আজ আমার বিয়ে। ফেসবুকে আংকেল বলে সম্বোধন করা লোকটার সাথে আমার বিয়ে। শয্যাশায়ী স্ত্রীর জন্য একজন পরিচারিকা তার ভীষণ প্রয়োজন অথবা ছেলে মেয়ে দুটির বিকল্প মায়ের প্রয়োজন।
গর্ভধারিণী উপন্যাসে পড়েছিলাম, সুদীপের বাবা মাসে মাসে গৃহ পরিচারিকা বদলায়, আমার গল্পটাও সেরকমই। এই লোকটি সামাজিকতার ভয়ে গৃহ পরিচারিকার ঘরে ঢুকতে না পারলেও কখনো বা নিজের প্রয়োজনে আমার ঘরে ঢুকে গেলেও আমি না করবো না কারণ আমি তার বিবাহিতা স্ত্রী হতে চলছি আর কিছুক্ষণ পর।
আমি আয়নার সামনে বসে আছি। চোখ ছলছল করছে, কাজল লেপ্টে গেছে সেই কখন। আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে আমার মা, চোখ দুটি কী সুন্দর লাগছে দেখতে। কষ্টের সাথে কি কিছু আনন্দ আছে আজ? হয়তো আছে, আজ আমার মায়ের মুক্তি হচ্ছে অনেক কিছু থেকেই। আমি বেশিক্ষণ মায়ের দিকে না তাকিয়ে নিজের সাজের দিকে মনোযোগ দিলাম।
শফিক সাহেব পাশের ঘরে বসে আছেন। ভদ্র লোকের মাথার চুলে কিছুটা পাক ধরেছে, মুখের চামড়াতেও বয়সের ছাপ বেশ বুঝা যায়। উনার সাথে উনার ছেলে মেয়েও এসেছে। ছেলের বয়স বারো এবং মেয়েটির আট বছর। মেয়েটির বয়স যখন চার শফিক সাহেবের স্ত্রী তখন থেকেই শয্যাশায়ী। মেয়েটি একটু আগে এ ঘরে এসেছিলো বেশ অবাক হয়ে আমার শাড়ি পরা দেখছিলো। আচ্ছা, বিয়ের পর এরা আমাকে কী বলে ডাকবে? ছোট মা ডাকবে হয়তো।
আমার ভাইয়া আজ সারাদিন একবারো আমার আমার সামনে আসেনি। সময় পায়নি বলে অথবা লজ্জায় আসেনি। ভাইয়ার চোখে কি আনন্দ আছে আসলে একবার দেখতে পারতাম। আমার চোখে কি আনন্দ দেখা যাচ্ছে? আম্মাকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারতো হয়তো, থাক ইচ্ছে হচ্ছে না।
বিয়ের পর শফিক আংকেলকে কি আংকেল ডাকবো নাকি অন্যকিছু? উনাকেই জিজ্ঞেস করে নিবো।
আম্মা কান্না করছে, আমি আয়নায় তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আমি আম্মাকে থামাবো না, কাঁদতে থাকুক যতোটা পারুক। বাবা মায়ের বিচ্ছেদের দিনের কথা আমার মনে আছে। নয় বছর বয়সী আমি কোর্টের সামনের বারান্দায় দৌড়াচ্ছিলাম। মা বাবা একসাথেই বের হয়ে এলেন। আমি যখন মায়ের সাথে চলে আসছিলাম, তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম- "আব্বু যাবে না?" বেশ সহজ কণ্ঠেই আম্মা বলেছিলো- "তোমার আব্বু নতুন বিয়ে করেছে সেখানেই থাকবে এখন থেকে, আর আমি তোমাদের সাথে, আজ থেকে আমিই তোমাদের মা আর আমিই বাবা।"
একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে শুনি আম্মা স্ট্রোক করেছে, রাস্তায় পড়ে ছিলো, কয়েকজন পথচারী তাকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। তখন কেবল দশম শ্রেণীতে পড়ি। আমার ভাই বয়সে বড় হলেও আমরা ছিলাম সহপাঠী। ভাইয়া সেদিন আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলেছিলো, " বোন, আমি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে হলেও তোকে পড়াবো, তোর জন্য আমি সবকিছু করতে পারবো, দোকানে কাজ করবো, রিক্সা চালাবো, যা পারি তবুও তুই পড়বি।" তখন থেকে ভাইয়াকে দেখতাম এই বাড়ি ঐ বাড়ি ঘুরে ছাত্র পড়াতে। ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে এসে আমার সাথে তার অনেক গল্প করার ছিলো। আমি তখনও ভালো রান্না পারি না, কিন্তু আমার রান্নাই যেন ভাইয়ার কাছে ছিলো অমৃত।
আমার মা সেই বছর থেকেই বিছানা নিলেন, তবুও আমার বাবার কাছে খরচের জন্য হাত পাতেনি কখনো। ভাইয়া লেখাপড়াটা চালিয়ে গেলো সবকিছুর মাঝেই। মাস শেষে কষ্টের পারশ্রমিকের সিংহভাগটা আমার খরচের জন্য পাঠিয়ে দিতো। বারবার বলতো তোকে পড়তে হবে, ভালো ফলাফল করতে হবে, অনেক কিছু করতে হবে। যেন আমার সাফল্যটাই ভাইয়ার সাফল্য।
বন্ধু মহলে আমি কৃপণ হিসেবে পরিচিত। সবাই যখন কাউকে দান করার জন্য পকেট থেকে একটা মোটা অংকের টাকা বের করে ফেলে তখন আমার সামান্য টাকাটা বের করতেও লজ্জায় পড়ে যাই বলে আর করা হইনা। সারাদেশে যখন করোনা মহামারী, বন্ধুরা যখন সাহায্যের যখন বিকাশ, রকেট নাম্বার শেয়ার করে তখনো আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। কিন্তু আমি তো বলতে পারি না, আজ তিন মাস ধরে আমার ভাইয়ার কোন টিউশন নেই, আমার তিন মাসে মেস ভাড়া জমা হয়ে আছে কতো, টাকার জন্য মায়ের ওষুধ কেনা হচ্ছে না, আমাদের ঘরে বাজার নেই, আমার লেখাপড়াটাও যে আর চলবে না একটা সময়ের পর। আমার কথাটা শোনার জন্য কেউ নেই, কোথাও নেই।
সৌরভের সাথে চার বছরের সম্পর্কটাও শেষ করে দিতে হলো কিছুদিন আগে। যার জন্য বুকের ভেতর আজন্ম ভালোবাসা পুষেছিলাম তার কাছেও আশ্রয় খুঁজেছিলাম। ঠোঁটের স্বাদ আর বুকের মাংসের গন্ধ ছাড়া সৌরভ কিছুই বুঝেনি, প্রেম তো নয়ই।
আশ্রয় পেলাম একজন মাঝবয়েসী মানুষের কাছে। মন্দ নয় তো সে। তার যতোটুকু প্রয়োজন আমি ততোটুকু পূরণ করতে পারবো, আমার প্রয়োজনটাও সে পারবে। প্রয়োজনের জন্য একটি সম্পর্কে আবদ্ধ হতে আর কিছু সময় বাকি।
লকডাউন শেষে আমার মা মুক্তি পাবে, ভাইয়ের মুক্তি হবে। আমার জন্য বাড়তি কিছুই করতে হবে না। বন্ধুদের সাথে আড্ডার পর চায়ের বিলটা দিতে পারবো, কিংবা কোন দামী রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে পারবো। ভালো পোশাকের জন্য ভার্সিটির আর কোন প্রোগ্রাম মিস হবে না আমার, যেকোন আর্থিক সাহায্য করতে পারবো।
আমি লেপ্টে যাওয়া চোখের কাজলটা ঠিক করে নিলাম। আয়নায় নিজেকে দেখতে বেশ মোহনীয় লাগছে।
( সমাপ্ত )
Writer: Esrat Emu