> আমাদের মা | Bangla Short Story | Boipoka365
-->

আমাদের মা | Bangla Short Story | Boipoka365

 

১.

আমরা তিন ভাই এক বোন। বোন অর্থাৎ আপা সবার বড়ো। আর সবার ছোটো আমি। আমি যখন মায়ের কোলে তখন আমাদের বাবা মারা যান। মা কঠোর পরিশ্রম করে আমাদের বড়ো করে তোলেন। এখানে বলা দরকার, আর্থিক ভাবে আমরা কখনো অসচ্ছল ছিলাম না। মা সরকারি উচ্চপদে চাকরি করতেন। তাছাড়া দাদা আর নানার পরিবারও সচ্ছল। উভয় পরিবারই মাকে সাহায্য করেছে আমাদের বড়ো করে তুলতে।

আমরা ভাইবোনরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বড়ো আপা পরিবার নিয়ে আমেরিকা থাকেন। ওখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। মেজো ভাই থাকেন অস্ট্রেলিয়াতে। তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সেজো ভাই সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। বদলির চাকরি। তিনি পরিবার নিয়ে অন্য একটা জেলায় থাকেন। আর আমি ব্যাংকে চাকরি করছি। এখনো বিয়ে করি নি। তবে পাত্রী দেখা হচ্ছে।
মা আমার সঙ্গে থাকেন। বড়ো আপা আর মেজো ভাই চেয়েছিলেন মাকে স্থায়ী ভাবে তাদের কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু মা দেশ ছেড়ে যেতে চান না। তবে মাঝে মাঝে ওদের কাছে মাস কয়েকের জন্য বেড়াতে যান।
আমাদের মা শক্ত মনের মানুষ। তাকে আমরা কখনো ভেঙে পড়তে দেখি নি। কাঁদতে দেখি নি।
মায়ের সমস্ত গুণাবলী নিয়ে লিখলে হাজার পৃষ্ঠার বই হয়ে যাবে। মায়ের সমস্ত গুণাবলী নয়, শুধুমাত্র একটা বিশেষ গুণের কথা আপনাদের বলবো।
ছোটোকাল থেকে দেখেছি, আমরা ভাইবোনরা যখন অসুস্থ হয়ে পড়তাম, মা তখন আমাদের সুস্থতার জন্য দেশের সেরা ডাক্তারদের কাছে নিয়ে যেতেন। সেরা হাসপাতালে ভর্তি করাতেন। প্রয়োজনে দেশের বাইরেও নিয়ে যেতেন। অর্থাৎ সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা তিনি করতেন। আপনারা হয়তো ভাবছেন, এই যে তিনি আমাদের জন্য সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন এটাই তার বিশেষ গুণ। না, এটা নয়। বিশেষ গুণটি হলো, তিনি আমাদের সুস্থতার জন্য এতো কিছু করার পরও নিশ্চিত হতে পারতেন না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি বাড়তি একটা কাজ করতেন। আর সেটা হলো, তিনি আমাদের জন্য রোযা রাখতেন। ছোটোকালে মায়ের এই রোযা রাখার গুরুত্ব বুঝি নি। কিন্তু এখন ভাবলে তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা ঝুঁকে আসে।
২.
মাকে আমরা খুব একটা অসুস্থ হতে দেখি নি। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি দুর্বল হতে লাগলেন।
কয়েকদিন আগের ঘটনা। মা হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাড়াহুড়ো করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। আমরা ভাইবোনরা বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম মাকে বোধহয় আর আমাদের মাঝে পাবো না। মাকে দেখার জন্য বড়ো আপা, মেজো ভাই দেশে চলে এলেন। সেজো ভাইও কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন।
মা আমাদের সবাইকে দেখে খুশি হলেন। আমরা নিয়ম করে হাসপাতালে মাকে দেখতে যাই। মা অসুস্থ শরীর নিয়ে অল্প স্বল্প কথা বলেন আমাদের সাথে।
দেশের সেরা চিকিৎসা দেয়ার পরও মা সুস্থ হয়ে উঠছেন না দেখে আমরা শঙ্কিত হয়ে পড়ি। এবং দেশের বাইরে নেয়ার কথা ভাবতে থাকি।
বড়ো আপা বললেন, আমেরিকা নিয়ে গেলে সবচেয়ে ভালো হবে।
আমরা ডাক্তারদের সাথে কথা বলি।
তারা জানালেন, আমাদের মায়ের চিকিৎসা দেশেই সম্ভব। চিকিৎসার কোনো ত্রুটি হচ্ছে না। তবে সমস্যা হলো, মা মানসিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাকি এমন হয়। অর্থাৎ মনের জোর কমে যাওয়াতে শরীর ওষুধে সাড়া কম দিচ্ছে। এজন্য সারতে সময় লাগছে। কোনো ভাবে যদি ওনার মনটাকে দৃঢ় করে দেয়া যায় তাহলে উনি দ্রুত সেরে উঠবেন।
তারা বললেন,"আপনারা ভাইবোনেরা ওনাকে দেখার জন্য চলে এসেছেন, এতে অবশ্যই তিনি খুশি হয়েছেন। কারণ অনেক ছেলেমেয়েরা বাবা মাকে দেখার জন্য দেশের বাইরে থেকে আসা দূরে থাক, দেশে থেকেও আসে না। এবং এটাতে তার মনের জোর বাড়বে। আপনারা অপেক্ষা করুন তিনি ঠিক সেরে উঠবেন।"
কিন্তু ডাক্তাদের কথা অনুযায়ী প্রত্যাশিত ফল আমরা পাচ্ছিলাম না। মা আমাদের ভাইবোনদের একসাথে দেখে খুশি হলেও ওনার মানসিক অবস্থা প্রয়োজন মাফিক দৃঢ় হয়ে ওঠে নি।
আমরা ভাইবোনরা চিন্তিত হয়ে পড়লাম।
তখন বড়ো আপা একটা কথা বললেন। যা আমাদের কাছে সঠিক মনে হলো।
৩.
পরদিন আমরা ভাইবোনরা একসাথে মাকে দেখতে গেলাম।
মা বিছানায় শুয়ে আছেন। তিনি আমাদের দেখে আলতো হাসলেন। কিছুটা ক্লান্ত মনে হলো মাকে।
আপা বিছানায় বসে মায়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,"মা, আজ কেমন লাগছে?"
তিনি কোনো রকমে হাসলেন।
এবং নিচু স্বরে বললেন,"ভালো।"
তিনি যদিও মুখে বললেন ভালো, কিন্তু তার নিষ্প্রাণ চোখ দুটো দেখে বুঝতে পারছিলাম তিনি ভালো নেই।
আপা তারপর বললেন,"আপনি তো শক্ত মনের মানুষ ছিলেন আজীবন। পুরো সংসারটাকে একা দেখাশোনা করেছেন। কখনো আপনার মধ্যে দুর্বলতা দেখি নি। আমাদেরও দুর্বল হতে শেখান নি। তাহলে আজ কেনো আপনি এমন ভেঙে পড়ছেন? আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।"
মা ধীর কণ্ঠে বললেন,"বয়স মানুষকে দুর্বল করে দেয়। শরীর মন দু দিক থেকেই। মানুষের কিছু করার নেই এতে।"
"আপনি আমাদের উপর কোনো কারণে অসন্তুষ্ট নন তো?"
"একদম না।"
আপা খানিক থামলেন।
এরপর মায়ের ডান হাত নিজের দু হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,"মাগো, সেই ছোটোকাল থেকে দেখেছি, আমরা অসুস্থ হলে চিকিৎসার পাশাপাশি আপনি আমাদের জন্য রোযা রাখতেন। আমাদের ভালোর জন্য কতো কষ্টই না আপনি করেছেন! আমরা ঠিক করেছি আপনার সুস্থতার জন্য রোয়া রাখবো। এবং যতোদিন না আপনি সুস্থ হচ্ছেন ততোদিন রোযা রাখবো।"
কথাটা শুনে মা চমকে তাকালেন আমাদের দিকে। ওনার চমকানো দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি আমাদের কাছ থেকে এমন কথা আশা করেন নি।
তিনি শঙ্কা নিয়ে বললেন,"আমি কখন সেরে উঠবো তার ঠিক নেই। কতোদিন তোরা রোযা রাখবি? তোদের অনেক কষ্ট হবে।"
মেজো ভাই তখন বললেন,"আপনি আমাদের জন্য যা করেছেন, তার তুলনায় এটা কিছুই না।"
সেজো ভাই বললেন,"আপনার জন্য কষ্ট করা সেতো আমাদের সৌভাগ্য।"
আর আমি বললাম,"আমরা আজ রোযা রেখে হাসপাতালে এসেছি। যেদিন আপনাকে সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে যাবো, সেদিন আমাদের রোয়া রাখা শেষ হবে।"
কথাগুলো শোনার পর আমরা স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম, মায়ের নিষ্প্রাণ চোখ দুটোতে প্রাণের সঞ্চার হতে লাগলো। তার মুখের ক্লান্তির ভাব দূর হয়ে যেতে লাগলো।
আমরা বুঝলাম, মা আমাদের এই সিদ্ধান্তে ভীষণ খুশি হয়েছেন। ফলে তার মন দৃঢ় হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমরা মায়ের সঙ্গে ইফতার করি। মা আমাদের সঙ্গে ইফতার করেন আর আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন। গোটা জীবনে শক্ত মনের মানুষটির চোখে আমরা কখনো পানি দেখি নি। এই প্রথম দেখলাম।
আমরা যদি বলি,"মা কাঁদছেন কেনো?"
তিনি উত্তরে বলেন,"এ কান্না দুঃখের নয়।"
মায়ের কথা শুনে আমাদের বুক ভরে যায়।
পনেরো দিন আমরা রোযা রাখার সুযোগ পেয়েছিলাম। পনেরো দিনের মাথায় মা সুস্থ হয়ে ওঠেন।
৪.
মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছি। প্রাইভেট কারে করে যাচ্ছি।
বাড়ি যেতে যেতে মা বললেন,"আজ তো তোরা রোযা রাখিস নি?"
আমরা ভাইবোনরা একসাথে জবাব দিলাম,"না মা, আজ আমরা রোযা রাখি নি। কারণ আজ আমাদের ঈদ।"
শুনে মা তৃপ্তি নিয়ে হাসলেন।
আর আমরা বুঝলাম, ঐ অপূর্ব হাসি দেখার জন্য পনেরো দিন নয়, সারাজীবন রোযা রাখা যায়। সারাজীবন।



( সমাপ্ত )






লেখা: রুদ্র আজাদ
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
NEXT ARTICLE Next Post
PREVIOUS ARTICLE Previous Post
 

Delivered by FeedBurner