"ভাই আমার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। আমাদের একটু নিরাপদ স্থানে নিয়ে চলেন।"
"পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হইবো।"
"এত টাকা তো আমার কাছে এখন নাই।"
"তাহলে যামু না।"
"ভাই চলেন না ভাই প্লিজ।"
"না না এর কমে আমি যামু না।"
"আচ্ছা চল্লিশ হাজার টাকা দিবো। তবুও নিয়ে চলেন।"
"পঞ্চাশ হাজার টাকার এক টাকা কম দিলেও হইবো না।"
অসহায় চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে এক নিরুপায় স্বামী। অন্যদিকে টাকার লোভে নিজের নৌকা স্থির করে রেখেছে মাঝি।
না, শুধু এটুকুতেই শেষ নয়। বন্যা কবলিত সিলেটে যেখানে মানুষ বাঁচার জন্য হাহাকার করছে সেখানে ৫ টাকার মোমবাতি ১০০ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। নৌকার ভাড়া ২০ হাজারের নিচে নয়।
একদিকে কারোর একটু একটু করে জমানো লাখ টাকায় কেনা স্বপ্নের কম্পিউটার পানির স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। অন্যদিকে কারোর সদ্যজাত সন্তান পানির স্রোতের সাথে হারিয়ে যাচ্ছে বহুদূরে। কারোর প্রিয় বিড়ালছানা হারিয়ে গিয়েছে। তো কারোর গোয়ালঘরে থাকা গরুগুলো মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। সামনে এসএসসি, অথচ বই, খাতা সব পানিতে ভিজে গিয়েছে। ছোট্ট বাচ্চাটা খাবারের জন্য কাঁদছে। কিন্তু মায়ের কাছে তো কানাকড়ি ও নেই। ভাইয়ের ভীষণ জ্বর। কিন্তু ওষুধ খাওয়ানোর মতো পয়সা বোনের কাছে নেই।
হ্যা, সিলেটের এই করুণ দশায় সবাই বসে বসে আফসোস করছে ঠিকই। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেদের প্রিয় সিরিয়াল কিংবা মুভি দেখতে বসে যাচ্ছে টিভির সামনে। ভারত আমাদের দেশের সাথে যা করে করুক, আমরা আমাদের সিরিয়াল দেখা ছাড়বো না। কী? ঠিক বললাম তো?
আমাদের দেশের মানুষগুলো বড্ড স্বার্থপর। নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারে। কিন্তু অন্যের কষ্টে লোক দেখানো সমবেদনা ছাড়া সাহায্য খুব মানুষই করে। আমি অবাক হচ্ছি এটা ভেবে, একজন গর্ভবতী স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য স্বামীর আকুলতা ভরা কন্ঠস্বর সেই মাঝির কানে যায়নি বলে। আমি অবাক হতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ যেখানে পুরো সিলেট শহর অন্ধকারে ডুবে গিয়েছে, সেখানে ৫ টাকার কৃত্রিম আলোর দাম ধরা হচ্ছে ১০০ টাকা। আমাকে অবাক করছে এই সমাজের মানুষগুলো। বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি, টাকাপয়সা, বইখাতা, গবাদিপশু, ছোট্ট শিশু হারিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মনুষ্যত্ববোধ ও আজ অনেকেরই হারিয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির ফোঁটার ছোঁয়ায় শুধু রাস্তায় পড়ে থাকা আবর্জনাগুলো মুছে না গিয়ে যদি মানুষের কলুষিত মন থেকে দূষিত চিন্তাভাবনা মুছে যেত তাহলে হয়তো আজকের এই ঘটনাগুলো আমাদের দেখতে হতো না।
একজন বাংলাদেশী হিসেবে আমি সেদিনই গর্ববোধ করবো যেদিন এই দেশ থেকে চলে যেতে পারবো! কারণ এই দেশে থেকে সাঁতার শেখার জন্য কোটি টাকা বরাদ্দ, আর অসহায় মানুষদের জন্য জনপ্রতি ৩ টাকা পাওয়ার খবর শুনে গর্ববোধ করার মতো কোনোকিছু অন্তত আমি খুঁজে পাচ্ছি না। বরং এসব দেখে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে আমার। অবশ্য মাথাপিছু প্রত্যেকে এই তিন টাকাও পাবে কিনা সেই বিষয়ে আমি সন্দিহান। কারণ এটা তো আমাদের বাংলাদেশ!
এখন তো কিছু বলার ভাষা পর্যন্ত হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু প্রার্থনা করি, সিলেটবাসীর জীবনে খুব তাড়াতাড়ি সুদিন ফিরে আসুক। আল্লাহ খুব দ্রুত এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার তৌফিক দিন সবাইকে, আমিন।
সমাপ্ত
Writer:- নামিরা নূর নিদ্রা