আমার বড় বোনের নাম শম্পা।শম্পা আপুর বিয়ে হয়েছিল খুব ভালো ঘরে। ওখানে ছ'বছর সংসারও করেছে। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। আপুর এই ছ' বছরের বৈবাহিক জীবনে কোন সন্তান- সন্ততি হলো না।ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে অবশ্য দুলাভাই ভুল করেনি। কিন্তু ডাক্তার বলেছে আপুর সমস্যা আছে।তার সন্তান হবে না কখনো। শেষ মেষ একটা করুন কাহিনী ঘটেছে। আমার নম্র ভদ্র দুলাভাই তার মায়ের প্ররোচনায় একদিন আমার বোনকে তার বাড়ি থেকেই তাড়িয়ে দিয়েছে।আপু নাকি অপয়া এবং অলক্ষ্মী। তাকে ওই বাড়িতে রাখলে নাকি বাড়ির অমঙ্গল হবে। তাছাড়া দুলাভাই আরেকটা বিয়ে করবে। তার সন্তান প্রয়োজন। সুতরাং ওখানে উটকো ঝামেলা হিসেবে আপুকে রাখার কোন প্রশ্নই আসে না!
শেষমেষ বাবাকে খবর দিয়ে নিলো আপুর শাশুড়ি। তারপর এক রকম অপমান করেই বাবার সাথে আপুকে দিয়ে দিলো।বাবা ওখান থেকে যে দুঃখ পেয়ে এসেছেন তা তাকে কাবু করে বসে। এবং তিনদিন পর স্ট্রোক করে এই জগতের মায়া ত্যাগ করেন তিনি!
এরপর থেকে আমি আপু আর মায়ের সংসার। খুব ভালো যাচ্ছিলো আমাদের দিনগুলো।আমরা সব সময় হাসি খুশি এবং আনন্দে রাখতাম আপুকে।কষ্টের কথা তাকে কিছুতেই মনে করতে দিতাম না। কিন্তু সমস্যাটা বাঁধলো আমার বিয়ের পর। বিয়ের পর প্রথম এক বছর আমার স্ত্রী ভূবন আপুর সাথে খুব ভালো আচরণ করতো। কিন্তু যখনই ওর গর্ভে সন্তান এলো তখন থেকেই দেখলাম ওর আচরণ বদলে যেতে। আপুর সাথে সে কথাই বলে না। আপুর হাত থেকে কিছু খেতে চায় না। একদিন আপু এক বাটি আচার নিয়ে গিয়ে বললো,'ভূবন, তোমার জন্য আচার এনেছি।খাও।'
আমার স্ত্রী ভূবন সেই আচারের বাটি জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে বললো,'আর কখনোই আপনি আমার কাছে আসার সাহস করবেন না! আমাকে কিছু খেতেও দিবেন না বলছি!'
মা দৌড়ে এসে বললো,'কী হয়েছে বউ?কী সমস্যা?'
ভূবন বললো,'আপনার মেয়েকে আমার কাছে আসতে নিষেধ করবেন।মা বলেছে যেসব মেয়ের বাচ্ছা হয় না তারা যদি প্রেগন্যান্ট মেয়েদের কাছে আসে, কিছু খেতে দেয় তবে নাকি প্রেগ্নেন্সি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে!'
ওর মুখ থেকে এসব কথা শোনে আপু আর মা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো।
সে রাতে ঘরে ফিরতেই মা আমার কাছে সব খুলে বললো।শুনে আমি রাগান্বিত হয়েছি। কিন্তু আমি জানি রাগ নিয়ে ভূবনকে কিছু বললে এর ফল শূন্যই হবে। ওকে বুঝাতে হবে কোমল ভাবে। নয়তো সে অনুভব করতে পারবে না।
সেদিন আমি আর নিজ থেকে কিছু বললাম না। বরং ভূবন নিজেই আমার কাছে বললো,'শুনুন,মা বলেছে এই কদিন আপুর থেকে দূরে থাকতে। তার হাতের কিছু না খেতে। এই সময় নাকি একটু সেইফে থাকতে হয়!'
