> কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ ০৪ - আরিফ আজাদ - Arif Azad - ইসলাম - কুরআন
-->

কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ ০৪ - আরিফ আজাদ - Arif Azad - ইসলাম - কুরআন

সমুদ্র দেখলে আমার দু'জন পয়গম্বরের কথা মনে পড়ে যায়। প্রথমে মনে পড়ে মুসা আলাইহিস সালামের কথা। মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর এমন একজন নবি যাকে জীবনের সংগ্রামে জড়াতে হয়েছে জন্মের ঠিক পর পর-ই।

পাপিষ্ঠ ফেরাউনের হাত থেকে বাঁচাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা মুসা আলাইহিস সালামের মা'কে নির্দেশ দিয়েছিলেন বাকশোতে পুরে শিশু মুসা আলাইহিস সালামকে তিনি যেন সমুদ্রে নিক্ষেপ করে দেন।

দৃশ্যটা ভাবুন— একটা দুধের শিশুকে বাকশোতে ভরে দরিয়ায় নিক্ষেপ করে দিচ্ছে একজন মা! পৃথিবীর কোন মায়ের পক্ষেই কি এমনটা করা সম্ভব? আপনার আম্মা কি পারতেন আপনাকে খুব ছোটবেলায় ঠিক এভাবে বাকশো-বন্দী করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে? অথবা— আপনার দ্বারা কি সম্ভব আপনার দুধের সন্তানকে বাকশোর মধ্যে ঢুকিয়ে পানিতে ছুঁড়ে মারা?

দুনিয়ার কোন মা-ই এটা করতে পারে না। নারীত্বের মমতার অংশটা, মাতৃত্বের গভীর দরদটা এই জায়গায় এসে ভীষণভাবে থমকে যেতে বাধ্য।

মুসা আলাইহিস সালামের মা-ও কিন্তু পারতেন না। নাড়িছেঁড়া বুকের মানিককে তিনি কীভাবে নিক্ষেপ করবেন অকূল দরিয়ায়?

যেহেতু মা, তাই তাঁর মনেও যে ভয়ের উদ্রেক হবে, সন্তানের জন্য গভীর মমতা থেকে হাহাকার করে উঠবে হৃদয়— তা তো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা জানেন। মানবপ্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁর চাইতে ভালো আর কে জানবেন! মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের হৃদয়ের অবস্থাটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা সাথে সাথে আশার বাণীও শোনালেন। তিনি বললেন:

'যখন তার ব্যাপারে আশঙ্কা করবে, তখন তাকে নিক্ষেপ করবে দরিয়ায়। আর, ভয় করো না এবং চিন্তিতও হয়ো না। নিশ্চয় আমি তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেবো এবং তাকে রাসুলদের অন্তর্ভুক্ত করে নেবো।'- [১]

সমুদ্র সেই থেকে মুসা আলাইহিস সালামের জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলো।

মুসা আলাইহিস সালামের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে নান্দনিক যে পরিণতি, সেখানেও সমুদ্রের উপস্থিতি। আমরা জানি— নবি মুসা আলাইহিস সালাম এবং তাঁর সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা সমুদ্রে তৈরি করে দিয়েছিলেন পথ এবং ওই একই সমুদ্রে তলিয়ে মেরেছিলেন যালিম ফেরাউনকে।

জীবনের চরমতম এই মুহূর্তে মুসা আলাইহিস সালামের অবস্থান আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে রাখে।

সামনে অকূল দরিয়া আর পশ্চাতে ফেরাউনের বিশাল বহরের শক্তিশালী বাহিনী! এ যেন জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘের গল্পটার মতোই— দুই জায়গাতেই নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি! অবস্থা বেগতিক দেখে ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলো বনি ইসরাঈল সম্প্রদায়। তারা বললো, 'আমরা বুঝি ধরা পড়েই গেলাম'। [২]

বনু ইসরাঈল সম্প্রদায়ের সকলের মতো মুসা আলাইহিস সালামও দেখছিলেন যে— সম্মুখে যতোদূর চোখ যায় কেবল পানি আর পানি! আর পশ্চাতে একেবারে কাছাকাছি উপস্থিত চিরশত্রু ফেরাউন! তিনি না সম্মুখে যেতে পারবেন, না পারবেন পেছনে যাত্রা করতে। দৃশ্যত অন্য সকলের মতো তার সামনেও যাওয়ার আর কোন রাস্তা খোলা নেই।

কিন্তু অন্য সবার মতো তিনি ঘাবড়ালেন না একটুও। যদিও খালি চোখে সম্মুখে উপনীত বিপদ এড়াবার কোন পথ তিনি দেখছেন না, তবুও একেবারে নির্ভার আর নির্ভয় থেকে তিনি অন্যদেরকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে— 'কখনোই নয়। আমার রব আমার সাথে আছেন। তিনি শীঘ্রই আমাকে পথ দেখাবেন'। [৩]

সম্মুখে অকূল পাথার আর পশ্চাতে ঘাঁড়ের ওপর পড়তে যাচ্ছে শত্রুর নিশ্বাঃস। এর মধ্যে পথ কোথায় পাওয়া যাবে?

পথ কোথায় পাওয়া যাবে তা মুসা আলাইহিস সালাম নিজেও জানেন না। তবে তিনি এটুকু জানেন— আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা তাঁকে পথ অবশ্যই দেখাবেন।

এরপর যা ঘটলো তা তো রূপকথাকেও হার মানিয়ে দেয়! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা সমুদ্রে মুসা আলাইহিস সালামের জন্য তৈরি করে দিলেন পথ। আর, পশ্চাতে যে শত্রু পিঁছু নিয়েছিলো, তাকে ডুবিয়ে মারলেন ওই সমুদ্রের জলেই।

ওইদিন মুসা আলাইহিস সালাম কল্পনাও করতে পারেন নি যে— তাঁর জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা সমুদ্রের মধ্যে পথ তৈরি করে দেবেন। তিনি শুধু এটুকু জানতেন— আল্লাহ তাঁর সাথে আছেন। আর যার সাথে আল্লাহ থাকেন, তিনি পথের কথা ভাবেন না, ভাবেন পথের মালিকের কথা। মুসা আলাইহিস সালামও পথের মালিকের স্মরণে বিভোর ছিলেন সেদিন।

সমুদ্রের কাছাকাছি এলে দ্বিতীয় যে পয়গম্বরের কথা মানসপটে ভেসে উঠে তিনি হলেন নবি ইউনুস আলাইহিস সালাম। জীবনে এক সুকঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো তাঁকে। উত্থাল সমুদ্র একদিন তাঁকে নিক্ষেপ করেছিলো ফেনিল জলরাশিতে আর নবি ইউনুস আলাইহিস সালামকে গলাধঃকরণ করে নেয় এক বিশালকায় মাছ।

গভীর সমুদ্রের তলায়, একটা মাছের পেটে বন্দী হয়ে পড়াটাকে চিন্তার মধ্যে আনবার চেষ্টা করুন তো। কেমন সেই অবস্থা! ভাবতে গেলেও কেমন গা শিউরে উঠে, তাই না? কল্পনাও অতোদূর পৌঁছাতে পারে না আমাদের।

কিন্তু, সমুদ্রের সেই গভীরতম তলা থেকে, মাছের পেটের সেই নিশ্চিদ্র বন্দীত্ব থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা ইউনুস আলাইহিস সালামকে ঠিক ঠিক বাঁচিয়ে আনলেন।

যেখানে কোন রাস্তা থাকে না, সেখানে তিনি রাস্তা তৈরি করে দেন। যেখানে থাকে না বাঁচার কোন আশা, সেখানেও তিনি ফুরোতে দেন না প্রাণের ফুয়ারা। যেখানে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার, সেখানেও তিনি জ্বালিয়ে দেন একমুঠো আলো...

তবে, দুনিয়ার সকল অসম্ভবকে তিনি কাদের জন্য সম্ভব করেন?

কুরআন বলছে— 'আর যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তৈরি করে দেন (বিপদ হতে) উত্তোরণের পথ'। [৪]

সমুদ্র আমাকে খুব করে টানে। সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালে আমার মনে পড়ে যায় মুসা আলাইহিস সালাম আর ইউনুস আলাইহিস সালামের কথা। আমার অন্তরাত্মার ভেতরে প্রশ্ন জাগে— আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালাকে তাঁরা যেভাবে ভয় করেছিলেন, যার কারণে সমুদ্রের বিপদ হতে তিনি তাদের উদ্ধার করেছিলেন অকল্পনীয় উপায়ে, সেরকম ভয় কি আল্লাহকে আমি করতে পারছি? জীবনে তো বিপদের অন্ত থাকে না, কিন্তু যদি আল্লাহকে যথাযথ ভয় না-ই করতে পারি, কীভাবে আশা করতে পারি যে— আমার জন্যেও তিনি বের করে দেবেন উত্তোরণের পথ?

রেফারেন্স:

১. আল কাসাস, আয়াত-০৭
২. আশ-শুয়ারা, আয়াত-৬১
৩. আশ-শুয়ারা, আয়াত-৬২
৪. আত-তালাক্ব, আয়াত-০২




Writer:- Arif Azad


NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner