পাঁচ বছর আগে আমার একটা পরকীয়া ঘটনা ধরে আমি আর রিয়া আলাদা হয়ে যাই। শেষবার যখন রিয়ার সাথে কথা হয়েছিলো তখন সে বলেছিলো, "তোমার এমন চরিত্র নিয়ে তুমি কখনো সুখী হতে পারবেনা, ভালো থেকো!"
রিয়া একটু শ্যামলা বর্ণের ছিলো। আমাদের বিয়েটা বাবা, মা পছন্দ করে করিয়েছিলো। মেয়েটা শ্যামলা বর্ণের হওয়ায় আমি অনেক না করেছিলাম তারপরেও আমাদের বিয়েটা হয়েছিলো। বিয়ের কিছুদিন পর আমি অন্য একটা মেয়ের সাথে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। সেটা নিয়ে পরিবারে অনেক অশান্তি। সে জন্য রিয়া গোপনে অনেক কান্না করতো। দুজনে দু পাশ হয়ে শুইলে তার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করার শব্দ আমার কানে আসে। কখনো জানতেও চাইনি তার কান্নার কারণ। এত কিছুর পরেও তার কোন অভিযোগ নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে রিয়া ঠিকই চা এনে দিবে। কতবার তার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে মেরেছি সেটার কোনো হিসাব নেই। বিয়ের পর কখনো আমার নিজের হাতে কাপড় নিতে হয়নি, আমি গোসল করতে ঢুকলেই সে কাপড় গুলো ওয়াশরুমের বাইরে সাজিয়ে রাখে। রিয়া আমাদের বাড়িতে আসার পর মা'কে কখনো রান্না ঘরে যেতে হয়নি। রিয়া যে এক বছর আমাদের বাসায় ছিলো তার মাঝে এক সপ্তাহও মনে হয় তার বাপের বাসায় যায়নি। পুরো বছরটা সে আমাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করে। একটা সময় সে মানসিক অত্যচার সহ্য করতে না পেরে আমার কাছ থেকে আলাদা হতে চায়। আমি সেদিন হাসতে-হাসতে, নাচতে-নাচতে তাঁকে আলাদা করে দিই।
আজ পাঁচ বছর পূর্ণ হলো রিয়া আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আসলে চলে গেছে বললে ভুল হবে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। রিয়া চলে যাওয়ার দু বছর পর বাবা মারা যায়। রিয়া চলে যাওয়ার পর থেকে বাবা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার সাথে একটা কথাও বলেনি। মারা যাওয়ার সময় আমি অফিসে ছিলাম এসে শুনলাম মারা যাওয়ার সময় বাবা তার একমাত্র ছেলেকে না খুঁজে ছেলের বউকে একবার দেখতে চেয়েছিলো। জীবনের প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছিলাম সেদিন।
আজ আমার মা মারা গেলো!! রিয়া যাওয়ার পর থেকে মা প্রয়োজনের বেশি আমার সাথে একটা কথাও বলতো না। "ভাত দিছি খেতে আয়।" এই কথাটা ছাড়া আর বেশি কিছু বলতো বলে আমার মনে পড়েনা। খুব বেশি কান্না পাচ্ছে যখন মায়ের আলমারিটা খুলে দেখলাম রিয়া যাওয়ার পর থেকে আমার দেওয়া একটা শাড়ীও মা পড়েনি। কখনো বলতো না আমার জন্য কিছু লাগবে বা লাগবেনা। তবুও আমি অনেক কিছুই এনে দিয়েছিলাম যেগুলো যেভাবে এনেছি সেভাবেই এখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আমার উপর এতটা অভিমান নিয়ে মা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। মা মারা যাওয়ার সময় শুধু একটা কথাই বলেছে, "বাবা, তুই ছিলি আমাদের একমাত্র সন্তান তোর ভালোবাসায় কমতি হবে ভেবে আমরা দুইটা সন্তান নেইনি তারপরেও আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রিয়াকে মেনে নিতে পারিস নি! তোর বাবা মারা যাওয়ার আগে প্রতি রাতে শুধু এই কথাটা বলেই কান্না করতো, মেয়েটা অনেক ভালো ছিল রে।"
আমার পরকীয়ার সম্পর্ক ছিলো দুই থেকে তিন মাসের মতো এই দুই তিন মাস আমার কাছ থেকে মা, বাবা,রিয়া এবং পাঁচ পাঁচটা বছর কেড়ে নিলো। আজ বুঝতেছি ভালো থাকার মানেটা কি। কতো সুখি হতাম যদি বাবা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার সাথে আগের মতো সব কথা বলতো! কতো সুখি হতাম মা যদি আগের মত আমার বন্ধুর মতো থাকতো!
কিন্তু বুঝতে পারতেছিনা আজ কেনো এসব ভাবতেছি সেই পাঁচ বছর আগে যদি ভাবতাম তাহলে আমার জীবনটা অনেক সুন্দর হতো। এখন পুরো একটা বাড়িতে আমি একা কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবো সে উপায় ও নেই। নিজে নিজে কান্না করতেছি, নিজে নিজে চিল্লাতে চিল্লাতে আকাশ বাতাস ভারি করে ফেলতেছি কিন্তু সব কিছুই যেনো আমার থেকে বিমুখ হয়ে গেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু বললেই আকাশ যেনো উল্টো আমাকে বলতেছে সব কিছুর জন্য তুই দায়ী। আজ নিজেকে খুব বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে। রিয়ার চলে যাওয়ার সময় কথাটা যেনো আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়ে গেলো।
আজ পাঁচ বছর পর রিয়ার নাম্বারে ফোন দিলাম। ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করে ওপাশ থেকে একটা বাচ্চা বললো, "পাপ্পা-পাপ্পা তুমি কখন আতবে?"
বাচ্চাটার কথা শোনে আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেলো! মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছেনা।
দূর থেকে কেউ একজন বললো, "কে ফোন করেছে মা?"
কণ্ঠ শোনে বুঝতে পারলাম এটা রিয়া, মেয়েটা কতো সুখি হয়ে গেলো, বিয়ে করে বাচ্চা হলো। এখন খুব জেলাস ফিল হচ্ছে তার স্বামীর কথা ভেবে!!
ইচ্ছে করতেছে দৌড়ে গিয়ে রিয়াকে আমার কাছে নিয়ে আসি, জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করি। রাত দিন কান ধরে ক্ষমা চাই। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নই। সে এখন আরেকজনের বউ। তাছাড়া আমার মত খারাপ একটা মানুষকে কেনো সে জড়িয়ে ধরবে!
ওপাশ থেকে রিয়া বলতেছে, "দাও মা ফোনটা দাও, দেখি কে ফোন করেছে।"
এরপর আর কোনো কথা শুনতে পেলাম না। হয়তো আমার নাম্বার সে চিনতে পারছে তাই কোনো কথা বলতে চাচ্ছেনা। আমিও কেমন বোকা তার কাছ থেকে কথা আশা করতেছি। তার কণ্ঠ শুনতে পেয়েছি সেটাই তো অনেক। ফোনটা যদি তার কাছে থাকতো হয়তো তার কণ্ঠটাও শোনা হতো না। আমার মতো জঘন্য একজন মানুষের সাথে তার কথা বলা উচিৎ নই। এসব ভাবতে ভাবতে ফোনটা কেটে দিলাম।
।
মায়ের সাথে সাথে আমার চোখ থেকে ঘুমও বিদায় নিলো। বালিশে মাথা রাখলেই চোখের দু কোণা দিয়ে অজস্র পানি বেরিয়ে যাচ্ছে। মুছতে মুছতে ভাবতেছি,"শুধু কান্না নই এখন যদি মরেও যাই একটা লোকও নাই যে আমার জন্য দু ফোটা চোখের পানি ফেলবে।" আজ আমি এতই একা। একটা মূহুর্তের জন্যও ঐ পরকীয়ার সম্পর্ক টার ব্যাপারে ঘৃণা ছাড়া কিছু মাথায় আসতেছেনা। অথচ একটা সময় ছিলো রিয়ার প্রতি ঘৃণা আর পরকীয়ার প্রতি মায়া। আজ পরকীয়ার প্রতি ঘৃণা আর রিয়ার প্রতি মায়া। সময় কতো বড় শিক্ষক আজ তা শিখিয়ে দিয়ে গেল। আমাকে কেউ মারেনি কিন্তু সময়ের কাছে কী মার টাই না খেয়ে গেলাম!
খুব সকালে বাড়ির কলিং বেলটা বেজে উঠলো, চমকে উঠলাম কারণ মা মারা যাওয়ার তিন দিন পর কেউ একজন বাড়ির কলিং বেলটা বাজালো!
দরজা খুলতেই আরো বেশি অবাক হলাম, দেখলাম রিয়া একটা বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারতেছিনা এমন সময় আমি কি করবো? আমার কি করা উচিৎ?
চলবে...
লেখা:- সাইফুল ইসলাম সাইম