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসার চেষ্টা করে বললাম,'কেন দূরে থাকতে হয়?কেন ওর হাতের কিছু খাওয়া যাবে না?'
'আপু যে বাজা! সন্তানহীন! এই জন্য!মা বলেছে।'
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,'কুরান হাদিসে এসব আছে?'
ভূবন বললো,'আমি তো পড়িনি।জানি না। থাকতে পারে। নয়তো মা বললো কেন?'
আমি হাসলাম। হেসে বললাম,'এসব কুসংস্কার। বিশ্বাস করলেও পাপ হবে। এখন থেকে আপুর কাছে যাবে।সে যা দেয় তা খাবে। সন্তান সুষ্ঠু ভাবে জন্ম দানের মালিক আল্লাহ!আর আপুকে তুমি বাজা বলতে পারো না।আমি আপুকে আবার বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবো।দেখো আপু ঠিক সন্তানের মা হবে।'
এরপর থেকে ভূবন আপুর সাথে আর খারাপ আচরণ করেনি। এবং সবচেয়ে সুন্দর ব্যপার হলো আপুর কাছে ভূবন সব সময় যাওয়া আসা করা এবং তার হাতের খাবার গ্রহণ করা সত্ত্বেও তার ঘর থেকে একটি সুস্থ সবল শিশুই জন্ম গ্রহণ করেছে। এরপর তাকে আমি বললাম,'ভূবন, বলেছিলাম এসব কুসংস্কার?'
ভূবন সেদিন খুব লজ্জিত হয়েছিল। এবং আপুর কাছে হাত ধরে মাফ চেয়েছিল।
'
আপুকে বিয়ে দেয়ার জন্য মনে মনে একজন পাত্র খুঁজছিলাম আমি। কিন্তু পাত্র কিছুতেই যেন মিলছিলো না।একে তো আপু সন্তানহীনতার অভিযোগে স্বামীর কাছ থেকে তালাকপ্রাপ্তা হয়েছে। দ্বিতীয় হলো তার বয়স ত্রিশ পেরিয়ে পয়ত্রিশের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে। এমন মেয়েকে কে বা যেচে বিয়ে করতে চায়!
কিন্তু আল্লার কী অসীম কৃপা! একদিন বিকেল বেলা শহরের এক হুজুর এলেন আমাদের ঘরে।তার পরনে লম্বা জুহ্বা। মাথায় সাদা পাগড়ি। চেহারা উজ্জ্বল ফর্সা। বয়সে নিতান্তই যুবক। তাকে সাথে নিয়ে এসেছেন আমাদের গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব।
তাদেরকে বসতে দেয়া হলো।চা শরবত দেয়া হলো।এক পর্যায়ে ইমাম সাহেব শহুরে হুজুরকে দেখিয়ে বললেন,'বাবা মাহমুদ,ইনি হলেন ডাক্তার ফররুখ মিসবাহ। শিশু বিশেষজ্ঞ।'
ইমাম সাহেবকে আর বলতে হলো না।আমি বললাম,'উনার নাম কতো শুনেছি। ময়মনসিংহ বিভাগে উনার চেয়ে শিশু বিশেষজ্ঞ বড় ডাক্তার আর কেউ নাই!'
