাওয়া-দাওয়া-গোসল শেষ করতে করতেই আসরের আজান পড়ল। তার কিছুক্ষণ পর মামু আর মামানি এলেন বাসায়। বসার ঘরে নিচু গলায় আলোচনা শুরু হলো। গুরুগম্ভীর আলোচনা। আপু আমাকে জিগ্যেস করল,

' ব্যাপার কী রে?' 

আমি বিরস কন্ঠে বললাম,

' জানি না।' 

দুই জনই গিয়ে দাঁড়ালাম দরজার কাছে। কান খাঁড়া। মনে আলোচনার বিষয়বস্তু শোনার তাড়া। আলোচনার মাঝপথে হঠাৎ বললেন মামানি,

' তোমার ভাই ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলেছে। রোদের কথা বলার ছিল। রোদের বিয়ের কথা বলতে এসে.... ' 

আম্মু-আব্বু দুজনেই বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলেন। আপুও হতবাক। আম্মু-আব্বুর হতভম্ব ভাব কাটতে সময় লাগল। প্রায় দশ মিনিট চুপ করে চেয়ে থেকে প্রথম কথাটা বললেন,

' অসম্ভব! এই প্রস্তাবটা আপনি কী করে আনতে পারেন ভাবী? এমন প্রস্তাব আনাই তো উচিত হয়নি।' 

বাবার কথার উত্তরে ব্যস্ত হয়ে বললেন মামানি,

' অসম্ভব কেন? শুভ্র কী রোদের যোগ্য নয়?' 

বাবা উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,

' যোগ্যতা নিয়ে কথা আসছে না ভাবী। শুভ্র নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে। কিন্তু আপনারা একের পর এক যা প্রস্তাব আনছেন তা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। রোদের বয়স কত? ওর বিয়ের বয়স হয়েছে? শুভ্রর সাথে রোদের বিয়ে চিন্তায় করতে পারি না আমি। একইভাবে রুহির সাথেও শুভ্রকে ভাবতে পারি না। তাছাড়া রুহি থাকতে রোদকে বিয়ে দেওয়া অসম্ভব। সমাজ কী বলবে? বড় মেয়ে থাকতে ছোট মেয়ের বিয়ে? ছিঃ!' 

মামানি হাল ছাড়লেন না। অসহায় কন্ঠে বললেন, 

' এভাবে বলবেন না ভাই। আপনি তো জানেন রোদকে কতটা পছন্দ করি আমি। ছোট থেকেই নিজের বাচ্চার মতো দেখি ওকে। রোদের অন্য কোথাও বিয়ে হলে আপনাদের সাথে তার সম্পর্ক বহাল থাকলেও আমাদের সাথে তার সম্পর্কটা হয়ে যাবে নড়বড়ে। আমি রোদকে নিজের কাছে রাখতে চাই। এমন তো নয়, আপনারা আপনাদের মেয়েকে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। আমার ছেলে তো খারাপ নয়। যেকোনো মেয়েকে বিয়ে করার যোগ্যতা ওর আছে। অরি? তুমি কিছু বলো। শুভ্রকে তো ছোট থেকেই দেখছ।' 

আম্মু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। তাঁর বিস্ময়ভাব কাটছে না। আম্মুকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি কিছু বুঝতে পারছেন না। তাকে হঠাৎ প্রচন্ড ঝাঁকুনি দেওয়া হয়েছে। তাঁর মাথা ঘুরছে। আম্মু আরও কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে বললেন,

' শুভ্র আর রোদ? কীভাবে সম্ভব ভাবী? আপনার মাথা ঠিক আছে? শুভ্র রোদকে ছোটবেলা থেকেই বোনের মতো স্নেহ করে। শুনতেই তো কেমন বিদঘুটে লাগছে ভাবী। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন। আমরা বরং শুভ্রর জন্য সুন্দর একটা মেয়ে খুঁজি।' 

মামানি এবার রেগে গেলেন। বসার ঘরে তুমুল বাকবিতন্ডা শুরু হলো। আমি আর আপু ভীত চোখে চেয়ে আছি। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। শেষমেশ এই বিয়েশাদি নিয়ে দুই পরিবারের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে না তো? প্রায় ঘন্টাখানেক বাকবিতন্ডার পর বাবা মামুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

' ভাই? আপনিই বলেন। এই বয়সে রোদের বিয়েটা ঠিক? আমার ছোট মেয়েটাকে এখনই বিয়ে দেওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারি না আমি। বিয়ের বয়স হয়তো ওর হয়েছে কিন্তু আমার কাছে হয়নি। আমার শেষ বয়সের সম্বল আমার ছোট মেয়ে। ওকে শেষ বয়সে কাছে কাছে রাখতে চাই। এখনই বিয়ে দেব না। আপনি তো বুঝবেন ব্যাপারটা।' 

মামু এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার গলা খাঁকারি দিয়ে মৃদু কন্ঠে বললেন, 

' আপনার ব্যাপারটাও বুঝতে পারছি। কিন্তু ছেলে না মানলে, না মানে ছেলের মা মানতে না চাইলে কী করি বলুন? রোদের প্রতি ওর টান ছোট থেকেই। রোদও ছোট থেকে ওর কোলে কোলেই বড় হয়েছে। মেয়ে হয়ে যেহেতু জন্মেছে বিয়ে তো দিতেই হবে। আজ নাহয় কাল। শুভ্রর সাথে ওর আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। এর মধ্যে বিয়ের কথাটা আসলেই একটু বিদঘুটে শোনায়। কিন্তু শুভ্রর সাথে বিয়েটা হলে কিন্তু মেয়েকে আপনি কাছেকাছেই রাখতে পারছেন।' 

বাবা গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

' মেয়ে তো পালিয়ে যাচ্ছে না। শুভ্র পড়াশোনা শেষ করে ফিরুক। ততদিনে আল্লাহ চাইলে রুহির বিয়েটাও হয়ে যাবে। আমরা নাহয় তখন ভাবব এই বিষয় নিয়ে। তাড়া তো নেই।' 

দেখা গেল মামানির প্রচুর তাড়া। তিনি বাবাকে ব্যস্ত হয়ে বুঝালেন। শেষে ক্লান্ত কন্ঠে বললেন,

' ছেলে আমার বিদেশ ভূঁইয়া পাড়ি জমাচ্ছে ভাই। আপনার ভাইয়ের শরীরও ভালো না। কখন কী হয় বুঝা মুশকিল। একমাত্র ছেলের বিয়েটা না দেখে যেতে পারলে আফসোস থেকে যাবে। তাছাড়া, আমাদের দুজনেরও তো আঁকড়ে ধরার মতো কেউ চায়। আপাতত এতটুকু স্বস্তি পাব যে ছেলের ঠিকঠাক সঙ্গী নির্বাচন করতে পেরেছি।' 

মামানির এই কথায় বাবার তুমুল আপত্তি দেখা দিল। সব মিলিয়ে ঝামেলাটা প্রকান্ড রূপ ধারণ করল। আমি আর আপু দরজা ছেড়ে বিছানায় বসে রইলাম। দুজনের মুখই থমথমে, হতভম্ব। কী হচ্ছে এসব? আপু বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

' এখন কী হবে?' 

আমি জবাব দিলাম না। আপু নিজের মনে বলল,

' বাবাকে বলবি যে তুই অন্য কাউকে পছন্দ করিস? শুভ্র ভাইয়েরও তো গার্লফ্রেন্ড আছে শুনেছিলাম। তুই চাপ নিস না। শুভ্র ভাই লয়াল ছেলে। উনি যেহেতু অন্য কাউকে পছন্দ করেন সেহেতু দুনিয়া উল্টে গেলেও বিয়েতে রাজি হবেন না। কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে ফেলবে তবুও না।' 

আমি আগের মতোই চুপ করে বসে রইলাম। কিছুক্ষণের মাঝে উপলব্ধি করলাম, আমার রিয়েকশন বাটন কাজ-টাজ করছে না। সিস্টেম নষ্ট। কোনো ঘটনাতেই প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছি না। সন্ধ্যায় মামুরা চলে গেলেন। কী সিদ্ধান্ত হলো, আমি আর আপু কেউই বুঝতে পারলাম না। রাতে বাবা আম্মুর সাথে প্রচন্ড রাগ দেখালেন। তিনি মেয়ের বিয়ে কিছুতেই দিবেন না। আমি, আপু আর ভাইয়া একে অপরের দিকে হতাশ চোখে চেয়ে রইলাম। তাঁদের ঝগড়ার মাঝেই হঠাৎ উপলব্ধি করলাম আমার লজ্জা লাগছে। বাবা-মা আমার বিয়ে নিয়ে ঝগড়া করছে? ইয়া মা'বুদ! কী লজ্জাজনক অবস্থা। সেই রাতটা কাটল সবার থমথমে মেজাজে। একমাত্র আমিই বোধহয় ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা অনুভব করলাম। আমার স্বল্পবাসী ভাই মুখ ফুটে বলেই ফেলল,

' শুভ্র তো ছেলে ভালো। মামানিরা যখন এতো জোড়াজুড়ি করছে তখন পজিটিভ সিদ্ধান্তও নেওয়া যায়।' 

আপুর চোখ-মুখ উত্তেজনায় ঝলমল করতে লাগল। সে সারা রাত পায়চারী করে কাটিয়ে দিল। একটু পর পর ভবিষ্যতবাণী করতে লাগল, কী হতে পারে!  পরমুহূর্তেই হতাশ হয়ে আমায় জিগ্যেস করতে লাগল, কী হতে পারে? আমি বেকুবের মতো বসে রইলাম। ফোন বন্ধ, বই পড়তে ইচ্ছে করছে না, চা খেতে ইচ্ছে করছে না, ঘুমানোর কারণ খুঁজে পাচ্ছি না এভাবেই কেটে গেল আরেকটা রাত। পরের দিন সকালে কিছুক্ষণের জন্য ফোন অন করলাম। স্পৃহাকে পুরো ব্যাপারটা জানাব জানাব করেও ফোন কেটে আবারও ফোন অফ করে রেখে দিলাম। সারা শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে। প্রচন্ড টেনশনে গা গোলাচ্ছে। হাত জ্বলছে। আমি সকাল থেকেই ঘরের ভেতর চুপচাপ বসে রইলাম। দুপুর দিকে আপু এসে হতাশ কন্ঠে বলল,

' কাজী আসছে বিকেলে। বিয়েটা বোধহয় হয়েই যাবে। শুভ্র ভাই রাজি হয়েছে কি-না বলা যাচ্ছে না।' 

আমি চমকে উঠলাম। এভাবেই বিয়ে ঠিক হয়ে গেল? এদের লড়াই ঝগড়াতে আমার মতামত নেওয়ার ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গেল? আশ্চর্য!  আমি অবশ্যই বিয়ে টিয়ে কিছু করব না। শুভ্র ভাইকে তো কখনোই না। সবার এই নিষ্ঠুরতায় আমার কান্না পেয়ে গেল। আমি বিছানায় হাত-পা ছুঁড়ে দিয়ে বললাম,

' আমি বিয়ে করব না।' 

আপু হাই তুলতে তুলতে বলল,

' সেটা তোর কালকে বলার উচিত ছিল। বাবার মেজাজ এখন এমনিতেও চড়া। বাবার সামনে যেতেই ভয় লাগছে আমার।' 

আমি পুরো দুপুর বিছানায় গড়াগড়ি করে চিৎকার-চেঁচামেচি করলাম, 

' আমি বিয়ে করব না। শুভ্র ভাইকে তো জীবনেও বিয়ে করব না। করব না। করব না। করব না।' 

দুপুর পর্যন্ত আমার চিৎকার চেঁচামেচিতে মোটামুটি সবাই অতিষ্ঠ হয়ে গেল। ঘড়িতে তিনটা বাজতেই খেয়াল করলাম, বাসায় কোনো বাড়তি মানুষের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে না। আমি চিল্লাচিল্লি থামিয়ে দিলাম। বিয়ে মানেই অনেক মানুষ। যেহেতু মানুষ নেই সেহেতু বিয়ে হচ্ছে না। চিল্লাচিল্লি থামিয়ে ঘুম দিলাম আমি। অশান্তির ঘুম। আমাকে ঘুমের মাঝেই ডেকে তুলল আপু। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, 

' কী হয়েছে?' 

আপু উত্তেজনা নিয়ে বলল,

' বিশাল কাহিনী হয়ে গিয়েছে। বসার ঘরে কাজী সাহেব বসে আছেন অথচ শুভ্র ভাইয়ের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। উনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, উনি বিয়েশাদী করবেন না। উনার প্রচুর ব্যস্ততা। রুম থেকে বেরিয়ে আমাদের বাসা পর্যন্ত আসা মানে বিশাল ক্ষতি। রেজিস্ট্রার খাতায় স্বাক্ষর করার মতো সময় তার নেই।' 

আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। চুলগুলোকে হাত খোপা করতে করতে বললাম,

' উনি বিয়ে করবেন না মানে? আমি কী বিয়ে করার জন্য নাচছি নাকি? আমিই উনাকে বিয়ে করব না। করব না  মানে করব না।' 

বিছানার কুশন, কাঁথা, চাদর সবই ছুঁড়ে ফেললাম আমি। চাপা স্বরে শাসানোও চলল কিছুক্ষণ। বিয়ে করব না বলে হৈ হৈ চলল। আম্মু পর্দা সরিয়ে গরম চোখে তাকালেন একবার। আপু নির্বিকার বসে রইল। শুভ্র ভাইয়ের জেদ আমার থেকে ডাবল। উনি চোটপাট কিছু করলেন না। সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিলেন, উনি বিয়ে করবেন না। উনার এক কথা। যা বলবেন তাই। আমার মেজাজ খারাপ তখন তরতর করে বাড়ছে। মামু-মামানি দিশেহারা। শেষমেষ এক রকম জোর করেই শুভ্র ভাইকে ডেকে আনা হলো বাসায়। অনেকটা হাতে-পায়ে ধরার মতো অবস্থা। উনি বাসায় এসে মামানির সাথে কিছুক্ষণ চাপা রাগ দেখালেন। তারপর যথারীতি স্বাক্ষর করলেন। এবং স্বাক্ষর শেষেই পত্রপাঠ বিদায় নিলেন। এক মিনিটের জন্যও দাঁড়ালেন না। এটুকু আপুর বদৌলতে জানা, আমার সাথে উনার দেখা-টেখা কিছু হলো না। বাবাসহ অচেনা এক লোক আমার ঘরে এলেন ঠিক সন্ধ্যায়।  আমাকে রোল করা বিশাল এক খাতা দিয়ে স্বাক্ষর করতে বলা হলো। 'মা এখানে স্বাক্ষর করো' ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো কথা ভদ্রলোক রুমের ভেতরে থাকতে বললেন না। কিছুক্ষণ পর আপু নাচতে নাচতে এসে বলল,

' এতো ঢং করে কী লাভ হলো? কাবিন তো হয়েই গেল।' 

আমি অবাক হয়ে বললাম, 

' বিয়ে হয়ে গিয়েছে? কীভাবে হলো? কবুল তো বললাম না।' 

আপু বলল,

' বিয়ে হয়নি। কাবিন হয়েছে।' 

আমি হতবাক,

' মানে? বিয়ে আর কাবিন কী আলাদা?' 

' হ্যাঁ আলাদা। ধর্মীয় পদ্ধতিতে বিয়ে হয়নি। শুধু রেজিষ্ট্রেশন হয়েছে। শুধু রেজিষ্ট্রেশন করলে দাম্পত্য জীবন জায়েজ হয় না।' 

' তুমি না মাত্রই বললে, কাবিন হয়েছে? রেজিষ্ট্রেশন, কাবিন সবই তো হলো। তাহলে বিয়ে হলো না কেন?' 

আপু হতাশ হয়ে বলল,

' শুভ্র ভাই ঠিকই বলে, তুই গাধার চূড়ান্ত। কাবিন আর রেজিষ্ট্রেশন একই জিনিস।' 

আমি চূড়ান্ত কনফিউশড হয়ে বললাম,

' উফ! তাহলে বিয়ে আবার কীভাবে হয়? আলাদা নিয়ম আছে? আচ্ছা, তুমি এতটুকু বলো, আমি এখন বিবাহিত নাকি বিবাহিত নই?' 

' কাগজে-কলমে বিবাহিত। কিন্তু ধর্মীয়ভাবে বৈধতা নেই। বিয়ে বৈধ হওয়ার জন্য বিয়ে পড়াতে হবে। ওটা এখন হবে না। শুভ্র ভাই পড়াশোনা শেষে ফিরে আসার পর। বুঝলি রোদু? শুভ্র ভাই মামানির সাথে বিশাল রাগারাগি করলেন। তোর কাপলে দুঃখ আছে।'

আমি ক্লান্ত মুখে বসে রইলাম। আপু রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমি সীম অন করে দ্রুত স্পৃহাকে ফোন লাগালাম। স্পৃহা ফোন তুলতেই নিস্পৃহ কন্ঠে বললাম, 

' দোস্ত? আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।' 

স্পৃহা আমার কথাকে জাস্ট পাত্তা না দিয়ে আশেপাশের গল্প জুড়ে দিল। ফোন বন্ধ কেন, আইডি ডিয়েক্টিব কেন, হোয়াটসঅ্যাপে পাওয়া যাচ্ছে না কেন হেনতেন। আমি ক্লান্ত কন্ঠে বললাম,

' আমি সিরিয়াস দোস্ত। বিশ্বাস কর।' 

' আমাকে তোর বলদ মনে হয়? আমি জানি না আঙ্কেল-আন্টিকে? আপুকে রেখে তোকে বিয়ে দিয়ে দেবে? শোন দোস্ত? আমাকে বলদ বানানোর চেষ্টা বন্ধ কর। সারাটা জিন্দেগী প্র্যাঙ্ক করে করে আমাকে বলদ বানিয়ে আসছিস। আমার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বিশ্বাস করতে বললেও বিশ্বাস করব না।' 

আমি অসহায় কন্ঠে বললাম,

' বিশ্বাস কর, প্র্যাঙ্ক না। সিরিয়াসলি বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমার এখন কেঁদে কেটে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।' 

স্পৃহা স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

' তাহলে মরে যা। মরার আগে চল্লিশার দাওয়াত দিয়ে যা।' 

আমি হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এমন সময় আম্মু রুমে ঢুকলেন। আমি স্পৃহার ফোন কেটে চুপ করে বসে রইলাম। মুখে ভয়াবহ দুঃখী দুঃখী ভাব। আমার এবার সত্যি সত্যি কান্না পাচ্ছে। সবাই যখন জানবে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তখন কী হবে? রোদু দি বিবাহিত মহিলা!!! নো!!! আম্মু টেবিলের বই নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন,

' তোর আর শুভ্রর বিয়ের ব্যাপারে কেউ জানে না। পরিবারের বাইরে তোর ছোট কাকা শুধু জানে। তোদের ফুপুদেরও জানানো হয়নি। জানাজানি হলে সমস্যা। রুহির বিয়েতে সমস্যা হবে। আমাদের দুই পরিবার আর তোর ছোট কাকা ছাড়া এই খবর যেন আর কারো কানে না যায়। আদিবা, জারিফ কিংবা তোর বান্ধবী কেউ না। পরবর্তীতে ঘটা করে বিয়ের সময় সবাইকে জানানো হবে। এই ব্যাপারে কারো সাথে আলোচনা করিস না৷ তোর বাবা রাগ করবে। বিয়ে হয়েছে, এই ব্যাপারটাও ভুলে যা।' 

আমার বলতে ইচ্ছে করল, ' আমি কী বিয়ে করতে চেয়েছিলাম?জোর করে দিলে কেন? এখন আমি মাইক দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘোষণা করব।' বলতে ইচ্ছে করলেও বলা উচিত মনে হলো না বলে বলা হলো না। চুপ করে বসে রইলাম। মার কথা মতো বিয়ের ব্যাপারটা ভুলে গেলাম। পরিবারের সবাই না-জানার মতো ভাব করল। সবার আগে ভুলে গেলেন আমার বাবা, হয়তো শুভ্র ভাই নিজেও। স্পৃহা বারবার কল করছিল। আম্মু বেরিয়ে যেতেই রিসিভ করে বললাম,

' সরি, দোস্ত। বিয়ের ব্যাপারটা প্র্যাঙ্ক ছিল।' 

স্পৃহা খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠে বলল,

' আমি জানতাম। রুহি আপুর আগে তোর বিয়ে ইম্পসিবল। ভাগ্যিস বিশ্বাস করিনি। নয়তো ছ্যাঁকা দিতি। দেখেছিস কত ইন্টেলিজেন্ট আমি?' 

আমি হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

' হ্যাঁ। খুব ইন্টেলিজেন্ট তুই। প্র্যাঙ্কটা ধরে ফেলবি ভাবতেই পারিনি।' 

স্পৃহা গল্পের ফুলঝুরি নিয়ে বসল। আমি ফোন কেটে চুপচাপ বসে রইলাম৷ আমার পরিবারের সামনে পুরো ঘটনাটা প্রকাশ পেল এভাবে, শুভ্র ভাই বা আমি কেউই বিয়েতে রাজি নই। আমাদের ধরে-বেঁধে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মিল-মিছিল হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই। অথচ মুদ্রার অপর পাশ বলছে, এই আমরাই গত পাঁচ বছর যাবৎ লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছি। দু'দিকের দুই বিশ্বাস। মাঝে আমাদের দীর্ঘশ্বাস। ইন্টারেস্টিং না? 


রোদ-শুভ্রর প্রেমকথন 
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা 

শুভ্র ভাইয়ের সাথে আমার দেখা হলো সেই আকস্মিক ঘটনা ঘটে যাওয়ার সপ্তাহ দুই পর। বাসার অবস্থা তখন  স্বাভাবিক। আম্মু আগের মতোই ইউটিউব ঘেটে আমাদের স্বাস্থ্যবতী বানিয়ে ফেলার পায়তারায় মগ্ন। বাবা মগ্ন কোরবানির গরু সামলাতে। বিয়ে-শাদির ব্যাপারটা তাদের মাথায় নেই। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কিন্তু স্বস্তি বেশিক্ষণ টিকল না। আম্মু বিশাল এক বালতি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, 

' সারা বাড়ি ধোঁয়া-মোছার দায়িত্ব আজ তোর। সারাদিন শুয়ে-বসে থাকিস বলে ক্ষুধা লাগে না, শুকিয়ে যাচ্ছিস। স্বাস্থ্য ধরে রাখার প্রথম শর্তই হলো প্রচুর কাজ করা। সুতরাং কোনো বাহানা না দেখিয়ে কাজে লেগে পড়।' 

আমি বালতি হাতে অসহায় চোখে চেয়ে রইলাম। কাজ-টাজ পারি না, এমন কোনো ব্যাপার আমার মাঝে নেই। সমস্যা হলো, কাজ টাজ করতে আমার ভালো লাগে না। একটা বিছানা ঝাঁট দিয়েই যে হয়রান হয়ে যায় সে মুছবে পুরো বাড়ি! চারটা শোবার ঘর, বসার ঘর, খাবার ঘর, রান্না ঘর, বারান্দা..... আঙ্গুলের কড়ায় ঘর সংখ্যা গুণতে গুণতেই অজ্ঞান হওয়ার জোগাড় হলো আমার। কিছুক্ষণ গাইগুই করে, হাজারটা বাহানা দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত কাজে লেগে পড়লাম। ঘর মুছতে মুছতে প্রাণ যখন আমার ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগার। ঠিক তখনই বাসায় এলেন মামানি। আম্মু সুযোগ পেয়ে অভিযোগের পসরা নিয়ে বসলেন। আমাদের যন্ত্রণায় তাঁর যে যেদিকে দু'চোখ যায় সেদিকে চলে যেতে ইচ্ছে করে সেই মনোবাঞ্ছাও জানানো হলো। মামানি হাসলেন। ফেরার সময় আমাকে ঘর মুছামোছি থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে বললেন, 

' রোদু আমার সাথে চল তো। অরি? রোদকে সাথে নিয়ে গেলাম। তোমার ভাইয়া দুটো ইলিশ মাছ এনেছে। একটা তোমাদের জন্য। আসার সময় আনতে ভুলে গিয়েছি।  মাছ নিয়ে আবার আসতে পারব না। বয়স হয়েছে, অতো জোর নেই। রোদের কাছে দিয়ে দেব।' 

অন্যান্য সময় হলে ও বাড়ি না যাওয়ার জন্য হাজারটা অযুহাত দেখিয়ে ফেলতাম কিন্তু এবার তা করলাম না। এই ঘর মোছামুছির ভয়াবহ পরিশ্রম থেকে নিষ্কৃতি পাব ভেবেই খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠলাম। আম্মু কিছুক্ষণ না না করেও শেষমেশ রাজি হয়ে গেলেন। আমি জামা, ওড়না পাল্টে ভদ্র বাচ্চাটির মতো মামানির পিছু নিলাম। মামানিদের বাসায় গিয়ে দরজা থেকেই ভেতর দিকে উঁকিঝুঁকি দিলাম আমি। মূর্তমান সমস্যাটা কী বাসায় আছে নাকি নেই? মামানি আমাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, 

' কী রে? ভেতরে আয়। দরজায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন?' 

আমি কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বললাম, 

' মাছ-টাছ যা দেওয়ার এখান থেকেই দাও, নিয়ে চলে যাই। শুভ্র ভাই বাসায় থাকলে ভেতরে ঢুকব না। তোমার ছেলের বিশ্বাস নেই। উনার ইচ্ছে হলেই আমাকে আছাড় দিয়ে ইন্সট্যান্ট মেরে ফেলতে পারেন। আমার আপাতত মরার প্ল্যান নেই।' 

মামানি অবাক হয়ে বললেন, 

' ও শুধু শুধু তোকে আছাড় মারতে যাবে কেন? যদিও ওর মন মেজাজ খুব একটা ভালো নেই। তবুও, বিনা কারণে আছাড় টাছাড় মারবে না। ও নিজের ঘরে বসে পড়াশোনা না কী-সব করছে। এখন ঘর থেকে বেরুবে না। তুই ভেতরে আয়।' 

আমি ভেতরে ঢুকলাম। মামানি রান্না ঘরে যেতে যেতে বললেন, 

' সকালে খেয়েছিস?' 

আমি টেলিভিশন অন করে নিয়ে বললাম,

' না। খাওয়ার কথা বলো না৷ খেতে আমার আলসেমি লাগে।' 

মামানি কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বললেন,

' একটা বাজে এখনও সকালের খাবার খাসনি?' 

