"চলো আমরা বাচ্চাটা মেরে ফেলি! তা না হলে এই বাচ্চা বড় হলে আমাদের একদিন মেরে ফেলবে!"
ভেবেছিলাম লিমা কথাটা মজা করে বলেছে। কিন্তু বাচ্চার দিকে যখন সে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তখন আমি নিজেও কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম!
আমার স্ত্রী লিমা প্রথমবার মা হয়েছে। আর মা হবার পর থেকেই তার মাঝে অদ্ভুত সব আচরণ লক্ষ্য করছি! সে সারারাত ঘুমায় না।
সদ্যজাত সন্তানের প্রতি তার বিন্দু পরিমাণ মায়া কাজ করে না। কিভাবে নিজের সন্তানকে মেরে ফেলবে কিংবা ক্ষতি করবে এটা নিয়েই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে!
মাঝরাতে কিছু একটার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। খেয়াল করে দেখি লিমা বাচ্চাকে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বের হচ্ছে!
যখন জিজ্ঞেস করলাম- কোথায় যাচ্ছো তুমি? সে কিছু না বলে বাচ্চাকে নিয়ে দৌঁড়ে চলে গেলো। আমিও তার পেছন পেছন ছুটলাম।
পুকুর পাড়ে এসে দেখি সে বাচ্চাকে পুকুরে ফেলে দিতে চাইছে! আমি জোর করে তার কোল থেকে বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে বললাম– কি হয়েছে তোমার? তুমি এমন করছো কেন?
লিমা কিছু না বলে আমার কাছ থেকে বাচ্চা নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে লাগলো। আমি আর সহ্য করতে না পেরে তার গালে থাপ্পড় মেরে বললাম- আরে ও তোমার নিজের বাচ্চা। এই মাসুম বাচ্চাকে মারার এতো শখ কেন তোমার?
লিমা তখন জ্বিব বের করে কেমন জানি অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো। আমার চিৎকার-চেঁচামেচিতে মা- বাবাও ছুটে আসলো।
মা লিমার অবস্থা থেকে ভয় পেয়ে বললো- তোর বউয়ের গায়ে খারাপ বাতাস লেগেছে, ভূতে ভর করেছে তোর বউয়ের উপর।
কতোবার বলেছি খোলা চুলে বাড়ির পিছনে না যেতে। কিন্তু তোর বউ তো আমার কোন কথাই শুনে না। ভূত তাড়ানোর জন্য এখনই বাড়িতে কবিরাজ আনতে হবে।
যদিও আমি এসব ফকির-কবিরাজ বিশ্বাস করি না। কিন্তু এই মুহুর্তে লিমার অবস্থা দেখে আমার বিশ্বাস না করেও উপায় নেই।
কবিরাজ এসে লিমাকে দেখে বললো- এই মেয়েকে তো দেখছি আবড়া পিশাচে ধরেছে। এজন্যই তো কথা বলতে পারছে না!
সমস্যা নেই, আমি হাতের তুড়িতেই এই পিশাচকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করছি। শুধু আমাকে একটা শক্ত দেখে লাঠি দেন।
কবিরাজকে লাঠি দিলে সে মনে মনে কিছু একটা বলে আমার স্ত্রীকে লাঠি দিয়ে জোরে আঘাত করলো। আমি রেগে গিয়ে কবিরাজকে বললাম- আপনি আমার স্ত্রীকে মারছেন কেন?
কবিরাজ মুচকি হেসে বললো- বাবাজি, যে জিনিস বুঝো না সে জিনিস নিয়ে কোন কথা বলো না। আঘাত তো তোমার বউ পাচ্ছে না। তোমার বউয়ের উপর যে পিশাচ ভর করেছে আঘাত সব ওই পিশাচটাই পাবে!
কবিরাজের কথা শুনে বাবা রেগে আমাকে বললো- বউয়ের প্রতি তোর এতো পিরিত দেখাতে হবে না। তোর যদি সহ্য না হয়, তুই সামনে থেকে চলে যা। কবিরাজকে উনার মতো কাজ করতে দে।
আমি আর কাউকে কিছু বলতে পারছিলাম না, কারণ এই মুহুর্তে কেউ আমার কথা শুনবে না। কবিরাজকে দেখলাম এলোপাতাড়ি আমার বউয়ের গায়ে আঘাত করছে।
বুঝতে পারছিলাম লিমার খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু ওর মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিলো না। কবিরাজ একটা সময় কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো- এটা তো দেখছি খুব তেন্দর পিশাচ। কিছুতেই গা থেকে নামছে না। ওরে এখন আমি জনমের শিক্ষা দিবো!
কবিরাজ তখন একটা মাটির পাত্রে ধূপ আর শুকনা মচির পুঁড়ে সেই ধোঁয়াটা জোর করে আমার স্ত্রীর নাকে মুখে দিচ্ছে। স্ত্রীর উপর এমন অত্যাচার আর সহ্য করতে পারছিলাম না।
বাড়ির সামনে এসে আমার বাচ্চার দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম- বাবরে আগে যদি জানতাম তোকে জন্ম দিলে তোর মায়ের এমন অবস্থা হবে, তাহলে তোকে কখনোই এই পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখাতাম না!
পরদিন সকালে খেয়াল করি আমার স্ত্রীর হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। সারা হাতে ওর মারের দাগগুলো কালো হয়ে আছে।
আমি নিজের কান্নাটা কোন রকমে চেপে রেখে ওর এলো-মেলো চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললাম– তুমি একবার বলো তোমার কিছু হয় নি, বিশ্বাস করো কেউ তোমার গায়ে টোকা দেওয়ারও সাহস পাবে না।
লিমা তখন অন্য দিকে তাকিয়ে হাসছিলো আর বলছিলো- দেখো, এখানে কতোগুলো হাতি!
অথচ এখানে হাতির কোন অস্তিত্বই নেই! লিমা হাসছিলো আর ওর হাসি দেখে আমি আর কান্না চেপে রাখতে পারি নি।
শহরে সবচেয়ে বড় সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে গিয়ে যখন আমার স্ত্রীর সমস্যাটা পুরোটা বললাম, তখন উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- আপনার স্ত্রীর POSTPARTUM PSYCHOSIS-এ আক্রান্ত (পোস্টপারটাম সাইকোসিস) হয়েছে।
এটা খুব বিরল ভয়াবহ মানসিক রোগ৷ সন্তান প্রসবের পর কিছু মায়ের এ রোগ দেখা দেয়৷ সদ্য সন্তান প্রসব করা মা তখন এমন কিছু জিনিস বিশ্বাস করে যার বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই।
প্রথমবার সন্তান প্রসবের পর প্রতিটা মহিলারই কিছুটা অস্বস্তি, দুর্বলতা, মানসিক চিন্তা কম-বেশি থাকে, যা অল্প সময়ে সেরে যায়৷ তবে Postpartum Psychosis ভয়াবহ জিনিস!
রোগটির সঠিক কারণ এখনও অজানা৷ তবে চিকিৎসাবিদদের মতে- সন্তান প্রসবের পর মাতৃদেহে বড় পরিবর্তন হয়, তখন কোনো আকস্মিক হরোমনীয় পরিবর্তনের কারণে এমন হতে পারে৷
চোখের কোণে জমে থাকা জলটা মুছে ডাক্তারকে বললাম– এই রোগের চিকিৎসা কি নেই?
ডাক্তার মুচকি হেসে বললেন- অবশ্যই আছে। আমরা আমদের যথাযথ চেষ্টা করবো।
২ মাস পর…
আজ আমার স্ত্রী সম্পূর্ণ সুস্থ। যে সন্তানকে আমার স্ত্রী মেরে ফেলতে চেয়েছিলো, সেই সন্তান একটু কান্না করলেই আমার স্ত্রী অস্থির হয়ে পড়ে। সারাক্ষণ বাচ্চাকেই নিয়ে পড়ে থাকে। পরম মমতায় বড় করছে আমাদের সন্তানকে…
সদ্য সন্তান জন্ম দেওয়া কোন মা যদি এমন অস্বাভাবিক আচরণ করে, তবে তাকে কোন ভন্ড কবিরাজ বা ফকির না দেখিয়ে ভালো কোন সাইক্রিয়াটিস্টের পরামর্শ নিন। কুসংস্কার বিশ্বাস করে স্ত্রী উপর অমানবিক অত্যাচার করবেন না—
( সমাপ্ত )
লেখা: আবুল বাশার পিয়াস