ইমাম সাহেব গাঢ় হাসলেন। তারপর বললেন,'ডাক্তার সাহেব কীভাবে যেন তোমার বোনের বিষয়ে শুনেছেন। তারপর খোঁজ খবর নিয়ে এখানে এসেছেন। আমার সাথে কথা বলেছেন।উনি এখনও অবিবাহিত। ভালো মেয়ে খুঁজছিলেন। কিন্তু কার কাছে যখন শুনলেন তোমার বোনের বিষয়ে যে সন্তান হয়নি বলে তাকে তালাক দেয়া হয়েছে এবং আর কোথাও তার বিয়েও হচ্ছে না এটা শোনার পর থেকেই নাকি তিনি অনেক চিন্তা ভাবনা করেছেন।উনি তার মায়ের সাথে পরামর্শ করেছেন। পরামর্শ করে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শম্পার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবেন। এসেছেনও তিনি। এখন তোমাদের যদি কোন অমত না থাকে তবে আলহামদুলিল্লাহ!'
আমি সবকিছু শোনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। কোন কথা বলতে পারছিলাম না।বোকার মতো আমি গিয়ে ডাক্তার ফররুখ মিসবাহের হাত ধরে কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম,'আপনি আমার বোনের এতো বড় উপকার করবেন! আপনি মহান মানুষ!মহৎ মানুষ!'
ডাক্তার ফররুখ মিসবাহ আমায় তার বুকে জড়িয়ে নিলেন। তারপর বললেন,'আমাদের নবীজি সাঃ এর বেশিরভাগ স্ত্রীগণই ছিলেন বিধবা এবং সমস্যাগ্রস্থ । তাদেরকে তিনি বিয়ে করে আমাদের শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন। তাছাড়া আমি এটা কখনোই বিশ্বাস করি না যে সন্তানহীনতার জন্য শুধুমাত্র আপনার বোন দায়ী। সন্তান দানের মালিক মহান আল্লাহ। তিনি হযরত ইব্রাহীম আঃ এর স্ত্রীকে শেষ বয়সে সন্তান দান করেছিলেন। সুতরাং যে আল্লাহ ইব্রাহিম আঃ এবং তার স্ত্রীকে শেষ বয়সে সন্তান দান করতে পারেন সেই আল্লাহ অবশ্যই আপনার পয়ত্রিশ বছর বয়সী বোনকে সন্তান দান করতে পারেন।আর যদি তার ইচ্ছে না হয় তবে সন্তান দিবেন না। সন্তান না হলেই একটা সংসার ভেঙ্গে দিতে হবে?'
শম্পা আপুর বিয়ের কোন রকম সম্ভাবনাই ছিল না।পাড়া প্রতিবেশীরাও বলতো কোনদিন তার বিয়ে হবে না। কিন্তু শেষমেষ তার এমন ছেলের কাছে বিয়ে হলো যে কি না ময়মনসিংহ বিভাগের সবচেয়ে বড় নামকরা ডাক্তারদের একজন। এবং এরচেয়ে আশ্চর্য জনক বিষয় হলো বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই আমরা খুশির সংবাদ শুনলাম।আপু কনসিভ করেছে।সবাই শুনে অবাক। আনন্দে আত্মহারা। সময় পেরিয়ে আপু একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানও জন্ম দিয়েছে।
আমরা সবাই আপুদের বাসায় গিয়েছি।আপুর আজ বড় আনন্দের দিন। আমাদের দেখে আপু কাঁদতে শুরু করলো। এই কান্না দুঃখের নয়। আনন্দের। এই সময় দুলাভাইও এখানে এসে উপস্থিত হলো। এবং আমায় উদ্দেশ্য করে বললো,'কী মাহমুদ, বলেছিলাম না যে আল্লাহ ইব্রাহিম আঃ কে বৃদ্ধ বয়সে সন্তান দান করতে পারে সেই আল্লাহ তোমার পয়ত্রিশ বছর বয়সী বোনকেও সন্তান দান করতে পারেন?'
আমি দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। হাসতে গিয়ে আমি টের পেলাম আমার চোখ ভিজে উঠেছে জলে।
সে রাতে আবার ভূবনের সাথে কথা হলো আমার। ভূবন আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,'মাহমুদ, আল্লাহর রহস্য বোঝা সত্যিই দায়!'
'
( সমাপ্ত )
লেখা: অনন্য শফিক