আমি উত্তর না দিয়ে টেলিভিশনের চ্যানেল পাল্টাতে মনোযোগী হলাম। মামানি কয়েক মিনিটের মাঝেই এক থালা খাবার নিয়ে আমার পাশে বসলেন। আমি খাবার দেখেই আঁতকে উঠলাম।

' আমি খাইয়ে দিচ্ছি তুই শুধু গিলে যাবি। খাইয়ে দিলে খেতে সমস্যা কী?' 

আমি অসহায় চোখে তাকালাম। মামানি তার থেকেও অসহায় চোখে চাইলেন। মুখ গুজ করে বললেন, 

' তোদের মধ্যে এখনই এতো বুড়ো বুড়ো ভাব কেন বুঝি না বাপু। আমার একটা মাত্র ছেলে। মাঝে মাঝে যদি শখ করে বলি, "আয় বাবা, একটু খাইয়ে দিই।" সাথে সাথেই ভ্রু কুঁচকে তাকাবে।' 

আমি হেসে বললাম, 

' মামানি? তোমার উচিত তোমার ছেলেকে আরেকটা বিয়ে দিয়ে দেওয়া। নাতি-পুতি হবে আর তুমি ননস্টপ খাইয়ে যাবে। কোনো থামাথামি নেই।' 

মামানি দুঃখী দুঃখী কন্ঠে বললেন, 

' হ্যাঁ। তারপর শুভ্র পুরো বাড়িটাকেই মাথায় তুলে আছাড় মারবে। এইটুকুতেই যে তান্ডব দেখাল! তোর বাবার উপর শুভ্রর সংঘাতিক রাগ।' 

আমি হাসলাম। মামানি আমার মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন, 

' তোদের আমি কিছু বুঝি না। তোরা কখন কী চাস তা হয়ত তোরা নিজেরাই ঠিকঠাক বুঝিস না। শুভ্র তো.... '

মামানির কথার মাঝেই কলিং বেল বাজল। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে উঁকি দিতেই অপরিচিত এক ভদ্রমহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। আমি সরে দাঁড়াতেই ভেতরে আসলেন উনি। আমার দিকে এক ঝলক চেয়েই মামানির দিকে তাকালেন। সোফায় বসতে বসতে বললেন, 

' খেতে বসেছেন নাকি? খাওয়ার সময় বিরক্ত করে ফেললাম মনে হচ্ছে।' 

আমি দরজা লাগিয়ে আবারও সোফায় এসে বসলাম। মামানি এই ভদ্রমহিলার সামনে আমাকে খাইয়ে দিবে ভাবতেই অস্বস্তিতে কাদা হয়ে যাচ্ছে মন। মামানি ঠোঁটে বিশাল এক হাসি টেনে বললেন, 

' আমি খাচ্ছি না। এইযে, মেয়েকে খাওয়াচ্ছি।' 

আমি অস্বস্তি নিয়ে চুপ করে রইলাম। ভদ্রমহিলা একবার আমার দিকে তাকালেন, 

' আপনার তো মেয়ে নেই শুনলাম। তাহলে এটা কে? এতো বড় মেয়েকে খাইয়ে দিতে হয়! শ্বশুর বাড়ি গেলে কে খাইয়ে দিবে?' 

শেষ কথাটা বলেই মৃদু হাসলেন ভদ্রমহিলা। মামানি জোরপূর্বক আমার মুখে খাবার তুলে দিয়ে বললেন, 

' আমার ননদের মেয়ে। আমার শ্বশুরমশাইয়ের ছেলেমেয়ে ছিলেন মোটে দুই। দুই ভাইবোনের বাচ্চা কাচ্চার দিক দিয়ে আমাদের ছোট্টটি হলো এই মেয়ে। বাপের কাছে, মামার কাছে বাচ্চা বলতে এই একটাই। তাই আদরও বেশি। সবাই মিলে আদর দিয়ে বাদর বানিয়ে ফেলেছি বলেই নিজ হাতে খেতেও তার আলসেমি। সারাদিনে এখনও খায়নি।' 

ভদ্রমহিলা হেসে বললেন,

' ছোটরা একটু আহ্লাদীই হয়। আমার ভাইয়ের মেয়েটাও এমন। আচ্ছা, যে দরকারে এসেছিলাম, ভাবী এই মাসের ভাড়াটা...' 

আমি উঠে দাঁড়িয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম,

' আমি আর খাব না। পেট ভরে গিয়েছে। আমি ভেতরের ঘরে যাই।' 

মামানি আমার অস্বস্তি বুঝতে পেরে বললেন,

' আচ্ছা যা। ও শোন, ভেতরেই যেহেতু যাচ্ছিস একটা কাজ করে দে মা। শুভ্রর ঘরে গিয়ে ওর বিছানার চাদর, বালিশের কাভার আর পর্দাগুলো খুলে লাল বালতিতে রেখে দে। বুয়া চাইবে এখনই। শুভ্র বুয়াকে ঘরে ঢুকতে দেবে না।' 

আমি অসহায় চোখে তাকালাম। শুভ্র ভাইয়ের ঘরে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে যে আমার নেই তা এই অপরিচিত ভদ্রমহিলার সামনে বলে ফেলতে পারলাম না। মামানি আমাকে এক বিন্দু গুরুত্ব না দিয়ে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসলেন। বাধ্য হয়েই শুভ্র ভাইয়ের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হলো আমায়। শুভ্র ভাইয়ের ঘরের দরজা ভেজানো। আমি দরজাটা হালকা ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিলাম। শুভ্র ভাই টেবিলের উপর বিশাল এক কাগজ বিছিয়ে কিছু একটা আঁকাআঁকি করছেন। টেবিল জুড়ে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন শেইপের পেন্সিল, রাবার আর মার্কার পেন। আমি নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকে গেলাম। শুভ্র ভাই কপাল কুঁচকে কাগজের দিকে চেয়ে আছেন। মনোযোগী দৃষ্টির হেরফের করে আমাকে খেয়াল করলেন না। আমি কুশনের কাভারে হাত দিতেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন উনি। কুঁচকানো ভ্রু আরও কুঁচকে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ চেয়ে থেকে এক প্রকার জ্বলে উঠে বললেন,

' এই মহিলা! তোর এখানে কী?' 

আমি চোখ তুলে তাকালাম। কপাল কুঁচকে বললাম,

' মহিলা! আপনি আমাকে মহিলা ডাকলেন কেন?' 

শুভ্র ভাই এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। পরনে তার ছাই রঙা টি-শার্ট আর কালো টাউজার। 

' তো? ডাকব না কেন? তুই মহিলা নস? তবে তুই পুরুষ? পুরুষ ডাকব?' 

আমি ফুঁসে উঠে বললাম,

' কিচ্ছু ডাকবেন না। আমার নাম রোদ। ডাকতে হলে আমাকে রোদ বলেই ডাকবেন, ব্যাস।' 

' অবশ্যই ডাকব না। রুমে উঁকিঝুঁকি দেওয়া মহিলাদের আমি নাম ধরে ডাকি না।' 

' আমি রুমে উঁকিঝুঁকি মারি?' 

' অবশ্যই মারিস। এইযে আমার রুমে দাঁড়িয়ে আছিস এটাও উঁকিঝুঁকি মারার দৃষ্টান্ত। অনেক কথা নষ্ট করে ফেলেছি। আর নষ্ট করা যাবে না। তুই এই মুহূর্তে আমার রুম থেকে বের হ। আমার রুমের আশেপাশে এলে তোর খবর আছে।' 

আমি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালাম। জেদ ধরে বললাম,

' যাব না। মামানি আমাকে একটা কাজে পাঠিয়েছে। সেই কাজ করে তবেই বেরুব। আপনার সমস্যা হলে আপনি বেরিয়ে যেতে পারেন। সমস্যা নেই।' 

শুভ্র ভাই অবাক হয়ে বললেন,

' কী মারাত্মক মহিলা তুই? আমার রুম থেকে আমাকেই বহিষ্কার করছিস?' 

' বহিষ্কার টহিষ্কর করছি না। আমি আপনাকে সমাধানটা বলছি।' 

' আমার কোনো সমাধান টমাধান লাগবে না। তুই এই মুহূর্তে আমার রুম থেকে দূর হবি, আমার কাছে এটাই সর্বৎকৃষ্ট সমাধান।'

' বললাম তো যাব না। যাব যোগ দন্ত ন আকার না।' 

শুভ্র ভাই কয়েক সেকেন্ড আগুন চোখে চেয়ে থেকে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। শক্ত কন্ঠে বললেন, 

' তোকে আমি পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। পাঁচ মিনিটে যত কাজ আছে সমাধা কর এবং দূর হ। পাঁচ মিনিটের এক সেকেন্ড এপাশ-ওপাশ হলে আমি তোকে সত্য সত্য সাত তলা থেকে ফেলে দিব। উইদ আউট এনি ওয়ার্নিং।' 

আমি বালিশের কভার আর চাদর উঠালাম। জানালার পর্দা খুলে বারান্দার দরজার কাছে দাঁড়াতেই দেখলাম শুভ্র ভাই আগের মতোই গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কপালে চিন্তিত ভাঁজ। কোনো কারণে রেগে টেগে আছেন নাকি? আমার মাথায় দুষ্টুমি খেলে গেল। চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে দরজার পর্দা খুলতে খুলতে শুভ্র ভাইকে ডাকলাম, উনি জাস্ট পাত্তা না দিয়ে চুপ করে রইলেন। আমি আবারও ডাকলাম, উনি জবাব দিলেন না। এবার মাথাটা একটু নিচু করে বারান্দায় উঁকি দিয়ে বললাম, 

'শুভ্র ভাই? এই শুভ্র ভাই, শুনুন না? জাপানিজ মেয়েরা কিন্তু দেখতে দারুণ হয়। পুতুল পুতুল, আহা।' 

শুভ্র ভাই কুঞ্চিত কপাল খানি আরও একটু কুঁচকে ফেলে বললেন,

' তো?' 

