তনিমা। আমাদের সাথে একই ক্লাসে! টিভিতে অভিনয় করে ও। আয়ত চোখ দুটো আলাওলের পদ্মাবতীকে মনে করিয়ে দেয়। মাথায় রেশম কালো চুল। ঠোঁটে আলতো রঙের ছোঁয়া। এই মেয়ের জন্য অনায়াসে জীবন দেয়া যায়।
একটা সুযোগের অপেক্ষায় থাকি। চোখে পড়ার। সুযোগ আর আসে না। মনে ভাবি, তোমার চোখে কত ধুলো পড়ে! আমি কি তবে ধুলোরও যোগ্য নই!
অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! ওর জন্মদিনের অনুষ্ঠান করবে। ওদের বনানির বাসায়। যেতে হবে সবাইকে। আমি ওর একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি চাই। চোখ বড় করে মেয়েটা বলে, ছবি দিয়ে কি করবে? বললাম, লাগবে। দিলে ভাল হয়। ও বলল, তুমি চাইলে আমার বাসায় না ও আসতে পার। অত বাধ্যবাধকতা নাই।
কি কথার কি উত্তর! মানুষের সাথে কেমন করে কথা বলতে হয়- কেউ বুঝি শেখায়নি ওকে! পরের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ওর দিকে তাকিয়ে ছবির প্রয়োজন মেটালাম। এবার নো চিন্তা। এতেই কাজ হবে।
বিপত্তি বাধল ফাইনাল লিস্টের সময়। দাওয়াত দিয়েছে বলেই ত আর পুরো ক্লাস গিয়ে একটা বাসায় উঠতে পারে না! ঠিক হল পনের জন যাব। লিস্টে আমার জায়গা হল না। কিন্তু আমরা যেহেতু ডোন্ট মাইন্ড ফ্যামিলির পোলাপান- সমস্যা হল না একটুও। অনুষ্ঠানের দিন পনের জনের সাথে আমিও রওয়ানা দিলাম। সাথে একান্ত ব্যক্তিগত একটা গিফট।
পাঁচিল দেয়া আলিশান বাড়ি ওদের। সবুজ মাঠে সাদা খরগোশ দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের দেখে তনিমা দৌড়ে এল। সবাইকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল। আমাকেও কি?
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর চোয়াল শক্ত হল। তুই কেন এখানে? তোকে না বলেছি, না এলেও চলবে? পাশ থেকে দিয়া বলে উঠল, তুই তো আমাদের লিস্টে ছিলি না। তাও এসেছিস? আজব! তনিমা বলল, ওখানে স্ন্যাকস রাখা আছে। খেয়ে দূর হ। এসব ম্যানারলেস পোলাপান থাকলে অনুষ্ঠানটাই পণ্ড হয়ে যাবে।
তনিমা আর দিয়া চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হল। আমি অচল পয়সার মত জায়গায় পড়ে রইলাম। লুৎফর এসে ডাক দিল, ওখানে কি করছিস? এদিকে আয়। লুৎফরের কাঁধে ব্যাগ। আমার গিফট ওর ব্যাগে চালান করে বললাম, কাউকে না জানিয়ে ওর গিফটের সাথে এটা রেখে দিস। আমাকে এখনি জরুরি কাজে যেতে হচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে বনানি বাসস্ট্যান্ডে এলাম। সিনেমা হ'লে পরিচালক এখানে বৃষ্টির সিন রাখত, নিশ্চিত। আমার বুক ফেটে কান্না আসছে। অথচ কাঁদতে পারছি না। একটা গান মনে পড়ল, ভালবেসে আমি পাথরে ফোটাতে চেয়েছি ফুল- আমারই তো ভুল।
একটা বাস এসে সামনে থামল। মধুপুর। কিছু না ভেবেই উঠে বসলাম। কখন ঘুমিয়েছি, মনে নাই। যখন ঘুম ভাঙল বাস দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে অন্ধকার। পকেট হাতড়ে টের পাই, মানিব্যাগ উধাও।
বাস থেকে বেরিয়ে আশপাশে কাউকে পেলাম না। কেউ নেই কোথাও। হঠাৎ ভয় ধরল মনে, কিডন্যাপ হলাম না তো! এ সময় অন্ধকার ফুড়ে বেরিয়ে এল একজন।
-ঘুম ভাঙল? এমন মরার ঘুম কেউ ঘুমায়? এই নেন মানিব্যাগ। ভাড়ার একশ’ বিশ টাকা রেখে দিছি। - হাত বাড়িয়ে মানিব্যাগ নিলাম।
-রাতে কই থাকবেন?
-এইটা কোন জায়গা ভাই?
-মধুপুর।
-বাসস্ট্যান্ড কই?
-বাসস্টান্ডে সবাইরে নামায়া বাস নিয়া আসছি এইখানে। আপনারে কত ঠেললাম তখন।
উঠলেন না তো!
-বাসস্ট্যান্ড কতদূর এইখান থেকে?
-এক কিলো হবে। আপনে এক কাজ করেন রাইতটা আমার ঘরেই থাইকা যান। সকালে বাসস্ট্যান্ডে যাইয়েন।
মধুপুরে আনারস ক্ষেতে কাজ করে একটা মাস কাটিয়ে দিলাম। চেনা দুনিয়া তখন আমার কাছে এক অর্থহীন বাস্তবতা। সাফল্য, প্রতিপত্তি, জৌলুস সবই মনে হচ্ছিল এক গাঢ় প্রহেলিকার নাম। সে রাতে বাস কন্ডাক্টর দুলালের বাড়ি ছিলাম। সকালে উঠে আর স্ট্যান্ডে যেতে ইচ্ছে করল না। ওদের গ্রামের কিছু লোক তখন দল
বেঁধে যাচ্ছিল আনারস ক্ষেতে। আমিও সাথী হলাম।
দিনে হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর রাত নামার সাথে সাথে দুটো খেয়ে ঘুম। কোন কোন রাতে হ্যাজাক বা হারিকেন জ্বালিয়ে গানের আসর। এক আসরে গান ধরলাম। বুক চিরে বেরিয়ে আসা সুরে মথিত হল দিগন্ত। আমার বুকের মধ্যিখানে মন যেখানে হৃদয় সেখানে। তারপর থেকে খাতির যত্ন একটু বেশি পেতে শুরু করলাম। আমার ভাগের কাজটুকু অন্যরা করে দিতে চাইত প্রায়। আমি সমানে পাল্লা দিয়ে করার চেষ্টা করতাম। পারতাম না।
একদিন দুলাল খবর আনলো, পাশের গ্রামে মেলা বসেছে। গান আর নাচের আসরের সাথে আছে জুয়া আর মদের আসর। আমি চাইলে যেতে পারি। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। দুলালের বোন আম্বিয়া নিষেধ করল। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সন্ধ্যা হতেই
আমরা দু’জন দৌড়ে গেলাম মেলায়। দুলাল প্রথমেই আমাকে নিয়ে গেল, মদের আসরে। সেখানে কোমড় দুলিয়ে দুটো থার্ড ক্লাস নর্তকী নাচছে। ছ্যা! এগুলা দেখার মত নাচ! ওকে বললাম, গানের আসরে চল। এগুলো ভাল লাগছে না। ও বলল,
-একটু মদ খেয়ে নাও। তারপর গান শুনতে যাব।
-কিন্তু আমি তো মদ খাই না।
-মদ না খেলে হালকা হবে কিভাবে?
দুলালের বোন ওকে বলেছে, আমি অনেক কষ্ট পেয়ে বাড়ি পালিয়েছি। দুলাল বলেছিল, হয়ত খুন করে পালিয়েছি। আম্বিয়া বাজী ধরে বলেছে, ছ্যাকা খেয়েই পালিয়েছি আমি। দুলাল আমাকে মদ খাইয়ে মনের কথা শুনতে চায়। এতদিন চেষ্টা করেও পারেনি। আজ যদি মেলার উসিলায় সেটা হয়! কিন্তু আপনারাই বলেন, আমার সাথে যা ঘটেছে তা কি কাউকে বলবার মত কথা!
পরদিন কাজ থেকে ফিরে দেখি দুলালের বাসায় এক মেম বসে আছে। প্রথমে চিনতে পারলাম না। লুৎফরকে দেখে চিনলাম। তনিমা তুমি?
সেদিন সবার অগোচরে লুৎফর আমার গিফটটা তনিমার জন্মদিনে পাওয়া অন্যান্য গিফটের মধ্যে রেখে দিয়েছিল। সবাই যখন ডিনারে বসেছে, কি মনে করে গিফটগুলো খুলে খুলে দেখতে শুরু করল তনিমা। দেখতে দেখতে একটা গিফট দেখে চমকে উঠল। কেউ একজন ওর ছবি এঁকেছে। গ্রামীণ পটে আঁকা পৃথিবীর বয়সিনী এক নারীর ছবি। ছবির নীচে ক্যাপশন দেয়া-
সুরঞ্জনা ! আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছো, পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মত। কালো চোখ মেলে ওই নিলীমা দেখেছ। গ্রীক হিন্দু ফিনিসীয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন শুনেছ ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা
নগরীর গায়ে।- জীবনানন্দ দাশ।
গিফটটা তার এতই পছন্দ হয়েছে যে, সেটা সবাইকে দেখালো। তারপর জানতে চাইলো, কে এনেছে এই গিফট। কিন্তু কেউ স্বীকার করল না। এমনকি লুৎফরও। কারণ ও তো আর আমার গিফট খুলে দেখেনি। যখন কেউ স্বীকার করল না- লুৎফর বলল, দিপ্র আমাকে একটা গিফট দিয়ে বলেছিল, কাউকে না জানিয়ে অন্যান্য গিফটের মধ্যে রেখে দিতে। কিন্তু আমি নিশ্চিত না এটা ওর গিফট কিনা। অবশেষে সবার গিফটের লিস্ট করে ওরা নিশ্চিত হল, এটা আমারই গিফট।
দিন দুয়েক বাদে তনিমা ক্লাসে দাঁড়িয়ে আমার কাছে মাফ চাইল। আমাকে অপমানের জন্য নিজেকে ধিক্কার দিল। আমার আঁকা ছবিটা ওর জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার হিসেবে উল্লেখ করল। কিন্তু আমি কোথায়? আমি তো ক্লাসে নেই। শুরু হল খোঁজ!
জানা গেল, ওই দিনের পর আমাকে আর হলে দেখা যায়নি। তনিমাদের বাড়ির গার্ডের ছেলে জানালো, আমাকে এষা পরিবহণে উঠতে দেখেছে। গাড়িটি যাচ্ছিল, মধুপুর। এষা পরিবহণের প্রত্যেকটা বাসের সাথে কথা বলতে বলতে অবশেষে আবিষ্কার করেছে, আমার এই নিভৃতবাস!
তনিমা! আয়ত চোখের সেই অনিন্দ্য সুন্দরী! আমার সামনে এখন চুপ করে বসে আছে। চোখ গড়িয়ে নেমে আসছে অশ্রু। আমি লুৎফরের মুখের দিকে তাকাই। লুৎফর বলে, হলে চল দোস্ত! এই জীবন তোর জন্য না। কিন্তু লুৎফর কি জানে কার হৃদয়ের তন্ত্রী কোন সুরে জেগে ওঠে? আমার কাছে এখন আম্বিয়া আর তনিমার কোন ভেদ নেই। ভেদ নেই প্রাসাদ আর বটতলার। আমার কাছে এখন জীবন এক বহতা নদীর নাম।
বয়ে চলাই যার ধর্ম। এর বুকে নৌকা ভাসল নাকি জাহাজ ভাসল নাকি নিঃসীম শূন্যতা ঝুলে থাকল তাতে নদীর কি এসে যায়!
এক চোখ অশ্রু নিয়ে তনিমা ফিরে যাচ্ছে। চৌকাঠের ওপাড়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আম্বিয়া। ও কি ভাবছে আমি ওর প্রেমে মজে থেকে যাচ্ছি? হায়রে মানুষ! এত সহজেই অন্যকে বিচার করা যায়?
সূর্যটা গাঢ় হতে হতে টুপ করে জঙ্গলের ওপাশে হারিয়ে
গেল। আমি এক পোশাকে দুলালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।
( সমাপ্ত )
লেখক: দিপ্র হাসান