Leave a message
> এও কি সম্ভব
-->

এও কি সম্ভব

পাশের ফ্ল্যাট থেকে মারাত্মক চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। বোঝাই যাচ্ছে এরা আজকে আবার ঝগড়া শুরু করেছে। এখন চলবে অন্তত দুই ঘন্টা!! 
"ধুর" বলে বিছানা থেকে উঠে বসলাম। শুক্রবারের একটা দিন। গলা পর্যন্ত খেয়ে মাত্র জম্পেশ একটা ঘুম দিবো বলে শুয়েছি অমনি শুরু হয়ে গেল যন্ত্রনা। আজ আর কোন ঘুম টুম হবেনা মনে হচ্ছে।

পাশের ফ্ল্যাটের নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে মাস দুয়েক হল। দুইদিন পরপর গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করে দুইজন। ঘন্টা দুয়েক ফুল ভলিউমে চলবে তারপর আবার সব ঠান্ডা। কি আজব প্রানী এরা!!

আমার বউটা এদিক দিয়ে বেশ শান্ত স্বভাবের। চুপচাপ কাজ করে, অবসরে গান শোনে নয়তো বই পড়ে। ঝগড়া টগড়ার মধ্যে একেবারেই নাই। আহা। 

-"তোমার মা আমাকে এত বড় কথা বলল আর তুমি কাপুরুষের মত দাঁড়িয়ে থাকলে! আমি কি বস্তির মেয়ে?" পাশের ফ্ল্যাটের ভাবীর চিৎকার ভেসে এলো।

উফফ! এত জোড়ে কেউ কথা বলে!! আমি এই বাসা থেকে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।

-"আমার মা কে আমি কি বলতাম বল? ঝগড়া করতাম? আমার মা আমাকে কত কষ্ট করে মানুষ করেছে জানো??"
-"ওহ তোমার মা একাই কষ্ট করেছে? আমার মা আমাকে ফ্রিতে বড় করেছে তাইনা!"

নাহ, আর নেওয়া যাচ্ছেনা। আমি উঠে স্টাডি রুমে গেলাম। নীলা আমার স্ত্রী বারান্দায় বসে বই পড়ছে আর দোল খাচ্ছে। হালকা সাউন্ডে রবীন্দ্র সংগীত বাজছে পাশে। আহ! দেখেই শান্তি লাগছে। মেয়েটা এত লক্ষ্মী। গত বছর আম্মার করোনা হল। মেয়েটা একা হাতে আম্মার সমস্ত দেখাশোনা করেছে। আম্মা নিজে উঠে দাঁড়াতে পারতোনা। তার প্রস্রাব পায়খানা সে পরিস্কার করেছে। ডায়পার বদলে দিয়েছে। ইমারজেন্সি সিচুয়েশনে কখনো কারো জন্য বসে না থেকে নিজে থেকেই সব ব্যবস্থা নিয়েছে। অথচ কোনদিন তার কোন অভিযোগ নেই। 

প্রেমে গদগদ হয়ে তার কাছে গিয়ে বললাম "দেখসো ব্যাপারটা!! কি বিশ্রি ভাবে ঝগড়া করছে! এটা কোন ভদ্রলোকের কাজ বল??

নীলা বই থেকে মুখ না তুলেই বলল " অভদ্রতার কি পেলে? অভিযোগ বিরক্তি যা আছে তা প্রকাশ করছে মাত্র"

-"আজকালকার মেয়েরা সবকিছুতেই অভিযোগ করে। একটু মানিয়ে চলার ধৈর্য নাই। শ্বশুড় শ্বাশুড়িকে তো মা বাবা ভাবতেই পারেনা,শত্রু মনে করে"
-"হুম"
-"কি হুম!! তোমার আমার কখনো এমন হয়েছে বল? আমার মা আর তোমাকে তো বউ শ্বাশুড়ি কম মা মেয়ে বেশি মনে হয়। মা কে তুমি কত ভালবাস, কত খেয়াল রাখ মায়ের। 

নীলা এবার বই থেকে মুখ তুলে বলল
-"তোমার সত্যিই মনে হয় আমি তোমার মা কে ভালবাসি??"