' তো মানে? চার-পাঁচ বছর থাকবেন, প্রেম টেম করবেন না? দারুণ একটা চান্স মিস হয়ে যাবে নয়তো।' 

শুভ্র ভাই সরু চোখে তাকালেন। বারান্দার রেলিঙে ঠেস দিয়ে বুকের উপর হাতভাঁজ করে দাঁড়ালেন,

' তুই বাঙালী মেয়েদের ঐতিহ্য ধ্বংস করে ফেলবি দেখছি। তোর মাঝে মেয়ে জাতীয় কোনো অনুভূতি নেই?'

' অনুভূতি কেন থাকবে না? অনুভূতি আছে বলেই তো প্রেমের কথা বলছি। আমি মুভিতে দেখেছি। জাপানিজ আর কোরিয়ান মেয়েগুলো দেখার মতো।' 

শুভ্র ভাই আক্ষেপ নিয়ে বললেন, 

' হলেই কী? লাভ তো নেই। আমি হাফ বিবাহিত। এই যুগের ইয়াহিয়া আমাকে চূড়ান্ত ফাঁসানো ফাঁসিয়েছে।' 

' ইয়াহিয়া? এই যুগের ইয়াহিয়া আবার কে?' 

কথাটা বলেই চেয়ার থেকে নেমে দাঁড়ালাম আমি। পর্দাগুলো বুকে জড়িয়ে চোখ ছোট ছোট করে কৌতূহলী চোখে চেয়ে রইলাম।

' কে আবার? তোর ধান্ধাবাজ বাপ ছাড়া এতো সুন্দর বিশেষণ তো কাউকে দেওয়া যায় না।' 

' আপনি আবার বাবাকে নিয়ে বাজে কথা বলছেন? বাবা কী এমন করেছে যে আপনি তাঁকে ইয়াহিয়া বলছেন?' 

' করেনি, করছে। প্রেজেন্ট টেন্সে কথা বল। তোর বাপ হলো জলজ্যান্ত অত্যাচার। সেই যুগের ইয়াহিয়া বাংলার ঘর জ্বালিয়েছে। তোর বাপ ইয়াহিয়া, আমাকেই জ্বালিয়ে দিচ্ছে।'

আমি আঙুল উঁচিয়ে বললাম, 

' বাবাকে নিয়ে বাজে বকবেন তো মামানিকে ডাকব।' 

' তো ডাক। আমি ভয় পাই তোর মামানিকে? আর আমি মিথ্যাই বা বললাম কোথায়? পুরো ব্যাপারটা আমি প্রমাণ করে ফেলতে পারি। প্রমাণ চাস? আয়, তোকে উদাহরণ দেই।' 

আমি চুপ করে চেয়ে রইলাম। শুভ্র ভাই বাম পায়ের ভর ছেড়ে ডান পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন, 

' কোনো দরিদ্র, ক্ষুধার্ত মানুষ যদি খাবার চায়, সাধারণ মানুষ কী করবে বল তো? আবেগী হয়ে খাবার দিবে। কিন্তু তোর বাপের মতো মানুষ তা করবে না। তিনি অলওয়েজ ইয়াহিয়া টাইপ কিছু করবেন। দেখা যাবে, খাবারের প্লেট সামনে রেখে বলবে, 'ডোন্ট টাচ'। আমার সাথেও তাই হচ্ছে , বিরিয়ানির প্যাকেট সামনে রেখে বলছে, ডোন্ট টাচ। মানে হয় কোনো? ব্যাটা ইয়াহিয়া। এসব লোককে কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই শুট করে দেওয়া উচিত।' 

আমি অবাক হয়ে বললাম,

' আশ্চর্য!  আপনি এক প্যাকেট বিরিয়ানির জন্য একজনকে ইয়াহিয়া বানিয়ে ফেলবেন? চিন্তাভাবনা ছাড়াই শুট করে ফেলবেন? বাবা কবে আপনাকে এমন কথা বলেছে? আপনার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, বিরিয়ানি না পেয়ে আপনি মারা যাচ্ছেন? ওকে ফাইন! আমি আপনাকে বিরিয়ানি কিনে দেব। এক প্যাকেট বিরিয়ানি কেনার মতো সেভিংস আমার আছে।' 

শুভ্র ভাই ভ্রু উঁচিয়ে তাকালেন। ধমক দিয়ে বললেন,

' আল্লাহ! এই তুই আমার রুম থেকে বের হ। এখন এবং এই মুহূর্তে বের হ। দুনিয়ার সব গাধামি আল্লাহ তোকেই কেন দিয়েছে? তোর নাম রোদ বালিকা না হয়ে রাসভ বালিকা  হওয়া উচিত। 'র' ফর রোদ, 'র' ফর রাসভ সুন্দর মিলেছে। রাসভ অর্থ কী জানিস?' 

আমি বোকা বোকা চোখে চেয়ে মাথা নাড়লাম। শুভ্র ভাই বিরক্তি নিয়ে বললেন,

' জানতাম জানিস না। জানলে তো আর রাসভ হতি না, বুদ্ধিমতি হতি। রাসভ অর্থ হলো গাধা। আর তুই হলি নিম্নমানের গাধা।'

আমাকে প্রত্যুত্তরের সুযোগ না দিয়ে, শুভ্র ভাই হঠাৎ ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন, 

' কাছে আয়, একটা প্রশ্ন জিগ্যেস করি। প্রশ্ন করতে হবে চুপিচুপি। তুই গাধামীর কোন লেভেলে আছিস সেটা পরীক্ষা করতে হবে৷ কী হলো? আয়।' 

আমি মুখ ফুলিয়ে চুপচাপ চেয়ে রইলাম।শুভ্র ভাই কয়েক পা এগিয়ে এসে, হাত বাড়িয়ে আমার বেনিনু টেনে ধরলেন। আমি চোখ-মুখ কুঁচকে বললাম,

' আহ্। ব্যথা লাগে। ছাড়ুন।' 

' ব্যথা লাগার জন্যই তো টানলাম। আদর করার জন্য টানিনি। বড়রা কথা বললে শুনতে হয় জানিস না? আমি তোর কয় বছরের বড়? বড়দের সম্মান করতে শিখিসনি?কাছে আয়।' 

কথাটা শেষ করে আবারও এক টান দিলেন শুভ্র ভাই। আমি বাধ্য হয়েই দুই পা এগিয়ে গেলাম। শুভ্র ভাই মুচকি হাসলেন। আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই মাথা নুইয়ে মুখটা কানের কাছে নিয়ে আলতো স্বরে আওড়ালেন অপরিচিত কবিতার কয়েকটি লাইন। আমি অবাক হলাম। আশ্চর্য, এমন অশ্লীল কবিতাও কবিরা লিখে? আমার চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। ছিটকে সরে দাঁড়াতে গিয়ে চুলে টান পড়ল। এক হাতে বেনিনুটা শক্ত করে চেপে ধরে বললাম,

' ছি! অশ্লীল।' 

শুভ্র ভাই হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বিছানায় গিয়ে বসলেন। বিস্মিত হওয়ার চেষ্টা করে বললেন, 

' আশ্চর্য! অশ্লীল কী বললাম?' 

আমি কয়েক সেকেন্ড রক্তিম চোখে চেয়ে থেকে পর্দা আর বিছানার চাদর নিয়ে বেরিয়ে আসতে নিতেই সটান উঠে খপ করে বেনুনি চেপে ধরলেন আবার। আমি রাগে দুঃখে চেঁচিয়ে উঠে বললাম,

' উফ! আমি কিন্তু মামানিকে ডাকব। ব্যথা লাগছে। ছাড়ুন।'

বাস্তবিকই ব্যথা লাগছিল মাথায়। চুলে শক্ত টান পড়ায় চোখ উপচে জল গড়াল। শুভ্র ভাই যেন দেখেও দেখলেন না। তার চোখে-মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না বরং ভীষণ আক্ষেপ নিয়ে বললেন, 

' সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো লেখকের কবিতাকে তুই ফট করে অশ্লীল বলে ফেললি? এই অপরাধে তোকে আরেকটা কবিতা শুনাতে হয়। হুমায়ুন আজাদ অথবা খালেদ মতিন?' 

আমি চোখ-মুখ শক্ত করে বললাম,

' আমি শুনব না।' 

' শুনবি না বললেই হলো নাকি? শুনতে হবে।' 

আমি অসহায় চোখে তাকালাম। শুভ্র ভাই গম্ভীর কন্ঠে বললেন, 

' তোর এই চোর চোর মুখ দেখে আমার মায়া হচ্ছে। আচ্ছা যা। তোকে আমি দুটো অপশন দিচ্ছি। এক. এখানে দাঁড়িয়ে সুনীলের সেই কবিতা শুনবি। দুই. আমার ধোঁয়া শার্টগুলো ঝটপট ইস্ত্রি করে দিবি।' 

আমি অবাক চোখে চাইলাম। একটা মানুষ এতোটা সুবিধাবাদী কী করে হতে পারে? আমাকে দিয়ে কাজ করানোর পায়ঁতারা সব! আমি ফুঁসে উঠে বললাম,

' চোর চোর মুখ মানে কী? আপনি নিজের কাজ নিজে করতে পারেন না? আমি কোনো ইস্ত্রি ফিস্ত্রি করতে পারব না।' 

শুভ্র ভাই মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে বললেন, 

' তার মানে তুই কবিতা শুনতে চাস? সেটা সরাসরি বললেই হয়।' 

আমি আবারও অসহায় হরিণীর মতো চাইলাম। শুভ্র ভাইয়ের মতো বেয়াদব মানুষ পৃথিবীতে দুটো হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। এই ব্যক্তি জোরপূর্বক আমায় কবিতা শুনিয়ে কাজিন জাতিকে বলবে, রোদু জোর করে কবিতা শুনেছে। তাও আবার এমন সাংঘাতিক কবিতা! শুভ্র ভাই চোখ-মুখে হাসি নিয়ে কবিতা বলার প্রস্তুতি নিলেন। ঠিক সেই সময় বসার ঘর থেকে ডাকলেন মামানি। কাপড় ধোঁয়ার বুয়া এসেছে, কাপড় দিতে হবে। শুভ্র ভাই তার দ্বিতীয় নির্দেশ ছুঁড়ে দেওয়ার আগেই আকাশসম স্বস্তি নিয়ে বিছানার উপর থাকা চাদর আর পর্দাগুলো নিয়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে এলাম আমি। বুয়াকে কাপড়গুলো দিতেই মনে পড়ল আংটিটির কথা। সপ্তাহ এক আগে স্নিগ্ধার সাথে মার্কেটে গিয়ে হঠাৎ একটা আংটি পছন্দ হয়ে গিয়েছিল আমার। একটা বললে ভুল হবে, বলতে হয় এক জোড়া। কাপল রিং কেনার মতো কারণ আমার নেই। কিন্তু ফিমেল আংটিটা এতো পছন্দ হলো যে রেখে আসারও উপায় নেই। আকাশ-পাতাল চিন্তা করে অবশেষে কিনেই ফেললাম আংটি জোড়া। স্নিগ্ধা কাপল রিং এর মেল রিংটা নিয়ে কী কী করা যেতে পারে তার বিস্তর আইডিয়া নিয়ে বসতেই প্রথমেই মনে পড়ল শুভ্র ভাইয়ের কথা। কিন্তু উনাকে দেব আংটি! তাও আমি? সর্বনাশ! অতো সাহস কখনও ছিল নাকি আমার? আংটি দিতে গিয়ে ভয় আর লজ্জাতেই আধা মরা হয়ে যাব নির্ঘাত। অসম্ভব! কাউকে কোনো আংটি ফাংক্টি দেওয়ার দরকার নেই। আমার আংটি আমিই পরব, ব্যস। যা ভাবনা তাই কাজ। আজ সকালে ভীষণ আনন্দে অযথা পড়ে থাকা মেল আংটিটা পরেছিলাম  ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলটাতে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে টেখে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় খুলতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেই আংটির কথায় মনে পড়ল, শুভ্র ভাইয়ের রুমে গিয়ে পর্দা খোলার সময়। মনে যেহেতু পড়েছে, পর্দা খোলার পাশাপাশি আংটিটাও খুলে শুভ্র ভাইয়ের টেবিলে রেখে দিলাম। যাক! যার আংটি তাকে দেওয়া হয়ে গেল। ধরা পড়ার চান্স নেই। তখন সব ঠিকঠাক লাগলেও এখন কেমন খচখচ করছে মন। শুভ্র ভাই আংটি পরেন না। উনি কী আংটিটা আদৌ পরবেন নাকি ডাস্টবিনে ফেলে দিবেন? শুভ্র ভাইয়ের জন্য কোনো কিছুই আশ্চর্য নয়। উনার কাছে কারো অনুভূতি, টনুভূতি গুরুত্ব পাওয়ার কথা নয়। আমার শখের আংটি ডাস্টবিনে পড়ে আছে চিন্তা করেই বিশাল মন খারাপ হয়ে গেল আমার। আমি আংটি উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। এই বেয়াদব লোককে আংটি পরতে দেওয়াও চরম পাপ। এই ভয়াবহ পাপ করা যেতে পারে না। আমি ফিরে এসে খুব সাবধানে রুমে উঁকি দিলাম। শুভ্র ভাই ততক্ষণে আংটিটি তুলে নিয়েছেন হাতে। ভ্রু বাঁকিয়ে আংটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছেন। আমি মনে মনে জানতাম, আংটিটা উনি পরবেন না। হাতে আংটি পরে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস উনার নেই। পছন্দও না বোধহয়। তবে আংটিটা কী করবেন উনি? ফেলে দিবেন? শুভ্র ভাই আমাকে ভাবনাতীত অবাক করে দিয়ে আংটিটা হাতে পরলেন। ভ্রু কুঁচকে হাতের দিকে চাইলেন। হাতটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিয়ে কিছু একটা ভাবলেন। টেবিলের সিকিউর ড্রয়ার খুলতে খুলতে হঠাৎই, একদম আচমকা পেছন ফিরে দরজার দিকে তাকালেন। আমি দ্রুত সরে গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালাম। নিঃশ্বাস বন্ধ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে দেখে টেখে ফেলল না তো আবার? বেশ কিছুক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে, বুকে থুতু ছিটিয়ে আবারও দরজার উপর ঝুঁকে পড়লাম আমি। শুভ্র ভাই দরজা থেকে একহাত দূরে, পকেটে হাত দিয়ে নিশ্চিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি দরজার দিকে স্থির। আমি খুব বিশ্রীভাবে ধরা পড়ে গেলাম। ধরা খেয়ে মুখটা ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে যেতেই কয়েক পা এগিয়ে এলেন শুভ্র ভাই। আমি মনে মনে সূরা ইউনূস আওড়াতে আওড়াতে ভাবতে বসলাম, আমার কী এই মুহূর্তে দৌড় লাগানো উচিত? শুভ্র ভাই আমার সামনে এসে দাঁড়াতেই ঠোঁট টেনে বোকা বোকা হাসি দিলাম আমি। শুভ্র ভাইয়ের মুখ গম্ভীর। আমার হাসিকে পাত্তা টাত্তা দিলেন না। ভীষণ সিরিয়াস কন্ঠে বললেন,

' সমস্যা কী? উঁকিঝুঁকি মারছিস কেন? তুই আর তোর বাপ এসব উঁকিঝুঁকি মেরেই দুনিয়া ধ্বংস  করে ফেলবি। পুরো দুনিয়ার ভবিষ্যৎটাই টিকে আছে আমার মতো যুব সমাজের আশায়। কিন্তু তোর ইয়াহিয়া বাপের যন্ত্রণায় এই যুব সমাজ আজ ধ্বংস প্রায়। আমার মতো ট্যালেন্টেড ব্যক্তি যদি ধ্বংস হয়ে যায়, পৃথিবীটা চলবে কীভাবে?'

শুভ্র ভাইয়ের কথায় চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল আমার। ভীষণ বিস্ময় নিয়ে বললাম,

' যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে! আমাদের একটা উঁকি দেওয়াতে যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে শুভ্র ভাই?'

' যাবে কী? বল, যাচ্ছে। বাপে উঁকি মারে মাথায়, মেয়ে উঁকি মারে দরজায়, দেহে, মনে, মস্তিষ্কে। তোদের সমস্যাটা কী? এভাবে উঁকিঝুঁকি মেরে কী প্রমাণ করতে চাস? তোরা গেরিলা যোদ্ধা? পৃথিবীর ভবিষ্যৎ চিন্তায় অস্থির শুভ্রকে তোরা ঘায়েল করতে পারলি কী-না তার খবরাখবর নিতে চাস?'  

আমার মাথা ঘুরে গেল। চিন্তা-ভাবনা সব গুলিয়ে গেল। কথার সুর কেটে গেল। কোথা থেকে কথা শুরু হয়েছিল তাই ভুলে গেলাম। বোকা বোকা কন্ঠে বললাম,

' গেরিলা যোদ্ধারা কী উঁকিঝুঁকি মারত শুভ্র ভাই?' 

