রিদান,মোহের দিকে বেশ কিছু সময় অপলক তাকিয়ে থাকার পর ঠোঁটে আলতো হাসি ফুটিয়ে মোহের কপালে একটি চুমু এঁকে দেয়।অতঃপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলতে শুরু করে,
"দূরত্ব টা সাময়িক সময়ের জন্য হলে তা ভালোবাসা বাড়ায়।কারণ সে সময় টায় আমরা অনুভব করতে পারি মানুষটা আমাদের জীবনে কতোটা জায়গা দখল করে আছে।ওই সময় টায় আমরা অনুভব করি তাকে কতোটা প্রয়োজন আমাদের।ওই সময় টাই যথেষ্ট হয় বুঝার জন্য মানুষ টাকে কতোটা ভালোবাসি আমরা।
কিন্তু যদি দুরত্ব টা অধিক সময়ের জন্য হয় তবে টা দূরে যাওয়ার বাহানা বাড়ায়।কারণ অনেকটা সময় তাকে ছাড়া থাকতে থাকতে আমরা ওই মানুষটাকে ছাড়াই বাঁচতে অভ্যস্ত হয়ে যাই।যখন তাকে খুব করে চাই কিন্তু পাই না অথবা যখন খুব করে তার প্রয়োজন টা অনুভব করি কিন্তু সে উপস্থিত থাকে না তখন নিজেই নিজেদের প্রয়োজন টা পূরণ করা শিখে যাই।আস্তে আস্তে ওই মানুষটাকে ছাড়াই জীবন টাকে সাজিয়ে নেই।"
কথাটি শেষ করে রিদান,মোহের দিকে তাকায়।মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে।বেশ কিছু সময় নিরব দৃষ্টিতে রিদানের দিকে তাকিয়ে থাকার পর মোহ, রিদানকে জরিয়ে ধরে শক্ত করে যেনো ছেড়ে দিলেই রিদান চলে যাবে।
"এর পর কোথাও গেলে এমন অবহেলা আর করবেন না আমায়!প্রতিদিন অন্তত একটি বার কল দিবেন।সেই সাথে ওয়াদা করেন আমাদের মাঝে এমন দূরত্ব কখনো আসতে দিবেন না যা আমাদের আলাদা আলাদা,একা বাঁচতে শিখিয়ে দেয়।"
মোহের কথা শুনে রিদানের ঠোঁটে ফুটে ওঠে এক তৃপ্তির হাসি।সে মোহের মুখটি উঠিয়ে মোহের ঠোঁট টি নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেয়।বেশ কিছু সময় পর মোহকে ছেড়ে মোহের ঠোঁটের আশেপাশে আলতো করে কয়েকটা চুমু দিয়ে মোহকে জড়িয়ে ধরে।এভাবেই দুজন পাড়ি জমায় ঘুমের রাজ্যে।
!!
একাকিত্ব টা মানুষের ভয়ংকর শত্রু।এর কোনো বাহ্যিক ভয়ংকর রুপ না থাকলেও এটি মানুষের ভেতরে ভয়ংকর যন্ত্রণা তৈরি করতে সক্ষম।সময়ের সাথে সাথে এটি মানুষকে ভেতর দিয়ে শেষ করে দিতে থাকে।এই একাকিত্ব টাই তো হাজারো মানুষের আত্মহত্যার কারণ।আবার অনেকের খারাপ পথে যাওয়ার কারণ।একাকিত্ব টা মানুষের মাঝে তৈরি করে জীবনের প্রতি এক তীব্র বিতৃষ্ণা।
হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও কপালের ঘামটি মুছে দেওয়ার জন্য একটি ভালবাসাময় হাতের প্রয়োজন প্রতিটি মানুষেরই হয়।একটি সঙ্গী খুব প্রয়োজন হয় প্রতিটি মানুষের!শুধু শারিরীক চাহিদা মেটাতে নয় বরং মানসিক তৃপ্তি মেটাতে। এ প্রয়োজন টি বয়সের সাথে সাথে বাড়তে থাকে।বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ব্যস্ততা কমতে থাকে,দ্বায়িত্ব কমতে থাকে সেই সাথে বাড়তে থাকে মন খুলে কথা বলার ইচ্ছে টা।বয়সের সাথে মানুষ মানসিকভাবে অনেকটা দুর্বল হয়ে পরে তখন তার একজন আগলে রাখার মতো সঙ্গীর প্রয়োজন হয়।
জীবনের ১২ টি বছর এ একাকিত্ব টাই বয়ে বেড়াচ্ছেন আনিসা বেগম।১২ বছর আগে যখন তার স্বামী তাকে ত্যাগ করে তখন দিয়ে শুরু হয় তার সংগ্রাম।জীবনে হোঁচট খেয়েছেন অনেক বার। সে সময় তাকে সামলে নেওয়ার সঙ্গী বলতে ছিলোনা কেউ।হাত ধরে তাকে সামলে নেওয়ার মতো একটি মানুষের অভাবটি খুব করে অনুভব করতেন তিনি।কিন্তু নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রাখতেন তার দুটো মেয়ের কথা ভেবে।কিন্তু এখন তো মেয়েরাও যার যার মতো ভালো আছে।এ সময় আনিসা বেগমকে একাকিত্বরা যেনো আরও বেশি পীড়া দিচ্ছে।সেই সাথে আনিসা বেগমর জীবনের প্রতি তৈরি হতে শুরু করেছে চরম বিতৃষ্ণা।
.
সকালে একটি বইয়ে মুখ গুঁজে বসে ছিলেন আনিসা বেগম।হটাৎ ফোন বেজে ওঠায় তিনি বই রেখে ফোনটি তোলেন।
-আসসালামু আলাইকুম।কে বলছেন?
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।আমি ডাঃফেইজ।
-ওহ।ভালো আছেন?
-জ্বি!আসলে একটি কাজেই কল দিয়েছি।তার আগে বলুন,শরীর ভালো তো?
-জ্বি আলহামদুলিল্লাহ। তা কিছু জরুরী কাজ ছিলো কি?
-জ্বি।আসলে,আমার বোনের মেয়ের বিয়ে সামনে।গায়ে হলুদ টি ৩ দিন পর অথাৎ ১৫ তারিখ করা হবে।আর গায়ে হলুদে সব মেয়েরা একই ডিজাইনের শাড়ি পরবে।মেয়েদের সংখ্যা ২৫।মা চাইছেন এ শাড়িগুলো আপনার দোকান দিয়েই নিবে।আপত্তি আছে কি?
-জ্বি না!এটিই তো আমার কাজ।দুয়া করি আপনার ভাগনির আগামী পথচলা শুভ হোক।
-ধন্যবাদ,একটু পড়েই আমি আর আমার পরিবারের ক'জন আপনার দোকানে আসছি শাড়ি পছন্দ করতে।
-আচ্ছা।আমি তো এখন বাসায়।আশা করছি আপনাদের আগেই পৌঁছে যাবো।বেরোচ্ছি যতো দ্রুত সম্ভব।
-জ্বি তারাহুরোর কিছু নেই।আপনি আস্তে ধিরে এসেন।আমরা নাহয় ততক্ষণে শাড়ি দেখতে থাকবোনে।
-জ্বি আচ্ছা। রাখছি।
!!
মোহের ঘুম ভাঙতেই দেখে রিদান এখনো ঘুমোচ্ছে। হটাৎ রিদানের সেদিনের বলা কথাটি মনে পড়ে যায় মোহের তাই সে আর বিছানা দিয়ে উঠে না বরং রিদানের বুকে মাথা রেখে শক্ত করে রিদানকে জরিয়ে ধরে রিদানের গলার নিচের অংশে একটি চুমু খেয়ে আবারও ঘুমিয়ে যায়।
ঘুমের মাঝেই মোহ তার চোখ জোড়ায় কারো ঠোঁটের স্পর্শ পায়।তারপর দু গালেও ঠোঁটের স্পর্শ পাওয়ায় মোহ চোখ খুলে তাকায়।দেখে রিদান ওর দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মোহ কিছু বলে ওঠার আগেই রিদান মোহের ঠোঁট নিজের ঠোঁটের মাঝে নিয়ে নেয়।এভাবে কিছু সময় কাটাবার পর রিদান মোহের ঠোঁট ছেড়ে মোহের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, "ধন্যবাদ"
মোহ বেশ বুঝতে পারে,না উঠে আবার ঘুমোনোর জন্যেই সে "ধন্যবাদ" টি পেলো।তার মানে রিদান তখন জেগে ছিলো!
-আপনি জেগে ছিলেন?(মোহ)
-উহু।তোমার জরিয়ে ধরায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো।
বেশ লজ্জা পায় মোহ।উঠে যেতেও পারছে না।কারণ,রিদান তার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।
-সরুন।দেরি হয়ে যাচ্ছে।
-ঘুমোন্ত অবস্থায় একদম বাচ্চাদের মতো লাগে তোমায়!
-আপনাকেও।(বলে একটু হাসে মোহ)
-আচ্ছা?
-উঠুন প্লিজ।
-নো।আজ অফিস নাই।
-তাহলে সরুন,আমি উঠবো।
-উহু।
-ক্ষিদা লাগছে।
-বাহানার দোকান।
মুখটা বাংলা পাঁচের মতো করেই মোহের উপর থেকে সরে যায় রিদান।মোহ ও ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়।
!!
আনিসা বেগম দোকানে পৌঁছতেই দেখে ডাঃফেইজ ও তার মার সাথে দুটো যুবতী মেয়ে দাঁড়িয়ে শাড়ি দেখছে।আনিসা বেগম তাদের কাছে এগিয়ে যেয়ে কুশল বিনিময় করে অতঃপর তাদের সকলকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে,
-শাড়ি কি পছন্দ হয়েছে আপনাদের?
-নাহ আন্টি। একটিও ভালো লাগছে না।(ডাঃফেইজের ভাগনি,ফেয়রি।)
-আচ্ছা আমায় তোমাদের পছন্দ টা বলো সেই অনুযায়ী আমি শাড়ি বের করছি?
অতঃপর ফেয়রি ও তার বান্ধবী নিজেদের পছন্দের বর্ননা করে।আনিসা বেগম তাদের পছন্দ অনুযায়ী বেশ কিছু শাড়ি দেখায় যার মাঝে একটি শাড়ি তাদের খুব পছন্দ হয়।অবশেষে যাবার সময় ডাঃফেইজের মা আনিসা বেগমকে বিয়ে এবং হলুদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার আবেদন করে এবং বিয়ের কার্ড দেন।অনেকটা অনুরোধের সুরে তিনি আনিসা বেগমকে বিয়েতে উপস্থিত হতে বলে বিদায় নিয়ে সবাইকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসেন।কিন্তু ডাঃফেইজ সবার সাথে না গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।সবাই গাড়িতে উঠতেই তিনি আনিসা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-হলুদ এবং বিয়েতে আপনার উপস্থিতি কামনা করছি।আপনি আপনার মেয়ে-জামাইদের নিয়ে এলে খুশি হবো।
-জ্বি,আন্টি এতো করে বললো যে কথাটি ফেলতে পারছি না।ইন শাহ আল্লাহ, অবশ্যই যাবো।
-ধন্যবাদ। একটি কথা বলতাম!
-জ্বি বলুন।
-আপনায় ও শাড়ি টায় দেখতে বেশ লাগবে।হলুদে নাহয় ওটাই পড়েন।
ডাঃফাইজের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশংসাবাদে অস্বস্তি অনুভব করেন আনিসা বেগম। তবুও তা প্রকাশ না করে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে সম্মতি জানান।ডাঃফাইজ ও আলতো হেসে গাড়িতে গিয়ে বসে পড়েন।
!!
বিকেল চারটে__
মোহ ও রিদান বারান্দায় বসে গল্পে মগ্ন। গল্পের এক পর্যায়ে রিদান প্রশ্ন করে ওঠে,
-তুমি এ ক'দিন পড়তে বসেছিলে?
প্রশ্নটি শুনেই মুখ কালো হয়ে যায় মোহের।এ ক'দিনে তো সে একবারই পড়তে বসেছিলো তাও আধঘন্টার মতো।এটি শুনে রিদান রেগে যাবে না তো?মোহ আমতা আমতা করে বলে,
-বসেছিলাম।
-কতক্ষণের জন্যে?
-আধাঘন্টা।
-কিহ!!
-সরি!
-এখনই পড়তে বসবে চলো।
-একটু গল্প করি?
-নো মিনস নো।
মন খারাপ করে মোহ বিছানায় বই খাতা নিয়ে বসে পড়ে।রিদান ঠিক মোহের পেছনে বসে, পেছন থেকে মোহ কে জরিয়ে ধরে।মোহ মুচকি হেসে পড়া শুরু করে।মোহ জোরে জোরে পড়ছে আর রিদান মোহের কাধে মাথা রেখে পড়া শুনছে।সেই সাথে ভুল হলে তা ধরিয়ে দিচ্ছে।প্রায় ৪৫ মিনিট অতিবাহিত হবার পর মোহ বলে ওঠে,
-শুনছেন,মাথা ব্যথা করছে।
রিদান মোহের হাত থেকে বইটি নিয়ে মোহকে নিজের কোলে শুইয়ে এক হাতে মোহের মাথা টিপে দিতে থাকে আর অপর হাতে মোহের বইটি ধরে,মোহকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে।যেগুলোর উত্তর মোহ পারেনি সেগুলো রিদান জোরে জোরে উচ্চারণ করে আর তা শুনে রিদানের সাথে সাথে মোহও বার বার উচ্চারণ করে।এভাবে প্রশ্নের উত্তরগুলো মুখস্থ হয়ে যায় মোহের।এভাবেই সন্ধ্যে ৭ঃ৩০ অব্দি মোহকে পড়ায় রিদান।অতঃপর মোহের অনুরোধে পড়া শেষ করে ওঠে তারা।
মোহের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিদান।মেয়েটি মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে।হালকা নীল কালারের শাড়ী পড়েছে সে।চুল থেকে টুপ টুপ করে পানি পরছে,যা সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুছে চলছে।শাড়ি ভেদ করে কোমর টা দৃশ্যমান।বেশ মোহনীয় লাগছে মোহকে।রিদান এক ঘোর লাগা দৃষ্টিতে বেশ কিছু সময় মোহকে দেখার পর এগিয়ে যায় মোহের দিকে।হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় মোহের কোমর।ভিজে চুলে মুখ ডুবিয়ে হাতটি মোহের কোমর হতে পেট অব্দি আনে।মোহের পুরো শরীরে যেনো বিদ্যুৎ বয়ে যাচ্ছে।রিদানের হাতটি খামচে ধরে সে।রিদান মোহের কানের কাছে মুখ নিয়ে যায়।এতে মোহের মাঝে শিহরণ আরো বেড়ে যায়।হটাৎ রিদান মোহের কানে একটি কামড় বসিয়ে দেয়।ব্যথায় মোহ "আহহ" বলেই দূরে সরে যায় রিদানের থেকে।রিদান একটি বাঁকা হাসি দিয়ে আবারও যেয়ে বিছানায় বসে পড়ে আর মোহ তার কানে হাত দিয়ে বিরবির করে বলতে থাকে,"রাক্ষস,পঁচা ডিম,লেজকাটা টিকটিকি,সাদা বানর..............."।এদিকে রিদান মোহের বিরবির করা দেখে নিঃশব্দে হেসেই চলছে।এসব বলার মাঝেই মোহের চোখ যায় রিদানের দিকে ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।এ দেখে মোহের রাগ যেনো আরও বেড়ে যায়।মোহ বিছানার কাছে যেয়ে একটি বালিশ দিয়ে মারতে শুরু করে রিদানকে।মারার এক পর্যায়ে রিদান বালিশটি ধরে টান দিয়ে মোহকে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসে।এতে মোহ একদম স্তব্ধ হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রিদানের দিকে। এর মাঝেই রিদান,মোহের নাকেও কামড় বসিয়ে দেয়। ব্যাস,মোহের রাগ এখন ৭ম আসমান ছুঁই ছুঁই।রাগের বসে সেও কাপড় বসিয়ে দেয় রিদানের গলার নিচের দিকটায়।এতোটাই জোরে দেয় যে দাঁতের দাগ বসে জায়গাটা লাল হয়ে যায়। আরেকটুর জন্য রক্ত বের হয়নি।কিন্তু এমন কামড় দেওয়ার পরও রিদানের কোনো প্রতিক্রিয়া পেলো না মোহ।এতে অবাক হয়ে মোহ তাকিয়ে থাকে রিদানের দিকে।রিদান বাঁকা হেসে, মোহকে ছেড়ে আয়নার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়।আয়নার দিকে তাকিয়ে দাগটিতে হাত বুলোতে বুলোতে বলে,
"Our first love bite"
কথাটি শুনে প্রচন্ড লজ্জা পায় মোহ।তাই সেখানে আর দাঁড়িয়ে না থেকে বেরিয়ে পরে রুম থেকে।
!!
বিকেল ৫ টা।আজ সন্ধ্যায় ডাঃফাইজের ভাগনি ফেয়রির গায়ে হলুদ।আনিসা বেগম,মোহ-রিদান,তমা বেগম এবং রিয়াদ সাহেব যাবেন এ অনুষ্ঠানে।ডাঃফেইজ রিদানদের ফ্যামিলি ডক্টর এবং রিয়াদ সাহেবের বেশ ভালো বন্ধু তাই ডাঃফেইজ রিদানদের সবাইকে এ অনুষ্ঠানে শরিক হওয়ার আমন্ত্রণ করেছেন।অবশ্য আগে জানা না থাকলেও এখন ডাঃফেইজ মোহকে শুধু রিদানের স্ত্রী হিসেবে নয় বরং মোহ যে আনিসা বেগমের কন্যা তাও জানেন।
সবাই প্রস্তুত হয়ে রওয়ানা হয় কমিউনিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে।আধ ঘন্টার মাঝে পৌঁছে যায় তারা।ডাঃফেইজ এবং তার মা দুজনে স্বাগতম জানিয়ে রিদানদের নিয়ে যায় কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে।খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে সবটা।ভেতরে প্রবেশ করার পর ডাঃফেইজের পরিবারের বেশ কয়েকজনের সাথে কুশলাদি বিনিময়ের পর্যায় শেষে মোহ-রিদান,ফেয়রিদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে পরে।রিয়াদ সাহেব এবং তমা বেগমও ডাঃফেইজের মায়ের সাথে কথায় মগ্ন।আর আনিসা বেগম ঘুরে ঘুরে দেখছেন ডেকোরেশনগুলো।খুব সুন্দর সুন্দর ফুলের সমাবেশ।সেই সাথে জ্বলছে নানান রং এর লাইট।চমৎকার ভাবে সাজানো হয়েছে জায়গাটি।দেখেই বুঝা যাচ্ছে অনেক টাকা খরচ করা হয়েছে।
হটাৎ ডাঃফেইজের ডাকে ধ্যান ভাঙে আনিসা বেগমের।
-কেমন আছেন?
-জ্বি ভালো।আপনি?
-আলহামদুলিল্লাহ।তা কি করছেন একা একা?
-এইতো ঘুরে ঘুরে দেখছি।
-ভালো লাগছে একা একা এভাবে?
-হাসালেন।একাকিত্ব টাই কি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় একটি অংশ নয়?
-হু।দ্বিতীয় বিয়ে টা করেননি কেনো জানতে পারি?
-আসলে,অল্প বয়সে স্বামীর থেকে প্রাপ্ত এমন এক ধাক্কা সামলানোর সয়মটিও পেয়েছিলাম না।সম্মুখীন হতে হয়েছিল বিভিন্ন সংগ্রামের।আমাদের সমাজ সম্পর্কে তো জানেনই।স্বামীর ছায়া না থাকলে কতোটা অনিশ্চয়তা এবং অনিরাপদ জীবন কাটাতে হয় মহিলা মানুষের তা বোঝেন নিশ্চয়ই?এতো সবের মাঝে দু-দুটি মেয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বও তো ছিলো।কোনো ছেলেকে বিশ্বাস করে বিয়ে করলেও সে ছেলেটি আমার মেয়েদের কোন নজরে দেখবে তার ও ছিলোনা কোনো নিশ্চয়তা। তাই জন্যেই বিয়ে নিয়ে ভাবিনি।
-সবটাই ঠিক।১২ টি বছর তো এ একাকিত্ব টাই বয়ে বেড়াচ্ছেন।আর কতো?
-মানে?
-এখন তো আপনার মেয়ে রাও যার যার মতো বেশ ভালোই আছে।তাহলে এখন তো ভেবে দেখতে পারেন?
-আপনি যা বলছেন তা কি বুঝে বলছেন?এ বয়সে বিয়ে?দু মেয়ের বিয়ে দিয়েছি,দু দিন পর নানি হবো।এমন সময় আপনি বলছেন আমি নিজে বিয়ে করবো?
-বড্ড সেকেলে কথা বলছেন আপনি।দু-মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন,দু দিন পর নানি হবেন তাই বলে কি আপনার সুখে থাকার অধিকার নেই?দেখেন মানুষের জীবন একটাই অনেক তো অন্যের কথা চিন্তে করে নিজের জীবনের ১২ টি বছর নষ্ট করেছেন।এখন অন্তত নিজের কথা টি ভাবুন।এ সময় একজনকে খুব প্রয়োজন আপনার যে আপনার একাকিত্বের সঙ্গী হবে।এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে একটু নাহয় সমাজের বিরুদ্ধে যেয়ে বাঁচতে শিখুন।
কথা গুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন আনিসা বেগম। ডাঃফাইজের কথায় তিনি যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন। সেই সাথে এক আশার আলো নিজের মাঝে সঞ্চারিত হওয়াটা অনুভব করতে পারছেন।কিন্তু তারপরেও সে আশার আলোকে নিভিয়ে তিনি বলে উঠলেন,
-দেখুন এ বয়সে এগুলো মানায় না।কে করবে আমার মতো এমন এক বুড়ীকে বিয়ে?সেই সাথে আমাদের সমাজে এর স্বীকৃতি নেই।
-সমাজ তো মানুষেরই সৃষ্টি।এটা পরিবর্তনশীল।প্রথমে কেউ একজন শুরু করে পরে অনেকেই তার অনুসরণ করে।ব্যাস,তৈরি হয়ে যায় সমাজে এক নতুন নিয়ম/রীতি/প্রথা।আর কি যেনো বললেন, আপনি বুড়ী?আপনাকে দেখতে ৩৫ বছরের বেশি বয়সী নারী মনে হয় না।
ডাঃফাইজের কথা কোনোটিই ফেলে দেওয়ার মতো নয়।আসলেই সমাজ পরিবর্তনশীল।আমরা চাইলেই আমাদের সমাজে পরিবর্তন আনতে পারি।শুধু শুরুটি করতে হয় যেকোনো একজনের।এসব ভেবে আবার ও আনিসা বেগমের মনে জন্ম নিলো এক আশার আলো।হয়তো,সে ও আবার ভালো থাকতে আরম্ভ করতে পারবে।সবচেয়ে বড় কথা হয়তো সে এই যন্ত্রণাময় একাকিত্ব থেকে বাঁচতে পরবে।এসব ভাবনা দিয়ে নিজেকে বের করে আনিসা বেগম ঠোঁটে আলতো হাসি ফুটিয়ে বলেন,
-আমার বয়স ৪০।
-আর এ বয়সে নিজেকে বুড়ী বলছেন?
-তো কিশোরী বলা উচিৎ ছিলো?(হেসে বলে ওঠেন আনিসা বেগম)
-মন্দ বলেননি।আমার বয়স ৪৭।কিন্তু নিজেকে ২৭ বছর বয়সের যুবক মনে হয় আমার।
একথাটি শুনেই একটু শব্দ করে হেসে ওঠেন আনিসা বেগম।হাসার মাঝেই বলে ওঠেন,
-বেশ তো।তবে তো যুবকের বিয়ের বয়স হয়েছে।
-ঠিক বলেছেন।এখন পাত্রী রাজী হওয়ার অপেক্ষা।
-তা পছন্দ আছে?
-জ্বি।
-দেখতে পারি?
-অন্য একদিন?
-জ্বি আচ্ছা।
!!
মোহ-রিদান অনেকটা সময় ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে এবং আশেপাশের মানুষদের দেখছে।হটাৎ এক মেয়ে এসে রিদানের চোখ পেছন থেকে চেপে ধরে।আচমকা এমন হওয়ায় মোহ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে মেয়েটির কাজ।এদিকে রিদান মেয়েটির হাত স্পর্শ করে কিছুটা আন্দাজ করে বলে ওঠে,
-অন্তী?
-ঠিক।কেমন আছো?(রিদানের চোখ হতে হাত সরিয়ে)
-আলহামদুলিল্লাহ।তুই?
-অনেক ভালো।কত্তো দিন পর দেখা!!
-হ্যাঁ।লন্ডন দিয়ে এলি কবে?
-এইতো পরশু। চেয়েছিলাম তোমায় কল দিতে কিন্তু এতো ঝামেলা এখানে!!
-বিয়ে বলে কথা।
এমন আরো কথা হতে থাকে রিদান আর ও মেয়েটির মাঝে।মোহ কে যেনো ভুলেই গিয়েছে রিদান।এসব একটুও সহ্য হলো না মোহের।সে মন খারাপ করে সেখান দিয়ে সরে আনিসা বেগমের সাথে এসে দাঁড়ায়।আনিসা বেগমের সাথে দু-চারটি কথা বললেও মোহের দৃষ্টি রিদানের দিকে।রিদান মেয়েটির সাথে এতোটাই ব্যস্ত যে অন্য দিকে একটি বারের জন্য ও দেখছে না সে।এভাবে প্রায় আধা ঘণ্টার বেশি হওয়ার পর মোহ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।সে ছলছল চোখে রিদানের দিকে তাকিয়ে দেখে রিদান এখনো ও মেয়ের সাথে বেশ হেসে হেসে কথা বলায় ব্যস্ত।এতোটা সময়ের মাঝে একটি বারও মোহের খোঁজ করেনি সে।মোহ নিজের চোখের জল আটকাতে না পেড়ে এগিয়ে যায় নিজেদের গাড়ির দিকে।ড্রাইভারকে ডেকে রওয়ানা দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। সারাটি রাস্তা কান্না করে বাড়ি পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে তার মাকে মেসেজ করে দেয়,
"শরীর খারাপ থাকায় বাসায় চলে এসেছি।চিন্তা করোনা"
মেসেজ টি দিয়েই ছাঁদে চলে আসে মোহ।আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে ছলছল নয়নে।হটাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পেছনে ফিরে তাকায় মোহ।দেখে রিদান দাড়িয়ে আছে।এতো জলদি কি করে এলো রিদান?এতো সব না ভেবে মোহ রিদানের হাতটি কাঁধ দিয়ে সরিয়ে বলে ওঠে,
"কিছু টা সময় একা থাকতে চাই প্লিজ"
রিদান কিছু না বলে মোহকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে।এবার মোহ নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে পারে না।এক ঝটকায় রিদানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।তারপর বেশ উঁচু আওয়াজেই বলে ওঠে,
"শুনতে পারছেন না একা থাকতে চাইছি আমি?কেনো এসেছেন এখানে?কে আসতে বলেছে?অনুষ্ঠানের মেয়েটি কোথায়?এতো জলদি কথা বলা শেষ আপনাদের?"
-অন্তী আমার এক কাজিনের বউ,মোহ।ও আমার ছোট,আমি ওকে নিজের ছোট বোন হিসেবে যথেষ্ট ভালোবাসি।পুরো ৩ টি বছর পর ও দেশে ফিরেছে।কিছু কাজের জন্য ওখানে আরো ২ দিন থেকে আমার কাজিন টা ২ দিন পর দেশে আসবে।জানি,আমার ওভাবে একটি মেয়ের সাথে কথা বলাটা ভালো লাগেনি তোমার।কষ্ট পাচ্ছিলে তুমি।আর এটাই দেখার জন্য অন্তীর সাথে ওমন হেসে হেসে কথা বলছিলাম।আর আমার বউ টা যে আমায় দেখে চলছিলো তাও বুঝছিলাম।যখন দেখলাম বউ আমার কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যাচ্ছিলো তখন তার পিছু পিছু আমি বেরিয়ে গেলাম।তো এতোটা হিংসের কারণ টা কি?
নিজের কাজে বেশ লজ্জিত মোহ।সেই সাথে রিদানের করা প্রশ্নটি যেনো মোহের লজ্জা কয়েক শত গুণ বাড়িয়ে দিলো।মোহ নিচের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-বাঙালি মেয়ে রা তার স্বামীর ভাগ কেউকে দেয় না।
-আচ্ছা? আর স্বামী জড়িয়ে ধরলে এক ঝটকায় তাকে দূরে সরিয়ে দেয়?
এবার আর কোনো কথা না বলে মোহ শক্ত করে জরিয়ে ধরে রিদানকে।রিদানের ঠোঁটে ফুটে ওঠে এক তৃপ্তিময় হাসি।
চলবে...
Writer:- Mahzabin