বুকে সজোরে ধাক্কার মত খেলাম। কি বলছে নীলা!! মজা করছে নাকি? চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ একেবারে স্থির, নিস্তরঙ্গ। সেখানে কোন আবেগ নেই, ভাষা নেই। শুধু একটা প্রশ্ন। 

আমতা আমতা করে বললাম "কি বলছ তুমি!"

নীলা হাতের বই টা বন্ধ করে পাশে নামিয়ে রাখল। বারান্দার গ্রীল বেয়ে উপরের দিকে উঠে যাওয়া মানিপ্লান্টের কাছে দাঁড়িয়ে বলল

-" মনে পড়ে সৌমিক, আমার বাবা যেদিন মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে একবার আমাকে দেখতে চাইছিলেন সেদিন তোমার মা সাফ জানিয়ে দিলেন
- "আজ কোথাও যাওয়া হবেনা। বাড়িতে জামাই রা আসবে, আত্মীয় কুটুম আসবে বউকে থাকতে হবে। যেখানে যাবার পরশু দিন যাবে"

আমি তোমার দিকে তাকিয়েছিলাম অসহায়ভাবে। কিন্তু সেদিন তুমি কিছুই বলনি। আমার বাবা সেই রাতে মারা গেলেন আমাকে না দেখেই। সেদিন তোমরা আমার হৃদয়ে কত বড় আঘাত দিয়েছো কখনো ভেবে দেখেছ? দেখোনি। অথচ আমি ছাড়াও আরো তিনজন বউ বাড়িতে ছিল সেসময়, আমি না থাকলে বাড়ির জামাইদের আপ্যায়নে কোন সমস্যাই হতোনা। 

তারপর আমার সদ্য বিধবা মায়ের সাথে তুমি আমাকে একটা রাতও থাকতে দাওনি। কারন তোমার মা এর প্রেশার বেড়েছে!! একবারো তোমার মনে হয়নি তোমার মা তোমার কাছে যতোটা গুরুত্বপূর্ন আমার মাও আমার কাছে ততোটাই গুরুত্বপূর্ন!!

বাবার কুলখানিতে এসে তোমরা কি করেছিলে মনে আছে সৌমিক!?! তোমাদের জন্য কেন আলাদা করে গরুর মাংস ভুনা পোলাও করা হয়নি তা নিয়ে সে কি তুলকালাম কান্ড!! তোমার বাবা অতো মানুষের সামনে আমাদের ছোটলোক, ফকির বলে অপমান করেছিলেন। সেদিনও তুমি চুপ ছিলে। উলটে আমায় বলেছিলে "তোমাদের কাছে টাকা নেই আমাকে বলতে পারতা, আমি মাংস কিনতাম।" ঠিক সেদিন থেকে তোমার উপর আমার সব অভিযোগের ইতি টেনেছি। 

"এগুলো তো অনেক পুরোনো বিষয়। এখনো মনে কেন রেখেছ? আসলে তখন আমিও বুঝিনি মা বাবা এমন কেন করছে। আমি কিছু বলতেও পারিনি"- অপরাধীর সুরে কথাগুলো বললাম। 

নীলা আবার বলতে শুরু করল " প্রথমবার যখন বুঝলাম আমি মা হতে চলেছি সেদিনও তোমার প্রতি গাঢ় ভালবাসা অনুভব করেছিলাম। ভেবেছিলাম পুরনো সবকিছু ভুলে যাব। কিন্তু তোমার মা এসে বলে গেলেন
 " বাচ্চা পেটে আসছে ভাল কথা কিন্তু আমার ছেলে কোন টাকা দিতে পারবেনা। সব খরচ তোমাকেই দিতে হবে বৌমা"। 

