> বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ৫, ৬, ৭ এবং শেষ পর্ব | সাজু ভাই সিরিজ
-->

বিশ্বাস অবিশ্বাস পর্ব ৫, ৬, ৭ এবং শেষ পর্ব | সাজু ভাই সিরিজ

তুমি তো জানো আমি এক কথার মানুষ। আমি কিছুক্ষণ আগে আপুর বাসায় এসেছি। বিকেলে তোমার সঙ্গে জসীমউদ্দিন মোড়ে বিএফসি তে দেখা হবে ' 

আফরিন যখন তার মোবাইলে এই কথা বলতে বলতে বাসায় প্রবেশ করে তখন সে সজলের নাম্বারে কথা বলেনি। যদিও আফরিনের মোবাইল পাওয়া যায়নি কিন্তু তার নাম্বারটা সকালে হাসান সাহেবের কাছে দিয়েছিল সাজু ভাই। ফয়সালের কাছ থেকে সজল সরকারের পারসোনাল নাম্বার সাজু নিয়ে এসেছিল। 

ভিডিও ফুটেজে সাজু আফরিনকে যেই সময়ে কথা বলতে দেখেছে। সেই সময়ে সজলের ওই পারসোনাল নাম্বারে আফরিন কথা বলেনি। নতুন একটা নাম্বারে সে কথা বলেছে ৷ যেই নাম্বারে লাস্ট সাতদিনে মাত্র দুবার কল করেছে আফরিন। আর সেই নাম্বার থেকে সাতদিনে কোনো কল আসেনি। শুধু তিনদিন আগে মাত্র একটা মেসেজ এসেছিল৷ প্রযুক্তির বদৌলতে সেই মেসেজ বের করে দিয়েছে হাসান আলী। 

মেসেজটা হচ্ছে, 
' ফ্রী হয়ে কল দিস, আমার মনে হয় ওদের সঙ্গে তোর সামনাসামনি কথা বলে ঝামেলাটা মিটিয়ে নেওয়া উচিৎ। ' 

তাজুলের সঙ্গে কিছু না বলে সাজু বাহিরে আসে। যেই ওসি সাহেব আফরিন হ!ত্যার বিষয় তদন্ত করছেন তিনি থানায় নেই। ঘন্টা খানিক আগে বের হয়ে কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না। সাজু ভাই নতুন সেই নাম্বারে কল দিলেন কেউ রিসিভ করলো না। 

সাজু বিড়বিড় করে ভাবতে লাগলো, 
কিসের ঝামেলা ছিল আফরিনের? সেই ঝামেলা শেষ করার জন্যই কি আফরিন বিএফসি তে দেখা করতে চেয়েছিল? 
কিন্তু কার সঙ্গে? 
কে হতে পারে সেই ব্যক্তি? নারী না পুরুষ? 

এসব বিষয় তাজুলের জানার কথা নয়। নিশ্চয়ই সজল সরকার কিছু না কিছু জানেন। হাসবেন্ড হিসাবে আফরিন তার সঙ্গে নিশ্চয়ই বলেছে। তাই সজলের সঙ্গে দেখা করাটা জরুরি হয়ে গেল। কিন্তু সজল তো কথা বলতে রাজি হচ্ছে না। নিজ থেকে যে মানুষ লুকিয়ে বেড়ায় তাকে খুঁজে বের করা কষ্টকর। 

ওসি সাহেব থানায় এসেছে। তার পিছনে পিছনে সিদ্দিক সরকার। সাজুকে দেখে সরকার যেন খানিকটা বিব্রত হয়ে গেল। তবুও চেহারার রূপ বজায় রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন। 

' আরে সাজু সাহেব যে, কখন এসেছেন? ' হাসি হাসি মুখে কথাটা জিজ্ঞেস করেন ওসি সাহেব। 

' আধা ঘণ্টার মতো হবে, তাজুল সাহেবের সঙ্গে কথা বললাম। তা হঠাৎ সরকার সাহেবকে নিয়ে এলেন যে? ' 

' তিনি তাজুলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ' 

' ওহ্ আচ্ছা। ' 

খানিকটা চুপ করে থেকে সাজু বললো, ' তাকেও কি টাকার লোভ দেখাতে এসেছেন নাকি সরকার সাহেব? ' 

' মা মানে? ' থতমত খেয়ে উত্তর দিল সিদ্দিক সরকার। 

' আপনার বাসার দারোয়ান রফিক আপনাকে তাজুলের ফ্ল্যাটের সামনে দেখল। আপনি সে কথা গোপন করার জন্য তাকে নিষেধ করেছেন কেন? তাকে টাকার লোভ দিয়েছেন কেন? আপনি কিছু লুকাতে চাইছেন! ভালো মানুষ সেজে সবার অগোচরে কঠিন কোনো খেলা শুরু করেছেন। ' 

' আপনাকে এসব কে বলেছে? ' 

' আমি থানা থেকে সরাসরি আপনার কাছেই কথা বলতে যেতাম। কিন্তু ওসি সাহেবের সামনেই যখন দেখা হয়ে গেল সেহেতু এখানেই বলি সবকিছু। '

' কি কথা সাজু সাহেব? ' চিন্তিত হয়ে ওসির প্রশ্ন। 

সাজু নিজের মোবাইল বের করে কিছুক্ষণ আগে রফিকের সঙ্গে বলা কথোপকথনের রেকর্ড চালু করে দিলেন। রেকর্ড চলছিল আর সিদ্দিক সরকার দরদর করে ঘামছিল। সবটুকু শুনে ওসি সাহেবও তাকিয়ে রইল সরকারের দিকে। 

সরকার সাহেব এতটা আশা করে নাই। এমনটা হবে জানলে তিনি কখনো থানায় আসতেন না।  রফিক এভাবে সবকিছু বলে দিবে তিনি বুঝতে পারেননি। সামান্য সন্দেহ থেকে বাঁচার জন্য শুধু নিষেধ করেছে রফিককে।  

ওসি সাহেব বললেন, ' কাহিনি কি সিদ্দিক ভাই? ' 

' কোনো কাহিনি নাই। আর রফিক মিথ্যা কথা বলেছে, আমি তাকে এসব কিছু বলিনি। কোনো টাকার লোভ দেখাইনি। ' 

সাজু দেয়ালের দিকে মুখ রেখে বললো ' তাজুল সাহেবের কাছে শুনলাম আপনি নাকি গত বছর হজ্জ করে এসেছেন। তা এতো সহজে গরগর করে মিথ্যা বলতে বুক কাপে না? '

সিদ্দিক সরকার কিছু বললো না। সাজু প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললো, ' আপনার ছেলে এখর কোথায়? ' 

' আমি জানি না, সকাল থেকে তার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। ' 

' দেখা হয়নি নাকি আপনি নিজেই তাকে লুকিয়ে থাকার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন? ' 

' আমি কেন লুকিয়ে থাকার পরামর্শ দেবো? ' 

' আফরিনের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বের হলেই আপনার ছেলে যে আফরিনের স্বামী সেটা বের হয়ে যাবে। ' 

' কে বলেছে এসব? সম্পুর্ণ মিথ্যা কথা। ' 

' আমি সজলের বন্ধু ফয়সাল সাহেবের কাছে সবকিছু শুনেছি। পরশু রাতে তাজুলকে ডেকে অপমান করেছেন সেটাও তাজুল সাহেবের কাছে শুনলাম। মোটামুটি সবকিছু জানি বলতে পারেন। আপনি বরাবরই সবসময় ভালো সাজার চেষ্টা করেছেন। ভেবেছিলেন যদি বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেন তাহলে আপনার উপর কোনো সন্দেহ আসবে না। কিন্তু ছোটবেলার সেই কথাটা ভুলে গেছেন যে "অতি ভক্তি চোরার লক্ষ্মণ" তাই না? ' 

ওসি সাহেব বললেন, ' ওনার প্রশ্নের উত্তর দেন সিদ্দিক ভাই। চুপ করে আছেন কেন? ' 

মাথা নিচু করে সিদ্দিক সরকার বললো, ' আমি জানি না আপনি কি কি জেনেছেন। তবে আমি ধরে নিচ্ছি আপনি যা যা জানতে পেরেছেন সবকিছু সঠিক। মেনে নিলাম আপনার কথা। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ওই মেয়েকে খু!ন করিনি। '

' তাহলে রফিককে কেন নিষেধ করেছেন? ' 

' ওই কথা জানলে তো যে কেউ সন্দেহ করবে। তাছাড়া আমার ছেলে এরকম একটা কাজ যেহেতু করেছে তাই সব সন্দেহ আমার উপর আসবে। তাই ওকে শুধু ডেকে নিয়ে বলেছিলাম তখনকার কথা কাউকে বলিস না। অন্তত একটা সন্দেহ হতে মুক্তি থাকতাম। কিন্তু আমার কি দুর্ভাগ্য, সেটাই বড় বিপদ হয়ে গেল। ' 

' আপনি আপনার ছেলের বউকে কেন মেনে নিলেন না? যখন জানতে পেরেছেন আফরিন মা হতে চলেছে তখন অন্তত আপনার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলা দরকার ছিল। ' 

' আমি মানছি আমার ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে আমাকে খু!নি বলবেন না। বিশ্বাস করেন আমি সত্যিই কিছু করিনি। ' 

সাজু বললো, ' বিশ্বাস অবিশ্বাসের এই দুনিয়ায় আমরা সবসময় বিশ্বাসের কাছে হেরে যাই। এক ব্যক্তি বলেছিলেন ' পৃথিবীতে মানুষ ধর্মগ্রন্থ আর আদালতে নাকি সবচেয়ে বেশি মিথ্যা কথা বলে। আর আজকাল মানুষ সবচেয়ে বেশি মিথ্যা কথা বলে অপ্রয়োজনে। ' 

ওসি সাহেব বললেন, ' আপনিই ওই বাসায় গিয়ে মেয়েটাকে খু!ন করেছেন তাই না? '

' না, বললাম তো আমি জানি না। তাছাড়া ওই মেয়ে যে গতকাল সকালে আমার বাড়িতে এসেছে সেটাও জানতাম না আমি। আমি তো আগেরদিন রাতে তাজুলকে বলেছিলাম ওই মেয়ে যেন এই বাড়িতে আর না আসে। ' 

সাজু ভাই বললেন ' ওসি সাহেব আপনি কি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছেন? আফরিনকে খু!ন করা খু!নির হাতে বেশি সময় ছিল না। ' 

' এটা কেন বলছেন? ' 

' যদি সময় থাকতো তাহলে আফরিনের লা!শটা সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলাইতে চাইতো। তাহলে মামলা পুরোপুরি উল্টে যেত। ' 

' হুম, আপনার যুক্তি ঠিকই আছে। তখন আমরা এটা আত্মহত্যা ভাবতাম। ' 

সাজু ভাই সিদ্দিক সরকারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ' আমি আপনার ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চাই। তাকে কল দিয়ে আমার সামনে বসে কথা বলেন। জিজ্ঞেস করেন সে কোথায়? ' 

সিদ্দিক সরকার সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল বের করে ছেলের কাছে কল দিলেন। সাজু মোবাইল হাতে নিয়ে লাউডস্পিকার অন করে দিল। তারপর ইশারায় কথা বলার নির্দেশ দিলেন। 

সজল বললো, ' হ্যাঁ বাবা বলো! ' 

' বাবা কোথায় তুই? ' 

' মানিকগঞ্জে আছি, কেন কি হয়েছে? ' 

' সাজু সাহেব তোর সাথে দেখা করতে চায়। তোর সঙ্গে নাকি জরুরি কথা আছে। ' 

' তার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই। আর তুমি তাদের কাছে আফরিন আর আমার বিষয় কিছু বলতে যেও না। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাবার আগ পর্যন্ত তারা যেন কিছু জানতে না পারে। ' 

' তিনি সবকিছু জেনে গেছেন। '

' কীভাবে সম্ভব? '

' ফয়সাল সবকিছু বলে দিয়েছে। তুই  নিজেকে বাঁচাতে হলে তার সঙ্গে দেখা করে যা যা জিজ্ঞেস করে তার ঠিক ঠিক উত্তর দে। তাহলে তারা বউমার আসল খু!নিকে খুঁজে বের করতে পারবে। তোকেও লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতে হবে না। '

' এখন বৌমা হয়ে গেল? এতদিন কতো অনুরোধ করলাম তখন তো মানলে না। আর আজ যখন মেয়েটা মা!রা গেছে তখন বৌমা হয়ে গেল। আমি কারো সঙ্গেই দেখা করতে পারবো না। '

সাজু ভাই পাশ থেকে বললো, ' আপনার সঙ্গে আমার দেখা করাটা জরুরি মিস্টার সজল। আফরিন বেশ কিছুদিন ধরে একটা ঝামেলার মধ্যে ছিল। সেই বিষয় কিছু জানেন নাকি? ' 

সজল খানিকটা থতমত খেয়ে গেল। তারপর তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো, 

' তোমার পাশে সাজু বসে আছে বাবা? '

' হ্যাঁ, আমি থানায়। '

' তাকে বলে দাও যে আমি কোনো ঝামেলার কথা জানি না। আফরিন কখনো সেরকম কিছু আমার কাছে কখনো বলে নাই। ' 

সাজু বললো, 
' আপনি কি আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য আগ্রহী নয়? কোনো কারণে ধরা পড়ার ভয় লাগে তাই না সজল? ' 

' আপাতত আপনার সঙ্গে দেখা করা প্রয়োজন মনে করছি না। যেহেতু আপনি সবটাই ফয়সাল ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন। সেহেতু নতুন করে বলার মতো কিছু নাই আমার। যেটা বলার আছে সেটা হচ্ছে যে আফরিনের হ!ত্যার কথা আমি কিছু জানি না। ' 

' আপনার বাবা কিন্তু এখন থানায়। আপনি যদি আমাদের সাহায্য না করেন আমরা তাকে থানায় রাখতে বাধ্য হবো সজল। ' 

' যা ইচ্ছে করেন, আমার বাবার জন্যই আজকে এরকম হয়েছে। তিনি যদি মেনে নিতেন তাহলে ঘটনা ভিন্ন হতে পারতো। ' 

সিদ্দিক সরকার চেচিয়ে উঠলো। 
বললেন ' তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি। নিজের বাবার সম্পর্কে এসব কি কথা বলিস? ' 

' আমি রাখলাম। ' 

সাজু বললো, ' আমি যদি বলি আপনার জন্যই সবকিছু হয়েছে সজল সাহেব। আপনার স্ত্রীকে আপনিই হ!ত্যা করেছেন। কিন্তু লা!শ সিলিং ফ্যান এর সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখার সুযোগ পাননি। কারণ আফরিনের দুলাভাই তাজুল তখন কল দিচ্ছিল বারবার। আর আপনি আফরিনের মোবাইলের কল রিসিভ না করে একটা মেসেজ করেন। সেই মেসেজে তাজুলকে বাসায় আসতে বলেন। আপনার ধারণা ছিল তাজুল বাসায় এসে লাশ দেখবে। তারপর সব দোষ তার উপর পড়বে। ঠিক যেমনটা এখন সব দোষ তার উপর পড়েছে। ' 

' আপনি রাস্তার পাগলের মতো কথা বলছেন মিস্টার সাজু। ' 

' আপনি যদি আমাকে পাগল মনে করেন তাহলে তো ভুল করবেন। সম্ভবত সেটাই মনে করেছেন নাহলে এভাবে কথা বলতে পারতেন না। ' 

কল কেটে গেলে সিদ্দিক সরকার অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইল। 

সাজু ওসি সাহেবকে বললো, ' আফরিনের লা!শের খবর কী? '

ওসি সাহেব বললেন, 
' দুপুরের পরে আফরিনের মামা হাসপাতাল থেকে লা!শ নিয়ে এসেছে। মিতু ও তার মা-বাবা এখান থেকে সরাসরি গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। লা!শ গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে। '

' তাদের গ্রামের বাড়ি কোথায়? ' 

' মানিকগঞ্জে। ' 

' কোথায় বললেন? মানিকগঞ্জ? '

' হ্যাঁ। ' 

' এইমাত্র সজল বললো সে মানিকগঞ্জ আছে। তারমানে সজল আফরিনের লা!শ দা!ফন করতে মানিকগঞ্জে গেছে। '

' তাই তো। ' 

ওসি সাহেব সজলের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ' আফরিনের লাশটা ঝুলানো হলে মনে হয় খু!নির জন্য ভালো হতো। আ!ত্মহ!ত্যা ভেবে পোস্টমর্টেম করে প্রেগ্ন্যাসি ধরা পড়তো। সবাই ভাবতো অপবাদ থেকে বাঁচার জন্য আ!ত্মহ!ত্যা করেছে। কিন্তু এখন দেখুন কতজন ফেঁসে যাচ্ছে। এজন্যই বলে সত্য কখনো চাপা থাকে না। ' 



মাত্র পনের মিনিট আগে মাগরিবের আজান দেওয়া হয়েছে। সরকার বাড়ির ভেতর গেইটের কাছে বসে বসে গল্প করছে রফিক ও সিদ্দিক সরকারের ড্রাইভার। সিদ্দিক সরকারের একটা গাড়ি আছে, সেই গাড়ির ড্রাইভার। দুজনের কেউ নামাজ পড়তে যায়নি। আফরিন হ!ত্যার ঘটনা নিয়েই দুজনের সলাপরামর্শ চলছে। 

সরকার বাড়ির সামান্য দুরে মাস্ক পরে মাথায় হেলমেট দিয়ে দুটো লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের একজনের হাতে একটা ৪/৫ ফিট লম্বা চিকন 10 mm রড। রডের এক প্রান্ত ওয়ার্কশপ থেকে মেশিনের সাহায্যে সূচালো করে নিয়ে আসা হয়েছে। যে দুজন দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে একজন বেশ মোটা আর দ্বিতীয়জন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তাদের সঙ্গে একটা বাইক আছে। 

একজন বললো ' আমি ডাক দিয়ে গেইটের কাছে নিয়ে আসবো। কথা বলার মধ্যেই তুই কাজটা শেষ করবি। খবরদার মিস হয়না যেন। ' 

' ঠিক আছে মিস হবে না। ' 

' শা!লায় হয়তো গেইট খুলতে চাইবে না তাই রড পুড়ে গরম করে নিয়ে এসেছি। দুই সেকেন্ডের মধ্যে এটা শরীরের এপাশ থেকে ওপাশে বের হয়ে যাবে। '

দুজন এগিয়ে গেল সরকার বাড়ির সামনে। দ্বিতীয় লোকটা বাইক থেকে নেমে গেল। তার হাতে সেই সূচালো রড, রডের প্রান্ত খুবই গরম। যে প্রান্ত হাত দিয়ে ধরেছে সেখানে মোটা কাপড় পেচিয়ে নিতে হয়েছে। অ!স্ত্র বা ছোট কিছু হলে কাজটা করা যেত না। কিন্তু রড দেখে রফিকের সন্দেহ হবে না এটাই স্বাভাবিক। 

মোটা লোকটা বাইকে বসেই রফিককে ডাক দিয়ে বললো, 
' রফিক ভাই এদিকে আসেন তো। ' 

রফিক গেইট না খুলে গেইটের একদম কাছে দাঁড়িয়ে বললো, ' কারা আপনারা? ' 

রড হাতে দ্বিতীয় লোকটা বললো, 
' তোর য!ম আমরা, নেমকহারা!মের বাচ্চা তুই যার নুন খাইলি আজ তারই বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে সাক্ষী দিলি? ' 

রফিক কিছু বলার আগেই দ্বিতীয় লোকটা তার হাতের রডটা গেইটের গ্রীলের ফাঁক দিয়ে রফিকের পেটের খানিকটা উপর দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। গরম ও 
ওয়ার্কশপ থেকে একপ্রান্ত সূচালো করে আনার কারণে সেকেন্ডে মধ্যে কাজ হয়ে গেল। 

' শালা এবার কবরে গিয়ে সাক্ষী দিস। ভাগ্য ভালো যে যা যা দেখছে সবকিছু বলে নাই। যদি বাসার ভিতরে যা দেখেছে তাও বলে দিত তাহলে তো সবশেষ হয়ে যেত। ' 

রফিকের মর্মান্তিক চিৎকার আশেপাশের মানুষের কানে পৌঁছে গেল। দুই অজ্ঞাত হাম!লাকারী বাইক নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। 



মানিকগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে আফরিনের লা!শ নিয়ে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। মাগরিবের খানিকটা আগে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আফরিনের মেজো মামা নিজেই এক মসজিদের ইমাম। জানাজা তিনিই পড়াবেন। শেষ মুহূর্তে লা!শ সামনে রেখে যখন আফরিনের মামা বললেন, 

' আমার বোনের মেয়ের প্রতি কারো কোনো দাবি থাকলে সেগুলো মাফ করে দিবেন। যদি কোনো দেনাপাওনা থাকে তাহলে আমাদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করবেন। সবাই আমার বোনের মেয়ের জন্য দোয়া করবেন। ' 

সেই মুহূর্তে ১২/১৩ বছরের একটা ছেলে মামার কাছে এসে ছোট্ট একটা কাগজ দিল। আফরিনের মামা সেই কাগজ খুলে দেখেন সেখানে লেখা আছে, 

' এই মেয়েটা একটা বিশ্বাসঘাতক। আল্লাহ যেন ওকে কোনদিনই ক্ষমা না করে। তার মৃত্যুর কারণ ছিল বিশ্বাসঘাতকতা করা। 



আফরিনের লা!শ দাফন হয়ে গেল। সেই ছোট্ট ছেলেটার দেওয়া কাগজটির কথা পরিবারের কিছু ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ জানে না। রাত দশটার দিকে মিতু সাজুর কাছে কল দিয়ে কাগজের কথা বলে। আফরিনের উপর প্রতি!শোধ নিতে গিয়ে কেউ হয়তো তাকে খু!ন করেছে। 

সিদ্দিক সরকারকে থানা থেকে আর বের হতে দেননি। উপরমহল থেকে আদেশ দেওয়ার জন্য তাকে থানাতেই আটকে রাখা হয়। সাজু যখন রফিকের বলা কথাগুলো সিদ্দিক সরকারের কাছে বলেছে। তারপর থেকে সিদ্দিক সরকার সাজু ও ওসি সাহেবের সামনেই ছিল। এরমধ্যে সে শুধু তার ছেলে সজলের সঙ্গে কথা বলেছে৷ তাও যতটুকু কথা হয়েছে ততটুকুর মধ্যে রফিকের বিষয় কোনো কথা হয়নি।

মাগরিবের কিছুক্ষণ আগে সাজু যখন থানা থেকে বের হয়ে আসে তখন সিদ্দিক সরকার হাজতে। তার মোবাইল মানিব্যাগ যাবতীয় সবকিছু পুলিশ জমা নিয়ে রেখেছে। সুতরাং বাহিরের কেউ রফিক যে সাজুর কাছে সরকার সাহেবের কথা বলেছে সেটা জানলো কীভাবে? 

রফিক এখনো বেঁচে আছে, তবে ডাক্তার সাহেব বলেছেন অবস্থা খুবই খারাপ। সচারাচর এরকম আহত হলে বেঁচে থাকার কোনো সম্ভবনা আর থাকে না। রড পুড়ে গরম করা ছিল তাই আঘাত মারাত্মক রূপ ধারণ করে। ডিবি অফিসার হাসান আলী নিজেও এসেছেন হাসপাতালে। সে এসেছে সাজুর রাগারাগির জন্য। 

সাজু তাকে বললো, ' ভাই রফিকের কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে হবে। ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে। ডাক্তারকে একটু বলেন না যদি কথা বলার ব্যবস্থা করতে পারে। ' 

' সেটা তো সম্ভন না সাজু। রফিকের অবস্থা খুব খারাপ, এমতবস্থায় সে কীভাবে কথার জবাব দেবে বলো তো? ' 

' ভাই ড্রাইভারের কথা অনুযায়ী আ!ক্র!মনকারী দুজনেই যাবার সময় বারবার নেম!কহা!রাম বলে গালি দিয়েছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এটা ওদের একটা পরিকল্পনা। ' 

' কিরকম? '

' দেখুন, প্রথমত আমরা সিদ্দিক সরকারকে বাইরে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেইনি। আর দ্বিতীয়ত সিদ্দিক সরকারের লোক যদি আ!ক্র!মণ 
করে থাকে তাহলে কোনদিনই তার নাম বলে যাবে না। ' 

' হ্যাঁ সেটা ঠিক, কেউ নিজের পরিচয় এভাবে দিতে বলবে না। ' 

' এটা পরিকল্পনা ছিল। তাই হাম!লাকারীরা ইচ্ছে করে ওসব বলে গেছে। আমরা যেন পুরোপুরি বাড়িওয়ালাকে সন্দেহ করি। মূলত এখানে এমন কেউ রফিককে মারার চেষ্টা করেছে যারা সিদ্দিক সরকারকে ফাঁসাতে চায়। ' 

' তুমি কি রফিককে সন্দেহ করছো? ' 

' হ্যাঁ ভাই। তাকে দিয়ে কাজটা করানো হয়েছে বলে আমার ধারণা। এখন রফিককে সরিয়ে দিয়ে তারা এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করবে। প্রথমত রফিক সাক্ষী হিসেবে থাকবে না, দ্বিতীয়ত সিদ্দিক সরকারকে ফাঁসানো যাবে।  ' 

' কিন্তু রফিক...! 

' আমি তখন আপনাকে বারবার বলেছিলাম যে স্যারের কাছে সিদ্দিক সরকারের বিরুদ্ধে রফিক এর বলা কথাগুলো বলতে হবে না। আপনার জন্য স্যারকে বলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। ' 

' তোমার কি ধারণা যে ওগুলো স্যারের কাছে বলার কারণে রফিককে আক্র!মণ করা হয়েছে? '

' কিছুটা তাই। এজন্যই আমি চাকরি করতে চাই না। কিছু হলেই উপর থেকে হুকুম আসে। তাদের হুকুম মানতে গিয়ে কাজের বারোটা বেজে যায়। এই মামলা শেষ হলেই আমি চাকরি ছেড়ে দেবো। নিজের মতো করে পারলে করবো নাহলে নাই। ' 

' মাথা গরম না করে আগে ওই হাম!লাকারীদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের ধরতে পারলে আমরা আসল অপরাধীর কাছে পৌঁছে যাবো৷ ' 

সাজু হাসপাতালেই অপেক্ষা করতে লাগলো। হাসান আলী তাকে বাসায় নিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু সাজু রাজি হলো না। বাধ্য হয়ে হাসান নিজে ও থেকে গেল৷ সাজুর একটাই কথা, সে রফিকের সঙ্গে কথা বলতে চায়। 

রাত বারোটার দিকে রফিক আবোলতাবোল বলা শুরু করে। মনে হচ্ছিল দুনিয়ার কোনো খেয়াল তার মগজে নেই। তবে মাঝে মাঝে ডাক্তারের কিছু কথার জবাব সুন্দর করে দিচ্ছে। হঠাৎ করে সে সাজুর কথা জিজ্ঞেস করলো। সাজুে সঙ্গে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে গেল কিন্তু ডাক্তার রাজি হচ্ছিল না। 

রফিকের কথা বাহিরে জানানো জলো। ডাক্তারের নিষেধ অমান্য করে সাজু জোর করে রফিকের কাছে গেল।

ডিবি হাসান আলী ভাই পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন। 

সাজু বললো, ' রফিক ভাই আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, একটু মনোযোগ দেন। ' 

রফিক দুই মিনিটের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর কণ্ঠে পরিবর্তন এনে বললো ' স্যার আমি আমার পাপের শাস্তি পাচ্ছি। বেশি লোভ করতে গিয়ে আজ মরনের দরজার কাছে চলে এসেছি। আমাকে মাফ করে দিবেন। ' 

' রফিক ভাই, বিকেলে আপনি সিদ্দিক সরকারের কথা আমাকে বলার আগে বা পরে অন্য কাউকে হয়তো বলেছেন। আপনার আর সিদ্দিক সাহেবের সেই কথা আপনি আমি ছাড়া আরো কেউ জানে, তিনি কে? ' 

' স্যার আমি চিনি না তাকে, তার কাছ থেকে শুধু টাকা নিতাম আর তার কথা শুনতাম। ' 

' তার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হতো কীভাবে? ' 

' সবসময় মোবাইলে কথা হতো। দুবার শুধু দেখা হয়েছে আমাদের। ' 

' আফরিনকে আপনিই হ!ত্যা করেছেন তাই না? '

' হ্যাঁ স্যার, টাকার লোভে করছি। ছোটবেলা থেকে কষ্ট করতে করতে বড় হইছি। একটা মেয়ে খু!ন করতে পারলে ওরা বলছিল আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেবে। টাকার কষ্ট চলে যাবে আবার পুলিশও খুঁজে পাবে না। কিন্তু আমার জীবন শেষ করে দিল স্যার। '

' কতদিন আগে থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হতো বলেন তো? '

' দুইমাস আগে থেকে। ' 

' ওদের সঙ্গে কথা বলতেন কোর মোবাইল দিয়ে? আপনার মোবাইল দিয়ে নাকি আলাদা কোনো মোবাইল তারা দিয়েছে? '

' আমি যে ঘরে থাকি সেই ঘরে আমার খাটের নিচে একটা বাক্সের মধ্যে মোবাইল আছে। সেই মোবাইল দিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। ' 

' সেদিন কি হয়েছিল বলেন তো? ' 

' আফরিন আফা বাসায় আসার সময় আমি তাদের কল দিয়ে জানিয়ে দিলাম। তারা আমাকে বললেন সুযোগ পেলে যেন আফাকে মেরে ফেলি আমি। আমি সারাক্ষণ সুযোগ খুঁজতে থাকি। এক ফাঁকে সুযোগ করে বাসায় গিয়ে কলিং বেল চাপ দিতেই আফা দরজা খুলে দেয়। অজ্ঞান করার স্প্রে ছিল আমার কাছে। আমি তাকে বললাম যে দক্ষিণ পাশের রুমের জানালার কাছে একটা পাইপ আছে সেটা চেক করবো। আফা আমাকে সেই রুমে নিয়ে গেল। আমি রুমের মধ্যে গিয়ে আফার মুখে স্প্রে করে দিলাম। যখন তিনি অজ্ঞান হয়ে গেল তখন তার ওড়না দিয়ে তাকে বিছানায় ফেলে ফাঁ!স দিলাম। '

রফিক হাঁপাচ্ছে, তার প্রচুর কষ্ট হচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এখনো আসল অপরাধীর পরিচয় নিশ্চিত হয়নি। একটু সামলে নিয়ে রফিক বললো, 

' আমি আমার পাপের শা!স্তি দুনিয়া থেকে হাতে হাতে নিয়ে যাচ্ছি স্যার। তবে বিশ্বাস করেন আমি ওই লোককে চিনি না। টাকার জন্য কাজ করছি স্যার, আমাকে মাফ করে দিয়েন। ' 

সাজু কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইল। কারণ রফিকের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মিনিট খানিক পরে নিজেকে সামলে নিয়ে রফিক বললো, 
' বিকেলে আমাদের বাড়ির মালিক যখন আমায় ডেকে নিয়ে তার কথা বলতে নিষেধ করেছে। তখন আমার মাথায় বুদ্ধি আসে। এমনিতেই তো আপনারা তাকে সন্দেহ করছিলেন। তাই তার বিরুদ্ধে ওই কথা বলে আরো শক্ত সন্দেহ সৃষ্টি করি। তারপর আমি ওই লোককে কল দিয়ে বলি যে আপনার কাছে এসব বলছি। ' 

হাসান আলী পাশ থেকে বললো ' তারপর তারাই তোমাকে খু!ন করতে লোক পাঠিয়েছে। আর যাদের পাঠিয়েছে তাদের শিখিয়ে দিয়েছে যেন বাড়িওয়ালার কথা বলা হয়। ' 

রফিক বললো ' আমি জানতাম তারা আসবে। ' 

সাজু অবাক হয়ে বললো ' মানে? ' 

' আমাকে বলা হয়েছিল আমার উপর থেকে পুরোপুরি সন্দেহ দুর করতে হবে। আর সেজন্য দুজন লোক এসে আমাকে ছু!রি দিয়ে আ!ঘাত করবে৷ আমি সামান্য আহত হয়ে গেলে সম্পুর্ণ দোষ বাড়িওয়ালার উপর পড়বে। ' 

' আপনি কি ইচ্ছে করেই ড্রাইভার নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন? যেন তাদের বলা কথা শুনে ড্রাইভার সাক্ষী দিতে পারে। ' 

' হ্যাঁ হ্যাঁ, কিন্তু ওরা আমাকে জানে মেরে ফেলবে আমি ভাবি নাই। ' 

রফিক আরো অস্থির হয়ে গেল। ডাক্তার এসে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। সাজু ও হাসান আলী বারান্দায় এসে দাড়িয়ে রইল। দুজনেই চিন্তিত, কে হতে পারে সেই ব্যক্তি। 

হাসান আলী বললো, 
' তাহলে আফরিনের লা!শ দাফনের সময় ওই অজ্ঞাত ব্যক্তিই বিশ্বাসঘাতকতা করার কাগজটা লিখে পাঠিয়েছে। ' 

' হ্যাঁ ভাই, এখন আমাদের খুঁজে বের করতে হবে আফরিন কার সঙ্গে এরকম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ' 

' ওই নাম্বারটা আরেকবার কল দাও। যে নাম্বারে আফরিন কথা বলে বিকেলে বিএফসি তে দেখা করতে চাইল। যে মেয়ে মেসেজ দিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করতে বললো। আমার মনে হয় সেই মেয়ে সবকিছু জানে। ' 

' অন্তত ঝামেলার কথা জানবে নিশ্চয়ই। কারণ সে যে মেসেজ দিয়েছে সেখানে এরকমই কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ' 

' একটা অনুরোধ করি হাসান ভাই? ' 

' হ্যাঁ করো। ' 

' এসব কথা স্যারকে আপাতত বলবেন না। স্যার তখন দেখবেন আরেক হুকুম জারি করবে। রফিক যে খু!নের কথা স্বীকার করেছে। আর আমরা যে অজ্ঞাত তাদের অনুসন্ধান শুরু করবো সে কথা আপনি আর আমি ছাড়া কেউ জানবে না। ' 

' কিন্তু স্যার তো বারবার কল দিচ্ছে। ' 

' আপনাকে অনুরোধ করছি প্লিজ ভাই। নাহলে আমি এখান থেকেই বাসায় চলে যাবো। ' 

' ঠিক আছে বলবো না! '

' ম্যালা ম্যালা ধন্যবাদ। ' 



রফিক মারা গেল ভোরবেলা ফজরের আজানের একটু পরে। সাজু হাসপাতালেই ছিল, ডাক্তার এসে রফিকের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেন। লা!শ পোস্ট!মর্টেম করতে হবে। 

রাতে অনেকবার সেই নাম্বারে কল দিয়েও কোনো লাভ হলো না। নাম্বার বন্ধ ছিল। সকাল বেলা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সাজু আবার সেই নাম্বারে কল দিলেন। 

দুবার রিং বাজতেই কল রিসিভ করলো একটা মেয়ে। সাজু নিজের পরিচয় দিয়ে বললো, 

' গতকাল থেকে কল দিচ্ছি আপনাকে। '

' আমি পরশু রাত থেকে অসুস্থ তাই মোবাইল থেকে দুরে ছিলাম। বারবার অনেকে কল দিচ্ছে তাই মা মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিল৷ ' 

' আপনার নাম কি? ' 

' শারমিন চৌধুরী। ' 

' আফরিন নামে কাউকে চিনেন আপনি? ' 

' জ্বি, আমার বান্ধবী। ' 

' সে খু!ন হয়েছে সেটা তো নিশ্চয়ই জানেন? '

' হ্যাঁ জানি, আর এরকম কিছু হতে পারে সেটাও আমি জানতাম। এমনকি আফরিন নিজেও কিছু একটা বুঝতে পেরেছে কিন্তু পাত্তা দিত না। সেদিন আমাদের দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু আমার হঠাৎ করে হার্টের ব্যথাটা বাড়তে থাকে। এরপর আবার জ্বর এসেছে, তাই পুলিশের কাছে গিয়ে যোগাযোগ করতে পারিনি। ' 

' আমরা কি আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি? যদি আপনার ঠিকানাটা বলতেন। ' 

' তিন নাম্বার সেক্টরে ছয় নাম্বার রোডে চলে আসুন। ' 

আদনানকে রাতেই বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে সাজু। হাসপাতালের সামনে থেকে নাস্তা করে বাইক নিয়ে তারা শারমিনের বাসায় রওনা দিল। 

সাজু ভাই ও হাসান আলী দুজনেই শারমিনের সামনে মুখোমুখি বসে আছে। শারমিন যে সত্যি সত্যি অসুস্থ সেটা তার চেহারায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। 

সাজু বললো, 
' বলেন তো আফরিনের সঙ্গে কার সমস্যা ছিল? ' 

' সাথীর সঙ্গে ও একটা অপরাধ করেছিল। ' 

' সাথী কে? ' 

' আমাদের একটা বান্ধবী ছিল। '

' এখন নেই? ' 

' না নেই, দুই বছর আগে সে আত্ম!হত্যা করে মা!রা গেছে। '

' সাথী কি তাহলে আফরিনের কারণে আত্ম!হত্যা করেছে? মানে এরকম কিছু? ' 

' সাথী যথেষ্ট সুন্দরী ছিল, তবে খুব লাজুক ও ভিতু টাইপের। পড়াশোনায় অনেক মেধাবী। ' 

' আচ্ছা তারপর। ' 

' আমাদের একটা বন্ধু শাকিল সাথীকে অনেক পছন্দ করতো। শাকিল ছিল বড়লোকের সন্তান। কিন্তু সাথী তাকে অবহেলা করতো । কিন্তু শাকিল তবুও তার পিছনে পিছনে ঘুরতো। ' 

' তখন কি আপনারা একসঙ্গে পড়াশোনা করেন সবাই? ' 

' হ্যাঁ। ' 

' ঠিক আছে তারপর বলেন। '

' একদিন পরে সাথীর জন্মদিন ছিল। শাকিল তখন আফরিনকে বলে যে সাথীর জন্মদিনে সে স্পেশাল একটা সারপ্রাইজ দেবে। আে সেজন্য আফরিনের সাহায্য চায় শাকিল। ' 

' সেটা কেমন সারপ্রাইজ? '

' মিরপুরে শিকলদের একটা বাসা আছে। সেখানে সে জন্মদিনের আয়োজন করবে। আফরিন যেন সাথীকে নিয়ে সেখানে যায়। শাকিল বলেছিল যে সাথীর জন্মদিনে যদি ভালো কিছু করতে পারে তাহলে হয়তো রাজি হতে পারে। তাই আফরিন রাজি হয়ে গেল। পরদিন সাথীকে নিয়ে মিরপুরে চলে যায় আফরিন। আফরিনকে সাথী অনেক বিশ্বাস করতো তাই যেতে রাজি হয়ে যায়। ' 

' আপনি যাননি? '

' না আমাকে বলে নাই কিছু। আর আমি তখন মা-বাবার সঙ্গে কক্সবাজার ছিলাম। ' 

' তারপর কি হলো? ' 



শাকিল মনে মনে এতটা খারাপ পরিকল্পনা করে রেখেছে আফরিন যদি জানতো। তাহলে আফরিন কোনদিনই সেখানে যেত না। 

আফরিন ও সাথী সেই বাসায় যাবার পরে শাকিল যখন সামনে আসে তখন সাথী অবাক হয়ে যায়। আফরিন তাকে অভয় দিয়ে শান্ত থাকতে বলে। এরপর নাস্তার ব্যবস্থা করে শাকিল। শুরুতেই সে এতটা ভালো ব্যবহার করে যা দেখে আফরিন ভেবেছিল সত্যি সত্যি শাকিল সবকিছু সাথীকে খুশি করার জন্য করছে। 

জন্মদিনের সকল আয়োজন ছিল বেশ চমৎকার। কিন্তু কোন খাবারের মধ্যে যে অচেতন করার ওষুধ ছিল দুজনের কেউ জানে না। আফরিন বলেছিল, সে যখন চোখ মেলে তাকায় তখন সে সোফায় শুয়ে আছে। এরপর পাশের রুমে গিয়ে সাথীকে বিছানায় বিবস্ত্র অবস্থায় চাদর দিয়ে জড়ানো দেখতে পায়। আফরিন চাদে সরিয়ে সাথীর সঙ্গে কি কি হতে পারে সব বুঝে যায়। সে মোবাইল বের করে শাকিলের কাছে কল করে। 

শাকিল বলে যে, সে নাকি ফ্ল্যাটে নেই। আফরিন যেন সাথীকে নিয়ে বাসায় চলে যায়। আর এসব কথা কাউকে জানালে সাথীর অচেতন অবস্থায় উলঙ্গ ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে দেবে। 

ঘটনার পরে সাথী মাত্র একদিন ঢাকায় ছিল। তারপর সে চলে যায় গ্রামের বাড়িতে। গ্রামের বাড়িতে যাবার চারদিন পরে আমরা জানতে পারি যে সাথী আ!ত্মহ!ত্যা করেছে। সাথীর এক কাজিন এসে ঢাকা থেকে ওর যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেল৷ 

আফরিন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে খুব। সাথীর মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করে সবসময়। কিন্তু আফসোস করে তো লাভ নেই। পৃথিবী থেকে একবার যে চলে চায় সে তো আর কোনদিন পৃথিবীতে ফিরে আসে না। সেজন্যই মানুষের সঙ্গে মান অভিমান হলে বিদায় নেবার আগেই সবকিছু ঠিকঠাক করা উচিৎ। কে পৃথিবীকে বিদায় বলে সবকিছু স্মৃতি করে চলে যাবে, কে জানে? 

সাজু বললো ' দুই বছর আগের ঘটনা নিয়ে নতুন করে কবে থেকে ঝামেলা হয়েছে? আর আপনার বন্ধু সেই শাকিল কোথায়? '

' শাকিল এক্সি!ডেন্ট করে মারা গেছে তিনমাস আগে। তবে আমার আর আফরিনের ধারণা যে শাকিলকেও পরিকল্পনা করে খু!ন করা হয়েছে। শুধু নাম দেওয়া হয়েছে এক্সি!ডেন্ট। '

' সাথীর গ্রামের বাড়ি কোথায়? '

' কুষ্টিয়ার মিরপুরে। ' 

' ওর পরিবারে কে কে আছে? '

' আমি জানি না। মাস তিনেক আগে একদিন আফরিনের কাছে একটা কল আসে। কলকারী জানান যে সাথী নাকি তার বাড়িতে একটা ডায়েরিতে সেদিনের সেই ঘটনা লিখে গেছে। আর সেখানেই বিশ্বাসঘা!তক হিসেবে আফরিনের নাম লিখে গেছে সাথী। আফরিন বারবার বোঝাতে চেষ্টা করে যে সে কিছু ইচ্ছে করে করেনি। কারণ সে জানতো না এরকম একটা ঘটনা হবে। ' 

' কিন্তু সেই অজ্ঞাত ব্যক্তি সেসব বিশ্বাস করে না। সপ্তাহে দু তিনবার কল দিয়ে শুধু মৃত্যুর কথা স্মরণ করে দিত। আফরিন বিরক্ত হতো। তারপর পুরাতন নাম্বার পরিবর্তন করে কিন্তু নতুন সিমে আবার কল আসে। ' 

' সাথীর ফেসবুক আইডি ছিল? আর সেটা কি এখনো আছে? ' 

' হ্যাঁ আছে। ' 

' একটু মোবাইল বের করে ফেসবুকে লগইন করুন তো। আর সাথী কি তার নিজের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করতো? '

' হ্যাঁ পোস্ট করতো। '

' ঠিক আছে বের করেন। ' 


সাজু ভাই সিরিজের গল্প মোঃ সাইফুল ইসলাম ছাড়া আর কেউ লিখে না। 
.
ওসি সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে সাজু ও ডিবি হাসান আলী সরকার বাড়িতে প্রবেশ করলো। তাজুল সাহেবের ফ্ল্যাটের পাশের ফ্ল্যাটের শাহানা আক্তার গতকাল রাতে সিলেট থেকে এসেছে। আজকে তার অফিসে যেতে হবে না কারণ সে কদিন ধরে সিলেটে অফিশিয়াল কাজ করেছে। যে ক'জন সিলেট থেকে এসেছে সবার আজকে ছুটি। 

দারোয়ানের রুম থেকে তার সেই লুকিয়ে রাখা মোবাইল হাতে নিয়ে সাজু বসে আছে। ওসি সাহেব বসে আছে তাদের পাশেই। তাদের সামনে অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে শাহানা আক্তার। আফরিনের হ!ত্যাকাণ্ডের সময় সে ঢাকায় ছিল না। তবুও কেন পুলিশ তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছে? 

ওসি সাহেব বললেন ' কেমন আছেন? '

' জ্বি ভালো। ' শাহানার শুকনো উত্তর। 

' আর দুদিন পরে তো আপনার ছোটবোন সাথীর জন্মদিন। তা মৃত বোনের জন্মদিনে কোনো আয়োজন করবেন না? '

' আমার বোনের কথা আপনি জানেন কীভাবে? '

' আমরা আরো অনেক কিছু জানি। আপনার বোনের মৃত্যুর জন্য দায়ী দুজনকেই তো পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলেন। এবার নিশ্চয়ই মনের তৃপ্তি পেয়েছেন? ' 

শাহানা বিব্রত হয়ে গেল, কি জবার দেবে সেগুলো খুঁজে পাচ্ছে না। ওসি সাহেব মুখে গম্ভীরতা বজায় রেখে বললেন, 

' অনেক প্ল্যান করেছিলেন কিন্তু, চমৎকার। '

' কিসের প্ল্যান? ' 

সাজু বললো ' বোনের মৃত্যুর দুই বছর পরে লেখা ডায়েরি পড়ে বোনের মৃত্যুর জন্য দায়ী মানুষকে খু!ন করার পরিকল্পনা। ' 

' আশ্চর্য আমি কেন খুন করবো? ' 

' আপনি তো করেননি, করিয়াছেন। ' 

আফরিনের সেই বান্ধবীর কাছে সাথীর ফেসবুক আইডিতে সাথী ও তার বোন শাহানার কিছু ছবি পাওয়া যায়। যেহেতু সাজু শাহানাকে আগে দেখে নাই তাই নিশ্চিত হতে পারেনি। কিন্তু প্রতিটি ছবিতে Shahana Akhter নামের একটা আইডি ট্যাগ করা হয়েছে। তামান্না ও দারোয়ান বলেছিল সিলেটে যিনি গিয়েছে তার নাম শাহানা। 

আরো নিশ্চিত হবার জন্য মিতুর কাছে কল দিয়ে শাহানার একটা ছবি পাঠানো হয়। মিতু তখন নিশ্চিত করে এটাই তাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকা শাহানা আক্তার। 
তারপরেই সবাই মিলে চলে এসেছে সরকার বাড়িতে। বুদ্ধিমতী শাহানা ভেবেছিল রফিক মারা গেছে সুতরাং সে বিপদমুক্ত হয়ে গেছে। পুলিশের আগমন দেখে অবাক হলেও সে বুঝতে পারেনি এরা সবকিছু জেনে গেছে। 

সাজু বললো ' রফিক গতকাল রাতে সবকিছু বলে গেছে আমাকে। আপনি যতবারই না না বলেন তাতে কিছু পরিবর্তন হবে না। শুধু সময় পরিবর্তন হয়ে যাবে কারণ সময় বসে থাকে না। '

ওসি সাহেব বললেন ' আমি জানি আপনার বোন এভাবে মারা গেছে বলে আপনার মনের অবস্থা ভালো ছিল না। কিন্তু তাই বলে এভাবে নিজের হাতে প্রতিশোধ কেন নিতে হবে? আপনার বোনের সেই ডায়েরি পুলিশের কাছে দিতেন। তারা নাহয় সেগুলো দেখে অপরাধীর শাস্তি ব্যবস্থা করতো। ' 

শাহানা রেগে যায়। ' কিসের পুলিশ? আমার ভালো করে জানা আছে এদেশে কীভাবে বিচার সম্পন্ন হয়। আইনের আশ্রয় নিতে গিয়ে নিজেকে হাসির পাত্রী বানাতে চাইনি। ' 

ওসি সাহেব বললেন ' আপনার বাকি সহযোগীরা সবাই কোথায়? তাদের ঠিকানা দিন অথবা তাদের আত্মসমর্পণ করতে বলেন। ' 

' আমি তাদের চিনি না। ' 

' কেন? তাদের সঙ্গে সবকিছু নিয়ে আলোচনা কে করতো? ' 

' আছে একজন, তিনি আমার কাজ ভালোভাবে করে দিয়েছেন। তাই আমি তার নাম বলতে পারবো না। ' 

ওসি সাহেব বললেন ' আদালত থেকে রিমান্ড মঞ্জুর করলে তখন ঠিকই বলবেন। ' 

শাহানা চুপ করে রইল। নিজের জীবনটা শেষ হয়ে গেল এখানেই। ভবিষ্যতে কি হবে তার আর কোনো নিশ্চয়তা নেই। 

সাজু বললো ' আফরিনকে মারার জন্য আপনি এই বাসায় তিন মাস আগে ভাড়ায় উঠেছেন তাই না? তারপর গরীব দারোয়ানের দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে তাকে লোভ দিয়েছেন। ' 

শাহানার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ওসি সাহেব আরো কিছু প্রশ্ন করেছেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। শাহানা কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। অবশেষে শাহানাকে নিয়ে ওসি সাহেব থানায় চলে গেল। সাজু ও হাসান আলী বাইক নিয়ে চলে এলেন মিরপুরে হাসান সাহেবের বাসায়। 

গোসল করে খেয়ে সাজু লম্বা এক ঘুম দিল। ঘুম যখন ভাঙলো তখন মাগরিব হয়ে গেছে। ঘুমের আগে মোবাইল সাইলেন্ট করেছিল। একটা নাম্বার থেকে ৩৭ টা মিসকল এসেছে। একই নাম্বার দিয়ে একটা মেসেজ দিয়েছে সেই ব্যক্তি। 

" আপনার হিসেবের খাতাটা তোলা রইল। সময় হলে সুদসমেত ফিরিয়ে দেবো। খুব তাড়াতাড়ি আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে।
 T.T.I. ( তামান্না তারিন ইফরা ) 
পুনশ্চঃ শাহানা আপুর বোনের হত্যার প্রতিশোধের সবটা আমিই করেছি। " 

সাজু সঙ্গে সঙ্গে দু তিনজনের কাছে টিটিআই সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তারা জানায়, টিটিআই মানে তামান্না তারিন ইফরা সাম্প্রতিক কালের একটা লেডি কন্ট্রাক্ট কি!লার। তার বিষয় বেশ কিছু গুঞ্জন শোনা গেলেও সে এখনো পুলিশের কাছে ধরা পড়েনি। 








সমাপ্ত...








লেখা:- মোঃ সাইফুল ইসলাম


NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner