ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনা আমাকে সবসময় একটা নতুনত্ব শিক্ষা দেয়। সবকিছু নিয়ে নতুন করে ভাবতে, নতুন আঙ্গিকে দেখতে উদ্বুদ্ধ করে।
সূরা ইউসুফ শুরু হয়েছে একটা স্বপ্নের ঘটনার মাধ্যমে। স্বপ্নটা দেখেছিলেন বালক ইউসুফ আলাইহিস সালাম। স্বপ্নে তিনি দেখলেন— সূর্য এবং চাঁদ সহ অন্য আরো এগারোটা তারকা তাঁকে সিজদাহ করছে। এই স্বপ্নের রহস্য কী তা বালক ইউসুফ আলাইহিস সালাম বুঝতে পারলেন না। তিনি তাঁর পিতা নবি ইয়াকুব আলাইহিস সালামের কাছে এসে পুরো স্বপ্নটা বিবৃত করলে, ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এই স্বপ্নের গূঢ় রহস্য বুঝতে পারলেন এবং তা বালক ইউসুফকেও বুঝিয়ে দিলেন। তবে, তিনি সাথে সাথে সতর্ক করে দিলেন পুত্র ইউসুফকে। বললেন,
'আমার পুত্র! স্বপ্নের এই কথা তোমার ভাইদের কাছে কোনোভাবেই বলতে যেও না। যদি তারা তোমার স্বপ্নটার ব্যাপারে জানতে পারে, তাহলে যেকোনপ্রকারেই তারা তোমার ক্ষতি করতে উদ্যত হবে'।- সূরা ইউসুফ, ০৫
ইউসুফ আলাইহিস সালামের স্বপ্নটার মধ্যে কী এমন ছিলো যা ভাইদেরকে ঈর্ষাণ্বিত করে তুলতে পারে যার ফলে তারা তাঁর ক্ষতি করতেও দ্বিধা করবে না? সেটা হলো— আল্লাহ প্রদত্ত মর্যাদা। এই স্বপ্নের অর্থ ছিলো— ইউসুফ আলাইহিস সালামকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা একদিন এমন মর্যাদা দান করবেন যে, তাঁর এগারো ভাই, তাঁর পিতা এবং মাতা সহ সকলে তার অনুগত হবে। কিন্তু, মর্যাদার এই ব্যাপারটা সহজভাবে নিতে পারবে না তাঁর ভাইয়েরা। তারা চাইবে যাতে ইউসুফ আলাইহিস সালাম কোনোদিন এই মর্যাদায় উন্নীত হতে না পারে।
খেয়াল করে দেখুন— ইয়াকুব আলাইহিস সালাম কিন্তু বেশ জোরালোভাবেই ইউসুফ আলাইহিস সালামকে বারণ করেছেন স্বপ্নের কথা অন্যকাউকে না বলতে।
আপনার কি কোন স্বপ্ন আছে? এমন কোন ইচ্ছা যা অর্জনের তীব্র বাসনা আপনার হৃদয় গহীনে পুষে রেখেছেন? এমন কোন প্রতিভা কি আপনার আছে যা আপনার আশপাশের অন্য কারো কাছে নেই? এমন কোন দক্ষতা কি আপনার আছে যা আপনাকে আপনার চারপাশের সবার থেকে আলাদা করতে পারে?
যদি আপনার কোন স্বপ্ন থাকে, যদি আপনার কোন ইচ্ছা-অভিলাষ থাকে, যদি আপনি কোন একটা কাজে বিশেষভাবে পারদর্শী হোন, যদি কোন এক নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আপনার দক্ষতা আপনাকে অন্য সবার চাইতে আলাদা করার ক্ষমতা রাখে— দয়া করে সেই স্বপ্নের কথা, সেই ইচ্ছা-অভিলাষের কথা, সেই প্রতিভা কিংবা দক্ষতার কথা যথাসম্ভব গোপন রাখুন। জনে জনে গিয়ে আপনার স্বপ্নের কথা জানাবেন না। আপনার ইচ্ছের কথা আশপাশের সবাইকে বলে বেড়ানোর দরকার নেই। আপনি যে কোন একটা কিছু বেশ ভালো পারেন তা প্রত্যেকের কাছে গিয়ে বর্ণনা করা নিষ্প্রয়োজন।
কেনো জানেন? কারণ— আপনার আশেপাশে থাকা মানুষগুলোর প্রত্যেকে কিন্তু আপনার সত্যিকার শুভাকাঙ্খী নয়। হতে পারে তারা আপনার সাথে হেসে কথা বলে, হতে পারে তারা আপনার সাথে হাঁটে-চলে, হতে পারে তারা আপনার সাথে খায় এবং ঘুমোয়। তারা আপনার সাথে দিনের বেশিরভাগ অংশ কাটায় বলেই যে তারা আপনার সত্যিকার বন্ধু বনে যাবে, তারা হৃদয় থেকে আপনাকে ভালোবাসবে, আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী হবে, আপনার ভালো চাইবে— এমনটা ভাবা কিন্তু নিতান্তই ভুল।
আপনার অর্জন সর্বদা যে তাদের আনন্দ দেবে, তাদেরকে গর্বিত করবে তা কিন্তু নয়। আপনি হয়তো জানেন না— গোপনে তারা আপনাকে হিংসা করে। নিভৃতে তারা হয়তো আপনার নিন্দা করে বেড়ায়। আপনি যখন কোন বিপদে পড়েন, তখন তারা ভিতরে ভিতরে আনন্দে আটখানা হয়, কিন্তু আপনার সামনে চেহারাটাকে ম্লান এবং ক্লিশে করে তারা বোঝাতে চায় যে— আপনার দুঃখটা তাদেরকে ভীষণভাবে ছুঁয়ে গেছে।
হতে পারে তাদের এসবকিছুই মিথ্যা। তারা হয়তো আপনার জন্যে এই অকল্যাণটাই কামনা করে আসছিলো এতোদিন। রিটেনে টিকে গিয়েও ভাইবাতে বাদ পড়ে যাওয়া, একটা বছর ড্রপ খাওয়া, অথবা এতোদিনের চাকরিটা হারিয়ে ফেলা— এসবকিছুই তাদের জন্য আনন্দের উপলক্ষ হতে পারে। আপনার ডিভোর্স হয়ে যাওয়া, সন্তান না হওয়া, আয়-উপার্জন কম হওয়া, ব্যবসায়ে ক্ষতি— এগুলোও হতে পারে তাদের মনো-তৃপ্তির কারণ। তারা আপনাকে ভালোবাসে না, ঘৃণা করে অথবা হিংসা করে।
সুতরাং, যে স্বপ্নটা আপনি দেখছেন, যে ইচ্ছেটা আপনি পুষে রেখেছেন মনের ভেতর, যে বিশেষ দক্ষতায় আপনি এগিয়ে গিয়েছেন অন্য অনেকের চাইতে, যে বিপুল সম্ভাবনা আপনার দুয়ারে দাঁড়িয়ে— এসবের কোনোকিছুই আপনার আশেপাশের সবাইকে জানাবেন না। যেহেতু আপনি জানেন না আপনার প্রকৃত হিতাকাঙ্ক্ষী কে, সুতরাং যতোবেশি আপনার স্বপ্নকে নিজের ভেতরে রাখতে পারবেন, ততোবেশিই আপনার জন্যে মঙ্গল।
ইয়াকুব আলাইহিস সালাম চান নি ইউসুফ আলাইহিস সালামের স্বপ্নের ব্যাপারটা তাঁর ভাইয়েরা জানুক, কারণ— তিনি জানতেন যে, তারা ইউসুফ আলাইহিস সালামের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী নয়। তারা কোনোদিন চাইবে না ইউসুফ আলাইহিস সালাম এমন মর্যাদায় উন্নীত হোক।
আপনার স্বপ্নটাও, যে অবস্থায় আপনি নিজেকে কল্পনা করে রেখেছেন, যে ইচ্ছেটা আপনার মনের কোণে বড় করছেন ধীরে ধীরে— তা সকলের কাছে বলে বেড়ানোর ব্যাপারে দ্বিতীয়বার ভাবুন। আশেপাশের সকলেই কি আপনার সত্যিকার শুভাকাঙ্খী? নাকি, তাদের ভেতরে এমন অনেকেও থাকতে পারে যারা হাজার বছর আগের ইউসুফ আলাইহিস সালামের ভাইদের মতো নিভৃতে ভীষণ হিংসুটে?
তার মানে কিন্তু এটা নয় যে, আশপাশের সবাইকেই আপনি সন্দেহের চোখে দেখবেন, সবার সাথে দূরত্ব রাখবেন বা খারাপ আচরণ করবেন। এর কোনোটাই ইউসুফ আলাইহিস সালাম করেন নি। বরং, দিনশেষে ভাইদের তিনি আপন করেই নিয়েছিলেন।
সবার সাথে আপনার ভালো আচরণ, ভালোবাসা, হৃদ্যতা অব্যাহত-ই থাকবে, তবে নিজের স্বপ্নটার ব্যাপারে আপনাকে একটু সতর্ক হতে হবে। তা যেন ভুল মানুষের কানে না উঠতে পারে।
Writer:- Arif Azad