তুমি জানতে আমার প্রেগ্নেন্সি কত কমপ্লিকেটেড ছিল তবু তুমি আমার পাশে এতটুকুও ছিলেনা। মায়ের কথা শুনে একবার আমায় মারতেও এসেছিলে। কারন আমি বলেছিলাম সাত মাসের পেট নিয়ে লম্বা জার্নি করে তোমাদের গ্রামে যাওয়া সম্ভব না আমার। তোমার মা এর কথা শুনে আমাকে চেক আপে যেতে দিতেনা। আমি জোর করেই যেতাম। ঠিক সেই সময় থেকে তোমাকে তোমার মা কে আমি সম্মান করিনা, ভালবাসিনা সৌমিক। 

-"তুমি পাগল হয়ে গেছো নীলা। কি সব যা তা বলছ!?! আমি কি তোমায় ভালবাসিনা? আমাদের সন্তানকে কি ভালবাসিনা? আমার সাথে তোমার এতই সমস্যা তাহলে আছ কেন আমার সংসারে! চলে যাওনি কেন?"

-" তোমার সবচেয়ে বড়সুবিধা কি জানো? তুমি এই পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষ হয়ে জন্মেছ। আমার অনেকবার মনে হয়েছে তোমাদের ছেড়ে চলে যাই। তাহলে  আমি হয়তো বেঁচে যাব। কিন্তু এই সমাজ তো আমাকে বাঁচতে দিবেনা। সমাজ যদি এত নোংরা না হত, যদি মেয়েদের স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে দিত তবে নিশ্চিত থাকো এদেশের বেশিরভাগ সংসার ভেঙে যেত।

আর ভালোবাসা?? তুমি বল তুমি আমাকে ভালবাসো। তোমার অফিস কলিগ বন্ধু বান্ধবী সবাই জানে তুমি খুবই বউ পাগল। আচ্ছা বলতো শেষ কবে তুমি আমাকে বই কিনে দিয়েছো? 
কবে আমাকে বলেছো নীলা চলো আজ বৃষ্টিতে ভিজি?
কোনদিন আমার মা কে নিজের মা ভাবতে পেরেছো?
কোনদিন আমার মায়ের শরীর কেমন, একা একা বাড়িতে কিভাবে আছে জানতে চেয়েছ?
আমার শরীর কেমন জানতে চেয়েছ?
তুমি তো বলতেও পারবেনা এখন আমি কয়টা ওষুধ খাই, কি কি ওষুধ খাই। কোন ডাক্তার দেখাই। তুমি আমার সম্পর্কে কিছুই জানোনা সৌমিক। আরো অনেক ঘটনা আছে, আরো অনেক অপমান আমি সহ্য করেছি সেসব বলে শেষ করা যাবেনা। আর বলেই বা কি লাভ!!

-"ধুর তুমিও দেখি পাশের ফ্ল্যাটের মত শুরু করে দিলে"

নীলা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল -" ওরা অনেক সুখী জানোতো। তারা ঝগড়া করে অভিযোগ করতে পারে। অধিকার  থাকলেই অভিযোগ করা যায়। 

কথাটা যেন তীরের মত বিঁধল আমার বুকে। নীলা কোন অভিযোগ করেনা। তবে কি.....!!! 

নীলা আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আমার দিকে পিঠ দিয়ে। চাইলেই তাকে ছুঁতে পারি। কিন্তু পারছিনা। কি যেন একটা বিশাল দেয়াল আমাদের মাঝে। যে দেয়ালের প্রতিটা ইট আমি নিজের হাতে গেঁথেছি একটু একটু করে নিজের অজান্তে। এ দেয়াল আমি ভাঙবো কি করে!?!






সমাপ্ত






Writer:- অর্চি আজাদ
 

Delivered by FeedBurner

a