"তারগুত আল্প" উসমানী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম মহানায়ক। তিনি অনেক দীর্ঘ হায়াত লাভ করেন এবং সুলেমান শাহ্ থেকে শুরু করে ওরহান গাজী পর্যন্ত সুলেমান শাহের ৪ পুরুষের পাশে থেকেই উসমানী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আজ গল্প হবে ইতিহাসের এই কিংবদন্তি সৈনিক তারগুত আল্প কে নিয়ে।
যার হাত ধরে অটোমান সাম্রাজ্যের সূত্রপাত ঘটে সেই আর্তুগুলের অন্যতম প্রধান সৈনিক ছিলেন তারগুত আল্প। ধারণা করা হচ্ছে তারগুত আল্প ১২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সুঠাম দেহী এবং সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। তিনি কুঠার চালনায় খুবই পারদর্শী ছিলেন। তাই তুর্কী জাদুঘরে তার ব্যবহৃত কুঠারটি এখনো সংরক্ষিত রয়েছে। তিনি ছিলেন আর্তুগুল গাজীর একনিষ্ঠ সমর্থক, বিশ্বস্ত এবং খুবই কাছের বন্ধু। তিনি আর্তুগুল গাজীর যে কোনো সিদ্ধান্ত নির্দ্ধিধায় মেনে নিতেন এবং সমর্থন করতেন। আর্তুগুল গাজীর মৃত্যুর পর তিনি আর্তুগুল গাজীর ছেলে উসমানী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমান গাজীকে সমর্থন করেন এবং সাম্রাজ্য গঠনে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করেন। তারগুত আল্প উসমানী সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সেরা এবং সর্বাধিক নামী যোদ্ধা ছিলেন। ওসমান গাজীর মৃত্যুর পর,উসমানের ছেলে ওরহান গাজীকেও তারগুত আল্প পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা এবং সমর্থন করেন। উসমানী সাম্রাজ্যের গাজীর তালিকায়ও তারগুত আল্পের নাম ছিল অন্যতম। ইতিহাস থেকে জানা যায় ইলিয়াস বে নামে তুরগুত আল্পের একমাত্র পুত্র ছিল। ইলিয়াস বে এর মৃত্যুর পরে কনক মহললেসীর মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছিল তারগুত আল্পের ছেলের নামে। সুলেমান শাহ,আর্তুগুল গাজী, ওসমান গাজী এবং ওরহান গাজী এই ৪ পুরুষের সাথে উসমানী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিযুক্ত ছিলেন এই বীর সেনা।
যদিও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব অল্প তথ্য জানা যায়, তবে তিনি যে কেবল ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বই হিসেবে-ই খুব সুপরিচিত তা নয়, তিনি কিংবদন্তি ব্যক্তিও ছিলেন যার নাম লোকমুখে শোনা যেত।
যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদের সাথে তাঁর সাহসী যুদ্ধের কথা এবং তার কর্মকান্ড শুধু উসমানী সাম্রাজ্যের ইতিহাসে-ই লিপিবদ্ধ হয়নি বরং কিছু বাইজান্টাইন এর ইতিহাস গুলিতেও লিপিবদ্ধ রয়েছে।
তিনি দীর্ঘ দিন বেচে ছিলেন। আরতগ্রুল গাজির সাথে তিনি 35 বছর একনিষ্ঠ ভাবে তার সেবা, বিশ্বস্ত যোদ্ধা এবং খুবই কাছের বন্ধু ছিলেন। আরতগ্রুল গাজী মারা যাওয়ার পরে, তারগুত আল্প উসমান গাজি কে সমর্থন করেন। উসমানের ঘনিষ্ঠ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন, উসমানের মৃত্যুর (67 বছর বয়সী) বুরসার অবরোধের সময় পর্যন্ত।
উসমানী সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সূত্রের বিবরণ অনুসারে, কারাকাহিসার দুর্গের দ্বিতীয় বিজয় (1291.) এর সময় তারগুত আল্প উসমান গাজির পাশে ছিল এবং পরে তিনি উসমান গাজির সমস্ত বিজয়ে অংশ নিয়েছিলেন।
উসমান গাজি তারগুত আল্পকে ইনিগেল (প্রাচীন নাম: অ্যাঞ্জেলাকোমা) কে 1299 সালে বিজয়ের জন্য আদেশ করেছিলেন এবং বিজয়ের পরে পুরুষ্কার সরূপ শহরসহ এর আশেপাশের অঞ্চলগুলির গর্ভরনর এর দায়িত্ব তারগুত আল্পকে দেওয়া হয়েছিল। তিনি সেখানে 36 বছর শাসন করেছিলেন এবং সেই সেখানকার লোকেরা শান্তিতে ও সমৃদ্ধিতে বসবাস করেছিল।
উসমানের মৃত্যুর পরেও, যদিও তিনি জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে ছিলেন , তারগুত আল্প সুলতান ওরহান গাজিকেও তার পিতার ন্যায় একই রকম সমর্থন অব্যাহত রেখেছিলেন। ওরহান গাজির সবচেয়ে বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা হিসাবে হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তাঁর জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত।
ব্যাটল অফ ব্যাফিউসঃ
তুমি যদি তিরের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ আনতে চাও, তোমাকে আগে নিজের নফসের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।
ধনুক ধরার সময় নিজের হৃদপিণ্ডের স্পন্দন কে অনুভব করবে। যদি বুকের ভেতরে ধকধক আওয়াজে শোনে, বুঝবে আল্লাহর সাহায্যের জন্য তুমি এখনও তৈরি নও। নিজেকে প্রশান্ত করো, প্রশ্বাসের আরও গভীরে চলে যাও। তারপর আবার নিজের হৃৎস্পন্দনকে অনুভব করতে চেষ্টা করো।
দেখবে তুমি আর ধকধক আওয়াজ শুনছে না। তেমার রবের নাম তোমার হৃদপিণ্ড জিকির করছে।
প্রশ্বাসের সঙ্গে তখন তোমার পুরো শরীরের প্রতিটা পেশি সজাগ হবে। ধনুকের ছিলা এবার টানটান করো। দুচোখকে নিশানায় স্থির করো, তারপর চোখ বুজে আবার অনুভব করো তোমার সত্তার জিকির। এবার চোখ খুলে দেখো, তোমার নিশানা নিজেই তোমার সামনে হাজির হয়ে গেছে।
তোমার রবের নাম উচ্চারণ করো ইয়া হক!