শুভ্র ভাই বিরক্ত চোখে তাকালেন। আচমকা আমার বামহাতটা চেপে ধরে বললেন, 

' লাফালাফি করবি না। এভাবে উঁকিঝুঁকি মেরে আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট করার অপরাধে ভয়াবহ শাস্তি দেওয়া হবে তোকে।' 

শুভ্র ভাই শক্তিশালী পুরুষ। হাতের মুঠো শক্ত। উনার হাতের চাপে আমার হাতের হাড়গুলো যেন মড়মড় করে উঠল একবার। হাত ছাড়ানোর সাধ্য নেই বুঝতে পেরে খুব অসহায় কন্ঠে বললাম,

' আমি উঁকি দিলেই যে আপনার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে তা তো আমি জানতাম না শুভ্র ভাই। এরপর কখনও উঁকি দিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ নষ্ট করব না, কসম!' 

শুভ্র ভাই আমার বামহাতের আঙ্গুলগুলো মেলে ধরতে ধরতে বললেন, 

' যা নষ্ট করার তা তো করেই ফেলেছিস। আমার তো আর উপায় নেই।' 

আমি কথাটা ঠিক ধরতে না পেরে ক্লান্ত চোখে চেয়ে রইলাম। হাত ব্যথা করছে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার উপলব্ধি হলো, এই নিষ্ঠুর লোকের জন্য আংটি কিনে ভয়াবহ ভুল করে ফেলেছি আমি। এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য আমার এই মুহূর্তে রেললাইনের উপর শুয়ে জীবন বিসর্জন দিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু রেল লাইন পাবোটা কোথায়? মেডিকেল থেকে রেললাইন যেতে কমছে কম বিশ টাকা রিকশা ভাড়া। বেশিও হতে পারে। দশ টাকা রিকশা ভাড়া থাকাকালীনই জীবন বিসর্জন দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। এতো অত্যাচার সহ্য করে পাঁচটা বছর কেন বেঁচে থাকলাম আমি? মাঝ থেকে রিকশা ভাড়াটা বেড়ে গেল। ভুল হয়েছে, চরম ভুল। শুভ্র ভাই আমার বাম হাত থেকে আংটিটা খুলে নিতেই সচেতন হলাম আমি। লাফিয়ে উঠে বললাম, 

' আরেহ! আরেহ! এটা আমার আংটি। নিজের টাকায় কিনেছি। ছাড়ুন, ছাড়ুন।' 

শুভ্র ভাই চোখ রাঙালেন। ধমক দিয়ে বললেন, 

' লাফালাফি করবি তো এক চড়। আংটির সাথে সাথে মট করে ভেঙে ফেলব তোর হাত। লাফালাফি বন্ধ।' 

ঠিক এই মুহূর্তে কান্না পেয়ে গেল আমার। এই এতো বড় দুনিয়াতে শুভ্র ভাই কেন শুধু আমার সাথেই এমন করেন! হাত ভেঙে ফেলার জন্য কী এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই? আমার হাতই ভাঙতে হবে কেন? আমার আংটিই ছিনিয়ে নিতে হবে কেন? উনাকে কী আমি আংটি দিইনি? মেয়েদের আংটি দিয়ে উনার কী কাজ? শুভ্র ভাই আংটিটা খুলে নিয়ে বললেন, 

' তুই বাচ্চা মেয়ে। বাচ্চা মেয়েদের আংটি পরলে বলদের মতো লাগে। এলাকার অনেকেই জানে তুই আমাদের আত্মীয়। আমার বাবার বোনের কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে।  আমাদের আত্মীয় হয়ে হাতে আংটি পরে বলদ সেজে ঘুরে বেড়াবি, ব্যাপারটা তো ভালো দেখায় না।'  

আমার ধৈর্যের সব রকম বাঁধ ভেঙে গেল আমার। আমি অবসন্ন কন্ঠে বললাম,

' আমি বাচ্চা টাচ্চা কিছু নই। আই এম নাইন্টিন নাও।' 

শুভ্র ভাই গম্ভীর কন্ঠে বললেন, 

' তাহলে তো আরও পরতে পারবি না। উনিশ বছরের যুবতীদের আংটি পরতে হয় না। এই বয়সে আংটি পরা মানেই গর্হিত অপরাধ। আমি একজন রেসপন্সেবল মানুষ হয়ে তোকে কোনো গর্হিত অপরাধ করতে দিতে পারি না।'

আমি মেজাজ খারাপ নিয়ে বললাম, 

' গর্হিত হলে গর্হিতই। এই অপরাধে ফাঁসি হয়ে গেলেও সই। আপনি আমার আংটি দেন, ব্যস।' 

শুভ্র ভাই আকাশ থেকে পড়ার মতো মুখভঙ্গি করে বললেন, 

' তোর আংটি মানে? আংটিতে তোর নাম লেখা আছে? কোথায় তোর নাম? নাম থাকলে দিয়ে দেব। দেখা নাম!'  

ঠিক এই মুহূর্তে, ঠিক এই মুহূর্তে আমার মনে হলো, আমি বেঁচে আছি কেন? এই অসহ্য লোকটাকে সহ্য করার চেয়ে জীবন ধর্ম ত্যাগ করে ফেলা নিশ্চয় শতগুণ সুখময় হবে আমার জন্যে। আমি চোখভর্তি রাগ নিয়ে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাইয়ের ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝা যাচ্ছে আংটি ফেরত দেওয়ার বিন্দুমাত্র পরিকল্পনা তার নেই। তার পরিকল্পনা যেহেতু নেই সেহেতু তাকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে দেওয়া হলেও অথবা কেউ আত্মহত্যা করে মরে গেলেও তার কোনো যায় আসবে না। সে দিবে না, মানে দিবেন না, সোজা হিসেব। রাগে দুঃখে চোখদুটো টলমল করে উঠল আমার। অতিরিক্ত রাগে কান্না পেয়ে যাওয়ার বিশাল সমস্যাটা নিয়েই উনার সামনে থেকে সরে এলাম আমি। প্রচন্ড রাগে শরীর কাঁপছে। পৃথিবীটাকে আছাড় মেরে আলু ভর্তা বানিয়ে ফেলতে পারলে ভালো হতো, রাগটা একটু কমতো। আমি ঝড়ের গতিতে উড়ে এসে বসার ঘরে ঢুকলাম। মামানির দিকে চেয়ে জেদ নিয়ে বললাম,

' আমি এক্ষুনি বাসায় যাব মামানি। তোমার মাছ তুমি রাখো। আমি কোনো মাছ টাছ নিয়ে যেতে পারব না।'

মামানি ভদ্রমহিলার সাথে গল্পে ডুবে ছিলেন। আমার দিকে চেয়ে অবাক হয়ে বললেন, 

' কী হলো হঠাৎ? চোখ-মুখ এমন লাল হয়ে আছে কেন? শুভ্র কিছু বলেছে?' 

আমার বলতে ইচ্ছে হলো, তোমার অসভ্য, বেয়াদব ছেলে সবসময়ই অসভ্য, অভদ্র কথা বলে। তার মধ্যে অভদ্রতার বিশাল সফটওয়্যার ব্যতিত অন্যকিছু নেই। দুঃখের বিষয় তোমরা তা বুঝতে পারো না। কিন্তু ভদ্রমহিলার সামনে এসব বলা যায় না বলে বললাম,

' আমার শরীর খারাপ লাগছে। আমি বাসায় যাব।' 

মামানি আৎকে উঠে বললেন, 

' শরীর খারাপ লাগলে বাসায় যাবি কেন? শরীর খারাপ নিয়ে তোকে আমি এক পা বেরুতে দিব না। সুস্থ মেয়ে এখানে এসেই অসুস্থ হয়ে যাবে এ কেমন কথা? না খেলে তো শরীর খারাপ করবেই।' 

শরীর খারাপের দোহায় দিয়ে যে ভয়াবহ প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলেছি তা শীঘ্রই বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এদিকে রাগটাও কন্ট্রোলে রাখা যাচ্ছে না। আমি অসহায় কন্ঠে বললাম,

' প্লিজ মামানি। যেতে দাও। আমার ভালো লাগছে না। আমি বাসায় যাব, ব্যস।'

এমন সময় খুব ফুরফুরে মেজাজে বসার ঘরে এলেন শুভ্র ভাই। ভদ্রমহিলাকে দেখে বিনয়ী হাসি হাসলেন। তাকে দেখে মনে হল, তার মতো নম্র, ভদ্র ছেলে ইহজীবনে দ্বিতীয়টি হতে পারে না। অথচ ভেতরে ভেতরে কী অসহ্য! শুভ্র ভাই পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে হাসলেন,

' আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?' 

ভদ্রমহিলা নম্র হেসে ঘাড় নাড়লেন, 

' ভালো আছি। শুনলাম, তুমি জাপান চলে যাচ্ছ?' 

' দেশের পরিস্থিতি তো ঠিক অনুমান করা যাচ্ছে না। সব ঠিক থাকলে সেপ্টেম্বরে ইন-শা-আল্লাহ।' 

ভদ্রমহিলা মজার ছলে হেসে বললেন, 

' ফরেনে পড়াশোনা শেষ করতে তো প্রায় চার পাঁচ বছর লেগে যাবে। তোমার বাবা-মা তো দেশে একদম একা পড়ে যাবেন। একটা বিয়েশাদী করে ফেলো এর মধ্যে। আমরাও একটা দাওয়াত পাই।' 

শুভ্র ভাই জবাব না দিয়ে ভদ্রতার হাসি হাসলেন। আমি চোটপাট করে বললাম, 

' মামানি আমি গেলাম।' 

মামানি কপাল কুঁচকে তাকালেন। শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, 

' তুই ওকে কী বলেছিস শুভি?' 

শুভ্র ভাই মামানির কথায় পাত্তা না দিয়ে খাবার ঘরের দিকে চলে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, 

' আমি তাকে কী বলব? আশ্চর্য!' 

মামানি আমার দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখের ইশারায় আমায় সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, 

' আচ্ছা যা। রান্নাঘরে মাছ কেটে রেখেছি। মুখবন্ধ লাল বাটিতে আছে। যাওয়ার সময় নিয়ে যা।' 

এদের মা-ছেলের টানাহেঁচড়ায় তখন আমি ক্লান্ত প্রায়। মামানির কথায় ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে রওনা দিলাম। শুভ্র ভাই খাবার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে গ্লাসে পানি ঢালছিলেন। খাবার ঘর থেকে রান্নাঘরে যাওয়ার রাস্তাটা সরু। একসাথে দুজন যাওয়ার উপায় নেই। শুভ্র ভাই একটু পিছিয়ে আমাকে যাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। আমি তাকে পাশ কাটিয়ে এক পা এগুতেই আটকা পড়ল হাত। শুভ্র ভাইয়ের শক্ত হাতের মুঠোয় নিজের হাত আবিষ্কার করে চোখ রাঙিয়ে তাকালাম। শুভ্র ভাইয়ের ঠোঁটে মৃদু হাসি।

' ছাড়ুন!' 

শুভ্র ভাই ছাড়লেন না। আমি রাগ টলমলে চোখ নিয়ে বললাম,

' সমস্যা কী? চলেই তো যাচ্ছি। আসব না আর আপনার বাসায়। এতো জ্বালাচ্ছেন কেন! আপনাকে আমার একবিন্দু সহ্য হচ্ছে না আর। ছাড়ুন।' 

শুভ্র ভাই জোরপূর্বক হাত টেনে চেয়ারের সামনে ঠেস দিয়ে দাঁড় করালেন। স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন, 

' আমি তোকে ধরে রেখেছি নাকি? কী জানি? বুঝতে পারছি না। যখন বুঝতে পারব তখন ছেড়ে দেব।' 

আমি মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। বামহাতের আঙ্গুল উঁচিয়ে বললাম, 

' দেখুন.... ' 

শুভ্র ভাই হাত ছেড়ে আমার দুইপাশে চেয়ারের উপর হাত রেখে বললেন,

' কী দেখব?' 

আমার রুদ্রমূর্তি থিতিয়ে গেল। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আশেপাশে দেখলাম, কেউ দেখছে না তো? ধমক দেওয়ার মতো করে বললাম,

' আমাকে যেতে দিন। আমার মেজাজ খারাপ, আমি কিন্তু মামানিকে ডাকব। অযথা একটা সিনক্রিয়েট হয়ে যাবে।' 

শুভ্র ভাই হাসলেন। আমার চোখের পাতায় ফু দিয়ে বললেন, 

' যেখানে সেখানে আম্মুকে ডাকতে চাস কেন? এখানে আম্মুর কী কাজ?' 

আমি সন্দেহী চোখে তাকালাম। এবার আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। টেবিলের উপর থাকা কাঁচের জগটা তার মাথায় মেরে তাকে অজ্ঞান করে ফেলার ভয়াবহ ইচ্ছে জাগছে। উফ, জীবনটা এতো বিরক্তিকর কেন? আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, 

' এখানে আপনারও কোনো কাজ নেই। সরে দাঁড়ান।' 

শুভ্র ভাই না সরে এক পা এগিয়ে দাঁড়ালেন। বামহাতটা হাতে তুলে নিয়ে টাওজারের পকেট থেকে সাদা চকচকে একটা আংটি বের করে খুব যত্ন করে পরিয়ে দিলেন বামহাতের রিং ফিঙ্গারে। ফিসফিস করে বললেন,

' এখানে আমার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর কারো থাকতেই পারে না।' 

আমি তীক্ষ্ণ চোখে আংটির দিকে চেয়ে থেকে বললাম, 

' এটা আমার আংটি নয়। আপনি আমার আংটি ফেরত দেন। অন্যের আংটি আমি নেব না।' 

' ওটা তোর আংটি তেমন কোনো প্রমাণ তো দেখাতে পারিসনি। এটাই তোর আংটি। একদম পার্ফেক্ট। খুঁজে দেখ, নাম লেখা আছে।' 

আমি সন্দিহান চোখে তাকালাম। আংটি পরা আঙ্গুলটা চোখের সামনে নিয়ে বেশি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে খুব সূক্ষ্ম চোখে খেয়াল করতেই চোখে পড়ল ব্যাপারটা। আংটির ঘন কারুকার্যের মাঝে একদম সূক্ষ্ম চালে লেখা ' শুভ্র'স ওয়াইফ'। আমি অবাক হয়ে তাকালাম। শুভ্র ভাই ভ্রু নাচিয়ে হাসলেন,

' পার্ফেক্ট না? তোর সবচেয়ে ইম্পোর্টেন্ট নাম। পুরো পৃথিবী ভুলে গেলেও এটা ভুললে চলবে না। তুই যে রিজার্ভড সম্পদ হয়ে ঘুরাফেরা করছিস আংটিটা তার রিমাইন্ডার। মালিকের অনুপস্থিতিতে বারবার মনে করিয়ে দেবে," দিস রিসোর্স ইজ রিজার্ভড।"

তার কথার ধরনে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালাম আমি। গম্ভীর কন্ঠে বললাম, 

' সবচেয়ে ইমপার্ফেক্ট নাম। আমি এটা পরব না। আপনার রিমাইন্ডার আপনার কাছে রাখুন।'  

শুভ্র ভাই আচমকা হাতদুটো চেয়ারের দু'পাশে রেখে খুব কাছে এসে দাঁড়ালেন। সহজ কন্ঠে বললেন, 

' পরবি না? ওকে! খুলে দেখ, খুন করে ফেলব।' 

তার সহজ কন্ঠটিতে যে প্রচ্ছন্ন ধমকি ছিল তাতেই আটকে গেলাম আমি। আংটি খোলার সাহস করার সাহস করে উঠতে পারলাম না। তেজ নিয়ে বললাম,

' আপনিই না বললেন, উনিশ বছরের যুবতীদের জন্য আংটি পরা গর্হিত অপরাধ?' 

' উনিশ বছরের যুবতীদের জন্য অপরাধ৷ কিন্তু বউ বউ ধরনের যুবতীর জন্য বিশাল ছাড়।' 

এটুকু বলে আমার দিকে চাইলেন শুভ্র ভাই। পরমুহূর্তেই কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,

' যার হাসিটা পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর। যার আগমন মানেই প্রাণবন্ততা। যে তাকালেই খুন হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে, তার জন্য সাত খুন মাফ।' 

আমার ঠোঁটে অযথায় হাসি ফুটে উঠল। শুভ্র ভাই কথা না বাড়িয়ে সরে দাঁড়ালেন। তিনি সেখান থেকে সরে যাওয়ার পরও স্তম্ভিত মন নিয়ে একই জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। এখন আমার কী করা উচিত? রাগ ধরে রেখে উনাকে গালি দেওয়া উচিত? নাকি ভুলে যাওয়া উচিত? শুভ্র ভাই হঠাৎ ফিরে এলেন। ডানপাশের গালে আচমকা গাঢ় এক চুমু দিয়ে বললেন, 

' আর যে শুভ্রর বউ, যাকে শুভ্র প্রচন্ড ভালোবাসে, তার জন্য সব খুন মাফ। তার সব অপরাধই মিষ্টি। সে মানেই ভালোবাসা। তার ভাবনা মানেই প্রশান্তি। তার হাসি মানেই, আমি তোমাকে ভালোবাসি।' 

কথাটা বলে উত্তর-দক্ষিণ না দেখে আবারও হাওয়া হয়ে গেলেন শুভ্র ভাই। কিন্তু এক মিনিটের মাথায় আবারও ঘুরে এসে আবারও গাঢ় একটা চুমু খেলেন গালে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আবারও হাওয়া হলেন ঘরের বাঁকে! আমি আগের জায়গাটাতেই বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। ধীরে ধীরে রক্তিম হয়ে উঠল গাল। প্রচন্ড লজ্জায় শিউরে উঠল লোমকূপ পর্যন্ত। হৃদপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুত হলো। দ্রুত থেকেও দ্রুততর। হৃদস্পন্দের ধামামা বাজিয়ে তারাও নিশ্চয় বলছে, শুনছ হে? আমি তোমাকে ভালোবাসি! প্রচন্ড ভালোবাসি! 





সমাপ্ত.... 




Writer:- নৌশিন আহমেদ রোদেলা 
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner