> আমার কাহাফ ভাবনা ১১ - আরিফ আজাদ - Arif Azad - Boipoka365 - সুরা কাহাফ - Al Kahf
-->

আমার কাহাফ ভাবনা ১১ - আরিফ আজাদ - Arif Azad - Boipoka365 - সুরা কাহাফ - Al Kahf

আমার খুব কাছের এক মানুষের দাম্পত্য-জীবন ভাঙে ভাঙে অবস্থায়। যেদিন প্রথম শুনেছিলাম যে, তাদের সম্পর্কটা সমাপ্তির একেবারে দ্বারপ্রান্তে, এতোটা কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন যা বোঝাবার মতো নয়। 'মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া' প্রবাদটা আসলে কী অর্থ বহন করে সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম।

বন্ধুত্ব এবং ভাতৃত্বের দাবি থেকে আমি তাদের সম্পর্কটা টিকানোর শেষ চেষ্টাটা করতে চেয়েছিলাম। অন্তত আরেকটু সময় যাতে তারা নেয়, দুজন দুজনকে আরেকটু সময় যাতে দেয়, যাতে সিদ্ধান্তটাকে তারা আরেকবার বিবেচনা করে— এমনটাই আমার আশা ছিলো। ডিভোর্সের আগের রাতেও স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি নিরসন হয়েছে, তারা একসাথে সুখী জীবনযাপন করেছে— এমন ঘটনা আমাদের চারপাশে বিরল নয়, বিস্তর। 

কিন্তু তাকদিরের লিখন— তাদের সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত আর টিকলো না। দুজনের ডিভোর্স হয়ে গেলো। কিন্তু মধ্যখানে ঘটে গেলো আরো একটা ব্যাপার— আমার বন্ধুটা তার জীবনের সেই সিদ্ধান্তে আমার ভূমিকাটাকে পছন্দ করলেন না। তার ধারণা— পুরো ব্যাপারটায় আমি তার নয়, সেই মেয়েটার পক্ষে ছিলাম যাকে তিনি ডিভোর্স দিতে চাচ্ছিলেন।

কিন্তু আল্লাহর শপথ— আমি এককভাবে কারো পক্ষেই ছিলাম না। আমি থাকতে চেয়েছিলাম দুজনের পক্ষেই। চেয়েছিলাম দুজনের সম্পর্কটা টিকে যাক। সংসারে কতো ধরণের অশান্তিই তো ঘটে। রাগের মাথায় একজন স্বামী/স্ত্রী কতো ধরণেই সিদ্ধান্তই তো নেয়। তাদের সমস্যাটাকেও সেরকম ভেবে আমি চেয়েছিলাম যাতে মাঝখানে তারা কোন মধ্যস্ততাকারী রাখে এবং সমস্যাগুলো নিয়ে বিশদ আলাপ করে। কোন সমাধান থাকলে যেন সেদিকটায় ধাবিত হয়। একটা সংসার ভেঙে যাওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়!

কিন্তু, আমার এই 'জোড়া লাগাতে চাওয়া' মানসিকতাকে আমার বন্ধুটা ভেবে বসলেন পক্ষপাতিত্ব হিশেবে। ডিভোর্সের যে সিদ্ধান্তটা তিনি নিয়েছেন, তার ধারণা সেটাকে আমি অসম্মান করেছি। 

তাদের ডিভোর্স হলো এবং পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় গড়ালো অনেক জল। আর ঘটলো আরো একটা ব্যাপার— বন্ধুটার সাথে আমার তৈরি হলো একটা মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব। যদিও বেশ বিনয় আর আকুতিভরে তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম যে— পুরো ব্যাপারটায় আমার একটাই ইচ্ছে ছিলো। আমি চেয়েছিলাম তারা সুখী হোক। তাদের সমস্যাগুলো মিটিয়ে তারা পুনরায় যাত্রা করুক জীবনের স্রোতে৷ আমার এই চাওয়াতে কোন দুরভিসন্ধি নেই, কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। আমার একটাই উদ্দেশ্য ছিলো— তাদের কল্যাণ। সেই কামনার্থেই ছিলো আমার সকল তৎপরতা।

কিন্তু, যে দূরত্ব একবার তৈরি হয়ে যায় তা সহজে কাটে না। যদিও আমরা আগের মতোই চলি, একসাথে ঘুরি, খাই, নানান কাজে যুক্ত হই, কিন্তু মানসিকভাবে এড়িয়ে চলবার ব্যাপারটা বেশ চোখে পড়ে। তার জীবনের যে ঘটনাগুলোতে আমার সকলরব উপস্থিতি কাম্য ছিলো, সেখানে আমি যখন নিতান্তই একজন 'অতিথি' হয়ে পড়ি, তখন বন্ধুত্বের দাবি-দাওয়ায় আমার যে আর অবাধ অংশগ্রহণ তিনি চান না— তা বুঝতে পারি।

[২]

আমাদের সম্পর্কটা অত্যন্ত গভীর। সেটাকে বন্ধুত্ব কিংবা ভ্রাতৃত্ব দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা মুশকিল। ইটস সামথিং মোর দ্যান দ্যাট! আমাদের সেই সম্পর্কে এমন অদৃশ্য ফাটল, এমন দূরত্ব আর 'কষ্ট করে মানিয়ে নেওয়া'র যে প্রবণতা, সেটা বেশ পীড়া দেয় আজকাল। মাঝে মাঝে মনে হয়— ভালোটাই তো চেয়েছিলাম। তার কোন ক্ষতি, কোন অকল্যাণ আমি তো দুঃস্বপ্নেও কামনা করতে পারি না। তবে কেনো আমাদের মাঝে এই বিচ্ছেদরেখা?

মাঝে মাঝে ভাবি— তবে কি ভুল করেছি? একটা ভাঙতে যাওয়া সম্পর্ককে জোড়া লাগাতে চাওয়া, সেই লক্ষ্যে চেষ্টা করা কি তাহলে ভুল? একটা সম্পর্ক বেঁচে গেলে শান্তি না বন্ধুত্ব? তবে কি আমার আন্তরিকতা, ভালোবাসা, সম্পর্কের কোন মূল্য কোথাও পাওয়া হবে না? আমার এই পরম সদিচ্ছাটাকে সারাজীবন 'ভুল' হিশেবে টেনে নিতে হবে?

এতোসব ভাবতে ভাবতে যখন হাঁপিয়ে উঠছিলাম, তখন আমার সামনে নতুন এক আশার আলো হয়ে ধরা দিলো সুরা কাহাফের একটা আয়াত। সুরা কাহাফের এক জায়গায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা বলছেন,

'যে উত্তমভাবে কাজ করে, আমি তার কর্মফল বিনষ্ট করি না‌‌।'— সুরা আল-কাহাফ, আয়াত ৩০

উত্তম কাজ যারা করে, যাদের নিয়্যাত পরিষ্কার, কোন কাজ করার সময় যারা অন্তরে কোন দুরভিসন্ধি বা বক্রতা রাখে না, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা বলছেন যে, এমন লোকের কর্মফল তিনি বিনষ্ট করেন না। তিনি এর বিনিময় বান্দাকে প্রদান করবেন-ই।

সুবহান-আল্লাহ! এ যেন খুঁজতে থাকা আমার অস্থির অন্তর স্থির করবার মহৌষধ। কতো অপার মহিমা আমার রবের!

আমি আমার বন্ধুটাকে কতো আকুতিভরে বোঝাতে চেয়েছিলাম আমার উদ্দেশ্য, আমার নিয়্যাতের কথা। চোখে চোখ রেখে বলেছিলাম আমি তার পরম এক শুভাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু আমার বন্ধুটার অন্তর তা মানলো না। সেখানে তৈরি হলো এক বৈরিতা, এক অস্পষ্ট দূরত্ব। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালাকে কিছুই বোঝাতে হলো না আমার। আমার বন্ধুটাকে কলিজা ছিঁড়ে দেখালেও হয়তো একটা 'কিন্তু' সেখানে থেকে যেতো। অথচ আমার মালিককে কিছুই খুলে বলতে হলো না। অন্তরের খবর তিনি ছাড়া আর কে জানেন জগতে?

আমি আমার বন্ধুকে কোন দোষ দিই না। মানুষ মাত্র-ই এরকম। তার জায়গায় আমি হলে হয়তো আমিও এর ব্যতিক্রম হতে পারতাম না।

তার সাথে একটা মানসিক দূরত্ব তৈরি হওয়ার যে কষ্ট আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো, সুরা আল কাহাফের এই আয়াত সেখানে আমাকে অনেকখানি স্থিরতা এনে দিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। জীবনের সকল স্বীকৃতি যে মানুষের কাছ থেকেই পেতে হবে তা নয়, কিছু স্বীকৃতি কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালার কাছ থেকেই না-হয় নেওয়া হবে, ইন শা আল্লাহ।

এই আয়াত আমাকে জীবনের যে পরম পাঠ শিখিয়ে গেলো তা হলো এই— উত্তম কাজটুকু উত্তম উদ্দেশ্যে কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালার জন্যেই করা উচিত৷ সেই কাজে মানুষের স্বীকৃতি মিললে তো মিললোই, কেউ আপন করে নিলে ভালো, কেউ বন্ধু হয়ে গেলে আলহামদুলিল্লাহ, তবে যদি কেউ সেটাকে স্বীকৃতি না-ও দেয়, কেউ যদি আপন করে না-ও নেয়, কেউ যদি বন্ধু হয়ে পাশে না-ও থাকে তাতে কোন সমস্যা নেই৷ কারণ আপনার সামনে আছে এক আসমানী ভরসা—

'উত্তম কাজ যে করে, কেউ তা স্বীকার করুক বা না-করুক, কেউ তা ভুল বুঝুক বা ঠিক, কেউ তার বিনিময় দিক না না দিক, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা সেই উত্তম কাজের বিনিময় দিতে একদম কার্পণ্য করেন না। শুধু একটা জিনিসই কেবল ঠিক করতে হবে— নিয়্যাত৷





Writer:- Arif Azad 
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner