দরজা খুলতেই আরো বেশি অবাক হলাম, দেখলাম রিয়া একটা বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারতেছিনা এমন সময় আমি কি করবো? আমার কি করা উচিৎ?
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। রিয়াও কথা বলতে ইতস্তত বোধ করতেছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি?"
রিয়া তার কোল থেকে বাচ্চা মেয়েটাকে নামিয়ে দিয়ে বললো, "মা এখানে দাঁড়াও তো। আমি আসবো সেটা আশা করোনি তাইনা?"
চোখের সামনে সেই পাঁচ বছর আগের রিয়াকে ই যেনো দেখতে পাচ্ছি। মেয়েটার ভেতরটা যতটা নরম বাহির টা ততোটা নরম না। সেই আগের মতো তার কথা বলার ধরণ। রিয়ার মেয়েটার বয়স চার থেকে সাড়ে চার বছরের মতো হবে। হয়তো এখান থেকে গিয়েই বিয়ে করে ফেলেছিলো। মেয়েটা দেখতে একদম তার মায়ের মতো হয়েছে। আমি কিছু না বলে তার আশপাশ দেখতেছিলাম! সে কি একা আসছে নাকি স্বামী নিয়ে আসছে। দেখলাম তার পেছনে একটা সুটকেস ছাড়া আর কিছু নেই। কাউকে দেখতে না পেয়ে বললাম, "একা আসছো?"
-কেনো অন্য কেউ আসার কথা নাকি? আচ্ছা আমরা কি বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলবো নাকি ভেতরে যাবো?
আমি আমতা আমতা করতে করতে বললাম, "আসো!"
ঘরের ভেতর ঢুকে সে তো আগুন, "কি অবস্থা করে রেখেছো ঘরটার, একটু গুছিয়েও তো রাখা যায়।" এই বলতে বলতে সে আমার রুম গোছাচ্ছে। আমি সোফায় বসে রিয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম আর ভাবতেছি মেয়েটা কত সহজ-সরল, এমন একটা মেয়েকে আমি কতো কষ্ট দিয়েছি।
পাশ থেকে ওর বাচ্ছাটা আমার দিকে আঙ্গুল দিয়ে বার-বার বলতেছে, "মাম্মা, মাম্মা এতা কে? (মেয়েটার ভালো করে কথা ফোটেনি)
রিয়া চুপচাপ রুম গোছাতে থাকলো।
হঠাৎ খেয়াল করলাম তার হাতে আমাদের বিয়ের একটা ফটো, এটাই একমাত্র আমাদের বিয়ের স্মৃতি যেটা বিছানার পাশে ছিলো। রিয়ার চোখ দিয়ে নিরবে পানি বেরিয়ে যাচ্ছে। হয়তো বিয়ের কথা মনে পড়তেছে।
সাহস নিয়ে এক নিশ্বাসে বলে ফেললাম, "রিয়া তোমার স্বামী আসেনি? সে কেমন আছে? নিশ্চয় সে আমার মতো এত স্বার্থপর না তাইনা?
রিয়া চোখের পানি মুছতে মুছতে বলতেছে, " হ্যা সে-ও স্বার্থপর তাইতো তোমার সাথে পরকীয়া করতে চলে আসলাম। কি আমার সাথে পরকীয়া করবে?
রিয়া কি বললো সব কিছু আমার মাথার উপর দিয়ে গেলো, হয়তো আমার ধারণা ই ঠিক সে বিয়ে করেছে। কিন্তু আমার কাছে এটা পরিষ্কার যে আমাকে পরকীয়ার কথাটা ইগো দেখিয়ে বলছে। কারণ রিয়া এমন কোন মেয়ে না।
"মানে"
-সুখ জিনিসটা আমার কপালে নেই মনে করেছিলাম, আমি বিশ্বাস করতাম তোমাকে নিয়ে সুখী হতে না পারা টা আমার ভাগ্যে লিখা আছে, বিধাতা হয়তো আমার কপালে সুখ রাখেননি। তবুও আমি এই বিছানার এক পাশে সারা জীবন পার করে দিতে চেয়েছিলাম। এত কিছুর পরও আমি নিজে কান্না করে আমার দুঃখ গুলো ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছিলাম। যেদিন আমি রাগের বসে চলে যাবো বলছি আর তুমিও আমাকে আটকালেনা সেদিন মনে করেছিলাম আমার জীবনের শেষ দিন। কিন্তু আমার হায়াত ছিলো তাই বেঁচে গেছি। তোমার কি মনে আছে একদিন প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিলো? বিয়ের পর তুমি আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলে শুধু মাত্র সেদিন। হয়তো তুমি অবচেতন মনে ছিলে। যায় হউক। সেই রাতের ফসল হচ্ছে আমার মেয়েটা। যেদিন এখান থেকে চলে যাচ্ছিলাম সেদিন আমি আমাদের বাসায় যাইনি। গিয়েছিলাম সুইসাইড করতে। কিন্তু আমার মেয়েটা সুইসাইড করতে দেয়নি। আমার মনে হলো পেটের ভিতর থেকে সে বলতেছে, "মা আমি কোন অন্যায় করিনি আমাকে মেরো না!" এই সব ঘটনা আব্বা(শশুড়) জানতো। কিন্তু আমি বারন করেছিলাম তোমাকে কিছু বলতে, কারণ আমি চাইনি তুমি আমার প্রতি দয়া করো। আমি চেয়েছি তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমি চেয়েছি তোমার মাঝে অনুশোচনা বোধ সৃষ্টি হোক। আমার জীবনের কঠিন সময়ে তুমি স্বার্থপরের মতো আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলে। কিন্তু আমি পারিনি তোমার কঠিন সময়ে তোমাকে ছেড়ে থাকতে, কেনো জানো? অল্প দিনে বড্ড বেশী ভালোবেসে পেলেছিলাম। এই পাঁচ বছরে সব থেকে বেশী কষ্ট পাচ্ছিলাম তখন যখন মেয়েটা ওর পাপ্পা কোথায় জিজ্ঞেস করতো আর কথাটার আমি কোন জবাব দিতে পারতাম না। আমার ফোন যদি ওর হাতে থাকে যে কেউ কল দিলে ও পাপ্পা পাপ্পা বলে ডাকতে থাকে। একটা মেয়ের জীবনে সন্তানের কাছে তার পিতার পরিচয় দিতে না পারার মতো আর কোন কষ্ট নেই।
আমি নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারতেছিলাম না, মেয়েটা নিজের মধ্যে এতো কষ্ট লুকিয়ে রেখেছিলো?
রিয়া কথা গুলো বলে খাটের এক কোণায় বসে অবুঝ শিশুর মতো হু হু করে কান্না করতে করতে বলতেছে, "তুমি হয়তো ভাবতেছো তাহলে আজকে কেনো আসলাম, কারণ গতকাল তোমার ফোন পেয়ে বুঝেছিলাম তোমার মতো স্বার্থপর একটা মানুষ কখনো কোন কারণ ছাড়া ফোন দিবেনা। মা, বাবা দুজনের মৃত্যুর খবর আমি শুনেছি তারপরেও আমি তোমাকে দেখা দেইনি কারণ তোমার মধ্যে অনুশোচনা বোধ না আসলে কখনো ভালোবসার আসল অর্থটা তুমি বুঝতেনা।
মেয়েটাকে কোলে নিয়ে রিয়ার সামনে গিয়ে বললাম, "আমার মেয়েটার নাম কি রাখছো?"
সে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তার চোখের পানি টপ-টপ করে নিচে পড়তেছে। আমি পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম। কিন্তু সে এমন জেদ ধরে বসে আছে তাঁকে কোন ভাবেই ধরতে পারতেছিনা। খুব বেশী জোর করে তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, "হুম আজকে বেশী করে কেঁদে নাও এরপর কখনো এই চোখে পানি আসতে দিবো না। ভালো কিভাবে বাসতে হয় সেটা তুমি আমাকে শিখিয়েছো। এখন ভালোবাসার পরীক্ষাটা আমি দিবো।
সমাপ্ত...
Writer:- সাইফুল ইসলাম সাইম