নিশ্বাস ছেড়ে দাও। সাথে ছেড়ে দাও তির।
তির নিশানায় পৌঁছে দেওয়া তোমার রবের কাজ।
তুমি যখন সঠিকভাবে তোমার রবের নামে তির নিক্ষেপ করতে পারবে, তখন তুমি না তোমার রবই তির নিক্ষেপ করবেন। আর আল্লাহর তির কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।
সাকারজা নদীর তীরে ব্যাফিউস মালভূমির ওপরে ক্রমেই ঢালু হয়ে যাওয়া চাড়াইয়ের ঘন ঝোপে লুকিয়ে থাকা পাঁচশো গাজির নেতৃত্বে থাকা তাুগুত আল্প তার শায়েখের কথা ভাবছেন।
বাইজান্টাইন সম্রাটের পাঠানো দু হাজার যোদ্ধা ব্যাফিউস মালভূমিতে ঘাটি গেড়েছেন। তাদের লক্ষ্য, নিকোমিডিয়ার (ইজমিত) আশপাশ থেকে উসমান গাজির যোদ্ধাদের তাড়িয়ে দেওয়া।
এর আগে স্বয়ং কাইজার মাইকেল এসেছিলেন আনাতলিয়া অভিযানে। প্রায় দশ হাজার যোদ্ধা নিয়ে এসে বহুদূর পর্যন্ত তিনি তাড়া করেছেন উসমান গাজিকে।
২৭ জুলাই, ১৩০২ সাল, গভীর রাত।
মুজোলানের বাহিনী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
তারগুত যেদিকটার লুকিয়ে আছেন, তার বিপরীত দিক থেকে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে বাইজান্টাইন ক্যাম্পের ওপর নেমে এসেছে পাঁচশো গাজির আরেকটি বাহিনী।
এই দলের কাজ আচমকা হামলা করে ঘুমন্ত বাইজান্টাইনদের মধ্যে ভয় ধরিয়ে দিয়ে তাদের তারগুতের বাহিনীর দিকে পালাতে বাধ্য করা। তাদের আলোর সংকেত পেলেই তারগুত তির নিক্ষেপ করতে শুরু করবেন। এদিকে পালানোর জন্য যারাই আসবে, তারাই হবে শিকার। এদিক থেকে রাতের আধারে তিরবৃষ্টি শুরু হলে নদী তীরের বিপরীত দিকে ছুটবে ভীত বাইজান্টাইন বাহিনী। সেখানে তাদের জন্য প্রায় চার হাজার যোদ্ধা নিয়ে অপেক্ষা করেছেন স্বয়ং উসমান গাজি।
কিছুক্ষণের মধ্যে ক্যাম্পে হইচই শুরু হলো। হামলা শুরু হয়ে গেছে।
গ্রিকদের মতো পোশাক পরা ছায়ামূর্তিগুলো ছুটতে শুরু করেছে ক্যাম্প থেকে। নিজের ধনুকটা তুলে নিলেন তারগুত আল্প, তারপর একটা শিস দিয়ে উঠলেন। তার বাকি যোদ্ধারাও তৈরি হলো ধনুক বাগিয়ে।
তাদের হাতে যে ধনুক আছে, এটা ওঘুজদের ঐতিহ্যবাহী ধনুক। পৃথিবীতে আর কোন ধনুক এর মতো বিশাল পাল্লা নেই। ছয়শো মিটার দূর পর্যন্ত এটা দেখা এমনিতেই তির ছোড়া যায়। দক্ষ্য তিরন্দাজরা এমনকি আটশো মিটার দূরেও তির ছুড়তে পারে।
নিশান ভেদ করতেও এই ধনুকের কোন জুড়িই নেই। তিনশে মিটার দূরে থাকা ব্রেজ্ঞের বর্ম ফুঁড়ে বিঁধে যায় এই তির।
ধনুকে তির পরিয়ে অপেক্ষা করছিলেন তারগুত বে। চাঁদের আলোয় বোঝা যাচ্ছে, ছায়ামূর্তি গুলো বেশ কাছে এসে পড়েছে।
ওপার থেকে আলোর সংকেত জ্বলে ওঠল।
লম্বা একটা দম নিয়ে নিশানা স্থির করলেন তিনি, তার সারা শরীর টানটান হয়ে ওঠল।
তারগুত বে উচ্চারণ করলেন, ‘ইয়া হক!!’
বাইজান্টাইন সৈন্যরা দিশেহারা হয়ে দিগবিদিক ছুটতে শুরু করেছে। গাজিদের প্রথম আঘাতটা এসেছে উওর থেকে, তারা তখন গভীর ঘুমে। ঘুমন্ত শত্রুকে আঘাত হানা কাপুরষতা, তাই ঘুম থেকে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য আক্রমণের ঠিক আগে এলবার বিকট শব্দে হুংকার দিয়ে ওঠেছিল, ‘হাইদির আল্লাহ!’
কিছু বুঝে উঠার আগেই বাইজান্টাইনরা দেখল, তাদের ক্যাম্প শত্রুর দখলে চলে গেছে। প্রান নিয়ে তারা পালাল দক্ষিণ। সেখানে শিকারের আশায় অপেক্ষা করছিলেন তারগুত আল্প। ধনুকের পাল্লা ভেতরে শত্রুরা আসতেই তিরবৃষ্টি শুরু করলেন তারগুত আল্প।
উভয় সংকটে পড়া বাইজান্টাইন সেনারা এবার ছুটল পশ্চিমে, আর সেদিকেই লুকিয়ে আছে উসমান গাজির মূল বাহিনী।
প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে বাহিনী নিয়ে পশ্চিমে এগোচ্ছিলেন মুজেলান। তাদের পুরোপুরি হতভম্ব করে দিয়ে হঠাৎ উসমান গাজি হাক দিয়ে ওঠলেন, ‘ইয়া আল্লাহ, বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর!!’ শুরু হলো মুসলিম বাহিনীর আক্রমণ।
এই যুদ্ধ ব্যাটল অফ ব্যাফিউস নামে পরিচিত। যুদ্ধটা ছোট ছিল, কিন্তু এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
এশিয়া থেকে বাইজান্টাইনদের চিরতরে পাততাড়ি গোটানো এর মাধ্যমেই শুরু হয়।
এই লড়াইয়ে জেতার পর তারগুত আল্প এর নাম ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।
দলে দলে গাজিরা ভিড়তে থাকে উসমান গাজির কাছে। উসমান গাজির পতাকা হয়ে উঠে আনাতলিয়ার গাজিদের বীরত্বের প্রতিক।
তারগুত আল্প 125 বছর বয়সে আত্রানোস ক্যাসেল (ওরহানেলি দুর্গ) বিজয়ের সময় শহীদ হন। তারগুত আল্প এরতুগ্রুল গাজী, ওসমান গাজী এবং ওরহান গাজীর সময়কালে সৈন্যদের সেনাপতি ছিলেন।
তারগুত আল্প মৃত্যুর পরে, তারগুত আল্পকে জেনকো নামের একটি পরিচিত গ্রামে ইনিগলের কাছের একটি পাহাড়ে পরম শ্রদ্ধার সাথে দাফন করা হয়েছে। উসমানী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠায় এই বীর যোদ্ধার অবদান উসমানী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। আল্লাহ এই বীর যোদ্ধাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুক।
1877 সালে, [রুশো-তুর্কি যুদ্ধের সময় 1877-1878], বুলগেরিয়া থেকে আগত মুসলিমদের দ্বারা উসমানী সাম্রাজ্যের একটি নতুন শহর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং দ্বিতীয় সুলতান আবদুল হামিদের পরামর্শে এই শহরটির নামকরণ করা হয়েছিল "তুরগুটাল" সাহসী যোদ্ধা তারগুত আল্পের সম্মানে। এটি তুরস্কের মনিসা প্রদেশের সোমা জেলায় অবস্থিত। এই শহরের প্রধান অর্থনৈতিক ক্ষেত্র হলো কৃষি।
তারগুত আল্পের কুঠারঃ
তুরগুট আল্প যোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসাবে বিবেচিত হত এবং তার অস্ত্র, তার কুঠারটি বেশ কিংবদন্তি ছিল। তাঁর কুঠার এবং পোশাকটি যাদুঘরে এখনও সংরক্ষণ করা আছে।
তারগুত আল্পের কুঠারের বর্ননাঃ এটি 92 সেমি দীর্ঘ ছিল, এটির ওজন 1,650g (1 কেজি 650 গ্রাম); এটি নকল বার্সা ইস্পাত দিয়ে তৈরি, কুঠারটির হাতল চামড়া বেল্ট দিয়ে আবৃত;
তাঁর কুঠারটি খুব বিখ্যাত ছিল, যা তখন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হিসাবে পরিচিত ছিল।
Writer:- Md Saymun Husain